Friday, 19 September 2025

সমকোণী ত্রিভুজের সূত্রের উৎস সন্ধানে

 

সমকোণী ত্রিভুজের সূত্রের উৎস সন্ধানে

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আয়োগ ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের উপর জোর দিচ্ছেন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে এই বিষয়ে পড়ানোর নির্দেশ এসেছে। ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম — এই বাক্যবন্ধের সঠিক বাংলা রূপান্তর কী হবে আমি জানি না; কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রকের এই বিষয়ে যে ওয়েবসাইট আছে, তাতে লেখা আছে ভারতীয় জ্ঞান পরম্পরা। পরম্পরা কথা থেকে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে কী বলতে চাওয়া হয়েছে, কিন্তু সিস্টেম শব্দটা সেই অর্থে আগে কোথাও ব্যবহার হয়েছে কিনা জানি না।

নাম যাই হোক, বিষয়টি বেশ বিতর্কিত সন্দেহ নেই। বিজ্ঞানে প্রাচীন ভারতের নিঃসন্দেহে অনেক অবদান আছে, কিন্তু তা ইতিহাসের বাইরে আলাদা করে পড়াবার প্রয়োজন কেন পড়ল জানি না। হাজার হাজার বছর আগের মানুষ যে সমস্ত সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল, তারা তাদের মতো করে সেই সমস্যার সমাধান করেছিল। সেই ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি, কিন্তু তাদের সরাসরি আজকের সমস্যার সমাধানে প্রয়োগ করা যাবে না। যে ছাত্র বা গবেষক কম্পিউটার সায়েন্স বা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করবে, এই সমস্ত বিষয় তাদের কী উপকারে লাগবে? তবে এই প্রবন্ধে আমরা সেই আলোচনায় যাব না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আয়োগ এই বিষয়ে যে পাঠ্যসূচী ঘোষণা করেছে, সেখানে বৌধায়ন-পিথাগোরাসের উপপাদ্যের উল্লেখ আছে। শ্রেণিকক্ষে পিথাগোরাসের উপপাদ্যই পড়ানো হয়, গণিত শিখতে ইতিহাসের প্রয়োজন নেই বলেই তা নিয়ে আলোচনা হয় না। এই লেখাতে আমরা এই বিশেষ উপপাদ্যটির ইতিহাস ফিরে দেখব।

পিথাগোরাসের উপপাদ্যের কথা আমরা সবাই জানি — সমকোণী ত্রিভুজের ভূমির (a) বর্গ ও লম্বের (b) বর্গের যোগফল অতিভুজের (c) বর্গের সমান। গণিতের ভাষায় বলতে পারি, a2+ b2=c2 অন্য ভাবে বললে, অতিভুজকে বাহু ধরে একটা বর্গক্ষেত্র আঁকলে তার ক্ষেত্রফল, লম্ব ও ভূমির উপরে আঁকা দুই বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলের যোগফলের সমান। এর বিপরীতটাও সত্য, অর্থাৎ যদি দুই বাহুর বর্গের সমষ্টি তৃতীয় বাহুর বর্গের সমান হয়, তাহলে প্রথম দুই বাহুর মধ্যের কোণটি সমকোণ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আয়োগের পাঠক্রমে এটিকে পিথাগোরাসের সঙ্গে শুল্বসূত্রকার বৌধায়নের নামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।

পিথাগোরাসের উপপাদ্যটিকে নানা ভাবে প্রমাণ করা যায়, ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লেখক ৩৭০টি প্রমাণের কথা বলেছেন। গত কয়েক বছরে ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করে উপপাদ্যটিকে অনেকে প্রমাণ করেছেন, যা একসময় মনে করা হত অসম্ভব। ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই স্কুল ছাত্রী ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করে নতুন এক প্রমাণ আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু উপপাদ্যটি যে পিথাগোরাস প্রথম প্রমাণ করেছিলেন, তার পক্ষে কোনো নিশ্চিত তথ্য আমাদের জানা নেই। তাই আমরা এই লেখাতে এটিকে সমকোণী ত্রিভুজের সূত্র বলব। (কেন উপপাদ্য না বলে সূত্র বলছি তার কারণ পরে বোঝা যাবে।) পিথাগোরাস ছিলেন গ্রিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী, তাঁর জীবনকাল আনুমানিক ৫৭০-৪৯৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। তাঁর সম্পর্কে অনেক গল্প প্রচলিত আছে, তার মধ্যে একটি হল তিনি এই উপপাদ্যটি প্রমাণ করে আনন্দে দেবতার উদ্দেশ্যে একটি বা একাধিক ষাঁড় বলি দিয়েছিলেন। কিন্তু সমকালীন সাক্ষ্য থেকে পিথাগোরাস যে এই প্রমাণ করেছিলেন তেমন কোনো খবর পাওয়া যায় না। পিথাগোরাস নিজে ছিলেন নিরামিষাশী ও পশু বলির বিরোধী, তাই গল্পটা নিয়েও সন্দেহ আছে। কেন পিথাগোরাসের নাম এই উপপাদ্যটির সঙ্গে যুক্ত হল তা জানা যায় না।

ইউক্লিড ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ তাঁর বিখ্যাত জ্যামিতি বই এলিমেন্টস-এ এই বিশেষ উপপাদ্যটির দুটি প্রমাণ দিয়েছিলেন। বিপরীত উপপাদ্যটির প্রমাণ ইউক্লিডের লেখাতেই প্রথম পাওয়া যায়। পিথাগোরাসের নাম ইউক্লিড করেননি। তবে পিথাগোরাস এই উপপাদ্যের কথা নিঃসন্দেহে জানতেন, কারণ তিনি এটি ব্যবহার করেই প্রথম দেখিয়েছিলেন যে 2-এর বর্গমূল একটি অমূলদ সংখ্যা, তাকে দুটি পূর্ণ সংখ্যার অনুপাত হিসাবে প্রকাশ করা যায় না।

এবার আসি বৌধায়নের কথায়। ভারতের প্রাচীনতম গণিত বিষয়ক যে বই আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে তা হল শুল্বসূত্র। শুল্ব শব্দের অর্থ হল দড়ি। শুল্বসূত্রে বিভিন্ন প্রকার যজ্ঞবেদি নির্মাণের কথা বলা আছে। শুল্বসূত্রের বেশ কয়েকজন লেখক আছে, তাঁদের মধ্যে কালের বিচারে প্রথম হলেন বৌধায়ন। বৌধায়নের লেখাতে সমকোণী ত্রিভুজের সূত্রটির কথা আছে। এর থেকে পুরানো কোনো উৎসে সূত্রটি এত স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়নি। প্রাচীন ভারতের অন্যান্য নিদর্শনের মতোই শুল্বসূত্রের কাল নির্ণয় বেশ কঠিন; বিভিন্ন মতে আটশো থেকে দু'শো খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এসেছে। সব সূত্রগুলি এক সময়ে লেখা নয়। বৌধায়ন খুব সম্ভব পিথাগোরাসের পূর্ববর্তী।

তাহলে কি বৌধায়নকেই আমরা সমকোণী ত্রিভুজের উপপাদ্যের আবিষ্কর্তা বলব? প্রশ্ন হল আমরা উপপাদ্যের আবিষ্কার বলতে কী বোঝাতে চাই? আমাদের স্কুলের জ্যামিতি বইতে উপপাদ্যের প্রমাণ দেওয়া থাকে। সারা পৃথিবীতেই জ্যামিতির মডেল হল ইউক্লিডের বই। সেখানে কয়েকটি স্বতঃসিদ্ধ থেকে সমস্ত উপপাদ্যগুলি প্রমাণ করা হয়েছে। শুল্বসূত্রে কোথাও এই অর্থে প্রমাণ পাওয়া যাবে না। আধুনিক অর্থে তাকে উপপাদ্য না বলে সে জন্য সূত্র বলাই শ্রেয় মনে হয়েছে। ভারতে সমকোণী ত্রিভুজের সূত্রের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় দ্বাদশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় ভাস্করাচার্যের লেখাতে। সঙ্গের ছবিতে সেই প্রমাণটি দেখানো হল। তবে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে প্রমাণটি আরো প্রাচীন।

 

ভাস্করের দেওয়া সমকোণী ত্রিভুজের সূত্রের প্রমাণ


এই উপপাদ্যটির আমাদের জানান প্রাচীনতম প্রমাণটি অবশ্য এলিমেন্টস-এর থেকেও অনেক পুরানো, সেটি পাওয়া গেছে চিনের চৌ পে সুয়ান চিং বইতে। সেখানে এক কাহিনিতে গণিতবিদ শ্যাঙ কাও অভিজাত শাসক ঝাউ গঙ্গকে সূত্রটি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। যদিও তারিখটা নিশ্চিত নয়, কিন্তু এটিই আমাদের জানা প্রমাণগুলির মধ্যে যে সব থেকে পুরানো তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কায়রো ম্যাথামেটিকাল প্যাপিরাসে (কাল ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) 'টি গাণিতিক সমস্যা দেওয়া আছে যাদের সমাধানের জন্য আলোচ্য সূত্রটির প্রয়োজন হয়।

আমরা জানি যে প্রাচীন যুগের বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে যোগাযোগ ছিল। তাই কোনো একটি আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের খবর অন্যত্র পৌঁছানো অস্বাভাবিক নয়। আবার যোগাযোগ স্বাভাবিকভাবেই ছিল খুব ধীরগতিতে, তাই একই আবিষ্কার স্বাধীনভাবে বিভিন্ন সভ্যতায় হওয়াও সম্ভব। প্রাচীন কালের অনেক কথাই আমাদের এখনো অজানা; তথ্যের অভাবে এই নিয়ে কথা না বলাই শ্রেয়। যে অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বৌধায়ন-পিথাগোরাসের উপপাদ্য বলতে চেয়েছে, সেই অর্থে এটিকে শ্যাং কাও উপপাদ্য বলা উচিত। কিন্তু আমরা দেখব যে সূত্রটি নিঃসন্দেহে আরো প্রাচীন।

এবার আসি পিথাগোরিয় ত্রয়ীর কথায়। যদি তিনটি সংখ্যা a, b c-র জন্য a2+ b2=c2 শর্তটি পূরণ হয় তাহলে তাকে বলা হয় পিথাগোরিয় ত্রয়ী। উদাহরণ হিসাবে (3,4,5), (5,12,13) এই ত্রয়ী দুয়ের কথা ভাবা যেতে পারে, যেখানে প্রথম দুটির বর্গ যোগ করলে তৃতীয়টির বর্গ পাওয়া যাবে। আবার যে কোনো ত্রয়ীকে পূর্ণ সংখ্যা দিতে গুণ করলে এক নতুন ত্রয়ী পাওয়া যারে পারে, যেমন (3,4,5) ত্রয়ীটিকে দুই বা তিন দিয়ে গুণ করে পাই যথাক্রমে (6,8,10) (9,12,15); এগুলিও পিথাগোরিয় ত্রয়ী। স্পষ্টতই পিথাগোরিয় ত্রয়ী ও সমকোণী ত্রিভুজের তিনটি বাহুর সম্পর্কটি পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। পিথাগোরিয় ত্রয়ীর ইতিহাস কত প্রাচীন?

বৌধায়নের শুল্বসূত্রে বেশ কয়েকটি পিথাগোরিয় ত্রয়ীর কথা আছে। কিন্তু পিথাগোরিয় ত্রয়ীর ইতিহাস বহু প্রাচীন। মেসোপটেমিয় (অর্থাৎ বর্তমান ইরাক) সভ্যতার এক বহু পুরানো মাটির ট্যাবলেট প্লিম্পটন 322-র বয়স মেপে জানা গেছে সেটি খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ শতকের নিদর্শন। সেখানে যে সংখ্যাগুলি আছে, সেটিকে পিথাগোরিয় ত্রয়ীর আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়। নিচের সারণীতে সেই ট্যাবলেটের কয়েকটি সংখ্যা সেই রূপে দেখানো হল।


সারণী ১ - প্লিম্পটন 322 ট্যাবলেটে পাওয়া পিথাগোরিয় ত্রয়ী

a

b

c

119

120

169

3367

3456

4825

4601

4800

6649

12709

  13500

 18541 

4961

6480

8161

1771

2700

3229

1679

2400

2929

স্বাভাবিক প্রশ্ন আসে এই সংখ্যাগুলো ট্যাবলেটের লিপিকার কেমন করে পেলেন? ট্যাবলেটে পাওয়া অধিকাংশ ত্রয়ীর সংখ্যাগুলি পরস্পর মৌলিক, অর্থাৎ কোনো অপেক্ষাকৃত ছোট ত্রয়ীকে পূর্ণসংখ্যা দিয়ে গুণ করে এগুলি পাওয়া সম্ভব নয়। আধুনিক কম্পিউটার ছাড়া শুধুমাত্র আন্দাজ করে বা আকস্মিক ভাবে এত বড়বড় ত্রয়ী পাওয়া সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। এই নিয়ে বিভিন্ন মত আছে, এখনো পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।

আরো একটি প্রায় সমসাময়িক ট্যাবলেট YBC 7289-এ একটি বর্গক্ষেত্র এঁকে তার কর্ণ বরাবর 2-এর বর্গমূল লেখা আছে। এটিও স্পষ্টতই সমকোণী ত্রিভুজের সূত্রটিকে ব্যবহার করা হয়েছে; সূত্রটি থেকে দেখা যায় যে কর্ণ ও বাহুর অনুপাত হল 2-এর বর্গমূল। প্রাচীনকালে এই বর্গমূলটির এর থেকে সঠিক মান পাওয়া যায় নি, দশমিকের পরে ছয় ঘর পর্যন্ত মানটা ঠিক।

  

প্লিম্পটন 322


বৌধায়ন কি সূত্রটির কোনো প্রমাণ আবিষ্কার করেছিলেন বা জানতেন? বিখ্যাত বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক সমরেন্দ্রনাথ সেন লিখেছেন যে প্রমাণটি নিঃসন্দেহে বৌধায়নের জানা ছিল, যদিও তার পক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য বা যুক্তি তিনি দেননি। এখানেই প্রশ্ন আসে যে প্রমাণ না জেনে সূত্রটি আবিষ্কার করা কি সম্ভব? এই প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য তাঁর The Origin of Geometry in India: A Study of the Sulbasutras বইতে লিখেছেন যে প্রাচীন ভারতে জ্যামিতির ইতিহাস জানতে হলে আমাদের কিছু পুরানো ধারণা পরিত্যাগ করতে হবে। ইউক্লিডের জ্যামিতিই একমাত্র মডেল নয়; শুধুই ভারতে নয়, অন্য সভ্যতাতেও জ্যামিতি ইউক্লিডিয় পদ্ধতিতে সূচনা হয়নি। ইউক্লিডিয় বিমূর্ত পদ্ধতি প্রাচীন সভ্যতাতে কোনো কাজে আসত না। বলা হয় যে নীল নদে বন্যার পরে জমির মাপ ঠিক করতে গিয়ে প্রাচীন মিশরে জ্যামিতির সূচনা হয়েছিল। অবশ্য এটাই একমাত্র মত নয়; বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিক ভি গর্ডন চাইল্ডের মতে ছুতোরের কাজ করতে গিয়ে জ্যামিতির সূচনা হয়। বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন কারণে জ্যামিতির আবির্ভাব অস্বাভাবিক নয়। শুল্বসূত্রেও যজ্ঞের বেদি নির্মাণ করতে গিয়ে অর্থাৎ একান্তভাবেই হাতে কলমে কাজ করতে গিয়ে জ্যামিতির সমস্যার সমাধান করতে হয়েছে। সমকোণী ত্রিভুজের সূত্র ছাড়া প্রাচীন যুগের বিরাট বিরাট যে সমস্ত নির্মাণের হদিস আমরা পাই, সেগুলো বানানো সম্ভব হত কি? আমরা প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনার কথা জানি, সমকোণে রাস্তাগুলি ছেদ করত, বাড়ি তৈরির নির্দিষ্ট পদ্ধতি ছিল। সমকোণী ত্রিভুজের সূত্র ছাড়া তাকে রূপায়ণ করা কঠিন হত। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় অনুমান করেছেন যে সিন্ধুসভ্যতার জ্যামিতি জ্ঞানের সাহায্য পেয়েছিল শুল্বসূত্র, কারণ তার থেকে পুরানো জ্যামিতি জ্ঞানের কোনো নিদর্শন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে পাওয়া যায় না।

প্রাচীন কালের ইঞ্জিনিয়ারিঙের সব থেকে বিখ্যাত নিদর্শন হল 2600 খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ তৈরি গিজার গ্রেট পিরামিড। গিজার পিরামিডে নানা জায়গায় সমকোণী কাঠামো বানাতে এই সূত্রের ব্যবহার হয়েছে। যেমন একটি ত্রিভুজের ভূমি 115.2 মিটার, লম্ব 146.6 মিটার ও অতিভুজ 186.4 মিটার। দশমিকে প্রথম ঘর পর্যন্ত এই মাপ পুরোপুরি সঠিক। এই সব ত্রিভুজে সমকোণ অর্থাৎ নব্বই ডিগ্রির মাপে ত্রুটি আছে দশ হাজার ভাগের এক ভাগেরও কম। এখানেও বোঝা যায় যে প্রমাণ জানা থাক বা না থাক, সূত্রটি সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা ছিল।

সূত্র কথাটি বিজ্ঞানে সাধারণত পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষাতে পাওয়া কতকগুলি সিদ্ধান্তের জন্য ব্যবহার করা হয়। যেমন শক্তির সংরক্ষণ সূত্র বা রসায়নে ডালটনের সূত্র এ সবই পরীক্ষানিরীক্ষা করে পাওয়া দিয়েছিল। সমকোণী ত্রিভুজের সূত্রটির উল্লেখ থাকা মানেই যে তার আধুনিক গণিতের পদ্ধতিতে অর্থাৎ স্বতঃসিদ্ধ থেকে অগ্রসর হয়েই তার প্রমাণ জানা ছিল এমন নাও হতে পারে। মানুষকে বহু জায়গায় বহুবার সমকোণী ত্রিভুজকে ব্যবহার করতে হয়েছে। পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে সমকোণী ত্রিভুজের সূত্রে পৌঁছানোও অস্বাভাবিক নয়।

আধুনিক গণিত মূলত স্বতঃসিদ্ধভিত্তিক, অর্থাৎ সেখানে অবরোহী যুক্তি কাজ করে। প্রাচীন বিজ্ঞানের চরিত্রও ছিল একই রকম, সেখানে একটি বা কয়েকটি সাধারণ সত্য ধরে নেওয়া হত, তার প্রমাণের প্রয়োজন পড়ত না। সেগুলিকে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হত। এর ফলে সেখানে পরীক্ষানিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণের বিশেষ স্থান ছিল না। আধুনিক বিজ্ঞান কিন্তু আরোহী যুক্তিতে বিশ্বাসী; সেখানে নানা পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষা থেকে আমরা সাধারণ সত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়। ফলে সাধারণ সত্যটি পরিবর্তন করার বা বাতিল করার সুযোগ থাকে, এভাবেই আধুনিক বিজ্ঞান এগোয়। সেই অর্থে প্রাচীন গণিতের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের সাদৃশ্য পাওয়া যায়।


তথ্যসূত্র

The Origin of Geometry in India: A Study of the Sulbasutras, Ramkrishna Bhattacharya

পিথাগোরাস ত্রয়ী: একটি পরিক্রমা, ভূপতি চক্রবর্তী

History of Science and Technology in Ancient India, Debiprasad Chattopadhyay

God Created the Integers: The Mathematical Breakthroughs that Changed History, Edited with Commentary by Stephen Hawking

Science in Saffron: Skeptical Essays on the History of Science, Meera Nanda

Mathematics, Samarendranath Sen, in A Concise History of Science in India, Chief Editor Debendramohan Bose, Editors Samarendranath Sen and B V Subbarayappa

 

প্রকাশঃ জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার, শারদ ২০২৫  



মহাবিশ্বে প্রাণের সন্ধান

 

মহাবিশ্বে প্রাণের সন্ধান 

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়  


আমাদের সৌরজগতে পৃথিবী ছাড়া উন্নত সভ্যতা কোথাও নেই, কিন্তু অন্য কোথাও কি প্রাণের সন্ধান পাওয়া যাবে? কারোর মতে প্রাণ এতই বিরল ঘটনা যে আমাদের ছায়াপথ কেন, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডেই আমরা ছাড়া অন্য কোনো উন্নত সভ্যতাই নেই। আবার কারো মতে প্রাণের অনুকূল পরিবেশ থাকলেই প্রাণের জন্ম হবে। সমস্যা হল যে আমাদের কাছে মাত্র একটাই উদাহরণ আছে। তাই আমরা আমাদের সৌরজগতে প্রাণের সন্ধান করছি। যদি আমরা সফল হই, তাহলে দ্বিতীয় দলের যুক্তি অনেক জোরদার হবে সন্দেহ নেই।

প্রাণের জন্য তরল জল প্রয়োজন বলেই আমাদের অনুমান। সৌরজগতে আটটি গ্রহ আছে, তার মধ্যে তরল জল আছে বা কখনো ছিল এমন গ্রহ হল পৃথিবী ও মঙ্গল। তাই মঙ্গলই আমাদের প্রথম লক্ষ্য। মঙ্গলের সঙ্গে পৃথিবীর অনেক মিল। মঙ্গলের ব্যাস পৃথিবীর অর্ধেক। মঙ্গলের দিন পৃথিবীর দিনের থেকে মাত্র ঊনচল্লিশ মিনিট বড়। মঙ্গলও তার কক্ষপথের সঙ্গে প্রায় পৃথিবীর মতোই কোণ করে আছে; ফলে সেখানেও ঋতু পরিবর্তন হয়। মঙ্গলের দুই মেরুতে বরফ দেখা যায়। তাই মঙ্গলে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা নিয়ে অনেকেই চিন্তা করেছিলেন। ১৮৭৭ সালে ইতালির জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিওভান্নি শিপারেল্লি ঘোষণা করেন যে তিনি দূরবীন দিয়ে মঙ্গলগ্রহে canali দেখেছেন ইতালিয় ভাষায় তার মানে হল channel অর্থাৎ খাত, ইংরাজি অনুবাদে ভুল করে হয়ে গেল canal অর্থাৎ খাল পার্সিভাল লাওয়েল নামের এক বিজ্ঞানী 1892 সালে ঘোষণা করলেন খালগুলো কৃত্রিম। লাওয়েল যথেষ্ট খ্যাতনামা বিজ্ঞানী, কাজেই অনেকেরই ধারণা হয়েছিল যে মঙ্গলে নিশ্চয় বুদ্ধিমান প্রাণী আছে। মঙ্গলের অধিকাংশই বর্তমানে মরুভূমি, তাই তারা দুই মেরু থেকে খাল কেটে জল এনে কৃষিকাজ চালায়। বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞানকার এইচ জি ওয়েলস ওয়ার অফ দি ওয়ার্ল্ডস উপন্যাসে মঙ্গলবাসীদের পৃথিবী আক্রমণের কাহিনি লিখলেন। সেই গল্প এতটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়েছিলে যে একবার রেডিওতে তার নাট্যরূপ প্রচারের সময় বহু লোক সেটাকে সত্যি ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে মঙ্গল গ্রহে সভ্যতার অস্তিত্ব তখন সাধারণভাবে স্বীকৃত ছিল। বাংলাতেও হেমেন্দ্রকুমার রায়ের 'মেঘদূতের মর্তে আগমন' বা প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মঙ্গলগ্রহে ঘনাদা' অনেকেই হয়তো পড়েছেন।

মাঙ্গলিক ও মঙ্গলের খাল (চ্যাট জিপিটির সাহায্যে আঁকা) 

অবশ্য এই ধারণা বেশিদিন টিকল না। শিগগিরি বোঝা গেল যে মঙ্গলগ্রহের বায়ুর চাপ পৃথিবীতে সমুদ্রতলে বায়ুচাপের একশো ভাগের এক ভাগের থেকেও কম, সেখানে জল তরল অবস্থায় খোলা জায়গায় থাকাই সম্ভব নয় -- বাষ্প হয়ে উবে যাবে তা একমাত্র বরফ অবস্থাতেই থাকতে পারে। কাজেই খাল সেখানে কোনো কাজে লাগবে না।

তবে মঙ্গলে এই অবস্থা চিরকাল ছিল না। মঙ্গলের উদ্দেশ্যে অনেক অভিযান পাঠানো হয়েছে। মহাকাশ থেকে ছবি তোলা হয়েছে, গ্রহের মাটিতেও ল্যান্ডার বা রোভার নামানো হয়েছে। তাই আমরা এখন জানি যে একসময় মঙ্গলের বুকে সত্যিই তরল জল ছিল; তখন বায়ুচাপ ছিল বেশি। মঙ্গলের বুকে শুকনো নদীখাত পাওয়া গেছে, প্রাচীন সমুদ্রের সম্ভাবনাও পাওয়া গেছে। তাই একসময় প্রাণের অনুকূল পরিবেশ মঙ্গলে একসময় ছিল। তারপর কোনো এক বিপর্যয়ে মঙ্গল এক শীতল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হল একসময় যদি প্রাণের জন্ম হয়ে থাকে, তার পক্ষে কি বর্তমান অবস্থায় টিকে থাকা সম্ভব?

ঙ্গলের বুকে জলের প্রবাহের চিহ্ন- সাদা দাগগুলো হল জলে থাকা নুন (ছবি- NASA/JPL-Caltech/MSSS)

 

এখানে একটা ঘরের কাছের গল্প বলি। ১৯৬৭ সালে চাঁদে নেমেছিল রোবট যান সার্ভেয়র-৩। দু’ বছর পরে অ্যাপোলো-১২ অভিযান যখন চাঁদে নামে, মহাকাশচারীরা সার্ভেয়রের ক্যামেরাটিকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনেন। উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের এককোশী জীবের সন্ধান, হয়ত মাঝের দু’ বছরে সার্ভেয়রে তারা কোনোভাবে চলে আসতে পারে। পৃথিবীতে এনে সন্ধান পাওয়া গেল নেহাতই পার্থিব ব্যাকটেরিয়া স্ট্রেপ্‌টোকক্কাসের স্পোরের। দেখা গেল তারা তখনো জীবিত, সুযোগ পাওয়া মাত্র তারা বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করল। কাজেই মঙ্গলে এককোশী প্রাণের টিকে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই বেশ কিছু অভিযান মঙ্গলে চালানো হয়েছে। ফলাফল কী?

এখনো পর্যন্ত মঙ্গলে নিশ্চিতভাবে প্রাণের চিহ্ন পাওয়া যায় নি। জৈব যোগের সন্ধান পাওয়া গেছে। কাজেই তরল জল ও জৈব যৌগ, অর্থাৎ প্রাণের সব উপাদান একসময় মজুত ছিল। মঙ্গলের মাটির তলায় এবং দুই মেরুতে এখনো জলের বরফ আছে তার অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে সব থেকে বেশি কৌতূহলের বিষয় হল ঋতুপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মিথেনের পরিমাণ বাড়ে কমে। বায়ুমণ্ডলের মিথেন গ্যাস অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ভেজগে যায়,। তারপর সেই টুকরোগুলো হাইড্রোকার্বন অর্থাৎ জৈবযৌগ তৈরি করে। কিন্তু এভাবে চললে বায়ুমণ্ডল থেকে মিথেন শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। বৃহস্পতির মতো দানব গ্রহের বায়ুমণ্ডলের ভিতরের স্তরে হাইড্রোকার্বন ভেঙে আবার মিথেন তৈরি হয়। কিন্তু পৃথিবীর মতো ছোট গ্রহে তার অনুকূল পরিবেশ নেই। আমাদের বায়ুমণ্ডলে মিথেনের উৎস হল জীবজগৎ। মঙ্গলে মিথেন কোথা থেকে আসে? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনো আমরা জানি না। পৃথিবীতে ব্যাকটেরিয়া মিথেন তৈরি করে, মঙ্গলে কি একই ঘটনা ঘটছে? পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোও হয়েছে, কিন্তু নিশ্চিত উত্তর পাওয়া যায়নি। পাঁচ বছর আগে পার্সিভিয়ারেন্স রোভারকে পাঠানোই হয়েছিল বিশেষ করে প্রাচীন প্রাণের চিহ্ন খুঁজতে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমরা জানি না, সত্যিই কোনোদিন মঙ্গলে প্রাণ ছিল কিনা।


পার্সিভিয়ারেন্সের সেল্‌ফি (ছবি নাসা)

মঙ্গলের থেকেও আমাদের কাছের গ্রহ হল শুক্র, শুক্রের আয়তন এবং ঘনত্বও পৃথিবীর কাছাকাছি। শুক্ৰে প্ৰাণ আছে কি? শুক্রপৃষ্ঠে প্রাণ থাকা সম্ভব নয়। সেখানে তাপমাত্রা সাড়ে চারশো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, বায়ুর চাপ পৃথিবীর নবই গুণ, আকাশ থেকে যেখানে হয়তো ঝরে পড়তে পারে ঘন সালফিউরিক অ্যাসিডের বৃষ্টি, জল বা অক্সিজেন নেই বললেই চলে। শুক্রপৃষ্ঠে নয়, বিজ্ঞানীরা প্ৰাণের অস্তিত্ব খুঁজছেন বায়ুমণ্ডলে। বায়ুমণ্ডলের উপরদিকে চাপ তাপমাত্রা অনেক কম, প্রায় পৃথিবীরই কাছাকাছি। সেখানে হয়তো এককোশী জীবের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। বায়ুমণ্ডলে ফসজিন গ্যাসের চিহ্ন পাওয়া গেছে, মিথেনের মতো পৃথিবীর প্রাকৃতিক ফসজিনের উৎসও জীবজগৎ। আবার একটা পর্যবেক্ষণ দেখায় মাটি থেকে আশি কিলোমিটার উঁচুতে সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি শোষিত হয়ে যাচ্ছে। কোন পদ্ধতিতে এই শোষণ ঘটে, তা নিশ্চিত ভাবে বলা এখনই সম্ভব নয়। কেউ কেউ মনে করছেন যে এর জন্য দায়ী কোনো নতুন ধরনের জীবাণু।

দূরের গ্রহে প্রাণের নিশ্চিত চিহ্ন কী? কোন সঙ্কেত দেখলে বুঝব প্রাণ আছে? পৃথিবী হল আমাদের জানা একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রাণ আছে। তাই শুক্র অভিযানে পাঠানো ভেনাস এক্সপ্রেস পৃথিবীতে প্রাণের সন্ধান করেছে। তার ক্যামেরা পৃথিবীর ছবি তুলেছে। বিজ্ঞানীরা সেই ছবি থেকে পৃথিবীতে প্রাণের চিহ্ন সন্ধানের চেষ্টা করছেন । যদি এমন কিছু দেখা যায় যাকে নিশ্চিতভাবে জীবনের সঙ্কেত বলে চিহ্নিত করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে অন্য গ্রহের ছবিতে সেই চিহ্নকে খোঁজা হবে।

সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহে প্রাণ খুঁজে পাওয়ার আশা আমরা করি না। বুধের তাপমাত্রা খুব বেশি ওঠানামা করে, ৪৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে -১৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত। সেখানে জল নেই, নেই বায়ুমণ্ডল। বৃহস্পতি, শনির মতো গ্যাসদানব গ্রহে কোনো স্থলভাগ নেই, নেই অক্সিজেন। যদিও কল্পবিজ্ঞানকাররা অবশ্য বৃহস্পতির বায়ুতে ভেসে থাকা বিরাট প্রাণের কল্পনা করেছেন, তবে তার সম্ভাবনা বিশেষ নেই।

সৌরজগতে আরো অন্তত দুটি জায়গা আছে যেখানে প্রাণ থাকতেও পারে। কিছু বিশেষ পরিস্থিতি সেখানে প্রাণের অনুকূল কিছু পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এবার আর গ্রহ নয়, প্রাণের সন্ধানে যাব উপগ্রহে। বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা ও শনির উপগ্রহ টাইটান -- এই দুই জায়গা নিয়ে বিজ্ঞানীরা চিন্তা করেছেন। প্রথমে আসি ইউরোপার কথায়। ইউরোপা গ্যালিলিওর আবিষ্কৃত বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহের মধ্যে সব থেকে ছোট, আবার বৃহস্পতির থেকে সব থেকে দূরেও বটে। ইউরোপা আমাদের চাঁদের মতোই বড়। তার উপরটা বরফে ঢাকা। গ্যালিলিও মহাকাশযান দীর্ঘদিন বৃহস্পতির চারদিক পর্যবেক্ষণ করেছে, তার পাঠানো ছবি থেকে দেখা গেছে পৃথিবীর উত্তর মেরুতে যেমন ফাটল দেখা যায় ইউরোপার উপরিতল একেবারেই সেই রকম ফাটলে ভর্তি। উত্তর মেরুতে এর কারণ হল বরফের তলাতে আছে তরল জল, সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে উপরের বরফে ফাটল ধরে। ইউরোপা গোল্ডিলক্‌স অঞ্চলের অনেক বাইরে, সেখানে উপরের তাপমাত্রা হল -২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, সেখানে তরল জল আসবে কোথা থেকে?

অনেকদিন আগে থেকেই মনে করা হচ্ছিল ইউরোপাতে জল আছে। ইউরোপার বায়ুমণ্ডল নেই, কাজেই উপরে তরল জল থাকার উপায় নেই। তাই মহাসমুদ্রের উপরটা জমে গেছে। কিন্তু বৃহস্পতির টানে যে জোয়ারভাঁটা হয়, তা সেই বরফের স্তরের তলার জলকে জমতে দেয়নি। গ্যালিলিও দেখিয়েছে ইউরোপার একটা দুর্বল চৌম্বক ক্ষেত্র আছে। এর একমাত্র ব্যাখ্যা হল ইউরোপার ভিতরে এমন কোনো তরল আছে যা তড়িৎ পরিবহন করতে পারে। ইউরোপা এতই ছোট যে তার অভ্যন্তর বহুদিন শীতল হয়ে গেছে, কাজেই পৃথিবীর মতো তরল লোহার স্রোতের সাহাযযে তার চৌম্বক ক্ষেত্রের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। এর সব থেকে সহজ ব্যাখ্যা হল জল; নোনা জল তড়িৎ পরিবহন করতে পারে। দু একটা ছোটখাটো পুকুর নয়, ইউরোপাতে আছে এক উপগ্রহব্যাপী মহাসমুদ্র। হাবল টেলিস্কোপের সাম্প্রতিক ছবি থেকে মনে হয় সেই জল মাঝে মাঝে পিচকারির মতো বাইরে বেরিয়ে আসে। তা যদি সত্য হয়, তাহলে প্রায় দু’শো কিলোমিটার উঁচু জলের ফোয়ারার সন্ধান পাওয়া গেছে।

গ্যালিলিওর চোখে ইউরোপা (NASA/JPL-Caltech/SETI Institute


বৃহস্পতির এক শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র আছে, সে তার উপগ্রহগুলিকে মহাজাগতিক রশ্মির আঘাত থেকে রক্ষা করে। তাই তরল জল এবং মহাজাগতিক রশ্মির বর্ম, প্রাণের এই দুই শর্ত ইউরোপা পূরণ করে। কিন্তু সেখানে অক্সিজেন থাকার কোনো সুযোগ নেই, সূর্যের আলোও খুবই দুর্বল। তাহলে প্রাণ থাকলে কেমন হবে তার সম্ভাবনা তা জানতে ইউরোপা থেকে ফিরে আসতে হবে পৃথিবীতে।

কয়েক দশক আগে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক প্রাণের সন্ধান পৃথিবীতে পাওয়া গেছে। গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের কথা আমরা সবাই শুনেছি, সেখানকার পাণীজগতের বৈচিত্রই ডারউইনকে তাঁর বিখ্যাত প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের পথ দেখিয়েছিল। ১৯৭৭ সালে সেই দ্বীপপুঞ্জের কাছে সমুদ্রের নিচে এক সম্পূর্ণ নতুন ধরনের জীবমণ্ডল আবিষ্কার হয় যার জন্য গোল্ডিলক্‌স অঞ্চলের তত্ত্ব পুরোপুরি খাটবে না। সমুদ্রের গভীরে অনেক জায়গা আছে যেখানে ফাটল থেকে গরম জল বেরিয়ে আসে। এগুলিকে বলে জলতাপীয় রন্ধ্র (Hydrothermal vent)। এগুলি সাধারণত দুটি মহাদেশীয় পাতের সযোগস্থলে বা আগ্নেয়গিরির কাছে হয়। এই সব গঠনে যে ফাঁক থাকে তা দিয়ে সমুদ্রের জল ভূঅভ্যন্তরে প্রবেশ করে গরম হয় ও অন্য ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। সেই জলের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। তার সঙ্গে বেরিয়ে আসে নানা রাসায়নিক পদার্থ। এই রাসায়নিক পদার্থের উপর নির্ভর করে জলতাপীয় রন্ধ্রদের আশেপাশে সম্পূর্ণ নতুন এক জীবজগৎ গড়ে উঠেছে; সূর্যের আলো বা মুক্ত অক্সিজেনের উপর তা একেবারেই নির্ভর করে না। এখন শুধু গ্যালাপাগোস নয়, আরো অনেক জায়গায় এমন জীবজগতের সন্ধান পাওয়া গেছে। বৃহস্পতির টানে ইউরোপাতে শুধু তরল জল নয়, সমুদ্রের তলাতে আগ্নেয়গিরিও থাকা সম্ভব। তাহলে সহজেই জলের ফোয়ারার ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে কি আমরা ইউরোপার অভ্যন্তরে প্রাণের আশা করতে পারি? নাসার ইউরোপা ক্লিপার মহাকাশযান ২০২৪ সালের ১৪ অক্টোবর যারা করেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ সে ইউরোপা পৌঁছে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করবে। অবশ্য সমুদ্রের অভ্যন্তরে সন্ধান এখনো আমাদের ক্ষমতার বাইরে।

অপর এক সম্ভাব্য জায়গা হল আমাদের সৌরজগতের সবই থেকে বড় উপগ্রহ টাইটান। শনির এই উপগ্রহটা প্রায় মঙ্গলের মতোই বড়। তার একটা বায়ুমণ্ডল আছে যার মুখ্য উপাদান হল নাইট্রোজেন, আর্গন ও মিথেন। আগেই দেখেছি যে মিথেন সাধারণভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। মঙ্গলের ক্ষেত্রে আমরা জৈব উৎস্বের কথা বলেছিলাম, কিন্তু টাইটানের ক্ষেত্রে মিথেনের পরিমাণ এতই বেশি যে তা কোনভাবেই জৈব হতে পারে না। শনিতে পর্যবেক্ষণ চালিয়েছিল ক্যাসিনি মহাকাশযান, সেই সময় তা মিথেনের রহস্য উদ্ধারে টাইটানে হাইজেন্স নামের একটি অনুসন্ধানী যন্ত্র নামিয়েছিল।

হাইজেন্সের ছবি দেখাচ্ছে পৃথিবীর সঙ্গে টাইটানের ভূপ্রকৃতির অনেক মিল আছে। টাইটানে আছে নদী, সম্ভবত সেখান দিয়ে তরল মিথেন প্রবাহিত হয়। জল বরফ রূপেই আছে, কারণ টাইটানের তাপমাত্রা -১৮০ ডিগ্রি। হাইজেন্স নেমেছিল কাদার মধ্যে, সেই কাদাতে জল নয়, আছে মিথেন। সম্ভবত টাইটানের ভিতরের মিথেন আগ্নেয়গিরির থেকে বেরিয়ে আসে।

হাইজেন্সের ক্যামেরাতে টাইটান 

মিথেনের উৎস জৈব না হলে বিজ্ঞানীদের টাইটান নিয়ে আগ্রহের কারণ কী? আমরা পরে দেখব পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির সময় কোন ধরনের বায়ুমণ্ডল ছিল বলে মনে করা হয়। টাইটানের সঙ্গে তার অনেক মিল আছে। কাজেই টাইটানে কি আদি প্রাণের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে?

সৌরজগৎ নিয়ে আলোচনা শেষ করার আগে আরেকটা কথা বলে নেওয়া যাক। যদি সত্যিই মঙ্গল বা সৌরজগতে অন্য কোথাও প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়, কিন্তু দেখা যায় তার সঙ্গে পৃথিবীর প্রাণের মিল অনেক, তাহলে আমাদের সিদ্ধান্ত করতে হয় যে তাদের উৎস এক। সেটা খুব অসম্ভব নয়। গ্রহ বা উপগ্রহদের সঙ্গে গ্রহাণু বা ধূমকেতুদের সংঘর্ষে অনেক সময়ই কিছু পাথরের টুকরো মহাকাশে উৎক্ষিপ্ত হয়। তার স্নগে ব্যাকটেরিয়ার মতো এককোশী জীব চলে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক, আমরা চাঁদের ক্ষেত্রে দেখেছি যে ব্যাকটেরিয়ার স্পোর বায়ুশূন্য অবস্থায় জীবিত থাকতে পারে, সুযোগ পেলে সে আবার বংশবিস্তার করে। এভাবে সৌরজগতের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে প্রাণের চলাচলের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অবশ্য অন্য কোথাও প্রাণের সন্ধান পাওয়ার আগে পর্যন্ত এই মতের সত্যমিথ্যা নির্ণয় করা সম্ভব নয়।

সৌরজগতের বাইরে প্রাণের সন্ধান কেমনভাবে করা যাবে? গ্রহের বায়ুমণ্ডল কী দিয়ে তৈরি জানতে পারলে তার মধ্যে প্রাণের সম্ভাবনা বোঝা যায়। যেমন কোনো গ্রহের বায়ুমণ্ডলে যদি অক্সিজেন গ্যাস থাকে, তাহলে সেখানে প্রাণ আছে আমরা ধরে নিতেই পারি। অক্সিজেন সাধারণত অন্য সব মৌলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে, তাই তাকে স্বাভাবিকভাবে মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় না। আমাদের পৃথিবীতে অক্সিজেনের উৎস উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষ।

গ্রহের বায়ুমণ্ডলের উপাদান কেমনভাবে জানা যাবে? মহাকাশের দুই টেলিস্কোপ হাবল ও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এ ক্ষেত্রে খুব কাজে লাগছে। নক্ষত্রের আলো যখন বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে আসে, তখন সেখানকার অণুপরমাণুরা কিছু কম্পাঙ্কের আলো শোষণ করে। সেই আলোর বর্ণালীবিশ্লেষণ করে কোন কোন কম্পাঙ্ক শোষণ করেছে জানলে বায়ুমণ্ডল কী দিয়ে তৈরি জানা যায়। ২০২৫ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যলয়ের গবেষকরা জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ব্যবহার করে কে২-১৮ বি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে মিথেন ও ডাইমিথাইল সালফাইড ও ডাইমিথাইল ডাইসালফাইডের সন্ধান পেয়েছেন।

কে২-১৮ বি গ্রহের বায়ুমণ্ডলের উপাদান এই বর্ণালী থেকে পাওয়া গেছে। কার্বন ডাই অক্সাইডের সঙ্গে ডাইমিথাইল সালফাইড (DMS) ও মিথেনের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। (সৌজন্যে নাসা, ইএসএ, সি এস এ, র‍্যালফ ক্রফোর্ড ও জোসেফ অমস্টেড)

কে২-১৮ বি গ্রহটা পৃথিবীর থেকে বড় কিন্তু নেপচুনের থেকে ছোট। মূল তারা কে-২ আমাদের থেকে একশো কুড়ি আলোকবর্ষ দূরে আছে, তারাটা সূর্যের থেকে ছোট ও শীতল। আগেই বলেছি মিথেনের সম্ভাব্য উৎস হল প্রাণ। বাকি দুটি যৌগকে প্রাণের আরো নিশ্চিত সঙ্কেত মনে করা হয়। তাই পৃথিবীর বাইরে প্রাণের সম্ভাবনা আরো বেড়েছে। অবশ্য প্রাণ থাকলেই যে উন্নত সভ্যতা থাকবে এমন কথা বলা যায় না, কে২-১৮ বি-তে তার সম্ভাবনা নেই, কারণ বায়ুমণ্ডলে মুক্ত অক্সিজেন নেই। কিন্তু আর একটা গ্রহে যদি নিশ্চিত ভাবে প্রাণের খোঁজ পাওয়া যায়, তাহলে ছায়াপথের অন্যত্র উন্নত সভ্যতা থাকার সম্ভাবনা বাড়বে। 

 

(প্রকাশঃ বিজ্ঞান অন্বেষক, সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ২০২৫)