শুক্রের পরিক্রমণ ও সৌরজগতের পরিমাপ নির্ণয়
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাস আমরা অনেকেই কম বেশি জানি। শুধু ভারত নয়, সুমের, মিশর, চিন বা গ্রিসও প্রাচীন যুগে জ্যোতির্বিদ্যার উপর গুরুত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে গ্রহদের গতিবিধি সংক্রান্ত কেপলারের সূত্র আবিষ্কার ও গ্যালিলিও কর্তৃক দূরবিনের সাহায্যে আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু হওয়ার পরে জ্যোতির্বিদ্যার আমূল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে দূরবিনের সাহায্যে যে ধরনের নিখুঁত পর্যবেক্ষণ সম্ভব, তা আগে চিন্তাই করা যেত না। এর ফলে জ্যোতির্বিদ্যাতে পরিমাপের উপর গুরুত্ব আসে।
অনেক সভ্যতাই আকাশে জ্যোতিষ্কদের অবস্থান, সূর্য চন্দ্র গ্রহদের চলার পথ ইত্যাদি নিয়ে চিন্তাভাবনা করলেও প্রাচীন গ্রিকরাই সম্ভবত একমাত্র যারা দূরত্ব, আয়তন ইত্যাদি নির্ণয় করার চেষ্টা করত। পরবর্তীকালে এরাটোস্থেনেস প্রথম বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পৃথিবীর পরিধি মেপেছিলেন, তাঁর মাপে ভুল ছিল সম্ভবত পাঁচ শতাংশেরও কম। প্রাচীন যুগের সব থেকে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ হলেন হিপ্পার্কাস। তিনি সূর্যগ্রহণের সময় দুই বিভিন্ন স্থানে সূর্য কতটা ঢাকা পড়েছিল তা বিচার করে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব নির্ণয় করেছিলেন। তিনি হিসাব করে বলেছিলেন যে পৃথিবী ও চাঁদের দূরত্ব পৃথিবীর ব্যাসার্ধের 71 থেকে 83 গুণের মধ্যে থাকে। আসল মাপটা হল 60 থেকে 64-র মধ্যে। প্রাচীন যুগের পর্যবেক্ষণে এর থেকে ভালো মাপ পাওয়া সম্ভব ছিল না। অ্যারিস্টার্কাস মেপে পেয়েছিলেন সূর্য চাঁদের থেকে কুড়ি গুণ বেশি দূরত্বে আছে, আসলে তা হবে প্রায় চারশো গুণ। এরাটোস্থেনেস মেপে বলেছিলেন সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর 27 গুণ, আসলে তা হল 109 গুণ।
দূরবিন আবিষ্কারের পরে বিশেষ করে জ্যোতিষ্কদের কৌণিক অবস্থানের মাপে অনেক উন্নতি ঘটল। একই সঙ্গে সময় মাপার জন্য যান্ত্রিক ঘড়ি ব্যবহার করা শুরু হল। তার ফলে মাপ অনেক বেশি নির্ভুল হত। তা সত্ত্বেও নিউটন যখন কেপলারের সূত্র ব্যবহার করে শেষ পর্যন্ত সার্বজনীন মাধ্যাকর্ষণের সূত্রে পৌঁছান, তিনি কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের ধ্রুবক নির্ণয় করতে পারেন নি, কারণ সূর্য বা সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহের দূরত্ব ও ভর সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ছিল নিতান্তই সীমিত। প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকাতে নিউটন বিভিন্ন গ্রহের ও সূর্যের ভরের অনুপাত নির্ণয় করেছিলেন, কিন্তু প্রকৃত ভর বা দূরত্ব জানা ছিল না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে সমস্ত দূরত্বের অনুপাত পরিবর্তন করে সৌরজগতের আয়তনকে দুগুণ বাড়িয়ে দিলে বা অর্ধেক করে দিলেন তা কেপলার বা নিউটনের সূত্রে ধরা পড়বে না। এটাকে বিজ্ঞানের ভাষাতে বলে স্কেলের সমস্যা।
সৌরজগতের জ্যোতিষ্কদের দূরত্ব বা ব্যাস মাপার জন্য প্রাচীন গ্রিকরা লম্বন পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল, তা ছিল জ্যামিতির বা ত্রিকোণমিতির পদ্ধতি। বিংশ শতাব্দীতে রাডার আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত আমরা ওই একই ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলাম। একটা খুব সহজ উদাহরণ নেওয়া যাক। আজও আমরা আমাদের খুব কাছের কোনো নক্ষত্রের দূরত্ব মাপার জন্য ছয় মাস আগে পরে পৃথিবীর দুই অবস্থান থেকে সেই নক্ষত্রের অবস্থান মাপি। অনেক দূরের নক্ষত্রদের সাপেক্ষে কাছের নক্ষত্রটা জায়গা পাল্টায়, তার কৌণিক অবস্থানের যে পরিবর্তন ঘটে, তাকে বলে প্যারালাক্স বা লম্বন। ছ'মাস আগে পরে পৃথিবীর অবস্থানের পার্থক্য এবং লম্বন কোণের মান থেকে ওই নক্ষত্রের দূরত্ব বার করা হয়। এর জন্য সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্ব দরকার, অষ্টাদশ শতকের প্রথম অর্ধে তা ভালোভাবে জানা ছিল না।
লম্বন পদ্ধতিতে মঙ্গলের দূরত্ব প্রথম মেপেছিলেন প্যারি মানমন্দিরের বিজ্ঞানী জাঁ পিকার্ড ও জিওভান্নি ক্যাসিনি। প্রথমেই অবশ্য সূর্যের দূরত্ব মাপার কথা আসে, অন্য তারাদের তুলনায় সূর্য পৃথিবীর খুবই কাছে, তাই তার দূরত্ব মাপার জন্য ছ’মাস অপেক্ষা করার দরকার পড়ে না। পৃথিবীতেই দুই আলাদা জায়গা থেকে লম্বন নির্ণয় করা যায়। কিন্তু সূর্য আমাদের চোখে অনেক বড়, দুই জায়গা থেকে তার উপর ঠিক কোন বিন্দুর কৌণিক অবস্থান মাপা হবে তা ঠিক করা যাচ্ছিল না। যেমন কেপলার মেপে যা পেয়েছিলেন, লম্বনের প্রকৃত মান হল তার বারো ভাগের এক ভাগ।
গ্রহরা অনেক ছোট, তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই। প্যারি এবং ফ্রান্সের উপনিবেশ দক্ষিণ আমেরিকার ফ্রেঞ্চ গায়নার দুরত্ব জানাই ছিল; সেই দুই জায়গা থেকে মঙ্গল যখন পৃথিবীর সব থেকে কাছে এসেছিল সেই সময়ে মঙ্গলের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা মঙ্গলের দূরত্ব নির্ণয় করেছিলেন। সেটা ছিল 1671 সাল। মনে রাখতে হবে যে লম্বনের মান একই সময় বার করতে হবে, কারণ পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্য দুই অবস্থানই জায়গা পরিবর্তন করে। কিন্তু ফরাসি গায়না ও প্যারিতে পেন্ডুলাম ঘড়ি একই সময় দেয় না, কারণ দুই জায়গার অক্ষাংশ আলাদা। সেটা অবশ্য তখন বোঝা যায়নি, তার কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন নিউটন 1687 সালে প্রিন্সিপিয়াতে। কেপলারের সূত্র ব্যবহার করে একবার কোনো একটা গ্রহের দূরত্ব মাপতে পারলেই আমরা সৌরজগতের বাকি সমস্ত দূরত্ব নির্ণয় করা গিয়েছিল। ক্যাসিনিদের মাপ থেকে সূর্যের দূরত্ব পাওয়া যাচ্ছিল 14 কোটি কিলোমিটার, কিন্তু সময় নির্ণয় সহ বিভিন্ন কারণে তাতে বেশ কিছু সমস্যা ছিল। আধুনিক কালে আমরা জানি তাঁদের মাপে সাত শতাংশ ভুল ছিল। তাই সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্ব নির্ণয় করার জন্য শুক্রের পরিক্রমণকে ব্যবহার করার কথা ভেবেছিলেন বিজ্ঞানীরা।
শুক্র গ্রহ যখন সুর্য আর পৃথিবীর ঠিক মাঝখানে আসে, সেই ঘটনাকে বলে শুক্রের পরিক্রমণ বা ট্রানসিট। তখন সূর্যের উজ্জ্বল পটভূমিতে আমরা তাদের একটা কালো ছোট চাকতির মতো দেখতে পাই। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে দেখলে সূর্যের পটভূমিতে তাকে আমরা আলাদা জায়গায় দেখব। সেই সমস্ত জায়গার দূরত্ব জানা থাকলে গ্রহের অবস্থানের কৌণিক পার্থক্য বা লম্বন কোণ থেকে ঐ গ্রহটার দূরত্ব নির্ণয় সম্ভব। নক্ষত্রদের ক্ষেত্রের তুলনায় অবশ্য এই পদ্ধতিতে সামান্য একটা সমস্যা আছে। আমাদের পদ্ধতিতে দূরের নক্ষত্ররা অসীম দূরত্বে আছে বলে ধরে নিলে কোনো ভুল হয় না, তাই তাদের সাপেক্ষে লম্বন কোণ মাপা সহজ।
পৃথিবী থেকে সূর্য ও শুক্রের দূরত্ব তুলনীয়, তাই পৃথিবীতে বিভিন্ন অবস্থান থেকে শুক্রকে যেমন আলাদা কোণে দেখব, সূর্যকেও আলাদা কোণে দেখব। কিন্তু তার সমাধান করা খুব সোজা, কারণ দূরত্বগুলো না জানলেও নিউটন ও কেপলারের গবেষণা থেকে আমরা তাদের অনুপাতটা জানি। নিচের ছবিটাতে শুক্রের পরিক্রমণের সময় কেমনভাবে দূরত্ব মাপা সম্ভব তা দেখানো হয়েছে। A ও B অবস্থান থেকে শুক্রকে সুর্যের উপরে A' ও B' বিন্দুতে দেখা যাবে। আমরা AB দূরত্ব জানি, VA/VA' অনুপাত কেপলারের সূত্র থেকে জানা আছে, সুতরাং V বিন্দুতে উৎপন্ন কোণ মাপতে পারলেই আমরা শুক্র পৃথিবীর দূরত্ব VT, শুক্র সূর্যের দূরত্ব VS, সূর্য পৃথিবীর দূরত্ব ST জেনে নিতে পারব।
শুক্রের পরিক্রমণের সময় তার অবস্থান থেকে দূরত্ব মাপার কথা প্রথম বলেছিলেন জেমস গ্রেগরি। বিখ্যাত ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ এডমন্ড হ্যালি বিষয়টি বিজ্ঞানীদের নজরে এনেছিলেন। হ্যালি 1742 সালে পঁচাশি বছর বয়সে মারা যান। তিনি জানতেন যে শুক্রের পরিক্রমণ দেখার সুযোগ তাঁর হবে না, তা ঘটবে 1761 সালের 6 জুন। সূর্যের উপর কোন বিন্দুকে আলদা করে চেনা শক্ত, তাই কৌণিক অবস্থান নির্ণয়ে ভুল থেকে যেতে পারে। হ্যালি দেখান যে যদি বিভিন্ন জায়গা থেকে শুক্রের পরিক্রমণ ঠিক কতক্ষণ ধরে হচ্ছে তা মাপা যায়, তাহলে সেই ত্রুটি এড়ানো সম্ভব। নিচের ছবিতে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। এখানে দুই পর্যবেক্ষক কোন পথে শুক্রকে যেতে দেখবেন তা দেখানো হয়েছে। দুই পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে শুক্রের বেগ সমান, তাই পরিক্রমণের সময় থেকে শুক্রের কৌণিক অবস্থানের পার্থক্য অর্থাৎ আগের ছবিতে V বিন্দুতে উৎপন্ন কোণ নির্ণয় করা সম্ভব।
সেই সময় বিশেষ করে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সারা পৃথিবীতে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, সেই সুযোগ নিয়ে পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে পরিক্রমণ দেখার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই অর্থে এটিকে প্রথম আন্তর্জাতিক স্তরে বৃহৎ বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের নিদর্শন বলা যায়। মোট 122টি জায়গা থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। তার মধ্যে আমাদের দেশও ছিল।
সেই সময় আবার ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, ফলে অনেক বিজ্ঞানী সমস্যার মধ্যে পড়েছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে সুমাত্রাতে পাঠানো এক জাহাজের উপর ফ্রান্সের আক্রমণে বেশ কয়েকজন নাবিক প্রাণ হারান, এবং জাহাজ লন্ডনে ফিরে আসে। পরে অভিযানটি আবার রওনা হয়েছিল। এর নেতৃত্বে ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী চার্লস ম্যাসন ও জরিপদার জেরেমিয়া ডিক্সন। পরবর্তীকালে এই দুজন মার্কিন যুক্তরাষ্টের মেরিল্যান্ড ও পেনসিলভেনিয়ার মধ্যের সীমানা নির্দেশ করবেন যা ম্যাসন-ডিক্সন লাইন নামে পরিচিত। যাত্রা শুরুর কয়েকদিন পরেই তাঁরা বুঝতে পারেন যে সময়মতো সুমাত্রা পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাঁরা তখন দক্ষিণ আফ্রিকার ডাচ অধিকৃত কেপটাউনে যাত্রা শেষ করেন। নিরপেক্ষ ডাচদের সহায়তাতে সেখান থেকেই তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। লে জেন্টিল নামের এক ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী পন্ডিচেরি থেকে পরিক্রমণ দেখবেন বলে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু ফরাসি অধিকৃত মরিশাসে পৌঁছে তিনি শোনেন যে ব্রিটিশরা পন্ডিচেরি অবরোধ করেছে। অবরোধ ভাঙার জন্য যে জাহাজ পাঠানো হয়, তিনি সেই জাহাজের যাত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার জন্য জাহাজের দেরি হয়, মাহে বন্দরে পৌছে তাঁরা জানতে পারেন যে পন্ডিচেরি ব্রিটিশরা দখল করে নিয়েছে। তাঁদের জাহাজ আবার ফিরে যায়। লে জেন্টিল মাঝসমুদ্র থেকে পরিক্রমণ দেখেন কিন্তু জাহাজের দোলার ফলে পরিক্রমণের সময়কাল ও জাহাজের অবস্থান নির্ণয়ে প্রচুর ভুল থেকে গিয়েছিল। তাই তাঁর মাপ কোনো কাজে আসেনি। লে জেন্টিলের কথা আমাদের লেখাতে আবার আসবে।
ভারতে কয়েক জায়গায় পরিক্রমণ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। কলকাতা থেকে নোটারি পাবলিক উইলিয়াম ম্যাগি এবং মাদ্রাজের গভর্নরের প্রাসাদের উপর থেকে জ্যোতির্বিদ পাদ্রি উইলিয়াম হির্স্ট পরিক্রমণ পর্যবেক্ষণ করেছলেন। উইলিয়াম হির্স্ট এবং রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গের বিখ্যাত বিজ্ঞানী মিখাইল লোমোনোসভ তাঁদের পর্যবেক্ষণ থেকে প্রথম শুক্রের বায়ুমণ্ডলের অস্তিত্বের কথা বলেন, যদিও আধুনিক কালের বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন যে তাঁদের দূরবিন তা দেখার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। সে সময় চট্টগ্রামের উপকূল জরিপ করছিলেন বার্থেলমিউ প্লেইস্টেড, তিনিও পর্যবেক্ষণের রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন। তামিলনাড়ুর তরঙ্গমওয়াদি থেকে কয়েকজন জেসুইট পাদ্রি পরিক্রমণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
কিন্তু এত চেষ্টার পরেও যে পরিমাপ পাওয়া গিয়েছিল, তাতে এতই ভুল ছিল যে তা কাজে আসেনি। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের মধ্যে প্রায় কুড়ি থেকে পঁচিশ শতাংশ পার্থক্য ছিল। ফলে পিকার্ড আর ক্যাসিনির নির্ণয় করা দূরত্বের থেকেও এতে ত্রুটি ছিল অনেক বেশি। সব থেকে বড় সমস্যা হয়েছিল যে দুরবিন দিয়ে পর্যবেক্ষণের আগে বোঝা সম্ভব হয়নি যে পরিক্রমণ ঠিক কোন মুহূর্তে শুরু বা শেষ হবে তা নির্ধারণ করতে কত অসুবিধা হবে। সূর্যের সামনে আসার আগে শুক্রের প্রতিবিম্ব হঠাৎ লম্বাটে হয়ে গিয়েছিল, আবার যখন তা গোলাকার ধারণ করল, তখন তা অনেকটা ভিতরে। একে বলা হয়েছিল ব্ল্যাক ড্রপ এফেক্ট।
বিজ্ঞানীরা অবশ্য হাল ছাড়েননি, শুক্রের পরে পরিক্রমণ হবে 1769সালের জুন মাসের 3 ও 4 তারিখ। ইতিমধ্যে অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির অনেক উন্নতিসাধন হয়, বিশেষ করে ব্রিটিশ দূরবিন নির্মাতা জেমস শর্ট ব্ল্যাকড্রপ এফেক্টের জন্য ত্রুটি কমানোর দুটি নতুন পদ্ধতি খুঁজে বার করেন। লে জেন্টিল আর ফ্রান্সে ফিরে যাননি, মরিশাসেই রয়ে গিয়েছিলেন এবং আকাশ পর্যবেক্ষণের কাজ করছিলেন। তিনি আবার পন্ডিচেরি আসেন ১৭৬৮ সালে, ইতিমধ্যে যুদ্ধ শেষে তা ফরাসিদের হাতে ফিরে গেছে। পন্ডিচেরির গভর্নর তাঁকে সব রকমের সহায়তা করেন, স্থানীয় ব্রিটিশরা তাঁকে একটি টেলিস্কোপ দিয়ে সাহায্য করে। এক বছর ধরে তিনি নিখুঁতভাবে পন্ডিচেরির দ্রাঘিমা নির্ণয় করেছিলেন। কিন্তু আসল দিনে মেঘের জন্য তিনি কিছুই দেখতে পাননি। এত বছরের চেষ্টা বৃথা হওয়াতে তিনি খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। বিখ্যাত ব্রিটিশ অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন জেমস কুক জ্যোতির্বিজ্ঞানী চার্লস গ্রিন ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী জোসেফ ব্যাঙ্কসকে তাহিতি দ্বীপে নিয়ে যান, সেখানে পরিক্রমণ দেখার পরে তাঁরা দক্ষিণ গোলার্ধে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে যে অভিযান করেছিলেন তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। ব্যাঙ্কস অবশ্য ফেরার পথে অসুখে মারা যান। ফরাসি বিজ্ঞানী জাঁ-ব্যাপ্টিস্ট শ্যাপ 1761 সালে সাইবেরিয়াতে পরিক্রমণ অভিযানে গিয়েছিলেন, এবার তিনি গিয়েছিলেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে। অভিযান সফল হয়েছিল, কিন্তু তার পরেই এক মড়কে শ্যাপ সহ অভিযাত্রীদলের আটাশজন সদস্যের মধ্যে ছাব্বিশজন প্রাণ হারান। ভারতে পাটনার কাছে দানাপুর থেকে ক্যাপ্টেন লুই ডিগ্লস ও ক্যাপ্টেন আলকজান্ডার রোজ ফেজাবাদ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। আমাদের পূর্ব পরিচিত উইলিয়াম হির্স্ট তখন ইংল্যান্ডে। তিনি গ্রিনউইচ থেকে পরিক্রমণ দেখেছিলেন, যদিও এবারে বায়ুমণ্ডলের কোনো চিহ্ন তাঁর চোখে পরেনি।
এত বিপদ কষ্ট হতাশা প্রাণহানির পরে শেষ পর্যন্ত সাফল্য এসেছিল, বিভিন্ন জায়গার পরিক্রমণ পর্যবেক্ষণ থেকে শেষ পর্যন্ত সূর্যের যে দূরত্ব পাওয়া গিয়েছিল, আধুনিক যুগে রাডারের মাপের সঙ্গে তার পার্থক্য এক শতাংশেরও কম। সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্বকে বলে অ্যাস্ট্রনমিক্যাল একক, সেটার মান জানার পরে শুরু হয় নক্ষত্রদের দূরত্ব মাপার চেষ্টা। প্রথম ছবির মতো করে আঁকলে A ও B বিন্দুর মধ্যে দূরত্ব হবে দুই অ্যাস্ট্রনমিক্যাল একক বা তিরিশ কোটি কিলোমিটার, কারণ ছ'মাস আগে পরে মাপা হয়েছে। কিন্তু নক্ষত্রদের দূরত্ব এতই বেশি যে এত দূরের দুই বিন্দু থেকে মাপলেও তাদের লম্বন খুব কম, তাই তা মাপা অনেক বেশি শক্ত। সূর্যের লম্বনের মান হল 8.8", সেখানে আমাদের নিকটতম তারার লম্বনও এক সেকেন্ডের কম। তাই 1838 সালের আগে সূর্য ছাড়া অন্য কোনো নক্ষত্রের লম্বন মাপা সম্ভব হয়নি।শুক্রের আবার পরিক্রমণ হয় 1874 সালের 9 ডিসেম্বর, ও 1882 সালের 6 ডিসেম্বর, এবং 2004 সালের 8 জুন ও 2012 সালের 5 জুন। এর পরের পরিক্রমণ হবে 2117 সালের 10 ডিসেম্বর।
তথ্যসূত্রঃ
Transits of Venus and the Astronomical Unit, Donald A. Teets, Mathematics Magazine, December 2003
Venus in India: The Transit Tales, R.C. Kapoor
Indian Astronomy and the Transits of Venus. 1: The Early Observations, R.C. Kapoor, Journal of Astronomical History and Heritage, November 2013
ইউরোপিয়ান স্পেস অবজার্ভেটরির ওয়েবসাইট
No comments:
Post a Comment