ভারতে নিউক্লিয় বিজ্ঞানচর্চার প্রথম যুগ
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
আমরা সবাই জানি পরমাণুর কেন্দ্রে আছে নিউক্লিয়াস, তার মধ্যেই আছে পরমাণুর প্রায় সমস্ত ভর। আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ১৯১১ সালে নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেন, যদিও মূল পরীক্ষাটি হয়েছিল তার দু'বছর আগে ১৯০৯ সালে। সঠিকভাবে বলতে গেলে অবশ্য আঁরি বেকারেল ১৮৯৬ সালে তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে নিউক্লিয় বিজ্ঞানের সূত্রপাত হয়েছিল বলে ধরা যেতে পারে, কারণ নিউক্লিয়াসই হল তেজস্ক্রিয়তার উৎস। নিউক্লিয়াস প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে তৈরি। রাদারফোর্ডই প্রথম নিউট্রনের অস্তিত্বের কথা অনুমান করেছিলেন, ১৯৩২ সালে তাঁর ছাত্র জেমস চ্যাডউইক কণাটিকে আবিষ্কার করেন। ১৯৩৪ সালে আইরিন জোলিও কুরি ও ফ্রেডেরিক জোলিও কুরি কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন। সেই বছরই নিউট্রন, বিশেষ করে ধীরগতির নিউট্রন ব্যবহার করে নিউক্লিয় বিক্রিয়া বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন এনরিকো ফের্মি। ১৯৩৯ সালে অটো হান ও ফ্রাঞ্জ স্ট্রাসমান আবিষ্কার করেন নিউক্লিয় বিভাজন বা ফিশন বিক্রিয়া, অবশ্য তার পিছনে লিজে মাইটনারের অবদানও ভোলার নয়। এই বিভাজন বিক্রিয়াই পরমাণু বোমা বা শক্তি উৎপাদনে ব্যবহার হয়। এই লেখাতে অবশ্য শক্তি উৎপাদন বা পরমাণু অস্ত্রের মতো নিউক্লিয় প্রযুক্তির দিকে না গিয়ে শুধুমাত্র মৌলিক গবেষণাতেই আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
ঘটনাচক্রে নিউক্লিয় বিজ্ঞানের প্রথম যুগের সঙ্গে আমাদের দেশে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার সূচনাকালের কালপঞ্জীর বেশ কিছুটা মিল আছে। ১৮৯৪ সাল নাগাদ প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্র নিজের পরীক্ষাগার তৈরি করে ভারতে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার সূত্রপাত করেন। মহেন্দ্রলাল সরকার অবশ্য ১৮৭৬ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু ১৯০৭ সালে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন কাজ শুরু করার আগে সেখানে আধুনিক বিজ্ঞানে গবেষণা বিশেষ হত না। টাটা গোষ্ঠীর উদ্যোগে ১৯০৯ সালে বাঙ্গালোরে তৈরি হয়েছিল ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স, সেখানে মূলত রসায়ন বিষয়ে গবেষণা হত। ১৯৩৩ সালে রামন অধিকর্তা হিসাবে যোগ দেওয়ার পরে সেখানে পদার্থবিদ্যা বিভাগ তৈরি হয়েছিল। জগদীশচন্দ্র ১৯১৭ সালে তৈরি করেন বসু বিজ্ঞান মন্দির।
তবে নিউক্লিয়াস বিষয়ে গবেষণার প্রথম উদাহরণ এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যাবে না। ১৯১৪ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে তৈরি হয় বিজ্ঞান কলেজ বা ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স; তার এক মূল অঙ্গ ছিল পদার্থবিদ্যা বিভাগ। সেখানে ১৯১৬ সাল থেকে ক্লাস ও গবেষণা শুরু হয়। গবেষকদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা। মেঘনাদ সাহাই আমাদের দেশে প্রথম সুসম্বদ্ধভাবে নিউক্লিয় গবেষণার সূচনা করেছিলেন, সে কথাতে আমরা পরে আসব।
বিজ্ঞান কলেজের প্রথম দুই পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকদের মধ্যে ছিলেন দেবেন্দ্রমোহন বসু। তিনি জার্মানিতে গবেষণা করে ডক্টরেট করেছিলেন, সেখানে তিনি ক্লাউড চেম্বার বা মেঘকক্ষ নিয়ে কাজ করেছিলেন। তিনি ও তাঁর ছাত্র সুবোধ ঘোষ আমাদের দেশে প্রথম ক্লাউড চেম্বার তৈরি করে তা দিয়ে কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। আধুনিক যুগের হিসাবে মহাজাগতিক রশ্মিকে কণা পদার্থবিদ্যা বা পার্টিকল ফিজিক্সের মধ্যে ফেলতে হবে। সেই যুগে অবশ্য এই ভাগ ছিল না, তা হলেও এই লেখাতে আমরা কণা পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়ে যাব না। তাঁরা মেঘকক্ষ দিয়ে বিভিন্ন গ্যাসের মধ্যে আলফা কণার শক্তিক্ষয় কেমনভাবে হয় তা পর্যবেক্ষণ করতেন। বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় তাঁদের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, একেই আমরা আমাদের দেশে নিউক্লিয় বিজ্ঞান বিষয়ে প্রথম গবেষণা বলতে পারি।
মেঘনাদ সাহা ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন, সেখানেই তাঁর তত্ত্বাবধানে ভারতবর্ষে প্রথম সুসম্বদ্ধ নিউক্লিয় গবেষণার সূচনা হয়। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে দু'জনের আলাদা করে নাম করতে হয়, দৌলত সিং কোঠারি ও বাসন্তীদুলাল নাগ চৌধুরি। দ্বিতীয়জনের কথা পরে আসবে, প্রথমেই বলি কোঠারির কথা।
রাদারফোর্ড দেখিয়েছিলেন যে অনেক তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে বিটা রশ্মি বেরোয়। বিটা রশ্মি হল ইলেকট্রন। তিনি আরো দেখান যে আলফা ও বিটা তেজস্ক্রিয়াতে এক পরমাণু অন্য পরমাণুতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। কিন্তু নিউক্লিয়াসে যদি ইলেকট্রন না থাকে, তাহলে তা আসে কোথা থেকে? অপর এক সমস্যা ছিল বিটা ক্ষয়ে নির্গত ইলেকট্রনদের সবার গতিশক্তি কেন সমান নয় কোনো ভাবেই তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না। বিজ্ঞানী নিলস বোর তো এক সময় ভেবেছিলেন বিটা ক্ষয় ভর–শক্তির সংরক্ষণ সূত্র মেনে চলে না।
১৯৩৩ সালে মেঘনাদ ও কোঠারি বিটা ক্ষয়ের এক নতুন তত্ত্ব দেন। তাঁরা বললেন যে প্রোটন কোনো মৌলিক কণা নয়, তাকে ভাঙ্গলে পাওয়া যায় নিউট্রন ও ইলেকট্রনের বিপরীত কণা বা অ্যান্টিপার্টিকল পজিট্রন। নিউক্লিয়াসের মধ্যে আলফা কণার চলাফেরার জন্য গামা রশ্মির ফোটন কণা তৈরি হয়, তার থেকে সৃষ্টি হয় ইলেকট্রন ও পজিট্রন। পজিট্রন ও নিউট্রন মিলে তৈরি করে প্রোটন, ইলেকট্রন বিটা কণা রূপে নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে আসে। এই ছিল সাহা–কোঠারির বিটা ক্ষয়ের তত্ত্ব।
এই তত্ত্বের আয়ু বেশিদিন ছিল না। ১৯৩০ সালেই উলফগ্যাং পাউলি বলেছিলেন যে নিউট্রন ভেঙে তৈরি হয় প্রোটন, ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো নামের তড়িৎআধানহীন অতি ক্ষুদ্র ভরের এক কণা। এই নতুন কণাটা কিছুটা শক্তি নিয়ে চলে যায়, সেটা পরীক্ষাগারে ধরা পড়ে না বলে ভর-শক্তির সংরক্ষণ সূত্র মিলছে না। তবে মনে রাখতে হবে যে পাউলি এই প্রস্তাব কোনো গবেষণা পত্রিকাতে প্রকাশ করেননি, ইউরোপের এক সম্মেলনে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের সঙ্গে ইউরোপের বিজ্ঞানীমহলের যোগাযোগ ছিল ক্ষীণ, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রের এলাহাবাদের অবস্থান ছিল কলকাতার তুলনায় আরো প্রান্তিক। মেঘনাদরা এলাহাবাদে বসে সম্ভবত পাউলির সেই চিঠির খবর পাননি। নিউট্রিনোকে হিসাবে রেখে বিটা ক্ষয়ের তত্ত্ব প্রকাশ করেন এনরিকো ফার্মি ১৯৩৩ সালে, নিউট্রিনো প্রথম আমাদের যন্ত্রে ধরা পড়ে ১৯৫৬ সালে। কাজেই সাহারা যখন গবেষণা করছিলেন, তখনও বিটা ক্ষয়ের তত্ত্ব নিয়ে শেষ কথা বলার সময় আসেনি। পরে দেখা গেছে যে প্রায় দশাদের প্রস্তাবের মতো ঘটনা নিউক্লিয়াসে ঘটে, সেখান থেকে নির্গত উচ্চ শক্তির গামা অনেক সময় ইলেকট্রন ও পজিট্রন রূপে পরিবর্তিত হয়।
এই গবেষণার কয়েকটা দিক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথমত সাহা ও কোঠারি বিজ্ঞানের প্রথম সারির এক সমস্যাতে হাত দিয়েছিলেন; সাধারণ গবেষণাতে তাঁরা সন্তুষ্ট ছিলেন না। দ্বিতীয়ত তাঁরা সাহস করে বলেছিলেন প্রোটন মৌলিক কণা নয়, তাকেও ভাঙা সম্ভব। সম্ভবত তাঁরাই এই কথা প্রথম বলেছিলেন। পরে এক গবেষণাতে মেঘনাদ বলেছিলেন নিউট্রনও মৌলিক কণা নয়, তা দুই চৌম্বক একমেরু কণার সমষ্টি। তিন দশক পরে বোঝা যাবে প্রোটন ও নিউট্রন আসলে মৌলিক কণা নয়, তারা তিনটি করে কোয়ার্ক কণা দিয়ে তৈরি। তার সঙ্গে অবশ্য মেঘনাদদের তত্ত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। একমেরু কণার সন্ধানও এখনো পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীকালে মেঘনাদ কোঠারিকে কেমব্রিজে রাদারফোর্ডের কাছে গবেষণা করতে পাঠান, তাঁর সঙ্গে কাজ করেই তিনি ডক্টরেট করেছিলেন। দেশে ফিরে তিনি দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন; স্বাধীন ভারতে তিনি প্রথমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পরামর্শদাতা ও পরে বারো বছর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রধান হিসাবে কাজ করেছিলেন। আমাদের দেশ থেকে আরো দুই ছাত্র রাদারফোর্ডের কাছে গবেষণা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন নাজির আহমেদ যিনি পাকিস্তান পরমাণু আয়োগের প্রথম সভাপতি। অপরজন রফি আহমদ চৌধুরি পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্র প্রকল্পে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মেঘনাদ, তাঁর ছেলে অজিত কুমার সাহা এবং সমরেন্দ্রনাথ ঘোষাল নিউক্লিয়াসের ভর নির্ণয়ের একটি সূত্র তৈরি করেছিলেন। এই ধরনের সূত্র প্রথম দিয়েছিলেন হান্স বেথে ও কার্ল ওয়াইজ্যাকার। সাহারা এই সূত্রে একটি নতুন পদ যোগ করেছিলেন। এই পদটি নিউক্লিয়াসে স্পিন বা কৌণিক ভরবেগের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে আমরা ভর নির্ণয়ের সূত্রে ওই বিশেষ পদটি ব্যবহার না করে কাছাকাছি একটি পদ প্রয়োগ করি যা প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যা জোড় না বিজোড় তার উপর নির্ভর করে। ঘোষাল পরে স্মৃতিচারণ করেছেন যে বিশ্বযুদ্ধের সময় গবেষণা পত্রিকা ও বিজ্ঞানের খবর আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাতে তাঁদের বিশেষ অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। অজিত সাহা পরে সাহা ইনস্টিটিউটের অধিকরতার দায়িত্ব পালন করেন।
সমরেন্দ্রনাথ ঘোষালের একটি বিশেষ গবেষণার কথা এই প্রসঙ্গে বলতে হয় যা সারা পৃথিবীতে পদার্থবিদ্যার ছাত্রদের অবশ্যপাঠ্য। ঘোষালের পরীক্ষা নামে পরিচিত এই কাজটিতে তিনি নিউক্লিয় বিক্রিয়ার এক মৌলিক তত্ত্ব প্রমাণ করেছিলেন। দুটি নিউক্লিয়াসের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিয়ে নতুন নিউক্লিয়াস তৈরি করা যায়। এই নিউক্লিয়াসগুলি সাধারণত উত্তেজিত অবস্থায় অর্থাৎ অত্যন্ত উচ্চ শক্তিসম্পন্ন হয়, এদের বলে যৌগ (compound) নিউক্লিয়াস। এর থেকে নিউট্রন, প্রোটন, গামা রশ্মি ইত্যাদি নির্গত হয়। বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিল্স বোর বলেছিলেন যে এই ধরনের যৌগ নিউক্লিয়াস থেকে যে কণা বা গামা রশ্মির নির্গমন যৌগ নিউক্লিয়াস কিভাবে তৈরি হয়েছে তার উপর নির্ভর করে না। সমরেন্দ্রনাথ ১৯৫০ সালে দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন বিক্রিয়াতে একই যৌগ নিউক্লিয়াস তৈরি করে বোরের প্রকল্পের সত্যতা পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করে দেখান। এই কাজটি অবশ্য তিনি দেশে নয়, আমেরিকার বার্কলেতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে করেছিলেন। দেশে ফিরে তিনি প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাফল্যের সঙ্গে অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেছিলেন।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সূচনা করেছিলেন শ্যামাদাস চ্যাটার্জি, ছাত্রাবস্থাতে নিউক্লিয় বিভাজন বিষয়ে গবেষণা শুরু করে তিনি এক নতুন আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন, কিন্তু ঘটনাচক্রে সেই কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। শ্যামাদাস তখন বসু বিজ্ঞান মন্দিরে দেবেন্দ্রমোহন বসুর ছাত্র, জগদীশচন্দ্রের মৃত্যুর পরে তাঁর ভাগনে দেবেন্দ্রমোহন ১৯৩৮ সালে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অধিকর্তা হয়েছিলেন। ইউরেনিয়ামের বিভাজন নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে করতে শ্যামাদাস দেখলেন যে নিউট্রন উৎস সরিয়ে নিলেও ফিশনের সঙ্কেত তাঁর ডিটেক্টরে ধরা পড়ছে। দেবেন্দ্রমোহন সেই সময় দার্জিলিঙে, কার সঙ্গে আলোচনা করবেন? সত্যেন্দ্রনাথ বসু তখন কলকাতায়, শ্যামাদাস তাঁর কাছে গিয়ে বিষয়টা খুলে বললেন। সত্যেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন মহাজাগতিক রশ্মির জন্য কি এটা হতে পারে? শ্যামাদাস ইউরেনিয়ামকে সিসের চাদর দিয়ে মুড়ে মহাজাগতিক রশ্মি কমানোর ব্যবস্থা করলেন, কিন্তু সঙ্কেত আসা কমল না। সত্যেন্দ্রনাথ তখন অনুমান করলেন যে ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস নিজে নিজেই ভেঙে যাচ্ছে। সে সময় নিউক্লিয় বিভাজন ব্যাখ্যা করার জন্য নিল্স বোর ও জন হুইলারের তত্ত্ব ব্যবহার করা হত, সেই অনুযায়ী এই ঘটনা অসম্ভব। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ চিরকালই পরীক্ষানিরীক্ষাকে তত্ত্বের থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন; তিনি শ্যামাদাসকে তাঁর গবেষণার কথা ছাপানোর পরামর্শ দেন। শ্যামাদাসও সেই মতো গবেষণাপত্রটি লিখে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু দেবেন্দ্রমোহন কলকাতাতে ফিরে এসে শ্যামাদাসের পরীক্ষা দেখে সন্তুষ্ট হতে পারেননি; হয়তো তাঁর মনে হয়েছিল যে নিল্স বোরের তত্ত্বে ভুল থাকতে পারে না। তিনি শ্যামাদাসকে গবেষণাপত্র ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেন। ঠিক দু’মাস পরে দুই সোভিয়েত বিজ্ঞানী ফ্লেরভ ও পেত্রাক ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসের নিজে নিজে ভেঙে পড়ার কথা প্রকাশ করেন।
কণা পদার্থবিদ্যা, বিশেষ করে মহাজাগতিক রশ্মির গবেষণাতে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন হোমি জাহাঙ্গির ভাভা ও পরে বিক্রম সরাভাই; স্বাধীন ভারতে তাঁরা দুজনে পরপর পরমাণু শক্তি আয়োগের প্রধান হয়েছিলেন। দেবেন্দ্রমোহন ও তাঁর ছাত্রী বিভা চৌধুরিও কণা পদার্থবিদ্যাতে এক অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের কাছাকাছি পোঁঁছেছিলেন। আগেই বলেছি এই লেখাতে কণাপদার্থবিদ্যার আলোচনা থাকবে না। নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানের প্রথম যুগে সকলেই তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে নির্গত রশ্মি অথবা মহাজাগতিক রশ্মির সাহায্যে পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন, ভারতীয় বিজ্ঞানীরাও সেই পথেই হেঁটেছিলেন। তেজস্ক্রিয়তাতে নির্গত কণাদের শক্তি খুব বেশি নয়, অন্যদিকে মহাজাগতিক রশ্মি কখন আসবে তা বিজ্ঞানীদের হাতে নেই, তার পরিমাণও কম। ফলে পরীক্ষার সুযোগ ছিল খুব সীমিত। পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটল ১৯২০-র দশকের একদম শেষে যখন কণাত্বরকের সাহায্যে প্রোটন বা আলফা কণাদের উচ্চ শক্তি দেওয়া সম্ভব হল। বিশেষ করে বলতে হয় আর্নেস্ট লরেন্স আবিষ্কৃত সাইক্লোট্রনের কথা। আধুনিক অধিকাংশ কণাত্বরকের উৎস হল এই যন্ত্র।
মেঘনাদ ১৯৩৮ সালে এলাহাবাদ থেকে আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। তিনি প্রথমেই নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যার পাঠক্রম চালু করেন, সারা দেশের মধ্যে সেটিই প্রথম। তখনই তিনি একটি সাইক্লোট্রন স্থাপনের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে পড়েন। তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন বাসন্তীদুলাল নাগ চৌধুরি। বাসন্তীদুলালকে মেঘনাদ লরেন্সের ল্যাবরেটরিতে পাঠান, উদ্দেশ্য সাইক্লোট্রন যন্ত্র স্থাপন ও ব্যবহার সম্পর্কে তিনি সেখান থেকে শিখে আসবেন। বাসন্তীদুলাল সেখানে পরবর্তীকালের নোবেল জয়ী এমিলিও সেগ্রের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে ডক্টরেট করেন। বিষয় ছিল তিনটি নতুন কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় মৌল যেগুলি বার্কলের সাইক্লোট্রনের সাহায্যে বানানো সম্ভব হয়েছে। ইতিমধ্যে মেঘনাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, টাটা গোষ্ঠী, বিড়লা গোষ্ঠী ও কিছু সম্পদশালী ব্যক্তির থেকে সাইক্লোট্রনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। বাসন্তীদুলাল আমেরিকা থেকে যন্ত্রাংশ সংগ্রহের ব্যবস্থা করে ১৯৪১ সালে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তার পরেই আমেরিকা মিত্রপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করে, ফলে সেগুলির দেশে পৌঁছানোতে সমস্যা হয়। একটি জাহাজ তো জাপানিরা ডুবিয়েই দেয়। ফলে সাইক্লোট্রন তৈরিতে দেরি হয়; তার থেকে প্রথম কণার স্রোত পাওয়া যায় ১৯৫৪ সালে। যন্ত্রটি পুরোপুরি কাজ শুরু করে ১৯৬৬ সালে, মেঘনাদ তার দশ বছর আগেই প্রয়াত হয়েছিলেন।
মেঘনাদ ১৯৪৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরেই ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স তৈরি করেছিলেন, কিন্তু প্রথম থেকেই তার পরিচালনাতে অর্থসমস্যা দেখা দেয়। ভারতের স্বাধীনতা লাভের কয়েকবছর আগে থেকেই গবেষণা বিশেষত নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা বিষয়ে পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল। জওহরলাল নেহরুর ইচ্ছাতে সেই উদ্যোগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন হোমি জাহাঙ্গির ভাভা। সদ্যস্বাধীন দেশের অর্থবল ছিল কম, তাই ভাভা একমাত্র বোম্বাই, অর্থাৎ বর্তমানে মুম্বাইতে নিউক্লিয় গবেষণা কেন্দ্রীকরণের পক্ষপাতী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেও গবেষণার জন্য বিশেষ অর্থবরাদ্দ করা সম্ভব হয় নি। শেষ পর্যন্ত সাহার ইন্সটিটিউট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, বর্তমানে তার নাম সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। মেঘনাদের মৃত্যুর পরে বাসন্তীদুলাল সাহা ইনস্টিটিউটের প্রধান হয়েছিলেন।
পরাধীন ভারতে কলকাতা বা এলাহাবাদে নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা শুরু হয়েছি, স্বাধীনতার পরে তার মূল কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াল বোম্বাই। পরাধীন ভারতে নিউক্লিয় গবেষণার আরো এক কেন্দ্র তৈরির চেষ্টা হয়েছিল, বাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়ন্সে সেই প্রয়াস নিয়েছিলেন রামন। রামন তাঁর ছাত্র আর এস কৃষ্ণনকে কেমব্রিজে পাঠান। সেখানে তিনি বাসন্তীদুলালের মতোই সাইক্লোট্রন চালানোর ব্যাপারে জ্ঞান লাভ করে এবং কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণা করে ১৯৪১ সালে দেশে ফেরেন। কৃষ্ণন ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সে নিউক্লিয় গবেষণাগার তৈরির চেষ্টা করেন। ইতিমধ্যে রামন ইন্সটিটিউটের অধিকর্তার পদ ছেড়েছেন, তবে নতুন অধিকর্তা জ্ঞানচন্দ্র ঘোষও কৃষ্ণনের প্রয়াসকে জোরদার সমর্থন করেন। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে – নিউক্লিয় গবেষণা খুব ব্যয়বহুল, ফলে কৃষ্ণনকে অর্থের জন্য ইন্সটিটিউটের বাইরের উপর নির্ভর করতেই হচ্ছিল। কিন্তু সে সময় দেশের বিজ্ঞাননীতি নির্ধারণের দায়িত্ব ছিল যে সমস্ত বিজ্ঞানীদের হাতে, সেই ভাভা, শান্তিস্বরূপ ভাটনগর বা মেঘনাদদের কেউই কৃষ্ণনের প্রস্তাব সমর্থন করেননি। ফলে ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সে আর কখনোই নিউক্লিয় গবেষণা শুরু হয়নি।
১৯৪৫ সালের দুই পরমাণু বিস্ফোরণ নিউক্লিয় প্রযুক্তির অমিত সম্ভাবনা সম্পর্কে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী ও দেশের নীতি নির্ধারকদের সচেতন করেছিল। রাষ্ট্রের উৎসাহের ফলে নিউক্লিয় গবেষণাতে অর্থবরাদ্দ বাড়ে, এবং নতুন এক যুগের সুচনা হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই অর্থবরাদ্দের সিংহভাগ নিউক্লিয় প্রযুক্তির উন্নতিতেই ব্যবহৃত হয়েছিল, তবে মৌল গবেষণাও তার ফলে উপকৃত হয়েছিল। সেই আলোচনা স্বল্প পরিসরে করা সম্ভব নয়, তাই এই লেখা নিউক্লিয় গবেষণাতে প্রথম যুগেই সীমাবদ্ধ থাকল।
প্রকাশঃ জ্ঞান ও বিজ্ঞান, জানুয়ারি ২০২৩
No comments:
Post a Comment