Friday, 19 May 2017

সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখরঃ শতবর্ষ


নক্ষত্রের মৃত্যু ও দুই বিজ্ঞানী

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


(জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী চন্দ্রশেখরের জন্মশতবর্ষে ছোটোদের পরিচালিত একটি পত্রিকায় এই লেখাটা প্রকাশিত হয়েছিল। কিছুটা পরিবর্তনের পর লেখাটি এখানে তুলে দিলাম।)

তোমরা সবাই নিশ্চয় জেনে গেছে যে ২০০৯ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক বিজ্ঞানী, ভেঙ্কটরমন রামকৃষ্ণণ। এও নিশ্চয় জানো যে কোষের মধ্যে যে রাইবোজোম থাকে, তার গঠন আবিষ্কারের জন্য তাঁকে এই সম্মান দেওয়া হয়েছে। আমি আজ অন্য এক বিজ্ঞানীর আবিষ্কার নিয়ে একটা গল্প তোমাদের শোনাতে বসেছি। তিনিও জন্মসূত্রে ভারতীয়, তিনিও নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এবছর তার জন্মের একশো বছর পূর্ণ হল। অনেকেই নিশ্চয় নামটা ধরে ফেলেছ। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, আমি সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখরের নোবেল জয়ের কথাই তোমাদের আজ বলব। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীমহল তাঁকে চন্দ্র নামে চেনে।

চন্দ্রশেখরের জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত ভারতের লাহোরে ১৯১০ সালের ১৯শে অক্টোবর। তাঁর বাবা চন্দ্রশেখর সুব্রহ্মনিয়া আয়ার তখন সেখানে রেল দপ্তরে চাকরি করতেন। মা সীতালক্ষ্মী বালাকৃষ্ণ পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন যদিও স্কুলে প্রথাগত পড়াশোনার সুযোগ তাঁর বিশেষ হয়নি। নিজের চেষ্টাতে সারাজীবন তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যান। কিন্তু তাঁদের পরিবারের যে সদস্যের কথা আমরা সকলেই জানি, তিনি হলেন বাবার ছোটো ভাই। তার নাম চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন, আজ পর্যন্ত এক মাত্র ভারতীয় নাগরিক যিনি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

চন্দ্রশেখরের পড়াশোনা মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে। তাঁর শিক্ষকেরা সবাই বুঝতে পেরেছিলেন যে এক বিরল প্রতিভার তাঁরা সম্মুখীন। কাকা রমন তার কলকাতার গবেষণাগারে কাজ করার সুযোগ তাঁকে দিয়েছিলেন। চন্দ্রশেখরের বয়স তখন মাত্র আঠারো । তবে অচিরেই বহু যন্ত্রপাতি ভাঙার পরে সবাই বুঝলেন যে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান তাঁর বিষয় হতে পারে না। কিন্তু এই সময়ের এক যোগাযোগে চন্দ্রশেখরের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। রমনের ঘরে তাঁর হাতে এসেছিল জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান অর্থাৎ Astrophysics সংক্রান্ত একটি বই The Internal Constitution of the Stars। নক্ষত্রদের অভ্যন্তরীণ গঠন নিয়ে বইটি লেখেন আর্থার স্ট্যানলি এডিংটন। বইটি রুদ্ধশ্বাসে শেষ করেন চন্দ্রশেখর। তখন থেকেই এডিংটন তাঁর কাছে আদর্শস্বরূপ। তোমরা দেখবে যে শেষ পর্যন্ত কিন্তু এডিংটনকে এত শ্রদ্ধার ফল চন্দ্রের পক্ষে ভালো হয়নি।

সে বছরই মাদ্রাজে এসেছিলেন এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রেই তাঁর নাম জানে, আর্নল্ড সমারফেল্ড। তিনিও আঠারো বছরের এই ছাত্রের বিজ্ঞানে দখল দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন এবং তাঁকে ভবিষ্যৎ গবেষণার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন। ফলত সেই বছরই; অর্থাৎ ১৯২৮ সালে চন্দ্রের প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। এডিংটনের তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে তারাদের ভিতরে পরমাণু, ইলেকট্রন ও আলো নিজেদের মধ্যে কেমনভাবে ক্রিয়া করে সে বিষয়ে তিনি গবেষণাটি করেছিলেন।

তরুণ চন্দ্রশেখর এখন অনেক বেশী সাহসী । তিনি ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির সদস্য র‍্যালফ ফাউলারকে তাঁর পরবর্তী গবেষণাটি লিখে পাঠান। উত্তর দিয়েছিলেন ফাউলার। তাঁর মতামত অনুযায়ী সামান্য পরিবর্তন করে সেটি Proceedings of the Royal Society-তে ছাপা হয়। এসময় মাদ্রাজে এসেছিলেন আর এক দিকপাল পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। চন্দ্রশেখর জানতেন আটাশ বছর বয়সী এই বিজ্ঞানী আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে তিনি যে আবিষ্কার করেছিলেন, তার জন্য একত্রিশ বছর বয়সে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। তোমরা নিশ্চয় ভাবছ যে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে এত বড়ো কাজ করা সম্ভব? আমাদের গল্পের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করো । যা হোক, হাইজেনবার্গের সঙ্গে চন্দ্রশেখরের বন্ধুত্ব হয়েছিল। মেঘনাদ সাহাও এসময় চন্দ্রশেখরের গবেষণার প্রশংসা করেন।

চন্দ্রশেখর স্থির করলেন ইংল্যান্ডে যাবেন। পড়তে যাবেন কেমব্রিজে। সেখানে আছেন ফাউলার। আর আছেন তাঁর আদর্শ এডিংটন। ১৯৩০ সালের ৩১ শে জুলাই বোম্বাই বন্দর থেকে তাঁর জাহাজ ইংল্যান্ডে রওনা হল। চন্দ্রশেখরের বয়স কুড়ি পূর্ণ হতে তখনো কয়েক মাস বাকী। 

শান্ত আরব সাগরের বুক চিরে জাহাজ এগিয়ে চলেছে। ডেকে বসে এক তরুণ পদার্থবিজ্ঞানের বইতে নিমগ্ন। কী ভাবছেন তিনি? তাঁর মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে এডিংটনের বইতে লেখা নক্ষত্রদের মৃত্যুর বিবরণ। সূর্য কেন নিজের মাধ্যাকর্ষণের টানে আরো ছোটো হয়ে যাচ্ছেনা? এডিংটন দেখিয়েছেন যে সূর্যের বিকিরণের চাপ ও উত্তপ্ত গ্যাসের চাপ মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে কাজ করে। তারাই সূর্যকে তার বর্তমান আকারে ধরে রাখে । কিন্তু যখন কোনো তারকার জ্বালানি ফুরিয়ে যায় তখন কী হয়? তখন তো এই দুই বল আর মাধ্যাকর্ষণের সমান থাকবে না। এডিংটন বললেন তারকা নিজের মাধ্যাকর্ষণের টানে আস্তে আস্তে ছোটো হতে থাকবে । যত ছোটো হবে, স্বাভাবিক ভাবে ততই তার ঘনত্ব বাড়তে থাকবে । এডিংটনের মতে এক সময় নক্ষত্রের কেন্দ্র এতটাই ঘন হয়ে যাবে যে তাকে মাধ্যাকর্ষণ আর চাপ দিয়ে ছোটো করতে পারবে না।

  সেই রকম তারার সন্ধান জানা ছিল। শ্বেত বামন নক্ষত্র এতই কম উজ্জ্বল যে খালি চোখে দেখার প্রশ্ন ওঠে না। ১৭৮৩ সালে প্রথম শ্বেত বামন নক্ষত্রটিকে আবিষ্কার করেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেল, তবে তখন তার সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। এর পর আসে ফ্রিয়েডরিশ উইলহেল্ম বেসেলের কথা। আমরা সবাই রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা লুব্ধক বা সিরিয়াসকে চিনি।  বেসেল তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বলেন যে সেটি আসলে যুগ্ম নক্ষত্র, তার একটি অদৃশ্য সঙ্গী আছে। সেই সঙ্গীটি দূরবিনে ধরা দিল 1862 সালে, ঔজ্জ্বল্য খুব কম বলে তাকে আগে দেখা যায়নি। তাকে প্রথম দেখতে পেয়েছিলেন মার্কিন লেন্স নির্মাতা আলভিন গ্রাহাম ক্লার্ক। দূরবিনের লেন্স বানানো ছিল তাঁদের পারিবারিক ব্যাবসা, একটি লেন্স পরীক্ষা করতে গিয়ে তিনি সেটিকে আবিষ্কার করেছিলেন। এই হল নতুন দুনিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে জ্যোতিবিদ্যার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। এর নাম দেওয়া হল সিরিয়াস বি।

শ্বেত বামনরা অন্য সব নক্ষত্রদের থেকে আলাদা। তাদের অদ্ভুত চরিত্র সম্পর্কে কেমন করে জানা গেল তার বিবরণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি নরিস রাসেল লিখে গেছেন। ১৯১০ সালে তিনি হার্ভার্ড মানমন্দিরের অধিকর্তা এডওয়ার্ড পিকেরিং-এর থেকে বামন নক্ষত্রদের শ্রেণি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছিলেন। সব বামন নক্ষত্রই M শ্রেণিতে পড়ছিল, কিন্তু হার্ভার্ডের মহিলা জ্যোতির্বিদ উইলিয়ামিনা ফ্লেমিং দেখান যে হার্শেলের দেখা নক্ষত্রটি হল A-শ্রেণিতে পড়ে। এই শ্রেণির অন্য নক্ষত্ররা সবাই অনেক বেশি উজ্জ্বল, অর্থাৎ এদের তাপমাত্রা খুব বেশি। তাপমাত্রা জানা থাকলে তার প্রতি একক ক্ষেত্রফল থেকে কত শক্তি বেরোয় তা তাপগতিবিদ্যা থেকে নির্দিষ্ট।1 কোনো নক্ষত্রের মোট শক্তি বিকিরণের পরিমাণকে লিখতে পারি তার প্রতি একক ক্ষেত্রফল থেকে বিকিরিত শক্তি ও তার উপরিতলের ক্ষেত্রফলের মোট গুণফল। কোনো তলের তাপমাত্রা কেলভিন স্কেলে T হলে তার প্রতি একক ক্ষেত্রফল থেকে নির্গত শক্তির পরিমাণ হল E=sT4। একে বলে ভীনের সূত্র, s হল ভীন-বোলজ্‌মান ধ্রুবক। সব A শ্রেণির তারাদের ক্ষেত্রেই একক ক্ষেত্রফল থেকে বিকিরিত শক্তির পরিমাণ কাছাকাছি, কারণ তাদের তাপমাত্রার খুব একটা পার্থক্য হয় না। সুতরাং এই তারাদের এত কম উজ্জ্বলতার একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে, এরা নিশ্চয় আয়তনে খুব ছোট বা বামন। হিসাব করে দেখা গেল এই দ্বিতীয় তারাটির ভর সূর্যের প্রায় সমান, কিন্তু তা আয়তনে পৃথিবীর থেকে সামান্য বড়ো। এরকম আরো তারকার খাঁজ মিলল। সহজ অঙ্ক কষে দেখা গেল এদের এক ঘন সেন্টিমিটার, মানে বড়ো চামচের এক চামচ, পদার্থের ভর হবে একশো কিলোগ্রাম। তারার কেন্দ্রের এই বিশাল ঘনত্বই মাধ্যাকর্ষণকে  প্রতিহত করে। আয়তনে ছোটো ও সাদা রঙের বলে এধরনের নক্ষত্রদের নাম দেয়া হল শ্বেত বামন। এডিংটনের সহকর্মী ফাউলার দেখালেন যে নতুন আবিষ্কৃত কোয়ান্টাম তন্ত্র প্রয়োগ করলে দেখা যায় তারাদের ঘনত্ব একটা নির্দিষ্ট মানের চেয়ে বেশী হতে পারে না। পদার্থের অতি ঘন অবস্থায় ইলেকট্রনেরা যে চাপ তৈরি হয়, তা মাধ্যাকর্ষণকে প্রতিহত করে।

যদিও ফাউলারের তত্ত্ব মাত্র দু বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল, তরুণ চন্দ্রশেখর এই সমস্ত বিষয়ে পরিচিত ছিলেন। জাহাজে যেতে যেতে তিনি ভাবলেন যে ফাউলার তো ধরে নিয়েছেন  ইলেকট্রনরা নিউটনের গতিসূত্র মেনে চলে । কিন্তু আমরা জানি যে যদি কোনো কণা আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে চলে, তাহলে তাদের জন্য নিউটনের বলবিদ্যা কাজ করে না।  আইনস্টাইন আবিষ্কৃত বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ বা Special Theory of Relativity-ই একমাত্র তার গতিবিধি ব্যাখ্যা করতে পারে। চন্দ্রশেখর বুঝতে পারলেন যে নক্ষত্র যখন মাধ্যাকর্ষণের টানে ছোটো হয়ে আসে, তখন তার ভিতরের ইলেকট্রনের বেগ খুব বেড়ে যায়। তার ফলে ফাউলারের তত্ত্বের পরিবর্তন হতে বাধ্য । জাহাজেই তিনি প্রাথমিক অঙ্কটা কষে ফেললেন। দেখলেন যে শ্বেত বামনের ভর সূর্যের থেকে ১.৪ গুণের বেশী হওয়া সম্ভব নয়। তার থেকে বেশী ভরের তারাদের মাধ্যাকর্ষণ আরো বেশী, তাই ইলেকট্রনের চাপ মাধ্যাকর্ষণকে প্রতিহত করতে পারবে না। তারাটা ছোটো হতে হতে একটা বিন্দুতে পর্যবসিত হবে যার ঘনত্ব অসীম । আমরা যাকে আজ কৃষ্ণ গহ্বর বা Black Hole বলি, তাই হল ভারী তারাদের অন্তিম পরিণতি । এই কাজের সময় চন্দ্রশেখরের বয়স কুড়িও পূর্ণ হয়নি।


সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর (অক্টোবর ১৯, ১৯১০ - আগস্ট ২১, ১৯৯৫)

কেমব্রিজে পৌঁছে চন্দ্রশেখর তাঁর তত্ত্ব ফাউলার, এডিংটন প্রমুখদের কাছে ব্যাখ্যা করেন। পরের দু বছরে তিনি তাকে আরো বিকশিত করেন। ফাউলারের অধীনে তিনি গবেষণা করেছিলেন। এডিংটনও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, তার এ বিষয়ে গবেষণার খবর নিতেন। এডিংটনকেই তখন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী বলে সবাই মেনে নিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পেয়ে চন্দ্রশেখর নিজেও খুব খুশী ছিলেন। হঠাৎই হল বিনা মেঘে বজ্রপাত।

১৯৩৫ সালের ১১ই জানুয়ারি রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনেমিকাল সোসাইটির এক সভায় চন্দ্রশেখর তাঁর তন্ত্র ব্যাখ্যা করেন। তাঁর ঠিক পরে বলতে ওঠেন এডিংটন। তিনি কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি ছাড়াই চন্দ্রশেখরের গবেষণাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। চন্দ্রশেখর হতচকিত হয়ে যান। তিনি অনেকবার এডিংটনের সঙ্গে তার গবেষণা নিয়ে আলোচনা করেছেন, কখনো তো এডিংটন তাঁর কাজকে ভুল বলেন নি। হঠাৎ করে প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের এক সভায় এরকম ব্যক্তিগত আক্রমণ তাঁকে স্তম্ভিত করে দেয়। চন্দ্রশেখর উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে যান, কিন্তু সভাপতি তাঁকে সেই সুযোগ দেন নি।

চন্দ্রশেখর জানতেন এডিংটন যা বলছেন তা পুরোপুরি ভুল। তিনি আরো অবাক হয়ে যান এই ভেবে যে এডিংটন নিজে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ বিষয়ে প্রথম সারির বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম। অন্য কেউ না বুঝুক, তিনি তো চন্দ্রশেখরের গবেষণার প্রকৃত অর্থ বুঝবেন! এডিংটনের নামডাক তখন এতই বেশী যে কোনো বিজ্ঞানীই প্রকাশ্যে সে সময় চন্দ্রশেখরকে সমর্থন করলেন না। এর পরেও এডিংটন আরো প্রায় দশ বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু কখনোই তিনি নিজের ভুল স্বীকার করেন নি। পরেও বারবার তিনি চন্দ্রশেখরের তত্ত্বকে আক্রমণ করেছেন। চন্দ্রশেখর অবশ্য তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় এই যে ১৯৪৪ সালে যখন চন্দ্রশেখর রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন, তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন এডিংটন। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেল। চন্দ্রশেখরের আবিষ্কারের তাৎপর্য বুঝতে বুঝতে আরোপ্রায় তিরিশ বছর গড়িয়ে যায়। অনেক বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক মনে করেন যে এর ফলে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান অন্তত দুই দশক পিছিয়ে গেছে।

১৯৩৫ সালের পরে চন্দ্রশেখর আরো বিভিন্ন 'বিষয়ে গবেষণা করেন। তিনি অবশেষে আমেরিকা চলে যান ও সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। শ্বেত বামনের সর্বোচ্চ ভরকে আমরা আজ চন্দ্রশেখর সীমা বলে নাম দিয়েছি। আমরা এও জানি যে শ্বেত বামন ও কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে আরো একটা স্তর আছে। যে সমস্ত তারাদের মোটামুটি তিন গুণের কম, সেগুলো জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে নিউট্রন তারাতে রূপান্তরিত হয়। চন্দ্রশেখর যখন গবেষণা করেছিলেন, তখন নিউট্রন আবিষ্কার হয়নি, তাই তীর পক্ষে সে সময় তাকে হিসাবে ধরা সম্ভব ছিল না। অবশেষে ১৯৮৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। উনিশ বছরের এক তরুণ জাহাজের ডেকে বসে যা ভেবেছিলেন, সেটাকেই নোবেল করিটি সেই তরুণের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব মনে করেছিলেন। হবেই তো, নক্ষত্রের শেষ পরিণতি কী হবে, তা আমাদের বুঝিয়েছিলেন চন্দ্র। তার চেয়ে বড়ো কাজ আর কী খুব বেশী হবে?

১৯৯৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। জীবনের প্রায় শেষ দিন পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের একজন বলে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯৯ সালে মহাকাশে উৎক্ষিপ্ত তাঁর নামাঙ্কিত চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি আজও মহাকাশ থেকে নানা খবর আমাদের কাছে পাঠাচ্ছে।

আর্থার এডিংটন
কেন এডিংটন এভাবে চন্দ্রশেখরকে আক্রমণ করেছিলেন তা আজও আমরা ভালোভাবে বুঝতে পারিনি। নানা লোকে নানা মত দিয়েছেন। পরাধীন ভারতবাসীর কৃতিত্ব কি তাঁর সহ্য হচ্ছিল না? কেমব্রিজের আর এক অধ্যাপক হার্ডি অঙ্কের প্রতিভা শ্রীনিবাসন রামানুজনকে কেমন করে সাহায্য করেছিলেন তা আমাদের সকলের জানা। এডিংটন কিন্তু সেই উদাহরণ দেখাতে পারেন নি। বিজ্ঞানীরাও মানুষ, তাঁদেরও ভুলভ্রান্তি হয়, ব্যক্তিগত বিশ্বাস অনেক সময় বৈজ্ঞানিক যুক্তিকে ছাড়িয়ে ওঠে। এডিংটন জ্যোতির্পদার্থবিদ্যাকে পরিণত বিজ্ঞানে রূপান্তরিত করেন। তাঁর এই ব্যবহার বিজ্ঞানের ইতিহাসে কলঙ্কময় ঘটনাদের অন্যতম। বিজ্ঞানের সৌভাগ্য যে চন্দ্রশেখর নিজের জোরে এ মানসিক অবস্থা কাটিয়ে ওঠেন এবং আরো দীর্ঘ ষাট বছর বিজ্ঞানকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেন। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্পর্দার্থবিজ্ঞানীদের নাম করলে তার নাম কারোর পরে থাকবে না, এমনকি এডিংটনের পরেও নয়।



প্রকাশ : ফিনিক্স বৈশাখ ১৪১৭ (২০১১), পরিমার্জিত









Tuesday, 9 May 2017

রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান ভাবনা




রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানভাবনা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

(প্রথমেই একটা স্বীকারোক্তি করে নেয়া ভালো । আমি সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ নই, বিজ্ঞানের ছাত্র। রবীন্দ্রনাথ শেষ বিচারে লেখক। তাঁর অনুরাগী পাঠক হলেও লেখার সাহিত্য বিচার আমার পক্ষে ধৃষ্টতা। তাই তাঁর যে সমস্ত গল্পের পটভূমি বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেমন “তিনসঙ্গী” বা  “ল্যাবরেটরি”, তাদের বিশ্লেষণ এই লেখাতে নেই। অন্যদিকে আমি সমাজবিজ্ঞানীও নই, তাই রবীন্দ্রনাথের লেখার সমাজবিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণও আমার পক্ষে অনধিকারচর্চা। কিন্তু সমাজ-বিচ্ছিন্ন ভাবে বিশেষত প্রযুক্তি বিষয়ে আলোচনার চিন্তাও করা যায় না। তাই এই প্রবন্ধকে বিজ্ঞানের এক ছাত্রের ব্যক্তিগত মত হিসেবেই ধরে নিতে পাঠককে অনুরোধ জানাই )

(১)

সময়টা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক। সে সময় ভারত থেকে যাঁরা বিদেশে পড়তে যেতেন, তাঁরা প্রায় সবাই আইন পড়ে ব্যারিস্টার বা জজ হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। কয়েকজন হয়তো ডাক্তারি শেখার জন্য সাগর পাড়ি দিতেন। জগদীশচন্দ্র বা প্রফুল্লচন্দ্র দু দশক আগে মৌলিক বিজ্ঞানে পড়াশোনা করে দেশে ফিরে এসে গবেষণা করছেন। কিন্তু তাদের ব্যতিক্রম হিসাবেই দেখতে হবে। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর বড়ো ছেলে রথীন্দ্রনাথ ও তাঁর এক বন্ধুর ছেলে সন্তোষ মজুমদারকে আমেরিকাতে কৃষিবিজ্ঞান শেখার জন্য পাঠান। তাঁরা দুজনেই ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। পরবর্তী কালে তাঁর ছোটো জামাই নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীকেও একই লক্ষ্যে সেখানেই পাঠিয়েছিলেন। কবির উদ্দেশ্য ছিল অত্যন্ত গদ্যময়: দেশে কৃষির উন্নতির মাধ্যমে খাদ্যসংকট দূর করা, বা সোজা কথায় বললে দেশের না খেতে পাওয়া মানুষের পেটে দুবেলা খাবার জোগানো। তিনি জানতেন তার জন্য প্রয়োজন আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি; সেটা করায়ত্ত করার জন্যই এঁদের বিদেশযাত্রাতে তাঁর উৎসাহ।
একথা অস্বীকার করা যায় না যে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক, অন্তত প্রথম দৃষ্টিতে, মিশ্র। তাঁর একটি বহুপঠিত কবিতা, “দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর”। অথচ এই একই রবীন্দ্রনাথ অন্য কথাও বলেছেন। বিদেশে দেওয়া “সাধনা” বক্তৃতামালাতে তিনি বলেছিলেন, “Steam andelectricity shall be our nerve and muscle”, অর্থাৎ বাষ্পশক্তি ও বিদ্যুৎ হবে আমাদের স্নায়ু ও পেশী। সভ্যতার চালিকাশক্তিটিকে চিহ্নিত করতে তিনি কোনো ভুল করেননি বা কবিসুলভ ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হয়ে প্রাচীন কালে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন নি। অন্য এক সময় আইনস্টাইন সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন যে তিনি ও আইনস্টাইন দুজনেই নিশ্চিত যে আধুনিক শিল্পের উন্নতি মানুষের অগ্রগতির জন্য জরুরি। “সভ্যতার সংকট” প্রবন্ধে ইংরাজ শাসনের প্রতি তীব্র ধিক্কার বর্ষণের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সেই শাসনের স্থায়িত্ব যে প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে আছে, সে কথা ভোলেন নি। “যে যন্ত্রশক্তির সাহায্যে ইংরেজ আপনার বিশ্বকর্তৃত্ব রক্ষা করে এসেছে তার যথোচিত চর্চা থেকে এই নিঃসহায় দেশ বঞ্চিত।” ভারতের অবস্থার বিপরীতে কবি জাপান ও রাশিয়াতে যে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল, তার তুলনাও করেছেন।
তাহলে পরিণত বয়সে লেখা “মুক্তধারা” বা “রক্তকরবী'-র মতো নাটকে আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার উপর রবীন্দ্রনাথ যে আক্রমণ শানিয়েছেন, তাকে আমরা কোন চোখে দেখব? মুক্তধারা নাটকে যন্ত্ররাজ বিভূতির বিরুদ্ধে ধনঞ্জয়ের লড়াই কিন্তু স্পষ্টতই প্রযুক্তিসভ্যতার বিশু যখন বলে, “ওদের কাছে আমরা মানুষ নয়, কেবল সংখ্যা”, যখন মানুষের নাম হয় ৪৭ফ কিংবা ৬৯ঙ, তখন কি চার্লি চ্যাপলিনের “মডার্ন টাইমস” মনে পড়ে না?
আজীবন সুন্দরের পূজারী কবির এই ক্ষোভ একদিকে নগরসভ্যতার কুশ্রীতার বিরুদ্ধে। বিখ্যাত বিজ্ঞান ঐতিহাসিক জে ডি বার্নাল তাঁর ‘সায়েন্স ইন হিস্ট্রি” বইতে লিখেছেন, “Wealth had never been accumulated so easily; misery had never been so widespread and unmitigated by social defences. With all the new triumphs of engineering went a smoky dirtiness, drabness, and ugliness which no previous civilization could have produced. It was in this environment that science approached its present scale of activity and importance.” শিল্পবিপ্লবের  ফলে শহরগুলির এই ক্লেদাক্ত রূপ নিয়ে মার্কসও চিন্তা করেছিলেন। ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথও। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় মার্কসবাদী নন। কিন্তু যে আধুনিক প্রযুক্তিসভ্যতা মানুষকে শুধু উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবে দেখে, তার অন্য সমস্ত পরিচয় যার কাছে গৌণ, যা প্রতিটি মানুষকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তাঁকে করতেই হয়েছে। আমার কাছে অন্তত সে প্রতিবাদ প্রযুক্তি নয়, ধনতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে। শেষ কথাটা যদি মনে হয় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, খুলুন “রক্তকরবী”-র প্রস্তাবনা । সেখানে সরাসরি রাজাকে কবি বলেছেন,“সোনার খনির মালিক”। ধনতন্ত্রকে এর চেয়ে সহজ করে আর কীই বা বলতে পারতেন? তাও পাছে আমরা ভুল করি, পরের অনুচ্ছেদে গ্রামের কৃষকদের টিটাগড়ের চটকলে মরতে আসার কথা বলেছেন। আর কতো স্পষ্ট করে কবি লিখবেন? উপরের উদ্ধৃতিটির শেষে বার্নাল আধুনিক বিজ্ঞানের বিকাশের যে পটভূমি এঁকেছেন, শিল্পবিপ্লব সৃষ্ট নগরসভ্যতার সেই ক্লেদের বিরুদ্ধে কবি সোচ্চার তিনি সংবেদনশীল, কিন্তু সমাজবিজ্ঞানী নন, তাই কখনো কখনো হয়তো তাঁর প্রতিবাদ পুঁজিবাদী শোষণের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির বিরুদ্ধেও গেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এমন একজন মানুষ যিনি সারা জীবন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। তাই প্রথম যৌবনের অরণ্যকে ফিরে পাওয়ার আকুতি পরবর্তীকালে অনুপস্থিত।
বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মত কী? এমন অনেকে আছেন যাঁরা বিশ্বাস করেন যে বিজ্ঞানীর কোনো সামাজিক দায় নেই। বিজ্ঞান গবেষণা করতে হবে শুধু বিজ্ঞানের জন্য: তার সামাজিক প্রয়োগ আছে কি না দেখার দায়িত্ব বিজ্ঞানের নয়। রবীন্দ্রনাথ এই মতের শরিক নন। ১৯২৫ সালে লেখা “চরকা” প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, “য়ুরোপীয় সভ্যতায় বিজ্ঞানচর্চার সামনে যদি কোনো বড়ো নৈতিক সাধনা থাকে সে হচ্ছে বাহ্যপ্রকৃতির হাতের সব রকম মার থেকে মানুষকে বাঁচানো, আর হচ্ছে মানুষের মনটাকে যন্ত্রে না বেঁধে প্রাকৃতিক শক্তিকেই যন্ত্রে বেধে সমাজের কাজ আদায় করা।“
প্রথম যৌবনের উচ্ছ্বাসের পরে রবীন্দ্রনাথ যে সরল জীবনে ফিরে যাওয়াতে আর বিশ্বাসী ছিলেন না, তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ হল গান্ধীজীর সঙ্গে তাঁর চরকা নিয়ে মনান্তর। দুজনের প্রতি দুজনের শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। কিন্তু গান্ধীজী যখন চরকাকে তাঁর পথের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করলেন; তখন তিনি কুটিরশিল্পকেই আধুনিক ভারত গড়ার চাবিকাঠি হিসেবে ধরে নেন। এই প্রচেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি “চরকা” প্রবন্ধেই লিখছেন, “বিজ্ঞানকে এক পাশে ঠেলে রেখে কেবল হাত চালিয়ে দেশের বিপুল দারিদ্র্য কিছুতে দূর হতে পারবে না। মানুষের জানা এগিয়ে চলবে না, কেবল তার করাই চলতে থাকবে, মানুষের পক্ষে এতো বড়ো কুলিগিরির সাধনা আর কিছুই নেই।” তাঁর স্পষ্ট মত: চরকা যে শুধু স্বরাজ আনার কঠোর সাধনাকে লঘু করে দিচ্ছে তা নয়, আধুনিক ভারত গড়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্যত্রও তিনি একই কথা লিখেছেন।
তবে একথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে মৌল বিজ্ঞান, অর্থাৎ যা সরাসরি প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত নয়, তাকে তিনি অবহেলা করতেন। বিমূর্ত বা মৌল বিজ্ঞানের সঙ্গে তার যোগাযোগ নিয়ে নিবন্ধের শেষ ভাগে আলোচনা করা যাবে। নানাভাবে রবীন্দ্রনাথের কাছে বিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞাননির্ভর গল্পের লেখকদের মধ্যে এইচ জি ওয়েলস যে সর্বকালের শ্রেষ্ঠদের মধ্যে জায়গা করে নেবেন, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর লেখা ওয়ার অফ দি ওয়ার্ল্ডস, ইনভিজিবল ম্যান বা টাইম মেশিন এখন চিরায়ত সাহিত্যের অঙ্গ । বিজ্ঞানের পথ আগামী দিনে কোনদিকে হবে সে বিষয়ে তাঁর  ভবিষ্যৎবাণী আশ্চর্যরকম মিলে যায়। সেই ওয়েলসের সঙ্গে ১৯৩০ সালে জেনেভাতে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, “Physical science of the nineteenth century probably has created the spirit of race superiority in the West. When the East assimilate the physical science, the tide may turn and take a normal course.” এখানেও তিনি স্পষ্টতই দেশের মানুষের কথা চিন্তা করছেন। দেশবাসীরা ভৌত বিজ্ঞান আত্মস্থ করতে পারলেই পশ্চিমের লোক তাদের নিচু নজরে দেখবে না, এই মত একটু অতি সরলীকৃত হতে পারে, কিন্তু দেশের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা এখানে স্পষ্ট। এর সঙ্গে তাঁর ছেলে বা জামাইকে বিদেশে কৃষিবিজ্ঞান শিখতে পাঠানোর কারণের যোগও আমরা খুঁজে পাই। শুধু দেশবাসীর জীবন জীবিকার উন্নতি নয়, তাদের জগৎসভায় মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্যও বিজ্ঞানশিক্ষা জরুরি ।
রবীন্দ্রনাথের জীবনকালের মধ্যেই ভারতীয় বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত হয়েছে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা বা সত্যেন্দ্রনাথ বোসের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল। কলকাতাতে কাজ করলেও সি ভি রমনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনো সাক্ষাতের খবর আমার জানা নেই। কিন্তু জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে তার দীর্ঘ এবং গভীর বন্ধুত্বের কথা সকলেই জানেন। তার একটা কারণ যেমন ছিল জগদীশচন্দ্রের দেশপ্রেম, তেমনি রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর গবেষণা জাতীয় প্রগতির প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছিল। অনেক আর্থিক অসুবিধার মধ্যেও অকাতরে তাঁর গবেষণার জন্য অর্থের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এজন্য ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের সাহায্যপ্রার্থী হতে তিনি দ্বিধাবোধ করেন নি। মহারাজকে লেখা তীর চিঠির একটি অংশ “জগদীশবাবুর জন্য আমি প্রত্যক্ষভাবে মহারাজের নিকট দরবার করিতে ইচ্ছুক - এজন্য আমি আগরতলা যাইতে প্রস্তুত।“ পরের মাসে সত্যিই তাকে আগরতলা যেতে হয়। মহারাজা যথাসাধ্য সাহায্য করেন।
জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার সম্পর্কে ১৯০১ সালে “জড় কি সজীব, নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন রবীন্দ্রনাথ। তা পড়ে স্বয়ং বিজ্ঞানীর প্রতিক্রিয়া, “তুমি যে গত মাসে আমার কার্যের আভাস বঙ্গদর্শনে লিখিয়াছিলে তাহা অতি সুন্দর হইয়াছে। তুমি যে এত সহজে ও বৈজ্ঞানিক সত্য স্থির রাখিয়া এরূপ সুন্দর লিখিতে পার, ইহাতে আমি আশ্চর্য হইয়াছি।” কবি যে সহজেই জটিল বিজ্ঞানের মূল তত্ত্ব আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন, সে বিষয়ে এর চেয়ে বড়ো সাক্ষ্য আর কী হতে পারে?

(২)
তবে এটিই রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক নিবন্ধ নয়। ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গদ্য রচনাই ছিল বিজ্ঞান বিষয়ে। বারো বছর বয়সে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে লেখা এই প্রবন্ধের নাম “গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি”। এখানে কিশোর লেখক অন্যান্য গ্রহে প্রাণীদের থাকার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। এর পরের কুড়ি বছরে বিভিন্ন পত্রিকাতে তিনি অন্তত আরো কুড়িটি বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা ছাপান। এর পূর্ণাঙ্গ তালিকা অধ্যাপক দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান বইটিতে আছে।  রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান বিষয়ে উৎসাহে তাঁর পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। কিন্তু যে সময় প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানশিক্ষা প্রায় অনুপস্থিত, বিজ্ঞান সংস্কৃতিও গড়ে ওঠেনি, সে সময় এই রচনাগুলি যে বিজ্ঞানে তাঁর উৎসাহের স্বাক্ষর দেয়, সে নিয়ে সন্দেহ নেই।
রবীন্দ্রনাথের একটি বইয়ের কথা আলাদা করে বলতেই হয়, তা হল “বিশ্বপরিচয়”। পরিণত বয়সে লেখা তাঁর এই বই আজও সম্ভবত সাধারণের জন্য বাংলা ভাষায় লেখা বিজ্ঞান গ্রন্থদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জায়গা অধিকার করবে। রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথ সেনগুপ্তকে এই বইটি লেখার জন্য বলেছিলেন। তাঁর লেখা মনোমত না হওয়াতে নিজেই নতুন করে বইটি লেখেন। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। ভূমিকাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিজ্ঞানে আগ্রহের ইতিহাস ও কারণ সম্পর্কে অনেক কথা লিখেছেন, আগ্রহী পাঠককে তা পড়ে নিতে অনুরোধ করি। আমরা লক্ষ্য করি যে বিজ্ঞানের সে সময়ের অতি আধুনিক আবিষ্কারও বইটিতে জায়গা করে নিয়েছে।
সেই সময় অর্থাৎ ১৯৩৭ সালে অর্ধেক ইউরোপ ফ্যাসিবাদের কাছে নতজানু হয়ে শান্তি খুঁজছে। চারিদিকে বেজে উঠেছে আসন্ন যুদ্ধের দামামা। রবীন্দ্রনাথ অপর কয়েকজন মনীষীর সঙ্গে পৃথিবীর বিবেক হিসেবে পরিচিত। সেই সময়ের যন্ত্রণা ও জটিলতা তার সাহিত্যে প্রতিফলিত। সময়টাকে বুঝতে গেলে, বিশ্ব পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করতে গেলে যে বিজ্ঞানকে বুঝতে হবে: সেই বোধ থেকেই আমাদের দেশের মানুষের কথা ভেবে তাঁর “বিশ্বপরিচয়” রচনা। দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় তাঁর পূর্বোল্লিখিত বইতে এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।
আমাদের অনেকের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের ভক্ত। তাঁকে আমরা গুরুদেব বলে ডেকে হয়তো নিজেদের অগোচরেই তাঁর লেখায় ধর্মের দিকটাতে বেশী গুরুত্ব আরোপ করি (যদিও তাঁর পরবর্তীকালের লেখায়, বিশেষত “নবজাতক'-এ অস্তিবাদের সঙ্কট সুস্পষ্ট) ৷ কিন্তু “বিশ্বপরিচয়”-এ গীতাঞ্জলির জীবনদেবতাকে তিনি স্থান দেননি । দেখা যাক জীবনের উৎস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কী বলছেন। “বিশ্বরচনার মূলতম উপকরণ পরমাণু: সেই পরমাণুগুলি অচিন্তনীয় বিশেষ নিয়মে অতি সূক্ষ্ম জীবকোষরূপে সংহত হল। ... (কোষের) প্রত্যেকের নিজের ভিতরেই একটা আশ্চর্য শক্তি আছে যাতে করে বাইরে থেকে খাদ্য নিয়ে নিজেকে পুষ্ট, অনাবশ্যককে ত্যাগ ও নিজেকে বহুগুণিত করতে পারে। এই বহুগুণিত করার শক্তি দ্বারা ক্ষয়ের ভিতর দিয়ে মৃত্যু ভিতর দিয়ে প্রাণের ধারা প্রবাহিত হয়ে চলে।” স্রষ্টা এখানে অনুপস্থিত; প্রাণ এখানে বিজ্ঞানের নিয়মে তৈরি। তাঁর সময়ের  থেকে আমরা এখন এ বিষয়ে অনেক বেশী জানি। কিন্তু সেই সময়েও রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত যে জীবনের উৎসের সন্ধান শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানই দেবে।
অপর একটি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ নজর দিয়েছিলেন যা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার জন্য অপরিহার্য -- তা হল বিজ্ঞানের পরিভাষা । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে তিনি এই বিষয়ক কমিটিতে যোগদান করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেই পরিভাষা যে সব সময় জনপ্রিয় হয়েছে তা নয়, কিন্তু উৎসুক পাঠক পরিভাষাগুলি বিবেচনা করলে দেখবেন যে সেগুলি তৈরি করতে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেছেন। আবারও “রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান থেকে একটা উদাহরণ নেয়া যাক। আমরা ইংরাজি solid শব্দের বাংলা করি কঠিন। কিন্তু কঠিন শব্দের সঙ্গে কাঠিন্য গুণটি যুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাতে কঠিন বস্তু বলতে আমরা ময়দার তালকে বুঝব না। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের বিচারে ময়দার তালও solid, তাই “বিশ্বপরিচয়”-এ রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছিলেন নিরেট। দেখতে পেলাম যে পরিভাষা তৈরি করতে তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দই ব্যবহার করতে কবে এমন কোনো ছুঁৎমার্গ তার ছিল না। সাধারণ মানুষের জন্য পরিভাষা তৈরি করতে দুরূহ শব্দ ব্যবহার না করাই ভালো, একথা আমরা কবে শিখব কে জানে ?
রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতেন। “বিশ্বপরিচয়” এর ভূমিকাতে তিনি লিখছেন, “ক্রমাগত পড়তে পড়তে মনের মধ্যে বৈজ্ঞানিক একটা মেজাজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। অন্ধ বিশ্বাসের মূঢ়তার প্রতি অশ্রদ্ধা আমাকে বুদ্ধির উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে আশা করি অনেক  পরিমাণে রক্ষা করেছে।” শুধু বিজ্ঞানের তত্ত্ব বা তথ্য নয়, বিজ্ঞান যে একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবনবোধ দেয়, সেদিকেই কবির নির্দেশ । বিহারে ১৯৩৪ সালে ভূমিকম্পের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরে গান্ধীজী তাকে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে ভগবানের শাস্তি হিসেবে বর্ণনা করেন। রবীন্দ্রনাথও অস্পৃশ্যতার তীব্র বিরোধী ছিলেন, কিন্তু বিজ্ঞানপ্রসূত জীবনবোধ থেকেই তিনি গান্ধীজীর এই উক্তির কঠোর সমালোচনা করেন।
তাঁর জীবন ও রচনাতে পাওয়া যাবে। বিশেষ করে “বনবাণী” কাব্যগ্রন্থটিতে পরিবেশ বিষয়ে তার যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় আছে, তার আলাদা উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিশ্বভারতীতে যে পদ্ধতিতে তিনি বিজ্ঞান শিক্ষা চালু করার চেষ্টা করেছিলেন, তা নিশ্চয় যারা শিক্ষা বিষয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের আলোচনার বিষয়। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে একটা কথাই বলতে পারি - রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান বিষয়ক সমস্ত চিন্তাধারার ঘুলে ছিল মানুষ, বিশেষ করে আমাদের দেশের সেই সব মানুষ যারা জীবনে পিছিয়ে পড়েছে।
(৩)
কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমাকে ব্যক্তিগত ভাবে যা নাড়া দেয়, তা হল মৌলিক বিজ্ঞান বিশেষত পদার্থবিজ্ঞান প্রসঙ্গে তাঁর স্বজ্ঞা বা intuition| প্রথাগত বিজ্ঞানশিক্ষা তাঁর ছিল না। আমরা সবাই জানি যে কলেজ দূরে থাক, স্কুলের পড়াও তিনি শেষ করেন নি। আধুনিক পদার্থবিদ্যা মূলত গণিতাশ্রয়ী। ঠাকুরবাড়িতে দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ অঙ্ক নামক বিষয়টিতে পণ্ডিত হলেও ভাইটি ওদিকটা এড়িয়েই চলতেন। তাই পদার্থবিদ্যা বিষয়ে তাঁর জ্ঞান সীমাবদ্ধ হতে বাধ্য। অসামান্য স্বজ্ঞা দিয়ে তিনি সেই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছিলেন।
জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল এবং বহু বই তিনি পড়েছেন। জীববিদ্যাতে আলফ্রেড ওয়ালেসের বিবর্তন সংক্রান্ত লেখা একসময় নিজে অনুবাদ করবেন ভেবেছিলেন। পাঠকদের মনে করিয়ে দিই, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের তত্ত্ব ওয়ালেস সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে আবিষ্কার করেন এবং তাঁর এ বিষয়ে লেখা ডারউইনের প্রবন্ধের সঙ্গে একই সময়ে প্রকাশিত হয়। বিবর্তন তত্ত্বের বৈপ্লবিক তাৎপর্য রবীন্দ্রনাথ কতোটা বুঝতে পেরেছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ আমার জানা নেহ। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে জটিল সমস্যা, আজ পর্যন্ত যার সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি, তার বিষয়ে কবি সচেতন ছিলেন। সেই পরিচয় আমরা পাই রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের মধ্যে সুপরিচিত এক কথোপকথনে।

দুজনের মধ্যে কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তার একটি ঘটেছিল ১৯৩০ সালের ১৪ই জুলাই তারিখে আইনস্টাইনের বাড়িতে। আইনস্টাইনের সৎ মেয়ে মার্গটের হবু স্বামী দিমিত্রি মারিয়ানফ তার একটি বিবরণ নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাতে প্রকাশ করেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় অমিয় চক্রবর্তীর নেওয়া নোট থেকে রবীন্দ্রনাথ অনুমোদিত বিবরণটি ছাপা হয়। দুটি বিবরণের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে, তবে আমরা তার মধ্যে যাব না। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস “সত্যের স্বরূপ” নাম দিয়ে তার অনুবাদ করেছিলেন, তার থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে আমরা আলোচনা করব। দৈর্ঘ্যের কারণে সাক্ষাৎকারটি সংক্ষেপিত করতে হয়েছে, তবে আশা করি তাতে আমাদের পরবর্তী আলোচনাতে কোনো বিভ্রান্তি আসবে না।
আ: সত্য ও সুন্দর, এই দুই’ই তবে মানব নিরপেক্ষ নয়?
র: না!
আ: মানুষ যদি না থাকে, তো বেলভিডিয়ারের আপোলোও সুন্দর থাকিবে না?
র: না!
আ: সুন্দরের বিষয়ে আমি আপনার সহিত একমত, কিন্তু সত্যের বিষয়ে নয়।
র: কেন? সত্যকে তো মানুষই উপলব্ধি করিতেছে?
আ: আমার মত যে অভ্রান্ত, তার প্রমাণ দিতে পারি না, কিন্তু এই বিশ্বাসই আমার ধর্ম।
র: সুন্দর, সে তো বিশ্বমানবের নিখুঁত আদর্শের মধ্যে; সত্য, সেও বিশ্বচেতনার অভ্রান্ত উপলব্ধিতে প্রকাশিত। ভুলভ্রান্তির মধ্য দিয়া আমরা প্রত্যেকে সেই উপলব্ধিতে পৌঁছিতে চাই, আমাদের পুঞ্জীভূত অভিজ্ঞতার মধ্যে আমাদের উদ্ভাসিত চেতনার মধ্যে তাহাকেই খুঁজি, তা ছাড়া অন্যভাবে কি করে সত্যকে জানিব?
আ: সত্য যে মানুষের অস্তিত্বের অপেক্ষা না রাখিয়াও সত্য ইহা আমি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রমাণ করিতে পারিব না, তবু তাই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। ...
র: ... অন্ততঃ যাহাকে বিজ্ঞানে সত্য বলিয়া বর্ণনা করি, বিচার মাগেই তো তাহার সাক্ষাৎ ঘটে। অর্থাৎ মানুষের মনরূপ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই তাহার জ্ঞান সম্ভব। ...
আ: আমাদের চেতনার অতীত সত্যের অস্তিত্ব আছে কি না, বস্তুতঃ সেইখানেই সমস্যার আরম্ভ।
আরো কিছুক্ষণ পরে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “মানুষের সহিত সম্পর্করহিত কোন সত্য থাকিলেও, তাহা মানুষের পক্ষে না থাকার সামিল। ... মানুষের অনুভূতি কিংবা যুক্তির সহিত সম্পর্কমাত্র রহিত সত্যের অস্তিত্ব থাকিলেও, যতদিন আমরা মানুষধর্মী ততদিন তাহা আমাদের কাছে নাস্তির পর্যায়েই থাকিবে।”
এই কথোপকথন সম্পর্কে বিজ্ঞানী ইলিয়া প্রিগোজিনের একটা মন্তব্য শুনে নেব। “The question of the meaning of reality was the central subject of a fascinating dialogue between Einstein and tagore. Einstein emphasized that science had to be independent of the existence of any observer ... On the contrary, Tagore maintained that even if absolute truth could exist, it would be inaccessible to the human mind. Curiously enough, the present evolution of science is running in the direction stated by the great Indian poet.” সহজ কথায়, আইনস্টাইন দর্শক নিরপেক্ষ সত্য বা বাস্তবতাতে বিশ্বাস করেন, আর রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে সেরকম কোনো পরম সত্য থাকলেও তা মানবমনের গোচর হয় না। প্রিগোজিন মন্তব্য করছেন যে বিজ্ঞানের বর্তমান ধারা কবিকেই সমর্থন করছে।
প্রিগোজিনের একটু পরিচয় দেয়া হয়তো প্রয়োজন। ১৯৭৭ সালে রসায়নে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি একালের একজন সেরা চিন্তানায়কও বটে। (সচেতন ভাবেই বুদ্ধিজীবি শব্দটি ব্যবহার করলাম না, কারণ আমাদের দেশে বিজ্ঞানীকে বুদ্ধিজীবি মনে করা হয় না।) নৈরাজ্য তত্ত্ব বা chaos theory-র মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানে আমাদের বহু সযত্ন লালিত প্রাচীন ধারণাকে পাল্টে দিয়েছেন। এমন একজন মানুষ যখন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেন, তা আমাদের ভাবায় বৈকি। আর এক নোবেলজয়ী পদার্থবিদ ব্রায়ান জোসেফসনও রবীন্দ্রনাথকেই সমর্থন করেছেন।
এখন দেখা যাক এই আলোচনার বৈজ্ঞানিক পরিপ্রেক্ষিত কী ছিল। আধুনিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্ম হয়েছিল ১৯২০-র দশকের মাঝামাঝি। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ও এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার তার জন্মদাতা, নিলস বোর তার পালক পিতা। এই  তত্ত্বের সবচেয়ে পরিচিত ব্যাখ্যা অনুসারে পর্যবেক্ষক নিরপেক্ষ সত্য বা বাস্তবের কোনো অস্তিত্ব নেই। কথাটা একটু দর্শনের মতো শোনালেও তা পরীক্ষাগারে প্রমাণিত। ধরা যাক একটা পর্দার উপর একটা একটা করে ইলেকট্রন ছোঁড়া হচ্ছে।পর্দার মধ্যে দুটো গর্ত আছে। সাধারণ বুদ্ধি বলে যে একটা ইলেকট্রন একই সময়ে একটা গর্তের মধ্যে দিয়ে যাবে। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে যে যতক্ষণ আমরা ইলেকট্রনটা কোথা দিয়ে যাচ্ছে দেখার চেষ্টা না করব, ততক্ষণ সেটা এক সঙ্গে দুটো গর্তের মধ্যে দিয়েই যাবে। পরীক্ষাও তাকে সমর্থন করে ! অর্থাৎ আমরা যতক্ষণ দেখতে চাইব না, ততক্ষণ ইলেকট্রনের কোনো নিদিষ্ট অবস্থান নেই। শুধু ইলেকট্রন নয়, অণু পরমাণু সমস্ত মৌলিক কণা, সকলের জন্যই এটা সত্য। আমরা দেখতে চাইলে তখন ইলেকট্রন কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় আমাদের কাছে ধরা দেবে, নচেৎ নয়। কোথায় তাকে আমরা পাব, তা আগে জানার কোনো উপায় নেই কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় তাকে পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা, সেটা বলা সম্ভব। শুধু অবস্থান নয়; বেগ, ঘূর্ণন ইত্যাদি সমস্ত ধর্মের জন্য এটা সত্য। যেমন না মাপা পর্যন্ত কণার কোনো নিদিষ্ট বেগ থাকে না, মাপার ফলেই তার নির্দিষ্ট মান প্রকাশ পায়।
পর্যবেক্ষণ না করা পর্যন্ত কণার কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান নেই, অর্থাৎ পর্যবেক্ষকের উপর বাস্তবতা নির্ভর করছে। শ্রয়ডিঙ্গার এই প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন এই বিশ্ব আমাদের অনুভূতি ও স্মৃতির সৃষ্টি। এর নিজস্ব অস্তিত্ব আছে বলে ধরলে আমাদের সুবিধা হয়, কিন্তু শুধুমাত্র অস্তিত্বের মাধ্যমেই এর প্রকাশ ঘটে না। কোয়ান্টাম তত্ত্বের অন্যতম জন্মদাতা হয়েও আইনস্টাইন বলবিদ্যার এই অনির্দিষ্টতাকে কখনো মেনে নিতে পারেননি । চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের সমস্ত ধ্যানধারণার বিরোধী এই কোয়ান্টাম বাস্তবতা প্রসঙ্গেই আলোচনা করছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন ।
একথা ভেবে আশ্চর্য লাগে যে অনেক বিজ্ঞানী যখন এই নতুন বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারেন নি, তখন রবীন্দ্রনাথ কেমন করে তার মুল ভাবনা উপলব্ধি করেছেন এবং আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীর সামনে তা দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করছেন। একই চিন্তাভাবনা আছে ছ'বছর পরে লেখা “শ্যামলী” কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত “আমি” কবিতাটিতে।
আমারি চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, 
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, সুন্দর,
সুন্দর হল সে।
দর্শক না থাকলে পান্না চুনির রঙ নেই, নেই আলো। পরের পংক্তিগুলিতে কবি বলেই দিচ্ছেন যে তিনি বিজ্ঞানের সত্যকেই প্রকাশ করছেন।
তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা,
এ কবির বাণী নয়।
আমি বলব, এ সত্য;
তাই এ কাব্য ।

প্রসঙ্গত বলে রাখা যাক যে এই অনির্দিষ্টতা কিন্তু ভাববাদকে প্রতিষ্ঠা করে না। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বস্তুবাদী ব্যাখ্যা সম্ভব। ডেভিড বোহ্‌ম তা করে দেখিয়েছেন -- কিন্তু তা অনেক পরের ঘটনা ।
শুধু আইনস্টাইন নন; কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম স্রষ্টা হাইজেনবার্গ ও অপর এক বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড সমারফেল্ড ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভারতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল জানা যায় নি। ফ্রিজফ কাপরা একজন পদার্থবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানের দার্শনিক। তাঁর “Uncommon Wisdom” বইতে তিনি লিখেছেন যে হাইজেনবার্গ তাঁকে এই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে জানান, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বিজ্ঞান ও ভারতীয় দর্শন নিয়ে আলোচনা হয়। হাইজেনবার্গ মন্তব্য করেন, “After these conversations with Tagore some of the iodeas that seemed so crazy suddenly made much more sense. That was a great help to me.” দুঃখের বিষয় যে এই আলোচনা চিরকাল আমাদের অজানাই থেকে যাবে। আমরা কখনোই আর জানতে পারব না কোন ধারণাই বা বিজ্ঞানীর কাছে পাগলামি মনে হচ্ছিল, আর কবিই বা তাঁকে কেমন করে তার সারবত্তা বোঝান। মৌল বিজ্ঞান বা তার দর্শন প্রসঙ্গে কবির এই দখল এককথায় তাঁর স্বজ্ঞার প্রকাশ।
তথ্যসূত্র:
রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতিগুলি পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত রচনাবলী থেকে সংকলিত । আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকারের সত্যেন্দ্রনাথ কৃত অনুবাদটি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ প্রকাশিত “সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সংকলন” থেকে গৃহীত। অন্যান্য বহু তথ্য ও আলোচনার জন্য আমি আনন্দ প্রকাশিত দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের “রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান” বইটির কাছে ঋণী।

(প্রকাশ: নিশিত সাহিত্যপত্রিকা, ডিসেম্বর, ২০১০, পরিমার্জিত)
























Friday, 5 May 2017

গুহাচিত্র

         জীবনে অনেক অদ্ভুত কাজ করেছি, তার মধ্যে একটা হল একটা ভূতের গল্প লেখা। সেটা বেরিয়েছিল ম্যাজিক ল্যাম্প ওয়েব ম্যাগাজিন জুলাই ২০১৬  সংখ্যায়। তার লিঙ্কটা নিচে দিলাম। অলঙ্করণ করেছিলেন পুষ্পেন মণ্ডল।  
অবিশ্বাসী লোকে ভূতের গল্প লিখছে -- এর পিছনে কি তেনাদের হাত আছে? কে জানে।
গুহাচিত্র
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

উপরের লিঙ্কে ক্লিক করলে ওয়েব ম্যাগাজিনে পড়া যাবে। 

ইতালি ভ্রমণ কাহিনি (১)



মিকেলাঞ্জেলোর দেশে
ট্রিয়েস্ট-ভেরোনা-ভেনিস
শম্পা গাঙ্গুলী

টিনটোরেটোর যীশু পড়ার পরে ইতালিয় শিল্পকর্ম সম্পর্কে বেশ আগ্রহ জন্মেছিল। রেনেসাঁ যুগের বিখ্যাত শিল্পী জ্যাকোপো তিনতোরেত্তো - তাই রেনেসাঁর শিল্পকলার উপর কয়েকটা বইও পড়ে ফেলেছিলাম। তবে বই পড়া বা ইন্টারনেটে ছবি দেখা এক জিনিস, আর নিজের চোখে দেখা আর এক। দুধের সাধ কি আর ঘোলে মেটে? এবার ত্রিয়েস্তে যাবার আগে গৌতম প্রস্তাব দিলো আমিও ইচ্ছা করলে ইতালি ঘুরে আসতেই পারি। আমি এক কথায় রাজি স্কুল থেকে না হয় দু সপ্তাহ ছুটি নিতে হবে --- এমন সুযোগ কি আর কেউ ছাড়ে?
ইতালির পথে
গৌতম আগেই চলে গেছে। সৃজনশীল আমাকে কথা দিয়েছিল আমার সঙ্গে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাবে। তাই একটু নিশ্চিন্ত ছিলামচেহারাটা ছোটোখাটো হলেও ওর ওপর ভরসাটা রাখা যায়। কিন্তু সমস্যাটা এল অন্য দিক থেকে। শ্বশুরমশায়ের শারীরিক অসুস্থতার কারণে যাওয়াটা প্রায় বানচাল হয়েই যাচ্ছিল। শেষ মুহূর্তে উনি কিছুটা সুস্থ হওয়ায় লাগেজ গোছানো শুরু করলাম। আর তখন থেকেই মনের মধ্যে শুরু হল এক অদ্ভুত শিহরণ। যাওয়ার আগেরদিন তো উত্তেজনায় সারারাত ঘুমই হল না।
রওনা দিলাম ২২ জুলাই রাত এগারোটায়। কলকাতা থেকে দোহা যাবার ফ্লাইট ছিল পরের দিন ভোররাতেএকা একা প্রথমবার বিদেশ যাবার উত্তেজনাটা ভালোই টের পাচ্ছিলাম। কলকাতা থেকে কাতারের রাজধানী দোহা পৌঁছলাম সাড়ে পাঁচ ঘন্টা পরে। সেখানে ইন্টারন্যাশানাল ট্রান্সফারের সময়ে একটু টেনশন হচ্ছিল বৈকি --- সময় মাত্র দু ঘন্টা। তারপর আবার দোহা থেকে ভেনিসের ফ্লাইটের ছ ঘন্টা সময়টা কিছুতেই যেন কাটছিল না। কলকাতা-দোহার ফ্লাইটে বেশিরভাগই ভারতীয় ছিল। কিন্তু ভেনিসের প্লেনে লক্ষ্য করলাম আমিই বোধহয় একমাত্র ভারতীয়। পূর্ব গোলার্ধ থেকে পশ্চিমে ছিটকে পড়ে নানান দেশের লোকের মাঝে থাকার এই প্রথম অভিজ্ঞতাটা বেশ মজার লাগছিল।
ভেনিস এয়ারপোর্টে পা দেওয়ার পর এক অদ্ভুত অনুভূতি হল।  যে আমি বরাবরই হারিয়ে যাবার ভয়ে কলকাতাতেই অচেনা রাস্তা ঘাটে একা যেতে ইতস্তত করি; সেই আমিই কিনা আত্মীয়-পরিজন সবাইকে বহু যোজন দূরে  ফেলে এসে বিদেশে একদম একা! ভাবা যায় না। প্লেন থেকে নেমে ইমিগ্রেশনের জন্য বেশ খানিকটা দেরি হল। কিন্তু প্রথমবার বিদেশে আসার উত্তেজনায় হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে --- তাই সময়টা কোথা দিয়ে যে কেটে গেল, বুঝতেই পারলাম না।
ট্রিয়েস্টের পথে
সাগরপাড়ের শহর ত্রিয়েস্তে
ভেনিস এয়ারপোর্টে গৌতম আমাকে নিতে এসেছিল। ওর সাথে প্রায় দেড় মাস পরে দেখা-- কিন্তু কোনো কথার আগেই দাঁড়াতে হল বাসের টিকিটের লাইনে। এয়ারপোর্ট থেকে বাসে মেস্ত্রে স্টেশন আধঘন্টা। সেখান থেকে ট্রেনে ত্রিয়েস্তে দুঘন্টা।  নেমেই প্রথমে লাগেজ সমেত ঢুকে পড়লাম স্টেশনের সামনের সুপার মার্কেটে।  যা যা দরকার সবই নিলাম --- ফল, সবজি, মশলা, মাছ, মাংস, দুধ, সসেজ, পাস্তা।
এখানকার বাসে টিকিট চেকার থাকে না --- কালেভদ্রে ওঠে। সব তাবাচ্চি মানে তামাকের দোকানে বাসের টিকিট পাওয়া যায়। বাসে উঠে পাঞ্চ করতে হয়। দেখলাম লক্ষ্য করার কেউ না থাকলেও যার যার মতো সবাই বাসে উঠে টিকিট পাঞ্চ করছে। তবে গৌতম বলল, ও অনেক লোককে বাসে টিকিট না কাটার জন্য ফাইন দিতেও দেখেছে।
ত্রিয়েস্তে শহরটা ভূমধ্যসাগরের তীরে উত্তর ইতালিতে --- এপেনাইন পাহাড়টা এখানে সোজা সমুদ্রে নেমেছে।  গৌতম যে আপার্টমেন্টটা ভাড়া নিয়েছিল সেটা একদম সমুদ্রের ধারে, পাহাড়ের ঢালে।  বাড়িটা খুব হাল্কা কোনো উপাদান দিয়ে তৈরি, দেওয়ালগুলো ফাঁপা -- মনে হয় ভূমিকম্পের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। জানলাগুলো ফাইবারের -- চারভাবে খোলা যায়। প্রযুক্তিটা বেশ অভিনব লাগল।
সেই অভিনব জানলা
শোবার ঘরের জানলা খুললেই সাগরের নীল জল। গৌতম গবেষণার কাজে আগেও বেশ কয়েকবার এই শহরে এসেছে। তাই ছবিতে ওই শহর, ওই সমুদ্র আমার চেনা। ডালমেশিয়ান উপকূলের হাতছানি কখনো সত্যি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে সেখানে ফেলবে ভাবিনি। জানলা দিয়ে দেখলাম, গাঢ় নীল জলে ফেনা তুলে হাওয়াকে কাজে লাগিয়ে অক্লান্ত ভাবে সারফিং করে চলেছে কতো মানুষ। ভাসতে ভাসতে হামেশাই উলটে তারা জলে পড়ে যাচ্ছে-- কিন্তু কেউ দমছে না। আবার পাল খাড়া করে সমুদ্রের ফেনা ছুঁয়ে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে। বাইনোকুলার চো
খে সিগালদের ডুবসাঁতার দিয়ে জলে ওঠা-নামা-ডানা ঝাপটানো, কেন জানি হঠাৎ মনে করালো ঘরের কবি জীবনানন্দের ‘সিন্ধুসারস’ --- ‘দু-এক মুহূর্তে শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি/ হে সিন্ধু সারস,/ মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি/ নাচিতেছে টারানটেলা-রহস্যের; আমি এই সমুদ্রের পাড়ে চুপে থামি/ চেয়ে দেখি বরফের মতো শাদা ডানা দুটি আকাশের গায়/ ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীরে আনন্দ জানায়’
ত্রিয়েস্তেতে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে সমুদ্রতীর
      যাওয়ার আগে দুদিন সারারাত উত্তেজনায় ঘুম হয়নি, প্লেনেও তথৈবচ। কিন্তু আনন্দে সব ক্লান্তি গায়েব। মনটাও তখন হাওয়ার বেগে দ্রিম দ্রিম তালে নাচছে। একি! আমি যে ঘামছি! না, শুধু উত্তেজনায় নয়, মাথার ওপর পাখা নেই, সেজন্যও। ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুতে গরমকালেও কিছুদিন আগে পর্যন্ত উত্তর ইতালিতে নাকি কারোর বাড়িতে পাখা লাগাত না। এখন পৃথিবী জুড়ে উষ্ণায়ণফলে ওখানেও অনেকের বাড়িতে পাখা, এসি আছে। কিন্তু দাভেদার বাড়িতে, যেখানে আমরা ছিলাম, সেখানে নেইতাই সমুদ্রের হাওয়া বন্ধ হলেই বেশ গরম। দিনের বেলা বাইরে বের হলেই গা পুড়ে যাবে। আসলে ওখানকার বাতাসে দূষণের মাত্রা কম বলে সূর্যরশ্মি শোষণ করে নেবার জন্য বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা, কার্বন কণাও কম। ফলে অনেক বেশি তাপ ওখানকার মাটি ছোঁয়। কিন্তু আকাশ খুব পরিষ্কার বলে সূর্য ডোবার পর খুব তাড়াতাড়ি তাপ ছেড়ে দিয়ে রাত্রিগুলো বেশ ঠাণ্ডা হয়-- গায়ে কম্বল লাগে। গরমকালে সন্ধে নামে রাত নটার পর। হবেই তো, গ্রীষ্মকালে দিনের অনেকটা সময় সূর্যের দিকে হেলে থাকে উত্তর গোলার্ধে মধ্য অক্ষাংশের ওই জায়গাগুলোতে
ব্যালকনি থেকে দূরের পাহাড় ও সমুদ্র

      সেইদিন বিকেলে আমাদের ঘরের উল্টোদিকে অন্য ভাড়াটে মার্কোর সাথে আলাপ হলঅল্প বয়সি ইতালিয়ান। অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। মা অসুস্থ, তাই দেশে ফেরা। ক্রাচ নিয়ে হাঁটছে। বলল, রক ক্লাইম্বিং করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পা ভেঙ্গেছে। ভাবলাম মাকে দেখতে ভাঙা পা নিয়ে দেশে এসে একা বাড়ি ভাড়া নিয়ে আলাদা আছে! একা রান্নাবান্না করে খাচ্ছে, একাই ভ্যাক্যুয়াম ক্লিনার দিয়ে ঘর পরিষ্কার করে দু একদিন ছাড়া, একাই মেশিনে কাচাকাচি করে বাইরে বারান্দায় রোদে মেলে। আবার রোজ পাহাড়ী ঢালের ঐ বাড়িটার থেকে বের হয়ে দিনের মধ্যে তিন চারবার কোথায় যেন যায়। বোঝা যায় কতটা স্বাধীনচেতা আর আত্মবিশ্বাসী। 

ত্রিয়েস্তের সমুদ্রতীর

সন্ধেবেলায় দাভেদার সঙ্গিনী সাবিনা ও তাদের বছর দশেকের ছেলে টমাসের সঙ্গেও পরিচয় হল। সারা দিন সমুদ্রের ধারে ছিল ওরা। প্রতিদিন তারা সমুদ্রের ধারে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খেলাধুলো-গানবাজনা-হইচই করে তবে সন্ধেবেলায় বাড়ি ফেরে। গরমের ছুটিতে ওখানে সবাই তা-ই করে। দিনের বেলা সমুদ্রের ধারে ওই চড়া রোদ্দুরে পড়ে থাকে, সূর্যস্নান করে। সূর্যের থেকে  অত তাপ নিয়েই কি ওরা দিনের পর দিন এত প্রাণশক্তিতে ভরপুর? শনি-রোববার সমুদ্রের ধার আরো জমজমাট। সকাল থেকে সারাদিন হাঁটাহাঁটি, যোগাসন, সাইকেল চালানো, সমুদ্রে ডাইভিং, সারফিং, নানা খেলাধুলো, নানান কিছু। কেউ কেউ গাছে দোলনা বেঁধে বা ছাউনি করে পিকনিক করছে, কিংবা সার্কাসের মত বিশাল ঝোলানো নেটের ওপর লাফাচ্ছে, ব্যালেন্স করে অ্যাক্রোব্যাটিক গেম খেলছে। কোথাও বা মিউজিক চালিয়ে ব্যায়াম করছে একদল – তাদের সঙ্গে জুটে গেল সম্পূর্ণ অপরিচিত আরো কয়েকজন। একদিন বিকেলে দেখি গাড়ি চালিয়ে এসে ষাটোর্ধ্ব এক দম্পতি হঠাৎ গাড়ির ভিতর থেকে দুটো সাইকেল বার করে  চালাতে শুরু করল সমুদ্রের ধারে
।  একঘন্টা চালিয়ে আবার ফিরে গেল। ভাবি, কী অফুরন্ত জীবনীশক্তি ওদের। শনিবার সন্ধে থেকে সারা রাত সমুদ্রের ধারে জলসা চলে-- ব্যান্ডগুলো গান বাজনা করে -- আর তাদের শ্রোতারাই কেবল তা উপভোগ করে। রাস্তা পেরিয়ে পাহাড়ের ঢালের বাড়িগুলোতে তার আওয়াজটুকুও আসে না। ওরা নিজেদের আনন্দে কেবল নিজেরাই মেতে থাকে --- আমাদের মতো অন্যের কানের গোড়ায় সজোরে মাইক বাজিয়ে আনন্দ পায়না।
ত্রিয়েস্তে গ্রান্ড ক্যানাল

ত্রিয়েস্তেতে ছিলাম এক সপ্তাহগৌতম রোজ সকালে জলখাবার খেয়ে টিফিন নিয়ে অফিস বার হত। আমি রান্নাবান্না সেরে সময়টা কাটাতাম বই পড়ে বা ল্যাপটপে সিনেমা দেখেবিকেলে গৌতম ফিরলে দুজনে বাজার সেরে আশপাশটা ঘুরে বেড়াতাম। গ্র্যাণ্ড ক্যানালের ধারটা খুব সুন্দর। শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটা ওখানেই, Piaza del Unita, দেশ হিসাবে ইতালির ঐক্যসাধনের স্মৃতি বহন করে সমুদ্রের ওপর এড্রিয়াটিক উপকূলে
দিনের পিয়াজা দেল ইউনিতা
বিশাল একটা ফাঁকা চত্বর। সেখানে অসংখ্য ‘পাব’
কোথাও অনেক মিউজিক্যাল ইনসট্রুমেন্ট নিয়ে বাজনার দল বাজিয়ে চলেছে। এক জায়গায় দেখি এক সুবেশা ব্যালেরিনা  চলেছে নেচে--- সঙ্গে একজন বেহালা বাদক; তাদের ঘিরে প্রচুর দর্শক। খোলা আকাশের তলায় পাবগুলো সকাল থেকেই আলো ঝলমলে। নানান সাজপোশাকে মানুষজন নিজেদের মধ্যে গল্প করছে, নিজের নিজের প্রিয়জনকে জড়িয়ে ধরে প্রকাশ্যে চুম্বন করছে। একটা সন্ধ্যায় আমরাও একটা পাবে গিয়ে বসলাম। লক্ষ্য করলাম অল্প বয়সী কত মেয়েরা স্বল্প বেশভূষায় ঘন্টার পর ঘন্টা, এমনকি মাঝরাত পর্যন্ত পাবে বসে গল্প করছে, ধূমপান করছে, ওয়াইন, বিয়ার বা অন্য কিছু খাচ্ছে কেউ তাদের উঠিয়ে দিচ্ছে না, বাড়ি ফেরার তাড়া দিচ্ছে না। ও দেশে গেলে তবেই বোঝা যায় সেখানে মেয়েরা প্রকৃতপক্ষে কতটা স্বাধীন, নিরাপদও বটেপ্রতিটা মানুষ, নিজেরা যেমন খুশি আছে, অন্যের ব্যাপারে মাথাও ঘামায় না, অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না। অথচ প্রয়োজন হলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
রাতের ত্রিয়েস্তেঃ পিয়াজা দেল ইউনিতা
জনসংখ্যার শতকরা হিসাবে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের দিক থেকে এই শহর ইতালির মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে। বাসিন্দাদের আর্থিক অবস্থাও বেশ ভালো। একদিন বিকেলে একটা নতুন ধরণের ট্রামে চেপে আমরা পাহাড়ের ওপরের ওপিসিনা বলে একটা জায়গায় গিয়েছিলাম। পাহাড়ের ওপর ট্রাম ওঠে কেউ কখনো শুনেছে! অদ্ভুত এই কৌশলকে বলে ফিউনিকুলার প্রযুক্তিযে ট্রামটা উপর থেকে নিচে নামছে, সেটা কেবল ট্রাক্টর লাগিয়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে আমাদের ট্রামটাকে টেনে তুলল
ট্রাম

প্রায় সাড়ে তিনশ মিটার ওপর থেকে নীচের এড্রিয়াটিক উপকূলটা দারুণ লাগছিল। পাহাড়ের ঢালের বসতিগুলো ছবির মত। ট্রামে যেতে যেতে ইতালিতে এই প্রথম  একজনের সঙ্গে আলাপ হল যিনি ইতালিয়ান হলেও ঝরঝরে ইংরাজি বলতে পারেন। নাম আলেকসান্ড্রা চিন্যাগলিয়া। দেখলে আন্দাজ করা যাবে না, সত্তরের ওপর বয়স। পেশায় সাইকোলজিস্ট। ভেনিসে চেম্বার, ওখানেই থাকেন। ত্রিয়েস্তেতে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন। ওনার ছেলে সাহিত্যের অধ্যাপক --- সেই সূত্রে বিশেষ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাহিত্যিকদের ওনাদের বাড়িতে আনাগোনা আছে। সলমন রুশদি, বিক্রম শেঠ বা অনিতা দেশাই, শুধু লেখার মাধ্যমে যাঁদের সঙ্গে পরিচয়, তাঁরা  ওনার বাড়িতে আসেন শুনে কেমন যেন থমকে গেলাম
জিজ্ঞাসা করলাম, এনারা মানুষ হিসাবে কেমন? সান্ড্রা বললেন, প্রতিভাবান সাহিত্যিক তো, তাই প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর ছিটগ্রস্ত। You know, Vikram Seth is totally mad. Genius, but mad.
ট্রামে ওপিসিনার পথে এক ইতালিয়ান পরিবার
নেপোলিয়নের পায়ে পায়ে
ওপিসিনাতে নামলাম সান্দ্রার জন্য তাঁর বোনঝি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। যাবার সময় বারবার  বললেন ভেনিসে গেলে সময় পেলে আমরা যেন ওনার চেম্বারে গিয়ে দেখা করি। ওনাকে বিদায় জানিয়ে আমরা দুধারে গাছ দিয়ে সাজানো ট্রাম রাস্তা ধরে খানিকটা নেমে এলাম। সেখানে সুড়কি বিছানো দারুণ সুন্দর অথচ খুব নির্জন একটা রাস্তা। অনেকখানি হাঁটলাম। জায়গাটার নাম স্ট্রাডা নেপোলিয়নিকা। অনেকটা নীচে এড্রিয়াটিক উপকূলের নীল সমুদ্র হাতছানি দিচ্ছে। রাস্তাটা কিজন্য বিখ্যাত জানলাম। সঙ্গে সঙ্গে জুতোর তলার সুড়কিতে মশমশ শব্দ তুলে উত্তেজনায় হাঁটতে হাঁটতে ঝটাঝট বেশ কয়েকটা ফোন করে ফেললাম বন্ধু পরিজনদের -- তাদেরও উত্তেজনার ছোঁওয়াটা দেবার জন্য। জানালাম ওই রাস্তা দিয়ে এসে নেপোলিয়ন ইতালি আক্রমণ করেছিলেন।

ত্রিয়েস্তেতে সকলের বাড়িতে বোধহয় একটা বা দুটো কুকুর আছে। এত যে বিভিন্ন রূপের বা বিভিন্ন প্রজাতির কুকুর হয় তা জানতাম না। বেড়াতে বেরোলে কুকুরও তাদের সঙ্গী। প্রত্যেক ছোট্ট কুকুরের মালিকের সঙ্গে একটা করে ঝুড়ি বা ব্যাগ থাকে। কুকুর ক্লান্ত হলে তাদের ওই ব্যাগে ভরে নেয়। অনেক কুকুরই লক্ষ্য করলাম রাস্তার ধারে ঘাসের উপর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছে। কুকুরের মালিক হাতে দস্তানা পরে অনায়াসে সেই নোংরা ন্যাপকিন দিয়ে তুলে নিজের সঙ্গের ঝোলায় পুরছে।  ত্রিয়েস্তে শহরে বিশেষত সমুদ্রের ধারে দেখতাম, সবাই খুব আইস্ক্রিম খেতে ভালোবাসে। আইস্ক্রিমের সঙ্গের ন্যাপকিনটাও কেউ কখনো এদিক সেদিক ফেলত না- ডাস্টবিন পেলে তবেই। পরিচ্ছন্নতা আর কুকুরপ্রেমের এমন নিদর্শন আমায় অভিভূত করল। মাঝে মাঝে ভাবি, আমরা যতই স্বচ্ছ ভারতের স্বপ্ন দেখি, আর সারা বছর নির্মল বিদ্যালয়ের শপথ নি, ঘটা করে নির্মল বিদ্যালয় সপ্তাহ পালন করি, “ও আচ্ছে দিন আভি বি বহুত দূর হ্যায়।”
      ত্রিয়েস্তেতে বাসে করে বাজার যাওয়ার পথে একটা মজার গল্প বলি। বাসে টিকিট পাঞ্চ করে সবে বসেছি। হঠাৎ হাঁচি। হাঁচড় পাঁচড় করে রুমাল বের করার জন্য ব্যাগ হাতড়াচ্ছিকিন্তু ইতিমধ্যে আমি নিজেকে অপ্রস্তুতে ফেলে প্রায় আট দশটা হাঁচিতে বাসের মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছি। আমার সঙ্গী আমাকে সামলে নিতে বলছে। কিন্তু এলার্জির জন্য পারছি না। সেও অপ্রস্তুত। এন্টি-এলার্জিক ওষুধটাও সঙ্গে নেই। কিন্তু বাসে অন্য কারোর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। যে যার মতো গল্প করে যাচ্ছে। একটা অল্প বয়সি জুটি আগের মতোই একে অপরকে চুম্বন করে যাচ্ছে। এরকম অস্বস্তি একনাগারে চললে আমার সবসময় যা হয় তাই হতে লাগল। ফলে নাকের ওপর তখন প্রবল অত্যাচার। ছোটোবেলায় মনে পরে আমার মামাতো দিদি আমার নাক নিয়ে খুব প্রশংসা করত। ছোটর ওপর আমার নাকটা নাকি বাঁশির মতো সরু। সেই সরু নাক তখন বারবার ঘষছি। নাক লাল, নাক সরসর, নাক ভরভর; আমাকে লজ্জায় ফেলার জন্য যত রকমের বিচ্ছিরি কাণ্ড হতে পারে তাই তাই হতে লাগল। এইসময় মনে হয় প্রবল ঠাণ্ডা লেগে সর্দি লেগে গেছে বুঝি। তাই অভ্যাসবশত ঘনঘন নাক টেনে সর্দিকে বশে রাখতে চেষ্টা করলাম। হঠাত লক্ষ্য করলাম বাস সুদ্ধ লোক আমার দিকে তাকিয়ে। গৌতম আমাকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে বলল, ইউরোপে নাক টানাটা অসভ্যতা।
রোমিও জুলিয়েটের শহরে

      ত্রিয়েস্তে থেকে আমরা দুদিন দুটো জায়গায় গিয়েছিলাম – ভেরোনা আর ভেনিস। দুটো শহরই ত্রিয়েস্তের পশ্চিমে। রবিবারের ট্রেনের সুবিধা হল, একটা টিকিট কাটলে আর একটা ফ্রি। ভেরোনার জন্য সকাল ৬টা ৩৮মিনিটে ফ্রেসিয়াব্রিয়াঙ্কা ট্রেনে চাপতে হবে -- এই ট্রেনগুলো লোকাল ট্রেনের চেয়ে অনেকটা জোরে যায়। কিন্তু মুশকিল হল আমরা যে জায়গাটায় থাকতাম, স্টেশন থেকে সেটা চার কিলোমিটার দূর। রবিবার অত সকালে বাস পাওয়া যাবে কি? তাই কোনোরকম ঝুঁকি না নিয়ে আমরা ভোরবেলা উঠে হাঁটা লাগালাম।
এরিনা, ভেরোনা
      ত্রিয়েস্তে সেন্ট্রালে স্টেশন থেকে ভেরোনা পোর্টানোভা পৌঁছতে প্রায় তিন ঘন্টা সময় লাগল। স্টেশনেই আমরা দুজনের জন্য ৩৬ ইউরো দিয়ে দুটো ভেরোনা কার্ড কিনে নিলাম। তাতে সারাদিনের জন্য সমস্ত বাস রাইড আর সব দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো একবার করে ঢোকা ফ্রি। বাসে চেপে  প্রথমে গেলাম এরিনা রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারে। আজ থেকে প্রায় দু হাজার বছর আগে রোমান সম্রাটদের সামনে কখনো গ্ল্যাডিয়েটরদের মধ্যে, আবার কখনো মানুষে-পশুতে যুদ্ধ হত। আমরা একটা গ্যালারিতে বহুক্ষণ বসে ছিলাম। প্রাচীনত্বের ছোঁয়ায় হারিয়ে গিয়েছিলাম কিছুক্ষ্ণণের জন্য। মনে হচ্ছিল গ্যালারির আশপাশের দর্শকাশনগুলো বুঝি ভর্তি। উন্মুক্ত মঞ্চে মানুষে পশুতে যুদ্ধ দেখার জন্য উদগ্রীব জনতার কোলাহল।
     
হঠাৎ দেখি বাইরে থেকে,
গগনচুম্বী ক্রেনে চেপে বিশাল বড়ো মাঝারি, ছোটো বিভিন্ন আয়তনের স্ফিংক্সের বেশ কিছু মূর্তি ঢুকে পড়ছে মঞ্চে। আসলে, এরিনা এম্পিথিয়েটারে চলছিল বিশ্ববিখ্যাত অপেরা উৎসব। সেদিন সন্ধ্যেবেলায় হবে ভার্দির অপেরা ‘আইদা’-- সেই উপলক্ষ্যে স্টেজ সাজানোর প্রস্তুতি। মূর্তিগুলো সাজিয়ে তুলছিল স্টেজটাকে। পঞ্চাশ ষাট ফুট বড়ো মূর্তিগুলোকে খোলা আকাশের তলায় উন্মুক্ত স্টেজে শক্তিশালী ক্রেনে করে ঝুলন্ত অবস্থায় বহন করে আনার কায়দাটা আমাদের অবাক করেছিল। মন চাইছিল নাটকটা দেখেই যাই। কিন্তু সময় নেই, তাছাড়া অপেরার টিকিট শেষ হয়ে গেছে অনেক দিন আগে। ১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল যখন উদ্বোধন হয়, তখন ইজিপ্টের সরকার নতুন একটা অপেরা হাউসের জন্য ভার্দিকে একটা অপেরা লিখতে বলেছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত অপেরাগুলির মধ্যে একটা হল ‘আইদা’।
ভেরোনা শহরটা খুবই ছোটো। এরিনা থেকে বেরিয়ে সারাদিন আমরা পায়ে হেঁটেই ঘুরেছি। এরপর গেলাম শহরের কেন্দ্রস্থল পিয়াজা দেল এরবে সেখানে বহু পুরানো একটা ঘন্টা মিনার আছে, টরে দি ল্যাম্বার্টি
টরে দি ল্যাম্বার্টি
চুরাশি মিটার উঁচু মিনারের ওপর ওঠার জন্য সিঁড়ির পাশাপাশি লিফটও আছে -- সে জন্য বাড়তি এক ইউরো করে দিয়ে উপরে উঠলাম। সেখানে পেল্লাই সাইজের তিনটে ঘন্টা ঝুলছে। দুপুর বারোটার সময় প্রতিদিন সেই তিনটে ঘন্টাই নাকি নিচের থেকে এক সঙ্গে বাজানো হয়। সেজন্য পৌনে বারোটার সময় আমরা সেখান থেকে নেমে এলাম।
ঐ অত বিশাল ঘন্টা কানের কাছে বাজার ঝুঁকি নিতে পারলাম না।
      এরপর আমাদের গন্তব্য কাসা দি জুলিয়েটা অর্থাৎ জুলিয়েটের বাড়ি ভেরোনা শুনেই মনে পড়েছিল রোমিও জুলিয়েটের কথা --- শেক্সপিয়ারের সবচেয়ে বিখ্যাত এই দুটি চরিত্রের বাড়ি ছিল এই শহরেইটুরিস্টদের বোকা বানানোর জন্যই নিশ্চয়, সরকারি দপ্তর থেকে তাদের দুজনের নামে দুটো আলাদা আলাদা বাড়ি চিহ্নিত করা আছে। তবে রোমিওর বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেয় না-- সেখানে লোক বসবাস করেজুলিয়েটের বাড়ি দেখতে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। ওখানকার মানু্যও যে কাল্পনিক কোনো ব্যাপার নিয়ে এত মাতামাতি করতে পারে সেটা একটু পরেই পরিষ্কার হল।
পিয়াযাদেল এরবেতে কবি বার্তো
বার্বারিনির মূর্তি
      আমাদের বজবজ থেকে আমতলার দিকে যেতে মুচিশা পেরিয়ে বাখরাহাটের কাছে বড় কাছারি বলে একটা বিখ্যাত জায়গা আছে। সেখানে প্রচুর লোকজন মানত করতে যায়। আমিও সেখানে একবার গেছি। না না,  মানতের জন্য নয় --- মুচিশা-বাখরাহাট অঞ্চলে  গাছের অনেক নার্সারি আছে, সেখান থেকে ক্যাক্টাস আনতে প্রায়ই যেতাম। লোকের মুখে বড় কাছারির কথা এত শুনেছি যে ঐ জায়গাটা দেখার ইচ্ছে আমার ছিলই। দেখেছিলাম মানুষ কাগজে তার সমস্যা লিখে শিবের কাছে পাঠানোর জন্য টানিয়ে দিচ্ছে
    জুলিয়েটের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম একই ব্যাপার। প্রধান ফটক থেকে বাড়ি পর্যন্ত দেওয়ালে ওই রকম হাজার হাজার চিরকুট ঝোলানো, দেওয়াল জুড়ে অসংখ্য লেখালেখি। প্রথমে সত্যিই ঘাবড়ে গেছিলাম। ইউরোপের লোকজন আবার এত ঠাকুর ভক্ত হয়ে মানত করা শুরু করল কবে থেকে? ওই ভিড়ের মধ্যে চতুর্দিকে শুধু ক্যামেরার ফ্লাশের ঝলকানি। ভাবলাম বুঝি কেষ্ট বিষ্টু কোনো নামজাদার আগমন ঘটেছে। তারপর কোনোক্রমে ভিড় ঠেলে একটু এগিয়ে দেখি সামনের বেদিতে দণ্ডায়মান নায়িকা জুলিয়েট সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুদলে দলে লোকজন মহম্মদ আলি পার্কের দুর্গাপুজোর প্যাণ্ডেলের মতো ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে জুলিয়েটের ব্রোঞ্জের মূর্তির বুকে হাত রেখে প্রেমের শপথ নিচ্ছে, আর সেই স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ঝটাঝট ক্যামেরার ঝলকানি দিচ্ছে। দৃশ্যটা ভাবুন একবার! বছরের পর বছর প্রতিদিন হাজার হাজার লোকের হাতের স্পর্শে মূর্তির বুকের অংশ ঘষা লেগে লেগে একেবারে অনাবৃত চকচক করছিল। মজা করে আমাকেও গৌতম বলেছিল ওদের মতো করতে --- আমি রাজি হইনি। পাগলামির একটা মাত্রা থাকা উচিত। আমার আসলে ঐ হুজুগে ব্যাপারটা খুবই বোকা বোকা লেগেছিল। বললাম, ‘আমার পরকীয়ার লাইসেন্সটা এইভাবে বাতিল করতে চাও নাকি?’
জুলিয়েটের মূর্তি, ভেরোনা
     
আদিগে নদী
ভেরোনা শহরটাকে চিরে চলে গেছে  আদিগে নদী
ব্রিজ টপকে আমরা এবার রোমান সাম্রাজ্যের প্রাচীন একটা উন্মুক্ত থিয়েটার হল দেখতে গেলাম। এরিনার অনেক আগে ওটা তৈরি, অনেকটাই ভেঙে পড়েছেঐ সময় থেকে সেখানে থিয়েটারই হত-- এখনো তাই হয়। ওর লাগোয়া মিউজিয়ামটা সেদিন বন্ধ ছিল।
     
কাস্তেলভেচ্চিও যাওয়ার সেতু

নদীর অন্য পাড়ে শহরের একদম মাঝখানে  একটা দুর্গ কাস্তেলভেচ্চিও --  এখন সেটা একটা মিউজিয়াম। এতদিনে অবশেষে তিনতোরেত্তোর আঁকা অনেক ছবি দেখার সৌভাগ্য হল
তার মধ্যে ‘Contest between the Muses and the Pierides’ বেশ বিখ্যাত। রাজা পিয়েরসের নয় কন্যাকে বলা হত পিয়েরাইদস তারা সঙ্গীতে এত ভালো ছিল যে গানের দেবতা মিউসদের চ্যালেঞ্জ করে। অনিবার্য পরাজয়ের পর দেবতারা নয়জনকেই পাখি বানিয়ে দিয়েছিলেন ছবিটার গল্প সেটাই।
Contest between the Muses and the Pierides

এছাড়া আছে তিনতোরেত্তোর আঁকা ‘Adoration of Magi’ গল্পটা আমরা সবাই জানি। যিশুখ্রিস্টের জন্মের সময় তাঁকে তিনজন পণ্ডিত সম্মান জানিয়েছিলেন। পরে ভেনিসে তিনতোরেত্তোর আরও অনেক ছবি দেখেছি। পাওলো ক্যারিওলি বিখ্যাত ছিলেন ‘ভেরোনিজ পেন্টার’ নামে। তাঁর আঁকা ”Deposition” ছবিটার কথা মনে আছে; ক্রুশবিদ্ধ যিশুকে ক্রুশ থেকে নামানো হচ্ছে। শিল্পীর তুলিতে বাইবেলের গল্পটা যেন জীবন্ত। তাঁর আরও কিছু ছবি সযত্নে রাখা আছে। তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, ওখানকার ছবিগুলো অত সুন্দর হলেও ভাস্কর্য কিন্তু কাঠকাঠ। মধ্যযুগীয় ছাপ রয়েছে।
      এখানে একটা  অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মিউজিয়ামের গার্ডরা সারাক্ষণ আমাদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য রাখছিল। ভাবলাম কালো চামড়ার লোক বলে বোধহয় এই রকম খাতির। ইতালিতে অন্য কোনো মিউজিয়ামে এমন পাইনি। পরে ইন্টারনেটে দেখলাম ইউরোপ আমেরিকার অনেকেই এই মিউজিয়াম সম্পর্কে একই কমপ্লেন করেছে সমস্যাটা তাহলে চামড়ার রঙের নয়, অন্য কিছুর!
শিল্পকলা দেখতে দেখতে ইউরোপের ইতিহাস মনে পড়ে যাচ্ছিল।  পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য পতনের পর পঞ্চম শতাব্দী থেকে মধ্যযুগীয় অন্ধকার সারা ইউরোপকে গ্রাস করেছিল ইউরোপের পুরো সমাজটা ঈশ্বর কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছিলফলে শিল্পে, ভাস্কর্যে তার প্রভাব পড়েছিল অবধারিত ভাবে। তাই ছবি, মূর্তি সবই হয়ে পড়েছিল নিস্প্রা, কাঠকাঠ। সেগুলো কিছু কিছু সেন্ট ও যিশুখ্রিস্টের জীবনের কিছু ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ কিন্তু প্রাচীন গ্রিক ভাস্কর্য বা সৌধ যেখানেই দেখেছি তা জীবনী শক্তিতে ভরপুর। মধ্যযুগের শেষে সমাজ যখন শুধুমাত্র ঈশ্বর, স্বর্গ এই চিন্তার বাঁধনে হাঁপিয়ে উঠছিল তখনই এল রেনেসাঁর স্বর্ণযুগ  মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণ পর্বে সভ্যতার বহুমুখী বিকাশই তো হল রেনেসাঁইতালিতে এই পর্বের সূচনা হয় চতুর্দশ শতাব্দীতে এবং বিকাশের শীর্ষে পৌঁছায় পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে। এ যুগে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য, আত্মচেতনা এবং পার্থিব অভিজ্ঞতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। ইতালিতে এই পর্বের সূচনার প্রেক্ষাপট ছিল রাজনৈতিক স্থায়িত্ব, অর্থনৈতিক উন্নয়ন  এবং বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির মধ্যে  মেলবন্ধন স্থাপন। বিকাশমান নাগরিক সভ্যতা ভেনিস, ফ্লোরেন্স, পিসা, জেনোয়া, মিলান প্রভৃতি শহরগুলিকে শক্তিশালী নগররাষ্ট্রে পরিণত করে। এই আন্দোলনের মূলে যে অর্থনৈতিক ঘটনাটি ক্রিয়াশীল ছিল সেটা হল নৌ বাণিজ্যের অতি দ্রুত বিস্তার।
দেশে ফেরার অনেক পরে খবর পেলাম নভেম্বর মাসে কাস্তেলভেচ্চিও থেকে লুঠ হয়ে গেছে বেশ কয়েকটা অতুলনীয় শিল্পকর্ম। তার মধ্যে আছে তিনতোরেত্তো, রুবেন্স, বেনিনির মতো শিল্পীদের ছবি। মনটা কিছুক্ষণের জন্য খারাপ হয়ে পড়েছিল।

ভেনিস, সাগর পারের  দ্বীপমালা
ভেনিস স্টেশনে নেমে
ভেরোনা ঘুরে আসার ঠিক দুদিন পর আমরা গিয়েছিলাম ভেনিস  ভেনিস শহরটা আসলে অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে তৈরি প্রাচীনকাল থেকেই এটা বন্দর শহর হিসাবে প্রতিপত্তি লাভ করেছিল। ভেনিসের মাধ্যমেই এককালে পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে বানিজ্যিক যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল বাইজেনটাইন অর্থাৎ পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য এবং এশিয়ার সেজন্য ত্রয়োদশ শতাব্দীতে  ভেনিস ছিল ইউরোপের সবচেয়ে ধনী নগর রাষ্ট্র আমরা নেমেই ভেপোরেত্তো অর্থাৎ জলের বাসের টিকিট কেটে ফেললাম। ঐ বাস কানাল গ্রান্দে (Grand Canal) দিয়ে আমাদের নিয়ে গেল মূল দ্বীপ সান মার্কোর দিকে। কথিত আছে ৮২৮ সালে যিশুর অন্যতম  শিষ্য সেন্ট মার্কের দেহাবশেষ এখানে আনা হয়েছিল
লঞ্চ থেকে সান মার্কো
সেই থেকেই সেন্ট মার্ক বা সান মার্কো হলেন ভেনিস এর রক্ষাকর্তা। জলযান থেকে দেখলাম চারপাশের অপূর্ব দৃশ্য। সমুদ্রের ধারের বাড়িগুলো ফুলে ফুলে সাজানো; সেগুলোর বেশিরভাগই হোটেল বা রেস্তরাঁ বাড়িগুলো যেন সোজা জলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। স্বচ্ছ জলে নীল আকাশে সাদা মেঘের অসংখ্য ভেলা আর জলের ওপর ঝুঁকে থাকা ফুলবাড়িগুলোর প্রতিচ্ছবি মনের মধ্যে স্বপ্নের মায়াজাল তৈরি করছিল। ইতালির মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত দ্বীপের অংশটুকুতে কেবল বাস বা ট্রেন যোগাযোগ আছেবাদবাকি শহরে কোথাও অন্য কোনও গাড়ি নেই। আছে কেবল জলযান, যাকে বলে গণ্ডোলা। তাই বাতাস পুরোপুরি দূষণ মুক্ত। বাড়িগুলো বহু প্রাচীন। কোনো কোনোটা  পাঁচ-সাতশো বছরের বা আরও বেশি পুরানো । লাইন দিয়ে বাড়িগুলো খাল দিয়ে দিয়ে যুক্ত । ফলে জালের মত অসংখ্য খাল আর ব্রিজ। বেশ মজার লাগছিল ব্যাপারটা দেখতে। রিয়াল্টো নামে বিখ্যাত একটা ব্রীজের ওপর আমরা দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি, দেখি বাড়িগুলোর পেছনের দিকে খালের ওপর  লাগোয়া পরপর অনেকগুলো গণ্ডোলা দাঁড়িয়ে । অল্প সময়ের মধ্যে লক্ষ্য করলাম  বেশ কয়েকজন বাড়ির মালিক খিড়কির দরজা খুলে সামনে রাখা গণ্ডোলায় দাঁড়িয়ে দরজায় তালা দিয়ে নৌকোর দাঁড় টানতে টানতে কাজে বেরিয়ে গেল । ঠিক আমরা যেমন বাড়ির সামনে রাখা নিজের গাড়ি চালিয়ে কোথাও যাই বাড়ির জানলা দিয়ে দড়ি টাঙিয়ে কাচা জামাকাপড় মেলা আছে, ঐ খালেরই ওপর। খালটা যেন বাড়ির উঠোন কি মজার না ব্যাপারটা ! আমরা অবশ্য জলযানের বদলে পদযানেই শহরটা ঘুরেছি
ভেনিসের গলিপথ
      ভেনিসের শাসনকর্তা ডোজে মানে ডিউক যেখানে থাকতেন  সেটাকে বলে  ডুকাল প্রাসাদটিকিট আগেই কাটা ছিল। ঢোকার আগেই দেখলাম উঁচু মিনারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিশাল ডানাওয়ালা সিংহের বিখ্যাত মূর্তি।
ডানাওয়ালা সিংহ ও সান মার্কো


এটা সান মার্কো বা সেন্ট মার্কের প্রতীক। প্রতিবছর ভেনিসে যে চলচ্চিত্র উৎসব হয়, তাতে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য যে ভেনিসিয়ান সিংহ উপহার দেওয়া হয় তা এই বিখ্যাত
winged lion এর অনুকরণে তৈরিডুকাল প্রাসাদে ঢোকার মুখে বিখ্যাত golden staircase স্বর্ণ-খচিত এই সিঁড়ি দিয়ে প্রাসাদে ঢুকে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে ঘুরে ঘুরে সাক্ষী রইলাম নানান ভাস্কর্যের, চিত্রকলার নিদর্শনের। মধ্যযুগের শেষদিকে ইউরোপে প্রযুক্তির নানান উন্নতি ঘটে, বিশেষত কৃষিতে, বস্ত্রনির্মাণে। তারই ফলে জমে ওঠে এই উদ্বৃত্ত। একই সঙ্গে এই উদ্বৃত্তকে অত্যন্ত সহজলভ্য করে তোলে জাহাজ ও নৌচলাচলের উন্নতি। এই বাণিজ্যের মূলস্রোত পূর্ব দিক থেকে এসে ভেনিসের মধ্যে দিয়ে গোটা ইউরোপে প্রবাহিত হত। সোনা দিয়ে কাজ করা প্রাসাদের ছাদ, দেওয়াল মনে করালো বৈদেশিক বাণিজ্যের দৌলতে ফুলে ফেঁপে ওঠা ঐশ্বর্যশালী সেই ভেনিসকে



ইল প্যারাডিসো
‘ইল প্যারাডিসো”, জ্যাকোপো তিনতোরেত্তোর আঁকা পৃথিবী বিখ্যাত সবচেয়ে বড় তৈলচিত্র আছে এখানে। স্বর্গের ছবি,  মাঝখানে রয়েছেন যিশু -- তাঁকে ঘিরে অসংখ্য  সাধু সন্ত। পাপীদের ক্ষমা করে দিতে মা মেরি তাঁকে অনুরোধ করছেন প্রাসাদের মূল হলঘরে, যেখানে প্রধান কাউন্সিলরদের সভা হত, সেখানে একদিকের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে ২২ মিটার লম্বা ৭ মিটার উঁচু এই ছবি ছবিটি আঁকা শুরু করেছিলেন তিনতোরেত্তো -- কিন্তু শেষ করতে পারেননি। তাঁর ছেলে দোমিনিকো ও তাঁর স্টুডিয়োর ছাত্ররা ছবিটি শেষ করেন। আছে পাওলো ভেরোনিসের আঁকা `Rape of Europa’, জিওভান্নি তিয়েপোলোর আঁকা `Gift of Naptune to Venice’ (একটা কথা বলে রাখা ভালো, সব মিউজিয়ামেই এত বেশি শিল্পকলার নিদর্শন দেখেছি, তাদের মাত্র কয়েকটার কথাই লেখা সম্ভব)  
Giant Staircase
প্রাসাদের একপাশে রয়েছে Giant Staircase - মঙ্গল ও নেপচুনের বিশাল মূর্তিগুলো একটা বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার ওপরআসলে ভেনিস একসময় সমুদ্র পথে বাণিজ্য করেই বিশাল ধনসম্পত্তি করে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়সেজন্য সমুদ্রের ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য এবং তা  সারা পৃথিবীকে বোঝানোর জন্য যুদ্ধের দেবতা মঙ্গল এবং সমুদ্রের দেবতা নেপচুনের আশীর্বাদ তখন তাদের  বিশেষ ভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল তখন ভেনিস শাসন করত ধনী পরিবারগুলো থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে তৈরি দশজন সদস্যের একটা দল, `Great Council’ ভেনিসের ডিউক, যাঁকে ডোজে বলা হত, এবং যাঁর নামে এই প্রাসাদ; তিনিও নির্বাচিত হতেন। কিন্তু একবার নির্বাচিত হবার পর আমৃত্যু তিনি ঐ পদে বহাল থাকতেন।   ডুকাল প্রাসাদের অসংখ্য কক্ষ। একজায়গায়, সংকীর্ণ অলিন্দ টপকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলাম প্রাসাদের নীচে অন্ধকূপে। বন্দীদের রাখা হত লোহার গরাদ দেওয়া ছোটো ছোটো খুপরিগুলোতে  সংকীর্ণ অলিন্দ দিয়ে  কারাগারে যাবার আগে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে তারা জীবনের শেষবারের জন্য বাইরের পৃথিবীটার দিকে একপলকের জন্য যখন তাকাত, একটা ব্রিজ তাদের চোখে পড়ততাই আজও সেটা  ‘Bridge of Sighs’ নামে পরিচিত ।
ব্রিজ অফ সাইস, ভেনিস
      ব্যক্তি মানুষ ও ব্যক্তিত্বের বহুমুখী বিকাশের ওপর মৌলিক প্রাধান্য থেকে উদ্ভব হয় রেনেসাঁ যুগের আদর্শ-মানুষ সম্পর্কিত মানবতাবাদী ধারনা ইতালীয় ভাস্কর্য , স্থাপত্য ও  চিত্রকলায় লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চি, মিকেলাঞ্জেলো, রাফায়েল, ব্রামান্ত প্রমুখের এবং সাহিত্যে পেত্রারক, দান্তে, বোকাচ্চিও, এরিওস্তো্র মতো সাহিত্যিকদের  আবির্ভাব  ইতালির মনন জগত বিকাশের এক স্বর্ণযুগ আনে তার এত নিদর্শন, যে দেখে শেষ করা যায় না।

পিয়াজা সান মার্কো

প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আমরা চলে গেলাম উল্টোদিকের
Correr  Museum,
জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব মিউজিয়ামে  ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের পতনের পর অষ্ট্রিয়ার অধীনে থাকাকালীন যুগের ভেনিসের নানান রকমের অস্ত্র সম্ভার, যুদ্ধজাহাজের মডেলগুলো সেখানে সংরক্ষিত আছে।
করার মিউজিয়ামের নানা সংগ্রহ



সামনের ব্যাসিলিকায় ঢোকার জন্য বিশাল লাইন দেখে  ঢোকার ইচ্ছে সংবরণ না করে উপায় ছিল না; কারণ ভেনিসে রাত্রে থাকব না আমাদের হাতে সময় কমই ছিল কেবল ব্যাসিলিকার মাথায় চারটে বিখ্যাত ব্রোঞ্জের ঘোড়ার মূর্তি  দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। এগুলো অবশ্য নকল, মূল প্রাচীন গ্রিক মূর্তিগুলো ভিতরে আছে। নেপোলিয়ন ইতালি আক্রমণের সময় এই ঘোড়াগুলো আর ডানাওয়ালা সিংহকে ফ্রান্সে নিয়ে যানপরে সেগুলো আবার ফেরত আসে
সান মার্কোর ব্যাসিলিকা
      সারা পৃথিবী থেকে আসা পর্যটকের ভিড় বেশ উপভোগ করা যায় ভেনিসের পুরানো ইতিহাসের স্মৃতি বয়ে বেড়ানো অতি প্রাচীন অলিগলিতেখাবারের অসম্ভব দামতার মধ্যেই আমরা একটা বাংলাদেশী দোকান থেকে দোনা কাবাব কিনে খেলাম, সঙ্গে পানীয়প্রচুর বাংলাদেশী ওখানে ব্যবসা করে। মুখোশ খুব বিক্রি হচ্ছে দেখলাম, কয়েকটা কিনেও ফেললাম । একটু আগে ‘Great Council’ এর কথা বলেছি। ভেনিস শাসন করার সময়ে দশ জন সদস্যদের মধ্যে অনেকে নগর পরিচালনার সময়ে প্রকাশ্যে পরিচয় জানাত না। সভাতে তারা মুখোশ পরে থাকত সেই থেকেই সম্ভবত ভেনিসের মুখোশ  বিখ্যাত।

ফুলের বাহার, ভেনিস

ভেনিস থেকে ত্রিয়েস্তে ফিরে রাত্রে প্রবল উদ্যমে দুজনে মিলে গল্প করতে করতে রান্না করলামস্যালমন মাছের ঝাল আর ভাত। বাইরে বেড়াতে গেলে আমরা সবাই খুব উদার হয়ে যাই। বাড়িতে কখনো রান্না করলে গৌতম ভুলেও আমাকে যেচে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না। কিন্তু ওখানে উৎসাহটাই আলাদা রকম ত্রিয়েস্তেতে রোজ রাতের রান্নাতে ও হাত লাগাতো রাতে রান্নার ফাঁকে ফাঁকে আমরা একসঙ্গে গান করতাম বা কবিতা আওড়াতাম। ভেনিস ঘুরে আসার পর আর মাত্র দুদিন ওখানে থাকব । তারপর ফ্লোরেন্সের দিকে রওনা দেব। সেখানে রান্না করে খাবার কোনো সুযোগ নেই। এদিকে ফ্রিজে একগাদা মাংস, সব্জি ঠাসা কিন্ত চাল শেষ। গৌতম বলল, দুটো দিন ভাত বাদ দিয়ে পাস্তা দিয়ে চালিয়ে দাও দু ইউরো দিয়ে এক কিলো চাল কিনলে শেষ হবে না, ফেলে দিতে হবে। কিন্তু আমার মনটা মুষড়ে গেল। ফ্লোরেন্স  বা রোমে গিয়ে ভাত পাব কিনা জানি না।  ত্রিয়েস্তেতে যেখানে রোজই প্রায় রেঁধে খেতাম। ভাত ছাড়া কতদিন থাকতে হবে ভেবেই কষ্ট হতে লাগল। পরদিন ফ্রিজে যা যা ছিল, একটা গোটা বাঁধাকপি, অন্য সব্জি, মাংস সব রান্না করে ফেললাম আমার ভাতের জন্য শোকাকুল অবস্থা বুঝে ও অফিস যাবার আগে বাজার থেকে অল্প চালের (৫০০ গ্রাম) সিল করা প্যাকেট কিনে এনে আমার মুখে হাসি ফোটালো। ঐ চাল দিয়ে আমার চার বেলা ভালোভাবে চলে যাওয়ার কথা কিন্তু রান্না করতে গিয়ে একেবারে বোকা বনলাম। প্যাকেটে চাল নয়, ছিল রান্না করা ভাত -- খালি গরম করে খেতে হবে প্যাকেটের গায়ে ইতালিয়ান ভাষায় সবই লেখা থাকে  কিন্তু ভাষাটা না জানার ফলে ঐ দুদিন দুপুরে ও রাত্রে স্তুপাকার বাঁধাকপি, সব্জি ও মাংসের ওপর নামমাত্র ভাত ছড়িয়ে পেট ভরালাম  বিদেশে গেলেও ভাতের প্রতি আকর্ষণ আমার এতটুকুও কমেনি দেখে নিজেই অবাক হলাম। (ক্রমশ)


প্রকাশিতঃ সৃষ্টির একুশ শতক, জুন ও জুলাই সংখ্যা, ২০১৬