Sunday, 1 December 2024

পরিবর্জন নীতির শতবর্ষে বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলি

 

পরিবর্জন নীতির শতবর্ষে বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলি

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


 

()

কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্ম ১৯০০ সালে; তাকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতে পরিবর্তিত করতে চিরায়ত পদার্থবিদ্যার ধ্যানধারণাকে বিসর্জন দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। মাক্স প্লাঙ্ক, আলবার্ট আইনস্টাইন, নিলস বোর, আর্নল্ড সমারফেল্ড প্রমুখের গবেষণা চিরায়ত বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা দেখাচ্ছিল, পরের প্রজন্মের পদার্থবিদরা সেই সীমাবদ্ধতাকে স্মরণে রেখেই বিজ্ঞানের জগতে পা রেখেছিলেন। তাই হয়তো তাঁদের পক্ষে চিরায়ত বিজ্ঞানের সঙ্গে বিচ্ছেদ সহজতর হয়েছিল। এই তরুণদের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য ছিলেন উলফগ্যাং পাউলি, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এবং পল ডিরাক। পঁচিশ বছর বয়সের আগেই তাঁরা তাঁদের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজগুলি করেছিলেন। এঁদের মধ্যে সব থেকে বড় ছিলেন পাউলি, আবার এঁদের মধ্যে কোয়ান্টাম তত্ত্বে তিনিই প্রথম অবদান রেখেছিলেন। তা৬র এক বিশেষ আবিষ্কারের শতবর্ষে আমরা প্রবেশ করেছি। এই লেখাতে আমরা তাঁর সম্পর্কে শুনব।

পাউলির জন্ম ভিয়েনাতে ১৯০০ সালের ২৫ এপ্রিল। তাঁর বাবার নামও উলফগ্যাং, তিনি ছিলেন ডাক্তার, কিন্তু চিকিৎসা পেশা ত্যাগ করে গবেষণাতে যোগ দিয়েছিলেন, এবং ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ইন্সটিটিউটের অধিকর্তা হয়েছিলেন। মা বার্থা ছিলেন সুপরিচিত লেখিকা ও সাংবাদিক। ছোটবেলা থেকেই সবাই বিশ্বাস করতেন পাউলি এক বিরল প্রতিভা, পাউলির নিজেরও তাই নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। গল্প আছে মাত্র বারো বছর বয়সে পাউলি সমারফেল্ডের বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলেন, ছোট্ট পাউলিকে সমারফেল্ড জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সব বুঝতে পারছ? পাউলি বললেন, “হ্যাঁ, খালি বোর্ডের ওই উপরের ডানদিকের সমীকরণটা ছাড়া।“ সমারফেল্ড ঘুরে দেখে বললেন, “ওহো, ওটা ভুল লিখেছি।“ এটা খুব সম্ভবত গল্পই, কিন্তু তা হলেও পাউলিকে বুঝতে কাজে লাগে।

১৯১৮ সালে পাউলি মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, আকর্ষণ সেই সমারফেল্ড। সমারফেল্ড বুঝলেন পদার্থবিদ্যা ও গণিতের প্রায় সব কিছু জেনেই পাউলি মিউনিখে এসেছেন। সঙ্গে করে এনেছিলেন সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে একটা গবেষণাপত্র। আঠারো বছর বয়সী পাউলির গবেষণাপত্রটির প্রশংসা করেন সেই তত্ত্বের স্রষ্টা আইনস্টাইন স্বয়ং। ১৯১৯ সালে পাউলি সেই বিষয়ে তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সমারফেল্ডের উপর সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রবন্ধ লেখার দায়িত্ব পড়ে, সমারফেল্ড পাউলিকে বলেন তাঁরা দু’জনে মিলে সেটি লিখবেন। কিন্তু পাউলির প্রথম ড্রাফ্‌টই এত ভালো হয় যে সমারফেল্ড তাতে হাত না দিয়ে পাউলির নামেই সেটি ছাপতে পাঠিয়ে দেন। দু’শো সাঁইত্রিশ পাতার সেই প্রবন্ধটি সমারফেল্ড ছাড়াও মাক্স বর্ন ও এরউইন শ্রয়ডিঙ্গারের মতো প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীর সমীহ আদায় করে নিয়েছিল। আইনস্টাইন ছাপার অক্ষরে পাউলির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।

এর পরেই পাউলি সাধারণ আপেক্ষিকতাকে সাময়িকভাবে ত্যাগ করে পরমাণু ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের দিকে মন দেন। সমারফেল্ডের সঙ্গে কাজ করে তিনি একুশ বছর বয়সে এই বিষয়ে ডক্টরেট করলেন। এর পর পাউলি গটিনগেনে মাক্স বর্নের সহকারী হিসাবে যোগ দেন। এক বছর তিনি সেখানে ছিলেন, বর্নের সঙ্গে মিলে তিনি হিলিয়াম পরমাণুর ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগের এক নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এর পর হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক মাস কাটানোর পরে বোরের আমন্ত্রণে কোপেনহাগেন যান। বোরের আমন্ত্রণের উত্তর পাউলি যে ভাষায় দিয়েছিলেন, তাও তাঁকে বুঝতে আমাদের সাহায্য করে; “কোপেনহাগেনে বিজ্ঞান বিষয়ে আপনার চাহিদা পূরণের বিষয়ে আমি কোনো সমস্যার আশঙ্কা করছি না, কিন্তু ড্যানিশের মতো বিদেশী ভাষা শেখাটা আমার কাছে সত্যিই সমস্যা হবে।“ পরে তিনি স্বীকার করেছিলেন যে দুই ক্ষেত্রেই তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। কোপেনাহাগেনে এক বছর কাটিয়েছিলেন, তার মধ্যেই তিনি বোরের মনে যে দাগ কেটেছিলেন তা অভূতপূর্ব। এরপর তিনি ১৯২৩ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান।

হামবুর্গে থাকাকালীন ১৯২৫ সালে পাউলি তাঁর জীবনের সব থেকে বিখ্যাত কাজটা করেছিলেন, যা তাঁকে কুড়ি বছর পরে নোবেল পুরস্কার এনে দেবে। আমরা মেন্দেলিয়েভের পর্যায় সারণীর কথা জানি, সেখানে মৌলিক পদার্থগুলি তাদের ধর্ম অনুসারে সাজানো থাকে। নিচে আধুনিক পর্যায় সারণির একটি রূপ দেখানো হল।


পর্যায় সারণী
    দেখা যাচ্ছে যে প্রথম সারিতে দু’টি মৌল জায়গা পেয়েছে, দ্বিতীয় সারিতে আটটি, তৃতীয় সারিতে আটটি, চতুর্থ সারিতে আঠারোটি, এভাবে মৌলিক পদার্থগুলি সাজানো থাকে। সারির একেবারে শেষে আছে নিষ্ক্রিয় গ্যাসেরা, তাদের পরমাণু ক্রমাঙ্ক বা পরমাণুর ইলেকট্রনের সংখ্যা হল যথাক্রমে 2, 10, 18, 36, 54 86। এই সংখ্যাগুলোর থেকে একটা ইলেকট্রন বেশি হলেই আমরা পাই লিথিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদি ক্ষার ধাতু; আবার একটা ইলেকট্রন কম হলেই পাই হয় হাইড্রোজেন, নয়তো ফ্লোরিন, ক্লোরিন, ব্রোমিন ইত্যাদি হ্যালোজেন মৌল। এরা সবাই রাসয়ানিক বিক্রিয়াতে অত্যন্ত সক্রিয়, অথচ নিষ্ক্রিয় গ্যাসরা বিক্রিয়া করতেই চায় না।

বোর ১৯২২ সালে তাঁর পরমাণুর মডেল থেকে পর্যায় সারণীর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। বোরের মডেলে ইলেকট্রনেরা কতগুলো কক্ষপথে অবস্থান করে। বোর বললেন যে পরমাণুর বাইরের কক্ষপথ যদি পুরোপুরি ভর্তি হয়, তাহলে সে খুব সুস্থিত, ফলে বিক্রিয়াতে অংশ নিতে চায় না। এর পরে একটা ইলেকট্রন যোগ করলে সে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিতে বাঁধা পড়ে, তাই পরমাণু চট করে তাকে ছেড়ে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মতো হতে চায়। আবার একটা ইলেকট্রন কম থাকলে অন্য মৌলের পরমাণু থেকে ইলেকট্রন ছিনিয়ে নিয়ে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রন বিন্যাস নেয়। ফলে ক্ষার ধাতু বা হ্যালোজেনরা অত্যন্ত সক্রিয়। কিন্তু নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রনের সংখ্যা কেন 2, 10 ইত্যাদি হবে তার ব্যাখ্যা বোর দেননি।

এডমন্ড স্টোনার বেশি বয়সে কেমব্রিজে ডক্টরেট করছিলেন। ১৯২৪ সালে তিনি প্রস্তাব করেন যে পর্যায় সারণীতে যতগুলি ঘর থাকে, ইলেকট্রনরা ততগুলি শক্তিস্তরেই থাকতে পারে। সেখানে বোর-সমারফেল্ড মডেল তিনি কাজে লাগান। ধরা যাক মুখ্য কোয়ান্টাম সংখ্যা হল n, সেক্ষেত্রে l-এর মান হয় 0, 1, 2... (n-1); আবার প্রতিটি l–এর জন্য (2l+1) সংখ্যক m কোয়ান্টাম সংখ্যা হতে পারে। সুতরাং কোনো বিশেষ n-এর জন্য মোট শক্তিস্তরের সংখ্যা পাওয়ার জন্য যতগুলি l আছে, তাদের প্রত্যেকের জন্য (2l+1) –কে যোগ করতে হবে। যোগফলটা খুব সোজা, তার মান n2। এখান n–এর জায়গায় 1 বসালে পাব 1, আবার 2 বসালে পাব 4, তেমনি 3 বসালে পাব 9। পর্যায় সারণীতে প্রথম সারিতে 2–টি, দ্বিতীয় সারিতে 8–টি, চতুর্থ সারিতে 18-টি মৌল আছে। (তৃতীয় সারিতে কেন 18 নয় তার আলোচনা এখানে সম্ভব নয়, তখন তা বোঝাও যায়নি।) দেখা যাচ্ছে শক্তিস্তরের সংখ্যাকে দুই দিয়ে গুণ করলে বিভিন্ন সারিতে মৌলের সংখ্যার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।

পাউলি এই ধারণাটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বললেন যে ইলেকট্রনরা ত্রিমাত্রিক কক্ষপথে থাকে, সেজন্য তাদের সম্পর্কে জানতে তিনটি কোয়ান্টাম সংখ্যা n, l m প্রয়োজন। কিন্তু প্রত্যেক ইলেকট্রনের আরো একটি কোয়ান্টাম সংখ্যা আছে যার দু’টি মান হতে পারে। সেই কারনেই দুই দিয়ে গুণ করতে হচ্ছে। এই নতুন কোয়ান্টাম সংখ্যার তিনি নাম দিলেন Zweideutigkeit, জার্মান শব্দটার মানে হল দুই রকম মান। সেজন্য ইলেকট্রনের বর্ণনা দিতে চারটি কোয়ান্টাম সংখ্যা লাগবে, এবং পরমাণুতে কোনো দু’টি ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে এই চারটি সংখ্যাই অবিকল এক হতে পারবে না। একে বলে পাউলির পরিবর্জন নীতি। ১৯২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাইটশক্রিপ্ট ফার ফিজিক গবেষণাপত্রিকাতে তিনি এটি প্রকাশ করেন।

পাউলির ব্যাখ্যা একসঙ্গে অনেকগুলি সমস্যার সমাধান করল। প্রথম থেকেই একটা প্রশ্ন ছিল, পরমাণুর সব ইলেকট্রন কেন নিচের স্তরে চলে যায় না। পরিবর্জন নীতি অনুযায়ী তার সুযোগ নেই, কারণ সেখানে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার থেকে বেশি ইলেকট্রন থাকতে পারে না। মুখ্য কোয়ান্টাম সংখ্যা n-এর জন্য কক্ষপথে 2n2-এর থেকে বেশি ইলেকট্রন থাকা সম্ভব নয়।

পাউলির পরিবর্জন নীতির একটা বড় সাফল্য ছিল সোডিয়ামের বর্ণালীর ব্যাখ্যা। সোডিয়ামকে উত্তপ্ত করলে তার থেকে হলুদ আলো বেরোয়। ভালো করে বিশ্লেষণ করে দেখা গেল এই হলুদ আলোতে একটা নয়, দুটো খুব কাছাকাছি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আছে। আধুনিক ভাষায় বললে দু’টি ফোটন আছে যাদের শক্তি খুব কাছাকাছি। আমরা দেখেছি যে বোরের মডেলে এই আলোর উৎস হল উপরের কক্ষপথ থেকে নিচের কক্ষপথে ইলেকট্রনের ঝাঁপ। কিন্তু এত কাছাকাছি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য তখনই সম্ভব যদি উপরে খুব কাছাকাছি শক্তির একটি নয়, দু’টি স্তর থাকে। বোরের মডেলে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পাউলির এই নতুন কোয়ান্টাম সংখ্যা খুব সহজেই সমস্যাটার সমাধান করে দিল। ওই দু’টি শক্তিস্তরের (n,l,m) কোয়ান্টাম সংখ্যাগুলি সমান, কেবল চতুর্থ কোয়ান্টাম সংখ্যাতে তারা আলাদা। সেজন্য তাদের শক্তির মান খুব কাছাকাছি হয়। আরো বেশ কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা এই নীতি দিয়েছিল, তার মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য হল ব্যতিক্রান্ত জিমান ক্রিয়া। তিরিশ বছর আগেই পিটার জিম্যান দেখিয়েছিলেন যে পরমাণুর উপরে চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করলে তার থেকে নির্গত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কয়েকটি কাছাকাছি তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ভেঙে যায়। এই নতুন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মধ্যে পার্থক্যটা চৌম্বকক্ষেত্রের মানের সমানুপাতী। চিরায়ত পদার্থবিদ্যা কয়েকক্ষেত্রে ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা ব্যর্থ হয়। যেমন সোডিয়ামের একটি রেখা চারটি ও অন্য রেখাটি ছয়টি ভাগে ভাঙে — এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি। পাউলির নতুন কোয়ান্টাম সংখ্যা এই সমস্যার সমাধান করল। এই পরিবর্জন নীতির জন্য ১৯৪৫ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার জিতবেন।

()

পাউলির সম্পর্কে সে সময় একটা গল্প চালু ছিল। মৃত্যুর পরে পাউলি স্বর্গ গেছেন, ভগবান তাঁকে বললেন পাউলি তোমার উপরে আমি সন্তুষ্ট, তুমি কী চাও বলো। পাউলি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার এক বিশেষ বিষয় বুঝতে চাইলেন। ভগবান একটা ক্লাসরুম সৃষ্টি করে পাউলিকে বসতে বললেন, বোর্ডে গিয়ে বোঝানো শুরু করলেন। পাউলির মতো খুশি সেই মুহূর্তে সৃষ্টিতে আর কেউ ছিলেন না। কিন্তু দু’ মিনিট পরেই তাঁর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। আরো দু’ মিনিট পরে পাউলি আর থাকতে পারলেন না, লাফিয়ে উঠে বললেন, ভগবান, আপনি সবই ভুল করছেন।

গল্পটা মজার, কিন্তু পরের ঘটনাটা বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে। পাউলি সমালোচনাতে কাউকেই রেয়াত করতেন না বলে তাঁর নাম হয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানের বিবেক, কেউ কেউ বলত পোপ। কলেজে পড়াকালীন জীবনে প্রথমবার আইনস্টাইনের বক্তৃতার পরে তাঁর মন্তব্য ছিল, প্রফেসর আইনস্টাইন যা বলছেন সবটাই বোকা বোকা নয়। কোনো গবেষণা পছন্দ না হলে মন্তব্য আসত, এমন কি ভুলও নয়! এমনকি তিনি নিজেই ছিলেন নিজের সব থেকে বড় সমালোচক। অনেক বছর পরে পাউলি ও হাইজেনবার্গ এক তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন, হাইজেনবার্গ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তাঁদের গবেষণা প্রায় সম্পূর্ণ, ছোটখাটো কয়েকটা জিনিস বাকি আছে। সেটা শুনে পাউলি তাঁকে একটা খালি পোস্টকার্ড পাঠান, নিচে খালি লেখা ছিল, ‘আমি টিশিয়ানের মতো আঁকতে পারি, ছোটখাটো কয়েকটা জিনিস বাকি আছে।’

পাউলি এই নতুন কোয়ান্টাম সংখ্যা বাস্তবে ইলেকট্রনের সঙ্গে কেমন ভাবে সংশ্লিষ্ট তা নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি ছিলেন না। তবে স্বাভাবিক ভাবেই অন্যরা তাই নিয়ে ভাবছিলেন। তরুণ র‍্যালফ ক্রনিগ পাউলিকে বলেন ইলেকট্রন যদি পৃথিবীর মতো নিজের অক্ষের চারপাশে পাক খায়, তাহলে হয়তো এই নতুন কোয়ান্টাম সংখ্যার ব্যাখ্যা সম্ভব। পাউলি তাঁকে এমন ভাষাতে উড়িয়ে দেন যে ক্রনিগ বিষয়টা নিয়ে আর এগোননি। তিনি পরে কোপেনহাগেনে বোরকে অবশ্য বলেছিলেন, কিন্তু বোরও বিশেষ উৎসাহ দেখাননি।

সকলেই পাউলির মতো কড়া ছিলেন না। এক বছর পরে হল্যান্ডের লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পল এহরেনফেস্টের দুই ছাত্র জর্জ উহ্‌লেনবেক ও স্যামুয়েল গৌডস্মিট প্রায় একই কথা তাঁদের শিক্ষককে বলেন। এহ্‌রেনফেস্ট তাঁদের দু’জনকে সোডিয়ামের মতো ক্ষার ধাতুর বর্ণালী নিয়ে কাজ করতে বলেছিলেন। আমরা দেখেছি পাউলি সোডিয়ামের বর্ণালীর জন্য তাঁর চতুর্থ কোয়ান্টাম সংখ্যার প্রস্তাব করবেন। ক্ষার ধাতুর বর্ণালী প্রসঙ্গেই উহ্‌লেনবেকরা ইলেকট্রনের ঘূর্ণির ধারণাতে আসবেন। তাঁরা তার নাম দিলেন স্পিন। এহ্‌রেনফেস্ট তাঁদের তত্ত্বকে প্রবন্ধের আকারে লিখে তাঁকে জমা দিতে বলেন। হল্যান্ডের দিকপাল পদার্থবিজ্ঞানী হেন্‌ড্রিক লরেঞ্জ চিরায়ত পদার্থবিদ্যাতে ইলেকট্রন তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত ছিলেন, এহ্‌রেনফেস্ট দুই ছাত্রকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। লরেঞ্জ তখনো লেইডেনে সপ্তাহে একদিন ক্লাস নেন, ক্লাসের পরে উহ্‌লেনবেক ও গৌডস্মিট তাঁকে তাঁদের তত্ত্বের কথা বলেন। লরেঞ্জ বলেন তিনি ভেবে দেখবেন।

পরের সপ্তাহে আবার তাঁরা লরেঞ্জের কাছে যান। লরেঞ্জ তাঁদের একতাড়া অঙ্ক দেখান, বলেন যে ইলেকট্রনের ঘূর্ণি থেকে যদি পাউলির কোয়ান্টাম সংখ্যা ব্যাখ্যা করতে হয়, তাহলে ইলেকট্রনের বাইরের তলের বেগ আলোর থেকে অনেক বেশি হতে হবে। হতাশ হয়ে দুই ছাত্র শিক্ষকের কাছে গিয়ে বলেন যে লরেঞ্জ তাঁদের তত্ত্ব যে ভুল তা দেখিয়ে দিয়েছেন, কারণ বিশেষ আপেক্ষিকতা অনুসারে আলোর বেগের থেকে বেশী বেগ সম্ভব নয়। এহ্‌রেনফেস্ট বলেন যে তিনি সেই গবেষণাপত্র আগেই ছাপতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ‘তোমরা দু’জনেই তরুণ, একটা বোকামি তোমরা করতেই পারো।‘ পাউলির মতোই এহ্‌রেনফেস্টও প্রথমেই এই সমস্যাটা বুঝেছিলেন, কিন্তু তিনি আরো বুঝেছিলেন যে যখন প্রকৃত তত্ত্ব আসবে, তখন এই সমস্যা থাকবে না। লরেঞ্জ চিরায়ত পদার্থবিদ্যা থেকে বেরোতে পারেননি। বাস্তবে ঘটবেও তাই। আমরা এখন জানি যে স্পিন ইলেকট্রনের মূলগত ধর্ম, তার সঙ্গে ইলেকট্রনের ঘূর্ণির কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের সাধারণ জগতের কোনো ছবি দিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। তখন অবশ্য সে কথা বোঝা সম্ভব ছিল না।

উহ্‌লেনবেকদের গবেষণাপত্রটি বিজ্ঞানীমহলে বেশ আলোড়ন তুলেছিল। নিলস্‌ বোর আবারও একেবারেই স্পিনের ধারণার সঙ্গে সহমত হতে পারেননি। পরের মাসে তিনি লেইডেনে এক সম্মেলনে যোগ দিতে ট্রেনে করে যাচ্ছিলেন। হামবুর্গ স্টেশনে পাউলি ও অটো স্টার্ন তাঁর সঙ্গে দেখা করে স্পিন সম্পর্কে তাঁর মত জানতে চান। বোর বলেন পরমাণুর মধ্যে স্পিনের প্রভাব দেখতে হলে চৌম্বক ক্ষেত্র দরকার, সেটা কোথা থেকে আসবে? কাজেই উহ্‌লেনবেকদের তত্ত্ব ভুল। লেইডেন স্টেশনে আইনস্টাইন ও এহ্‌রেনফেস্ট তাঁর সঙ্গে দেখা করে স্পিন সম্পর্কে তাঁর মত জানতে চান। বোর তাঁর আপত্তির কথা জানান। এহ্‌রেনফেস্ট বলেন আইনস্টাইন সমস্যাটার সমাধান করেছেন। ইলেকট্রনের কাছে মনে হবে ধনাত্মক আধানের নিউক্লিয়াসটা তার চারপাশে ঘুরছে, সেটাও একটা তড়িৎপ্রবাহ, সেই তড়িৎপ্রবাহ চৌম্বক ক্ষেত্রের জন্ম দিচ্ছে। বোরের মত সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়, তিনি স্পিনের উৎসাহী সমর্থক হয়ে দাঁড়ান। কোপেনহাগেন ফেরার সময় গটিনগেন স্টেশনে হাইজেনবার্গ ও পাস্কাল জর্ডান তাঁর সঙ্গে দেখা করে স্পিন সম্পর্কে তাঁর মত জানতে চান। বোর আইনস্টাইনের মত তাঁদের বলেন, এবং যোগ করেন যে এটা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। বার্লিন স্টেশনে আবার পাউলি তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি শুধু স্পিন সম্পর্কে বোরের মত পরিবর্তন হয়েছে কিনা জানতেই হামবুর্গ থেকে এসেছেন। বোরের উৎসাহ দেখে পাউলি মন্তব্য করেন, কোপেনহাগেনের নতুন ধর্মদ্রোহিতা (heresy)। ফিরে গিয়ে বোর এহ্‌রেনফেস্টকে চিঠিতে লেখেন যে তিনি এখন ইলেকট্রন চুম্বক বিষয়ক দৈববাণীর প্রচারক। এহ্‌রেনফেস্টদের গণনার থেকে পরীক্ষার ফল দু’’গুণ কম হচ্ছিল, যে কারণে পাউলি বিষয়টাকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বোর নিশ্চিত ছিলেন যে পরে তার কারণ বোঝা যাবে। পরের বছর লেওয়েলিন টমাস দেখান যে আপেক্ষিকতাকে হিসাবে নিলে এই সমস্যা আর থাকে না। পাউলি এবার পুরোপুরি সন্তুষ্ট হলেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯২৪ সালের তাঁর বিখ্যাত গবেষণাপত্রে ফোটনের স্পিনের কথা বলেছিলেন, কিন্তু আইনসস্টাইন অনুবাদের সময় সেটি বাদ দিয়ে দেন। নোবেলজয়ী আর্থার কম্পটনও ১৯২৪ সালে ইলেকট্রনের স্পিনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবিষ্কর্তা হিসেবে উহ্‌লেনবেক ও গৌডস্মিটের নামই ইতিহাসে লেখা রইল। ক্রনিগ বোরের সহকারী হেনড্রিক ক্রেমার্সকে এক চিঠিতে নিজের রাগের কথা লিখেছিলেন। ক্রেমার্স সেটি বোরকে দেখান। বোর এক চিঠিতে ক্রনিগের কাছে ঘটনাক্রমের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। ক্রনিগ উত্তরে লেখেন যে এই কথা যেন উহ্‌লেনবেক ও গৌডস্মিটের কানে না যায়, কারণ তাঁরা নিজেরাই বিষয়টা আবিষ্কার করেছেন। ক্রনিগ না চাইলেও অবশ্য বিষয়টা ছড়িয়ে পড়েছিল, উহ্‌লেনবেক প্রকাশ্যেই বলেন যে তাঁদের আগেই ক্রনিগ স্পিনের ধারণাতে পৌঁছেছিলেন। এই সমস্ত কারণেই হয়তো স্পিনের মতো পদার্থের মৌলিক ধর্ম আবিষ্কার কখনো নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়নি।

পাউলির অন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল নিউট্রিনোর তত্ত্ব, কিন্তু সেই নিয়ে আলোচনার সুযোগ এই লেখাতে নেই। আরো অনেক মৌলিক অবদান তিনি রেখেছিলেন। হিটলার ক্ষমতায় আসার পরে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া এক হয়ে যায়, ফলে পাউলিও জার্মান নাগরিকে পরিণত হন। ইহুদি পাউলি সুইস নাগরিকত্ব নেওয়ার চেষ্টা করে বিফল হন। বাধ্য হয়ে ১৯৪০ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে ১৯৪৬ সালে তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন। আবার তিনি সুইজারল্যান্ডে ফিরে এসে পড়ানো শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি সুইস নাগরিকত্ব পান। ১৯৫৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

পাউলি পরিবর্জন নীতির কথা আমরা শুনেছি, শেষ করার আগে পাউলি ক্রিয়ার গল্প শুনে নিই। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী পাউলি পরীক্ষানিরীক্ষাতে একেবারেই পারদর্শী ছিলেন না, ল্যাবরেটরিতে জিনিসপত্র ভাঙতে বা যন্ত্র খারাপ করতে তাঁর জুড়ি ছিল না। তাই বন্ধুরা বলতেন পাউলি পরীক্ষাগারে এলেই যন্ত্র খারাপ হয়ে যায়, তার নাম তাঁরা দিয়েছিলেন পাউলি ক্রিয়া। পাউলি নিজেও বিষয়টাতে মজা পেতেন। একবার গটিনগেনের পরীক্ষাগারের একটা যন্ত্র হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দেয়, কেন তা কেউ বুঝতে পারছিলেন না। পরীক্ষাগারের অধিকর্তা জেমস ফ্রাঙ্ক পাউলিকে এক চিঠি লিখছিলেন, তিনি সেখানে মজা করে লিখে পাঠান যে এর জন্য অন্তত পাউলিকে দায়ী করা যাচ্ছে না। পাউলি উত্তরে আরো মজা করে লেখেন যে ঐ দিন ঐ সময়ে তিনি গটিনগেন স্টেশনে ট্রেন পরিবর্তন করছিলেন।

 

প্রকাশিত জ্ঞান ও বিজ্ঞান, শারদীয় ২০২৪ 

Saturday, 23 November 2024

রেডিওথেরাপি, রেডিওডায়াগনসিস ও নিউক্লিয় বিজ্ঞান

 

রেডিওথেরাপি, রেডিওডায়াগনসিস ও নিউক্লিয় বিজ্ঞান

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


রেডিওথেরাপি কথাটার সঙ্গে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। রেডিয়েশন অর্থাৎ বিকিরণের সাহায্যে দেহের অভ্যন্তরে ক্যান্সার বা ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের কোষকে ধ্বংস করাকে বলে রেডিওথেরাপি। রেডিওডায়াগনসিস কথাটা অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত হলেও তার মানে বুঝতে অসুবিধা হয় না -- বিকিরণের সাহায্যে রোগনির্ণয়। এই লেখাতে আমরা রেডিওথেরাপি ও রেডিওডায়াগনসিসে নিউক্লিয় বিজ্ঞানের প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করব।

এই দুই ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিকিরণ নানা রকম হতে পারে। ক্যান্সারের রেডিওথেরাপিতে এক্স রশ্মির ব্যবহারের কথা অনেকেই জানি। অন্য ধরনের বিকিরণের মধ্যে পড়বে বিটা ও গামা রশ্মি, নিউট্রন, উচ্চশক্তির প্রোটন, ইত্যাদি। এদের সাধারণ একটা ধর্ম আছে যা রেডিওথেরাপিতে কাজে লাগানো হয়। কোনো পদার্থের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় বিকিরণ সেই পদার্থকে আয়নিত করে। দেহের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় বিকিরণ যে আয়ন সৃষ্টি করে, তা কোশের ডিএনএ-কে ধ্বংস করে কোশের মৃত্যু ঘটায়।

১৯১১ সালে ম্যানচেস্টারে বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড পরমাণুর নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেন। নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের আগেই কিন্তু নিউক্লিয় প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল। তেজস্ক্রিয়তার উৎস হল পরমাণুর নিউক্লিয়াস। ১৮৯৬ সালে তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার হওয়ার কিছু দিন পর থেকেই বোঝা গিয়েছিল যে ক্যান্সারের চিকিৎসাতে তাকে কাজে লাগানো যায়। ১৯০৩ সালের নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রথমে তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারের জন্য আঁরি বেকেরেল ও সেই বিষয়ে গবেষণার জন্য পিয়ের কুরিকে মনোনীত করা হয়। পিয়ের নোবেল কমিটিকে লিখে পাঠিয়েছিলেন যে তাঁর স্ত্রী মেরি ও তিনি একসঙ্গে সমস্ত কাজ করেছেন, তাই মেরির নামও থাকা উচিত। কমিটি তখন বাকি দুজনের সঙ্গে মেরির নামে জমা পড়া এক মনোনয়ন ব্যবহার করে মেরির নাম তালিকাতে ঢুকিয়েছিলেন। সেই মনোনয়ন দিয়েছিলেন শার্ল বৌশার্ড নামের এক ডাক্তার; চিকিৎসাতে রেডিয়ামের প্রয়োগের জন্যই তাঁর মাথায় পিয়ের ও মেরির কথা মনে এসেছিল।

রেডিওথেরাপিতে নানা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। অনেক সময়েই ক্যান্সারগ্রস্ত টিউমারের কাছে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ রেখে তাকে ধ্বংস করা হয়। সাধারণভাবে তিন রকমের তেজস্ক্রিয়তা হয়। আলফা তেজস্ক্রিয়তাতে নিউক্লিয়াস থেকে আলফা কণা অর্থাৎ হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস বেরিয়ে আসে। বিটা কণা হল ইলেকট্রন বা পজিট্রন। গামা তেজস্ক্রিয়তাতে নিউক্লিয়াস থেকে উচ্চশক্তির ফোটন কণা নির্গত হয়। তেজস্ক্রিয়াতে নির্গত আলফা কণার ভেদনক্ষমতা খুব কম, চামড়ার বাইরের মৃত কোশের স্তরই তাকে আটকে দেয়। তেজস্ক্রিয় পদার্থের প্রয়োগের ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপিতে কার্যকর বিকিরণটি হল মূলত বিটা রশ্মি।

বিটা রশ্মির ভেদনক্ষমতা আলফা রশ্মির থেকে বেশি হলেও খুব বেশি নয়, অর্থাৎ তা দেহের মধ্যে বেশিদূর যেতে পারে না। ফলে শুধুমাত্র টিউমার বা তার আশপাশের কোশগুলিই ধ্বংস হয়। সুতরাং বিটা তেজস্ক্রিয় পদার্থকে টিউমারের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তার জন্য নানা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক থাইরয়েডের ক্যান্সারের কথা। দেহের অধিকাংশ আয়োডিন থাইরয়েড গ্রন্থিতে শোষিত হয় ও জমা থাকে। আয়োডিনের একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ হল I-131 এই 131 হল ওই আয়োডিন আইসোটোপের ভরসংখ্যা অর্থাৎ নিউট্রন ও প্রোটনের মোট সংখ্যা। কোনো নির্দিষ্ট মৌলের নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা নির্দিষ্ট, কিন্তু নিউট্রন সংখ্যার হেরফের হতে পারে। পরিবেশে সাধারণ যে আয়োডিন পাওয়া যায়, তা হল I-127, তার নিউক্লিয়াসে আছে 53টা প্রোটন ও 74টা নিউট্রন। অন্যদিকে I-131-এর মধ্যে আছে 78টা নিউট্রন। একটা ক্যাপসুলের মাধ্যমে সোডিয়াম আয়োডাইড লবণ রোগীকে খাওয়ানো হয়, তার আয়োডিনটা হল I-131আইসোটোপ, এর থেকে বিটা কণা বেরোয়। আয়োডিন রক্তের মাধ্যমে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাইরয়েডে গিয়ে জমা হয় এবং তার থেকে নির্গত বিটা বিকিরণ সেখানকার ক্যান্সার কোশদের ধ্বংস করে।

প্রকৃতিতে এই I-131 পাওয়া যায় না; কেমন ভাবে তা তৈরি করা হয়? নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টরে তৈরি হয় প্রচুর নিউট্রন। সেই নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়ামের আইসোটোপ U-235-এর নিউক্লিয়াসকে আঘাত করলে তা ভেঙে যায়, একে বলে ফিশন বা বিভাজন বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়াতে আরো অনেক নতুন মৌলের সঙ্গে I-131 তৈরি হয়; তাকে রাসয়ানিক পদ্ধতিতে আলাদা করা হয়। অন্য এক উপায়ে রিঅ্যাক্টরের নিউট্রন দিয়ে টেলুরিয়ামের আইসোটোপ Te-130-কে ধাক্কা দিলে সে নিউট্রনকে ধরে নিয়ে হয় Te-131। এটি ক্ষণস্থায়ী আইসোটোপ, বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে তা I-131-এ রূপান্তরিত হয়।

আধিকাংশ সময় এত সহজে একটা নির্দিষ্ট অঙ্গ বা গ্রন্থিকে নিশানা করা যায় না, তার জন্য অন্য পদ্ধতি আছে। যকৃতের টিউমারের ক্ষেত্রে ইট্রিয়াম বা হোলমিয়ামের তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ Y-90 বা Ho-166 কে কাচের তৈরি অতি ক্ষুদ্র গোলকের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। গোলকগুলির ব্যাস তিরিশ মাইক্রনের কাছাকাছি, মোটামুটি চারটে লোহিত রক্তকণিকার কোশের মতো। সেগুলিকে সরাসরি ইঞ্জেকশনের সাহায্যে যকৃতের ধমনীতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। গোলকগুলি যকৃতের গিয়ে জমা হয় ও তার থেকে নির্গত বিকিরণ মাধ্যমে সেখানকার টিউমারের কোশগুলিকে অনেকটা মারতে সক্ষম হয়। সাধারণত টিউমারের আয়তন কমাতে এর ব্যবহার হয়, এর পরে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে টিউমারটিকে সরানো হয়। ইট্রিয়াম বা হোলমিয়ামের এই তেজস্ক্রিয় আইসোটোপদেরও রিঅ্যাক্টরে নিউট্রন বিক্রিয়ার সাহায্যে তৈরি করা হয়।

রেডিওথেরাপির এই পদ্ধতির পোশাকি নাম Selective Internal Radiation Therapy (SIRT)এর সব থেকে বড় সুবিধা হল যে বিকিরণ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে, অন্য অঙ্গের ক্ষতি করে না। আরো একটা বড় সুবিধা হল যে কোনো দীর্ঘস্থায়ী তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থাকে না। ধরা যাক I-131-এর কথা। এর অর্ধায়ু কাল হল আট দিন, অর্থাৎ আট দিন পরে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা কমে অর্ধেক হয়। তার অর্থ ওই আইসোটোপ থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা মাসখানেকের মধ্যে কমে দশ শতাংশে পৌঁছে যায়। ইট্রিয়াম বা হোলমিয়েমের অর্ধায়ু কাল আরো কম, ফলে দীর্ঘস্থায়ী কোনো প্রভাব থাকে না। সেই কারণে বিকিরণের মাত্রা বা ডোজ অনেকটা বাড়ানো যায়।

এইরকম বহু তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ চিকিৎসা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। এই সমস্ত আইসোটোপের অধিকাংশই হল কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ, প্রকৃতিতে তাদের পাওয়া যায় না। নিউক্লিয় গবেষণা ছাড়া এই সমস্ত আইসোটোপ পাওয়া যেত না। কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেছিলেন মাদাম কুরির মেয়ে আইরিন জোলিও-কুরি ও তাঁর স্বামী ফ্রেডরিক জোলিও-কুরি। এ জন্য তাঁরা ১৯৩৫ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

রোগ নির্ণয়ে তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহারের উদাহরণ হল পেট (PET) স্ক্যান, পুরো কথাটা হল পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি। সাধারণ এক্স-রশ্মির বড়ো সমস্যা হল যে তা দিয়ে হাড়ের ছবি ভালো উঠলেও নরম কলা বা পেশী ইত্যাদির ছবি ভালো ওঠে না। কোনো কোনো কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়াতে পজিট্রন তৈরি হয়। পজিট্রন হল ইলেকট্রনের বিপরীত কণা, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই দুটি বিপরীত কণা একে অপরকে ধ্বংস করে দেয় ও দুটি 511 keV (কিলো ইলেকট্রনভোল্ট) গামা রশ্মি পরস্পর বিপরীতদিকে বেরোয়। এই গামারশ্মিগুলিকে ধরে কোন জায়গায় তারা সৃষ্টি হয়েছে জানা সম্ভব। সঙ্গের ছবিটাতে বিষয়টি সহজ করে দেখানো হয়েছে।


  পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি


পেট স্ক্যানের একটা উদাহরণ দেখা যাক। ক্যান্সারের কোশ দ্রুত বিভাজিত হয় বলে সেখানে বিপাক ক্রিয়ার হার বেশি। রক্তের মধ্যে গ্লুকোজের অনুরূপ একটা অণু ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যার মধ্যে থাকে ফ্লোরিনের তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ F-18। এই আইসোটোপ থেকে পজিট্রন বেরোয়। বিপাকের হার বেশি বলে ক্যান্সারগ্রস্ত কোশ বেশি গ্লুকোজ নেয়। সেখানে এই অণুটিও বেশি জমা হয় ও তার থেকে পজিট্রন বেরোয়। ইলেকট্রন পজিট্রন ধ্বংসের মাধ্যমে সেখানে গামা রশ্মি তৈরি হয়, ফলে বাইরের গামা ক্যামেরার তোলা ছবিতে ওই জায়গাটি অনেক বেশি উজ্জ্বল দেখায়।

কোনো যৌগের পরমাণুতে সাধারণ আইসোটোপের বদলে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করলে তাকে বলে ট্রেসার। এভাবে সাধারণ অণুর মধ্যে ট্রেসার ব্যবহার করাকে বলে ট্যাগিং। এখন ট্রেসার ব্যবহারের সঙ্গে সিটি (CT) স্ক্যানের সংযোগ ঘটিয়ে চালু হয়েছে স্পেক্ট (SPECT: Single Photon Emission Computed Tomography)। এই পদ্ধতিতে শিরা ও ধমনীর মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন অঙ্গে রক্তের প্রবাহকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। এখানেও গামা ক্যামেরার সাহায্যে আইসোটোপ থেকে বেরোনো গামা রশ্মিকে ধরা সম্ভব হয়। গামা ক্যামেরার কথা আগেও এসেছে। এতে থাকে একটি প্রতিপ্রভ পদার্থ, সাধারণত সোডিয়াম আয়োডাইড। গামা রশ্মি এসে সোডিয়াম আয়োডাইডে পড়লে তার থেকে আলোর ঝলক বেরোয়, সেই ঝলক পরে রাখা ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউব নামের যন্ত্রে ধরা পড়ে। এভাবে একটি গামা ফোটনকেও (Single Photon) ধরা সম্ভব, তাই এই পদ্ধতির সুবেদিতা খুব বেশি। এই পদ্ধতিতে কিছু কিছু ক্যান্সার অন্য স্ক্যানের থেকে আগে ধরা পড়ে।

রিঅ্যাক্টর ছাড়াও নিউক্লিয়ার অ্যাক্সিলারেটরে বা কণাত্বরকে নিউক্লিয় বিক্রিয়ার মাধ্যমে এখন চিকিৎসাতে ব্যবহৃত আইসোটোপ তৈরি হয়। ১৯৪০-এর দশকে ভারতের প্রথম সাইক্লোট্রন অ্যাক্সিলারেটর তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা, তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ তৈরি করা। সেই সাইক্লোট্রনের জন্য প্রথম অর্থসাহায্য করেছিল টাটা চ্যারিটিজ ট্রাস্ট যারা তখন বম্বেতে ক্যান্সার হাসপাতাল বানাচ্ছিল। সেই পুরানো সাইক্লোট্রন অবশ্য বহুদিন বাতিল হয়ে গেছে, কিন্তু আধুনিক চিকিৎসার চাহিদা মেটাতে কলকাতার কাছেই নিউ গড়িয়াতে বসেছে এক নতুন সাইক্লোট্রন। ভারতের অন্য কণাত্বরকরা কখনো কখনো এইসব আইসোটোপ বানায়, কিন্তু এই নতুন সাইক্লোট্রনের প্রধান উদ্দেশ্যই হল তাই।

দেখা যাক কোন ধরনের আইসোটোপ এই সাইক্লোট্রনে তৈরি হয়। অক্সিজেনের একটা আইসোটোপ হল O-18। এটি তেজস্ক্রিয় নয়, সাধারণ অক্সিজেনের প্রতি পাঁচশো পরমাণুর মধ্যে একটি O-18-এর পরমাণু পাওয়া যায়।এই সাইক্লোট্রনে লক্ষ্যবস্তু হিসাবে যে জল ব্যবহার করা হয়, তাতে অবশ্য O-18 কিছু বেশি থাকে, যে পদ্ধতিতে তা করা হয় তাকে বলে এনরিচমেন্ট। সাইক্লোট্রন থেকে উচ্চশক্তি সম্পন্ন প্রোটন দিয়ে এই অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়াতে তৈরি হয় পেট স্ক্যানে ব্যবহৃত F-18। এছাড়াও অন্য নানা পদ্ধতিতে তৈরি হচ্ছে Ge-68, I-123, Tl-201 এই সমস্ত আইসোটোপ। এদের থেকে গামা রশ্মি বেরোয়। স্পেক্ট-Ge-68, I-123 এই আইসোটোপদের ব্যবহার করা হয়। থ্যালিয়ামের আইসোটোপ Tl-201 হৃৎযন্ত্রের অবস্থা নির্ণয়ে ব্যবহার হয়।

স্পেক্ট-এ গ্যালিয়ামের আইসোটোপ, Ga-68 ব্যবহার হয়। কিন্তু তার অর্ধায়ু কাল খুব কম, মাত্র আটষট্টি মিনিট। তাই অন্যত্র তৈরি করে এনে রোগীর দেহে ব্যবহার সম্ভব নয়, তার আগেই সমস্ত পরমাণুর ক্ষয় হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে জার্মেনিয়ামের আইসোটোপ Ge-68-কে উৎস বা জেনারেটর হিসাবে ব্যবহার করা হয়। জার্মেনিয়ামের এই আইসোটোপটির অর্ধায়ু হল 271 দিন, ফলে একবার তৈরি করলে অনেক দিন চলে। জার্মেনিয়ামের বিটাক্ষয় থেকে গ্যালিয়াম তৈরি হয়, স্পেক্ট-এ ব্যবহারের সময় জেনারেটর থেকে গ্যালিয়ামকে বার করে নিয়ে কাজে লাগানো হয়।

যে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপটি চিকিৎসাক্ষেত্রে সব থেকে বেশি ব্যবহার হয়, তা হল টেকনিশিয়ামের আইসোটোপ, Tc-99। টেকনিশিয়ামের সমস্ত আইসোটোপই তেজস্ক্রিয়, পৃথিবীতে তাদের পাওয়া যায় না। টেকনিশিয়ামের এই আইসোটোপের অর্ধায়ু কাল ছ' ঘণ্টা, ফলে প্রয়োগের এক দিনের মধ্যেই তার সমস্ত পরমাণু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সেকারণে দীর্ঘস্থায়ী তেজস্ক্রিয়তার সমস্যা নেই। এর থেকে যে গামা রশ্মিটি বেরোয় তার শক্তি 140 keV। এই শক্তির গামা রশ্মি ক্যামেরাতে সহজেই ধরা পড়ে। প্রতি বছর কোটি কোটি রোগীর দেহে স্পেক্ট, বোন স্ক্যান সহ নানা রকম পদ্ধতিতে রোগনির্ণয়ে ট্রেসার হিসাবে ব্যবহার হয় এই আইসোটোপ।

এবার আমরা ক্যান্সারের চিকিৎসাতে একটা অপেক্ষাকৃত আধুনিক পদ্ধতির কথা বলব। শরীরের ভিতরে কোনো অংশের ক্যান্সারের চিকিৎসা করা বেশ শক্ত। রেডিওথেরাপিতে এর জন্য নানারকম পদ্ধতি নেওয়া হয়, থাইরয়েডের ক্যান্সারের কথা যেমন আগে বলেছি। অস্ত্রোপচার না করে বাইরে থেকে বিকিরণ দিয়ে ক্যান্সার ধ্বংসের জন্য সাধারণত এক্স রশ্মি ব্যবহার করা হয়। এর প্রধান সমস্যা হল যে এক্স রশ্মি যে শুধু ক্যান্সারের টিউমারের কোশগুলিকেই মারবে এমন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, তার আগে ও পরে শরীরের যে অঙ্গের মধ্যে দিয়ে যাবে সেখানকার কোশগুলিও ধ্বংস হবে। তার পরিবর্তে প্রোটন বা কার্বনথেরাপি ব্যবহার শুরু হয়েছে। এর পোশাকি নাম পার্টিকলথেরাপি বা হ্যাড্রনথেরাপি। প্রোটন, নিউট্রন বা তাদের দিয়ে তৈরি নিউক্লিয়াস, এরা হল হ্যাড্রন। ইলেকট্রন কিন্তু হ্যাড্রন নয়। তাই হ্যাড্রনথেরাপি শব্দটাই সঠিকতর, তবে পার্টিকলথেরাপিই বেশি চালু।

দেহের কলার মধ্যে বিভিন্ন বিকিরণের শক্তি ক্ষয়

সঙ্গের ছবিতে কেমনভাবে দেহের কলার মধ্যে এক্স রশ্মি, প্রোটন এবং কার্বন আয়নের শক্তি ক্ষয় হয় দেখানো হয়েছে। যত বেশি শক্তি কোনো বিশেষ জায়গায় জমা পড়ে, সেখানে আয়নন তত বেশি হয়। দেখা যাচ্ছে দেহের গভীরে অবস্থিত টিউমারের মধ্যে আয়নন ঘটাতে গেলে এক্স রশ্মির অধিকাংশ শক্তিটাই আগে ও পরে জমা পড়ে, টিউমারে যায় কম। ফলে টিউমারের থেকে দেহের স্বাভাবিক কোশের ক্ষতি হয় বেশি। এই কারনে বিকিরণের মাত্রা বেশি করা সম্ভব নয়। মাত্রা কম হলে আয়ননও কম হবে। কিন্তু আয়নন কম হলে সাধারণত ডিএনএ-র দুটি তন্তুর একটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ধরণের ক্ষতি সারানো কোশের পক্ষে অনেক সহজ, ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে টিউমার কোশের মৃত্যু হয় না। প্রোটন বা কার্বন পার্টিকল থেরাপিতে অধিকাংশ শক্তি খুব কম একটা অংশে জমা পড়ে। পথের একদম শেষের এই অংশটাকে বলে ব্র্যাগ পিক, উইলিয়াম ব্র্যাগ এটি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। প্রচুর পরিমাণ শক্তি খুব অল্প জায়গায় জমা পড়ে, তাই হ্যাড্রনথেরাপিতে অনেক বেশি আয়নন হয়। সেই কারণে দুটি তন্তুই সাধারণত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে কোশের মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাছাড়া এক্স রশ্মি রেডিওথেরাপি কোশের মধ্যের অক্সিজেনকে আয়নিত করে ডিএনএ তন্তু ভাঙে। কিছু টিউমার আছে যাদের কোশে অক্সিজেন কম থাকে, এক্স-রশ্মি দিয়ে তাদের ধ্বংস করা কঠিন। হ্যাড্রনথেরাপিতে এই সমস্যা নেই।

দেহের অভ্যন্তরে কতদূরে টিউমারটি আছে, তা বিচার করে কণার গতিশক্তি ঠিক করা হয়। যেমন পঁচিশ সেন্টিমিটার ভিতরে টিউমার থাকলে প্রোটনের গতিশক্তি হতে হবে 200 MeV (মেগা ইলেকট্রনভোল্ট), কার্বনের জন্য প্রয়োজন 4500 MeV। কার্বন নিউক্লিয়াসের আধান প্রোটনের ছয় গুণ, তাই একই গভীরতাতে যেতে অনেক বেশি শক্তি প্রয়োজন হয়। সেই কারণে প্রোটনের থেকে কার্বন নিউক্লিয়াস টিউমারের মধ্যে বহু গুণ বেশি শক্তি জমা করে, ফলে কোশের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।

প্রোটনথেরাপিতে প্রোটন কণা অর্থাৎ হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে অ্যাক্সিলারেটরের সাহায্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি দেওয়া হয়। কার্বন থেরাপিতে প্রোটনের জায়গা নেয় কার্বনের নিউক্লিয়াস। কোন গতিশক্তির প্রোটন বা কার্বন নিউক্লিয়াস মানবদেহের ভিতরে কতদূরে প্রবেশ করতে পারে, তা খুব নির্দিষ্ট। শুধু তাই নয়, প্রোটন বা কার্বনের নিউক্লিয়াসের আধান আছে, ফলে তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করে খুব সরু রশ্মি (চালু কথায় পেনসিলের) আকারে পাঠানো সম্ভব; এক্স রশ্মি অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে টিউমারকে লক্ষ্য করে প্রোটন বা কার্বনকে পাঠানো যায়, অন্য কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কণাগুলি পথে খুব একটা বেশি শক্তি খরচ করে না, যাত্রাপথের শেষে গিয়ে প্রায় সমস্ত শক্তিটা একবারে ছেড়ে দেয়। তার ফলে টিউমারের আগে বা পরে কণাদের পথে যে সমস্ত কোশ পড়ে তাদের ক্ষতি হয় অনেক কম। সেই কারণে চিকিৎসার সময় বিকিরণের মাত্রা অনেক বেশি করা সম্ভব। ফলে চিকিৎসার সময়ও কমানো যায়। কার্বনথেরাপিতে প্রোটনের থেকেও আরো সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করে শুধুমাত্র টিউমারকে ধ্বংস করা সম্ভব। যে সব ক্ষেত্রে টিউমারটি মস্তিষ্কের মতো খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গের কাছে অবস্থিত, সেখানে পার্টিকল থেরাপি খুব কার্যকর হয়। প্রোটন বা কার্বনথেরাপিতে আরো একটা সুবিধা হল যে এর ফলে দেহের মধ্যে জমা হয় হাইড্রোজেন বা কার্বন। এই দুটি মৌল শরীরের মুখ্য উপাদানের মধ্যে পড়ে ও তারা আদৌ তেজস্ক্রিয় নয়। ফলে তেজস্ক্রিয়তার বিপদ নেই।

প্রোটনথেরাপির কথা প্রথম বলেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লরেন্স বার্কলে ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী রবার্ট উইলসন ১৯৪৬ সালে, কিন্তু তা পরীক্ষামূলকভাবে চালু হতে আট বছর পেরিয়ে যায়। হাসপাতালে প্রোটনথেরাপি প্রথম শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯০ সালে। এখন পৃথিবীতে প্রায় দেড়শো প্রোটনথেরাপি কেন্দ্র আছে। আমাদের দেশে মুম্বাই-এর টাটা মেডিক্যাল সেন্টার ও চেন্নাই-এর অ্যাপোলো হসপিতালে এই ব্যবস্থা আছে। কার্বন থেরাপি শুরু হয় ১৯৯৪ সালে জাপানে। পার্টিকলথেরাপি কো-অপারেটিভ গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে পৃথিবীতে মোট পনেরটি কার্বনথেরাপি সেন্টার চালু আছে, তার মধ্যে সাতটিই জাপানে। বছরে পনের থেকে কুড়িহাজার রোগীর প্রোটন ও পাঁচ হাজার রোগীকে কার্বন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা হয়।

হ্যাড্রনথেরাপি শুরু হয়েছিল দ্রুতগতির নিউট্রন দিয়ে ১৯৩৮ সালে, কিন্তু তা চিকিৎসার পক্ষে সুবিধাজনক ছিল না। আবার ১৯৬০-এর দশকে নতুন ভাবে অনেক জায়গায় শুরু হলেও বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য একটি কেন্দ্র ছাড়া বাকি সব গুলি বন্ধ হয়ে গেছে। তবে নতুন এক পদ্ধতি পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে। একে বলে বোরন নিউট্রন ক্যাপচার থেরাপি (BCNT)। এই পদ্ধতিতে টিউমারটিতে প্রথমে বোরনের আইসোটোপ B-10 প্রবেশ করানো হয়। এটি তেজষ্ক্রিয় নয়, তাই নিজে থেকে কোশের কোনো ক্ষতি করে না। এর পরে রিঅ্যাক্টর থেকে ধীরগতির নিউট্রন দেহের সেই অংশে ফেলা হয়। টিউমারের মধ্যের বোরন নিউট্রনের সঙ্গে বিক্রিয়াতে লিথিয়াম (Li-7) ও হিলিয়াম (He-4) নিউক্লিয়াস তৈরি করে। এই দুই নিউক্লিয়াসই খুব অল্প দূরত্ব গিয়েই থেমে যায়, ফলে তাদের পুরো গতিশক্তিটাই কোশের মধ্যে জমা পড়ে এবং টিউমারের কোশের মৃত্যু ঘটে।

তেজস্ক্রিয় নয় এমন নিউক্লিয়াসের ধর্মকেও রোগনির্ণয়ে ব্যবহার করা হয়, তার উল্লেখ করে শেষ করি। আমরা সবাই এমআরআই কথাটা শুনেছি। পুরো কথাটা হল নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং, কিন্তু নিউক্লিয়াস শুনলেই অনেকে ভয় পান বলে প্রথম শব্দটা আর ব্যবহার হয় না। বিজ্ঞানের পরীক্ষাগারে কিন্তু পুরো নামটাই চালু। অনেক নিউক্লিয়াসের চৌম্বক ভ্রামক (Magnetic moment) আছে, অর্থাৎ তারা শক্তিশালী চৌম্বকক্ষত্রের সঙ্গে ক্রিয়া করে। এই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে দেহের ভিতরের বিভিন্ন অঙ্গের ছবি তোলা সম্ভব, সেটাই হল ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং। এই পদ্ধতি সব থেকে বড় সুবিধা হল যে এতে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। এক্স-রে দেহের ক্ষতি করে, এমনকি বেশি এক্স-রে থেকে ক্যান্সারও হতে পারে। এমআরআই-তে সেই সম্ভাবনা নেই। এমআরআই-এর সাহায্য টিউমারটিকে চিহ্নিত করা সম্ভব হলে তাকে ধ্বংস করার জন্য পার্টিকলথেরাপিতে কত শক্তি হওয়া প্রয়োজন তা নির্ণয় করা খুব সহজ। নিউক্লিয় ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স পদ্ধতি আবিষ্কার ও তার উন্নতির জন্য ১৯৪৪ সালে ইসিডোর রাবি এবং ১৯৫২ সালে ফেলিক্স ব্লখ ও এডওয়ার্ড মিলস পার্সেল পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

বিজ্ঞানের অগ্রগতি যে এই একটি ক্ষেত্রে অন্তত মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হচ্ছে সন্দেহ নেই। মনে রাখতে হবে যে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে; অন্য সমস্ত পদ্ধতিরও প্রয়োজন আছে। ক্যান্সারের চিকিৎসায় পার্টিকলথেরাপির ব্যবহার ক্রমশই বাড়ছে। তবে সাধারণ চিকিৎসার থেকে পার্টিকলথেরাপির খরচ অনেক বেশি, তার কারণ যন্ত্রপাতির দাম। সেই কারণেও রোগীদের খুব কম অংশই এর সুযোগ নিতে পারে। এমন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশেও কোনো কার্বনথেরাপি কেন্দ্র এখনো চালু হয়নি। আশা করা যাক ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি একে সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে আনবে।


আরো জানতে হলে

Scientific and technological development of hadrontherapy, Saverio Braccin, Astroparticle, Particle and Space Physics, Detectors and Medical Physics Applications. World Scientific (2010)

Particle Therapy Cooperative Group (PTCOG) website https://www.ptcog.site/

VECC Medical Cyclotron Facility website https://www.vecc.gov.in/r-d-activities/742

প্রকাশ - জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার, শারদ ২০২৪