Saturday 10 July 2021

এক বইমেলার গল্প

 

এক বইমেলার গল্প

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       কলকাতা বইমেলা এখন দুর্গাপুজো আর কালীপুজোর পরেই কলকাতার সেরা উৎসব। কলকাতার বাংলা বইয়ের ব্যাবসা এই মেলার উপর অনেকটাই নির্ভর করে। বইমেলাতে সময়মতো বই প্রকাশের জন্য এই সময়ে কাজের চাপে কলকাতা বা অন্যান্য জেলার প্রকাশক মুদ্রক বাঁধাইকারীদের, এমনকি অনেক লেখক-কবিদেরও, রাতের ঘুম চলে যায়।

       তবে এই সব ঘটনা নতুন নয়। অনেক বছর আগের মেলাতে বইপ্রকাশের একটা গল্প বলি। লেখক যেদিন ছাপাখানাতে তাঁর পাণ্ডুলিপি নিয়ে যান, সেদিনটা ছিল ৩১ জানুয়ারি। শেষ পর্যন্ত কোয়ার্টো সাইজের মাত্র ষাট পাতার বই হলে কি হবে, লেখকের নানা আবদারের জন্য ছাপানোর ঝামেলা মোটেই কম ছিল না। এই গল্প কম্পিউটার আবিষ্কারের আগের যুগের কথা, তখন লেটার প্রেসে বই ছাপা হত। বইমেলার আর মাত্র কদিন বাকি, তার আগে সমস্ত  বই ছাপাতে হবে। অথচ পাণ্ডুলিপি তখনো পুরোপুরি রেডি নয়, তাই টানা কম্পোজ করলে চলবে না, কোন পাতার পরে কোন পাতা কম্পোজ করতে হবে তা লেখক বলে দেবেন। তিনি  মাঝখানে আরও ম্যাটার যোগ করবেন। মেলাতে বই পাঠাতেও সময় লাগবে, অথচ মেলার দু‘সপ্তাহ আগেও বইয়ের নাম নিয়ে লেখক সংশয়ে। সুতরাং বইয়ের প্রথম পাতা আগে ছাপা যাবে না। বইয়ের মধ্যে পাঁচটা ফাঁকা জায়গা রাখতে হবে, পরে সেখানে ছবি বসানো হবে। লেখক জলরঙে ছবি আঁকবেন, তারপরে তার থেকে এচ করে ছাপাতে হবে।

       এই পর্যন্ত পড়ে কিছুদিন আগের পরিস্থিতির সঙ্গে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া নিশ্চয় অস্বাভাবিক নয়। অফসেট ডিটিপি ইত্যাদি তো এই সেদিন শুরু হল, তার আগে বই লেটার প্রেসেই ছাপা হত। সেখানে ইচ্ছামতো পরিবর্তন করা খুবই দুঃসাধ্য ছিল। মুদ্রক বা প্রকাশক কি আজকের দিনের মতোই ভেবেছিলেন, এই মেলাতেই বইটা প্রকাশিত না হলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? 

       শুধু লেখকের নানা আবদার নয়, বই ছাপার ক্ষেত্রে অন্য সমস্যাও কম ছিল না। প্রকাশক হিসাবে যাঁর নাম ছিল, তিনি অন্যের হয়ে কাজ করছিলেন। কিছু ক্ষমতাবান লোকের বিরাগভাজন হয়ে গ্রেপ্তারের ভয়ে নাম ভাঁড়িয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন আসল প্রকাশক। ছাপানোর খরচ পাবেন কিনা, তাই নিয়েও প্রকাশকদের সন্দেহ ছিল। লেখকের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ --  অকর্মা ভাইয়ের দেখাশোনা করতে হয়, তিন সন্তান ও সহধর্মিণীকে নিয়ে নিজের পরিবার, আবার বোনের বিয়ের জন্য টাকা জোগাড় করতে হচ্ছে। লেখকের এক পুরানো ছাত্র এখন বিরাট লোক, তাঁর কাছে তিনি সাহায্যের আশায় আছেন। যদি সফল হন, তাহলে বই তাঁকেই উৎসর্গ করবেন, সেক্ষেত্রে আবার কিছু কিছু ব্যাপারে তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। ছাত্রের চিঠি আসতে দেরি হচ্ছিল, বাধ্য হয়ে লেখক প্রথম পাতা কম্পোজ করিয়ে ফেলেছিলেন। ছাত্রের সম্মতির সঙ্গে এলো কিছু শর্ত, সুতরাং প্রথম পাতাটা পাল্টাতে হল। শেষ ম্যাটার ছাপাখানাতে পৌঁছোয় ২ মার্চ, আর বই প্রকাশিত হয় ১৩ মার্চ। এত রকম ঝামেলার মধ্যে দিয়ে বই ছাপিয়ে লেখক কি পৃথিবী উদ্ধার করতে চাইছেন?

       পৃথিবীর সব থেকে বড় বইমেলা হয় ফ্রাঙ্কফুর্টে, লেখক সেখানেই বই প্রকাশ নিয়ে ব্যস্ত হয়েছিলেন। আর সময়? কলকাতা বইমেলা শুরু হয়েছিল ১৯৭৬ সালে; ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার কাছে সে নিতান্তই শিশু। ঠিক কবে থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলা শুরু তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ১৪৬২ সালের মধ্যে নাগাদ তা নিঃসন্দেহে বইমেলা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। অবশ্য দ্বাদশ শতাব্দীতেই ফ্রাঙ্কফুর্টের সাধারণ মেলাই হাতে লেখা পুঁথি কেনা বেচার জন্য পরিচিত ছিল। তবে স্বাভাবিক ভাবেই হাতে লেখা বই ছিল অত্যন্ত দামী, সাধারণের নাগালের বাইরে। জোহানেস গুটেনবার্গ ইউরোপে আধুনিক ছাপাখানা তৈরি করেছিলেন ১৪৪০-৫০ সালে, তারপরেই বইয়ের দাম কমে এবং বই প্রকাশনাতে জোয়ার আসে। গুটেনবার্গের ছাপাখানা ছিল মেইঞ্জে, ফ্রাঙ্কফুর্টের থেকে তার দূরত্ব পঞ্চাশ কিলোমিটারও নয়। আমরা যে গল্প বলছি তা হল ১৬১০ সালের।

       বই তো শুধু ছাপালেই হবে না, তাকে নিয়ে যেতে হবে মেলাতে। তখন পরিবহন ব্যবস্থার একেবারে শৈশব অবস্থা। বই ছাপা হল ইতালির ভেনিসে। আসল প্রকাশক ও মুদ্রক রবার্টো মেরিয়েত্তি ভেনিসের হয়ে রোমের ভ্যাটিকানের সমালোচনা করে পোপের বিরাগভাজন। তাঁর হয়ে কাজ করছিলেন টম্মাসো ব্যাগলিয়নি, তিনিই আল্পস পর্বত পেরিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্টে বই পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।

       এত ঝামেলা সামলে ফ্রাঙ্কফুর্টে বই পাঠানোর কারণ হল সেই সময়েই ইউরোপে ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা ছিল বিখ্যাত। খবরের কাগজ রেডিও টিভি ইন্টারনেটের যুগের আগে বইয়ের খবর পাওয়া ছিল কঠিন। ফ্রাঙ্কফুর্টের মেলাতেই বইয়ের প্রচার হত, পণ্ডিতরা খবর নিতেন, ইউরোপের নানা দেশের রাজারাও বই কেনার জন্য সেখানে প্রতিনিধি পাঠাতেন। তাই লেখক প্রকাশকরা সেখানে বই পাঠানোর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতেন। সারা ইউরোপ থেকে বই যেত ফ্রাঙ্কফুর্টে। আমাদের লেখকও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না, যে করেই হোক সময়মতো বইমেলাতে প্রকাশের জন্য তিনি মরিয়া ছিলেন। এত তাড়া কিসের?

       পাঠকদের অনেকেই এর মধ্যে ধরে ফেলেছেন, সত্যিই সেই লেখকের নতুন অনেক কিছু বলার ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসের মোড় ফিরিয়ে দিয়েছে যে সমস্ত বই, তার মধ্যে পড়বে ১৬১০ সালের সেই ষাট পৃষ্ঠার প্রকাশনা। বইটি মানুষের ইতিহাসে এতই গুরুত্বপুর্ণ যে কয়েক বছর আগে তার একটি প্রুফ কপি পাঁচ লক্ষ ডলারে বিক্রি হয়েছিল। পরে অবশ্য প্রমাণিত হয়েছে যে সেটি জাল, তবে সে আলাদা গল্প। লেখক আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম জনক গ্যালিলিও গ্যালিলি, আর সেই বইয়ের নাম Sidereus Nuncius। লাতিন শব্দদুটোর অর্থ করা যেতে পারে নক্ষত্রলোকের দূত (কিংবা বার্তা)।

       কী ছিল বইতে? ঠিক আগের বছর গ্যালিলিও তাঁর নিজের তৈরি দুরবিন দিয়ে রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করেছিলেন; তিনি মহাবিশ্বের যে সমস্ত নতুন নতুন বিস্ময়ের সম্মুখীন হয়েছেন, তাই সেই বইতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। প্রাচীন গ্রিসের বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটলের দীর্ঘ ছায়া বিজ্ঞানকে মধ্যযুগের ইউরোপে ও তারও আগে আরবে যে কানাগলিতে নিয়ে গিয়েছিল, তার থেকে বের করে এনেছিল ওই কটি পাতা। অ্যারিস্টটলিয় বিশ্ববীক্ষার মূল কথা ছিল কতগুলি মৌলিক স্বতঃসিদ্ধ থেকে যে কোনো জ্ঞান অর্জন সম্ভব। এই অবরোহী যুক্তি আধুনিক বিজ্ঞানে অচল, তার জায়গা নিয়েছে  পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা এবং আরোহী যুক্তি। অ্যারিস্টটলকে ভুল প্রমাণ করতে না পারলে আধুনিক বিজ্ঞানের পক্ষে সাবালকত্ব লাভ করা সম্ভব হত না। কাজটা সহজ ছিল না, সময় লেগেছিল অনেক।    মধ্যযুগে ইউরোপে ও তার আগে আরবে The Philosopher বলতে একজনকেই বোঝাত, অ্যারিস্টটল। তাঁর কথা অনুসরণ করে খ্রিস্টান চার্চ বলত আকাশের জ্যোতিষ্করা সবাই নিখুঁত ও অপরিবর্তনীয়। পৃথিবী অন্য সমস্ত জ্যোতিষ্কদের থেকে আলাদা, পাপ ও ক্লেদে ভরা পৃথিবীর কোনো আলো নেই। চাঁদ পৃথিবীর কাছে আছে, পৃথিবীর প্রভাব তার উপর পড়েছে। তাই তার নিজের আলো নেই। মাটির পৃথিবীই একমাত্র পরিবর্তনশীল; আকাশের জ্যোতিষ্করা অপরিবর্তনীয়, বিধাতার অমোঘ নিয়মে মেনে চলে। তাদের সকলের গতি বৃত্তাকার পথে, কারণ বৃত্ত হল একমাত্র নিখুঁত আকৃতি। পৃথিবী আছে বিশ্বের কেন্দ্রে, তার পরে চাঁদ, অন্যান্য গ্রহ এবং সবশেষে নক্ষত্রেরা। বিশ্বের এই মডেলে তারও বাইরে খ্রিস্টধর্মের স্বর্গ ও নরকের জন্য অনেকটা জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল।

       দূরবিন দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে গ্যালিলিও দেখলেন তা মোটেই এক মসৃণ গোলক নয়, পাহাড় পর্বত ও গহ্বরে পূর্ণ। শুক্র গ্রহের দিকে দুরবিন ফেরালেন গ্যালিলিও, দেখলেন চাঁদের মতো শুক্রের কলা আছে। অর্থাৎ শুক্রের নিজের আলো নেই। পৃথিবী তাহলে অন্য গ্রহদের থেকে আলাদা কিছু নয়। বৃহস্পতিকে ভালো করে দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন তার চারটি উপগ্রহ। বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে যদি উপগ্রহরা পাক খেতে পারে, তাহলে পৃথিবী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র না হতেও পারে। রাতের আকাশে দুধ-সাদা আকাশগঙ্গার দিকে দূরবিন ফেরালেন, দেখলেন তা হল অসংখ্য নক্ষত্রের সমষ্টি। খালি চোখে মোটামুটি ছ’হাজার নক্ষত্র দেখা যেত, সংখ্যাটা তার থেকে বেশি যে হতে পারে এতদিন পর্যন্ত সে কথা কেউ চিন্তাও করেন নি। শুধু তাই নয়, গ্যালিলিওই প্রথম  বুঝলেন যে আকাশগঙ্গার নক্ষত্ররা এত দূরে আছে যে খালি চোখে তাদের আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। অর্থাৎ এই একটি পর্যবেক্ষণই মহাবিশ্বের আয়তনকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিল। এই বিরাট ব্রহ্মাণ্ডে পৃথিবীর স্থান অতি নগণ্য। তাহলে কি কোপার্নিকাসই ঠিক বলেছেন, চার্চ ভুল; পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে পাক খাচ্ছে? গ্যালিলিওর আগেও কেউ কেউ বিজ্ঞানকে অ্যারিস্টটলের প্রভাব থেকে বার করে আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিমূর্ত যুক্তি এক, আর নিজের চোখে দেখা আলাদা; সরাসরি পর্যবেক্ষণের বর্ণনা ছিল বলে অ্যারিস্টটলের বিজ্ঞানকে আগে কেউ এই বইয়ের মতো আঘাত করতে পারেনি। অবস্থা এমনই হয়েছিল যে অ্যারিস্টটলের দর্শনে পণ্ডিতরা দূরবিনের ভিতর দিয়ে গ্রহতারাদের দিকে তাকাতেই অস্বীকার করেছিলেন।

       গ্যালিলিও জানতেন যে আরও অনেকেই দূরবিন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করেছেন, আবিষ্কারের ক্ষেত্রে নিজের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে তাঁদের সকলের আগে বই প্রকাশ ছিল জরুরি। তাই একদিকে কম্পোজের কাজ চলছিল, অন্যদিকে গ্যালিলিও তাঁর পর্যবেক্ষণ লিখে লিখে বইতে ঢোকানোর জন্য ছাপাখানাতে পাঠাচ্ছিলেন। গ্যালিলিও বেশ হিসেব করে চলতেন। তিনি একসময় অঙ্ক শিখিয়েছিলেন কসমো দি মেদিচিকে, ১৬১০ সালে গ্র্যান্ড ডিউক কসমো হয়েছেন সেই যুগের সব থেকে ধনী শহর ফ্লোরেন্সের শাসক। গ্যালিলিও ফ্লোরেন্সেরই লোক, তিনি কসমোর দরবারে চাকরির প্রত্যাশা করছিলেন। কসমোর কাছে তিনি প্রস্তাব করলেন যে বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহের নাম দেবেন Cosmica Sidera, কসমোর তারা। কসমোকে বাঁধাই না করা কিছু পাতা ও দূরবিন পাঠাতেও তাঁর ভুল হয় নি। কসমোর চিঠি এলো ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ, উপগ্রহদের নাম দিতে হবে Medicea Sidera, মেদিচিদের তারা। বইয়ের প্রথম পাতা আবার পালটাতে হল।  তবে সমস্ত পরিশ্রম সার্থক হয়েছিল। নক্ষত্রলোকের দূত অল্প দিনের মধ্যে গোটা ইউরোপের পণ্ডিতমহলে বিখ্যাত হয়ে পড়েছিল। শুফহু পণ্ডিতদের কথাই বা বলি কেন? বইয়ের জনপ্রিয়তার একটা মাপকাঠি হল তার পাইরেটেড বা বেআইনি সংস্করণ প্রকাশ। তখনো  তা খুব একটা চালু হয়নি, কিন্তু গ্যালিলিওর বইয়ের চাহিদা দেখে সেই বছরই ফ্রাঙ্কফুর্টের এক প্রকাশক তার পাইরেটেড কপি ছেপে ফেলেছিলেন। 



       কলকাতা বইমেলাতে কিছু লেখক মাঠে ঘুরে ঘুরে নিজেদের বই বিক্রি করেন। সাধারণত অধিকাংশ মানুষই তাঁদের এড়িয়ে যান। যদি কোনোদিন শোনেন যে আপনাকে যে অচেনা লোকটি বই কেনার অনুরোধ করেছিলেন এবং আপনি পাত্তাই দেননি, তিনি পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের একজন – কেমন লাগবে? গ্যালিলিওর যুগে তাঁর সমকক্ষ বিজ্ঞানী একজনই ছিলেন – জোহানেস কেপলার। স্কুলে কেপলারের গ্রহদের গতিবিধি সংক্রান্ত সূত্র আমাদের অনেককেই পড়তে হয়েছে। সেই কেপলার ফ্রাঙ্কফুর্টের মেলাতে পরিচয় লুকিয়ে নিজের বই বিক্রি করেছিলেন। সেই গল্পটাই এখন বলি।

       ফ্রাঙ্কফুর্টের মেলাতে কেপলারের নাম পরিচিত ছিল। ১৫৬৪ সাল থেকেই বইমেলাতে ক্যাটালগ ছাপা হত, মেলাতে না যেতে পারলেও পণ্ডিতরা তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। ১৬০৮ সালে বিজ্ঞানী ফেব্রিসিয়াস কেপলারকে চিঠিতে লেখেন ফ্রাঙ্কফুর্টের ক্যাটালগ থেকে তিনি দেখেছেন যে কেপলারের De Stella Nova অর্থাৎ নতুন তারা বইটি প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু তিনি সেটি জোগাড় করতে পারছেন না। ১৬০৪ সালে আকাশে যে নতুন তারা দেখা গিয়েছিল, তার সম্পর্কে কেপলারের পর্যবেক্ষণ এই বইতে তিনি লিখেছিলেন। একে আমরা এখন কেপলারের সুপারনোভা বলি, আমরা জেনেছি এ ছিল এক নক্ষত্রের মৃত্যুকালীন বিস্ফোরণ। আবার ১৬০৯ সালে কেপলার অপর এক বিজ্ঞানী টমাস হ্যারিয়টকে লিখছেন যে ফ্রাঙ্কফুর্টের ক্যাটালগ থেকে তিনি জানতে পেরেছেন যে তাঁর নতুন বই Astronomia Nova অর্থাৎ নতুন জ্যোতির্বিদ্যা বইটি প্রকাশিত হয়ে গেছে, কিন্তু তার কোনো কপি তখনো কেপলারের হাতে আসেনি। (আজকের যুগের সঙ্গে মিল খুঁজে পেলেন নাকি?) কেপলারের গ্রহদের গতিবিধি সংক্রান্ত কেপলারের তিনটি বিখ্যাত সূত্রের প্রথম দুটি এই বইতেই তিনি প্রকাশ করেছিলেন।

       কেপলারও অবশ্যই সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের কথাই লিখেছিলেন, কিন্তু তাঁর বই ছিল জটিল গণিতে ভর্তি। নক্ষত্রলোকের দূত-এ সরাসরি পর্যবেক্ষণের কথা ছিল, তার সঙ্গে যোগ করতে হবে গ্যালিলিওর লেখার প্রসাদগুণ ও তাঁর আত্মপ্রচারের ক্ষমতা, এ জন্য গ্যালিলিওর বইয়ের প্রভাবই সমকালীন মানুষদের উপর বেশি পড়েছিল। তবে আধুনিক বিজ্ঞানে কেপলারেরও বিশাল অবদান আছে। তিনি দেখিয়েছিলেন যে গ্রহরা মোটেই বৃত্তাকার পথে চলে না, তাঁর প্রথম সূত্রেই আছে উপবৃত্তের কথা। এ ছিল অ্যারিস্টটলের বিজ্ঞানের উপর আরেক আঘাত। কেপলারের সূত্র থেকেই শেষ পর্যন্ত নিউটন মাধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিষ্কার করেন।

       কেপলার ছিলেন Holy Roman Empire বা পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের রাজদরবারের জ্যোতির্বিদ। তাঁর আগে সেই পদে ছিলেন আর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহে, কেপলার তখন ছিলেন টাইকোর সহকারী। গ্রহদের গতিবিধি সংক্রান্ত যে বিশাল তথ্যভাণ্ডার টাইকো সারাজীবন ধরে পর্যবেক্ষণ করে সঞ্চয় করেছিলেন, ১৬০১ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে তা প্রকাশের দায়িত্ব পড়ে কেপলারের উপর। সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফের আদেশ কেপলার অমান্য করতে না পেরে এই বিশাল জটিল ও পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজে হাত দেন।

       ১৬১২ সালে দ্বিতীয় রুডলফের মৃত্যু হয়। কেপলারের কাজ শেষ হয় ১৬২৩ সালে, কিন্তু পরবর্তী সম্রাটদের কোষাগার থেকে বই ছাপানোর খরচ দূরে থাক, কেপলারের মাইনেই নিয়মিত আসছিল না। এক বছর ধরে কেপলার এক শহর থেকে আরেক শহরে সম্রাটের নানা অফিসে ঘুরে বেড়ান। তাঁর পাওনা ছিল ৬২৯৯ স্বর্ণমুদ্রা, অনেক পরিশ্রমের পর তিনি ২০০০ স্বর্ণমুদ্রা আদায় করতে সক্ষম হন। তাই দিয়ে শুধু কাগজের দাম ওঠে, ছাপার খরচ কেপলারকেই দিতে হয়। মুদ্রক জোনাস সাউরের সঙ্গে বারবার ঝগড়াঝাটির পরে শেষ পর্যন্ত ১৬২৭ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলার ঠিক আগে এক হাজার কপি ছাপানো সম্ভব হয়েছিল। তার নাম দেওয়া হয়েছিল Tabulae Rudolphinae, অর্থাৎ রুডলফের টেবিল।



      কেপলার ফ্রাঙ্কফুর্টের মেলাতে একাধিকবার গিয়েছিলেন। যেমন ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দের মেলাতে তিনি একটি বিশেষ বইয়ের সন্ধান পান যা তাঁর চিন্তাধারাকে বিশেষ প্রভাবিত করেছিল বলে তিনি নিজেই লিখেছেন। কাজেই মেলাটা তিনি চিনতেন। বইয়ের সমস্ত কপিই তিনি বইমেলাতে বিক্রির নিয়ে যান। সব খরচই দিয়েছিলেন কেপলার, কিন্তু আইনমাফিক দেখলে বই ছিল সম্রাটের সম্পত্তি। তাই কেপলার নিজের পরিচয় না দিয়ে মেলাতে সেই বই বিক্রি করতে থাকেন। কেপলার এই টেবিল তৈরি করছেন সেই খবর আগে থেকেই প্রচারিত হয়েছিল; শুধু জ্যোতির্বিদ বা জ্যোতিষীরা নয়, আরও অনেকেই এই টেবিলের অপেক্ষায় ছিলেন। সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্য চন্দ্রের সাপেক্ষে গ্রহদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে টেবিলের সঙ্গে তুলনা করে পৃথিবীতে কোন জায়গা থেকে দেখা হচ্ছে তা নির্ধারণ করা সম্ভব; আধুনিক যুগে জিপিএস কিছুটা এই ধরণের পদ্ধতি অবলম্বন করে। সমুদ্রপথে জাহাজের ক্ষেত্রে রুডলফের টেবিল তাই খুবই কাজ লাগত। এই সমস্ত কারণে বইয়ের চাহিদা এত বেশি ছিল যে এক হাজার কপিই মেলাতে বিক্রি হয়ে যায়।

       ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলার ইতিহাসে আরও অনেক বিজ্ঞানের বইয়ের গল্প পাওয়া যায়। মধ্যযুগে ইউরোপে প্রকাশিত সমস্ত বই কোনো না কোন সময় মেলাতে পাওয়া যেত। প্রচারের উপায় বেশি না থাকাতে পণ্ডিতরা নতুন বইয়ের খবর পেতে ও অন্যকে নিজের বইয়ের খবর পৌঁছে দিতে এই বইমেলার দিকেই তাকিয়ে থাকতেন। বইমেলাতে বই পাঠিয়ে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে নিজেদের অগ্রাধিকারকেও প্রতিষ্ঠিত করতেন। তাই আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মের সঙ্গে ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলার এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। সে অন্য কথা, কিন্তু পরের বইমেলাতে কোনো অচেনা লেখক তাঁর বই কিনতে বললে কেপলারকে মনে পড়বে কি? কিংবা, লেখক যদি দেরিতে পাণ্ডুলিপি দিয়েও বইমেলাতেই সময়মতো প্রকাশের জন্য অনুরোধ করেন, তখন কি গ্যালিলিওর কথা মনে আসবে?

      


No comments:

Post a Comment