Monday 11 June 2018

বিজ্ঞানীর বিবেক

আমার প্রথম দিকের লেখা। বিষয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরমাণু বোমা সংক্রান্ত গবেষণা।  বেশ বড় বলে দুই কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল  'এখন পর্যাবরণ' পত্রিকার ডিসেম্বর ২০০৩ ও জানুয়ারি ২০০৪ সংখ্যায়। 
 

বিজ্ঞানীর বিবেক

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের দ্বিতীয় পরমাণু বোমা পরীক্ষার পর সারা দেশে বহু লোক এর পক্ষে বা বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের যাঁরা পরিচালক তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ সাধারণভাবে সকলেরই পরিচিত। পরমাণু অস্ত্র বিষয়ে তাঁদের সমর্থন থাকাই স্বাভাবিক। দেশের বিজ্ঞানীদের এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি কী অনে তাকেরই অজানা। দেশের বিজ্ঞানচর্চার মূল কেন্দ্রগুলির মধ্যে যেগুলি সরাসরি সরকারের অধীন নয় তার প্রায় প্রত্যেকটিতে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে দেশব্যাপী যে সমর্থন ও উচ্ছ্বাসের জোয়ার দেখা গিয়েছিল তার তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল প্রতিবাদের কণ্ঠ। কিন্তু একথাও মনে রাখতে হবে যে বহু বিজ্ঞানী প্রতিবাদে যোগ দেননি অথবা সরকারের পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন। পরমাণু বোমা প্রকল্পে অনেক বিজ্ঞানী কাজ করেছেন বা এখনও করছেন। এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পরমাণু বোমা প্রকল্পের সূচনাপর্বে এবং অব্যবহিত পরে প্রকল্পে যুক্ত বিজ্ঞানীদের ভূমিকা আলোচনা হয়তো বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে এই নিবন্ধ পরমাণু বোমা তৈরির বিজ্ঞান বিষয়ে নয়। বিজ্ঞানীরাও মানুষ, গবেষণাগারের বাইরে। তারা আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতোই । তাঁদের রুজিরোজগার, সংসার ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। তাঁরাও ভুল করেন, আবার তা সংশোধনের চেষ্টা করেন। সেই মানুষগুলিকে নিয়েই এই প্রবন্ধ।

বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলি বিমূর্ত ও নৈর্ব্যাক্তিক। সমাজের উপর তা নির্ভর করে না। কিন্তু গবেষণা ও বিজ্ঞানের প্রয়োগ একান্তভাবেই সমাজনির্ভর। গ্যালিলিওর সময়ে যেআধু নিক বিজ্ঞানের জন্ম তার উত্তরাধিকার নিহিত আছে বিজ্ঞানীর সত্যের প্রতি ভালবাসার মধ্যে, প্রকৃতিকে বোঝার প্রচেষ্টার মধ্যে। বিংশ শতাব্দিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত গবেষণাগারের বাইরে তাঁর কাজের প্রয়োগ নিয়ে তিনি ছিলেন উদাসীন। বিজ্ঞানের গজদন্ত-মিনারের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাই তাঁর কাছে ছিল শ্রেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে সিদ্ধান্তের ভার আরোপিত হয়েছিল তা বহনের প্রস্তুতি তাঁর ছিল না। এ বিষয়ে বিখ্যাত পদার্থবিদ রিচার্ড ফেইনম্যানের একটি মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। সফল পরমাণু বোমা পরীক্ষার পর মানসিক অবস্থা বোঝাতে তিনি লিখেছেন, ‘... আমরা একটা ভাল উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করেছিলাম। উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পরিশ্রম করা আনন্দ ও উত্তেজনার বিষয় চিন্তা করা তখন একেবারে বন্ধ।' এই সমাজবিমুখীনতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন এক বিলাস যা গবেষকের পক্ষে আর উপভোগ করা সম্ভব নয়। অথচ চারশ বছরের বিজ্ঞানচর্চার উত্তরাধিকার অস্বীকার করাও তার পক্ষে সহজ নয়। এই দুয়ের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় বিজ্ঞানীর বিবেক। পরমাণু বোমা প্রকল্পে যুক্ত বিজ্ঞানী জেমস্ ফ্রাঙ্ক Emergency Committee of the Atom Scien tists -এর সামনে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বলেছিলেন 'আমাদের নৈর্ব্যক্তিকতাই রাজ নৈতিক বিবাদে কোনো পক্ষ নিতে বাধা দেয়, কারণ ন্যায় সেখানে কখনই একপক্ষীয় নয়। তাই আমরা সহজ পথ বাছি এবং আশ্রয় খুঁজি আমাদের গজদন্ত মিনারে। আমরা মনে করেছিলাম যে আমাদের গবেষণার ভালো বা খারাপ কোনো প্রয়োগই আমাদের দায়িত্ব নয়।' বিশ্ববিশ্রুত গবেষকের এই স্বীকারোত্তির প্রতিধ্বনি শোনা যায় সংশ্লিষ্ট আরও অনেকের কণ্ঠে।

পরমাণু বোমা সৃষ্টির কথা বলতে গেলে প্রথমেই আলোচনা করতে হয় তার পট ভূমিকা। বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড পরমাণুর কেন্দ্রীণ বা নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে নিউক্লিয় বিজ্ঞানের জন্ম। নিউক্লিয়াসের মধ্যে যে অমিত শক্তি নিহিত আছে তা মুক্তির জন্য কয়েকজন বিজ্ঞানী কাজ করে চলেছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অটো হান, হান্স বেথে, এনরিকো ফার্মি, লিও জিলার্ড, লিজে মিটনার, আইরিন জোলিও কুরি প্রমুখ। ১৯৩০-এর দশকে ধীরে ধীরে তাঁদের গবেষণার তাৎপর্য পরিষ্কার হয়ে আসে গবেষক মহলে। পরীক্ষাগারের বাইরে তখন চলছে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। ইউরোপের বিজ্ঞান গবেষণার পীঠস্থান ছিল জার্মানি। ১৯৩৩ সালে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিরা ক্ষমতায় আসে। নাৎসি মতবাদের এক মূল স্তম্ভ ছিল অন্ধ ইহুদিবিদ্বেষ এবং পরমত অসহিষ্ণুতা। নাৎসিদের হাতে পরবর্তী বারো বছরে খুন হয় ষাট লক্ষ ইহুদি। বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে ইহুদি চিন্তাবিদ এবং যাঁরাই নাৎসি দর্শনের বিরোধী তাদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার। শুধুমাত্র নাৎসি জার্মানি বা তার সহযোগী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ইতালি নয়, ইউ রোপের বহু বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নাৎসি ছাত্ররা তাদের বিরোধীদের উপর আক্রমণ চালায়। ফলে অনেক বিজ্ঞানী দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। 'নতুন দুনিয়া" মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁদের সাদরে গ্রহণ করে। এঁদের মধ্যে আইনস্টাইনের নাম সকলেরই জানা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনার পর জার্মানির অধিকৃত দেশগুলি থেকেও অনেক বিজ্ঞানী আমেরিকায় চলে যান। এই সময় থেকেই বিজ্ঞান গবেষণার শীর্ষস্থান আমেরিকার দখলে যায়। দেশত্যাগী বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেই পরমাণু বোমা তৈরিতে সাহায্য করেন। নাৎসিদের মতবাদের ভয়াবহতার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে তাঁরা হিটলারের হাতে পরমাণু বোমার সম্ভাবনাতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। মানবজাতির ভবিষ্যৎ বিষয়ে দুশ্চিন্তা তাঁদের বাধ্য করে জার্মানির বিরোধী পক্ষকে পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে সহায়তা দিতে। অনেকেই জানেন যে আইনস্টাইন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি এফ. ডি. রুজভেল্টকে পর মাণু গবেষণার গুরুত্ব বোঝাতে একটি চিঠি লেখেন। এই চিঠি লিখতে তাঁকে উৎসাহিত করেছিলেন লিও জিলার্ড, ইউজিন উইগনার এবং এডওয়ার্ড টেলার। এঁরা সবাই নাৎসি দের অত্যাচারে ইউরোপ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

প্রায় একই সঙ্গে গবেষণাক্ষেত্রে ঘটেছিল। আর একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন যার প্রভাব তখনই বোঝা যায় নি। বিজ্ঞান গবেষণা চিরকালই ছিল খরচসাপেক্ষ। বিজ্ঞানীরা এতদিন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি সামান্য অনুদান এবং ব্যক্তিগত সাহায্যের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। ১৯৩০-এর দশক থেকেই রাষ্ট্র গবেষণাতে অর্থসাহায্য করতে শুরু করে যা বিজ্ঞানীরা সাদরে গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রের অনুদানের ক্ষমতা অনেক বেশি তাই নতুন ও উন্নতমানের যন্ত্রপাতিতে গবেষণাগারগুলি আধুনিক হয়ে ওঠে। কিন্তু অনেকেই ভুলে গিয়েছিলেন সেই ইংরাজি প্রবাদবাক্য 'He who pays the piper calls the tune'। গবেষণার দিকনির্দেশ অনেক সময়েই চলে যায় রাষ্ট্রশক্তির হাতে। রাষ্ট্র যখন গবেষণাকে মারণাস্ত্র তৈরির কাজে লাগায়, তখন অনেকের পক্ষে তাকে আর অস্বীকার করার কোনো পথ থাকে না।

আবার আগের কথায় ফিরে আসি। যদিও অধিকাংশ বিজ্ঞানী পরমাণু গবেষণার সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য বিষয়ে অচেতন ছিলেন কিছু ত্রিশের দশকের মধ্যভাগ থেকেই আস্তে আস্তে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৩৫ সালে লিও জিলার্ড বিজ্ঞানীদের কাছে আবেদন জানান স্বেচ্ছা প্রণোদিতভাবে গবেষণার ফল প্রকাশ বন্ধ রাখতে। কিন্তু তাঁর অনুরোধ সাধারণভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়। যুদ্ধ শুরুর পর আইনস্টাইনের চিঠি আগেই উল্লেখিত হয়েছে। আইনস্টাইন ও অন্যান্যদের উদ্বেগের মূল কারণ ছিল ১৯৩৮ সালের বার্লিনের কাইজার উইলহেল্‌ম ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের পরমাণু বিভাজনে সাফল্যলাভ। এরপরই বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ঐ ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা হন। মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে জার্মানিতে তখনও যে বিজ্ঞানীরা আছেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র হাইজেনবার্গের পক্ষেই পরমাণু বোমা নির্মাণ সম্ভব। মিত্রপক্ষের বিজ্ঞানীরা এই সময় থেকেই দুটি কারণে জার্মানিতে তাঁদের সহকর্মীদের সঙ্গে যোগা যোগ বন্ধ করে দেন। প্রথমত নাৎসিরা জোর করে বা ভয় দেখিয়ে জার্মান বিজ্ঞানীদের থেকে কাজ আদায় করে নিতে পারে। দ্বিতীয় কারণ একটু জটিল। লেনার্ড ও স্টার্ক এই দুই নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী নাৎসিদের পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। মার্কিন মহলে তখন জার্মানির রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত যে কোন বিজ্ঞানীর ভূমিকা সন্দেহ জনক মনে হয়। ইহুদিদের উপর নাৎসিদের অত্যাচারের সময় চুপ করে থাকাও তখন এক ধরনের অপরাধ বলে তাঁরা মনে করেছিলেন। তাঁদের পক্ষে তখন জানা সম্ভব ছিল না হাইজেনবার্গ ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে দেশত্যাগ করতে মনস্থ করেছিলেন, কিন্তু অশীতিপর বিজ্ঞানী কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জনক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তাঁকে নিবৃত্ত করেন। প্ল্যাঙ্ক তাঁকে বোঝান যে, যাঁরা সরাসরি অত্যাচারিত নয় তাঁরা বিদেশে চাকরি নিলে যাঁদের অনেক বেশি প্রয়োজন তাঁরা বর্ণিত হবেন। ব্যক্তিগত মতামতও অনেক সময় গুরুত্ব পায়। এডওয়ার্ড টেলার জানতেন যে তাঁর প্রাক্তন বন্ধু কার্ল ফ্রেডরিক ভন ওয়াইজেকার নাৎসিদের মতবাদের সমর্থক। তাই তিনি যখন জার্মানির ইউরেনিয়াম প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত হন তখন টেলার মার্কিন সামরিক মহলকে পরমাণু বোমা তৈরির জন্যে চাপ দিতে শুরু করেন। এর মধ্যে যে ওয়াইজেকারের মনের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে তা তাঁর অজানা ছিল। জার্মান বিজ্ঞানীদের ভূমিকা যথাস্থানে আলোচনা করব। যুদ্ধ শুরুর পর ব্রিটেনে রুডলফ ই পিয়ের্লস ও অটো রবার্ট ফ্রিশ সরকারের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। তাঁরা দেখান যে পরমাণু বোমা একটি সম্ভবপর প্রকল্প। এরপর ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে গবেষণা শুরু হয়।

জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও পরমাণু বোমা গবেষণা শুরু হয়। রুজভেল্ট এ বিষয়ে সংগঠনের দায়িত্ব দেন মেজর জেনারেল লেসলি গ্রোভকে। প্রকল্পের নাম হয় ম্যানহাটান প্রকল্প। বিজ্ঞানী জে. রবার্ট ওপেনহাইমার হলেন প্রকল্পের অধিকর্তা। নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে লস এলামসে মূল গবেষণাগার স্থাপিত হয়। এছাড়াও ওক রিজ ও শিকাগোতেও প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ব্রিটেনের পরমাণু প্রকল্পে কর্মরত বিজ্ঞানীরাও এখানে যোগ দেন। বস্তুতপক্ষে এই প্রকল্পে যে রকম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের সমাবেশ ঘটেছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে আগে বা পরে কখনও হয় নি। বহু বিজ্ঞানীর অনলস প্রচেষ্টাতে প্রথম পরমাণু বোমা পরীক্ষা হয় ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ১৬ জুলাই নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে। বোমা বিস্ফোরণের জ্যোতি ওপেনহাইমারের মনে এনে দেয় ভগবদ্গীতার বিশ্বরূপ দর্শন।

দিবি সূর্যসহস্রস্য ভবেদ্ যুগপদুত্থিতা ।

যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ্ভাস্তস্য মহাত্মনঃ ।।

( যদি যুগপৎ সহস্র সূর্য উত্থিত হয়, তা সেই পরমাত্মার জ্যোতির সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে)। কিন্তু এ তো ভগবানের বিশ্বরূপ নয় — এ নটরাজের কালরূপ-মৃত্যুর দ্যোতক। তাই আবার তিনি আশ্রয় খুঁজলেন গীতার মধ্যে।


কালেহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো লোকান্ সমাহর্তুমিহঃ প্রবৃত্তঃ।

ঋতহপি ত্বাং ন ভবিষ্যন্তি সর্বে যেহবস্থিতা প্রত্যনীকেষু যোধাঃ।।


( আমি লোকক্ষয়কারী কাল – বর্তমানে সংহারে প্রবৃত্ত। তুমি যুদ্ধ না করলেও বিপ ক্ষের যোদ্ধাগণ জীবিত থাকবেন না)। অর্থাৎ এই মারণ অস্ত্র তৈরিতে ওপেনহাইমার নিমিত্ত মাত্র।

ওপেনহাইমারের দর্শন সকলের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তার মূল কারণ ছিল জার্মানদের বোমা বানানোর অক্ষমতা সম্বন্ধে মিত্রপক্ষের বিজ্ঞানীরা এর আগেই নিশ্চিত ছিলেন। ব্রিটেনে বিজ্ঞানীরা জানতেন যে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকরা তখনও নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন। এর সঙ্গে তুলনা করতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে গোটা দেশের প্রায় সমস্ত প্রথমশ্রেণীর পদার্থবিদরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অদৃশ্য থেকে হয়ে গেছেন এবং তাদের কারও সঙ্গে সেই মুহূর্তে যোগাযোগ করা অসাধ্য প্রায়। কী ঘটেছিল জার্মানির বোমা তৈরির প্রকল্পে?

বস্তুতপক্ষে জার্মানির পরমাণু অস্ত্র বানানোর প্রচেষ্টা সম্পর্কে আজও বিশেষজ্ঞরা একমত নন। তার একটা কারণ অবশ্যই। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাতে সর্বময় সন্দেহের বাতাবরণ। ফলে বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে যোগাযোগ প্রায় অদৃশ্য হয়ে পড়েছিল। ফ্রিজ হাউটারম্যান জার্মান ডাক বিভাগের হয়ে পরমাণু গবেষণা করতেন এবং প্রায় কোনো তথ্যই প্রকাশ করতেন না। Federation of American Scientists (এই সংস্থার কথা পরে আসবে)-এর মুখপত্রে সংস্থার সভাপতি জে.এফ. স্টোন ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনাকাল থেকেই জার্মান বিজ্ঞানীরা পরমাণু বোমার সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেখানোর জন্য এক নীরব সহমত গঠন করেন। তাঁরা হিটলারের হাতে এই অস্ত্র তুলে দিতে চান নি। তারা সরকারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে মানবজাতির সেবা করেছিলেন। যুদ্ধোত্তর কালে হাইজেনবার্গ লিখেছেন তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল জার্মানির পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে জার্মানিতে পদার্থবিদ্যার গবেষণার যাতে মৃত্যু না হয় তা নিশ্চিত করা। এজন্য তিনি তরুণ বিজ্ঞানীদের সৈন্যদল থেকে এনেছিলেন বোমা গবেষণার নাম করে তাঁদের প্রাণ রক্ষা করতে। ২০০০ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে হাল বেথে এবং রবার্ট ইয়ুঙ্ক তাঁর গ্রন্থ 'Brighter Than a Thousand Suns'-এ এই মত সমর্থন করেন। ওয়াইজেকারের কথা আগেই বলেছি। অর্থাৎ জার্মান বিজ্ঞানীরা সচেতনভাবে বোমা বানানো থেকে বিরত ছিলেন। হাইজেনবার্গের একদা সহকর্মী রুডলফ পিয়ের্লসের মতে হাইজেনবার্গ ও অন্যান্য জার্মান বিজ্ঞানীরা পরমাণু বোমা বানানোর প্রযুক্তিগত বাধাগুলিকে অনেক বড়ো ভেবেছিলেন। তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন যে বোমা বানানো সম্ভব নয়, সুতরাং কোনো নৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের সম্মুখীন তাঁদের হতে হয় নি।

এটা নিশ্চিত যে হাইজেনবার্গ মিত্রপক্ষের বিজ্ঞানীদের কাছে সঙ্কেত পাঠাতে চেয়ে ছিলেন। জার্মানি ডেনমার্ক অধিকারের পর হাইজেনবার্গ তাঁর শিক্ষক স্থানীয় প্রবাদপ্রতিম ডেনিশ পদার্থবিদ নিলস বোর-এর সঙ্গে দেখা করেন। বোরের মৃত্যুর পর পাওয়া হাইজেনবার্গকে লেখা ডাকে না দেওয়া এক চিঠি থেকে জানা যায় যে হাইজেনবার্গ তাকে পরমাণু বোমার সম্ভাবনা সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। তা মিত্রপক্ষকে সতর্ক করার জন্য না কি মৌন সম্মতির মাধ্যমে উভয়পক্ষকেই গবেষণা থেকে বিরত হওয়ার অনুরোধ করতে অথবা ভয় দেখিয়ে বা জোর করে বোরকে জার্মান পক্ষে আনার জন্যে- - তা আজ আর জানার কোনো উপায় নেই। হাইজেনবার্গের সমালোচকরা তৃতীয় বিকল্পটিকে বেছে নিয়েছেন। তবে ইহুদি বিজ্ঞানীদের হিটলারের কবল থেকে উদ্ধার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর কাজে বোরের সক্রিয়তার কথা হাইজেনবার্গের অজানা থাকার কথা নয় তাই সেটি সম্ভবপর বলে মনে হয় না। যুদ্ধোত্তর কালে জার্মান পরমাণু বিজ্ঞানীরা একবাক্যে বলেছেন যে তাদের লক্ষ্য ছিল রিঅ্যাক্টর তৈরি, বোমা নয়। যদি একথা মেনে নেওয়া হয় যে প্রযুক্তিগত বাধাগুলিকে অনেক বড়ো মনে করার জন্যই তাঁরা বোমা বানানোর পথে যান নি - সেক্ষেত্রে অবচেতন মনে বোমা সম্পর্কে বিতৃষ্ণার থেকে প্রকৃত গবেষণাতে অনীহার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যাই হোক না কেন - ইতিহাসের পরিহাসে টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা ফ্যাসিবাদী শক্তির হাতে ভয় করতম অস্ত্র তুলে দেন নি অথচ গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা সেই অস্ত্রই তুলে দেন রাষ্ট্রের হাতে। রাষ্ট্রশক্তির সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের জ্ঞান কতটা সীমিত ছিল তা বোঝার জন্য একটি ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট। জার্মানির ইউরেনিয়াম প্রকল্পের অগ্রগতি বোঝার জন্য মার্কিন সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে বিজ্ঞানী স্যামুয়েল গোডস্মিটের নেতৃত্বে এক অনুসন্ধানকারী দল পাঠানো হয়। অনুসন্ধানের ফলে জার্মান পরমাণু বোমার অস্তিত্ব নেই বুঝতে পেরে গোডস্মিট সহযোগী এক মেজরকে বলেন যে মার্কিন পক্ষের আর পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না। মেজর উত্তর দেন যে অস্ত্র যদি আমেরিকানদের হাতে থাকে তারা তা ব্যবহার করবেই। ইতিহাস প্রমাণ করে দিয়েছে বিজ্ঞানীর সমাজ বিষয়ে অনভিজ্ঞতা।


বিপক্ষের হাতে পরমাণু বোমা নেই তা বোঝার পর কী করেছিলেন বিজ্ঞানীরা? পূর্বোল্লিখিত প্রবন্ধে জে. এফ. স্টোন লিখেছেন ১৯৪৩ সালের গ্রীষ্মকালেই বোঝা গিয়েছিল জার্মানরা বোমা বানাতে পারবে না। কিন্তু ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা তা জানা সত্ত্বেও মানহাটান প্রকল্পে কর্মরত বিজ্ঞানীদের জানানোর সক্রিয় প্রচেষ্টা করেন নি এবং যখন তাঁরা তা করলেন তখন তাঁদের মত রাজ নৈতিক মহলে গ্রাহ্য হয় নি। যদিও সমস্ত বিজ্ঞানী যে একরকম পথ নিয়েছেন তা নয়। জার্মানির পরমাণু বোমা নেই জানার পর জোসেফ রটব্ল্যাট মানহাটান প্রকল্প থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৪৪-এর শেষভাগ থেকেই অনেক বিজ্ঞানী বোমা প্রয়োগের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতে থাকেন। বিজ্ঞানী নিলস্ বোর যিনি ইতিমধ্যে আমেরিকা পালিয়ে এসে মানহাটান প্রকল্পে সহায়তা করেছেন তিনি মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সঙ্গে দেখা করে পরমাণু অস্ত্রের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন। তাঁর প্রস্তাব কোনো গুরুত্ব পায় নি।

এরপরই রুজভেল্টের মৃত্যু হয় এবং তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী ট্রুম্যান রাষ্ট্রপতির ভার গ্রহণ করেন। জেমস্ ফ্র্যাঙ্ক, লিও জিলার্ড এবং ইউজিন রাবিনোভিচের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী একটি রিপোর্ট তৈরি করেন এবং ১৯৪৫ সালের জুন মাসে তদানীন্তন মার্কিন সমর-সচিব হেনরি স্টিমসনের কাছে পেশ করেন। বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারের ফলে তাঁদের নিজেদের উপর যে অপরিসীম নৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ পড়েছিল এই রিপোর্ট হল তাঁদেরই পক্ষ থেকে এবিষয়ে প্রকাশিত প্রথম যৌথ প্রয়াস। এতে পরমাণু শক্তির উপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয় এবং পরবর্তীকালে মারণাস্ত্র প্রতিযোগিতা সম্বন্ধে নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় ৷

শিকাগোতে জিলার্ড বিশেষ সক্রিয় ছিলেন। ৩ জুলাই তিনি মার্কিন রাষ্ট্রপতির কাছে এক আবেদনে নৈতিক কারণে পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগে বিরত থাকতে বলেন। একই সঙ্গে এই আবেদন পত্রটি তিনি সহকর্মীদের মধ্যে স্বাক্ষরের জন্য পাঠান। সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে এক চিঠিতে তিনি লেখেন যে সাধারণ জার্মানরা নাৎসিদের অনৈতিক কার্যকলাপের বিরোধিতা না করার জন্য সমালোচনার পাত্র। মানহাটান প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করেও যদি পরমাণু বোমার বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকেন তবে তাঁদের কোনো অজুহাতই থাকবে না। ওক রিজের বিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রপতির কাছে দুটি পৃথক আবেদন পাঠান। প্রথমটিতে আঠার জন ও দ্বিতীয়টিতে সাতযট্টি জন স্বাক্ষর করেন। তাঁরা আবেদন জানান যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োগের আগে যেন এই নতুন অস্ত্রের ক্ষমতা শত্রুপক্ষকে জানানো ও দেখানো হয়। তাঁরা মনে করেন যে এই পথ ভবিষ্যতে যুদ্ধ বন্ধ করতে ফলপ্রসূ হবে। ১৭ জুলাই রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে জিলার্ড আরও একটি আবেদন পাঠান। শিকাগোতে কর্মরত ঊনসত্তর জন বিজ্ঞানী এতে স্বাক্ষর করেন। তাঁরা জাপানের বিরুদ্ধে প্রয়োগের আগে আলোচনা ও অস্ত্রের শক্তি প্রদর্শনের অনুরোধ করেন। তাঁরা পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের পর এমন এক পরিস্থিতির ভবিষ্যদ্বাবাণী করেন যেখানে বিবদমান দুপক্ষের নগরগুলি সর্বদা ধ্বংসের আশঙ্কায় থাকবে।

এই আবেদন নিবেদনে কোনো ফল হল না। কারণ ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি তখন তাদের শত্রু পরিবর্তন করে ফেলেছে। জার্মানি বা জাপান নয়, যুদ্ধোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নই তখন নতুন প্রতিপক্ষ। প্রকৃতপক্ষে মার্কিন সামরিক মহল এই আবেদন প্রথমে রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছতে বাধা দিয়েছে এবং এমন সময়ে পৌঁছে দিয়েছে যখন সমস্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গেছে। শেষ যে আবেদন পত্রটির কথা পূর্ব অনুচ্ছেদে বলেছি সেটি যখন প্রকাশ পায় তখন দেখা গেছে আবেদনকারীদের অনেকের স্বাক্ষরের নামের পাশেই তাঁদের প্রকল্প থেকে কর্মবিচ্যুতির তারিখ লেখা রয়েছে। অনুমান করা অসঙ্গত নয় আবেদন কারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হিসেবেই তাঁদের বরখাস্ত করা হয়। এর সঙ্গে মনে রাখতে হবে ততদিনে দুশ কোটি ডলার খরচ হয়ে গেছে বোমা তৈরিতে। কাজেই সামরিক কর্তৃপক্ষের উপরও যুদ্ধে তা কত কার্যকরী তা দেখানোর চাপ ছিল।

প্রশ্ন উঠতে পারে এমন পরিস্থিতিতেও কেন বিজ্ঞানীরা বোমা বানানোর কাজ করেছিলেন। জোসেফ রটব্ল্যাটের মতে এটা হল যা চলছে তাকে চলতে দেওয়ার মনোবৃত্তি। লস এলামসে কর্মরত বৈজ্ঞানিকদের মানসিকতার প্রতিভূ হিসাবে রুডলফ্ পিয়ে লসের মতামত দেখা যাক।

পিয়ের্লসের মতো বিজ্ঞানীরা আশা করে ছিলেন যে পরমাণু অস্ত্র মিত্রপক্ষকে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখবে। কিন্তু ইঙ্গ-মার্কিন সরকার একমাত্র খুব বিশেষ ক্ষেত্রেই এর ব্যবহার করবেন। কোনো নগরের উপর, কোনো বিপদসঙ্কেত ছাড়াই এটা প্রয়োগ হবে তা তাঁরা কল্পনাও করতে পারেন নি। পিয়ের্লস লিখেছেন কোনো জনবিরল জায়গায় প্রয়োগ করে বোমার কার্য ক্ষমতা দেখানোই যেত, আর নাগাসাকিতে বোমা ফেলার কোনো কারণই ছিল না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, অপর এক বিজ্ঞানী ব্রায়ান ফিল্ড লিখেছেন যে হিরোসিমাতে বোমা ফেলার পর তিনি উল্লাস ই করলেও দ্বিতীয় বোমা ফেলার সংবাদে বিরক্ত হয়ে পড়েন। অস্ত্রপ্রয়োগের আগে বিবেচনার জন্য বিজ্ঞানীরা ভরসা করেছিলেন নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞানীদের উপর যাঁরা সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবেন। ওপেনহাইমার, ফার্মি ছাড়াও এই নেতৃস্থানীয় বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে ছিলেন আর্নেস্টো লরেন্স এবং আর্থার কম্পটন। কিন্তু সে আশা তাঁদের পূরণ হয় নি। উপরোক্ত চারজনকে নিয়ে গঠিত কমিটি নৈতিক প্রশ্ন এবং বিজ্ঞানীদের প্রতিবাদ বিষয়ে আলোচনাই করেন নি। তাঁরা সুপারিশ করেন যে জাপান যুদ্ধে আমেরিকানদের জীবন বাঁচানো তাঁদের দায়িত্ব এবং সরাসরি সামরিক ক্ষেত্রে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করা ছাড়া তা সম্ভব নয়। এঁরা চারজনই বিজ্ঞানী হিসেবে সমস্ত সহকর্মীর শ্রদ্ধার পাত্র এবং মানবিক দিক থেকেও সংবেদনশীল। কিন্তু প্রয়োজনের সময় তাঁরা তাঁদের কর্তব্যপালনে ব্যর্থ হলেন।

টুম্যান তাঁর ডায়েরিতে বলেছেন যে তিনি সম্পূর্ণ সামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর বোমা ফেলতে নির্দেশ দেন যাতে মহিলা ও শিশুদের প্রাণহানি না ঘটে। প্রকৃত সামরিক দলিলে এই চিন্তাভাবনার কোন নজির নেই। লক্ষ্যবস্তু হিসেবে প্রথমে চারটি শহরকে বাছা হয়েছিল যেগুলির কোনোটিরই বিশেষ সামরিক গুরুত্ব ছিল না। ইঙ্গ-মার্কিন রাজ নৈতিক ও সামরিক মহল যুদ্ধের পর বলেন যে পরমাণু বোমাতে যত লোক মারা গেছে, জাপান আক্রমণ ও অধিকার করতে গেলে জাপানিদেরই প্রাণহানি হত তার চেয়ে বেশি। অনেক বিজ্ঞানীও তাই মনে করতেন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না যে জাপান তখন আত্মসমর্পনের জন্য প্রস্তুত এবং ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্ব তা জানতেন। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এমন একটা মানসিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। যে অসামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর আক্রমণ স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে পড়েছিল। ফলে শহরের উপর বোমা নিক্ষেপের বিষয়ে নৈতিক আপত্তি ওঠে নি। কিন্তু যে অস্ত্রে কার্যত নিজেদের কোনো ঝুঁকি ছাড়াই শত্রুদেশের একটি বিরাট শহরকে এক মুহূর্তে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা যায় তাকে অন্য অস্ত্রের থেকে পৃথকভাবে দেখা প্রয়োজন।

হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে বোমা বিস্ফোরণে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা অনেকেরই জানা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় দুই লক্ষাধিক ব্যক্তি। দীর্ঘকাল যন্ত্রণা ভোগের পর মৃত্যুর সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি। বোমার ভয়াবহতা তার নির্মাতাদের অধিকাংশকেই বিষণ্ণ করে তোলে। রাজ নীতিবিদরা যখন বোমার গুণগানে ব্যস্ত তখনই উইলি হিগিনবোথামের নেতৃত্বে Association of Atom Scientists গঠিত হয় জনগণকে এর ভয়াবহতা সম্বন্ধে সচেতন করার জন্য। ১১ অগস্ট নাগাসা কিতে বোমা পড়ার দুদিন পরই, নিলস বোর লন্ডনের 'দি টাইমস' পত্রিকায় লেখেন যে সভ্যতা এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর পূর্ণ অধিকার এবং আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধান ছাড়া পরমাণু অস্ত্রের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণই ফলপ্রসূ হওয়া সম্ভব নয়। তিনি পরবর্তীকালে এই প্রস্তাব রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাছে এক খোলা চিঠির মাধ্যমেও দিয়েছিলেন। পরমাণু গবেষণা সামরিক নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মার্কিন সেনেটে একটি বিল আসে। নবগঠিত Federation of Atom Scientists (পরে যার নাম হয় Federation of American Scientists বা FAS)-এর চেষ্টাতে এই বিল পাস হতে পারে নি। FAS প্রথম থেকেই পরমাণু অস্ত্রের উপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের দাবি রাখে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন পরমাণু বোমা পরীক্ষার তীব্র সমালোচনা করে FAST বিজ্ঞানীদের অনেকেরই মনে হয় যে সমসাময়িক রাজনৈতিক চিন্তাধারা পরিস্থি তির মোকাবিলায় অক্ষম। আইনস্টাইন বলেছিলেন যে প্রথম পরমাণু বোমা কেবল হিরোসিমা শহর নয়, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত প্রাচীন রাজনৈতিক মতাদর্শকেও ধ্বংস করেছে। তিনি এক আন্তর্জাতিক সরকারের কথা বলেন রাষ্ট্রসমূহ যার নিয়ম মানতে বাধ্য থাকবে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে তিনি কিন্তু রাষ্ট্রসঙ্ঘের কথা বলেন নি। আইনস্টাইন ও জিলার্ডের চেষ্টায় তৈরি হয় Emergency Committee of Atom Scientists। প্রথম সভাপতি হন আইনস্টাইন।

সোভিয়েত ইউনিয়নও এরপর পরমাণু অস্ত্র বিস্ফোরণ ঘটায়। এর পরই ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ট্রুম্যান হাইড্রোজেন বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। মার্কিন জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। আইনস্টাইন,জিলার্ড, কম্পটন, বেথে, ফার্সি ও রাবি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন। গণিতবিদ নর্মান উইনার লেখেন যে বিজ্ঞানীর এই গবেষণা তাদের হাতেই ক্ষমতা তুলে দেয় যাদের সে বিশ্বাস করে না। থিওডোর হাউস্কা লেখেন যে বিজ্ঞানীদের খ্যাতি হয়েছে মৃত্যুর দৌতা করার জন্য।

একথা ভাবলে ভুল হবে যে সমস্ত বিজ্ঞানী বিরোধিতার দলে যোগ দিয়েছিলেন। এডওয়ার্ড টেলার বা জন ভন নয়ম্যানের মতো বিজ্ঞানীদের উৎসাহেই হাইড্রোজেন বোমা তৈরির কাজ শুরু হয়। টেলার যে মতে বিশ্বাস করতেন তা পরমাণু অস্ত্রধর রাষ্ট্রের কর্ণধারদের মুখে আজও শোনা যায় -- শান্তির জন্য অস্ত্র। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভন নয়ম্যানের তীব্র কম্যুনিস্ট বিদ্বেষ। অপর এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বিজ্ঞানীদের উপর চাপ। আগেই বলেছি, রাষ্ট্রশক্তি পিছনের দরজা দিয়ে গবেষণার উপর নিয়ন্ত্রণ চালু করেছিল। এসময় মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সর্ববৃহৎ সাহায্যকারী ছিল সামরিক কর্তৃপক্ষ। জীবিকার প্রয়োজনে অনেক বিজ্ঞানীকেই সামরিক কাজে সহায়তা করতে হয় । জেনারেল গ্রোভস এটা আগেই অনুমান করেছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে অধিকাংশ বিজ্ঞানী যারা পরমাণু বোমা বানানোর বিরোধিতা করছেন তাঁরা আবার ফিরে আসবেন। অনেকক্ষেত্রেই তা ঘটেছিল। এমন কি হান্স বেথের মতো বিজ্ঞানীও হাইড্রোজেন বোমা বানানোর কাজে যোগ দিয়েছিলেন যদিও তিনি নিজে বলেছেন যে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন হাইড্রোজেন বোমা বানানো অসম্ভব। ব্রিটেনে পরমাণু অস্ত্র তৈরির বিরোধিতা করার জন্য Atomic Scientists' Association গঠিত হয় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে। অথচ ব্রিটেন যখন পরমাণু বোমা বানানো শুরু করে তখন সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরাই তাকে সমর্থন করেন। অবশেষে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে সংগঠন বন্ধই হয়ে যায়। টেলারের কার্যকলাপ বিশেষভাবে নিন্দার্হ। জে.এফ.স্টোন লিখেছেন মানবজাতি যে ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন তাতে বিজ্ঞানী হিসেবে সবচেয়ে বেশি দায় টেলারের। মারণাস্ত্র প্রতিযোগিতাতে টেলারের দায়িত্ব অপরিসীম। পরমাণু বোমা যেমন গবেষণা থেকে স্বাভাবিক ভাবে উঠে এসেছিল হাইড্রোজেন বোমা কিন্তু তা নয়। হাইড্রোজেন বোমা তৈরির সেই মুহূর্তে কোনো কারণ ছিল না। টেলার যদি রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে হাইড্রোজেন বোমার বিষয়ে ব্যাখ্যা না করতেন, তাহলে হয়ত তা বানানো পেছিয়ে যেত। পরবর্তীকালেও রোনাল্ড রেগানের ব্যর্থ ‘তারকা যুদ্ধ' বা Star Wars-এর উৎসাহদাতা হিসেবে টেলারের বিশেষ ভূমিকা ছিল। বিজ্ঞান জগতের এক দুর্বলতা হল যে সর্বব্যাপী ভীতির সময় কোনো রাজনীতি মনস্ক ও দৃঢ়চেতা বিজ্ঞানী যদি তাঁর সহকর্মীদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে রাজি থাকেন তবে তিনি মানবতা বিরোধী কাজেও বিজ্ঞানকে নিয়োজিত করতে পারেন।

বিজ্ঞানীদের প্রতিবাদ প্রতিরোধ কিন্তু শেষ হয়ে যায় নি। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ও আইনস্টাইন বিভিন্ন দেশের সরকার ও জনগণের কাছে এক যৌথ বিবৃতিতে বিরোধ বিদীর্ণ বিশ্বে হাইড্রোজেন বোমার বিভীষিকা সম্পর্কে সচেতন হতে আহ্বান জানান। বিজ্ঞানীদের কাছে তাঁদের আবেদন ছিল এই বিপদ হ্রাসের জন্য পদক্ষেপের। এটি আইনস্টাইনের শেষ বিবৃতি, স্বাক্ষরদানের দুদিন পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। অন্যান্য স্বাক্ষরদাতারা ছিলেন ম্যাক্স বর্ন, পার্সি ব্রিজম্যান, লিওপোল্ড ইনফেল্ড, ফ্রেডরিক জোলিও কুরি, হেরম্যান মুলার, লিনাস পাউলিং, সিসিল পাওয়েল, হিদেকি ইউকাওয়া এবং জোসেফ রটব্ল্যাট। রাসেলের চেষ্টায় ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে লন্ডনে বিজ্ঞানীদের এক সম্মেলন হয় । এখানে পরমাণু অস্ত্রের ধ্বংস ক্ষমতা, অসামরিক পারমাণবিক গবেষণার ঝুঁকি, নিরস্ত্রীকরণের প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা ও বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব বিষয়ে আলোচনা হয়।

১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে কানাডার নোভা স্কটিয়াতে হয় প্রথম পাগওয়াশ সম্মেলন। যুদ্ধ ও শান্তিতে পরমাণু শক্তির বিপদ, পরমাণু শক্তির উপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের সমস্যা ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব নিয়ে আলোচনার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ ১০টি দেশের ২২ জন বিজ্ঞানী মিলিত হন। এর থেকেই সূচনা হয় এক স্থায়ী সংগঠনের The Pugwash Conferences on Science and World Affairs। দীর্ঘদিন পরে এই সংস্থা ও এর কর্ণধার জোসেফ রটব্ল্যাট যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।

এই নিবন্ধে দেখানোর চেষ্টা করেছি অধিকাংশ বিজ্ঞানী কিভাবে পরবর্তীকালে পরমাণু অস্ত্রের বিরোধিতা করেছেন। প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করা সকলের পক্ষে সম্ভব হয় নি - তাই অনেকের প্রতিবাদ প্রকাশ্যে আসে নি। আবার রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এসে ক্ষমতার স্বাদও অনেককে প্রলুব্ধ করেছিল অস্ত্র তৈরিতে সহায়তা করতে। বোমা বিস্ফোরণের পর বিজ্ঞানীদের সামাজিক সম্মান অনেক বেড়ে যায়। এমন অনেক বিষয়ে তাঁদের মতামত চাওয়া হয় যা তাঁদের জ্ঞানের বাইরে। যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিষয়ে মার্কিন প্রশাসন বিশেষজ্ঞের মত চেয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে। এর ফলে বিজ্ঞানীদের উপর চাপ বেড়ে যায়। পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে বিজ্ঞানীদের ভূমিকার নিন্দা করার আগে একটা কথা যেন আমরা বিস্মৃত না হই। বিজ্ঞানীরা এই বাড়তি সম্মানকে তাঁদের প্রাপ্য বলে মেনে নিয়ে চুপ করে যেতে পারতেন। তা না করে তাঁরা রাজনৈতিক ও সামরিক মহলের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে দেশব্যাপী জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সমাজকে সচেতন করতে চেয়েছেন সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে। রাজনীতিবিদদের উপর তাঁদের আস্থা আমাদের কাছে বোকামি মনে হতে পারে। এ বিষয়ে রুডলফ পিয়ের্লসের একটি মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করব, ‘Perhaps the Scientist who is used to rational arguments makes the mistake of expecting politicians to act ra tionally'


প্রকাশঃ এখন পর্যাবরণ, ডিসেম্বর ২০০৩ ও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০০৪

 















1 comment:

  1. Sir, puro Manhattan project ta tei to Scientists der misuse korechilo kichu politician,Claus Fuchs, jini critical size calculate koren,tar swikarakti anujayi. Ref. BISWASGHATAK by Narayan Sanyal.

    ReplyDelete