Saturday 2 December 2017

শতবর্ষে বিজ্ঞানী অসীমা চট্টোপাধ্যায়

অগ্রণী মহিলা বিজ্ঞানী অসীমা চট্টোপাধ্যায়


গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       আমরা যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজাবাজারে অবস্থিত বিজ্ঞান কলেজে পড়াশোনা শুরু করেছিলাম, রসায়ন বিভাগে এক অধ্যাপিকাকে দেখলাম। স্পষ্টতই তাঁর অনেক বয়স, কিন্তু নিয়মিত আসেন, সারা দিন ল্যাবরেটরিতে থাকেন, কাজ করেন। প্রথম প্রথম অবাক হয়ে ভাবতাম এত বয়স, এখনো অবসর নেননি? পরে এক বন্ধু চিনিয়ে দিল, অনেক আগে থেকেই তাঁর নাম শুনেছিলাম, তিনিই অসীমা চট্টোপাধ্যায়। তার পরেও দীর্ঘদিন তিনি নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে এসেছেন, কাজ করেছেন। কখনো কখনো তাঁর সঙ্গে আমার দু-একটা কথাও হয়েছে। তাঁর জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়েই এই প্রবন্ধ। শিরোনাম দেখে কেউ যেন ভুল না করেন যে  অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের বিজ্ঞান জগতে খ্যাতির অন্যতম কারণ তিনি মহিলা। তাঁর গবেষণা যে কোনো পুরুষ বিজ্ঞানী করলেও তিনি একই সুনাম অর্জন করতেন। কিন্তু সন্দেহ নেই বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকৃতি পেতে তাঁকে পুরুষদের থেকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছিল। আজও আমাদের দেশে বিজ্ঞানীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি। আধুনিক ভারতের বিজ্ঞানে যে মহিলারা প্রথম নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিলেন, অসীমা তাঁদের মধ্যে বহুক্ষেত্রেই প্রথম।
       বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ ইন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায় ও  কমলা দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা অসীমার জন্ম হয়েছিল ১৯১৭ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর। অসীমা এবং তাঁর ভাই ডাক্তার সরসীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় দুজনেই গবেষণাতে কৃতিত্বের স্বাক্ষর হিসাবে ভারতে বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মান ভাটনগর পুরস্কার অর্জন করেন –ভারতের ইতিহাসে এই উদাহরণ আর নেই। অসীমা বেথুন কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৩২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। দু বছর পরে সেখান থেকে আইএসসি পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হনদুটি পরীক্ষাতেই তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃত হিসাবে তিনি সরকারি বৃত্তি পেয়েছিলেন। তাছাড়াও পেয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব লতিফ এবং ফাদার লাফোঁর নামে বৃত্তি এবং হেমপ্রভা বসু স্মারক পদক।

অসীমা চট্টোপাধ্যায় (২৩ সেপ্টেম্বর ১৯১৭ -- ২২ নভেম্বর ২০০৬)
       এরপর অসীমা ভর্তি হন স্কটিশ চার্চ কলেজে। সে সময় একমাত্র এই কলেজেই মেয়েদের রসায়নে অনার্স পড়ার সুযোগ ছিল। পরিবারের থেকে আপত্তি ছিল,  কারণ ওই কলেজে ছেলে মেয়েরা একত্রে পড়াশোনা করত। সেই সময়ের সামাজিক পরিবেশের কথা চিন্তা করলে আমরা বুঝতেই পারি যে অসীমার এই সিদ্ধান্ত তাঁর দৃঢ়তার পরিচয় দেয়। এ কাজে তাঁর সহায় হয়েছিলেন মা কমলা। রসায়ন অনার্সে তিন জন পড়ুয়ার মধ্যে একমাত্র মেয়ে অসীমা। ১৯৩৬ সালে স্বর্ণপদক সহ অনার্স পাস করে মায়ের বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছিলেন অসীমা। দু বছর পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এমএসসিতে দ্বিতীয় স্থান।
       আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের মধ্যমণি। তাঁর উৎসাহে জৈব রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করছেন অধ্যাপক প্রফুল্লকুমার বসু, তাঁরই তত্ত্বাবধানে অসীমা কাজ শুরু করলেন – তাঁর লক্ষ্য ভেষজ উদ্ভিদ থেকে পাওয়া জৈব যৌগের রাসায়নিক গঠন নির্ণয়। অসীমা বুঝতেই পেরেছিলেন যে ভারতবর্ষে ভেষজ উদ্ভিদের প্রাচুর্য আছে, তাই এ বিষয়ে গবেষণার সুযোগ প্রচুর। গবেষণার মধ্যেই তিনি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপিকা হিসাবে যোগদান করেন এবং তাঁর হাত ধরেই ঐ কলেজে রসায়ন বিভাগের পথচলা শুরু হয়। ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম মহিলা হিসাবে ডিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই বছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনা পারিশ্রমিকে পড়ানো শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে  শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক বরদাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হনতাঁদের একমাত্র কন্যা জুলি, তিনিও মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জৈব রসায়ন বিষয়েই গবেষণা করেছেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন।
       ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ – এই তিন বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বা ক্যালটেক এবং সুইজারল্যান্ডের জুরিখে উচ্চতর গবেষণার জন্য কাটান অসীমাজুরিখে তিনি নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী পল কারেরের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। সর্বত্রই একই বিষয়ে অর্থাৎ ভেষজ উদ্ভিদ সংক্রান্ত জৈব রসায়ন। দেশে ফিরেও গবেষণাতে ভাঁটা পড়েনি। ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে রিডার পদে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে হলেন ওই বিভাগেই খয়রা অধ্যাপক। ১৯৭২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরেই শুরু করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের আনুকূল্যে বিশেষ গবেষণা প্রোগ্রাম১৯৮২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু গবেষণাতে ছেদ পড়েনি। ২০০৬ সাল পর্যন্ত নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন এবং গবেষণাতে অংশ নিয়েছেন। তাঁর গবেষণা পত্রের সংখ্যা চারশোরও বেশি। প্রায় পঞ্চাশ জন ছাত্রছাত্রী তাঁর কাছে কাজ করে ডক্টরেট উপাধি পেয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, তাঁরা সবাই অধ্যাপিকা চট্টোপাধ্যায়কে ‘মাস্টার’ বলে ডাকতেন।  
       তাঁর গবেষণার পথ মোটেই সহজ ছিলনা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন তিনি পড়ানো ও গবেষণা শুরু করেছিলেন, সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে সুযোগসুবিধা বিশেষ ছিল না। আর্থিক অসুবিধা তো ছিলই। গবেষকদের বৃত্তি ছিল দুর্লভ, ফলে প্রায় সব ছাত্রই আংশিক সময়ে কাজ করতেন। তাঁর প্রথম যুগের ছাত্র সত্যেশচন্দ্র পাকড়াশি লিখেছেন তিনি যখন অধ্যাপিকা চট্টোপাধ্যায়ের কাছে কাজ শুরু করেন, তখন তিনিই ছিলেন তাঁর একমাত্র সর্বসময়ের ছাত্র, বৃত্তি ছিল দেড়শো টাকা। পক্ষান্তরে অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণাগারের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র তিনশো টাকা। গবেষণার জন্য তাঁদের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, বোস ইনস্টিটিউট বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বিভাগগুলির উপর নির্ভর করতে হত।
       এত প্রতিকূলতার মধ্যে অসীমা চট্টোপাধ্যায়কে কাজ করতে হয়েছিল। তার মধ্যেও ১৯৬১ সালে তিনি ভারতীয় বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড়ো সম্মান ভাটনগর পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে হয়েছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি। তাঁর আগে কোনো মহিলা এই সম্মান লাভ করেন নি। ১৯৬০ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স আকাদেমির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে পদ্মভূষণ সম্মান লাভ করেন১৯৮২ সালে রাজ্যসভার সাম্মানিক সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন, ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি সদস্য ছিলেন
       বহু বিখ্যাত বিজ্ঞানীর স্নেহ লাভ করেছিলেন অসীমা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর গবেষণার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত দশ বছর তিনি গবেষণাতে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাহায্য পেয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ পদার্থবিদ হিসাবে সুবিদিত, কিন্তু রসায়নে তাঁর আগ্রহ সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা প্রচলিত নেই। সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকাতে এক প্রবন্ধে রসায়ন বিষয়ে তাঁর গবেষণার উপর আলোকপাত করেছিলেন অসীমা চট্টোপাধ্যায়। বিদেশে যাওয়ার সময় সত্যেন্দ্রনাথই তাঁর গবেষণাগারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অসীমা নিজেই লিখেছেন যে ১৯৬৭ সালে চারমাসের মধ্যে যখন তাঁর বাবা ও স্বামী মারা গিয়েছিলেন, তখন সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর বাবার স্থান অধিকার করে তাঁকে মানসিক শান্তি দিয়েছিলেন।  ক্যালটেকে থাকার সময় তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী দু’বার নোবেল পুরস্কার জয়ী লাইনাস পাউলিঙের সাহচর্য পেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে সৌহার্দ্য পাউলিঙের মৃত্যু পর্যন্ত বজায় ছিল। বিজ্ঞান জগতের বাইরে আর একজন মানুষ তাঁর গবেষণা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। ভারত সরকার যখন প্রস্তাব দিয়েছিল যে জমি পেলে তাঁর গবেষণার জন্য আয়ুর্বেদ হাসপাতাল তৈরি করে দেবে, তখন জ্যোতি বসুই নামমাত্র ভাড়ায় সল্ট লেকে জমির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত মনে পড়ে আর একজন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিজ্ঞান কলেজে একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন, তখন অধ্যাপিকা চট্টোপাধ্যায়কে দেখতে পেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে তাঁকে নমস্কার করেন।
       অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণার খুব সংক্ষিপ্ত পরিচয় আমরা এর পরেই দেখব, তার আগে বলি তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা। বিদেশী এক ওষুধ কোম্পানি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যালের কাছে পেটেন্ট আইন ভঙ্গের জন্য মামলা করে বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলআদালতে বিশেষজ্ঞ হিসাবে দিনের পর দিন বেঙ্গল কেমিক্যালের হয়ে লড়াই করে জয় ছিনিয়ে এনেছিলেন তিনি। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মৃত্যুর পরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন অধ্যাপিকা চট্টোপাধ্যায়১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি ঐ পদে ছিলেন। ১৯৮৩ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি ছিলেন পরিষদের উপদেষ্টা। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদে তাঁর অবদান নিয়ে অধ্যাপিকা সুমিত্রা চৌধুরী জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় আলোচনা করেছেন।
       সাধারণ মানুষের মধ্যে ভেষজ উদ্ভিদের গুরুত্ব প্রচারে তিনি সবসময় সচেষ্ট ছিলেন। কালীপদ বিশ্বাস ও বিজয়কালী ভট্টাচার্য রচিত ‘ভারতীয় বনৌষধি’ বইটি তাঁরি সম্পাদনায় সংস্কার ও পরিবর্ধন করে ছয় খণ্ডে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করেছিল। পরবর্তীকালে ১৯৯২ থেকে ২০০১ সালে কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ ছয় খণ্ডে ‘The Treatise of Indian Medicinal Plants’ প্রকাশ করেছিল মূল সম্পাদক ছিলেন অসীমা চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর ছাত্র সত্যেশ চন্দ্র পাকড়াশি।

       সবশেষে আসি তাঁর গবেষণার কথায়। স্বাভাবিক ভাবেই সে সম্পর্কে বিশদ আলোচনার সুযোগ এই নিবন্ধে নেই। কিন্তু একটা কথা খুবই স্পষ্ট, তাঁর গবেষণাও কিন্তু সমাজ বিচ্ছিন্ন বিজ্ঞানীর গজদন্ত মিনারে বসে কাজ নয়। যে বিজ্ঞানীরা আমাদের দেশে উচ্চতর গবেষণার ফল সরাসরি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের নাম তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে থাকবে। একটা উদাহরণ দেখা যাক। শুষনি শাক থেকে তিনি এক নতুন যৌগ মারসিলিন নিষ্কাশন করেন। তাঁর ভাই সরসীরঞ্জনের সঙ্গে যৌথ গবেষণাতে তিনি দেখান যে এই যৌগ মৃগীরোগের উপশমে সাহায্য করে। করে তাঁর আয়ুষ-৫৬ মৃগীরোগের ওষুধ এবং আয়ুষ-৬৪ ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভারত সরকার আয়ুর্বেদ হাসপাতালের মঞ্জুরি দেন, যে কথা আগেই বলেছি।
       অসীমা প্রাকৃতিক যৌগ নিষ্কাশন ও তাদের আণবিক এবং ত্রিমাত্রিক গঠন নিরূপণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে বিশেষজ্ঞের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তাঁর ছাত্র কালীপ্রসন্ন ধারাকে বিদেশ এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী বলেছিলেন যে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তাঁরা অধ্যাপিকা চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণার দিকে নজর রাখতেন, কারণ তাঁরা জানতেন যে ভেষজ যৌগের প্রস্তাব তাঁরা করবেন, অসীমা তা নিষ্কাশন করে দেখাবেন। বিশেষ করে ইন্ডোল উপক্ষারঘটিত যৌগের বিষয়ে তাঁর গবেষণা সারা পৃথিবীতে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। হাঁপানি রগে ব্যবহৃত এফিড্রিন যৌগ বিষয়ে তাঁর গবেষণা স্নাতক স্তরের বইতে স্থান পেয়েছে। সর্পগন্ধা, জেটামানসি, ছাতিম সহ আরো নানা ভেষজ উদ্ভিদ থেকে তিনি বহু যৌগ নিষ্কাশন করেছিলেন, তাদের গঠন নির্ধারণ করেছিলেন, এবং ক্যানসার, হৃদরোগ, মৃগী, হাঁপানি, ম্যালেরিয়া সহ বিভিন্ন রোগে তাদের কার্যকারিতা বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন।  
       অসীমা চট্টোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন যতদিন তিনি বাঁচবেন, কাজ করে যেতে চান। তাঁর এই ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছিল। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে পর্যন্ত তিনি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০৬ সালের ২২শে নভেম্বর তাঁর প্রয়াণ ঘটে। তাঁর গবেষণাপত্রের তালিকাতে শেষ সংযোজন ঘটে ২০০৭ সালে।  ভারতীয় মার্গসঙ্গীত বিষয়ে তিনি উৎসাহী ছিলেন, চোদ্দ বছর ধ্রুপদ ও খেয়াল শিখেছিলেন। ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণার কাজে গিয়েছিলেন, রামকৃষ্ণ মিশনের থেকে নানাভাবে সাহায্য পেয়েছিলেন। আমৃত্যু মিশনের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। জীবনের শেষ দিনগুলিতে স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে কিছু লেখার তাঁর ইচ্ছা ছিল, তা আর পূরণ হয়নি।

       লেখাটি তৈরি করতে অনেকের সাহায্য লেগেছে। জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকার মে ২০১৭ সংখ্যায় অধ্যাপিকা অসীমা চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে কয়েকটি মূল্যবান নিবন্ধ লিখেছেন কালীপ্রসন্ন ধারা, সুমিত্রা চৌধুরী, দীপক ভট্টাচার্য এবং স্মরজিত চট্টোপাধ্যায়। সৃষ্টির একুশ শতক পত্রিকার মে ২০১৭ সংখ্যায় তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন মানস প্রতিম দাস। ভারতের মহিলা বিজ্ঞানীদের নিয়ে  এ যুগের কিশোর বিজ্ঞানী পত্রিকার মে-জুন ২০১৬ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে অধ্যাপিকা চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে কলম ধরেছিলেন সরোজকুমার রায়। অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের ছাত্র অধ্যাপক কালীপ্রসন্ন ধারার স্মৃতিচারণা শোনার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে। অধ্যাপিকা জুলি বন্দোপাধ্যায়ের কাছেও তাঁর মায়ের বিষয়ে কিছু কথা শুনেছিলাম। তাছাড়াও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স আকাদেমির ফেলোদের যে জীবনী প্রকাশিত হয়, সেখানে তাঁর মায়ের জীবন এবং গবেষণার বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে তিনি লিখেছিলেন। ভারতীয় মহিলা বিজ্ঞানীদের নিয়ে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স আকাদেমি প্রকাশ করেছে Lilavati’s Daughters, সেখানে তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন সত্যেশ চন্দ্র পাকড়াশি তাঁদের সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। 

প্রকাশঃ চিন্তাভাবনা শারদীয় সংখ্যা ১৪২৪

No comments:

Post a Comment