মহাকাশের মাপনি
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
আকাশের গ্রহনক্ষত্র নিয়ে মানুষের আগ্রহ
চিরদিনের, তাই জ্যোতির্বিদ্যাকে বলা হয় প্রথম সচেতন বিজ্ঞান। ক্যালেন্ডার বা
পঞ্জিকা তৈরির প্রয়োজন হয়েছিল কৃষিকাজের জন্য, যুদ্ধযাত্রার জন্য; হয়তো তারও আগে মানুষকে
শিকারের মরশুমের কথা ভাবতে হয়েছিল। আকাশের চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র – এরা
ক্যালেন্ডার তৈরিতে সাহায্য করত, তাই প্রথম যুগেই তাদের গতিবিধি সম্পর্কে জানার
প্রয়োজন হয়েছিল। এদের মধ্যে চাঁদ ও সূর্য দৃশ্যতই অন্যদের থেকে আলাদা। গ্রহদের
চেনাও সহজ ছিল, কারণ আমাদের চোখে তাদের নক্ষত্রদের থেকে বড় দেখায়, তাদের আলো
স্থির, নিয়মিত লক্ষ্য রাখলে দেখা যায় যে তাদের আপেক্ষিক অবস্থান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে
পাল্টে যায়। প্রাচীন যুগের জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাস খুবই চিত্তাকর্ষক, কিন্তু
আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় আলাদা।
প্রাচীন যুগে জ্যোতিষ আর জ্যোতির্বিদ্যাকে আলাদা করার উপায় ছিল না। শুধুমাত্র আকাশের
জ্যোতিষ্কদের গতিবিধি নয়, তাদের গঠন, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নিয়ে যে বিজ্ঞানে চর্চা
হয়, তাকে আমরা জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান বা অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বলি। আধুনিক কালে
অ্যাস্ট্রোকেমিস্ট্রি বা অ্যাস্ট্রোবায়োলজিও গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান হিসাবে জায়গা
করে নিচ্ছে। পরীক্ষানিরীক্ষার উপরে জোর দেওয়া হল আধুনিক বিজ্ঞানের একটা বড়
বৈশিষ্ট্য। জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে বিজ্ঞানের অধিকাংশ শাখার পার্থক্য এই যে
গ্রহ নক্ষত্র গ্যালাক্সি সহ মহাবিশ্বের এক অতি ক্ষুদ্র অংশকে আমরা আমাদের ল্যাবরেটরিতে
পরীক্ষার সুযোগ পাই। অপর এক সমস্যা হল যে গ্রহ নক্ষত্রদেরও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে
বিবর্তন হয়, কিন্তু কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া তা এতই ধীর গতিতে যে তা একজন মানুষের
জীবনকাল, এমনকি আমাদের সভ্যতার বয়সের থেকেও অনেক বড়। সূর্য অন্তত চারশো পঞ্চাশ
কোটি বছর ধরে আলো দিচ্ছে, প্রায় একই সময় এইভাবেই বিকিরণ করবে। আমাদের সভ্যতার বয়স
তার তুলনায় কতটুকু? তাই আমাদের পর্যবেক্ষণে তাদের বিবর্তন ধরা পড়ে না। নক্ষত্রদের
মধ্যে কী বিক্রিয়া চলছে, তার গঠন কিরকম, কেমন করে তারা তৈরি হল, কীভাবে তাদের
মৃত্যু ঘটে -- এসব জানতে তাই আমাদের প্রয়োজন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বের। তত্ত্ব
নির্মাণের জন্য প্রয়োজন তথ্যের;
নক্ষত্রদের ভর কত, কী দিয়ে তারা তৈরি, কত দূরে তারা আছে, তাদের তাপমাত্রা
কত – এ সমস্ত নানা খবর জানতে হবে। কিন্তু কেমন করে? স্কেল, থার্মোমিটার, ওজনযন্ত্র
তো এক্ষেত্রে অচল - তাহলে কোন মাপনি আমরা ব্যবহার করব? কেমন করে এই সমস্ত তথ্য
আমরা জোগাড় করতে পারি – তাই নিয়েই এই প্রবন্ধ।
একটা কথা মনে রাখা দরকার। যে কোনো
রকমের মাপে কিছু না কিছু ত্রুটি থেকে যাবে। পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে যেরকম
নিখুঁত ভাবে মাপা সম্ভব, দূরত্বের কারণে জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে প্রায়শই তা
আমাদের ক্ষমতার বাইরে। ইলেকট্রনের ভরের মাপে ত্রুটির পরিমাণ ভরের 10-8 অর্থাৎ দশ
কোটি ভাগের এক ভাগের বেশি নয়। কিন্তু আমরা লুব্ধক নক্ষত্রের ভরের মাপে এক শতাংশ
ভুল আমরা মেনে নেব, এমনকি ঘরের কাছের নক্ষত্র সূর্যের ভরেও এক লক্ষ ভাগের তিন ভাগ
পর্যন্ত ত্রুটি নিয়ে আমরা চিন্তিত হই না।
মাপের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে দূরত্বের
কথা। জ্যোতিষ্কে গিয়ে দূরত্ব মাপার প্রশ্ন ওঠে না। সামনে যে কলমটা রাখা আছে, তা
হাত বাড়িয়ে নেওয়াটা খুব সহজ, আমার মস্তিষ্ক হাতকে নির্দেশ দেয় কোথায় যেতে হবে।
কিন্তু ফিতে দিয়ে না মেপে মস্তিষ্ক কলমের দূরত্বটা মাপে কেমন করে? কোনো বস্তুর
দিকে তাকালে আমাদের দুই চোখ ঠিক একই রকম প্রতিবিম্ব আমাদের রেটিনাতে গঠন করা না,
কারণ তারা আলাদা কোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করছে। আমাদের মস্তিষ্ক সেই দুটি ছবিকে বিশ্লেষণ করে তার থেকে
দূরত্ব বার করে। এক চোখ বন্ধ করে কলমটা হাতে নেওয়ার চেষ্টা করলেই
বিষয়টা বোঝা যাবে। কিন্তু বস্তুটা যত দূরে যাবে, দুই চোখের প্রতিবিম্ব তত একইরকম হবে, তখন দূরত্ব মাপার সমস্যা বাড়বে। অনেক দূরের বস্তুর এভাবে মাপাই সম্ভব নয়। দুরের
পাহাড়ের দূরত্ব যদি চোখের আন্দাজে না মাপতে পারি, তাহলে গ্রহ নক্ষত্রদের দূরত্ব
মাপব কেমন করে?
আমাদের দুটো
চোখের মধ্যের ফাঁক কয়েক সেন্টিমিটার, এটা যদি অনেকটা বাড়াতে পারতাম তাহলে দু’চোখের
প্রতিবিম্ব অনেকটা আলাদা হত। সেক্ষেত্রে আমরা আরো বেশি দূরের বস্তুর দূরত্ব মাপতে
পারতাম। সেটা বাড়াব কেমন করে? উপরের বাঁদিকের ছবিটা দেখুন। এখানে 1 ও 2 ছয় মাস আগে
পরে পৃথিবীর অবস্থান। এই দুই অবস্থানে দূরবিন হল দুই চোখ যাদের মধ্যে তফাৎটা তাহলে
পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাস অর্থাৎ তিরিশ কোটি কিলোমিটার। অপেক্ষাকৃত কাছে যে নক্ষত্র
আছে, দূরের নক্ষত্রদের সাপেক্ষে 1 ও 2 বিন্দু থেকে
তার অবস্থান পাল্টে যাচ্ছে। দূরের নক্ষত্ররা এতই দূরে আছে যে ওই দুই বিন্দু থেকে
দেখলেও তাদের অবস্থান পাল্টায় না; এই কথাটায় আবার আসব। বোঝার সুবিধার জন্য ছবিতে নক্ষত্রটাকে
খুব কাছে দেখানো হয়েছে। তাহলে ছ’মাস আগে পরে নক্ষত্রটার অবস্থান নির্ণয় করে p কোণের মান নির্ণয় সম্ভব। এই কোণটাকে বলে লম্বন (parallax)। এখানে d হল পৃথিবী ও সূর্যের গড় দূরত্ব, একে বলে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট, সংক্ষেপে এইউ(AU)। অর্থাৎ 1 এইউ = 15 কোটি কিলোমিটার। এখন রাডার ব্যবহার করে এই মানটা খুব নিখুঁত ভাবে মাপা সম্ভব হয়েছে, তবে
তারও আগে এই লম্বন পদ্ধতি ব্যবহার করেই আমরা পৃথিবী সূর্যের গড় দূরত্ব মেপেছিলাম। সৌরজগৎ
থেকে নক্ষত্রটার দূরত্বকে D দিয়ে বোঝানো হয়েছে।
ডানদিকের ছবির
সূর্য, পৃথিবী ও নক্ষত্র দিয়ে গঠিত সমকোণী ত্রিভুজটা বাঁদিকে আলাদা করে দেখানো
হয়েছে। কোণ p খুব ছোটো হলে, আমরা জানি
এই সমীকরণে লম্বন p-এর মান রেডিয়ানে দেওয়া আছে। সাধারণত লম্বনের মান
সেকেন্ডে মাপা হয়। ষাট মিনিটে এক ডিগ্রি, ষাট সেকেন্ডে এক মিনিট, অর্থাৎ এক
সেকেন্ড হল এক ডিগ্রির 3600 ভাগের এক
ভাগ। এক রেডিয়ান মোটামুটি 57.3 ডিগ্রি,
অর্থাৎ এক সেকেন্ড = এক রেডিয়ান/206280। আগেই দেখেছি d হল পনের কোটি কিলোমিটার =1.5X108 কিলোমিটার। তাই কোনো নক্ষত্রের লম্বন যদি এক
সেকেন্ড হয়, তাহলে তার দূরত্ব হবে
D=1.5X108 কিলোমিটার/(1/206280)=3.086X1013 কিলোমিটার=3.26 আলোকবর্ষ
এই 3.26 আলোকবর্ষকে বলে 1 পারসেক। পারসেক হল জ্যোতির্বিদ্যাতে দূরত্ব মাপার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত একক। সৌরজগত
থেকে ঐ দূরত্বের মধ্যে কোনো নক্ষত্র নেই। যদি লম্বনের মান 0.1 সেকেন্ড হয়, দূরত্ব হবে 32.6 আলোকবর্ষ বা 10 পারসেক। আমাদের নিকটতম নক্ষত্র
প্রক্সিমা সেন্টাউরির লম্বন 0.768, অর্থাৎ
তার দূরত্ব হল 1/0.768 পারসেক = 1.3 পারসেক বা 4.2 আলোকবর্ষ। । লুব্ধকের লম্বন হল 0.385 সেকেন্ড, তার থেকে বুঝতে পারিও তার দূরত্ব হল 2.6 পারসেক। এভাবেই নক্ষত্রদের দূরত্ব মাপা শুরু হয়েছিল। এখানেই দেখা যাচ্ছে যে D যদি খুব বড় হয়, তাহলে p-এর মান খুব কমে যাবে। সেজন্যই ছ’মাস আগে পরে পর্যবেক্ষণ করলেও খুব দূরের
নক্ষত্রদের অবস্থান পাল্টায় না।
এভাবে কত দূর
পর্যন্ত মাপতে পারি? আমরা দূরবিনে কত ছোট কোণ মাপতে পারি তার একটা সীমা আছে, সেটা 10-5 সেকেন্ডের কাছাকাছি বলে ধরে নিতে
পারি। কিন্তু সেই সীমাতে পৌঁছানোর অনেক আগেই সমস্যা আসে। আমরা দেখেছি যে নক্ষত্রদের
আলো ঝিকমিক করে। বায়ুপ্রবাহ ইত্যাদি কারণে বায়ুমণ্ডলের প্রতিসরাঙ্ক সবসময়
পরিবর্তিত হচ্ছে, ফলে নক্ষত্র থেকে আসা আলোর গতিপথও পাল্টে যাচ্ছে। তাই নক্ষত্রের
প্রতিবিম্ব স্থান পরিবর্তন করে, আমাদের মনে হয় সে ঝিকমিক করছে। প্রতিবিম্ব যেহেতু
এক জায়গায় থাকে না, লম্বনের মানও পালটে পালটে যায়। তাই 10-2 সেকেন্ডের থেকে
লম্বন কম হলে পৃথিবীতে বসে তা ঠিকঠাক মাপা সম্ভব নয়। লম্বন 10-2 অর্থ দূরত্ব একশো পারসেক, তাহলে যে সমস্ত
নক্ষত্র তার থেকে দূরে আছে, তাদের দূরত্ব মাপব কেমন করে?
বায়ুমণ্ডলের
বাইরে থেকে যদি লম্বন মাপা হয়, তাহলে এই সমস্যা থাকে না। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির
হিপ্পারকস উপগ্রহ 1989 থেকে 1993 পর্যন্ত মহাকাশে অবস্থান করে লম্বন পদ্ধতিতে নক্ষত্রদের
দূরত্ব মেপেছে। হিপ্পারকস 10-3 পর্যন্ত
লম্বন মাপতে পারত। এক লক্ষেরও বেশি নক্ষত্রের
দূরত্ব এভাবে মাপা গেছে। ওই এজেন্সিরই গাইয়া উপগ্রহ 2013 থেকে কাজ করছে। গাইয়া 2.4X10-5 পর্যন্ত লম্বন মাপতে পারে, তাই তার
দূরত্ব মাপার পাল্লা হল চল্লিশ হাজার পারসেক বা একলক্ষ তিরিশ হাজার আলোকবর্ষ। আমাদের
ছায়াপথ মোটামুটি এক লক্ষ আলোকবর্ষ চওড়া, তাই ছায়াপথের শেষ সীমা পর্যন্ত নক্ষত্রদের
দূরত্ব মাপা গাইয়ার পক্ষে সম্ভব। একশো কোটি নক্ষত্রের দূরত্ব মাপার কাজ করে চলেছে
গাইয়া, শেষ হতে আরো কয়েক বছর সময় লাগবে। ছায়াপথে নক্ষত্রের সংখ্যা অবশ্য তার কয়েকশো
গুণ, একটা ন্যূনতম ঔজ্জ্বল্য না থাকলে লম্বন মাপা সম্ভব নয়।
কিন্তু এতো গেল ছায়াপথের কথা।
মহাবিশ্বে হাজার হাজার কোটি গ্যালাক্সি আছে, তাদের দূরত্ব অনেক বেশি। আমাদের
সবচেয়ে কাছের যে পূর্ণাঙ্গ গ্যালাক্সি আছে, সেই অ্যান্ড্রোমিডা যে আমাদের থেকে প্রায়
পঁচিশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে আছে, তা মাপলাম কেমন করে? লম্বন পদ্ধতি সেখানে অচল।
ধরা যাক কোনো একটা আলোর উৎস আছে
যার থেকে প্রতি সেকেন্ডে কত শক্তি বেরোচ্ছে আমরা জানি। একটা 10 ওয়াটের বাল্ব এক
মিটার দূর থেকে যত উজ্জ্বল দেখাবে, দু মিটার দূর থেকে তার ঔজ্জ্বল্য হবে তার ঠিক
চার ভাগের এক ভাগ। মহাকাশে যদি কোনো এরকম কিছু পাওয়া যায়, তাহলে তার পৃথিবীতে
প্রতি সেকেন্ডে কত শক্তি আসছে তা মেপে আমরা তার দূরত্ব নির্ণয় করতে পারি। ধরা যাক
তার থেকে প্রতি সেকেন্ডে E পরিমাণ শক্তি নির্গত
হচ্ছে। উৎসের থেকে D দূরত্বে যদি প্রতি
একক ক্ষেত্রফলের মধ্যে দিয়ে লম্বভাবে I পরিমাণ শক্তি যায়, তাহলে
I=E/4πD2
পৃথিবীতে বসে I মাপা খুব সহজ, তাই E জানা থাকলে দূরত্ব D পাওয়া যাবে। একে বলে স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডল পদ্ধতি। আমরা দুটো স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডলের কথা আলোচনা করব।
প্রথমটা হলে সেফিড ভেরিয়েবল বা
পরিবর্তনশীল নক্ষত্র। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে এদের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে কমে। এবার
নিচের ছবিটার দিকে তাকান। এখানে সেফিড ভেরিয়েবলের ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে তার
পর্যায়কাল, অর্থাৎ তার একবার বাড়তে কমতে করতে সময় লাগবে তা দেখানো হয়েছে। ওই
সরলরেখা দুটো দু ধরনের সেফিডের ঔজ্জ্বল্য আর পর্যায়কালের মধ্যে সম্পর্ক দেখাচ্ছে।
এখানে একটা কথা বলে রাখি, জ্যোতির্বিদ্যাতে দুইরকম ঔজ্জ্বল্যের কথা আছে। আপাত
ঔজ্জ্বল্য হল পৃথিবী থেকে আমরা জ্যোতিষ্কটাকে কতটা উজ্জ্বল দেখি, নিরপেক্ষ
ঔজ্জ্বল্য জ্যোতিষ্কটা আসলে কতটা উজ্জ্বল তা বোঝায়-- সে কথা এই লেখার পরিশিষ্টে পাওয়া
যাবে। এই লেখাতে আমরা ঔজ্জ্বল্য বলতে সবসময় দ্বিতীয়টা বুঝব। ঔজ্জ্বল্য ঋণাত্মক
দেখে ঘাবড়ানোর কিছু নেই, ঐতিহাসিক কারণে জ্যোতিষ্কদের ঔজ্জ্বল্যের মাপটা এমনই হয়ে
গেছে যে যত উজ্জ্বল, তার ঔজ্জ্বল্যের মাপ তত কম। দু ধরনের সেফিডের মধ্যে তফাত করাও
শক্ত নয়, প্রথম শ্রেণির সেফিডদের বর্ণালীতে ধাতুর রেখা দেখা যায়, দ্বিতীয় শ্রেণির
সেফিডে তারা অনুপস্থিত। (জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম ছাড়া
সবই ধাতু, এমনকি নাইট্রোজেন অক্সিজেন কার্বন -- এরা সবাই ধাতু!) পর্যায়কাল বার করা
খুব সোজা, একবার ঔজ্জ্বল্যটা মেপে নিলাম, তারপর আবার বেড়ে কমে যখন আগের জায়গায়
ফিরে এলো, মাঝের সময়টাই পর্যায়কাল। সেফিডের ঔজ্জ্বল্য ও পর্যায়কালের মধ্যে
সম্পর্কটা নির্ণয় করেছিলেন মহিলা বিজ্ঞানী হেনরিয়েটা লেভিট। লেভিট ও তাঁর মতো অনেক
মহিলাই উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের শুরুতে হার্ভার্ড মানমন্দিরে কাজ করতেন।
তাঁদের বলা হত হার্ভার্ড কম্পিউটার্স – এখানে কম্পিউটার অর্থে গণক। সমকাল তাঁদের
বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকার করতে কুণ্ঠা বোধ করলেও জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসে তাঁদের অবদান
এখন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। ব্লগের এই লেখাতে তাঁদের কথা পড়া যাবে।
দেখা
যাচ্ছে যে সেফিডের পর্যায়কাল জানা থাকলে তার ঔজ্জ্বল্য মাপা সম্ভব, অর্থাৎ আমরা
উপরের সমীকরণে E জেনে গেছি। তাহলে পৃথিবীতে আমাদের
টেলিস্কোপে প্রতি সেকেন্ডে তার থেকে কত শক্তি এসে পড়ছে মেপে তার দূরত্ব মাপা
সম্ভব। আমাদের থেকে অন্য গ্যালাক্সিদের দূরত্ব বিশাল, গ্যালাক্সির সাইজ তার কাছে
খুবই কম। তাই সেই গ্যালাক্সির সেফিডের দূরত্বকেই আমরা গ্যালাক্সির গুরুত্ব ধরে
নিতে পারি। এভাবেই অ্যান্ড্রোমিডার মতো আমাদের কাছাকাছি গ্যালাক্সিদের দূরত্ব মাপা
হয়েছে।
অপেক্ষাকৃত দূরের গ্যালাক্সিদের
ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি চলবে না, কারণ সেখানে একটা নক্ষত্রকে আলাদা করে আমরা দেখতে পাই
না। তাই সেফিড চেনা সম্ভব নয়। তাদের ক্ষেত্রে যে স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডল আমরা
ব্যবহার করি, তা হল এক বিশেষ ধরনের বিস্ফোরণ যাদের বলে ওয়ান এ সুপারনোভা। আমরা
জানি সুপারনোভা বিস্ফোরণে এতই শক্তি বেরোয় যে গোটা একটা গ্যালাক্সির থেকেও
সুপারনোভাকে সাময়িকভাবে উজ্জ্বল দেখায়, পরে তা আস্তে আস্তে কমে যায়। ওয়ান এ
সুপারনোভা কেমনভাবে হয় তার আলোচনায় যাচ্ছি না, কিন্তু সমস্ত ওয়ান এ সুপারনোভার
সর্বোচ্চ ঔজ্জ্বল্যের মান সমান। তাই সেফিডের মতো একই সমীকরণ ব্যবহার করে
সুপারনোভার দূরত্ব বার করা সম্ভব। এখানে একটা সুবিধা হল যে সুপারনোভা যে কোনো
সাধারণ নক্ষত্রের থেকে অনেক বেশি উজ্জ্বল, তাই বহু দূরের গ্যালাক্সিতে বিস্ফোরণ
হলেও তার দূরত্ব মাপা সম্ভব। কিন্তু অসুবিধা হল যে ওয়ান এ সুপারনোভা বিস্ফোরণ একটা
গ্যালাক্সিতে একশো বছরে গড়ে একটাও ঘটে না। তাই অধিকাংশ গ্যালাক্সির দূরত্ব এভাবে
মাপা সম্ভব নয়।
সব থেকে দূরের গ্যালাক্সিদের
দূরত্ব মাপার জন্য এক সম্পূর্ণ অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তার জন্য আমাদের
গ্যালাক্সির বেগটা জানতে হয়। ডপলার ক্রিয়ার সাহায্যে আমাদের সাপেক্ষে কোনো নক্ষত্র
বা গ্যালাক্সির বেগ মাপা যায়। ডপলার ক্রিয়া কী? স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি, সামনে দিয়ে
একটা এক্সপ্রেস ট্রেন হুইসল দিতে দিতে চলে যাচ্ছে। যখন সে আমার দিকে আসছে, তখন তার
হুইসলের স্বরগ্রাম অর্থাৎ কম্পাঙ্ক বেশি মনে হচ্ছে। যখন আমার থেকে দূরে চলে
যাচ্ছে, হুইসলের কম্পাঙ্ক কমে যাচ্ছে। একে বলে ডপলার ক্রিয়া। আলোর ক্ষেত্রেও একই
ঘটনা ঘটে। যে জ্যোতিষ্ক আমাদের দিকে আসছে, তার থেকে নির্গত আলোর কম্পাঙ্ক বেড়ে
যায়, যে আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তার কম্পাঙ্ক কমে যায়। এই কম্পাঙ্ক বাড়া কমা
থেকে উৎসের বেগ নির্ণয় করা যায়।
আমরা জানি প্রায় তেরোশো কোটি বছর
আগে বিগ ব্যাঙ বিস্ফোরণে মহাবিশ্বের জন্ম, তার পর থেকে তা প্রসারিত হচ্ছে। ফলে
গ্যালাক্সিরা সাধারণভাবে এক অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। প্রায় সব গ্যালাক্সি যেহেতু আমাদের থেকে দূরে
চলে যাচ্ছে, তাই তাদের আলোর কম্পাঙ্ক কমে যায়। একে বলে মহাজাগতিক লোহিতাপসরণ (Cosmological red shift)। দূরের গ্যালাক্সিদের বেগ আলোর
বেগের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, তাই সেখানে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের জন্য কম্পাঙ্কের
পরিবর্তন ও বেগের মধ্যের সম্পর্কটা একটু অন্যরকম। বিজ্ঞানী এডউইন হাবল দেখিয়েছিলেন
যে দূরের গ্যালাক্সিদের বেগ v এবং দূরত্ব D-এর মধ্যে একটা খুব সহজ সম্পর্ক আছে। সেটা হল
v=Hd
H-কে বলা হয় হাবলের ধ্রুবক। এর মান
হল 67.4 কিলোমিটার/সেকেন্ড/মেগাপারসেক।
মেগাপারসেক মানে দশ লক্ষ পারসেক। অর্থাৎ আমাদের থেকে একহাজার মেগাপারসেক দূরে যে
গ্যালাক্সি আছে, সে আমাদের থেকে এক সেকেন্ডে মোটামুটি 67400 কিলোমিটার দূরে সরে
যাচ্ছে।
এই মানটা পেলাম কেমন করে? সেফিড তারা বা সুপারনোভা থেকে যেসব গ্যালাক্সির দূরত্ব মাপা গেছে, তাদের D জানি। ডপলার ক্রিয়া থেকে তাদের v-এর মান মাপলাম। এই দুটো মাপ থেকে H-এর মান সহজেই বার করে নেওয়া সম্ভব। এবার যে গ্যালাক্সির দূরত্ব জানি না, ডপলার ক্রিয়া থেকে তার বেগ বার করে উপরের সম্পর্কটা ব্যবহার করে দূরত্ব নির্ণয় করা খুব সহজ। এভাবে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে দূরের যে জ্যোতিষ্কের খোঁজ আমরা পেয়েছি তা হল এক 1339 কোটি আলোকবর্ষ দূরের এক গ্যালাক্সি GN-z11। দূরত্ব নির্ণয় করার আরো কিছু পদ্ধতি আছে, তবে আমরা যেগুলো আলোচনা করলাম সেগুলিই বেশি ব্যবহার করা হয়।
এই মানটা পেলাম কেমন করে? সেফিড তারা বা সুপারনোভা থেকে যেসব গ্যালাক্সির দূরত্ব মাপা গেছে, তাদের D জানি। ডপলার ক্রিয়া থেকে তাদের v-এর মান মাপলাম। এই দুটো মাপ থেকে H-এর মান সহজেই বার করে নেওয়া সম্ভব। এবার যে গ্যালাক্সির দূরত্ব জানি না, ডপলার ক্রিয়া থেকে তার বেগ বার করে উপরের সম্পর্কটা ব্যবহার করে দূরত্ব নির্ণয় করা খুব সহজ। এভাবে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে দূরের যে জ্যোতিষ্কের খোঁজ আমরা পেয়েছি তা হল এক 1339 কোটি আলোকবর্ষ দূরের এক গ্যালাক্সি GN-z11। দূরত্ব নির্ণয় করার আরো কিছু পদ্ধতি আছে, তবে আমরা যেগুলো আলোচনা করলাম সেগুলিই বেশি ব্যবহার করা হয়।
1998 সালে সুপারনোভার সাহায্যে
দূরের গ্যালাক্সিদের দূরত্ব মাপার সঙ্গে সঙ্গে ডপলার ক্রিয়া ব্যবহার করে তাদের বেগ
মাপতে গিয়ে এক অভাবনীয় ঘটনা ধরা পড়ে। দেখা যায় গ্যালাক্সিদের এক অন্যের থেকে দূরে
সরে যাওয়ার বেগ আগের থেকে ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। গ্যালাক্সিরা একে অপরের সঙ্গে
মাধ্যাকর্ষণের মাধ্যমে ক্রিয়া করে, কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের থেকে কিছুতেই এই ঘটনাকে
ব্যাখ্যা করা যায় না। একটা ঢিল উপরদিকে ছুঁড়লাম, তার বেগ মাধ্যাকর্ষণের টানে ক্রমশ
কমবে, একসময় থেমে যাবে তারপর ফিরে আসবে। আরো জোরে ছুঁড়লাম, আবার বেগ কমবে, থামবে,
ফিরে আসবে। যদি মুক্তিবেগ নিয়ে ছুঁড়তে পারতাম, তাহলে থামত না বা ফিরেও আসত না,
কিন্তু বেগ কমতেই থাকত। তাহলে গ্যালাক্সিদের বেগ ক্রমশ বাড়ছে কেন? এর পিছনের কারণের একটা নাম দেওয়া হয়েছে, কৃষ্ণ
শক্তি বা ডার্ক এনার্জি। আরো একটা কথা একটু পরে আসবে, কৃষ্ণ পদার্থ বা ডার্ক ম্যাটার। কিন্তু এরা যে কী সে প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি না। কৃষ্ণ শক্তি ও কৃষ্ণ পদার্থ বিষয়ে এইখানে পড়তে পারেন।
বেগ মাপার প্রসঙ্গে আর একটা কথা
বলে রাখি। সৌরজগতের বাইরে গ্রহ খুঁজে পাওয়ার একটা উপায় হল তারকার বেগ সময়ের সঙ্গে
সঙ্গে কেমন পালটায় তা দেখা। গ্রহ থাকলে তার মাধ্যাকর্ষণের জন্য নক্ষত্রের বেগের পরিবর্তন
হবে। নিচের ছবিতে প্রক্সিমা বি গ্রহের জন্য প্রক্সিমা সেন্টরাই নক্ষত্রের বেগ কেমন
পালটায় তা দেখা যাচ্ছে। আরো জানতে হলে এই লেখাটা পড়ে দেখতে পারেন।
এরপর আসা যাক তারকাদের ভর
নির্ণয়ের কথায়। যে নক্ষত্রের কাছাকাছি অন্য কোনো জ্যোতিষ্ক নেই, সরাসরি তার
ভর মাপার কোনো পদ্ধতি আমাদের জানা নেই। কিন্তু মহাবিশ্বে অধিকাংশ নক্ষত্রই যুগ্ম (biary) হিসাবে অবস্থান করে। গ্রহদের গতিবিধি সংক্রান্ত কেপলারের
সূত্র যুগ্ম নক্ষত্রের জন্য ব্যবহার করে তাদের ভর বার করা সম্ভব। নিচের ছবিটা
দেখুন। এখানে দুটি তারা তাদের সাধারণ ভরকেন্দ্রের চারপাশে বৃত্তাকার কক্ষপথে
ঘুরছে। দুটো তারার কক্ষপথের ব্যাসার্ধ যথাক্রমে R1 ও R2 এবং ভর যথাক্রমে M1 ও M2।
ভরকেন্দ্রের সমীকরণ থেকে পাওয়া
যায়
R1M1=R2M2
নক্ষত্র দুটি যদি একে অন্যের চারদিকে T সময় নিয়ে পাক খায়, তাহলে কেপলারের সূত্র থেকে দেখানো যায়
M1+M2=4π2(R1+R2
)3/T2G
G হল নিউটনের মহাকর্ষীয় ধ্রুবক। এখানে দুটো সমীকরণ আছে, তাদের থেকে দুটি অজ্ঞাত
রাশি M1 ও M2 –র মান সহজেই বার করা যায়। আমাদের সূর্যের তুলনায় পৃথিবীর ভর এতই কম যে উপরের
সমীকরণে তাকে আমরা শূন্য ধরে নিতে পারি। পৃথিবীর ক্ষেত্রে R1+R2 = পনের কোটি কিলোমিটার, T হল এক
বছর। সমীকরণে মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের মান বসিয়ে সূর্যের ভর পাই 1.99X1030 কিলোগ্রাম। নক্ষত্রের ভর
সাধারণত সূর্যের ভরের M⊙-এর এককে প্রকাশ
করা হয়। আমরা যে লুব্ধক নক্ষত্রকে দেখি, তা আসলে এক যুগ্ম নক্ষত্র যারা 50.1 বছরে
একবার একে অপরকে প্রদক্ষিণ করে। এদের জন্য R1 ও R2
হল 13.2 এইউ ও 6.6
এইউ। যুগ্ম নক্ষত্রের মধ্যে একটা হল শ্বেত বামন নক্ষত্র সিরিয়াস বি যার ঔজ্জ্বল্য
খুব কম। উপরের সমীকরণ থেকে আমরা দুটি তারকারই ভর নির্ণয় করতে পারি। সিরিয়াস বি-র ভর
সূর্যের ভরের প্রায় সমান। অন্য নক্ষত্রটা হল সিরিয়াস এ, তার ভর 2M⊙ অর্থাৎ সূর্যের ভরের দ্বিগুণ -- সেটাকেই
আমরা খালি চোখে দেখতে পাই।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, R1 ও R2-র মান জানতে গেলে কিন্তু আমাদের থেকে ঐ যুগ্ম তারার দূরত্ব জানা প্রয়োজন।
কারণ দূরবিনে আমরা দুটো তারাকে যখন আলাদা করে দেখি, আমরা আসলে তাদের থেকে আসা আলো
কতটা কোণ করে আসছে মাপতে পারি। সেই কোণকে আমাদের থেকে তাদের দূরত্ব D দিয়ে গুণ করে r1 ও r2-র মান বার করা সম্ভব।
নিচের ছবিটাতে হয়তো বিষয়টা পরিষ্কার হবে। দূরবিন দিয়ে θ1 ও θ2 মাপা যাবে। তার
থেকেR1=Dθ1 এবং R2=Dθ2বার করা যাবে
সরাসরি নক্ষত্রের ভর মাপার অন্য
কোনো পদ্ধতি জানা নেই। যদি জ্যোতিষ্ক দুটিকে দূরবিনে আলাদা না দেখা যায়, তাহলে এই
পদ্ধতি অচল, কারণ সেক্ষেত্রে R1 ও R2 নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তবে একেবারে
জানা না গেলেও কিছুটা আন্দাজ করা সম্ভব। সেই আলোচনায় আর যাচ্ছি না। গ্যালাক্সিদের
নিজেদের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণের টানে চলাফেরা বা কোনো গ্যালাক্সির টানে আলো কতটা
বেঁকে যায় তার থেকে সেই গ্যালাক্সির ভর অনুমান করা যায়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সাহায্য লাগবে। দেখা গেছে গ্যালাক্সিদের ভরের
অধিকাংশটাই এমন পদার্থ যা আলোর সঙ্গে ক্রিয়া করে না, তাই বিজ্ঞানীরা কোনো নতুন
ধরনের পদার্থের কথা চিন্তা করছেন। তার নাম দেওয়া হয়েছে কৃষ্ণ পদার্থ বা ডার্ক
ম্যাটার, যদিও আগেই বলেছি সেটা যে আসলে কী তা আমরা জানি না।
দূরের নক্ষত্রদের উপরিতলের
তাপমাত্রা মাপার বিষয়টা অপেক্ষাকৃত সোজা। তারকাদের আমরা মোটামুটি ব্ল্যাক বডি বা
কৃষ্ণ বস্তু হিসাবে ধরে নিতে পারি। তার পক্ষে যুক্তিও আছে, তবে তা আমাদের আলোচনার
পরিধির বাইরে। উত্তপ্ত কৃষ্ণ বস্তু থেকে আলো বা আরো সঠিক ভাবে বললে তড়িৎচৌম্বক
তরঙ্গ নির্গত হয়। সেই তরঙ্গের বর্ণালীর তীব্রতা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে সঙ্গে পালটে
যায়। যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বর্ণালীর তীব্রতা সব থেকে বেশি তাকে যদি λmax বলি, তাহলে ঐ তারার উপরিতলের গড় তাপমাত্রা
কৃষ্ণ বস্তুর জন্য ভীনের সূত্র থেকে নির্ণয় করা যায়
T=b/λmax
যেখানে b হল ধ্রুবক। এখানে T তাপমাত্রার কেলভিন স্কেলে পাওয়া যাবে। যেমন সূর্যের বর্ণালী
থেকে পাওয়া যায় যে λmax হল 500 ন্যানোমিটারের কাছাকাছি। তার থেকে জানা যায় সূর্যের উপরিতলের গড় তাপমাত্রা হল 5800 কেলভিনের মতো। সিরিয়াস এ ও বি-র উপরিতলের গড় তাপমাত্রা হল যথাক্রমে সাড়ে দশ হাজার
ও পঁচিশ হাজার কেলভিনের কেলভিনের কাছাকাছি। তবে কেন্দ্রের তাপমাত্রা অনেক বেশি,
তাকে সরাসরি মাপা যায় না। নক্ষত্রের বাইরে অংশের তাপমাত্রা মাপার আরো একটা পদ্ধতি আছে, মেঘনাদ সাহার আবিষ্কৃত সাহা আয়নন সমীকরণ থেকে তাপমাত্রা নির্ভুল্ভাবে মাপা সম্ভব। কিন্তু সেই আলোচনা অপেক্ষাকৃত জটিল, তাই তার মধ্যে আমরা আজ যাচ্ছি না। আগ্রহী পাঠক এই লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন।
নক্ষত্ররা কত বড়? সূর্য থেকে
পৃথিবীর দূরত্ব জানি। সূর্য আমাদের চোখে 0.53 ডিগ্রি অর্থাৎ 0.0092 রেডিয়ান কোণ করে সেটাও
জানি। এই দুটো সংখ্যাকে গুণ করলে সূর্যের ব্যাস পেয়ে যাই প্রায় চোদ্দ লক্ষ
কিলোমিটার। কিন্তু আমাদের দূরবিনে সূর্য ছাড়া সব নক্ষত্রকেই বিন্দুর মতো দেখায়,
তাই তাদের ব্যাস সরাসরি নির্ণয় করা সহজ নয়। খুব কম সংখ্যক নক্ষত্রের ব্যাস আমরা
মাপতে পেরেছি, এখানে সেই আলোচনা সম্ভব নয়। তবে একটা পরোক্ষ উপায় আছে। আমরা
উপরিতলের গড় তাপমাত্রা কেমন ভাবে মাপা যায় তা দেখলাম। তাপগতিবিদ্যার স্টেফান-বোলজ্ম্যান
সূত্র অনুযায়ী কৃষ্ণ বস্তুর উপরের প্রতি একক ক্ষেত্রফল থেকে প্রতি সেকেন্ডে σT4 পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়। এখানে σ হল স্টেফানের ধ্রুবক। যদি ধরে নিই
যে জ্যোতিষ্কটি R ব্যাসার্ধের একটি
গোলক, তাহলে তার মোট পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল হল 4πR2, সুতরাং তার থেকে প্মোরতি সেকেন্ডে শক্তি বেরোয় E=4πRσT4 । আগেই দেখেছি যে জ্যোতিষ্কটি
যদি D দূরত্বে থাকে, তাহলে আমাদের
দূরবিনে প্রতি একক ক্ষেত্রফলে যে শক্তি এসে পড়ে তার পরিমাণ E/4πD2=R2σT4/D2। সুতরাং I, D ও T জানা থাকলে ব্যাসার্ধ
R-এর মান জানা যাবে। যেমন সিরিয়াস এ-র ব্যাসার্ধ হল 11.9 লক্ষ কিলোমিটার। সিরিয়াস
বি-এর ব্যাসার্ধ হল 5840 কিলোমিটার, পৃথিবীর থেকেও কম। ব্যাসার্ধ জানতে পারলে আয়তন
জানা সহজ। ভরও যদি জানা থাকে, তাকে আয়তন দিয়ে ভাগ দিলে গড় ঘনত্ব পেয়ে যাব। সিরিয়াস
এ-র গড় ঘনত্ব হল 0.57 গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার, জলের প্রায় অর্ধেক। সূর্যের ঘনত্ব হল 1.41
গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার। সিরিয়াস বি-এর ঘনত্ব হল 2.38 টন/ঘন সেন্টিমিটার, তার এক চামচ
পদার্থের ওজন হবে এক টনের বেশি। শ্বেত বামন নক্ষত্রের তাপমাত্রা ও বিপুল ঘনত্ব
থেকে নক্ষত্রের জীবন ইতিহাস সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানতে পেরেছি, কিন্তু সে আলাদা
আলোচনার বিষয়।
সবশেষে আসি নক্ষত্ররা কী দিয়ে
তৈরি। বিজ্ঞানী গুস্তাফ কিরশফ দেখিয়েছিলেন যে নিরবচ্ছিন্ন আলোকে যদি কোনো মৌলিক
পদার্থের গ্যাস বা বাষ্পের মধ্যে দিয়ে পাঠানো হয়, তাহলে সেই মৌল কয়েকটা নির্দিষ্ট
তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে। এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলো প্রত্যেক মৌলিক পদার্থের জন্য
আলাদা। তাহলে সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলো জানতে পারলে আমরা মৌলিক পদার্থটাকে চিনতে পারব।
বিজ্ঞানী জোসেফ ফন ফ্রনহফার সূর্য
থেকে আসা আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন উজ্জ্বল
পটির উপরে অনেকগুলো কালো রেখা দেখা যায়। কিরশফ ও রবার্ট বুনসেন
বললেন সূর্যের ভিতরটা সাংঘাতিক গরম, বাইরেটা অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা। ভিতর থেকে যে আলো আসছে, বাইরের গ্যাস সেই আলো শোষণ
করছে। তাহলে ফ্রনহফার বর্ণালীতে কালো কালো রেখাগুলো নিশ্চয় আলোটা কোন কোন মৌলিক
পদার্থের মধ্যে দিয়ে আসছে তা দেখাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু কিছু রেখার উৎস পৃথিবীর
বায়ুমণ্ডলের সূর্যালোক শোষণ। সেই অংশ বাদ দিলে যা পড়ে
থাকবে তা নিশ্চয় সূর্যের বাইরের অংশে কোন কোন মৌল আছে তা দেখাচ্ছে। এভাবে সূর্যে লোহা,
ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, নিকেল, তামা, বেরিয়াম, সোডিয়াম ইত্যাদি আছে, তা দেখা
যায়। অবশ্য আমরা এখন জানি সূর্য বা অন্য নক্ষত্র মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে
তৈরি। সৌর বর্ণালী থেকে সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে প্রয়োজন হয়েছিল মেঘনাদ সাহা
আবিষ্কৃত আয়নন সমীকরণের, কিন্তু আগেই বলেছি সে কথাও আমাদের আজকের আলোচনার বাইরে।
মহাকাশের মাপনিদের কথা এখানেই
শেষ করা যাক। আলোচনার সুবিধার জন্য যতটা
সরল করে লেখা হয়েছে, বিষয়টা সবসময় ততটা সরল নয়। যেমন তারারা সাধারণত বৃত্তাকার নয়,
উপবৃত্তাকার পথে একে অপরকে প্রদক্ষিণ করে। সেক্ষেত্রেও কেপলারের সূত্র প্রয়োগ করা
যায়, তবে সেটা এত সহজে লেখা যায় না। আমরা দেখলাম বিজ্ঞানের যে সমস্ত সূত্র আমাদের
জানা, পৃথিবীতেই পরীক্ষা করে যাদের আবিষ্কার করা হয়েছে -- তাদের ব্যবহার করে
জ্যোতিষ্কদের সম্পর্কে নানা খবর জোগাড় করা হয়েছে।
এই সমস্ত খবর থেকে আমরা জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার তত্ত্ব নির্মাণ করেছি,
মহাবিশ্বকে বুঝতে শিখেছি। এখানে একটা কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র সূত্র
জানলেই তো হবে না, পর্যবেক্ষণের জন্য যন্ত্রপাতির উন্নতিও করতে হয়েছে। সেই কথা এই
নিবন্ধের বাইরে রয়ে গেল, কিন্তু তাছাড়া কোনোভাবেই আমরা মহাকাশের জ্যোতিষ্কদের
সম্পর্কে এত খবর সংগ্রহ করতে পারতাম না।
পরিশিষ্ট
আপাত ও প্রকৃত ঔজ্জ্বল্য
গ্রহ তারা নক্ষত্রদের ঔজ্জ্বল্য
মাপার জন্য আমরা যে স্কেল ব্যবহার করি তা শুরু করেছিলেন প্রাচীন যুগের গ্রিক
বিজ্ঞানী হিপ্পারকাস। সে দূরবিন আবিষ্কারের অনেক আগের কথা। তিনি চাঁদ ও সূর্যের
বাইরে আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কদের ঔজ্জ্বল্যের মান ধরেছিলেন 1, এবং সবচেয়ে অনুজ্জ্বল তারকার মান ধরেছিলেন 6। 1856 সালে
নর্মান রবার্ট পগসন মাপটা একটু পরিবর্তন
করেন। তিনি বললেন 1 মাপের উজ্জ্বল তারকা 2 মাপের উজ্জ্বল তারকার থেকে 2.512 গুণ বেশি শক্তি আমাদের কাছে পাঠায়, সে আবার 3 মাপের তারকার
থেকে 2.512 গুণ বেশি শক্তি পাঠায়। এভাবে
দেখলে 1 মাপের উজ্জ্বল তারকা 6 মাপের তারকার থেকে একশো গুণ বেশি শক্তি পাঠায়। এই 2.512 সংখ্যাটাকে বলা হয় পগসনের অনুপাত। যে জ্যোতিষ্ক যত
উজ্জ্বল, পগসন স্কেলে তার মান তত কম। এই মাপে সূর্যের ঔজ্জ্বল্য হল -26.74। অভিজিৎ বা ভেগা নক্ষত্রের মান শূন্য ধরে হিসাবটা করা হত,
এখন অবশ্য কৃত্রিম মান ব্যবহার করা হয়।
এই ঔজ্জ্বল্যের মাপে কিন্তু
পৃথিবী থেকে দূরত্বের হিসাব রাখা হয় না। তাই লুব্ধক আসলে সূর্যের থেকে অনেক বেশি
উজ্জ্বল হলেও তার ঔজ্জ্বল্যের মান হয় -1.2। একে তাই বলা হয়
আপাত ঔজ্জ্বল্য (Apparent magnitude)। এছাড়া আরো একটা মাপ আছে, নিরপেক্ষ ঔজ্জ্বল্য (Absolute magnitude)। জ্যোতিষ্কটা যদি ঠিক দশ পারসেক দূরে থাকে তাহলে তার আপাত ঔজ্জ্বল্য
যত হত, তাকেই বলা হয় তার নিরপেক্ষ
ঔজ্জ্বল্য। নিরপেক্ষ ঔজ্জ্বল্য থেকে বোঝা সম্ভব কোন জ্যোতিষ্ক বেশি শক্তি বিকিরণ
করছে। এর মান নির্ণয় করতে গেলে জ্যোতিষ্কটার দূরত্ব জানা প্রয়োজন। সূর্যের নিরপেক্ষ
ঔজ্জ্বল্য হল 4.83।
No comments:
Post a Comment