Friday, 28 February 2020

তেজস্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ - নিউক্লিয় বিজ্ঞানে নারী ২য় পর্ব

ভবিষ্যতের প্রযুক্তিঃ সমস্যা ও সম্ভাবনা -- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ক্লোনিং ও জিন টেলরিং


ভবিষ্যতের প্রযুক্তিঃ সমস্যা ও সম্ভাবনা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ক্লোনিং ও জিন টেলরিং

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       আধুনিক প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি যেমন নতুন নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে, তেমনি নতুন নতুন সমস্যাও সৃষ্টি করছে। যন্ত্রের উন্নতির পথে জন্ম নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্সমানবদেহের ইঞ্জিনিয়ারিঙের রাস্তা দেখাচ্ছে ক্লোনিং ও জিন টেলরিং। এই লেখাতে আমাদের জীবনে এই দুই ভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
(১)
                                   I am the dark
                                   on
                                   the night
                                   The
                                   past of love
                                   gone stale.

       পাঠককে http://botpoet.com ওয়েবসাইটটা খুলে দেখতে অনুরোধ জানাই। কিছু কবিতা আছে, সেগুলোর কয়েকটা মানুষের লেখা, বাকিগুলো লিখেছে কম্পিউটারপাঠক ইচ্ছা করলে অনুমান করতে পারেন কোনটা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে, ওয়েবসাইট পরে তা ঠিক না ভুল বলে দেবে উপরের কবিতাটার উৎস ৫১ শতাংশ মানুষ সঠিক ভাবে চিহ্নিত করেছেন, ৪৯ শতাংশ পারেননিঅর্থাৎ প্রায় অর্ধেক পাঠক এটা মানুষ না কম্পিউটার, কার লেখা বুঝতে পারেন নি।
       পশ্চিমী ক্লাসিকাল মিউজিক বা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সর্বকালের সেরা স্রষ্টাদের মধ্যে পড়বেন জোহান সেবাস্টিয়ান বাখ। ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ক্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতের অধ্যাপক ডেভিড কোপ ইএমআই (Experiments in Musical Intelligence) নামের একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখেছেন যা প্রথমে বাখ ও পরে অন্যান্য সঙ্গীত রচয়িতাদের স্টাইল আত্মস্থ করে তাদের মতো সঙ্গীত সৃষ্টি করছে। এক অনুষ্ঠানে যখন স্রষ্টার নাম ঘোষণা না করে তার কয়েকটা শোনানো হয়, শ্রোতারা তাকে বাখের সৃষ্টি ভেবে প্রশংসায় ভরিয়ে দেন। সঠিক তথ্যটা জানার পরে অনেকেই রেগে গিয়েছিলেন। ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভ লারসন কোপকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। এক অনুষ্ঠানে বাখ, লারসন ও ইএমআই-এর সৃষ্টি শোনানোর পরে ভোট নেওয়া হয়। ভাবের গভীরতা বিচার করে শ্রোতারা ইএমআই-এর রচনাকে বাখের এবং বাখের রচনাকে লারসনের বলে ভুল করেছিলেনলারসনের সৃষ্টি করা সঙ্গীতকে শ্রোতারা ইএমআই-এর লেখা বলে ধরে নিয়েছিলেন
       ডেভিড কোপ এরপরে আর একটা প্রোগ্রাম লিখেছেন, অ্যানি। অ্যানি যেমন সঙ্গীত রচনা করতে পারে, তেমনি কবিতাও লিখতে পারে। ইএমআই প্রোগ্রামকে কোপের ঠিক করে দেওয়া নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হয়। অ্যানি কিন্তু স্বশিক্ষিত, বাইরের থেকে যা ইনপুট আসে তার উপর নির্ভর করে তার রচনাশৈলী পালটাতে থাকে২০১১ সালে কোপ প্রকাশ করেছেন Comes the Fiery Night: 2000 Haiku by Man and Machine এই দু’হাজার হাইকুর মধ্যে কোনটা মানুষের বা কোনটা যন্ত্রের লেখা বলা নেই, কোপও কাউকে জানান না। ইন্টারনেটে দেখলাম এক সমালোচক লিখেছেন প্রথম পাঁচশোটা হাইকুর মধ্যে তাঁর মতে কোন দুশো একুশটা মানুষের লেখা সেটা তিনি কোপকে জানিয়েছিলেন। কোপ উত্তরে লিখেছেন তাদের মধ্যে মাত্র একুশটা মানুষের লেখা! নিচে সেই বইয়ের একটা হাইকু দেওয়া হল – পাঠককে তার উৎস অনুমান করার আহ্বান জানাই।
                                  The fire crackles loud
                                  In the morning air as I
                                  Wander on the path.
কবিতা বা সঙ্গীতকে সাধারণত আমরা বুদ্ধিমত্তার থেকেও বেশি ইমোশন বা আবেগের সৃষ্টি বলে মনে করি। কোনো কিছুর মধ্যে আবেগ না থাকলে আমরা তাকে যান্ত্রিক বলতে অভ্যস্ত। অধিকাংশ বোদ্ধা যদি যন্ত্র ও মানুষের সৃষ্টিকে পৃথক করতে না পারেন, তাহলে কি যন্ত্রেরও আবেগ আছে বলতে পারি? সেই কথায় আমরা পরে আসছি, কিন্তু সন্দেহ নেই সমস্যাটা বেশ গভীর
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ধীশক্তি অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স এআই’ এই সংক্ষিপ্ত নামেই বেশি পরিচিত, কথাটা সম্ভবত প্রথম শোনা গিয়েছিল ১৯৫৬ সালের এক কনফারেন্সে। সেই আলোচনাচক্রে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই পরবর্তীকালে এই বিষয়ে পথ প্রদর্শকের কাজ করেছেন। আধুনিক যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা বললে অবশ্যই কম্পিউটারের কথা মনে আসে। ১৯৯১ সালে বর্তমান লেখকের প্রথম যে পার্সোনাল কম্পিউটারে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তার র‍্যাম অর্থাৎ র‍্যানডম অ্যাক্সেস মেমরি ছিল ৬৪০ কিলোবাইট, হার্ড ডিস্কের ধারণ ক্ষমতা ৫ মেগাবাইট এবং প্রসেসরের স্পিড ছিল ৫ মেগাহার্জ।  আধুনিক কালের যে কোনো স্মার্ট ফোনের র‍্যাম, হার্ড ডিস্ক বা প্রসেসর কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার গুণ বেশি ক্ষমতা রাখে। দেখা গেছে যে প্রতি আঠারো মাস থেকে দুই বছরের মধ্যে কম্পিউটারের এই সমস্ত ক্ষমতা দ্বিগুণ হয়ে যায়। ১৯৫০-এর দশকে কম্পিউটারের ক্ষমতা কতটা কম ছিল তা সহজেই আন্দাজ করতে পারেন। তাই আজ থেকে ছয় দশক আগে যাঁরা এই বিষয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ দর্শনের ক্ষমতা ভাবলে অবাক হতে হয়। এই দ্রুত ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলেই আপনার স্মার্ট ফোনও কিন্তু এক অর্থে বুদ্ধিমান যন্ত্র। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে কোন যন্ত্রকে বুদ্ধিমান বলব, আর কোনটাকে নয়?
        এখানে দুটো কথাকে আলাদা করে নেওয়া উচিত, বুদ্ধিমত্তা ও চেতনা বা কনসাসনেস। কেউ কেউ মনে করেন যে যন্ত্রকে তখনই বুদ্ধিমান বলা যায় যখন তার চেতনা আছে। অনেকেই আবার একমত নন। এই নিয়ে আলোচনার সমস্যা হল চেতনার যে কোনো সংজ্ঞাই তর্কসাপেক্ষ। জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স অনুমান করেছেন, Perhaps consciousness arises when the brain's simulation of the world becomes so complex that it must include a model of itself অর্থাৎ বাইরের বিশ্ব সম্পর্কে চেতনা শেষ পর্যন্ত নিজের সম্পর্কে চেতনাপ্রশ্ন আসে আমি কি আমার সম্পর্কে সচেতন? বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিক রেনে দেকার্তে ১৬৩৭ সালে লিখেছিলেন, Cogito, ergo sumলাতিন থেকে অনুবাদে, আমি চিন্তা করি, তাই আমার চৈতন্য আছে। পরবর্তীকালে দার্শনিকরা দেকার্তের যুক্তির মধ্যে ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন, কিন্তু চেতনা সম্পর্কে একমত হতে পারেন নি। ক্ষুধা তৃষ্ণা ইত্যাদি বোধ করলেই কি তাকে চেতনাসম্পন্ন বলা যাবে? ১৯৪৮ সালে বিজ্ঞানী গ্রেগ ওয়াল্টার এমন আলোকসংবেদী রোবট বানিয়েছিলেন যে উজ্জ্বল আলোর দিকে যেত। আবার তার ব্যাটারির চার্জ কমে গেলে নিজেই রিচার্জিং স্টেশনের কাছে চলে যেত, একে কি আমরা ক্ষুধা মেটাতে খাবারের উদ্দেশ্যে যাত্রার সঙ্গে তুলনা করব? সেই রোবটের দেহের সঙ্গেই একটা উজ্জ্বল আলো লাগিয়ে তাকে একটা আয়নার সামনে রাখা হল। দেখা গিয়েছিল রোবটটা ছটফট করছে। আমরা কি সেই রোবটকে নিজের সম্পর্কে সচেতন বলব? আমার কম্পিউটার কি নিজের সম্পর্কে সচেতন? এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়, কারণ আমি আমার সম্পর্কে সচেতন কেমন ভাবে প্রমাণ হবে তা নিয়েই পণ্ডিতরা একমত নন। তাই এই লেখাতে আমরা বুদ্ধিমত্তার কথাই আলোচনা করব, চেতনা নিয়ে নয়। আমরা ধরে নেব যে চেতনা ছাড়াও বুদ্ধিমান যন্ত্র সম্ভব।
       কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আলোচনাতেও সমস্যা আছেমানুষ যে বুদ্ধিমান সে নিয়ে নিশ্চয় কেউ দ্বিমত পোষণ করেন না। আপনার কুকুরেরও নিশ্চয় বুদ্ধি আছে, কিন্তু আমরা কি সেই ধরনের বুদ্ধির কথা বলছি? তার বুদ্ধি মাপব কেমন করে? এখানেই আসে চালাক হান্সের কথা। কোনো প্রাণী সাধারণ যোগ বিয়োগ ইত্যাদি করতে পারলে নিশ্চয় তাকে বুদ্ধিমান ধরতে পারিগত শতাব্দীর গোড়ার দিকে জার্মানিতে হান্স বলে এক ঘোড়া ঠিক তাই করতে পারত। তাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হত তিন চারে কত হয়, পা ঠুকে ঠুকে হান্স উত্তর দিত বারো। লিখিত প্রশ্ন করা হল, কুড়ি থেকে নয় বাদ দিলে কত পাব? হান্সের উত্তর এগারো। ছয় বছরের বাচ্চা যে অঙ্ক কষতে পারে, হান্সও তার উত্তর বলে দিতে পারে। শুধু তাই নয়, হান্স জার্মান ভাষা বুঝতে পারে, এমনকি পড়তেও পারে!
চালাক হান্স
       বিষয়টা মানুষের মনে এতই সাড়া জাগিয়েছিল যে সরকার থেকে সে বিষয়ে তদন্ত করার জন্য একটা কমিটি করা হয়। তাঁরা কোনো রকম জালিয়াতি ধরতে পারেন নি। প্রথমেই সন্দেহ করা হয়েছিল হান্সের মালিককে, কিন্তু দেখা গেল তিনি উপস্থিত না থাকলেও হান্স অধিকাংশ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিচ্ছে। তাহলে কি হান্স সত্যিই বুদ্ধিমান? কয়েক বছর পরে এক মনোবিজ্ঞানী দেখেন যে প্রশ্নকর্তা যদি উত্তরটা না জানেন, তাহলে হান্স উত্তর দিতে পারছে না। ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারেন যে হান্স পা ঠুকতে শুরু করার সময় প্রশ্নকর্তার দিকে লক্ষ্য রাখছে। সে যখন উত্তরটার খুব কাছে চলে আসছে তখন প্রশ্নকর্তার চেহারায় উত্তেজনার ছাপ পড়ছে। সঠিক উত্তর আসার পরেই তা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছচ্ছে এবং তার চরিত্র পালটাচ্ছে। হান্স তখন পা ঠোকা থামিয়ে দিচ্ছে। হান্স, জার্মান ভাষা নয়, প্রশ্নকর্তার দেহের ভাষা পড়ছে।
       দেহের ভাষা আমরাও কিছুটা পড়তে পারি, অন্যের রাগ দুঃখ আনন্দ সে না বললেও টের পাই।   কিন্তু হান্সের মতো উত্তর দেওয়া আমাদের সাধ্যাতীত। যেদিন থেকে মানুষ কথা বলে ভাব বিনিময় করতে পেরেছে, সেদিন থেকেই দেহের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আমাদের ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছেমনুষ্যেতর অনেক প্রাণী ভাব বিনিময়ের জন্য সেই ভাষার উপরেই নির্ভর করে, তাই তাদের এই  বিষয়ে উপলব্ধি অনেক সূক্ষ্ম। হান্সের ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য এই যে শুধু অন্য ঘোড়া নয়, সে এমনকি অচেনা মানুষের দেহের ভাষাও পড়তে পারছে। যাঁরা কুকুর পোষেন, তাঁরা হয়তো খেয়াল করেছেন যে অনেক সময় কিছু বলার আগেই, এমনকি সচেতনভাবে ভাবার আগেই, কুকুর তাঁদের মনের ভাব বুঝতে পারে। এই সব প্রাণীরা পৃথিবীকে অন্য ভাবে চেনে, তাদের ইন্দ্রিয় আমাদের থেকে অনেক আলাদা। যেমন কুকুরের কাছে বাইরের বিশ্বের অস্তিত্বের একটা বড় অংশ হল তার গন্ধ। ডলফিন বা শিম্পাঞ্জি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অনেকেরই মতে আমরা যে পদ্ধতিতে তাদের বুদ্ধিমত্তা মাপি, তা মানুষের জন্য ঠিক হতে পারে, কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে অচল। শিম্পাঞ্জি, ডলফিন, কুকুর বা ঘোড়া – বিবর্তনের পথে এরা কেউই আমাদের খুব দূরের আত্মীয় নয়। মানুষ ও শিম্পাঞ্জির কোষের সক্রিয় জিনের মধ্যে মিল প্রায় ৯৯ শতাংশ! রক্তমাংসের প্রাণী, যাদের সঙ্গে আমাদের অনেক মিল তাদের বুদ্ধিমত্তা মাপতেই যদি এত সমস্যা হয়, তাহলে সিলিকন তামা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি যন্ত্রের বুদ্ধি আমরা কেমন করে  মাপব? শুধু বুদ্ধি নয়, মনস্তত্ত্বের কথাও ভাবতে হবে -- সে কথায় আমরা ফিরে আসব।
       সিলিকন তামার কথা বললাম বটে, কিন্তু সমস্যাটা আরো জটিল। বুদ্ধিমান কে, যন্ত্র না যন্ত্রের প্রোগ্রাম? পাঠকদের অনেকেরই নিশ্চয় ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট আছে, নিয়মিত বা অনিয়মিত ভাবে ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট দেখেন, পছন্দ মতো লাইক দেন। কয়েক বছর আগে ফেসবুক ৮৬২২০ জন মানুষের উপর এক সমীক্ষা চালায়। বিভিন্ন বিষয়ে মতামত জানতে চেয়ে তাঁদের একশোটা প্রশ্ন করা হয়েছিল। তাঁরা ফেসবুকে নানারকম পোস্টে যে লাইক মারেন তার উপর ভিত্তি করে তাঁদের মতামত কী হবে তা ভবিষ্যৎবাণী করার জন্য একটা অ্যালগরিদম তৈরি করা হয়েছিল। আবার জনৈক ব্যক্তি কোন উত্তরটা বেছে নেবেন, তা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তাঁর সহকর্মীদের, বন্ধুদের, পরিবারের লোকদের। এবার আসল উত্তরগুলোর সঙ্গে পরিচিতদের মত ও অ্যালগরিদমের ভবিষ্যৎবাণী মিলিয়ে দেখা হল। দেখা গেল উত্তরকর্তা কোন দশটা পোস্টে লাইক দিয়েছেন তা দেখেই অ্যালগরিদম তাঁর উত্তর তাঁর সহকর্মীদের থেকে ভালো মিলিয়ে দিতে পারছে। বন্ধুদের থেকে ভালো ভবিষ্যৎবাণী করতে গেলে অ্যালগরিদমের মাত্র সত্তরটা লাইক দেয়া পোস্ট সম্পর্কে জানার প্রয়োজন হচ্ছে। পরিবারের অন্যদের থেকে ভালো মেলাতে লাগছে দেড়শো লাইক। এমনকি তিনশোটা লাইক বিচার করে উত্তরদাতার স্বামী বা স্ত্রীর থেকেও অ্যালগরিদম তাঁর উত্তর বেশি মিলিয়ে দিতে পারছে। এই অ্যালগরিদমকে বুদ্ধিমান বলতে নিশ্চয় আপত্তি হবে না। এ কিন্তু কোনো বিশেষ যন্ত্রের মধ্যে আবদ্ধ নেই, একদিক থেকে বললে ইন্টারনেটের মাধ্যমে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। একে বলা হয় ডিস্ট্রিবিউটেড আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স। আমাদের অভিজ্ঞতার বুদ্ধিমান প্রাণী একটি দেহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই বুদ্ধিমান যন্ত্র বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রসঙ্গে আলোচনাতে সবসময়েই বিতর্কের অবকাশ আছে। সেই কথা মাথায় রেখেই এগোনো যাক।
       (এই লেখায় ব্যবহৃত কয়েকটা শব্দের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা এখানেই দেখে নেয়া যাকঅ্যালগরিদম হল কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য অনুসরণ করা সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি যা ধাপে ধাপে ব্যবহারের মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানো যায়। যেমন ধরুন, কোনো পূর্ণসংখ্যা মৌলিক কিনা তা জানার একটা অ্যালগরিদম হতে পারে দুই থেকে শুরু করে তিন, চার এভাবে পরপর পূর্ণসংখ্যা দিয়ে সেই সংখ্যাটিকে ভাগ দিয়ে ভাগশেষকে পরীক্ষা করা। যদি ওই সংখ্যার থেকে ছোটো কোনো একটি পূর্ণসংখ্যা দিয়ে তাকে ভাগ করলে ভাগশেষ শূন্য হয় তাহলে সংখ্যাটি মৌলিক নয়। এটা অবশ্য খুব ভালো অ্যালগরিদম নয়, একে আরো ভালো করার অনেক সুযোগ আছে। কম্পিউটার প্রোগ্রাম হল কম্পিউটারকে দেয়া নির্দিষ্ট নির্দেশ যা অনুসরণ করে কম্পিউটার কোনো সমস্যার সমাধান করে। উপরের অ্যালগরিদমকে কম্পিউটারের ভাষায় লিখলে যেটা পাব তা হল প্রোগ্রাম। কম্পিউটারের নানা ভাষা আছে, যেমন C++, জাভা, পাইথন ইত্যাদি এই ভাষাগুলোকে বলে হাই লেভেল। কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার যে ভাষা পড়ে তার নাম মেশিন লেভেল, হাই লেভেল থেকে মেশিন লেভেলে অনুবাদ করে হার্ডওয়্যারকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।)
(২)
       তবে এগোনোর জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটা কাজ চালানোর মতো সংজ্ঞা আমাদের অবশ্যই প্রয়োজন। এই লেখাতে আমরা ধরে নিতে পারি যে বুদ্ধিমত্তা হল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ও দূরদৃষ্টি সহকারে করা আচরণ। সেই আচরণ যখন কোনো যন্ত্রের মধ্যে দেখা যায়, তাকে আমরা কৃত্রিমভাবে বুদ্ধিমান বলতে পারি। এই পরিবেশ ও দূরদৃষ্টি কথা দুটো একটু ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করা যাক। সচেতনভাবে প্রথম যে সমস্ত আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স করা তৈরি হয়েছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হল দাবা খেলার অ্যালগরিদম কোনো ভালো দাবা খেলোয়াড় যে কোনো পরিস্থিতিতে পরের বেশ কয়েকটি সম্ভাবনা সম্পর্কে জানেন বা খেয়াল রাখেন দাবা খেলা বেশ জটিল, বিভিন্ন ঘুঁটি বিভিন্ন ঘরে রেখে কতরকম ভাবে সাজানো যায়? সংখ্যাটা বিশাল, লিখতে গেলে একের পিঠে ছেচল্লিশটা শূন্য দিতে হবে কোনো কম্পিউটারের পক্ষেই এত তথ্য মেমরিতে রাখা বা খুঁজে বার করা সম্ভব নয় তাই প্রোগ্রাম দাবা বোর্ডের যে কোনো অবস্থান থেকে পরের কয়েক ধাপে কী কী দান দেওয়া সম্ভব সেটাকে হিসাব করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ হল দাবা বোর্ডে ঘুঁটিগুলির অবস্থান, দূরদৃষ্টি হল ভবিষ্যতের দানের হিসাব। ঠিক তেমনি চালক বিহীন গাড়ির পরিবেশ হল রাস্তা ও তার আশেপাশের গাড়িগুলি, এবং দূরদৃষ্টি হল নিরাপদ ভাবে গন্তব্যে পৌঁছানোর পথ অনুসন্ধান।
       দাবার উদাহরণটা আরো একটু আলোচনা করে আমরা এআই কত তাড়াতাড়ি বিকশিত হচ্ছে তা বুঝে নিইকম্পিউটারের যখন শৈশব, তখন তার মেমরি ও প্রসেসিং স্পিড ছিল খুবই কম। তাই তখন প্রোগ্রাম দুই তিন চালের বেশি ভবিষ্যৎ গণনা করতে পারত না। প্রোগ্রামগুলির  ছিল খুবই সরল, সাধারণ খেলোয়াড়ও তাকে হারিয়ে দিত। খেলোয়াড়ের সঙ্গে প্রোগ্রামের তফাত ছিল, খেলোয়াড় জানেন কোন কোন চাল গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা অর্থহীন। যে চাল দিলে সঙ্গে সঙ্গেই রাজা খোয়া যাবে তা তাঁর চিন্তাতেও আসবে না। কম্পিউটার কিন্তু সমস্ত চাল এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্ভাব্য সমস্ত উত্তর, সবই বিচার করত। হার্ডওয়্যারের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটারের ক্ষমতাও বাড়ল। গ্র্যান্ড মাস্টাররা সেকেন্ডে মোটামুটি তিনটে চাল হিসাব করতে পারেন। আইবিএম-এর ডিপ ব্লু নামের সুপারকম্পিউটার এক সেকেন্ডে কুড়ি কোটি চালের হিসাব করে। তার সঙ্গে যোগ হল অ্যালগরিদমের বিকাশ। সেরা খেলোয়াড়দের কৌশল অ্যালগরিদমের ভিতরে ঢোকানো সম্ভব হল। ফলে অর্থহীন পথের হিসাব কষা অনেকটা কমানো গেল। সব শেষে যোগ হল নিজের ভুল থেকে শেখা; অ্যালগরিদম কোনো ভুল একবারের বেশি করবে না। এর ফলে দ্রুত উন্নতি ঘটল। প্রথম কোনো কম্পিউটার দাবাতে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার রেটিং পায় ১৯৮১ সালে। পনের বছরের মধ্যে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভ ডিপ ব্লু-এর কাছে পরাজিত হন। ২০০৫ সালের পর দাবাতে কম্পিউটারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কোনো মানুষের কাছে পরাস্ত হয়নি। দাবাখেলার ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেটিং হল ২৮৮২, দাবাতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেন ২০১৪ সালে এই মাত্রায় পৌঁছেছিলেন। বর্তমান কম্পিউটার চ্যাম্পিয়ন স্টকফিশের রেটিং হল ৩৩৯৪। স্টকফিশ কিন্তু কোনো বিশেষ কম্পিউটার নয়, অ্যালগরিদমবিনা পয়সায় ডাউনলোড করে আপনার ল্যাপটপেই তার সীমিত রূপ চালানো সম্ভব। ভবিষ্যতে কোনোদিনই আর সেরা কম্পিউটারদের কাউকে মানুষ হারাতে পারবে না, তাই সেরা দাবার প্রোগ্রামরা নিজেদের মধ্যেই এখন টুর্নামেন্ট খেলে
       কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত উন্নতি ঘটছে। আমাদের মস্তিষ্ক কেমনভাবে কাজ করে, এআই নিয়ে গবেষণা তা বুঝতে সাহায্য করছে। মনোবিদ্যা বা সাইকোলজিকে সে সমৃদ্ধ করছে। সেই বিষয়ে আলোচনা বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ট্রেনিং, মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং, নিউরাল নেটওয়ার্ক বা এই রকম আধুনিক গবেষণাও এই প্রবন্ধের আওতার বাইরে আমরা শুধু এআই কত ভাবে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করছে বা ভবিষ্যতে করতে পারে তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়, উইক বা দুর্বল ও স্ট্রং অর্থাৎ শক্তিশালী। যে সমস্ত এআই এক ধরনের কাজই করতে পারে, তাদের বলা হয় দুর্বল এআই। এর উদাহরণ বহু জায়গায় ছড়িয়ে আছে। দাবার প্রোগ্রাম যেমন দুর্বল এআই। শক্তিশালী এআই এখনো কল্পনার বস্তু, তাদের কথায় আমরা পরে আসব। আমাদের দেশে এআই-এর প্রয়োগ এখনো পর্যন্ত খুব বেশি না হলেও পশ্চিমী দেশে তাকে নানা জায়গায় পাওয়া যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চিনতে অসুবিধার একটা কারণ হল যে চালু হওয়ার পরেই সে অন্য নামে পরিচিত হয়ে যায়। ইন্টারনেটে কোনো কিছু খোঁজার সময়ে আমরা কজন খেয়াল রাখি যে সেই সার্চ ইঞ্জিনের চালিকাশক্তি হল এআই? এআই বহুভাবে আমাদের জীবনকে পাল্টে দিচ্ছে, এই প্রবন্ধে তার এক ক্ষুদ্র অংশও আলোচনা সম্ভব নয়। কয়েকটা মাত্র উদাহরণ দেখা যাক।
       প্রথমেই আসে পরিবহনের কথা। গাড়িতে বিভিন্ন রকমের সেন্সরের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে এবং ড্রাইভারকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে কম। সিট-বেল্ট না লাগালে, গতির সীমা অতিক্রম করে গেলে, বা এইরকম আরো অনেক ক্ষেত্রে গাড়ি চালককে সাবধান করে দিচ্ছে। জিপিএস রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছে এবং কোন রাস্তায় এই মুহূর্তে ভিড় কম, তা বলে দিচ্ছে। সেন্সরের মাধ্যমে গাড়ির কম্পিউটার ইঞ্জিনকে সবচেয়ে ভালোভাবে চালানোর জন্য সেখানে প্রতি সেকেন্ডে কতটা হাওয়া বা কতটা তেল ঢুকবে, অক্সিজেন পোড়ানোর হার কত তা নিয়ন্ত্রণ করছে বা ধাক্কা লাগলে মুহূর্তে এয়ার ব্যাগ খুলে দিচ্ছে। এগুলো যে গাড়িতে আছে, তাকে আমরা বলি স্মার্ট কার। এর পরের ধাপ হল চালকবিহীন গাড়ি যা নিয়ন্ত্রণ করবে এ আই। ২০০০ সালেও এমন গাড়ি ছিল স্বপ্ন, কিন্তু ২০১২ সাল থেকে এই রকম গাড়ি রাস্তায় দেখা গেল। টেসলা বা গুগলের চালকবিহীন গাড়ির কথা হয়তো অনেকেই শুনেছেন। অনেক জায়গায় এই গাড়ি এখন আইনি, অন্য অনেক দেশ আইন সংশোধন করে এদের অনুমতি দেওয়ার পথে। অনুমান করা হচ্ছে যে ২০২০ সাল নাগাদ রাস্তায় এই রকম গাড়ির সংখ্যা এক কোটিতে পৌঁছাবে। এ ধরনের গাড়ি কতটা নিরাপদ? মনে রাখতে হবে কম্পিউটার কখনো ক্লান্ত বা বিরক্ত হয় না, তার বিরুদ্ধে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর অভিযোগ আনা যাবে না, এবং যে কোনো মানুষের থেকে সে কয়েক লক্ষ গুণ দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। এখনো পর্যন্ত চালকবিহীন গাড়ির এআই-এর দোষে সারা পৃথিবীতে দুর্ঘটনার সংখ্যা মাত্র পাঁচ, এবং এদের কোনোটাতেই সর্বোচ্চ মানের এআই ছিল না। গাড়ির সংখ্যা নিশ্চয় কম, কিন্তু সাত বছরে সারা পৃথিবীতে পাঁচটি মাত্র দুর্ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে এই রকম গাড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী। এর পর আসে চালকবিহীন ট্রাক, বাস, ট্রেন ইত্যাদির কথা। বেশ কিছু শহরে ড্রাইভার বিহীন মেট্রো চালানো হচ্ছে। বিদেশে ড্রোনের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি জিনিস ডেলিভারি চালু হচ্ছে শুধু রাস্তাতে গাড়ি চালানোর মধ্যেই এআই সীমাবদ্ধ নয়। উবেরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে সারা পৃথিবীতে তিরিশ লক্ষ ড্রাইভার উবেরের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সবাইকে চব্বিশ ঘণ্টা নির্দেশ দেওয়ার জন্য মানুষের উপর নির্ভর করতে গেলে কতজন কর্মী লাগত? আমি গাড়ি বুক করার সময় এআই ঠিক করে দিচ্ছে কোন গাড়ি আমার কাছে আসবে, গাড়ি এই মুহূর্তে কোথায় আছে, যেতে কতক্ষণ লাগবে, রাস্তায় জ্যাম আছে কিনা, কোন পথ সে ধরবে, ভাড়া কত, এরকম নানা খবর। একই সঙ্গে আরো হাজার হাজার যাত্রীর জন্যেও সে একই কাজ করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতির ফলেই এই ধরনের অ্যাপ-নির্ভর ট্যাক্সি চালানো সম্ভব হয়েছে।
       এআই নির্ভর পরিবহন ব্যবস্থা আমাদের সমাজকে পাল্টে দিতে পারে। আমেরিকার মতো দেশে, যেখানে প্রায় সকলেই ব্যক্তিগত গাড়ির উপর নির্ভরশীল, সেখানে এই রকম গাড়ির সুযোগে শহর থেকে দূরে থাকার প্রবণতা বাড়বে, প্রধান শহরগুলির উপর থেকে জনসংখ্যার চাপ কমবে। ব্যক্তিগত গাড়ির তুলনায় চালকবিহীন ট্যাক্সির উপর নির্ভরতা বাড়বে। পক্ষান্তরে পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে বিরাট সংখ্যার মানুষ যুক্ত আছেন, তাঁদের কাজ হারানোর আশঙ্কার কথাও স্মরণে রাখতে হবে।
       দ্বিতীয় যে জায়গায় এ আই-এর কথা আমরা আসতে পারি, তা হল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাআমি যখন ডাক্তারের কাছে যাই, তিনি আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করেন ও হৃৎস্পন্দন রক্তচাপের মতো কয়েকটা সাধারণ নির্দেশক মাপেন। এর থেকে আমার রোগ সম্পর্কে অনুমান করেন, এবং অনেক সময় আরো পরীক্ষানিরীক্ষার কথা বলেন। সেই পরীক্ষাগুলির ফলাফল জানার পরে রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় এবং চিকিৎসা শুরু হয়ডাক্তার আমাকে কয়েকটির বেশি প্রশ্ন করতে পারেন না, অন্য রুগীদেরও দেখতে হবে তাঁকেআমাকে যখন ডাক্তারবাবু আগেকার রোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, আমি হয়তো সবগুলো মনে করতে পারলাম না। কোনো ডাক্তারের পক্ষেই সমস্ত রোগ ও তার চিকিৎসা মনে রাখা সম্ভব নয়। এইখানে চলে আসবে এ আই। সে আমাকে অনেক বেশি প্রশ্ন করতে পারে, কারণ এক সঙ্গে কয়েক লক্ষ রোগীর সঙ্গে সে কথা চালাতে পারে। আমিও আরামে ঘরে বসে তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি। আমার মোবাইল ফোন থেকেই সে আমার শরীরের সাধারণ নির্দেশকগুলো দেখে নিতে পারবে। তার তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণ করে সে আমাকে কিছু পরীক্ষা করার নির্দেশ দিল। যে কোনো পরীক্ষার রিপোর্ট সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে চলে যাবে, তা ছাড়াও তার কাছে আমার পুরানো সমস্ত রিপোর্ট আছে। সে ডাক্তারদের জানা সমস্ত রোগ ও তার চিকিৎসা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, নতুন যে কোনো গবেষণার খবর সে রাখে। সে শুধু আমার নয়, আমার নিকটাত্মীয়দের স্বাস্থ্য সম্পর্কে খবর রাখে, জেনেটিক কারণে রোগের সম্ভাবনা মাথায় রাখে। আমি এমন কোনো জায়গায় গিয়েছিলাম কিনা যেখানে কোনো বিশেষ রোগের সম্ভাবনা আছে, তাও সে জানে। সে কখনো ক্লান্ত হবে না, কোনো তথ্য ভুলে যাবে না।  রোগ নির্ধারণ ও তার চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে তার মতামত সাধারণ ডাক্তারের থেকে পিছিয়ে থাকবে না। একটা উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক। ক্যান্সারের চিকিৎসায় আইবিএম-এর ওয়াটসন সুপারকম্পিউটার এক পরিচিত নাম। বিভিন্ন রকম বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞদের মতে ক্যান্সার চিকিৎসায় যুগান্তর আনতে পারে ওয়াটসনের মতো এআই। একটি বিশেষ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল অ্যালগরিদম ফুসফুসের ক্যান্সার নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে সঠিক ভাবে চিহ্নিত করছে যেখানে মানুষ ডাক্তারদের সাফল্যের হার পঞ্চাশ শতাংশ।
       অন্যান্য অনেক ভাবে  কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতে কাজে আসবে। আমার এক ডাক্তার বন্ধু এমন একটা মোবাইল অ্যাপ তৈরির কাজ করছে যেটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে ডাক্তার নেই, সেখানে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে রোগ নির্ধারণের প্রাথমিক কাজ করতে পারবে এবং কোন ধরনের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে তাকে যেতে হবে সে বিষয়ে পরামর্শ দেবে। অর্থাৎ জেনারেল প্র্যাকটিশনারের জায়গা নেবে এ আই। অন্য একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। পৃথিবীতে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, তাঁদের খেয়াল রাখা সারা পৃথিবীতেই একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এআই-নির্ভর অ্যাপ নিয়মিত তাঁদের স্বাস্থ্য মনিটরিং করতে পারবে, প্রয়োজনে ডাক্তার ডাকতে পারবে, হসপিটালে খবর দিয়ে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারবে।
       তৃতীয় আর এক জায়গার কথা ধরা যাক, রোবটিক্স। গল্প সিনেমা ইত্যাদির কল্যাণে আমরা সাধারণত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে রোবটের কথা ভাবতেই অভ্যস্ত। চালকবিহীন গাড়ি বা ড্রোনও এক অর্থে রোবট তেজস্ক্রিয় চুল্লিতে বা খনিগর্ভের মতো বিপজ্জনক জায়গায় রোবট যে কাজ করতে পারে সেটা বোঝা শক্ত নয়কিন্তু চাষবাস বা ঘরের কাজের মতো অনেক সাধারণ কাজও করতে পারে এআই পরিচালিত রোবট। স্মার্ট ভ্যাকুয়াম ক্লিনার বা রোবোভ্যাক ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে, আমাদের দেশে তার দাম কুড়িহাজার টাকার আশেপাশে। ডাক্তারিতে সহায়ক হিসাবে রোবট কাজ করছে, যে ভাবে বিভিন্ন পরীক্ষা বা সার্জারির সময় যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে, হয়তো অচিরেই আমরা রোবট সার্জনকেও দেখতে পাব। সেন্সরের অগ্রগতির ফলে রোবটের যে কোনো পরিবেশে চলাফেরার সমস্যা সমাধান করা গেছে – রোবোভ্যাক সবচেয়ে বুদ্ধির যে কাজ করে তা হল সে সিঁড়ি এড়িয়ে চলে, গড়িয়ে পড়ে যায় না।  বিভিন্ন কারণে রোবট এখনো অন্য অনেক এআই-নির্ভর ক্ষেত্রের থেকে কিছুটা পিছিয়ে। তবে সুযোগ আছে অনন্ত। ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তির দুর্ঘটনাতে হাত কাটা গেলসেই জায়গায় এআই-নির্ভর রোবোটিক অঙ্গ লাগানো সম্ভব হল। রক্তমাংসের হাতের থেকেও এই রোবট হাত বেশি কাজ করবেএকই সঙ্গে হাত থেকে যে সমস্ত অনুভূতি মস্তিষ্কে আসত, সেন্সর তার সবগুলিই মস্তিষ্কে আবার পাঠাবে। মানুষ ও মেশিনের মধ্যে এই ধরনের যোগাযোগ ও নিয়ন্ত্রণ স্থাপন সাইবারনেটিকস প্রযুক্তির একটা লক্ষ্য। সিনেমার দৌলতে সাইবর্গ কথাটার সঙ্গে অনেকেই পরিচিত, সে হল মানুষ ও রোবটের মিলিত রূপরোবট হাত যদি একদিন রক্তমাংসের হাতের থেকে বেশি কর্মক্ষম হয় ও একই রকম অনুভূতির সৃষ্টি করে, তাহলে অস্ত্রোপচার করে হাতটা পালটে নিতে অনেকেরই হয়তো আপত্তি হবে না।
       এইরকম আরো অসংখ্য ক্ষেত্রের কথা বলা যেতে পারে। শিক্ষাক্ষেত্রে এআই-এর প্রবেশ এখনো সীমাবদ্ধ, তার কারণ খরচ। তবে এখানেও আস্তে আস্তে জায়গা করে নিচ্ছে সে সাধারণভাবে সামরিক ক্ষেত্রে অর্থবরাদ্দ বেশি, সেখানে এআই-এর ব্যবহার ক্রমশই বাড়ছেতবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার আলোচনা প্রকাশ্যে আসে না। বিনোদন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রের কথা নিশ্চয় আলাদা করে বলতে হবে বা। ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ তো বটেই, গোটা ইন্টারনেটই এআই-এর উপর নির্ভর করে। আপনি যখন গুগল বা অন‍্য কোনো সার্চ ইঞ্জিনকে কোনো কিছু খুঁজতে বলেন, সাধারণত দেখবেন প্রথম কয়েকটা আইটেমের মধ্যেই আপনার প্রয়োজনীয়টি লিঙ্কটিকে আপনি পেয়ে যান। সার্চ ইঞ্জিনের এআই সেই কাজ করে। আপনার কম্পিউটারের ভৌগোলিক অবস্থান, পুরানো সার্চের ইতিহাস, কী ধরনের ওয়েবসাইট আগে দেখেছেন, এই রকম নানা খবর বিচার করে সবচেয়ে সম্ভাব্য আইটেমদের সামনে নিয়ে আসে। মাইক্রোসফটের কর্টানা, অ্যাপলের সিরি বা আমাজনের আলেক্সার মতো ভারচুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম আপনার মোবাইল বা কম্পিউটারে বসে থেকে আপনার দৈনন্দিন জীবনের নানা কাজকে সহজ করে দিচ্ছে। আপনি কিবোর্ডে বা মাউসে নয়, কথা বলে এদের নির্দেশ দিচ্ছেন – এআই সেই কথাকে কম্পিউটারের ভাষাতে পরিবর্তন করছে কম্পিউটার বা মোবাইল সেই নির্দেশ পালন করছেবুঝতেই পারছেন এই কাজটা যদি করতে পারে, এক ভাষা থেকে অন্য ভাষাতে সার্থক অনুবাদের কাজও এআই সহজে করতে পারবে।
       সবই যে অবিমিশ্র ভালো হবে তা বলতে পারি না। সোশ্যাল মিডিয়াতে বা বৃহত্তর সমাজে আপনার ভূমিকা বিশ্লেষণ করে এ আই শুধুমাত্র আপনার জন্য কোন ধরনের বিজ্ঞাপন, টেলিমার্কেটিং বা রাজনৈতিক প্রচার ফলপ্রসূ হবে তা বলে দেবে এবং বিভিন্ন ভাবে আপনার উদ্দেশ্যেই তা পাঠিয়ে দেবেমার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ও ব্রেক্সিটের গণভোটে কয়েক কোটি ফেসবুক প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে প্রচার চালানো হয়েছিল। রাষ্ট্র বা অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থা এতদিন যদি সবার টেলিফোন মেলামেশা চিঠিপত্র বা মেল ইত্যাদি রেকর্ডও করত, ঐ বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ ছিল মানুষের সাধ্যাতীত। এখন এআই সেই কাজটা সহজেই করে দিতে পারে। ফলে অরওয়েলের নাইনটিন এইটি ফোর হয়তো বাস্তবে দেখা দেবে। গুগল সার্চে ঠাণ্ডা লাগা, মাথা ধরা, জ্বর ইত্যাদি কতবার খোঁজা হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে গুগল ফ্লু ট্রেন্ডস অ্যালগরিদম ব্রিটেনের জাতীয় হেলথ সার্ভিসের দশদিন আগে ফ্লু এপিডেমিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে কিনা বলতে পারে। এই প্রয়োগ নিশ্চয় ভালো, কিন্তু একই ভাবে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দানা বাঁধছে কিনা তা আগাম অনুমান করা সম্ভব। সরকার সবসময়েই এধরনের সংবাদে উৎসাহী হবে। বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানি তার ব্যবসার জন্য অন্য ধরনের খবর হয়তো নিতে চাইবে। গুগলের বক্তব্য যে তারা ব্যক্তিগত ই-মেল পড়ে না; কিন্তু খুব সম্প্রতি দেখলাম মাইক্রোসফট স্বীকার করেছে যে তার সহযোগীরা স্কাইপে ও কর্টানাতে করা ব্যক্তিগত কথোপকথনে আড়ি পেতেছে। ব্যক্তিগত জীবনে এআই-এর মাধ্যমে এই অনুপ্রবেশ নিশ্চয় বাঞ্ছনীয় নয়।


My wife asked me why I was speaking so softly at home.
 I told her I was afraid Mark Zuckerberg was listening!
She laughed. I laughed.
Alexa laughed. Siri laughed.
 








সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া একটি পোস্ট, এ কি বাস্তব হওয়ার পথে?

       এআই ব্যবহারের বড় কারণগুলো হল দ্রুত চিন্তা করার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণের সামর্থ্য এবং ফোকাস বা মনঃসংযোগধরুন যুদ্ধক্ষেত্রে দুটি ড্রোন প্লেন একে অপরকে ধ্বংস করতে উদ্যত। একটি এআই পরিচালিত, অন্যটি নিয়ন্ত্রণ করছে একজন মানুষ। নিশ্চিন্তভাবে বলা যায় যে দ্বিতীয়টি ধ্বংস হবেই, কারণ এআই মানুষের থেকে কয়েক লক্ষ গুণ দ্রুত চিন্তা করতে বা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই যে কোনো সামরিক কর্তৃপক্ষ যেখানেই সম্ভব সেখানেই এআই ব্যবহার করবে। তা না হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান ট্যাঙ্কের সামনে পোল্যান্ডের ঘোড়সওয়ার বাহিনীর যা পরিণতি হয়েছিল তাই হবে। বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আরো একটা জায়গা হল স্টক মার্কেট। অ্যালগরিদম চালিত স্টক ট্রেডিং এক সেকেন্ডে যে পরিমাণ তথ্য পড়তে পারে, কোনো মানুষ এক বছরেও তা পারবে না। মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তাই বড়ো ট্রেডিং কোম্পানিরা এআই-এর উপরেই নির্ভর করে। এই যুগ হল তথ্যের যুগ, বিপুল পরিমাণ তথ্য প্রতি মুহূর্তে সঞ্চিত হচ্ছে ইন্টারনেটে, কিন্তু তার কোনো নির্দিষ্ট ফরম্যাট নেই। এই পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ এআই-এর পক্ষেই সম্ভব। ফোকাসের সুবিধাও বুঝতে অসুবিধা নেই। আমাদের পক্ষে একটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে কতক্ষণ চিন্তা করা সম্ভব? এআই-এর ক্ষেত্রে কোনো সীমা নেই -- সে বিরক্ত হয় না, অন্য বিষয়ে চিন্তা করে না, ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ক্লান্তি তার নেই। ডিপ ব্লু বছরের পর বছর শুধুমাত্র দাবার চাল নিয়েই চিন্তা করে যেতে পারে, কাসপারভের পক্ষে তা সম্ভব নয়।
       বিভিন্ন জায়গায় এআই-এর প্রবেশ দ্রুত হারে বাড়ছে কেন? অর্থনৈতিক সুবিধা একটা মুখ্য কারণ, আগের আলোচিত যুক্তিগুলিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাদের বাইরেও একটা কথা মনে রাখতে হবে। দুটি কারণে এআই ব্যবহারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সমস্ত পেশাই বিশেষজ্ঞদের দখলে চলে যাচ্ছে। এখানে বিশেষজ্ঞ বলতে কিন্তু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের মতো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীদের কথাই শুধু বলছি না। ইলেকট্রিশিয়ান, কলের মিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি – এঁরাও বিশেষজ্ঞ। প্রত্যেক পেশার জ্ঞানভাণ্ডার এতই বিস্তৃত হয়ে পড়ছে যে কোনো এক ব্যক্তির পক্ষে তাঁর নিজস্ব বৃত্তের বাইরে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। দ্বিতীয়ত, একই সঙ্গে যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে যন্ত্রনির্ভরতা বাড়ছে। ডাক্তার আজ আর নাড়ি টিপে ওষুধ দেন নাতিনি বিভিন্ন পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে চান, তার প্রায় সবগুলিই যন্ত্রনির্ভর। বিভিন্ন সেন্সরের উপর ড্রাইভারের নির্ভরতা ক্রমবর্ধমান। শপিং মলে বিল করার সময় লেবেল যত্ন করে পড়ার দরকার হয় না, বারকোড রিডার সেই কাজটা করে দেয়। অনেক মলে তো বিলের জায়গায় কোনো মানুষই থাকে না, ক্রেতাকে নিজেকেই যন্ত্রে বিল করিয়ে কার্ডে দাম মেটাতে হয়। এই সমস্ত যন্ত্র থেকে যে উত্তর বা সঙ্কেত আসে, কম্পিউটারের পক্ষে তাকে বিশ্লেষণ করা সহজ। এই দুই কারণে এই বিশেষজ্ঞ পেশাগুলিতে প্রবেশ এআই-এর পক্ষে সহজ হয়ে পড়েছে
       দুর্বল এ আই কখনোই মানুষের সঙ্গে তুলনীয় নয়। যে কোনো মানুষের যতরকম ক্ষমতা আছে, সে তার এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও করতে পারবে না। যে ড্রাইভার ট্যাক্সি চালান, তিনিই হয়তো অবসর সময়ে দাবা খেলেন বা কবিতা লেখেন, সন্তানকে পড়ান, জ্বর হলে থার্মোমিটার দিয়ে দেহের তাপমাত্রা মাপেন, রান্না করেনআমরা দেখেছি যে এর প্রত্যেকটা কাজ আলাদা আলাদা এআই-এর পক্ষে করা সম্ভব,  কিন্তু দুর্বল এআই এর যে কোনো একটাই পারে। কিন্তু একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছে আধুনিক সমাজের চাহিদা হল যে সে যাত্রীকে নিরাপদ ভাবে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে, সে কবিতা লিখতে পারে কিনা তা অবান্তর। তাই দুর্বল এআই একমুখী হলেও এই কাজের জন্য যথেষ্ট।
       পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে ক্রমবর্ধমান এ আই-এর ব্যবহার সমাজের ক্ষেত্রে জটিল সমস্যা ডেকে আনবে। এই লেখায় দৈর্ঘ্যের কারণে অর্থনৈতিক আলোচনা সচেতনেই এড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কয়েকটা কথা মনে রাখা জরুরি। কৃষি থেকে শিল্পে উত্তরণের সময় জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ কর্মহীন হয়ে পড়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আধুনিক শিল্প তাকে কাজের জায়গা দেয়। তার কারণ শিল্পক্ষেত্রে অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এআই-এর ক্ষেত্রে কিন্তু সেই রকম সুযোগ নেই। মানুষ দুই ধরনের পরিশ্রম করতে পারে – শারীরিক ও বৌদ্ধিকপ্রযুক্তি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এতদিন সমাজে প্রথমটার প্রয়োজন কমেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি দ্বিতীয়টাকেও অপ্রয়োজনীয় করে তোলে? পরিবহন, কারখানা, কৃষি, সামরিক ক্ষেত্র – যে সব জায়গায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় কাজ জোটে সেখানেই মানুষের প্রয়োজন ক্রমশ কমে আসছে। এর ফলে এক বিরাট সংখ্যায় মানুষ সমাজে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। এমনকি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার উকিল শিক্ষকের মতো পেশাও বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক কার্ল ফ্রে ও মাইকেল অসবোর্ন আগামী কুড়ি বছরের মধ্যে কোন কোন পেশার জায়গা নেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তার হিসাব করেছেন। তাঁদের মতে ২০৩৩ সালে পশ্চিমী দুনিয়ায় যে সমস্ত পেশার আশি শতাংশের বেশি এআই-এর দখলে চলে যাবে, তাদের মধ্যে পড়ছে টেলিমার্কেটিং, বীমা, ক্যাশিয়ারের কাজ, হোটেল রেস্তরাঁর রান্না ও ওয়েটারের কাজ, ট্যাক্সি ও বাস ড্রাইভার, সিকিউরিটি গার্ড,  কেক-পাউরুটি-বিস্কুট ইত্যাদি বানানোর কাজ, নির্মাণ শিল্প, ইত্যাদি। যে সীমিত সংখ্যক পেশার প্রয়োজনীয়তা থাকবে, বর্তমান সমাজব্যবস্থায় তাদের সঙ্গে বাকিদের বিশাল পার্থক্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই প্রসঙ্গে আমরা এই লেখার শেষে ফিরে আসব।
       শুরুতেই বলেছি সাহিত্য সৃষ্টি বা সঙ্গীত রচনার মতো সৃষ্টিশীল কাজও এআই করে দেখাচ্ছে। চেতনা না থাকলে আবেগ কি থাকতে পারে? এতদিন এই প্রশ্নের উত্তর ছিল, না। ইএমআই বা অ্যানি সেই উত্তরকে কি ভুল প্রমাণ করছে? প্রশ্ন হল আবেগ কী? সঠিক ভাবে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন হলেও বিভিন্ন পরিবেশ পরিস্থিতিতে বাইরের বা ভিতরের স্টিমুলাস বা উদ্দীপকের প্রভাবে মনের মধ্যে যে তীব্র অনুভূতি সৃষ্টি হয় তাকে আমরা আবেগ বলে ধরে নিতে পারি। এআই-এর বিশ্লেষণী ক্ষমতা বিভিন্ন স্তরে এই পরিবেশ পরিস্থিতি ও উদ্দীপকে মানবমন যে সাড়া দেয় তা বিচার করছে এবং তার থেকে শিক্ষা নিচ্ছে। তার সব থেকে বড় সুবিধা হল সমস্ত এআই-এরই যা বৈশিষ্ট্য – দ্রুত বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষমতা। শিল্পী যখন মহৎ কিছু সৃষ্টি করছেন তখন তাঁর মনে যে অনুভূতি বা আবেগ জন্ম নেয়, সমতুল্য কিছু (সম্ভবত) এআই অনুভব করে না। কিন্তু তার বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে এআই যে সৃষ্টি করছে তা শ্রোতা বা পাঠক বা দর্শকের মনে মানবসৃষ্ট মহৎ সৃষ্টিকর্মের মতো একই অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। তার পদ্ধতিটা যান্ত্রিক হতেই পারে, কিন্তু আমার মনের কাছে তা অবান্তর। যন্ত্র কি চিন্তা করতে পারে, এই প্রশ্নের জবাবে এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী একটা পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ডুবোজাহাজ কি সাঁতার কাটে? অর্থাৎ প্রশ্নটার ক্ষেত্রে সমস্যা এই জায়গায় নয় যে যন্ত্র চিন্তা করতে পারে কিনা, সমস্যা হল চিন্তা বলতে আমরা কি বুঝি তার সঠিক ব্যাখ্যা। এই সমস্যা নিয়ে অনেকে মাথা ঘামিয়েছেন ও ঘামাচ্ছেন, কিন্তু তার আলোচনাও আমাদের পরিধির বাইরে।
       আগের অনুচ্ছেদে একটা শব্দ বন্ধনীর মধ্যে রেখেছিলাম, সম্ভবত। এআই যে আবেগ অনুভব করে না, তা নিশ্চিত ভাবে কি বলতে পারছি না? আমাদের মস্তিষ্কে কিছু জৈবরাসয়ানিক পরিবর্তন হয়, তার ফলে  মস্তিষ্কে যে উদ্দীপনা হয় তা আবেগের জন্ম দেয়। কিন্তু এটা স্পষ্টতই জীবের ক্ষেত্রেই সত্য। একই ধরনের আবেগ ড্রাগ প্রয়োগের ফলেও সৃষ্টি করা যায়। অ্যানি নামের এআই যখন কাজ করে, তখন তাকে যে কম্পিউটারে চালানো হচ্ছে, সেখানে বিদ্যুতের প্রবাহ হয়। এভাবেই কম্পিউটার কাজ করে। অ্যানি যখন একটি অসাধারণ হাইকুর জন্ম দেয়, তখন কি তার মধ্যে ইলেকট্রনের প্রবাহ কোনো বিশেষ প্যাটার্ন অনুসরণ করে? আমরা জানি না। যদি করে, তাহলে সেই বিশেষ প্যাটার্নকে কি অ্যানির আবেগ বলতে পারি? কম্পিউটারের ভাষায় বললে, আমার মস্তিষ্কে যে জৈবরাসয়ানিক পরিবর্তন হ তা হল প্রোগ্রাম। আমার মস্তিষ্কের কোশগুলি শুধুমাত্র জৈবরাসয়ানিক ভাষাই বোঝে, সেই ভাষাতেই ঐ প্রোগ্রাম লেখা। কিন্তু এই প্রোগ্রাম তো কোনো অ্যালগরিদমকে ভাষায় প্রকাশ করছে। আমি কি নিশ্চিত যে সেই অ্যালগরিদমকে ইলেকট্রনের প্রবাহের ভাষায় লিখলে কম্পিউটারের মধ্যের ঐ প্যাটার্নটাকে খুঁজে পাব না?  চিন্তা, আবেগ ইত্যাদি শব্দগুলো আমরা যে অর্থে ব্যবহার করি, তা পুরোপুরি মানবকেন্দ্রিক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ করার সময় তা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।
(৩)
       শেষ কথাটা খুব বেশি সত্য শক্তিশালী এ আই নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গেএতক্ষণ ধরে আমরা দুর্বল এআই-এর কথা বললাম। সে একটা নির্দিষ্ট কাজই করতে পারে, কিন্তু সেটা যে কোনো মানুষের থেকে ভালো পারে বা এখন না পারলেও ভবিষ্যতে যে পারবে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়তার কারণটা খুব স্পষ্ট। দ্রুততা, বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষমতা ও ফোকাস – এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের জন্যই এআই যে কাজগুলি করতে সক্ষম, সেগুলিতে সে মানুষকে ছাড়িয়ে যাবেই। শক্তিশালী এ আই কিন্তু একসঙ্গে অনেক কাজ পারবে, এবং স্বাভাবিকভাবেই সেই সমস্ত ক্ষেত্রেই সে মানুষকে বহু পিছনে ফেলে দেবে। তাই শক্তিশালী এ আই-এর আরেক নাম আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টালিজেন্স বা এজিআই, আমরা এই কথাটাই ব্যবহার করবে এখনো পর্যন্ত এজিআই তৈরি হয়নি; কিভাবে হবে, কবে হবে বা আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা একমত নন। কিন্তু একবার তৈরি হলে তার কাছ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি একবার দেখে নেওয়া যাক। তবে বলে রাখা প্রয়োজন, এ সবই হল কল্পনা, বাস্তব সম্পূর্ণ অন্যরকম হতে পারে।
       প্রথমেই একটা কথা মনে রাখা দরকার, সেটা এতই স্পষ্ট যে তার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। আজ পৃথিবীতে মানুষ যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য বিস্তার করে আছে, তার কারণ বুদ্ধিমত্তা। শারীরিক ক্ষমতার দিক থেকে সে অন্য অনেক প্রাণীর কাছে নিতান্তই দুর্বল। এজিআই সেই বুদ্ধিমত্তার দিক থেকেই মানুষের থেকে এতটাই এগিয়ে থাকবে যে তার কাছে আমরা হয়তো পিঁপড়ে সদৃশ কোনো প্রাণী। এ ধরনের বুদ্ধিমত্তা আমাদের কেমনভাবে দেখবে, তা নিতান্তই কল্পনার বস্তু, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। এর ভালো মন্দ দুই দিকই আছে।
       ভালো দিকটা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার কোনো প্রয়োজন নেই। ক্যান্সারের চিকিৎসা থেকে শুরু করে সমাজে আর্থিক স্থিতিশীলতা আনা, মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপন থেকে শুরু করে পরিবেশ দূষণ বা বিশ্ব উষ্ণায়নের সমস্যার সমাধান – মানুষের ভবিষ্যতের নানা লক্ষ্য কল্পনা করতে আমাদের অসুবিধা নেই।  কিন্তু তাদের সবার জন্যই হয়তো শেষ পর্যন্ত উচ্চ মানের বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজন।  একজন আইনস্টাইন, একজন নিউটন বা একজন ডারউইনের মস্তিষ্কের শক্তির সঙ্গে আমার আপনার যা তফাত, এজিআই-এর সঙ্গে যে কোনো মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির পার্থক্য হবে তার থেকে অনেক অনেক গুণ বেশি। আমাদের কাছে যে সমাধান চিন্তার অতীত,  এজিআই-এর হয়তো তার সমাধান করতে কয়েক মুহূর্তের চিন্তার প্রয়োজন হবে। আবারও বলছি, এ সবই কল্পনা, আমাদের কাছে এখনো পর্যন্ত এগিয়ে থাকা বুদ্ধিবৃত্তির এমন কোনো উদাহরণ নেই যার থেকে আমরা সাহায্য পেতে পারি।
       এজিআই-এর বিপদ বিষয়ে গবেষণারত বিশেষজ্ঞরা (সত্যিই এরকম বিশেষজ্ঞদের অস্তিত্ব আছে তাঁদের কথা আবার এই লেখাতে আসবে।)  বিশেষ করে দুটি সম্ভাবনার কথা বলছেন। একটা ব্যাপারে সবাই একমত, সিনেমা গল্পে যেমন দেখা যায়, সেই টার্মিনেটর ধরনের বুদ্ধিমান কিন্তু মানুষের ধ্বংসসাধনে বদ্ধপরিকর রোবটের থেকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন, একক রোবটের পক্ষে মানুষের সামান্যই ক্ষতি করা সম্ভব। কারণ, তার বুদ্ধিমত্তা তার মাথার মধ্যে সীমাবদ্ধ। সে যতই শক্তিশালী হোক, আমাদের কাছে তার পরাজয় নিশ্চিত। তার থেকে অনেক ভয়ের জিনিস হল ডিস্ট্রিবিউটেড আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স যা এজিআই মাত্রেরই থাকবে। গোটা পৃথিবী জুড়ে যার মস্তিষ্ক, তাকে কেমন করে ধ্বংস করব?
       দুটি সম্ভাবনার কথা বলেছিলাম, দুটিতেই ভয়ের কারণ হল এজিআই-এর দক্ষতা যা আমাদের বর্তমান যে কোনো যন্ত্রকে বহু পিছনে ফেলে দেবে। প্রথম সম্ভাবনা আসে যদি এজিআইকে সামরিক অস্ত্রের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়আগেই আমরা আলোচনা করেছি যে সহজবোধ্য কারণেই তার উপরে মানুষের বিশেষ নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। কিন্তু তার প্রোগ্রামে থাকবে শত্রুপক্ষের যতটা সম্ভব ক্ষতিসাধন, সে জন্যই তার সৃষ্টি। এই পরিস্থিতি হাতের বাইরে গেলে গোটা পৃথিবী মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাতে পারে।
       দ্বিতীয় যে সম্ভাবনা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বিশেষ চিন্তিত সেটা উদ্দেশ্যের দিক থেকে ঠিক উল্টো। ধরা যাক আমরা এজিআইকে কোনো ভালো কাজের জন্যই সৃষ্টি করেছি, কিন্তু প্রোগ্রামে যথেষ্ট সেফগার্ড বা রক্ষাকবচ দেওয়া হয় নি। এজিআই সেই উদ্দেশ্য সাধনে দৃঢ়সংকল্প, তাই তার প্রোগ্রামের পরিধির মধ্যে থেকে যা যা করা সম্ভব সমস্তই সে চেষ্টা করবে। বিশেষজ্ঞদের লেখা থেকেই দুটো উদাহরণ নিলাম, তাঁরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই এগুলো আলোচনা করেছেনএজিআইকে বলা হল ক্যান্সার নির্মূল করতে, সে দেখল যে তার সবচেয়ে সহজ উপায় হল পৃথিবী থেকে সমস্ত জীবই ধ্বংস করে দেওয়া। এবং এমন হতেও পারে যে সেই এজিআই সেই ক্ষমতা ধরেদ্বিতীয় উদাহরণ, অর্থনীতি মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তাকে এর থেকে বার করতে হবে। ইতিহাসে অনেক সময় দেখা গেছে যুদ্ধ বা কোনো ভয়ঙ্কর বিপর্যয় অর্থনীতিকে সাময়িকভাবে চাঙ্গা হয়ে তোলেএজিআই এর মধ্যে কোনো একটা বেছে নিলো
       পাঠকের মনে হতেই পারে এই সম্ভাবনাগুলোকে মাথায় রেখে প্রোগ্রামটা লিখলেই হল। এখানে দুটো সমস্যা আছে। যাঁরা একটু জটিল প্রোগ্রাম লিখেছেন, তাঁরা সবাই জানেন যে চালু প্রোগ্রামেও অনেক ভুল থাকে, আর এজিআই-এর মতো অত্যন্ত জটিল প্রোগ্রামে তা অবশ্যম্ভাবী। কাজেই চাইলেও সমস্ত বিপজ্জনক সম্ভাবনাগুলো আটকানো না যেতেই পারে। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা অন্যএজিআই মানুষের থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। একজন মানুষ কয়েকবছর ধরে সারাক্ষণ চিন্তা করে যতগুলি এইরকম পরিস্থিতির কথা মাথায় আনবে, এজিআই এক সেকেন্ডে তার থেকে অনেক বেশি পথ আবিষ্কার করে ফেলবে। আমাদের সীমিত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
       শেষ সম্ভাবনাটা আরো একটু বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা যাক। আমরা কি বলতে পারব এজিআই কেন কোনো বিশেষ পদক্ষেপ নিচ্ছে? মনে রাখতে হবে, যে সমস্ত বিশেষ ক্ষেত্রে এআই প্রয়োগ করা গেছে, সেখানে সে শুধু তাড়াতাড়ি কাজটা করছে, তা নয়। একই সঙ্গে অনেক সময় এমন কাজ করছে যা আমাদের বুদ্ধির অগম্য। ২০১০ সালের ৬ মে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে যে বিপর্যয় এসেছিল তা ফ্ল্যাশ ক্র্যাশ বলে পরিচিত। পাঁচ মিনিটের মধ্যে এক্সচেঞ্জের সূচক এক হাজার পয়েন্ট নেমে যায়, আবার তিন মিনিটের মধ্যে আগের জায়গায় ফিরে আসে। এর পিছনে কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় নি। বিশেষজ্ঞরা জানেন স্টক কেনাবেচার দায়িত্বে থাকা এআই-এর অ্যালগরিদম এর জন্য দায়ী, কিন্তু এত দিন চেষ্টা করেও অ্যালগরিদম কেন এমন করেছে তা বুঝতে পারা যায়নি
       দ্বিতীয় আর একটা উদাহরণ দেখা যাকচিনের এক প্রাচীন খেলা আছে যা দাবার থেকেও জটিল, তার নাম গো। বিশেষজ্ঞরা বহুদিন নিশ্চিত ছিল যে গো-তে ভালো করতে এআই-এর অনেক দেরি আছে, কারণ দাবার মতো সমস্ত চালের হিসাব করে তার থেকে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করা গো-এর ক্ষেত্রে অচল। কিন্তু ২০১৬ সালে গুগলের আলফাগো কম্পিউটার বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় দক্ষিণ কোরিয়ার লী সেডলকে হারিয়ে দেয়। আলফাগো ডিপ ব্লু-এর মতো অসংখ্য চালের বিশ্লেষণ করে না, নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাকে মানুষের মতো খেলতে শেখানো হয়েছে। তার স্ট্র্যাটেজির মৌলিকত্ব দর্শকদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিলখেলার আগে পর্যন্ত লী সেডলের জয় সম্পর্কে যে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত ছিলেন, খেলার পরে তাঁরাই বললেন এআই-কে হারানো মানুষের ক্ষমতার বাইরে চলে গেল। এজিআই কোন পথ বেছে নিতে যাচ্ছে, তা আমরা আগে বুঝতে পারব কি? পরে কি আর তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব? এজিআইকে যে লক্ষ্য আমরাই স্থির করে দিয়েছি, সেটা পূরণ করাই তার অস্তিত্বের কারণচাইলেও কি সে আমাদের তা পরিবর্তন করে দেবে?
       কেউ কেউ বলেন যে এর থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হল এজিআইকে সমস্ত ক্ষমতা না দিয়ে শুধু তার থেকে সমস্যা সমাধানের পথগুলো জানতে চাওয়া, কোনটা অনুসরণ করা হবে তা ঠিক করবে মানুষই। এখানে দুটো সমস্যা আছেপ্রথমত, প্রযুক্তিগতভাবে নিজেদের এভাবে সীমাবদ্ধ রাখা খুব কঠিন। সবসময়েই লোভ হবে  এজিআইকেই পুরোপুরি দায়িত্ব দেওয়ারদ্বিতীয় সমস্যা হল, যে বুদ্ধিমত্তা আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে, আমরা কি তার স্ট্র্যাটেজি বুঝতে পারব? তার কথামতো এখন কোনো সামান্য পদক্ষেপ নিলে ভবিষ্যতে তার কি ফল হতে পারে তা অনুধাবন করার মতো বুদ্ধি আমাদের আছে কি?
       এই সমস্ত সম্ভাবনা থেকে উদ্ধার পাওয়ার একটাই উপায়, কিন্তু সেটা আমরা কখনোই অনুসরণ করব না সে কথা আগে থেকেই বলে দেওয়া যায়। উপায়টা কী? একটা পুরানো গল্প মনে করা যাক। দার্শনিক সক্রেটিস যুক্তি দিয়ে মানুষকে নিজের মতে আনার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। একদিন তিনি বন্ধু পলেমার্কাসের বাড়ি গিয়েছিলেন, বন্ধু রাত্রে থাকার জন্য জোর করছিলেন। সক্রেটিস বললেন, আমি তোমাদের যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলছি, তারপর দেখবে তোমরা আমার চলে যাওয়াতে আপত্তি করবে নাপলেমার্কাস উত্তর দিলেন, আমরা তোমার কোনো যুক্তিই শুনব না, তাই তুমি আমাদের মত পাল্টাতে পারবে না। সক্রেটিস আর পলেমার্কাসের বুদ্ধিমত্তার যা পার্থক্য, এজিআই-এর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য হবে তার থেকে অনেক গুণ বেশি। তাই এজিআই-এর দ্বারা প্রভাবিত না হওয়ার একমাত্র উপায় হল তার মত একেবারেই না শোনা। সেটা কি সম্ভব? তাহলে আর এজিআইকে কেন সৃষ্টি করলাম? প্রযুক্তির জন্ম ব্যবহারের জন্য, শোকেসে সাজিয়ে রাখার জন্য নয়।
       কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আলোচনা শেষ করার আগে একটা কথা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন, এখানে ভালো মন্দ বলতে মানুষের উপর তার প্রভাবের কথা বলা হচ্ছে। এআই-এর উদ্দেশ্যকে ভালো বা মন্দ বলার কোনো অর্থ নেই। বন্দুক থেকে গুলি চালিয়ে খুন করা হলে খুনীর শাস্তি হয়, বন্দুকের নয় – এ যুক্তি এখানে অবশ্যই খাটে না। কারণ এজিআই উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করবে। কিন্তু তাকে ভালো বা মন্দ বলব কি? আমাদের ভালোমন্দের বোধ অনেকটাই বিবর্তনের ফলে জন্মেছে। কথাটা অদ্ভুত লাগলেও অনেকেই এই বিশ্বাসের শরিক যে আমাদের নৈতিকতা সমাজনির্ভর তো বটেই, আবার অনেকটাই জিনগতও বটে। এআই নিশ্চয় আমাদের সৃষ্টি, কিন্তু আমাদের নৈতিকতা তার কাছে সম্ভবত অর্থহীন হতে পারে। সুতরাং তার মনস্তত্ত্ব বোঝা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন হবে। একটা খুব অবাস্তব উদাহরণ দেখা যাককোনো এজিআইকে বিশ্ব উষ্ণায়নের থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে বলা হয়েছে সে হয়তো সিদ্ধান্ত করল যে সবচেয়ে ভালো পথ হল রান্না বন্ধ করা, মানুষ কাঁচা খাবার খেয়েও দিব্যি বাঁচতে পারে, অন্য কোনো উপায় মানুষের জীবনযাত্রাতে অনেক বেশি সমস্যা ডেকে আনবেএই উদ্ভট পরিকল্পনা সাধারণত কোনো মানুষের মাথায় আসবে না (বর্তমান লেখককে এই উদাহরণের জন্য বেশ কয়েকদিন ভাবতে হয়েছিল), এলেও তা উড়িয়ে দেওয়া হবে। একটা বাঁধ তৈরির সময় আমরা নদীতীরের পিঁপড়েদের কথা মাথায় রাখি না, এজিআই  কি তার যে কোনো বৃহৎ পরিকল্পনা রূপায়ণের সময় অল্প বা বেশি সংখ্যক মানুষের সমস্ত সুবিধা অসুবিধার কথা মাথায় রাখবে? এই সব কারণে নিরাপদভাবে এআই প্রযুক্তির বিকাশের জন্য বেশ কয়েক জায়গায় গবেষণা শুরু হয়েছে। বোস্টনের ফিউচার অফ লাইফ ইন্সটিটিউট, ক্যালিফোর্নিয়ার মেশিন ইন্টালিজেন্স রিসার্চ ইন্সটিটিউট, অক্সফোর্ডে ফিউচার অফ হিউম্যানিটি ইন্সটিটিউট, কেমব্রিজের সেন্টার ফর দি স্টাডি অফ এক্সিস্টেনশিয়াল রিস্ক –এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের কথা বলা যেতে পারে। তাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন অনেক সুপরিচিত বিজ্ঞানী। তাঁদের মতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অমিত সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে গবেষণা এখনই শুরু করা প্রয়োজন।
(৪)
       কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা শুনলাম, এবার আসি প্রায় কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট প্রাণের প্রসঙ্গে। দুই দশক আগে ১৯৯৬ সালে ক্লোনিং কথাটা খবরের শিরোনামে এসেছিল। ডলি নামের এক ভেড়া ছিল প্রথম স্তন্যপায়ী যাকে ক্লোন করা হয়েছিল। ক্লোন করার অর্থ হল কোনো জীবের দেহ থেকে এমন এক জীবের সৃষ্টি করা যার জিনবিন্যাস আসলটার হুবহু প্রতিরূপ। সাধারণ ভাবে এই কাজটা নতুন নয়। কলম করার মাধ্যমে যখন নতুন চারাগাছ তৈরি করা হয়, সেও মূল গাছের ক্লোনআবার অভিন্ন বা আইডেনটিকাল যমজদের জিনবিন্যাস হুবহু এক, আমরা তাদের প্রাকৃতিক ক্লোন বলতেই পারি। বিজ্ঞানীরা ডলির আগে ব্যাঙ ও ইঁদুরের ভ্রূণের ক্লোন সৃষ্টি করেছিলেন, তবে প্রাপ্তবয়স্ক স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্লোন সৃষ্টি করা অনেক শক্ত। তাই ডলির ক্লোন করার খবর সাধারণ মানুষদের মতো বিজ্ঞানীদের মধ্যেও বেশ সাড়া ফেলেছিল।
এডিনবারের মিউজিয়ামে স্টাফ করা ডলির দেহের সামনে লেখক
       খুব সংক্ষেপে সহজ করে ক্লোনিং ব্যাপারটা কী দেখে নেওয়া যাকউদাহরণ হিসাবে আমরা ডলির কথাই ভাবতে পারি। ভেড়ার সাধারণ জনন পদ্ধতি কী? ভেড়ার সাধারণ প্রাপ্তবয়স্ক দেহকোশে আছে সাতাশ জোড়া ক্রোমোজোম। ক্রোমোজোম বা তার ভিতরের ডিএনএ অণুর অংশ হল জিন যা জীবের সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে। নারী ভেড়ার দেহে থাকে ডিম্বাণু, পুরুষের দেহ থেকে আসে শুক্রাণু। ডিম্বাণু ও শুক্রাণু হল জননকোশ, এদের প্রত্যেকটিতে আছে সাতাশটি করে ক্রোমোজোম। নিষেকের সময় শুক্রাণু থেকে শুধুমাত্র ওই সাতাশটি ক্রোমোজোম ডিম্বাণুতে প্রবেশ করে। ফলে নিষিক্ত কোশে এখন সাধারণ দেহকোশের মতো চুয়ান্নটি ক্রোমোজোম আছে এই কোশকে বলে জাইগোট বা ভ্রূণকোশ। জাইগোটই বিভাজনের মাধ্যমে নতুন ভেড়ার জন্ম দেয়। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে পদ্ধতিটা আসলে আরো একটু জটিল, কিন্তু মূল কথাটা হল সন্তানের নিউক্লিয়াসের জিনবিন্যাসের অর্ধেক আসে বাবার থেকে, বাকিটা মায়ের থেকে। জিনকে বলা হয় বংশগতির ধারক ও বাহক তাই সাধারণ জননের সময় জিনের মিশ্রণ ঘটে, সন্তানের কিছু বৈশিষ্ট্য হয় বাবার মতো, কিছু মায়ের অনুসারী।
       ডলির জিনবিন্যাস ছিল অবিকল তার মায়ের মতো। কেমন করে তা সম্ভব হল? ডলি হল আমরা যাকে টেস্টটিউব বেবি বলি সেই রকম শিশু। বিজ্ঞানীরা কয়েকবছর আগে মৃত এক স্ত্রী ভেড়ার সংরক্ষিত  দেহকোশ থেকেই সাতাশ জোড়া ক্রোমোজোম নিয়েছেন। অপর এক ভেড়ার ডিম্বাণু থেকে ক্রোমোজোমগুলি বার করে নিয়ে এই চুয়ান্নটি ক্রোমোজোমকে প্রতিস্থাপন করেছেন। তারপরে ওই ডিম্বাণু দ্বিতীয় ভেড়ার গর্ভে স্থাপন করেছেন, তাকে নানা ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন যাতে করে সে ভ্রূণকোশের মতো আচরণ করে, বিভাজনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ভেড়াটির জন্ম দেয়। দ্বিতীয় ভেড়াটি হলে সারোগেট, তার সঙ্গে ডলির কোনো মিল নেই। ডলি বেঁচেছিল ছ’বছর, সে  স্বাভাবিক সন্তানেরও জন্ম দিয়েছে।
       শুনতে যত সোজা লাগছে, বিষয়টা তত সহজ নয়। ভ্রূণকোশ বা তার থেকে প্রথম কয়েকবার বিভাজনের ফলে যে কোশদের জন্ম হয় তাদের একসঙ্গে বলে স্টেমকোশ। স্টেমকোশেরও প্রকারভেদ আছে, কিন্তু আমাদের আলোচনার জন্য সেটা জরুরি নয়। এই স্টেমকোশদের থেকেই দেহের সমস্ত রকমের কোশের সৃষ্টি হয়। মানবদেহে মোট ২২০ রকমের কোশ আছে, সবার জন্ম স্টেমকোশ থেকেবোঝাই যায় যে স্টেমকোশের মধ্যে সমস্ত ধরনের কোশের জিন সক্রিয় আছে। কিন্তু তার থেকে যে নির্দিষ্ট ধরনের কোশের জন্ম হয়, তার মধ্যে সেই কোশের জন্য প্রয়োজনীয় জিনগুলি ছাড়া অন্যগুলি নিষ্ক্রিয় হয় যায়। আমাদের দেহের স্নায়ুকোশ আর পেশীকোশের জন্ম একই ভ্রূণকোশ থেকে, কিন্তু শুধুমাত্র স্নায়ুকোশের জন্য প্রয়োজনীয় জিনগুলি পেশীকোশের মধ্যে নিষ্ক্রিয়। স্তন্যপায়ীদের প্রাপ্তবয়স্ক কোশগুলি নির্দিষ্ট কাজের জন্য বিশেষ রকম দক্ষএর জন্য তাই বিবর্তনের পথে তারা নমনীয়তা বিসর্জন দিয়েছ, সাধারণভাবে এক ধরনের কোশ অন্য কোনো ধরনের কোশের জন্ম দিতে পারে না। ডলির মায়ের স্তন থেকে কোশ নেওয়া হয়েছিল, সেই পূর্ণবয়স্ক কোশ থেকে স্টেমকোশ সৃষ্টি করতে হয়েছিল। এই সমস্ত জটিলতার কারণে স্তন্যপায়ীর ক্লোন সৃষ্টি করা নিয়ে বিজ্ঞানীরা সন্দিহান ছিলেন। ডলির পরে গরু, শুয়োর বা কুকুরের ক্লোন সৃষ্টি করা সম্ভব হলেও বাঁদরের ক্লোন করতে লেগে গেল বাইশ বছর।
       মানুষের ক্লোন নিয়ে মাঝে মাঝে নানারকম দাবি শোনা গেলেও এখনো পর্যন্ত সন্দেহ নেই যে সে সবই মিথ্যা। এর মধ্যে একটা পুরানো গল্প এখানে বলে রাখি। ১৯৭৮ সালে পরিচিত বিজ্ঞান সাংবাদিক ডেভিড ররভিক একটা বই লেখেন। In His Image: The Cloning of Man বইতে জনৈক বিজ্ঞানী  কেমনভাবে এক মার্কিন ধনকুবেরের ক্লোন কেমনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন তার বর্ণনা ছিল। বইটির প্রকাশক ছিল বিজ্ঞান গবেষণাতে সুপরিচিত জে বি লিপিনকট, বইটি লেখা হয়েছিল বিজ্ঞান নিবন্ধের মতো করে, সেখানে তের পাতা জুড়ে বহু আধুনিকতম গবেষণাপত্রের রেফারেন্স ছিল। বিজ্ঞানীরা একে গল্পকথা বললে উড়িয়ে দিলেও প্রকাশক ও লেখক মিলে এগারো লক্ষ ডলারের বেশি লাভ করেছিলেন, এই তথ্য থেকেই বোঝা যায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এই নিয়ে আগ্রহ কতখানি।
       মানুষের ক্লোন করা উচিত কিনা সে সময়েই তা নিয়ে তীব্র বিতর্কের জন্ম হয়েছিল, তা আজও চলছে। তবে এআই সংক্রান্ত তর্কের থেকে এর চরিত্র আলাদা। মানুষের ক্লোনদের হাতে মানবজাতি বিপন্ন, এসব কল্পবিজ্ঞান গল্প বা সিনেমাতেই চলে, বাস্তবে তার কোনো সম্ভাবনা নেই। পঁচিশ বছর বয়স্ক মানুষের ক্লোন পঁচিশ বছর বয়স্ক মানুষ হবে না। মানবভ্রূণ হিসাবেই তার সৃষ্টি, মাতৃগর্ভে নির্দিষ্ট কাল কাটানোর পরে শিশু হিসাবে তার জন্ম হবে। যে ব্যক্তির থেকে তার ডিএনএ নেওয়া হয়েছে সে শুধুমাত্র তারই বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মেছে, এটুকু ছাড়া অন্য শিশুদের থেকে তাকে পৃথক করা যাবে না। কোনো ব্যক্তির ক্লোন সেই অর্থে তার অভিন্ন যমজ, তফাত এই যে তাদের জন্মকালের পার্থক্য কয়েক মিনিট নয়, কয়েক বছর। অভিন্ন যমজরা একই জিনবিন্যাস নিয়ে একই সময়ে জন্মালেও তারপর থেকেই পরিবেশের প্রভাবে তাদের চরিত্রের পরিবর্তন হতে থাকে। ক্লোনের জন্ম অনেক বছর পরে, তাই নিশ্চিত ভাবেই সে বেড়ে ওঠার সময় মূল ব্যক্তির মতো একই পরিবেশ পাবে না। যে কোনো ব্যক্তির চরিত্র নির্ধারণে পরিবেশের কিছুটা ভূমিকা তো থাকেই, তাই রবীন্দ্রনাথের ক্লোন জীববিজ্ঞানে গবেষণা করে বা ফুটবল খেলে খ্যাতি অর্জন করতে পারে, কিংবা কোনো রকম প্রতিভার চিহ্ন নাও দেখাতে পারে।
       ক্লোনিঙের ক্ষেত্রে বিতর্কটা নৈতিক ও আইনি। সেখানে যাওয়ার আগে ক্লোনিঙের উদ্দেশ্য কী দেখে নেওয়া যাক মনে রাখতে হবে ক্লোনিং এক অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ পদ্ধতি, প্রায়শই তাতে সাফল্য আসে না। ডলির ক্ষেত্রে ২৭৭ তম চেষ্টাতে জাইগোট সৃষ্টিতে সাফল্য এসেছিল। অনেক সময় জন্মের আগেই ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়অনেক সময় প্রাণী কোনো খুঁত নিয়ে জন্মায়। যাঁরা প্রাণীদের অধিকার নিয়ে চিন্তা করেন তাঁদের অনেকেই এ জন্য ক্লোনিঙের বিরোধী। নতুন ভেড়ার জন্ম দিতে গেলে সাধারণভাবে পুরুষ ও স্ত্রী ভেড়ার মিলন নিঃসন্দেহে অনেক সহজ পদ্ধতি। অবশ্য ভবিষ্যতে হয়তো পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। কেউ কেউ বলেন ক্লোনিঙের সাহায্যে জৈবিক কারণে নিঃসন্তান দম্পতি সন্তানলাভ করতে পারেন। তা নিশ্চয় সম্ভব, কিন্তু বাস্তবে কাজে লাগবে কিনা সন্দেহ, কারণ ক্লোনিং গবেষণার থেকে ফার্টিলিটি বিষয়ে গবেষণা অনেক দ্রুত এগোচ্ছে।  শিশু সন্তানের মৃত্যুর শোক সন্তানের ক্লোন ভোলাতে পারবে এই মতামতও এসেছে এটাও সম্ভবত আকাশ কুসুম কল্পনা; ক্লোন সম্পূর্ণ নতুন এক প্রাণ, তার মধ্যে মৃতকে খুঁজতে যাওয়া তার বা বাবা মা কারোর প্রতিই সুবিচার করবে না। প্রিয় পোষা প্রাণীর মৃত্যুর পরে ক্লোনিং করে তাকে আবার ফিরিয়ে আমার জন্য কোম্পানিও তৈরি হয়েছিল। সেই কোম্পানি প্রথম একটি বিড়ালকে ক্লোন করেছিল (তার Copycat নামটা বোধহয় অবশ্যম্ভাবী ছিল)বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায় জীবের ক্লোনিঙের চেষ্টা হয়েছে, যদিও তেমন সাফল্য এখনো আসে নি। ভালো জাতের কুকুর, রেসের ঘোড়া, প্রচুর দুধ দেয় এমন গরু – এ ধরনের প্রাণীদের হুবহু কপি অবশ্য বাস্তবে কাজে লাগে  কাছাকাছি অন্য কোন ক্ষেত্রে ক্লোনিং ব্যবহার হয় তা আমরা পরে আলোচনা করব। তবে শুধুমাত্র নতুন জীব সৃষ্টির জন্য ক্লোনিঙের মতো ব্যয়বহুল পদ্ধতি বাস্তবে এখনো অচলকপিক্যাটের জন্য খরচ হয়েছিল বত্রিশ হাজার ডলার।
       তাহলে মানুষের ক্লোন সৃষ্টি করে লাভ কী? এখানেই আসে আধুনিক স্টেমকোশ চিকিৎসাতে ক্লোনিঙের সম্ভাব্য ভূমিকা। ধরুন কোনো ব্যক্তির কোনো একটি অঙ্গ খারাপ হয়ে গেছে, অন্য কোনো মানুষের দেহ থেকে ওই অঙ্গটি নিয়ে তার দেহে প্রতিস্থাপিত করা হলদেহের ইমিউনিটি সিস্টেম বা অনাক্রম্যতাতন্ত্রের কাছে কিন্তু এই নতুন অঙ্গ বাইরের থেকে আগত শত্রু, সে তাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করবে। সেই জন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করে দেহের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করতে হয়। এতে বিপদের সম্ভাবনা প্রচুর, তারপরেও অনেক সময় সাফল্য আসে না। উপায় কী? উপায় হল যদি ঐ ব্যক্তিরই দেহকোশ দিয়ে অঙ্গটি তৈরি করা, তাহলে অনাক্রম্যতাতন্ত্র তাকে দেহেরই অংশ মনে করবেএর জন্য সাধারণত পূর্ণ অঙ্গ প্রতিস্থাপনেরও প্রয়োজন পড়বে না। ধরা যাক কারো হৃৎপিণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখানে যদি তারই দেহের স্টেমকোশ প্রতিস্থাপিত করা যায়, তাহলে তার থেকে নতুন সুস্থ হৃৎপিণ্ডের পেশীকোশের জন্ম হবে, হৃৎপিণ্ডও সুস্থ হয়ে উঠবে। ইনসুলিন নিঃসরণকারী কোষ কমে গেছে, স্টেমকোশ প্রতিস্থাপন করে আবার তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলা যাবে। কারণ স্টেমকোশ যে পরিবেশে আছে, সেই অনুসারে বিভাজনের মাধ্যমে নতুন কোশের জন্ম দেয়। পরীক্ষা করে এই দুটি ক্ষেত্রেই সাফল্য এসেছে বলে মনে হচ্ছে, আরো অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা চলছেকিন্তু বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের দেহে স্টেমকোশের সংখ্যা খুবই কম, তাদের কার্যকারিতা নিয়েও সন্দেহ আছে। তাই যেভাবে ডলির জাইগোট সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে ক্লোন সৃষ্টি করে তার থেকে স্টেমকোশ নেওয়াও সুবিধাজনক
       একটা কথা পরিষ্কার, ক্লোন করা ভ্রূণটিকে প্রাণী হিসাবে জন্ম দেওয়ার জন্য নয়, স্টেমকোশের উৎস হিসাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেকেই নৈতিক কারণে এর বিরোধিতা করছেন। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাতকে অনেক রক্ষণশীল মানুষ খুনের সঙ্গে তুলনা করেন, তাঁদের এই পদ্ধতিতে তীব্র আপত্তিস্টেমকোশ চিকিৎসার সমর্থকদের বক্তব্য জাইগোট সৃষ্টির কয়েকদিনের মধ্যে ঐ ভ্রূণটিকে নষ্ট করা হচ্ছে। তখন তা কতকগুলো কোশের সমষ্টি মাত্র, স্নায়ুতন্ত্র ইত্যাদি সৃষ্টি না হলে তাকে প্রাণী বলা অর্থহীন। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গর্ভধারণের পরে কয়েকমাস পর্যন্ত গর্ভপাত বৈধ, তাকে হত্যার সঙ্গে তুলনা করে অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না।
       জুরাসিক পার্ক সিনেমাতে ডাইনোসরের ডিএনএ উটপাখি ও এমুপাখির ডিম্বাণুতে প্রবেশ করানো হয়েছিল -- এ হল আন্তঃপ্রজাতি ক্লোনিঙের উদাহরণ। এ হল আরো এক জায়গা যেখানে বিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেন নি। বিলুপ্ত প্রাণীর ক্লোন করতে হলে এই পদ্ধতি অনুসরণ করতেই হবে। বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর ক্ষেত্রেও অন্য উপায় নেই, কারণ ডিম্বাণু জোগাড় করা বা ভ্রূণকোশকে প্রতিস্থাপনের জন্য স্ত্রী প্রাণী পাওয়া অসম্ভব বললেই চলে।  দক্ষিণ এশিয়ার বুনো ষাঁড় গাউরের ক্লোন করার জন্য পোষা গরুর ডিম্বাণু ব্যবহার করা হয়েছিল, ক্লোনের জন্ম হলেও সে দুদিন পরেই মারা যায়। এই পদ্ধতিতে একটা সমস্যা হল যে ডিম্বাণুর মধ্যে আছে মাইটোকন্ড্রিয়া যার নিজের ডিএনএ আছে। যদিও সেই ডিএনএ সম্ভবত শুধু মাইটোকন্ড্রিয়াকেই প্রভাবিত করে, তবুও ভিন্ন প্রজাতির নিউক্লিয়াসের ডিএনএ-র সঙ্গে তার সম্পর্ক এখনো নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। তাই আন্তঃপ্রজাতি ক্লোনিঙের বিষয়ে অনেকের আপত্তি আছে। ২০০৩ সালে চিনের বিজ্ঞানীরা মানুষের ত্বকের ডিএনএ খরগোসের ডিম্বাণুতে প্রবেশ করিয়ে ভ্রূণকোশের সৃষ্টি করেছিলেন, অবশ্য কয়েকদিন পরেই সেই ভ্রূণগুলিকে নষ্ট করা হয়।  সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীমহলের তীব্র নিন্দার পরে এই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি হয় নি। 
       অপর এক পদ্ধতি হল কোনো প্রাণীর ক্লোনিঙের মাধ্যমে সৃষ্ট জাইগোটে অন্য প্রাণীর জিন প্রতিস্থাপন করা। প্রতিস্থাপনের জন্য গর্ভের বাইরে পরীক্ষাগারে অঙ্গ সৃষ্টি বহু দূরের প্রশ্ন, তা নিয়ে এখন কেউ চিন্তা করছেন না। কিন্তু এইচ জি ওয়েলসের আইল্যান্ড অফ ডক্টর মরো-র স্মৃতি ফিরিয়ে এনে বিভিন্ন প্রাণীর দেহে মানুষের অঙ্গ জন্ম দেওয়ার চেষ্টা চলছে। শুয়োরের দেহে জন্মানো মানুষের লিভার এখনি নিশ্চয় মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করা যাবে না, কিন্তু মানুষের লিভারের উপর নতুন কোনো ওষুধ কেমন কাজ করবে তা পরীক্ষার জন্য এই পদ্ধতিকে ব্যবহার করা যেতে পারে। অঙ্গ সৃষ্টির জন্য অন্য উপায় বেছে নেওয়া সম্ভব হলেও ক্লোনিংই এখানে সহজ পদ্ধতি।
       মানুষের ক্লোনের ক্ষেত্রে একটা সম্ভাব্য বিতর্কের জায়গা হল আইনি অধিকার। কারো কারো বক্তব্য যে ক্লোনকে মানবদেহ থেকে তৈরি করা হবে। নিজের হাতপায়ের উপর কোনো ব্যক্তির যে অধিকার, ক্লোনের উপরেও সেই অধিকার থাকবে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই অবশ্য এই কথা উড়িয়ে দেন। কারো হাত বা পায়ের নিজস্ব বুদ্ধি বা সত্তা থাকে না, ব্যক্তি মারা গেলে তার হাত বেঁচে থাকবে না। কাজেই এই যুক্তি খাটে না, মানুষের ক্লোনের অন্যান্য মানুষের মতোই সমস্ত অধিকার থাকবে।  অপর একটা সমস্যা অবশ্য ভেবে দেখার মতো। প্রায় সব সমাজেই বাবা মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হল সন্তান, তার অবর্তমানে রক্তের সম্পর্কে নিকটাত্মীয়। একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় এর কারণ হল ব্যক্তির জিনবিন্যাস সবচেয়ে বেশি মেলে তার সন্তান বা নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে, তাই ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব মেনে আদিম সমাজেই উত্তরাধিকারের এই নিয়ম সৃষ্টি হয়েছে জিন নিজের কপিকে চিরস্থায়ী করতে চায়, তার জন্য সে সমস্ত কিছু করতে প্রস্তুত। রিচার্ড ডকিন্সের ভাষায়, We are survival machines – robot vehicles blindly programmed to preserve the selfish molecules known as genes.  সমস্যাটা হল কোনো ব্যক্তির সঙ্গে তার সন্তানের জিনের মিল পঞ্চাশ শতাংশ, আর ক্লোনের সঙ্গে মিল একশো শতাংশ। তাহলে কি উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন পাল্টাতে হবে? একবার মানুষের ক্লোন সৃষ্টি হলে এই ধরনের আরো নানা সমস্যা সামনে আসবে সন্দেহ নেই।
(৫)
স্টেমকোশ চিকিৎসা কিন্তু ডলিকে ক্লোন করার উদ্দেশ্য ছিল নাযে কোম্পানি এই খরচ বহন করেছিল, তারা ভেড়ার ভ্রূণে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙের মাধ্যমে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলকী ধরনের পরিবর্তন? জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙের মাধ্যমে ভেড়া বা গরুর দুধের মধ্যে যদি ইনসুলিন বা ওই ধরনের কোনো প্রয়োজনীয় উপাদান সৃষ্টি করা যায়, তাহলে তার উৎপাদন খরচ বর্তমানের পদ্ধতির থেকে অনেক কম হবে ইনসুলিন নিঃসরণকারী গরুর জন্ম সত্যিই দেওয়া গেছেঅন্য আর এক রকম গরুর সৃষ্টি করা গেছে যাদের দুধের সঙ্গে মানুষ মায়ের দুধের কোনো তফাৎ নেই। যে সব শিশুর মায়ের দেহে কোনো কারণে দুধ তৈরি হয়না বা যারা জন্মের সময়ে মাতৃহারা, তাদের ক্ষেত্রে এ আশীর্বাদস্বরূপ। এরকম আরো নানা পরিবর্তনের চেষ্টা বিজ্ঞানীরা করছেন। স্বাভাবিক ভাবেই এই সমস্ত প্রাণী সৃষ্টির ক্ষেত্রে ক্লোনিং সুবিধাজনক, টেস্টটিউবে জাইগোট তৈরি করে নতুন জিনকে সহজেই তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙের পরিধি ক্লোনিঙের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কোনো কারণ নেই। ২০০৪ সালে মানুষের জিনোম বা জিনবিন্যাস পুরোপুরি জানা সম্ভব হয়েছে। ফলে মানুষেরও জিনে এখন পরিবর্তন করা সম্ভব। তার নৈতিকতা নিয়ে প্রচুর আলোচনা ও বিতর্ক চলছে, কিছু কিছু নিয়ম মেনে চলার ব্যাপারে একটা ঐকমত্য গড়ে উঠছে। (এখানে বলে রাখা ভালো, স্টেমকোশ গবেষণা নিয়ে অবশ্য বিভিন্ন দেশ একমত হতে পারেনি।) এরই মধ্যে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে দুই যমজ বোন লুলা ও নানার (আসল নাম নয়) জন্ম হয়। তারা টেস্ট টিউব বেবি, চিনের বিজ্ঞানী হি জিয়ানকুল ঘোষণা করেন যে তাঁর তত্ত্বাবধানে দুই বোনের জিনবিন্যাস ভ্রূণ অবস্থায় পরিবর্তন করা হয়েছে, তাদের এইচআইভি প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছেচিনের ভিতরে ও বাইরে তাঁর তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। অনেকেই বলেছিলেন যে নৈতিক মানদণ্ড স্থির না করে এই ধরনের কাজে হাত দেওয়া দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ। তদন্তের পরে জিয়ানকুলকে তাঁর কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এটা প্রচার হয়ে গেল যে সন্তানের ক্ষেত্রে নিজের পছন্দমত জিন বেছে নেওয়া বা বাদ দেওয়া সম্ভব।
       যদি আমি বুঝতে পারি যে জাইগোট থেকে আমার সন্তানের জন্ম হবে, তার মধ্যের কোনো জিন আছে ভবিষ্যতে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে বা প্রাণঘাতী হতে পারে, তাহলে সম্ভব হলে আমি সেই জিনকে জাইগোট থেকে বাদ দিয়ে দিতে পারি। আবার ইচ্ছা করলে কোনো বিশেষ জিনকে সেই জাইগোটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে  আমার পছন্দমতো কোনো গুণ সন্তানের মধ্যে আনার চেষ্টা করতে পারিজাইগোটের উপর না করে শুক্রাণু বা ডিম্বাণুর জিনেও পছন্দমতো পরিবর্তন করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিকে যে শিশুর জন্ম হয়, তাকে বলে জিন এডিটেড বা জিন টেলর্ড শিশুসব সময় যে কোনো বিশেষ গুণের জন্য একটা বা দুটো জিন দায়ী তা নয়, অনেকগুলি জিনের প্রয়োজন হতে পারে, কাজেই একটা বা দুটো জিনের পরিবর্তন করে অনেক সময় লাভ হবে না। তাছাড়াও একটা বিশেষ জিন যোগ করলে বা বাদ দিলে সে অন্য কোনো জিনের ক্রিয়ার উপর কী প্রভাব ফেলবে, সে সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনো অসম্পূর্ণ। এই সমস্ত কারণে এখনো জিন টেলরিঙের সুযোগ সীমিত। তবে পশুর ভ্রূণে জিন এডিটিং এখন সাধারণ ঘটনা, তাই মানবশিশুর ক্ষেত্রে তার ব্যাপক প্রয়োগ সম্ভবত শুধু সময়ের অপেক্ষা।
       এতদিন পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যবস্থাতে রোগ নিরাময় বা রোগ প্রতিরোধের কথাই চিন্তা করা হয়সুস্থ মানুষ বলতে কী বোঝায় সে সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা আছেধরা যাক রক্তের হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করাচ্ছি, তখন আমার রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণের পাশে লেখা থাকে কোন পাল্লার হলে তাকে স্বাভাবিক ধরা হবে। নতুন এই সমস্ত পদ্ধতির ক্ষেত্রে হয়তো স্বাভাবিক শব্দটাই অর্থহীন। সন্তানকে দৌড়বিদ বানাতে চান, জাইগোটের জিন এডিট করে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়িয়ে রক্তের অক্সিজেন বহন ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া হল। সন্তানকে বাস্কেটবল খেলোয়াড় বানাতে চান -- জিন এডিট করে উচ্চতা বাড়ানোর ব্যবস্থা হয়ে গেল। স্বাভাবিক মাপ বলে কিছু কি আর থাকবে?  জিন এডিটিং মোটেই সস্তা নয়, ল্যাবরেটরির বাইরে একমাত্র খুব ধনীরাই এর খরচ বহন করতে পারবে। মনে রাখতে হবে, জিন টেলর্ড কোনো ব্যক্তির সন্তানের মধ্যেও ঐ বিশেষ গুণগুলি যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এর ফলে একদল সুপারম্যান ও সুপারওম্যান সৃষ্টি হতে পারে যারা অন্য মানুষদের থেকে আলাদা। আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থায় নানা ধরনের অসাম্য বর্তমান। ইতিহাসে শাসকরা চিরকালই শাসিতদের থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখতে চেয়েছে, যেমন আমাদের দেশে প্রাচীনকালে সাধারণত কেবলমাত্র জন্মই ছিল বর্ণ ও পেশা নিরূপণের নিয়ন্তা। কিন্তু বাস্তবে পৃথিবীর কোনো সমাজেই শাসক ও শাসিতদের জিনে কোনো পার্থক্য ছিল না। জিন এডিটিং কিন্তু শুধুমাত্র সম্পদের পার্থক্য নয়, প্রকৃত জৈব পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারেপ্রাচীন বা মধ্য যুগে হয়তো এই রকম শ্রেণিভেদ নিচুতলার মানুষ মুখ বুজে মেনে নিয়েছিল, আধুনিক যুগে তার সূচনামাত্র বিপুল ক্ষোভের জন্ম হবে সন্দেহ নেই।
বাজারের চাহিদা ভিত্তিক প্রযুক্তির বিকাশ সর্বত্রই প্রথমে অন্তত অসাম্যকে বাড়িয়ে তোলে, কিন্তু জিন টেলরিং হয়তো তাকে সম্পূর্ণ অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে। এর সঙ্গে তুলনীয় সমস্যা আমরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স আলোচনার সময় দেখেছি যখন একমাত্র খুব স্পেশালাইজেশন ছাড়া অধিকাংশ পেশাতেই মানুষের প্রয়োজন হবে না, তখনও একধরনের নব্য অভিজাত শ্রেণি তৈরি হতে পারে। অভিজাতই বলুন আর সুপারহিউম্যানই বলুন, তাদের প্রতি পিছিয়ে পড়াদের ক্ষোভ বাড়বে সন্দেহ নেই। একটা চিত্র কল্পনা করা যাকসময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বয়স বাড়ে, আমরা বৃদ্ধ হই ও মারা যাই। এই বৃদ্ধ হওয়া ঠেকানোর জন্য নানা গবেষণা চলছে। সফল হলে মানুষ দুর্ঘটনা বা হিংসার কারণে মৃত্যুকে এড়াতে পারবে না, কিন্তু বয়সজনিত কারণে মারা যাবে না। ধরুন কোথাও সাফল্য এলো। প্রাথমিক ভাবে সেই পদ্ধতি নিশ্চয় ব্যয়সাধ্য হবে। সে ক্ষেত্রে এমন হতেই পারে যে তা খুব সীমিত সংখ্যক ক্ষমতাবান মানুষের দখলে গেল এবং তারা সেই পদ্ধতির সুযোগ থেকে বাকিদের বঞ্চিত করল। সেই বঞ্চিতদের মধ্যে যে বিক্ষোভের জন্ম নেবে, তা সভ্যতাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার শক্তি রাখে। এই উদাহরণটা হয়তো খুব কষ্টকল্পনা, কিন্তু মানুষে মানুষে পার্থক্য যদি বাড়তে থাকে এবং তার যদি জৈব ভিত্তিও তৈরি হয়, তাহলে এই দৃশ্যের বাস্তবে অভিনয় হওয়া বিচিত্র নয়। সেই রকম কোনো যুদ্ধে যদি বায়োলজিক্যাল অভিজাতরা জয়লাভও করে, তাদের আবার অন্য এক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণে জিনগত বৈচিত্র্যের অভাব যে কোনো প্রজাতিকে লুপ্ত হওয়ার পথে ঠেলে দেয়। সচেতনভাবে বংশপরম্পরায় একই বৈশিষ্ট্যের পুনরাবৃত্তি এবং সীমিত সংখ্যক মানুষের মধ্যে থেকে সন্তান উৎপাদন কিন্তু জিনগত বৈচিত্র্যের মূলে কুঠারাঘাত করবে সুতরাং অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে তবেই জিন টেলরিঙের পথে এগোনো উচিত।
*      *      *

এই লেখাতে যে সমস্ত সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা আলোচনা করা হল, তাদের মধ্যে কিছু কিছু বাস্তবে রূপ পেয়েছে, অনেকগুলিই আবার অনুমানসন্দেহ নেই বিজ্ঞানপ্রযুক্তি নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করতে যাওয়া অনেকটা সাহসের কাজ, বা মতান্তরে মূর্খতা। যে সম্ভাবনাগুলো আলোচনা হল, তাদের অনেকগুলো হয়তো কোনোদিনই বাস্তবায়িত হবে না। কিন্তু তা বলে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকাটা বোকামি হবে। এটাও সত্যি যে কোনো কিছু আমার মনোমত না হলেই তা ভুল প্রমাণিত হয় না। বুঝতে অসুবিধা নেই যে এই নতুন প্রযুক্তিরা যে সমস্ত সমস্যার জন্ম দিচ্ছে তাদের চরিত্র আগের যুগের থেকে অনেক আলাদা। সেজন্য আগের যুগের সমাধানও হয়তো অচল। এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে শুধুমাত্র বিজ্ঞানপ্রযুক্তির কাঠামোর মধ্যে এই সমস্যাদের সমাধান করা যাবে না। তাই বিষয়টাকে শুধু বিজ্ঞানীদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার দিন বিগত হয়েছে, এই বিতর্কে সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
      

তথ্যসূত্র
·        Homo Deus: A Brief History of Tomorrow, Yuval Noah Harari, Harvill Secker, 2016
·        Introducing Artificial Intelligence, Henry Brighton and Howard Selina, Icon Boks UK, 2007
·        Smarter than Us: The Rise of Machine Intelligence, Stuart Armstrong, Machine Intellidgence Research Unit, Berkley, 2014
·        Weird Maths: At the Edge of Infinity and Beyond, David Darling and Agnijo Banerjee, OneWorld 2018
·        Cloning around: The Ethics of Human Cloning and Stem Cell Research, Robin Craig, ThoughtWare Australia, 2012
·        Cloning: A Beginner’s Guide, Aaron D. Levine, OneWorld, 2007
·        The Future is Coming, Stephen L Thompson, Kindle ebook 2016
·        Negotiating Bioethics: The Governance of UNESCO’s Bioethics Programme, Adele Langlois, Routledge, 2013
·        The Selfish Gene, Richard Dawkins, Oxford, 30th Anniversery Edition 2006
এছাড়াও ইন্টারনেট থেকে বহু তথ্য নেওয়া হয়েছে।

প্রকাশঃ পরিকথা মে ২০১৯