Sunday 30 April 2017

ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোন



ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোনঃ সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


আজ থেকে কুড়ি বছর আগেও সকলের পকেটে মোবাইল ফোন ছিল না। ইন্টারনেট কথাটাও ছিল অপরিচিত। যারা জ্ঞান হওয়া থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের এই দুই আবিষ্কারকে দেখছে, তাদের পক্ষে সে সময়কে কল্পনা করাও শক্ত। কয়েকদিন আগে একটি অল্পবয়সী ছেলে তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করছিল মোবাইল ফোন আসার আগে সময় রাস্তায় বেরিয়ে কেমন করে যোগাযোগ রাখতে হত। এক কথায় এর উত্তর, যোগাযোগ রাখা যেত না। এমনকি আজকে আমরা যাকে ল্যাণ্ডলাইন বলি, ১৮৭৬ সালে আবিষ্কৃত সেই টেলিফোন, তাও তখন ভারতের ঘরে ঘরে ছিল দুর্লভ। গত দুই দশকে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে বিপ্লব ঘটেছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 


মোবাইল ফোন পৃথিবীটাকে অনেক ছোটো করে দিয়েছে। ইন্টারনেটের সঙ্গে জুড়ে সে মুহূর্তের মধ্যে আমাদের হাতে নানা দরকারি তথ্য তুলে দিয়েছে। জীবনকে করে দিয়েছে অনেক সহজ। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রায় কোনো আবিষ্কারই অবিমিশ্র ভালো নয়, তার প্রয়োগের পদ্ধতির উপর নির্ভর করে সে আমাদের উপকার করবে না অপকার। মোবাইল ফোনও তার বাইরে নয় – আমাদের জীবনে তার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। এই নিবন্ধে আমরা তার কয়েকটা দিক দেখব। শুরুতেই একটা কথা বলে রাখা ভালো – বর্তমান লেখক শারীরবিদ্যা বা মনস্তত্ত্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। অন্য যে কোনো সচেতন সাধারণ মানুষের মতো এ বিষয়ে আগ্রহ থেকেই এই লেখা। তবে এ কথা নিশ্চিত যে মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর দিক এবং তা থেকে রেহাই পাওয়ার উপায়, এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পক্ষে দুই দশক সময়টা খুব বেশি নয়। তাই শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। 


প্রথমেই দেখা যাক মোবাইল ফোন আমাদের কোনো শারীরিক ক্ষতি করে কিনা। মাঝে মাঝে আমরা খবরে দেখেছি মোবাইল ফোন ক্যান্সার বা হার্ট অ্যাটাকের মতো প্রাণঘাতী রোগকে ত্বরান্বিত করে। এর পিছনে কতটা সত্যতা আছে? মোবাইল ফোনে ব্যবহার হয় রেডিওতরঙ্গ। ওয়ার্ন্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার ২০১১ সালের বলেছে রেডিওতরঙ্গ থেকে ক্যান্সার হতেও পারে (Group 2B: Possibly carcinogenic to humans)। তবে তাতে সাংঘাতিক ভয় পাওয়ার কিছু আছে বলে মনে হয় না। এই তালিকাতে আরও অনেক জিনিসের নাম পাওয়া যায় যেগুলো আমরা সবাই ব্যবহার করি। কফির নাম এ বছরের গোড়া পর্যন্ত এই তালিকায় ছিল। এখনো আচার, ঘৃতকুমারী পাতার রস বা নারকেল তেল দিয়ে তৈরি কিছু সাবান বা শ্যাম্পুকে সেখানে পাওয়া যাবে। কাজেই শুধুমাত্র তালিকা টু বিতে নাম আছে এখানেই না ছেড়ে দিয়ে এ বিষয়ে আরও একটু অনুসন্ধান করা যাক।


আমরা সবাই জানি গামা রশ্মি বা এক্স রশ্মি জীবদেহে ক্যান্সার ঘটাতে সক্ষম। গামা রে, এক্স রে, মাইক্রোওয়েভ বা রেডিওতরঙ্গ, এরা সবাই তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গ। (আলোও তাই।) প্রশ্ন আসে তাহলে কী মোবাইল ফোন বা মাইক্রোওয়েভ থেকে ক্যান্সার হতে পারে। মনে রাখতে হবে গামা বা এক্স রশ্মির শক্তি অনেক বেশি, তাই তারা জীবকোশের মধ্যে আয়নন ঘটাতে পারে। এই আয়নন ক্রোমোজোমের পরিবর্তন ঘটিয়ে ক্যান্সার সৃষ্টি করে। মাইক্রোওয়েভ বা রেডিও ওয়েভ, এদের শক্তি অনেক কম, তাই কোষের মধ্যে আয়ননের ক্ষমতা এদের নেই। তাই অন্তত এই কারণে মোবাইল ফোন থেকে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। পৃথিবীব্যাপী বেশ কয়েকটি সমীক্ষা চালিয়েও মোবাইল ফোন ও ক্যান্সারের মধ্যে নিশ্চিত কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায়নি। হৃৎপিণ্ড, মানবদেহে গ্লুকোজ বিপাক বা মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালনের উপরে মোবাইল ফোনের প্রভাব বিষয়েও অনেক সমীক্ষা হয়েছে, কিন্তু খুব নিশ্চিত ভাবে বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখতে হবে, এ ধরণের সমীক্ষা দীর্ঘদিন ধরে অনেক মানুষের উপর চালাতে হয় —তবেই কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। তাই স্থির সিদ্ধান্ত করার আগে আমাদের এখনো অপেক্ষা করতে হবে। 


তবে মোবাইল ফোন শরীরের অন্য রকমের ক্ষতি যে করে সে বিষয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই নিশ্চিত। বিশেষ করে এখানে দৃষ্টিশক্তির কথা বলতেই হবে। ফোনের উজ্জ্বল নীলচে সাদা আলো চোখের পক্ষে ক্ষতিকারক। মনে রাখবেন বিবর্তনের ফলে আমাদের চোখ সূর্যের হলদেটে সাদা আলোতে অভ্যস্ত – বর্ণালীর অন্যান্য অংশ দেখতে আমাদের চোখকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। ফোনের ছোটো ছোটো লেখা বা ছবি দেখতেও চোখের উপর চাপ পড়ে। তার থেকে মাইওপিয়া বা দৃষ্টিক্ষীণতা হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। তবে শুধুমাত্র ফোনের উপর দোষ দিলে সম্ভবত আমরা একদেশদর্শিতার স্বাক্ষর রাখব। কম্পিউটার, ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি – এ ধরণের অনেক আধুনিক যন্ত্র আমাদের দৃষ্টি শক্তির উপর এই রকম প্রভাব ফেলে। তেমনি সারাক্ষণ কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শোনা যে কানের ক্ষতি করে, তাতেও সন্দেহ নেই। 


শারীরবৃত্তীয় প্রভাবের কথা ছাড়াও মোবাইল ফোন, আরও বিশেষ করে বললে স্মার্ট ফোন, আমাদের জীবনকে নানা ভাবে প্রভাবিত করে। বর্তমানে পৃথিবীর মানুষের এক চতুর্থাংশ এই ফোন ব্যবহার করে এবং এই সংখ্যাটা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ছে। আমাদের সামাজিক রীতিনীতি, আমাদের ব্যবহারকে স্মার্ট ফোন অনেকভাবে যে পালটে দিয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমরা এখন অনেকভাবেই এই ফোনের উপর নির্ভরশীল। তাই সে বিষয়েও নজর দেওয়া প্রয়োজন। এদের অনেকগুলোই অবশ্য কম্পিউটার বা ল্যাপটপের জন্যেও সত্যি, কিন্তু এই যন্ত্রগুলো কখনোই স্মার্ট ফোনের মতো সহজে সর্বত্র ব্যবহার যোগ্য নয়। তাই আমাদের আলোচনার সিংহভাগ অধিকার করে থাকবে স্মার্ট ফোন।


ইন্টারনেটে বা খবরের কাগজে খুঁজলেই স্মার্ট ফোনের নানা রকম কুপ্রভাব সম্পর্কে খবর পাওয়া যাবে। আশেপাশের লোকের থেকেও আরও নানা কথা শোনা যায়। তার মধ্যে কয়েকটা আমার কাছে অন্তত খুব হাস্যকর মনে হয়েছে। যেমন সেদিন ইন্টারনেটে পড়লাম গুগল ম্যাপ এবং মোবাইল ফোনে জিপিএস-এর কল্যাণে মানুষ ম্যাপ দেখতে ভুলে যাচ্ছে। বুঝতেই পারছেন এখানে মূলত পশ্চিমের উন্নত দেশ – যেখানে গাড়ি চালানো খুব স্বাভাবিক একটা স্কিল -- সেখানকার কথাই বলা হয়েছে। লেখকের মনে হয়েছে শেখা জিনিস ভুলে যাওয়া এবং তা নিয়ে চিন্তা না করাটা খুব ভালো কথা নয়। বাক্যটা ছিল ‘There is nothing that can define being dumber better than losing a skill, and not caring about it, don’t you think?’


আমার কিন্তু মনে হয় অনেক স্কিল বা দক্ষতা সমাজের, এবং আরও বিশেষভাবে বললে প্রযুক্তির, বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনাবশ্যক হয়ে পড়ে। মানচিত্র দেখতে শেখাকে এমন কোনো আবশ্যিক প্রয়োজন বলে মেন নেয়া আমার কাছে শক্ত। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ গাড়ি চালাতে জানেন না এবং মানচিত্র দেখতে তাঁদের কালেভদ্রে প্রয়োজন হয়। তবে মানচিত্র দেখতে পারাটা অপ্রয়োজনীয় হতে পারে, কিন্তু সব সমস্যাকে এরকম হালকা ভাবে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আমরা আর কোন কোন দক্ষতা হারাচ্ছি দেখা যাক।


আমাদের দেশে ইংরাজি ভাষা শেখার একটা সমস্যা অধুনা দেখা দিয়েছে। এস এম এসের মাধ্যমে বার্তা বিনিময়ে জন্য, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, অনেক সাধারণ কথাকে সংক্ষিপ্ত করে নিয়েছে। lol বা bbl আমরা অনেকেই মেসেজে দেখেছি। ইন্টারনেটে এক তালিকায় দেখলাম দুহাজার পাঁচশ এ রকম শর্ট কোড বা সংক্ষিপ্ত রূপ রয়েছে। প্রতিদিন এই সংখ্যাটা বাড়ছে। সংখ্যাটা মোটেই ছোটো নয়, এক হিসাবে দেখা যায় যে পরিভাষা বা টেকনিকাল শব্দ বাদ দিলে প্রতিদিন ইংরাজি ভাষায় যত শব্দ কাজে লাগে, তার নব্বই শতাংশই মাত্র তিন হাজার শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কে জানে, আড়াই হাজার শর্ট কোড হয়তো ভবিষ্যতে এক নতুন ভাষা তৈরির দিকে এগোচ্ছে। তা এগোক, কিন্তু এই মুহূর্তে এই সংক্ষিপ্ত রূপের ব্যবহার এবং বানান ঠিক করার সফটওয়্যারের সুবিধার জন্য কোনো শব্দের বানান মনে রাখার কোনো প্রয়োজন হচ্ছে না। আমাদের ছেলেমেয়েরা বানান শিখছে না বলে শিক্ষকরা হা হুতাশ করছেন। 


একটু গভীর চিন্তা করলে দেখব একই সমস্যা আরও বহু নানা ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিশেষ করে ইন্টারনেটের কল্যাণে নানা তথ্য, কখনো ঠিক কখনো ভুল, খুব সহজে পেয়ে যাচ্ছি। আমাদের ছোটবেলার পড়ায় বহু তথ্য মাথায় রাখতে হত। এখন প্রশ্নের উত্তর, রচনা, হোমওয়ার্ক, এমনকি স্কুলের প্রজেক্টও একটু খোঁজ করলে নেট থেকে পাওয়া যায়। স্মার্ট ফোনের সুবাদে সবই এখন সহজলভ্য। তার ফলে ছাত্রছাত্রীদের অনেক কিছুই নিজেদের আর করতে হচ্ছে না। 


শিক্ষার ক্ষেত্রে এই সমস্যা নিশ্চয় খুব গভীর। কিন্তু এর সমাধান কী? আমরা চাইলেই তো আর ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাবে না। কোন স্কিলটা আমাদের দরকারি আর কোন দক্ষতা আজকের দিনে সম্পূর্ণ অনাবশ্যক – সে কথা কেমন করে ঠিক করা যাবে তা আমি অন্তত জানি না। একসময় নামতা শেখাটা খুব দরকারি ছিল, ছোটোখাটো যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ মুখে মুখেই করে নেওয়া যেত। গত বইমেলাতে দুশ পঞ্চাশ টাকা দামের বইতে দশ পার্সেন্ট ডিসকাউন্টের পর বিল কত হয় তার জন্য কোনো একটি দোকানে দোকানদারকে ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে দেখেছি। নামতা ভুলে গেছেন বলে বিক্রেতার কোনো সমস্যা যদি না হয়, তা হলে নামতা মুখস্থ করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কথা বলতে বানান জানার প্রয়োজন হয়না। ফোন বা কম্পিউটারে টাইপ করার সময়ও তাই, কারণ সফটওয়্যার ভুল বানান সংশোধন করে দেয়। হাতে লেখার সময়ই সমস্যাটা দেখা দিচ্ছে। আজকের দুনিয়ায় বানান মনে রাখার প্রয়োজনীয়তা নামতা মুখস্থ করারই মতো, নাকি তার দরকার অনেক বেশি, এ প্রশ্নের উত্তর আমার অজানা। 


ইন্টারনেট থেকে উত্তর টোকা, অর্থপুস্তক অর্থাৎ নোটবই থেকে উত্তর টোকা বা গৃহশিক্ষকের বলে দেয়া উত্তর টোকা – এই তিনের মধ্যে পার্থক্য আছে কি? আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মুখস্থ বিদ্যার গুরুত্বটা অনেকটাই বেশি, নিজে ভাবনা চিন্তার সুযোগ সেখানে কম। স্কুলে যে ভাবে করানো হয়েছে সে পদ্ধতিতে করা হয়নি বলে সঠিক অঙ্ক কেটে দেওয়া হয়েছে – এ ঘটনার মুখোমুখি হয়তো অনেকেই হয়েছেন। এই যুগে দাঁড়িয়ে সম্ভবত ভেবে দেখার সময় এসেছে এই শিক্ষা ব্যবস্থা আরও কতদিন আমরা অপরিবর্তিত রাখব। ইতিহাস মানে রাজাদের বংশ তালিকা, জ্যামিতি মানে উপপাদ্য মুখস্থ, বিজ্ঞান মানে সূত্র ও সংজ্ঞাগুলোকে দাঁড়ি কমা ফুলস্টপ সমেত খাতায় উগড়ে দেওয়া – মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে এই শিক্ষা পদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা বিচার করা দরকার। ইন্টারনেট আমাদের অনেক কিছু শেখাতে পারে, প্রয়োজন তার সঠিক ব্যবহার।


স্মার্ট ফোন আমাদের বিনোদনের সংজ্ঞাকে পালটে দিয়েছে। চলচ্চিত্র যেদিন হল থেকে টেলিভিশনের মাধ্যমে আমাদের ঘরে পা রেখেছিল, সেদিন যে পরিবর্তন হয়েছিল, তার থেকেও এই পরিবর্তন আরও ব্যাপক, তার তাৎপর্য আরও গভীর। খুব সহজেই, প্রায় বিনা ব্যায়ে সিনেমা, গান ইত্যাদি স্মার্ট ফোনে পৌঁছে যাচ্ছে, বন্ধুদের মধ্যে শেয়ার হয়ে যাচ্ছে। পথে ঘাটে মোবাইল ফোনে গেম খেলা নিশ্চয় সকলেরই নজরে এসেছে। ফেসবুক, টুইটারের মতো সোশাল মিডিয়ার কথা আগে চিন্তা করাই যেত না, এখন তা অনায়াসলভ্য। এর ভালো দিকগুলোকে নিশ্চয় অস্বীকার করা যাবে না। সম্প্রতি কাশ্মীরে আন্দোলনরত জনগণের উপর কেন্দ্রীয় সরকার যে আক্রমণ নামিয়ে এনেছে, শুধুমাত্র মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের উপর নির্ভর করে থাকলে সে খবর আমাদের কাছে পৌঁছত কিনা সন্দেহ। বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রতিবাদের রূপকে পালটে দিয়েছে সোশাল মিডিয়া। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত এই মাধ্যমের বিপদগুলিকেও অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে পড়াশোনাতে অমনোযোগের কথা প্রায়ই শোনা যায়। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধির সময় এই সহজলভ্য বিনোদন, যা অনেক সময় অবাঞ্ছনীয় রূপও নিয়ে থাকে, তার প্রভাব খুব গভীর হতে পারে। 


এই সমস্যাটাও নতুন নয়। টেলিভিশন চালু হওয়ার সময় আমরা কিশোর মনের উপর তার প্রভাব নিয়ে চিন্তা করেছি। ভিডিও গেম আসক্তি নিয়ে এক সময় প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। পুরানো অভ্যাসকে ভেঙে ফেলা অনেক নতুন প্রযুক্তিরই একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেই সময় যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব পড়ে সমাজজীবনে। আজ আমরা সেই রকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। 


তবে বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সমাজে অল্প বয়সীদের মধ্যে এই মুহূর্তে সমস্যাটা যে আগের থেকে অনেক বেশি ব্যাপক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়ে নিউক্লিয় পরিবার সৃষ্টির ফলে বাড়ছে একাকীত্ব। শহরে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলোর সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। আমাদের জীবনের অপূর্ণ আশা পূরণের জন্য সাফল্যের ইঁদুর দৌড়ে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্মের পর থেকেই ঠেলে দিচ্ছি। তাদের বোঝাচ্ছি যে তোমার নিজের সাফল্যকে পাখির চোখ করে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তার জন্য তোমার বন্ধুবান্ধবী, আত্মীয় স্বজন, পরিচিত, কারোর কথা ভাবার প্রয়োজন নেই। নয়া উদার নীতির যুগে সাফল্যই একমাত্র মাপকাঠি, নৈতিকতা আদৌ বিচার্য নয়। যেখানে বাবা মায়েরাই তাঁদের সন্তানদের সমাজবিচ্ছিন্ন করে রাখতে চান, সেখানে একাকীত্বের সঙ্কট গভীর হতে বাধ্য। যৌথ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে অল্প বয়স্করা সহজলভ্য বিনোদনের কোনো বিকল্প হাতে পায় না। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার। সমাজবিচ্ছিন্নতা শুধুমাত্র অল্পবয়সীদের সমস্যা নয়, অনেক বয়স্ক ব্যক্তিও এর শিকার হয়ে এই ধরণের বিনোদনকে বেছে নিয়েছেন।


এই সমস্যার কোনো চটজলদি সমাধান বর্তমান লেখকের অজ্ঞাত। আমরা হয়তো কাউকে ক্ষতিকর দিকগুলো বোঝাতে পারি, কিন্তু তার সামনে কোনো বিকল্প না তুলে ধরলে সে কাজটা অধিকাংশ সময়েই অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হতে বাধ্য। বিকল্প সৃষ্টির পথ দীর্ঘ এবং আয়াসসাধ্য। কিন্তু সেই দিকেই এগোনো ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় আছে কী?


মনে হতেই পারে যে স্মার্ট ফোন ইত্যাদি যখন এতই সমস্যার, তখন সেটা থেকে দূরে সরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারো কারো ক্ষেত্রে সেটা সঠিক পথ হতে পারে, কিন্তু গোটা সমাজের ক্ষেত্রে এই সমাধান অচল। নতুন প্রযুক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। নানা দেশে নানা সময় সে চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু কখনোই তাতে দীর্গমেয়াদি সাফল্য আসেনি। নব আবিষ্কৃত প্রযুক্তিকে হৃদয়ঙ্গম করে, তাকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করা ছাড়া কোনো বিকল্প হতে পারে না। 



প্রকাশিতঃ নিশিত সাহিত্যপত্র উৎসব ২০১৬
       
       
       
    

       
       


        

No comments:

Post a Comment