বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা - কেন করব?
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
স্বাধীনতার পরের বছরেই আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর উদ্যোগে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা ও প্রসারের জন্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ। প্রতিষ্ঠা দিবসেই প্রকাশিত হয়েছিল পরিষদের মুখপত্র জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকার প্রথম সংখ্যা। সেখানে 'রামেন্দ্র'র পথ না জগদীশ-প্রফুল্ল'র পথ', এই নামের একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন সুপরিচিত সমাজবিজ্ঞানী বিনয়কুমার সরকার। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান প্রসারের জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন। তাঁর প্রায় সমসাময়িক জগদীশচন্দ্র ও প্রফুল্লচন্দ্র আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণাতে আমাদের দেশে পথিকৃৎ। বিশেষ করে জগদীশচন্দ্র তাঁর গবেষণা বাংলা ভাষায় লিখে প্রকাশ করেছিলেন। বিনয়কুমার প্রশ্ন করেছিলেন বিজ্ঞান পরিষদ কোন পথে এগোবে? সে কি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান গবেষণা করার দিকে নজর দেবে? নাকি শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান প্রসারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
বিনয়কুমার নিজের মতো করে প্রশ্নের একটা উত্তর দিয়েছিলেন, কিন্তু আট দশক পরে সেই উত্তর নিয়ে আলোচনার সম্ভবত বিশেষ প্রয়োজন নেই। এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীর বিজ্ঞান জগতের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবশ্যই শেষ হয়েছিল, কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে তার অভিঘাত তখনো পুরোপুরি বোঝা যায় নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত ইউরোপই ছিল বিজ্ঞান গবেষণাতে অগ্রগণ্য। কিন্তু হিটলারের ফ্যাসিস্ট শাসন থেকে প্রাণ বাঁচাতে ইউরোপের বিজ্ঞান জগতের রথীমহারথীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইউরোপে নানা দেশের বিজ্ঞানীরা নিজেদের ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করতেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পরে তাঁরা বাধ্য হয়েই ইংরাজিতে তাঁদের গবেষণা প্রকাশ করতে থাকেন। বিজ্ঞানের ভারকেন্দ্র চলে যায় নতুন দুনিয়াতে।
গত তিন দশকে তার সঙ্গে দুটি বিষয় যুক্ত হয়েছে। প্রথমত, অতি দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসার যা আগে কল্পনাতীত ছিল; গোটা পৃথিবীটাই একটা গ্রামের সমতুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাকে আমরা বলি ভুবন-গ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজ। দূরের দেশের কোনো ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষকেও একটা ইমেল লিখলে পরের মিনিটেই আমরা তার উত্তর আশা করি। আরও জরুরি প্রয়োজন হলে সরাসরি ফোন বা মেসেজ করি। এর সুযোগে ইংরাজি বাস্তবিকপক্ষে একমাত্র আন্তর্জাতিক ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত, একাকী বা অল্প কয়েকজন মিলে বিজ্ঞান গবেষণার যুগ এখন অতীত। বহু প্রকল্প এতই ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোনো একটি দেশের পক্ষে তার ভার বহন সম্ভব হচ্ছে না। গবেষণা এখন প্রকৃত অর্থেই আন্তর্জাতিক, নানা প্রকল্পে একই সঙ্গে হাজার হাজার বিভিন্ন ভাষাভাষী বিজ্ঞানী কাজ করেন; তাঁদের মত বিনিময়ের স্বাভাবিক মাধ্যম হল ইংরাজি। বিজ্ঞান বিষয়ক প্রায় সমস্ত প্রধান গবেষণাপত্রিকাগুলি এখন ইংরাজি ভাষাতেই প্রকাশিত হয়। ইউরোপের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ইংরাজি ভাষাতে শিক্ষাদান ক্রমশই বেড়ে চলেছে।
এখানে দু' একটা ব্যতিক্রমের কথা উল্লেখ করতে হয়, তার মধ্যে অন্যতম হল চিন। বিজ্ঞানপ্রযুক্তি গবেষণাতে মোট বিনিয়োগের হিসাবে চিন এখন দ্বিতীয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই। চিনের নীতিপ্রণেতারা বিশ্বাস করেন বিজ্ঞান প্রযুক্তিই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এবং জনগণের মধ্যে বিজ্ঞান প্রসার করতে হলে তাদের মাতৃভাষাই সব থেকে উপযুক্ত। তাই চিনা ভাষাতে বিজ্ঞান প্রসারে তাঁরা অর্থ বিনিয়োগ করছেন। তা সত্ত্বেও সেখানেও গবেষণাতে ইংরাজির ব্যবহার ক্রমশই বেড়ে চলেছে, কারণগুলো আগেই বলেছি। বিজ্ঞানচর্চার চরিত্রটাই হল আন্তর্জাতিক, এবং সেখানে ইংরাজি বর্তমানে একমাত্র মাধ্যম। জাপানের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যেতে পারে।
আগেই দেখেছি আন্তর্জাতিকভাবে ইংরাজি এখন বিজ্ঞানে যোগাযোগের ভাষা। কাজেই আমরা চাইলেও সম্ভবত তার থেকে মুখ ফিরিয়ে বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞানচর্চা করা খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্তু যদি সেটা করতেও চাই, আমাদের সামনে অনেকগুলি প্রতিবন্ধকতা কাজ করবে। ইংরাজির সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে যে কোনো ভাষার প্রয়োজন বিজ্ঞানচর্চার পরম্পরা, সদিচ্ছা এবং বিনিয়োগ। বিজ্ঞানচর্চার পরম্পরা আমাদের সমাজে নেই, দু' একজন বড় বিজ্ঞানী থাকলেও তা দিয়ে পরম্পরা গড়ে ওঠে না। আবার শুধুমাত্র পরম্পরা দিয়ে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি তার উদাহরণ। সেখানে জার্মানি, ইতালি বা ফ্রান্সের মতো বিজ্ঞানে অগ্রসর দেশেও মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা কমে এসেছে। ঐতিহাসিকভাবেই ঔপনিবেশিক শাসনের জন্য আমাদের দেশে ইংরাজি ভাষার চল আছে, এবং বিশেষ করে সমাজের উঁচুতলার মধ্যে তা আরও বাড়ছে। বহুভাষাভাষী ভারতবর্ষে বাংলা একটা প্রাদেশিক ভাষা মাত্র, এবং অবিরত তাকে হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমাদের দেশে বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ হাস্যকর রকম কম; এই মুহূর্তে তা চিনের ন' ভাগের এক ভাগ, এবং ক্রমেই আরও কমছে। সেই অতি সামান্য বিনিয়োগের একাংশকে মাতৃভাষাতে বিজ্ঞান গবেষণার মতো কাজে খরচ করার চিন্তা বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়।
কেন বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগ ক্রমশই কমছে? তার কারণ বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকরা প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ও পুরাণের মধ্যে বিজ্ঞান খুঁজতেই বাসত। তাঁদের কাছে আধুনিক বিজ্ঞান শুধু অপ্রয়োজনীয় নয়, রীতিমত বিপজ্জনক; কারণ বিজ্ঞান শুধু একটা বিষয় নয়। বিজ্ঞান একটা দর্শন, চোখ বুজে কোনো কিছুকে বিশ্বাস করতে বারণ করে, প্রশ্ন করতে ও যুক্তির সাহায্যে বিচার করতে শেখায়। বিশেষ করে আমাদের সমাজে যা কিছু পুরানো তাদের প্রতি একটা অহৈতুকী ভক্তি লক্ষ্য করা যায়, শাসকরা তার সুযোগ নিচ্ছেন। বিজ্ঞান ঠিক সেই পুরানোকেই প্রশ্ন করে। তাই সমাজপতিরা চিরকালই বিজ্ঞানকে অপছন্দ করেন।
বিজ্ঞান গবেষণা ও সাধারণের মধ্যে বিজ্ঞান প্রসারের বাইরে আরও একটা বিষয় আছে, তা হল বিজ্ঞান শিক্ষা। আমি একে দুই ভাগে ভাগ করতে চাই, উচ্চ শিক্ষা ও বিদ্যালয়ে শিক্ষা। প্রথমেই আসি উচ্চ শিক্ষার কথায়। প্রশ্ন আসে, বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে উচ্চশিক্ষার পরে ছাত্র বা ছাত্রীটি কী করবে? পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ এতই কম যে রাজ্য ত্যাগ করা ছাড়া তাদের সামনে বিশেষ পথ খোলা নেই। সেক্ষেত্রে ইংরাজি ভাষাতে অন্তত চলনসই জ্ঞান প্রয়োজন। সারা দেশেও বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে শিক্ষিতদের জন্য যে ক'টি নতুন চাকরি হচ্ছে তাদের অধিকাংশই তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে। সেখানে ইংরাজি ছাড়া গত্যন্তর নেই।
এর পাশাপাশি রয়েছে উচ্চশিক্ষার বাস্তব চিত্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত শতাব্দীতে অনার্স ও পাস পরীক্ষাতে বিজ্ঞানের প্রশ্নপত্র ইংরাজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও হত। কিন্তু আমার জ্ঞানত পদার্থবিদ্যার অনার্সে একজন পরীক্ষার্থীও বাংলা ভাষাতে উত্তর লিখেছে বলে শুনিনি; সে জন্য এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলা প্রশ্নপত্র বন্ধ হয়ে যায়। এর পিছনে একটা কারণ হয়তো ভালো পাঠ্যপুস্তকের অভাব, কিন্তু ব্যক্তিগত জ্ঞান থেকে বলতে পারি যে অন্তত পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে সেই যুক্তি খাটে না। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের উদ্যোগে গত শতাব্দীর শেষ দুই দশকে অনেকগুলি পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক ছাপা হয়েছিল, যেগুলি যে কোনো আন্তর্জাতিক পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত। সেগুলি লিখেছিলেন অমলকুমার রায়চৌধুরি বা সমরেন্দ্রনাথ ঘোষালের মতো দিকপাল বিজ্ঞানী ও অধ্যাপকেরা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ছাত্রছাত্রীরাও শ্রেণিকক্ষে বাংলা ভাষাতে পড়ানোকেই পছন্দ করে। তা সত্ত্বেও পরীক্ষাতে বাংলাতে উত্তর লেখার চেষ্টা ছাত্রছাত্রীরা করেনি। তার কারণ আগের আলোচনা থেকেই পাওয়া যাবে। বর্তমানে অবশ্য বাংলা পুস্তকগুলি বিশেষ পাওয়া যায় না। পেলেও লাভ হত না, কারণ এর মধ্যে পাঠক্রম অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে; কিন্তু আমাদের রাজ্য সরকার নতুন বই ছাপা বা পুরানোর পুনর্মুদ্রণ কোনোটাতেই আগ্রহী নন।
বিদ্যালয় স্তরের সমস্যাটা অন্য রকম। সেখানে বাংলা পাঠ্যপুস্তক পাওয়া যায়, এবং এখনো পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী বাংলা ভাষার মাধ্যমেই পড়াশোনা করে। কিন্তু সমাজের এলিট বা উচ্চশ্রেণি বাংলা মাধ্যম থেকে মুখ ফিরিয়েছেন, সম্ভব হলে তাঁরা বাংলা ভাষাটাকেই ত্যাগ করতে চান। তার পিছনে অনেক আর্থসামাজিক কারণ আছে, বিশেষ করে কাজের সুযোগের কথা আগেই বলেছি। তার সঙ্গে আছে সমাজের তথাকথিত নিম্নস্তরকে দূরে রেখে নিজেদের জন্য একটা আলাদা জগৎ সৃষ্টির প্রয়াস। তাই এখন যখন 'অন্য' শ্রেণির মানুষরাও কষ্ট করে হলেও ছেলেমেয়েদের ইংরাজি মাধ্যমে পড়াচ্ছেন, তখন উচ্চ শ্রেণি তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য বেছে নিচ্ছেন তথাকথিত আন্তর্জাতিক স্কুল। সেখানে বাংলা না পড়ালেও ইংরাজির পাশাপাশি ফরাসি জার্মান বা স্প্যানিশের মতো ভাষা পড়ানো হয়, যদিও ইংরাজির এই আধিপত্যের যুগে সেই জ্ঞান বাস্তবে কোন কাজে লাগবে জানি না।
এ ঘটনা নতুন নয়; আমাদের ইতিহাসেই এর উদাহরণ আছে। সংস্কৃত সাধারণ মানুষের ভাষা ছিল না, তা ছিল সমাজের উচ্চবর্ণের উচ্চ শ্রেণির ভাষা। সাধারণ মানুষ কথা বলতেন প্রাকৃতে। এভাবেই সমাজের উচ্চশ্রেণি নিম্নবর্গের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলেছিল। ইউরোপেও মধ্যযুগে পণ্ডিতরা লাতিন ভাষায় বিদ্যাচর্চা করতেন, নিজেদের মধ্যে মত বিনিময় করতেন। সাধারণ মানুষ সেই ভাষা ব্যবহার করতেন না।
বাংলা একটা দেশের মাতৃভাষা, কিন্তু সেই বাংলাদেশে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির চর্চা সম্পর্কে আমার খুব বেশি জানা নেই। তবে যেটুকু জানি, তার থেকে মনে হয় এই সমস্যাগুলো সে দেশেও কমবেশি আছে। বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান গবেষণা বা উচ্চ শিক্ষার সমস্যাগুলির সমাধান সুদূরপরাহত। সমাজের এলিট শ্রেণি বিদ্যালয়ে স্তরেই বাংলা ভাষাকে ত্যাগ করছেন। আমরা যতই ভাষাদিবস পালন করি, বা রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বলি শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ, সমাজের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। বরঞ্চ আমাদের সামনে এখন প্রশ্ন হল, সত্যিই কি বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান চর্চা বা বিজ্ঞান শিক্ষার কোনো প্রয়োজন আছে? নাকি এ শুধুমাত্র নস্টালজিয়া? শৈশবে কৈশোরে বাংলা ভাষাতে পড়াশোনা করেছিলাম, সেই অতীতে ফিরে যাওয়ার বন্ধ্যা প্রয়াস?
এই প্রশ্নের উত্তর আমি আমার মতো করে দেওয়ার চেষ্টা করব, তবে তার আগে আমাদের দেশে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। আমাদের সমাজে আধুনিক বিজ্ঞানকে বাইরে থেকে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, এখনো পর্যন্ত আমাদের জীবনের সঙ্গে তার যোগাযোগ বিশেষ নেই। ঐতিহাসিক কারণেই আমাদের জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চা প্রাচীন রীতিনীতির সঙ্গে সমঝোতা করে চলেছে। ঔপনিবেশিক শাসকরা যখন বিদেশি শাসনের যৌক্তিকতা হিসাবে আমাদের সমাজের পশ্চাতপদতার কথা বলতেন, তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে আমাদের নবজাগরণ প্রাচীন ভারতীয় সমাজকে মহিমান্বিত করেছিল। কিন্তু এর ফলে প্রাচীন সমাজের অযৌক্তিক দিকগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ব্যাহত হয়েছে, এবং বাস্তবে বিজ্ঞানবিপ্লব করা সম্ভব হয়নি। যেখানে বিজ্ঞানবিপ্লব সফল হয়েছে, সেই পশ্চিমি দুনিয়াতে বিজ্ঞানীদের মধ্যে অলৌকিক বা আধিদৈবিকে বিশ্বাস তলানিতে ঠেকেছে। যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে ধর্মে বিশ্বাস করেন তাঁরাও তাঁদের বিজ্ঞানচর্চাকে তার থেকে পৃথক রাখেন। সেখানে যে কোনো মানুষই বাইবেল বা অন্য ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত অলৌকিক ঘটনাকে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির মোড়কে উপস্থিত করার চেষ্টা করেন না তা নয়, কিন্তু তা নিতান্তই ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাই সমাজের উচ্চশ্রেণি সেই প্রচেষ্টাকে সমর্থনের চেষ্টা করে না বা কোনো প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী তাতে যোগ দেন না।
আমাদের মতো অনেক সমাজে পরিস্থিতিটা অন্যরকম। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেই কেউ বিজ্ঞানমনস্ক হবে এমন কথা বলা যায় না। বিজ্ঞানের বিপ্লব না হওয়ার ফলেই আমাদের বিজ্ঞানীদের মধ্যেও নানা অবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা বাসা বেঁধে আছে। আগে সেগুলি তেমন প্রকাশ পেত না বা প্রচার হত না। এই সর্বব্যাপী সমাজমাধ্যমের যুগে তা সহজেই সামনে আসছে, ফলে যে সাধারণ মানুষটি আগে তাঁর অবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনাকে লুকিয়ে রাখতেন, তিনি এখন তা প্রকাশ্যে আনতে দ্বিধা বোধ করছেন না, এবং তাঁর মতো অনেকেই তাঁকে সমর্থন করছেন। তার ফল হল ভোটের মুখাপেক্ষী আমাদের শাসকরা সমাজের পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিবর্তে তাদেরই জয়গান গাইছেন। যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান সব কিছু শিকেয় তুলে সমাজকে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে।
বর্তমানে বিজ্ঞান নিজেই আক্রান্ত হচ্ছে। বিজ্ঞানপ্রযুক্তির চোখ ধাঁধানো বিকাশ সত্ত্বেও গরিব মানুষের অবস্থার উন্নতি হয়নি; অন্যদিকে ধনী আরও ধনী হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি বেশ ব্যয়সাপেক্ষ, ফলে সমাজের উঁচুতলা তার দখল নিচ্ছে। মানুষের মনে যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে, তা শাসকদের আসন টলিয়ে দিতে পারে। শাসকরা তাই তাকে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী ধারণার বিরুদ্ধে চালনা করার চেষ্টা করছেন এবং অনেক সময়েই সফল হচ্ছেন। পুরানো ধ্যানধারণার বাড়বাড়ন্ত ঘটছে, ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে যুক্তিবাদের জায়গা নিচ্ছে কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস ও রহস্যবাদ।
এই পরিস্থিতিতে অবিজ্ঞান, অপবিজ্ঞান ও অযুক্তির বিরুদ্ধে লড়াইটা কঠিনতর হয়ে পড়েছে। তাহলে উপায় কী? আমরা ইতিহাসের পাতা খুলি। গ্যালিলিওর বিচারের কথা আমরা সবাই জানি। গ্যালিলিও সূর্যকে স্থির পৃথিবীকে চলমান বলে বাইবেল বিরোধী কথা বলছেন, ক্যাথলিক চার্চের সামনে এটাই একমাত্র সমস্যা ছিল না। সমস্যাটা এটাও ছিল যে তিনি তাঁর বই লাতিনে না লিখে ইতালিয় ভাষাতে লিখছেন, যাতে করে শুধু পণ্ডিতরা নয়, সাধারণ মানুষেও তাঁর কথা বুঝতে পারেন। এর ফলে ধর্মের উপর থেকে মানুষের বিশ্বাস টলে যেতে পারে, এবং বাস্তবেও তাই হয়েছিল। নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকার গণিত নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের অবোধ্য ছিল, সেই বই লাতিনেই লেখা। কিন্তু আলোকবিদ্যা সংক্রান্ত তাঁর অধিকাংশ পরীক্ষানিরীক্ষা যে কোনো উৎসাহী মানুষই করে দেখতে পারেন, তাই সচেতনভাবেই তাঁর অপটিক্স বইটি তিনি ইংরাজি ভাষাতেই লেখেন। আধুনিক বিজ্ঞান মূলগতভাবে প্রাচীন বিজ্ঞান থেকে পৃথক; সেখানে প্রাচীন পুস্তক বা পণ্ডিতদের কথায় বিশ্বাস না করে পরীক্ষানিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের উপর জোর দেওয়া হয়, আপ্তবাক্যের জায়গা নিয়েছে যুক্তি। স্বাভাবিকভাবেই সে যুগে সমাজের উপরের শ্রেণির তা পছন্দ ছিল না, কিন্তু সাধারণের বোধগম্য ভাষাতে বিজ্ঞানের প্রকাশের ফলে যে বিপ্লব শুরু হয়েছিল, তাকে আটকানোর ক্ষমতা তাঁদের ছিল না।
আরও প্রাচীন এক উদাহরণের কথা বলতে পারি। মধ্যযুগে ইউরোপ, ভারত বা চিনে যখন বিজ্ঞানচর্চা কানাগলিতে ঢুকে পড়েছিল, তখন তাকে উদ্ধার করেছিল আরব সভ্যতা। আরব সভ্যতার সেই যুগে বিজ্ঞানের চালনাশক্তি হয়েছিল বিদেশি ভাষা থেকে আরবিতে অনুবাদ। বহু গ্রিক, সংস্কৃত, চিনা বইয়ের অনুবাদ হয়েছিলে, খলিফারা ছিলেন সেই কাজের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। গ্রিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী অ্যারিস্টটলের অনেক বইয়ের গ্রিক মূলটি আর পাওয়া যায় না, আরবিতে অনুবাদ হয়েছিল বলে সেগুলি রক্ষা পেয়েছে। এভাবেই নিজের ভাষাতে চর্চার মাধ্যমেই আরব সভ্যতা বিজ্ঞানে প্রাচীন যুগকে ছাড়িয়ে অনেক মৌলিক অবদান রেখেছিল। আরব সাম্রাজ্য স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। আবার যখন তা পিছু হটতে শুরু করে, ইউরোপের পণ্ডিতরা আরবি ভাষায় লেখা বইপত্র হাতে পান। জ্ঞানবিজ্ঞানের বই আরবি থেকে অনুবাদের মাধ্যমে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। অবশ্য প্রথমে সেই অনুবাদ হয়েছিল পণ্ডিতদের ভাষা লাতিনে, কিন্তু তার পরে তা স্থানীয় ভাষাতেও অনুবাদ হয়েছিল।
উপরের দুটি উদাহরণ থেকে দেখতে পাই সমাজে বিজ্ঞানকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করতে গেলে মাতৃভাষার মাধ্যমেই সেটা সম্ভব। আমাদের প্রয়োজন সংস্কৃতির পরিবর্তন; তা মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে সম্ভব, অন্য কোনো ভাষার মাধ্যমে তত সহজে নয়। শুধু বিজ্ঞান পরিষদ নয়, আমরা যারা সমাজের সুস্থ বিকাশ চাই, সমাজকে বৈজ্ঞানিক ধারণার ভিত্তিতে সংগঠিত করতে চাই, আমাদের সকলের সামনে যে পথ খোলা তা হল রামেন্দ্র'র পথ, অর্থাৎ মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান প্রসার। তা যে স্কুল কলেজের শ্রেণিকক্ষে করতে হবে এমন নয়, জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বইও সেই কাজ সাফল্যের সঙ্গে করতে পারে। অবিজ্ঞান ও অযুক্তির বিরুদ্ধে যে পথকে রামেন্দ্র'র পথ বলে এই লেখাতে চিহ্নিত করতে চাওয়া হয়েছে, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী নিজেও সেই পথে স্থির থাকতে পারেননি; তবে সে অন্য প্রসঙ্গ। আরব সভ্যতার ইতিহাস এই শিক্ষাও দেয় যে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের জন্য সংগ্রামকে কখনোই বন্ধ করা যাবে না, তা হলে আবার আমরা পশ্চাৎপদতার কানাগলিতে ঢুকে পড়ব।
প্রকাশ - সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনা, নববর্ষ সংখা- ১৪৩২
উত্তম। যুক্তপূর্ণ তথ্য সমৃদ্ধ রচনা।
ReplyDelete