আপেক্ষিকতাবাদ ও
আইনস্টাইন
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
গত
একশো বছরের সেরা বিজ্ঞানীর নাম জিজ্ঞাসা করলে অধিকাংশ মানুষই একটা নাম বলবেন, আলবার্ট
আইনস্টাইন। সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীদের তালিকায়ও তিনি প্রথম দু-এক জনের মধ্যে জায়গা
করে নেবেন। তাঁর সম্পর্কে যত গল্পকথা প্রচলিত আছে, অন্য কোনো বিজ্ঞানীর সম্পর্কে তা
নেই। মানুষ হিসাবে তিনি ছিলেন নিজের প্রত্যয়ে দৃঢ়, মানবতাবাদী, সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণাতে
বিশ্বাসী।
বিজ্ঞানে
বিপ্লব কথাটা বহু ব্যবহৃত। অনেক আবিষ্কার বা উদ্ভাবনকেই আমরা বৈপ্লবিক বলে থাকি। চাকা
আবিষ্কার, বিদ্যুৎকে মানুষের কাজে লাগানো, বসন্তের টিকা তৈরি, এক্স রে আবিষ্কার, বাতাসের
নাইট্রোজেন থেকে অ্যামোনিয়া প্রস্তুতের পদ্ধতি বা ট্রানজিস্টার উদ্ভাবন – এসব আমাদের
জীবনকে বহুভাবে পালটে দিয়েছে। আর এক ধরনের আবিষ্কার আছে, যাকে আরও গভীর অর্থে বৈপ্লবিক
বলা যায়। কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, ডারউইন – এঁরা আমাদের চারপাশের মহাবিশ্বকে
নতুন ভাবে দেখতে শিখিয়েছেন, আমাদের মনের জগতে যুগান্তর এনেছেন। আইনস্টাইন এঁদের দলেই
পড়বেন। তাঁর আবিষ্কারের প্রভাব পড়েছে বিজ্ঞান প্রযুক্তির গণ্ডি ছাড়িয়ে দর্শনে, শিল্পকলায়,
সাহিত্যে। আধুনিক তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান অনেকভাবেই গণিতনির্ভর, অঙ্ক বাদ দিয়ে আইনস্টাইনের
গবেষণার আলোচনা সহজ নয়। কথায় বলতে গেলে কিছু ভুলচুক বা বিভ্রান্তির সম্ভাবনা থেকেই
যাবে, সে কথা ধরে নিয়েই এগোনো যাক।
আইনস্টাইনের
নাম বললে এখন প্রথমেই মনে আসে দুটি কথা, একটা তাঁর E=mc2 সমীকরণ, অন্যটা
হল অভিকর্ষ তরঙ্গ বা গ্র্যাভিটি ওয়েভ। এই দুটি আইনস্টাইনের দুই রিলেটিভিটি থিওরি বা
আপেক্ষিকতাতত্ত্ব থেকে পাওয়া যায়। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্ব
প্রকাশ করেছিলেন, তার থেকে তিনি ভর ও শক্তির তুল্যতা প্রমাণ করেছিলেন। তার পরে টানা
দশ বছর গবেষণার পরে তিনি তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে পূর্ণ রূপ দিয়েছিলেন, তার
থেকেই মহাকর্ষ তরঙ্গের কথা জানতে পারা যায়। তবে তার অস্তিত্ব তখন বাস্তবে প্রমাণ করা
সম্ভব হয়নি, একশো বছর পরে তা আমাদের যন্ত্রে প্রথম ধরা পড়ে। আজ খুব অল্প কথায় দেখা
যাক এই দুই আপেক্ষিকতা তত্ত্বে আইনস্টাইন কেমন করে আমাদের চেনা জগতকে নতুন করে দেখতে
শিখিয়েছিলেন।
প্রথমেই
বলা যাক বিশেষ আপেক্ষিকতার কথা। সেই মুহূর্তে আইনস্টাইন তাঁর গবেষণা শুরু করেছিলেন,
সেই মুহূর্তে পদার্থবিজ্ঞানের দুটি সুসংবদ্ধ
তত্ত্ব ছিল আইজ্যাক নিউটনের গতিবিদ্যা এবং জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচৌম্বক তত্ত্ব।
প্রথমটি সম্পর্কে আলাদা করে বলার নিশ্চয় দরকার নেই। দ্বিতীয়টি হল চার্জ বা তড়িৎআধান,
তড়িৎপ্রবাহ এবং চুম্বক ও তাদের ফিল্ড বা ক্ষেত্র সম্পর্কিত তত্ত্ব। আমাদের হয়তো কুলম্ব,
আঁদ্রে মারি আ্যাম্পিয়ার, এবং মাইকেল ফ্যারাডের সূত্রের কথা মনে আছে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে
তাঁদের সকলের গবেষণাকে চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিলেন ম্যাক্সওয়েল। তাঁর তত্ত্ব থেকেই বোঝা
যায় আলো আসলে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ।
অথচ
এই দুই তত্ত্ব এক জায়গায় মিলছিল না। ধরা যাক কোনো ট্রেনে আমি যাত্রী। ট্রেন যে দিকে
যাচ্ছে, আমি ট্রেনের মধ্যে সেই দিকেই ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার বেগে হেঁটে যাচ্ছি। স্টেশনে
দাঁড়িয়ে স্টেশন মাস্টার ট্রেনের গতিবেগ মাপলেন ঘণ্টায় একশো কিলোমিটার। তিনি যদি
আমার বেগ মাপেন উত্তর পাবেন ঘণ্টায় একশো পাঁচ কিলোমিটার। এ হল নিউটনের গতিবিদ্যার উত্তর।
এই পর্যন্ত বুঝতে অসুবিধা নেই। কিন্তু এবার ভাবুন কোনো এক রকেটের বেগ আমার সাপেক্ষে
সেকেন্ডে তিরিশ কিলোমিটার। তার ভিতরের এক মহাকাশচারী সামনের দিকে একটা টর্চের আলো ফেললেন।
আমরা জানি আলোর বেগ সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার। তাহলে নিউটনের সূত্র অনুযায়ী
আমি টর্চের আলোর বেগ মাপলে পাব সেকেন্ডে তিন লক্ষ তিরিশ কিলোমিটার। অথচ ম্যাক্সওয়েলের
সূত্র বলে আলোর বেগের মান শূন্যস্থানে অপরিবর্তনীয়, টর্চের আলোর বেগ মেপে তিন লক্ষ কিলোমিটারই পাব।
তাহলে
কে ঠিক, নিউটন না ম্যাক্সওয়েল? সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী নিউটন যে ঠিক তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের
কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু বহুদিন পর্যন্ত পরীক্ষা করে কোনটা ঠিক বোঝা সম্ভব হয়নি,
কারণ আলোর বেগে ওইটুকু তফাৎ মাপার মতো সূক্ষ্ম যন্ত্র ছিল না। সেই যন্ত্র তৈরি করার
পরে দুই বিজ্ঞানী আলবার্ট মাইকেলসন ও এডওয়ার্ড মর্লে আলোর বেগের পার্থক্য মাপতে বসলেন।
রকেট না থাকলেও তাঁদের কাছে সেকেন্ডে তিরিশ কিলোমিটার বেগের যান ছিল, তা হল পৃথিবী।
আমাদের এই গ্রহ মহাশূন্যের মধ্যে প্রতি সেকেন্ডে তিরিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। উনিশ
শতকের একদম শেষে তাকেই রকেটের জায়গায় ব্যবহার করে দেখা গেল ম্যাক্সওয়েলই ঠিক।
অধিকাংশ বিজ্ঞানী নানা রকম কায়দায় নিউটনের গতিবিদ্যা
থেকে এই ঘটনার ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আঁরি পয়ঁকেয়ার, হেনড্রিক
লরেঞ্জের মতো সেই সময়ের প্রথম সারির বিজ্ঞানীরা। আইনস্টাইনকে তখন কেউ চিনতেন না, তিনি
ছিলেন সুইজারল্যান্ডের এক পেটেন্ট অফিসের কেরানি। সেই অখ্যাত গবেষকের দুটি গবেষণাপত্র
বিজ্ঞানীদের বহুদিনের ধ্যানধারণাকে ওলটপালট করে দিল। আইনস্টাইন শুরু করলেন সম্পূর্ণ
বিপরীত দিক থেকে। মাইকেলসনদের পরীক্ষার কথা তিনি জানতেন। কিন্তু সে জন্য নয়, ম্যাক্সওয়েলের
সমীকরণের সিমেট্রি বা প্রতিসাম্য থেকে তিনি ধরে নিলেন যে আলোর শূন্যস্থানে বেগের মান
অপরিবর্তনীয়। আগের উদাহরণে মহাকাশচারীই মাপুন বা আমিই মাপি, আলোর বেগের মান পালটাবে
না।
আরও
একটা শর্ত তিনি ধরে নিলেন, সমস্ত জড়ত্বীয় নির্দেশতন্ত্রে পদার্থবিদ্যার সমস্ত নিয়ম
একই চলে। কথাটা শক্ত শোনালেও আসলে তার মানেটা খুব সোজা। নির্দেশতন্ত্র মানে যার সাপেক্ষে
আমরা সমস্ত কিছু মাপি। ধরা যাক রকেট থেকে মহাকাশচারী আমাকে ছাড়া কাউকে দেখতে পাচ্ছে
না। তাহলে রকেট যদি সমবেগে সরলরেখায় চলে, তাহলে মহাকাশচারীর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যে
সে গতিশীল না আমি। এদের বলে জড়ত্বীয় নির্দেশতন্ত্র। ট্রেনে যাওয়ার সময় আমরা দেখেছি যে কোনো ট্রেন আমাদের
পাশ দিয়ে যায়, তাহলে আমরা কত জোরে যাচ্ছি তা বুঝতে অসুবিধা হয়। এ হল জড়ত্বীয় নির্দেশতন্ত্রের
আরও উদাহরণ। বিজ্ঞানের ভাষায় যে সমস্ত নির্দেশতন্ত্রে নিউটনের প্রথম সূত্র খাটে, তাদের
বলে জড়ত্বীয়।
এই
দুই সামান্য শর্ত থেকে আইনস্টাইন দেখালেন যে আমরা এতদিন যা জানতাম, তার অনেক কিছুই
নতুন করে ভাবতে হবে। নিউটন বলেছিলেন যে সময় সকলের জন্য একই ভাবে চলে, এতদিন বিজ্ঞানীরা
কেউ তা নিয়ে প্রশ্ন করেননি। বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্ব বলল সময়ের গতি নির্দেশতন্ত্রের
গতির উপর নির্ভর করে। মহাকাশচারী দেখবে আমি তার সাপেক্ষে গতিশীল, তাই আমার ঘড়ি তার ঘড়ির থেকে স্লো যাচ্ছে। এর সঙ্গে কিন্তু ঘড়ির
কলকব্জার কোনো সম্পর্ক নেই, সময়ের গতিই ধীর হয়ে গেছে। ঠিক তেমনি আমি দেখব রকেট আমার
সাপেক্ষে গতিশীল, তাই রকেটের ঘড়ি আমার থেকে স্লো। এই দুইয়ের মধ্যে কিন্তু কোনো বিরোধ
নেই, কারণ আমরা আলাদা নির্দেশতন্ত্র থেকে মাপছি। তেমনি স্টেশনমাস্টার যদি চলমান ট্রেনের
দৈর্ঘ্য মাপেন, দেখবেন ট্রেনটা স্টেশন ছাড়ার পরে ছোট হয়ে গেছে। আবার কোনো ট্রেনযাত্রী
স্টেশনের দৈর্ঘ্য মাপলে দেখবেন যে ট্রেন স্টেশন থেকে রওনা হওয়ার পরে স্টেশনের দৈর্ঘ্য
কমে গেছে। ঠিক তেমনি দুটো ঘটনার মধ্যে সময়ের পার্থক্য যে মাপছে তার গতির উপর নির্ভর
করে। ত্রিমাত্রিক স্থান বা দেশ এবং কাল বা সময়কে আলাদা করা যায় না, তার জায়গা নিয়েছে
চতুর্মাত্রিক দেশ কাল। আমদের চিন্তা জগতে এ এক বিপ্লব সন্দেহ নেই। একটা কথা বলে রাখি,
পয়ঁকেয়ার ও লরেঞ্জ এই সময় বা দৈর্ঘ্যের এই পরিবর্তনগুলিই পেয়েছিলেন, কিন্তু তার প্রকৃত
তাৎপর্য বুঝতে পারেননি। এছাড়া এখান থেকেই আইনস্টাইন দেখালেন যে ভর ও শক্তি আসলে এক।
বস্তুর ভরও তার আপেক্ষিক বেগের উপর নির্ভর করে।
বিশেষ
আপেক্ষিকতাতত্ত্ব আলোচনা ছেড়ে যাওয়ার আগে একটা কথা বুঝে নেওয়া যাক। আমরা যে সাধারণ
গতিতে অভ্যস্ত, তাতে দৈর্ঘ্য বা সময়ের পরিবর্তনের পরিমাণ খুব কম। ঘণ্টায় একশো কিলোমিটার
বেগে গতিশীল ট্রেনের দৈর্ঘ্য পালটাবে একটা পরমাণুর ব্যাসের থেকেও কম, তা কোনাও ভাবেই
মাপা সম্ভব নয়। সেজন্যই আইনস্টাইনের আগে বিজ্ঞানীরা এই পরিবর্তন বুঝতে পারেননি। কিন্তু
আধুনিক কণা পদার্থবিদ্যাতে আমরা কণাদের প্রায় আলোর বেগের কাছাকাছি নিয়ে যাই, সেখানে
এই সমস্ত পরিবর্তন সহজেই মাপা যায়। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে, আপেক্ষিকতাবাদ অনুযায়ী কোনো বস্তুকণা আলো বা তার
থেকে বেশি বেগ নিয়ে যেতে পারবে না।
সাধারণ
আপেক্ষিকতাবাদে আইনস্টাইন শুধু জড়ত্বীয় নয়, যে কোনো ধরনের নির্দেশতন্ত্রের কথা ধরেছিলেন।
রকেট সমবেগে না চললেও সাধারণ আপেক্ষিকতাতত্ত্বের সমীকরণ কাজ করবে। লিফট যখন উপরে উঠতে
শুরু করে, নিজেকে ভারি লাগে। আবার যখন থামতে যায়, ওজন কম মনে হয়। ওজন হয় মাধ্যাকর্ষণের
জন্য। সমবেগে না চললে আমরা বলি ত্বরণসম্পন্ন গতি। আইনস্টাইন বললেন যে না জানা থাকলে আমরা মাধ্যাকর্ষণ এবং ত্বরণসম্পন্ন গতিকে আলাদা করতে পারব না। এও প্রতিসাম্যের
এক উদাহরণ। তাদের একই নিয়মে বাঁধা যায়, সেই নিয়মই হল সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বে মাধ্যাকর্ষণ হল একটা বল। নতুন তত্ত্বে মহাকর্ষ বল নয় -- দেশকালের বিকৃতি।
এই বিষয়টা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। নিউটনের প্রথম
গতিসূত্র অনুসারে বস্তুর উপর বল প্রয়োগ না করলে সে সমবেগে সরলরেখায় চলতে থাকবে।
পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে।, সূর্যের আকর্ষণ বল তাকে সরল রেখায় যেতে দেয় না,
এই ছিল নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের কথা। আইনস্টাইন দেখালেন যে পৃথিবী আসলে সোজা
রাস্তায়ই যাচ্ছে, কিন্তু সূর্যের টানে সোজা রাস্তাটাই গেছে বেঁকে। যে বস্তুর ভর যত
বেশি, তার দেশকালকে বিকৃত করার ক্ষমতাও বেশি। একটা রবারের পর্দা টানটান করে
অনুভূমিক ভাবে বেঁধে রেখেছি। আমরা যদি একটা হালকা মার্বেলের গুলি নিয়ে গড়িয়ে দিই,
সেটা ঠিক সরলরেখা বরাবর যাবে। এবার পর্দার ঠিক মাঝখানে একটা ভারি বাটখারা রেখে
দিলাম। আমরা দেখব যে এবার মার্বেলের গুলিটা বাটখারাটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার
দিকে বেঁকে গেল। তার মানে কি বাটখারা আর গুলির মধ্যে আকর্ষণ বল কাজ
করছে? তা নয়, বাটখারা পর্দাকে বাঁকিয়েছে, গুলিটা সেই বাঁকা পথ অনুসরণ করছে। ঠিক
তেমনি ভর বা শক্তি তার আশেপাশে দেশকালকে বাঁকিয়ে দেয়, সেই দেশকালের বক্রতার জন্য
অন্য বস্তুর পথ বেঁকে যায়। আমাদের মনে হয় আকর্ষণ বল কাজ করছে। শেষ বিচারে সাধারণ
আপেক্ষিকতাবাদকে আমরা জ্যামিতি বলতেই পারি, তবে এই জ্যামিতি আমরা স্কুলে যে
ইউক্লিডিয় জ্যামিতি পড়েছি তার থেকে আলাদা। এখানে সমান্তরাল রেখারা মিলে যেতে পারে,
ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি একশ আশি ডিগ্রির চাইতে কম বা বেশি হতে পারে। এই আরও এক জায়গা যেখানে আইনস্টাইন আমাদের
নতুন করে ভাবতে শেখালেন, জ্যামিতি হয়ে দাঁড়াল পদার্থবিজ্ঞানের অংশ।
এতদিন নিউটনের তত্ত্ব দু একটা জায়গা ছাড়া
সব কিছুর সুন্দর ব্যাখ্যা দিচ্ছিল। আইনস্টাইন দেখালেন যে মহাকর্ষ ক্ষেত্রের মান যদি খুব বেশি
না হয়, তাহলে তাঁর এবং নিউটনের হিসাবের কোনো পার্থক্য হয় না বললেই চলে। একমাত্র
যেখানে মাধ্যাকর্ষণ খুব জোরালো, সেখানেই আমরা দুই তত্ত্বের মধ্যে তফাত খুঁজে পাব। তেমনই এক জায়গা হল সূর্যের আশপাশ, সেখানে মহাকর্ষ ক্ষেত্রের মান বেশি। যেমন বুধ সূর্যের খুব কাছে আছে, তাই বুধের কক্ষপথের হিসাব নিউটনের সূত্র থেকে মেলে
না। আইনস্টাইনের তত্ত্ব থেকে বুধের কক্ষপথের হিসাব ঠিকঠাক মিলে গেল। তেমনি ১৯১৯ সালেই বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন সূর্যগ্রহণের সময় ছবি তুলে দেখালেন সূর্যের
পাশ দিয়ে আসার সময় তারার আলো ঠিক আইনস্টাইনের সমীকরণ অনুসারেই বেঁকে গেছে।
আইনস্টাইন দেখিয়েছিলেন যে দুর্বল
মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে দেশকালের যে সামান্য বিকৃতি হয়, তা এক তরঙ্গ সমীকরণ মেনে চলে।
পুকুরের জলে একটা ঢিল ফেলা হল, দেখব যে জলে ঢেউ উঠল। ঠিক তেমনি যদি দেশকালকে
কোনোভাবে নাড়াচাড়া করি, তাহলে তার যে তোলপাড় হবে সেটা ঠিক জলের ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে
পড়বে। সাধারণত এই ঢেউয়ের তীব্রতা এতই ক্ষীণ তাকে
ধরাটা শক্ত। আমাদের পরীক্ষাগারে সেরকম জোরদার ঢেউ তৈরি আমাদের ক্ষমতার বাইরে, কিন্তু
মহাবিশ্বে এমন অনেক ঘটনাতে অতি তীব্র মহাকর্ষীয় ঢেউ তৈরি হয়। দূরের কোনো জায়গার মহাকর্ষের ঢেউ তৈরি হলে আমাদের কাছে আসতে আসতে স্বাভাবিক
ভাবেই দুর্বল হয়ে পড়ে -- তাই আমাদের যন্ত্রে তাকে ধরা সহজ নয়। অবশেষে ১৯১৫ সালে
দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষে তৈরি মহাকর্ষ ঢেউ সরাসরি ধরা পড়ল যে যন্ত্রে, তার নাম
লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি, সংক্ষেপে লাইগো। এই কৃষ্ণ গহ্বরও সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সমীকরণ থেকে
পাওয়া।
আপেক্ষিকতাবাদের এমন একটা অঙ্কের কথা
বলি, যা আমাদের রোজ কাজে লাগে। মহাকাশের কৃত্রিম উপগ্রহের সঙ্গে রেডিয়ো তরঙ্গের মাধ্যমে
যোগাযোগ করে পৃথিবীতে কোনো জিপিএস রিসিভারের অবস্থান নির্ণয় করা হয়। এর জন্য উপগ্রহের
ঘড়ি থেকে অত্যন্ত সঠিক সময় পাওয়া দরকার। উপগ্রহগুলি মহাকাশে পৃথিবীর চার দিকে ঘুরছে।
তাদের বেগের জন্য তাদের ঘড়িতে সময়ের প্রবাহ ধীরগামী। আবার মহাকাশে পৃথিবীর অভিকর্ষ
কম, সে জন্য তাদের ঘড়ির সময় সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুসারে পরিবর্তিত হয়, পৃথিবীর ঘড়ির
থেকে তারা দ্রুত চলে। এই দুয়ের জন্য ঘড়িতে সময়ের পরিবর্তন হতে পারে দিনে এক সেকেন্ডের
এক লক্ষ ভাগের চার ভাগ। জিপিএস-এ এই হিসাব অবশ্যই মাথায় রাখতে হয়।
আইনস্টাইন
আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। তিনি আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন,
তার বৈপ্লবিক তাৎপর্য আপেক্ষিকতাবাদের থেকে কম নয়। আমরা সবাই জানি সত্যেন্দ্রনাথ ও
তাঁর গবেষণার সুবাদে বোস আইনস্টাইন সংখ্যায়ন পাওয়া গিয়েছিল। লেজারের মূলসূত্র এসেছে
তাঁর গবেষণা থেকে। তিনিই কসমোলজি নামে এক নতুন বিজ্ঞানের গোড়াপত্তন করেছিলেন। তিনি
বিভিন্ন ধরনের বলকে একই তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন, সেই সময়ে
তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিশেষ উৎসাহী না হলেও তা বর্তমান গবেষণার সামনের সারিতে আছে, আধুনিক
স্ট্রিং থিয়োরি তারই এক পদ্ধতি। এ সমস্ত নিয়ে অন্য সময় আলোচনা করা যাবে। কিন্তু এই
সমস্ত গবেষণাতেই তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন, নতুন দিকের সন্ধান দিয়েছিলেন।
মৃত্যুর পঁয়ষট্টি বছর পরেও তিনি প্রাসঙ্গিক, খুব কম বিজ্ঞানীর সম্পর্কে এই কথা বলা
যায়।
(Quarantine Chronicles ফেসবুক পেজে আইনস্টাইনের প্রয়াণদিবসে এই লেখাটা পড়া হয়েছিল।
এই ব্লগের অন্য লেখাতে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ ও সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত লেখা আছে।)
(Quarantine Chronicles ফেসবুক পেজে আইনস্টাইনের প্রয়াণদিবসে এই লেখাটা পড়া হয়েছিল।
এই ব্লগের অন্য লেখাতে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ ও সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত লেখা আছে।)
No comments:
Post a Comment