Tuesday, 9 November 2021

কিছু নতুন তথ্যের আলোতে বিভা চৌধুরি

 

কিছু নতুন তথ্যের আলোতে বিভা চৌধুরি

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার ফলে বিজ্ঞানী বিভা চৌধুরির নাম সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা পরিচিত হয়েছে। তাঁর স্মৃতিতে আকাশে একটি নক্ষত্রের নামকরণ হয়েছে। বিভা প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট করেছিলেন। ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করার পর তাঁর থিসিস অনুমোদিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। ডিগ্রি হাতে পেয়েছিলেন ১৯৫২ সালে; এই দেরির কারণ আমরা জানি না। তারও আগে, ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৫ সালে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে গবেষণার সময় তাঁর গাইড দেবেন্দ্রমোহন বসু এবং তিনি ফটোগ্রাফিক পদ্ধতি অবলম্বন করে মহাজাগতিক রশ্মিতে পাই মেসন বা আধুনিক ভাষায় পায়ন কণা আবিষ্কারের খুব কাছে পৌঁছেছিলেন, যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভালো প্লেটের অভাবে তাঁরা শেষ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে সেই দাবি রাখতে পারেননি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে ব্রিটেনে সিসিল পাওয়েল নিশ্চিতভাবে এই কণাটিকে সনাক্ত করেছিলেন। কয়েকবছর পরে পাওয়েল নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তার পিছনে পাই মেসন আবিষ্কারে তাঁর সাফল্যেরও ভূমিকা ছিল।

বিভার জন্ম সম্ভবত ১৯১৩ সালে, তিনি বেথুন কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্র্যান্স পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান কলেজ থেকে ১৯৩৬ সালে এমএসসি করার পরে তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দিরে গবেষণা করেছিলেন। ১৯৪৫ সালে তিনি ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট করতে যান। দেশে ফিরে তিনি চার বছর কাটিয়েছিলেন বম্বের টাটা ইন্সটিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, সংক্ষেপে টিআইএফআর-এ। এর পর সম্ভবত অল্প কিছুদিন শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়েরিং কলেজে কাটান। তারপর তিনি আবার বিদেশে চলে যান কয়েক বছরের জন্য। ফ্রান্সে ও আমেরিকাতে কয়েক বছর কাটানোর পরে দেশে ফিরে আমেদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি বা পিআরএল-এর সঙ্গে যুক্ত হন। সেখান থেকে অবসর নেওয়ার পর আবার কলকাতায় এসে গবেষণা করেছিলেন। ১৯৯১ সালের ২ জানুয়ারি তাঁর প্রয়াণ ঘটে।

তাঁকে নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হওয়ার ফলে কিছু নতুন তথ্য আমাদের সামনে এসেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড খুঁজে জানা গেছে যে তিনি ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স ও বিএসসি পড়েছিলেন সিটি কলেজ থেকে। সিটি কলেজে তখন পদার্থবিদ্যাতে অনার্স ছিল না, তিনি ডিস্টিংশন সহ বিএসসি পাস করেছিলেন। টিআইএফআর-এর অধ্যাপক বন্দনা নানাল ও পিআরএল-এর অধ্যাপক শ্রুবাবতী গোস্বামী বিভার চাকরির সময়ের কিছু নথি উদ্ধার করেছেন। তার থেকে পাওয়া কিছু তথ্য সম্প্রতি ফিজিক্স নিউজ পত্রিকার এক বিশেষ সংখ্যাতে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া রাজিন্দর সিং ও সুপ্রকাশ রায় বিভা চৌধুরির যে জীবনী লিখেছিলেন ‘A Jewel Unearthed: Bibha Chowdhuri, The Story of an Indian Woman Scientist', সম্প্রতি তার একটি ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেও এই তথ্যগুলি সংকলিত হয়েছে। শ্রুবাবতী গোস্বামীর উদ্ধার করা নথির সূত্র অনুসরণ করে জানা গিয়েছে যে আমেরিকাতে বিভা বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জন লিন্সলের সঙ্গে দু'মাস কাজ করেছিলেন, দেশে ফেরার পরেও তাঁদের মধ্যে গবেষণা বিষয়ে চিঠি মারফত আলোচনা হত। সন্ধান করে দেখা যায় যে লিন্সলেকে লেখা বিভার দুটি চিঠি আমেরিকার ফের্মিল্যাব আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। আর্কাইভ কর্তৃপক্ষ অনুরোধে সাড়া দিয়ে চিঠি দুটির প্রতিলিপি পাঠিয়েছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানাই। বিভার গবেষণার পরিপ্রেক্ষিত এই চিঠি দুটি থেকে কিছুটা স্পষ্ট হচ্ছে। সম্ভবত আগে কোথাও এই চিঠি দুটির বিষয় আলোচনা হয়নি।

আমরা জানি যে বিভা ভারতে ফটোগ্রাফিক প্লেট নিয়ে কাজ করলেও ম্যানচেস্টার ক্লাউড চেম্বার নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তিনি সেখানে কসমিক রে শাওয়ার বিষয়ে কাজ করেছিলেন প্যাট্রিক ব্ল্যাকেটের ল্যাবরেটরিতে, ব্ল্যাকেট ১৯৪৮ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। মহাজাগতিক রশ্মি প্রোটন ইলেকট্রন বা ফোটনের মতো মৌলিক কণা হতে পারে, কিংবা লোহার মতো ভারি নিউক্লিয়াসও হতে পারে। এদের শক্তি খুব বেশি। বায়ুমণ্ডলের একদম উপর দিকে কোনো পরমাণুর নিউক্লিয়াসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সে সাধারণত অনেক নতুন কণা তৈরি করে, তারাও আবার বায়ুর নিউক্লিয়াসের সঙ্গে সংঘর্ষ বা ক্ষয় ইত্যাদি পদ্ধতিতে আরো অনেক কণা তৈরি করে। ফলে পৃথিবীতে যখন সেই সমস্ত কণা এসে পৌঁছায় তখন কয়েক বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে একসঙ্গে তারা ধরা পড়ে। একে বলে এয়ার শাওয়ার।

বিভা কিন্তু দেশে ফটোগ্রাফিক প্লেট নিয়ে গবেষণার কথা ভোলেন নি বলেই মনে হয়। টিআইএফআর-এর রেকর্ড থেকে দেখা যাচ্ছে ডক্টরেট ডিগ্রি জমা দেওয়ার পরেই তিনি প্যারিতে লুই লাপ্রিন্স-রিঙ্গের পরীক্ষাগারে ছমাস কাজ করার জন্য ভারত সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। তাঁর আবেদনের সমর্থনে তাঁর গাইড ও থিসিসের পরীক্ষক জন উইলসন এক চিঠি দিয়েছিলেন। স্বাধীন ভারতের বিজ্ঞান বিষয়ক অনেক সিদ্ধান্তই নিতেন হোমি জাহাঙ্গির ভাবা, তিনি এক চিঠি লিখে উইলসনের কনফিডেনশিয়াল মতামত চেয়েছিলেন। কারণ হিসাবে তিনি বলেছিলেন যে লাপ্রিন্স-রিঙ্গের পরীক্ষাগারে ফটোগ্রাফিক পদ্ধতি নিয়ে কাজ হয়, বিভার থিসিসের কাজ হল মেঘকক্ষ নিয়ে। উইলসনের গোপনীয় উত্তরে কিন্তু বিভার সম্পর্কে অবিমিশ্র প্রশংসা ছিল না, তিনি লিখেছিলেন যে বিভাকে প্রথম শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞানী বলা যায় না, কিন্তু তাঁকে নির্দেশ দিলে তিনি ভালোই কাজ করতে পারেন। তবে নতুন কোনো বিষয়ে তাঁকে যেতে উৎসাহ দেওয়া ঠিক হবে না। আশ্চর্য হল ভাবা এবং উইলসন দুজনেই বিভার ভারতে থাকাকালীন কাজগুলোর কথা বিস্মৃত হয়েছিলেন, সে সময় তো তিনি ফটোগ্রাফিক প্লেট নিয়েই কাজ করেছিলেন!

তা সত্ত্বেও সম্ভবত সরকারি সাহায্য অনুমোদিত হয়েছিল, বিভা প্যারিতে কিছুদিন ছিলেন। সেখানে কী করেছিলেন জানার উপায় নেই, কিন্তু এর পর থেকে আর ফটোগ্রাফিক প্লেট নিয়ে কাজের সুযোগ বিভা পান নি। ১৯৪৯ সালেই দেশে ফিরে বিভা ১ নভেম্বর মুম্বাইতে ভাবার প্রতিষ্ঠান টাটা ইন্সটিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ বা টিআইএফআর-এ যোগ দেন। তাঁর আবেদনের সমর্থনে ভাবাকে এক চিঠিতে ব্ল্যাকেট লিখেছিলেন যে বিভার থিসিসের পরীক্ষকরা তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য সুপারিশ করেছেন, তাঁরাও দেখেছেন, ব্ল্যাকেট নিজেও তার পরে দেখেছেন যে তাঁর কাজ খুব ভালো। বিভা একজন সক্ষম কর্মী, তাঁর বিচারবুদ্ধির উপর ভরসা রাখা যায়, এবং ভবিষ্যতে ভালো কাজ করার মতো অভিজ্ঞতাও তাঁর আছে। উইলসনের সঙ্গে ব্ল্যাকেটের মতামতের পার্থক্য স্পষ্ট। অনুমান করি ব্ল্যাকেটের চিঠি ভাবার মতের পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। স্থায়ী চাকরি নয়, প্রাথমিকভাবে পাঁচ বছরের মেয়াদে রিসার্চ ফেলো, ইন্সটিটিউটের অ্যাকাডেমিক চাকরির সর্বনিম্ন ধাপ। নথিপত্র থেকে দেখা যাচ্ছে যে বিভা ক্লাউড চেম্বার গ্রুপের দায়িত্বে ছিলেন। ভাবা নিজে মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছিলেন, তাঁর উৎসাহে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষণার এক বড় গ্রুপ তৈরি হয়েছিল।

টিআইএফআর-এ বিভা ছিলেন চার বছর, কিন্তু এই সময়ের কাজের ভিত্তিতে তাঁর গবেষণাপত্রের সংখ্যা মাত্র এক। নতুন প্রতিষ্ঠানে ল্যাবরেটরি তৈরিতে বেশি সময় লাগে, গবেষণাপত্র ছাপানোর সুযোগ কম। মহিলা এবং চুপচাপ বিভার পক্ষে হয়তো কাজেরও অসুবিধা হচ্ছিল। ভারতবর্ষে প্রথম যুগের প্রায় সমস্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানেই মহিলারা এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। গত সাত দশকে পরিস্থিতির হয়তো কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তবে সবটাই যে পালটেছে এমন কথা হয়তো জোর দিয়ে বলা যায় না। অসুবিধার কারণেই হয়তো মেয়াদের আগেই টিআইএফআর ছাড়েন বিভা। কাগজপত্র থেকে দেখা যায় শিবপুরে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ডক্টর এস কে চক্রবর্তীর অধীনে পরমাণু শক্তি কমিশনের অনুমোদিত “Design and development of instruments for cosmic radiation and a study of allied theoretical problems” প্রকল্পে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসাবে বিভার নিযুক্তি কমিশনে অনুমোদিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড থেকে অনুমান করি যে এস কে চক্রবর্তী ছিলেন গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। হয়তো বিভা প্রকল্পে অল্প দিনের জন্য কাজ করেছিলেন, কিন্তু তার কোনো রেকর্ডের সন্ধান পাওয়া যায় নি। সেই বছরের শেষ দিকে তিনি যোগ দিলেন ফ্রান্সে পূর্বপরিচিত লাপ্রিন্স-রিঙ্গের পরীক্ষাগারে।

লাপ্রিন্স-রিঙ্গে ইউরোপে পরীক্ষামূলক কণা পদার্থবিদ্যার অগ্রগতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, বিখ্যাত সার্ন ল্যাবরেটরির সৃষ্টির মূলে যে কজন বিজ্ঞানী ছিলেন, তিনিও তাঁদের মধ্যে পড়বেন। এক বিশেষ ধরনের মৌলিক কণাকে বলা হয় হাইপারন, এই নামটা তাঁর সৃষ্টি। বিভা কাজ করেছিলেন আল্পসের এইগুইল দু মিদি-তে ৩৬৮০ মিটার উচ্চতায় এক ল্যাবরেটরিতে। দু'বছর ফ্রান্সে ছিলেন বিভা। এখানেও মেঘকক্ষ ব্যবহার করেছিলেন এই সময়, আরো কয়েকজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে কে-মেসন, বা আধুনিক ভাষায় ক্যাওন কণা নিয়ে কাজ করেছিলেন। এ সময় তাঁরা একটি গবেষণাপত্র ছাপিয়েছিলেন। দু'বছর পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসাবে যোগ দিলেন। পড়ানোর পাশাপাশি যোগ দিয়েছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েন হাজেনের পরীক্ষাগারে; সেখানে নেভি কসমিক রে রিসার্চের অর্থানুকূল্যে চার মাস রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ছিলেন। পিআরএল-এ বিভার জমা দেওয়া জীবনী পঞ্জি থেকে দেখা যাচ্ছে যে দেশে ফেরার আগে বিভা দু'মাস কাটিয়েছিলেন এমআইটি অর্থাৎ ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে এক প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী ব্রুনো রসির পরীক্ষাগারে। ব্রুনো রসিই প্রথম এয়ার শাওয়ারের কথা বলেছিলেন। তাঁর ল্যাবরেটরিতে এয়ার শাওয়ার ধরার এক সম্পূর্ণ নতুন যন্ত্র তৈরিতে অংশ নিয়েছিলেন বিভা। নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে ভলক্যানো র‍্যাঞ্চে সিন্টিলেটর বা প্রতিপ্রভ পদার্থ দিয়ে বানানো সেই গ্রাহক যন্ত্র বসানো হয়েছিল, সেই সময় তা ছিল মহাজাগতিক রশ্মির সব থেকে আধুনিক ও বড় গ্রাহক যন্ত্র। সেই অভিজ্ঞতা তাঁর কাজে লেগেছিল। এই কাজের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন দুই বিজ্ঞানী, জন লিন্সলে ও লিভিও স্কার্সি; তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন এবং পরে চিঠিতে যোগাযোগ রেখেছিলেন বিভা।

দেশে ফিরে তিনি কোদাইকানালে কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের এক প্রকল্পে যোগ দিয়েছিলেন বিভা। সেটা সম্ভবত ১৯৫৯ সাল। কোদাইকানালে অবস্থিত প্রকল্পটি ছিল পিআরএল-এর, এর পর ১৯৬১ সালে পিআরএল-এ পুল অফিসার হিসাবে যোগ দেন। এও সেই অর্থে স্থায়ী চাকরি নয়। এর পর ১ জুলাই ১৯৬৬ হলেন পিআরএল-এর ফেলো, সেখান থেকে অবসর নেন ৩১ অক্টোবর ১৯৭৬। পিআরএল-এ বিভা মূলত দুটি প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কর্ণাটকে কোলার সোনার খনির ভিতরে গ্রাহক যন্ত্র বসিয়ে এয়ার শাওয়ারে মিউয়ন পর্যবেক্ষণ করছিলেন বিভা, ১৯৬২ সাল থেকে সেই কাজ তিনি করেছিলেন। কোদাইকানালের প্রকল্পের সঙ্গে এর তফাতটা লক্ষণীয়। কোদাইকানাল হল তামিলনাড়ুর ২০০ মিটার উঁচু এক শহর, অন্য দিকে কোলার খনির ভিতরে মাটির তলায় প্রায় ২০০ মিটার নিচে। কোলারের তলাতে রাখা গ্রাহক যন্ত্রে একমাত্র খুব উচ্চশক্তিসম্পন্ন মিউয়ন কণারাই ধরা পড়বে, অন্যদিকে কোদাইকানালের পাহাড়ের উপরে কম শক্তির কণারাও ধরা দেবে।

বিভা কাজ শুরু করেছিলেন ফটোগ্রাফিক প্লেট দিয়ে, তারপর ম্যানচেস্টারে ডক্টরেট করার সময় এবং পরে ফ্রান্সে মেঘকক্ষ ব্যবহার করেছিলেন। টিআইএফআর-এ তিনি ক্লাউড চেম্বার গ্রুপের দায়িত্বে ছিলেন। যে কোনো যন্ত্রের মতো মেঘকক্ষও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, বিভা সেই সমস্তই আত্মস্থ করেছিলেন। রসির ল্যাবরেটরিতে দু মাস থাকার সময় তিনি সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে কাজ করা এক যন্ত্র তৈরিতে অংশ নিয়েছিলেন। বিভা বুঝেছিলেন যে মেঘকক্ষের যুগ শেষ হয়ে আসছে, তার জায়গা নিচ্ছে সেই নতুন পদ্ধতি যেখানে সিন্টিলেশন বা প্রতিপ্রভা ব্যবহার করা হয়। আমেদাবাদে এসে তিনি সে সমস্ত নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে গ্রাহকযন্ত্র বানিয়েছিলেন, তাই দিয়েই তিনি কোলার ও অন্যত্র পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। ভলক্যানো র‍্যাঞ্চ এক্সপেরিমেন্টের অন্যতম নেতা জন লিন্সলেকে চিঠি লিখে আমেদাবাদে পরীক্ষানিরীক্ষা বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছেন, সেই চিঠি দুটি ফের্মিল্যাব থেকে পাওয়া গেছে।

প্রথম চিঠিটি তারিখবিহীন, আর্কাইভ থেকে দেখা যাচ্ছে সেটি ১৯৫৯ সালের। দ্বিতীয় চিঠিটির তারিখ ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি। চিঠি থেকে দেখা যাচ্ছে যে লিন্সলে তাঁকে নিজের গবেষণাপত্রের কপি পাঠাতেন। কোদাইকানালে পরীক্ষার পরিকল্পনার ব্যাপারে সম্ভবত বিভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, হয়তো বা তিনি একাই এ বিষয়ে শেষ সিদ্ধান্ত নিতেন। তিনি লিন্সলের কাছে সেই বিষয়ে নানা পরামর্শ চেয়েছিলেন। সব থেকে বড় সমস্যা ছিল ইলেক্ট্রনিক কম্পিউটারের অভাব, তখন ভারতে একমাত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইন্সটিটিউট ছাড়া কোথাও কম্পিউটার ছিল না। দ্বিতীয় চিঠিতে তিনি লেখেন যে কোলারে টিআইএফআর-এর গবেষকদলের গবেষণা লিন্সলের গবেষণার ফলের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। চিঠির সুর থেকে বোঝা যায় যে কাজের বাইরেও তাঁদের কিছুটা বন্ধুত্ব হয়েছিল, বিভা লিন্সলের পরিবার সম্পর্কে খবর নিয়েছেন। বিভার বোন ম্যাসাচুসেটসে গেছেন, লিন্সলে ও তাঁর স্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য।

বিভার জীবনীতে এখনো কিছু ফাঁক রয়ে গেছে। বসু বিজ্ঞান মন্দিরে কাজ করার সময় বিভা বিখ্যাত নেচার পত্রিকাতে চারটি ও আমেরিকা থেকে প্রকাশিত প্রথম শ্রেণির গবেষণাপত্রিকা ফিজিক্যাল রিভিউতে একটি প্রবন্ধ ছাপিয়েছিলেন। এর বাইরে ভারত থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর চারটি প্রবন্ধ। অথচ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য থিসিস জমা দেননি, কেন তার কারণ আমাদের জানা নেই। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রকল্পে তিনি কাজ করেছিলেন কিনা আমরা জানি না। টিআইএফআর-এ চাকরির সময় ইন্সটিটিউটের অধিকর্তা ভাবাকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে তিনি কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদে যোগ দেবেন, কিন্তু সেটি কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কেন সেখানে শেষ পর্যন্ত যাননি, সেই বিষয়েও আমরা অজ্ঞ। পিআরএল-এ আবেদন করার সময় তিনি একটি তিন পৃষ্ঠার জীবনীপঞ্জী জমা দিয়েছিলেন, তাতে তখনো পর্যন্ত যে সমস্ত গবেষণাপত্র তিনি বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ করেছিলেন, তার তালিকা দেওয়া ছিল। সেই তালিকায় তাঁর নেচার-এ প্রকাশিত প্রথম লেখাটি বা ফিজিক্যাল রিভিউ ও ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ ফিজিক্সে প্রকাশিত দুটি প্রবন্ধের উল্লেখ নেই। বিভা কি খুব তাড়াতাড়ি করে লিখতে গিয়ে সেগুলির কথা ভুলে গিয়েছিলেন? যে বিভা নেচার-এর মতো বিখ্যাত জার্নালে পরপর প্রবন্ধ ছাপিয়ে গবেষক জীবন শুরু করেছিলেন, আমেদাবাদে থাকাকালীন সমস্ত গবেষণা পাঠাতেন শুধু ভারতীয় বিজ্ঞানপত্রিকাতে। আজও আমরা বিদেশী পত্রিকাতে প্রকাশিত না হলে সেই গবেষণার কদর করি না, অধিকাংশ ভারতীয় বিজ্ঞানীরই লক্ষ্য থাকে ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে প্রবন্ধ প্রকাশ করার। লিন্সলেকে চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে তিনি ১৯৬২ সালের মার্চ মাস থেকে কোলারে টিআইএফআর-এর প্রকল্পের সহযোগিতায় কাজ শুরু করতে চলেছেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের আগে পিআরএল থেকে তিনি কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন নি, এবং যে কটি ছাপিয়েছেন সবই তাঁর একমাত্র ছাত্র যোগেশচন্দ্র সাক্সেনার সঙ্গে। তাঁর ও টিআইএফআর-এর গবেষকদলের কোনো যৌথ গবেষণাপত্র কোনোদিন প্রকাশিত হয়নি। বিভা কি বড় দলের সঙ্গে গবেষণাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না? অথবা কি একমাত্র মহিলা বলে তাঁর অবদান মনে রাখা হত না?
কলকাতাতে ফিরে তিনি একই সঙ্গে একাধিক ইন্সটিটিউটের গবেষকদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছেন, এবং তাঁদের স্মৃতি অনুযায়ী তিনি খুব ভালোভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে তাঁর একাধিক গবেষণাপত্র বিদেশের পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানে ভারতের প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত মহিলা, যিনি গবেষকজীবনের শুরুতেই এক খুব বড় আবিষ্কারের কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন, কেন তিনি পরবর্তীকালে আঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি পান নি, তা বুঝতে গেলে এই সমস্ত প্রহেলিকার উত্তর খোঁজা জরুরি।

 


জন লিন্সলেকে লেখা বিভার তারিখবিহীন চিঠির অংশ

(কৃতজ্ঞতা স্বীকার Fermilab Archives, তাদের রেকর্ড অনুযায়ী এটি ১৯৫৯ সালে লেখা)


তথ্যসূত্রঃ

A Jewel Unearthed: Bibha Chowdhuri, The Story of an Indian Woman Scientist, Rajinder Singh and Suprakash C Roy, 2017

Bibha Chowdhuri – The First Woman Scientist at the TIFR, Suprakash C Roy and Rajinder Singh, Physics News, Vol. 51, Januray-June 1921

John Linsley Papers, Fermilab Archive

বিস্মৃত বাঙালিঃ নক্ষত্রের নাম বিভা, গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়, প্রকাশিতব্য 

বিভা চৌধুরির জীবন ও গবেষণা সম্পর্কে একপর্ণিকা পত্রিকার এই প্রবন্ধে  লিখেছিলাম। 

 

প্রকাশঃ জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার শারদ২০২১ 

No comments:

Post a Comment