Tuesday, 20 March 2018

স্মরণঃ ইউ আর রাও, যশপাল, পি এম ভার্গব এবং মিরিয়াম মির্জাখানি

       একই দিনে প্রয়াত হলেন ভারতের বিজ্ঞান জগতের দুই সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, ইউ আর রাও এবং যশপাল। দুজনেই দীর্ঘদিন মহাকাশ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এক আশ্চর্য সমাপতনে দুজনেই কিছুদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউটে কাজ করেছিলেন।ভারত সরকারও দুজনকেই পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করেছে।

       ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশনের অধিকর্তা মহাকাশ বিজ্ঞানী ইউ আর রাও (মার্চ ১০, ১৯৩২ – জুলাই ২৪, ২০১৭) ভারতীয় কৃত্রিম উপগ্রহ প্রোগ্রামের জনক হিসাবে পরিচিত। ১৯৭৫ সালে ভারতের প্রথম উপগ্রহ আর্যভট্ট থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন তিনি ভারতের সমস্ত উপগ্রহের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই ভারত এএসএলভি, জিএসএলভি এবং পিএসেলভি রকেট তৈরি করে। যখন ভারতকে রকেটের জন্য ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন প্রযুক্তি হস্তান্তরের উপর নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক স্তর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল, তখন তিনিই সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে ভারতে ঐ ইঞ্জিন তৈরি করে। আজ যে ভারত রকেট প্রযুক্তিতে সারা পৃথিবীতে একেবারে প্রথম সারিতে রয়েছে, এর পিছনে যদি একজন মানুষের নাম করতে হয়, তিনি ইউ আর রাও। আর্যভট্ট, ভাস্কর, রোহিণি উপগ্রহ থেকে শুরু করে চন্দ্রযান ও মঙ্গলযান অভিযান – সমস্তের পিছনেই তাঁর অবদান ভোলার নয়।তিনি মহাকাশ গবেষণাকে সাধারণ মানুষের উপকারে লাগানোর বিষয়ে সবসময় সচেষ্ট ছিলেন। মার্কিন পত্রিকা স্পেস নিউস ১৯৮৮ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে যে দশ জন ব্যক্তিত্ব মহাকাশ গবেষণাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন, সেই তালিকাতে রাওয়ের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিল। 

       যশ পাল (নভেম্বর ২৬, ১৯২৬ – জুলাই ২৪, ২০১৭) মুম্বাইয়রত টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চের মহাজাগতিক রশ্মি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে আমেদাবাদে স্পেস অ্যাপ্লিকেশনস সেন্টারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ভারত সরকারের বিজ্ঞানপ্রযুক্তি বিভাগের সচিব এবং ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য তাঁর তৈরি প্রোগ্রাম টার্নিং পয়েন্ট দূরদর্শনে একসময় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। সে জন্য তিনি আন্তর্জাতিক কলিঙ্গ পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন।

       দীর্ঘ রোগভোগের পরে প্রয়াত হলেন জীববিজ্ঞানী পি এম ভার্গব (ফেব্রুয়ারি ২২, ১৯১৮ – আগস্ট ১, ২০১৭)।  ভারতের জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে তাঁর নাম প্রথম সারিতে থাকবেরসায়নে পড়াশোনা শুরু করলেও ডক্টরেট করার পরে ব্রিটেনে গবেষণার সময় তিনি জীবপ্রযুক্তিবিদ্যা বা বায়োটেকনোলজি বিষয়ে মনোনিবেশ করেছিলেন। ১৯৭৭ সালে হায়দ্রাবাদে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেন্টার ফর সেলুলার এন্ড মলিকিউলার বায়োলজি, সংক্ষেপে সিসিএমবি, যা আজ দেশের অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান। তিনি ন্যাশনাল নলেজ কমিশনের সহসভাপতি হিসাবেও কাজ করেছিলেন। ভার্গব ছিলেন খুবই দৃঢ়চেতা এবং বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানমনস্কতার প্রতি দায়বদ্ধ। ১৯৮১ সালে দেশের প্রথমসারির বুদ্ধিজীবিরা বিজ্ঞানমনস্কতার সপক্ষে যে বিবৃতি প্রচার করেছিলে, তিনি ছিলেন সে বিষয়ে উদ্যোক্তাদের মধ্যে একজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে জ্যোতিষশাস্ত্রে বিএসসি ডিগ্রি চালু করার বিরুদ্ধে যাঁরা আদালতে গিয়েছিলেন, ভার্গবও তাঁদের মধ্যে ছিলেন। ১৮৮৬ সালে পদ্মভূষণ সম্মান পেলেও ২০১৫ সালে দেশে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি ২০১৫ সালে তা ফিরিয়ে দেন।

**********************************************************************
       মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে ক্যান্সারের কোপে প্রয়াত হলেন মিরিয়াম মির্জাখানি (মে ৩, ১৯৭৭- জুলাই ১৪, ২০১৭)গণিত জগতে সুপরিচিত এই ব্যক্তিত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। মির্জাখানির জন্ম ইরানে। সেখানে বিএসসি পাস করার পর তিনি উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার জন্য আমেরিকাতে যান। হার্ভার্ডে অধ্যাপক কার্টিস ম্যাকমুলেনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে তিনি ডক্টরেট করেন। ম্যাকমুলেন গণিত জগতে খুবই পরিচিত, অঙ্কশাস্ত্রে সর্বোচ্চ পুরস্কার ফিল্ডস মেডেলের অধিকারী। মির্জাখানিও ২০১৪ সালে রিমানিয়ান জ্যামিতির উপর তাঁর কাজের জন্য ফিল্ডস মেডেল লাভ করেন। তিনিই প্রথম মহিলা যিনি এই সম্মানে ভূষিত হন, ইরান থেকেও তিনি প্রথম ফিল্ডস মেডেল জয়ী। দীর্ঘদিন আমেরিকাতে থেকেও তিনি নিজের দেশকে ভুলে যাননি, তাঁর মেয়ের জন্য ইরানের নাগরিকত্ব তিনি চেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর ইরানের সংবাদপত্রে তাঁর যে ছবি প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে তাঁর চুল ঢাকা ছিল না- সে দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত মহিলাদের ছবিতে যা এতদিন ছিল অচিন্তনীয়। ইরানের সাংসদরা সম্মিলিত ভাবে তাঁর মেয়েকে ইরানের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাদের গণিত বিভাগের নাম দিয়েছেন মির্জাখানি।


(প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক,  আগস্ট ২০১৭)


 

       

Saturday, 17 March 2018

স্টিফেন হকিং- শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিজ্ঞানভাষে প্রকাশিত


স্টিফেন হকিং- শ্রদ্ধাঞ্জলি
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
অধ্যাপক, পদার্থবিদ্যা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রয়াত হলেন এ যুগের সবচেয়ে পরিচিত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং।
বিজ্ঞানী মহলে তাঁর খ্যাতি অনেক দিন, কিন্তু তাঁর বই ‘এ ব্রিফ হিস্টোরি অফ টাইমঃ ফ্রম দি বিগ ব্যাং টু ব্ল্যাক হোলস’ তাঁকে সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিশেষ জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। যৌবনেই তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন মোটর নিউরোন রোগে যার সংক্ষিপ্ত নাম এ এল এস। ফলে জীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি ছিলেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত, চলা ফেরা বা সাধারণভাবে কথা বলতে অক্ষম। এই পরিস্থিতিতে যে কেউ হাল ছেড়ে দিত। কিন্তু হকিং যে কেউ ছিলেন না। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তিনি বিজ্ঞান জগতে নিজের স্বাক্ষর রেখেছেন।
স্টিফেন হকিঙের জন্ম ১৯৪২ সালের ৮ই জানুয়ারি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে। ওনার বাবা ছিলেন জীববিদ্যার গবেষক। জার্মানির বোমাবর্ষণ থেকে বাঁচতে হকিং লন্ডন ছাড়েন মায়ের সাথে। লন্ডন এবং সেন্ট অ্যাবান-এ হকিং-এর বেড়ে ওঠা। স্কুল পাস করার পরে ভর্তি হন অক্সফোর্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজে। অক্সফোর্ড থেকে প্রকৃতিবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর, ১৯৬২ সালে কেমব্রিজের ট্রিনিটি হল। তাঁর ডক্টরেটের গাইড ছিলেন ডেনিস স্কিয়ামা। হকিং যে বিষয়ে কাজ করতেন, তার নাম সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং কসমোলজি বা ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব। নাম থেকেই গবেষণার বিষয় বোঝা যায়। ডেনিস স্কিয়ামা ছিলেন আধুনিক কসমোলজির স্রষ্টাদের মধ্যে অন্যতম। কৈশোরে ঘোড়ায়-চড়া ও নৌকা-চালানোয় বিশেষ উৎসাহ থাকলেও, কেমব্রিজে থাকাকালীন হকিং-এর মোটর নিউরোনে সমস্যা, এ এল এস রোগ ধরা পড়েছিল ধরা পড়ে – প্রায় সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় বাকি জীবনটা কাটাতে হয় তাঁকে।
১৯৬৪ সাল নাগাদ, তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রী হিসেবে যখন জেন’কে গ্রহণ করতে প্রস্তুত, তখন চিকিৎসকরাও দু’তিন বছরের বেশি দীর্ঘ জীবনের আশ্বাস তাঁকে দিতে পারেন নি। প্রথমে মানসিক অবসাদের শিকার হলেও তিনি তা কাটিয়ে ওঠেন এবং ১৯৬৬ সালে তাঁর কৃষ্ণ গহ্বর বিষয়ে ডক্টরেটের থিসিস জমা দেন। আমরা জানি যে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে কৃষ্ণ গহ্বর হল এমন শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রের উৎস যাকে অগ্রাহ্য করে কোনো কিছুই গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। অপর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী রজার পেনরোজের কৃষ্ণ গহ্বর সংক্রান্ত উপপাদ্যটিকে তিনি ব্রহ্মাণ্ডের উপর প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর থিসিসে।
এর পরে তিনি রজার পেনরোজের সঙ্গেই কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁদের যৌথ গবেষণার ফল হিসাবে আমরা আরো কয়েকটি উপপাদ্য পেয়েছি যাদের একসঙ্গে পোশাকি নাম হকিং পেনরোজ সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্য। এই গবেষণায় কাজে লেগেছিল একটি বিশেষ সমীকরণ যাঁর সঙ্গে আমাদের দেশের এক বিজ্ঞানীর নাম জড়িত। সাধারণ আপেক্ষিকতা বা জেনারেল রিলেটিভিটি বিষয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরির আবিষ্কৃত রায়চৌধুরি সমীকরণ ব্যবহার করেছিলেন হকিং ও পেনরোজ।

হকিং-এর সবচেয়ে বিখ্যাত আবিষ্কার নিঃসন্দেহে কৃষ্ণগহ্বর থেকে নির্গত বিকিরণ যা হকিং বিকিরণ নামে পরিচিত। আগেই বলেছি যে চিরায়ত পদার্থবিদ্যা অনুসারে কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাক হোল থেকে কখনোই কোনো কিছু বেরিয়ে আসে না। হকিং দেখালেন যে কোয়ান্টম বলবিদ্যা এবং তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুসারে কৃষ্ণ গহ্বর থেকে বিকিরণ নির্গত হতে বাধ্য। এই নিবন্ধে বিশদে বিজ্ঞানের আলোচনার সুযোগ নেই। সংক্ষেপে বিষয়টা দেখা যেতে পারে। কোনো তন্ত্রের বিশৃঙ্খলার পরিমাপকে বলে এনট্রপি। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী যে কোনো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এনট্রপি বৃদ্ধি পায়। হকিং দেখালেন যে কৃষ্ণ গহ্বরের সীমানার ক্ষেত্রফল হল তার এনট্রপির পরিমাপ। যে কোনো কৃষ্ণ গহ্বরের একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা আছে এবং তাপমাত্রা থাকার অর্থ হল তাপগতিবিদ্যা অনুসারে তার থেকে একটা বিকিরণ নির্গত হবে। হকিং দেখালেন কোয়ান্টম বলবিদ্যা এই সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করে।
এই লেখাতে হকিং-এর বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটা কথা মনে রাখতেই হবে, নতুন আবিষ্কার সবসময়েই পুরানো জ্ঞানকে অতিক্রম করবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে অস্বীকার করবে। এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রকেই আমরা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপ্লব বলি। হকিং-এর গবেষণা বিজ্ঞানে আমাদের প্রচলিত অনেক ধ্যানধারণাকে অস্বীকার করে, তাই তাকে আমরা বিপ্লব বলে চিহ্ণিত করতেই পারি।
হকিং শুধু বিজ্ঞানী হিসাবে নন, সামাজিক মানুষ হিসাবেও আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। মার্কিন-ব্রিটিশ শক্তির ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণকে যুদ্ধাপরাধ বলতে তিনি পিছপা ছিলেন না। জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ উন্নত দেশগুলির অনীহার তিনি কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। হকিং পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ধর্মের অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার তিনি সোচ্চারে বিরোধিতা করেছিলেন। খ্রিস্টধর্মের ডারউইনবাদের বিরোধিতার তিনি কঠোর সমালোচক। ১৯৯০-য় তাঁকে ‘নাইটহুড’-এ ভূষিত করার প্রস্তাব উঠলেও, গবেষণার খাতে সরকারী বরাদ্দের অপ্রতুলতার বিরুদ্ধে হকিং নাকচ করে দেন সেই সম্ভাবনা।
বিজ্ঞানের ইতিহাস বিষয়ে তিনি উৎসাহী ছিলেন, পদার্থবিদ্যা ও অঙ্কের ইতিহাসের ক্ষেত্রে তাঁর সম্পাদিত বই যথাক্রমে ‘অন দি শোল্ডারস অফ জায়ান্টস’ এবং ‘গড ক্রিয়েটেড দি ইন্টিজারস’ পড়ে আমরা অনেকেই এই দুই বিজ্ঞানের ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষালাভ করেছি। কন্যা লুসির সঙ্গে ছোটদের জন্য লেখা তাঁর কল্পবিজ্ঞান কাহিনীগুলিও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণেও তিনি উৎসাহী ছিলেন, কিন্তু তা বলে সাধারণের জন্য লিখতে গিয়ে তিনি বিজ্ঞানের তথ্য বিষয়ে কোনো সমঝোতা করেন নি।
বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার সমর্থক হকিং-এর কাছে পোপের সামনেই তাঁর বিরোধিতা করা হয়তো খুব সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু আমাদের কাছে তাঁর এই সাহস শ্রদ্ধা আকর্ষণ না করে পারে না। হকিং, মৃত্যুর পরে আত্মা বা চৈতন্যের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর মতো বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়না, তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর গবেষণায়, তাঁর ছাত্রদের মধ্যে, সাধারণ মানুষের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর লেখায়।

Saturday, 10 March 2018

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বিজ্ঞান গবেষণার অভিমুখ



       সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বিজ্ঞান গবেষণার অভিমুখ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


       ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে রাশিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানশিক্ষা ও গবেষণাতেও সেই নতুন রাষ্ট্র আমূল পরিবর্তন এনেছিল। তা শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক নয়, বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা সংস্থার পরিচালন সমিতির পরিবর্তনের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকেনি বিপ্লবের অব্যবহিত পরে নেয়া পদক্ষেপগুলি একদিকে যেমন বিজ্ঞান গবেষণা চালাবার সাবেকি রীতিকে পালটে দিয়েছিল, অন্যদিকে তেমনি বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক প্রগতির ইতিহাসকে দেখার এক নতুন দিক নির্দেশ করেছিল। ইতিহাস যেমন শুধুমাত্র রাজরাজড়া-সম্রাট-বাদশাহ-রাষ্ট্রনায়কদের বিবরণ নয়, বিজ্ঞানের ইতিহাসও তেমনি বিচ্ছিন্ন কিছু আবিষ্কারের কাহিনি নয় – এ কথা মনে রেখেই নতুন বিজ্ঞান নীতি স্থির করা হয়েছিল। কোন ধরনের নীতি সোভিয়েত ইউনিয়নে নেওয়া হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীর গবেষণা চালানোর পদ্ধতিতে তার কোন প্রভাব পড়ে, তা এই প্রবন্ধে সংক্ষেপে দেখব স্থান সংকুলানের জন্য আমরা আমাদের আলোচনাকে বিপ্লবের পরের দুই দশকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব  
       এক দেশে, বিশেষ করে রাশিয়ার মতো পশ্চাৎপদ দেশে, সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি নিয়েছিলতাদের সেই লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার হয়েছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইউরোপের আলোকপ্রাপ্তির যুগ, রাশিয়ার উদারপন্থী চিন্তাভাবনার ঐতিহ্য ও মার্ক্সবাদ থেকে শিক্ষা নিয়ে রাশিয়ার  কমিউনিস্ট পার্টি বিজ্ঞানের উন্নতির মাধ্যমে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, সমাজে মৌলিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল যুগযুগব্যাপী ধর্মীয় কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা দিয়ে পরাজিত করতে চেয়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নে যে চোখ-ধাঁধানো অগ্রগতি ঘটেছিল, তার পিছনে ছিল বিজ্ঞানপ্রযুক্তির পিছনে সুচিন্তিত বিনিয়োগ। সেই চিন্তার উৎস হল বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে অর্জিত শিক্ষা মার্ক্সবাদীদের কাছে ইতিহাস নিছক অতীতের বিবরণ নয়, তা ভবিষ্যতের পথ নির্দেশ করে। বিজ্ঞানের ইতিহাস তার ব্যতিক্রম নয়। ১৯৩১ সালে বিজ্ঞানের ইতিহাসে সোভিয়েত প্রতিনিধিদের আলোচনার উপর রিপোর্টে  বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক জে ডি বার্নাল লিখেছিলেন, ‘The history of science was plainly vitally important to them; it was  not only an academic study but a guide to action.’ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রয়াস পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞান পরিকল্পনাকে পথ দেখিয়েছিল বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য রাশিয়ার প্রয়াস বিশেষ করে পরাধীন বা অনুন্নত দেশগুলিতে বিশেষ আগ্রহের জন্ম দিয়েছিল।
       কী কী পরিবর্তন এনেছিল বিজ্ঞান গবেষণা পরিচালনার ক্ষেত্রে? কমিউনিস্ট পার্টি মনে করেছিল যে বিজ্ঞান গবেষণার লক্ষ্য হওয়া উচিত ব্যবহারিক প্রয়োগ, বিমূর্ত গবেষণার কোনো সার্থকতা নেই। এই মত নিয়ে সাধারণভাবে বিতর্ক থাকবেই, কিন্তু সেই মুহূর্তে রাশিয়ার পরিস্থিতি বিচার করলে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো তর্ক সম্ভবত ওঠে না। বিজ্ঞান গবেষণা, যার মধ্যে সমাজবিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণাকেও ধরতে হবে, তাকে এক গুরুত্বপূর্ণ পেশা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়সমস্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিকে রাষ্ট্রাধীন করা হয়, তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশকে পড়ানোর কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে শুধুমাত্র গবেষণার কাজে নিযুক্ত করা হয়। বিজ্ঞানের লক্ষ্য যেহেতু ব্যবহারিক প্রয়োগ, তাই গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা হয়। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন শিল্পের সামনের সমস্যাগুলি দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করা হয়, অন্যদিকে তেমনি শিল্পের কাছে যে অপেক্ষাকৃত বেশি সম্পদ আছে, তার একাংশ বিজ্ঞানের উন্নতিতে ব্যবহৃত হয়। শিল্পের সঙ্গে গবেষণার মেলবন্ধনের এই নীতি যে পৃথিবীতে একেবারে নতুন তা নয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে বিদ্যুৎ শিল্প এবং গবেষণা হাত ধরাধরি করে চলেছে গ্রাহাম বেল, এডিসন, টেসলা, মার্কনি - এঁদের নাম আমরা সকলেই জানি এঁরা সকলেই গবেষণা এবং একই সঙ্গে শিল্প-স্থাপনে উৎসাহী ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রসায়ন শিল্প বিষয়ে সরাসরি গবেষণা শুরু হয়েছিল কিন্তু তা ছিল সাধারণ ভাবে ব্যতিক্রম এগুলো ছিল মূলত ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রথম সংগঠিত ভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্প ও বিজ্ঞানের গাঁটছড়া বাঁধার চেষ্টা করে।
       বিমূর্ত ও মৌলিক গবেষণার মধ্যে পার্থক্য করার কোনো সহজ উপায় নেই কেজো লক্ষ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা মানেই কিন্তু মৌলিক গবেষণাকে অস্বীকার করা নয়। বিপ্লবের পরে সোভিয়েত দেশে মৌলিক গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়নি, তার অনেক উদাহরণ দেওয়া যায় -- সে কথায় আমরা পরে আসছি মুক্ত চিন্তার দিক থেকে বিচার করলে গবেষণার উপর কতটা নিয়ন্ত্রণ আদৌ কাম্য তা ঠিক করা সহজ নয়।  কিন্তু আজকের দিনে, স্বীকার করুক বা না করুক, সব দেশই গবেষণার ক্ষেত্রে একই নীতি অনুসরণ করছেপরীক্ষামূলক বিজ্ঞানে গবেষণা করতে গেলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়, গবেষককে স্বাভাবিকভাবেই সেদিকে খেয়াল রেখে তার গবেষণার দিক ঠিক করতে হবে। তাত্ত্বিক গবেষকদেরও নিজের খুশিমতো বিষয় নির্বাচন কঠিন হয়ে পড়েছে। গবেষণা সম্মেলনগুলিতে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর আলোচনা হয়, গবেষণা পত্রিকাতে প্রচলিত ক্ষেত্রের খুব বাইরের প্রবন্ধ ছাপা শক্ত হয়ে পড়েছে, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিও তাদের সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির লক্ষ্যের কোনো বিষয়ে গবেষণাকে উৎসাহ দেয় না সরকারি প্রতিষ্ঠান হোক বা বেসরকারি, অর্থ বরাদ্দ করার সময় তার নজরে থাকবে কত তাড়াতাড়ি তার থেকে ফল পাওয়া যায়। বর্তমান যুগে সর্বত্রই বিজ্ঞান গবেষণাকে ব্যবহারিক পথেই চালিত করা হচ্ছে, শিল্পের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার কথা বলা হচ্ছে।
এই পর্যন্ত পড়ে যদি কারো মনে হয় যে বর্তমানে ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে গবেষণাকে পরিচালনা করার চেষ্টা করছে, তা সোভিয়েত ইউনিয়ন অনুসৃত নীতি থেকে পৃথক নয়, তাঁদের জন্য দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক বিপ্লবের পাঁচ বছরের মধ্যে ১৯২২ সালে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সমীকরণের সমাধান করতে গিয়ে আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান প্রসারণশীল বিশ্বের কথা বলেন। প্রথমে আইনস্টাইন ভেবেছিলেন এই সমাধানটা ভুল, পরে অবশ্য তিনি মেনে নেন যে ফ্রিডম্যানের কাজ পুরোপুরি সঠিক১৯২৯ সালে হাবল আবিষ্কার করেন যে আমাদের বিশ্ব সত্যি প্রসারণশীল। ফ্রিডম্যানের কাজের কোনো ব্যবহারিক উপযোগিতা আমরা কল্পনাতে আনতে পারি না। তারপরে ধরা যাক রমন এফেক্টের কথা। ১৯২৮ সালের আটাশে ফেব্রুয়ারিকে রমন এফেক্ট আবিষ্কারের দিন বলে আমরা জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসাবে পালন করি, যদিও রমন ও তাঁর ছাত্র কে এস কৃষ্ণণ ১৬ ফেব্রুয়ারি নেচারে এক চিঠিতে এই সম্পর্কিত কিছু খবর লিখেছিলেন। সোভিয়েত বিজ্ঞানী লিওনিদ ম্যান্ডেলস্টাম ও গ্রিগরি ল্যান্ডসবার্গ সেই বছরই ২১ ফেব্রুয়ারি এই এফেক্ট দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয় মে মাসে, ততদিনে রমনের দাবী প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। রমনের অগ্রাধিকার নিয়ে নোবেল কমিটিও পুরস্কার দেওয়ার আগে দীর্ঘ আলোচনা করেছিল। এখন রমন এফেক্ট আমাদের নানা কাজে লাগলেও ১৯২৮ সালে তা ছিল একান্তভাবেই মৌলিক বিজ্ঞানের কাজ। সেই মুহূর্তে তার কোনো ব্যবহারিক প্রয়োগ কারো মাথায় আসেনি। অর্থাভাবসহ অন্যান্য সমস্যার মধ্যেও এবং ব্যবহারিক প্রয়োগের উপর জোর দিলেও মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণা রাশিয়ায় বন্ধ হয়ে যায়নি। তার কারণ নীতি প্রণেতারা মৌলিক গবেষণা বন্ধ করে দেশে শুধুমাত্র ব্যবহারিক গবেষণা করা সম্ভব, এ কথা চিন্তা করার মতো বোকা ছিলেন না। এরকম আরো নানা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি আমাদের দেশে অবস্থা কী? কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের কাছে গবেষণার জন্য অর্থে বরাদ্দের আবেদন করতে গেলে বর্তমানে বলে দিতে হয় গবেষণাটি Make in India, Swachch Bharat, Digital India, Swastha Bharat, Start-up India – এই পাঁচটির মধ্যে কার অধীনে আসবে। ফ্রিডম্যানের গবেষণা বা রমন এফেক্টকে এই বিভাগগুলির মধ্যে কোনটিতে আপনি ফেলবেন?
       কোলাবরেটিভ বা সহযোগিতামূলক গবেষণা আজ খুব সাধারণ বিষয়, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত একক, ছাত্রের সঙ্গে বা বড়োজোর সামান্য সংখ্যক বিজ্ঞানী মিলে কোনো বিষয়ে গবেষণাই ছিল রীতি। কিন্তু মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী কমিউনিস্ট পার্টি মনে করেছিল যে বিজ্ঞান গবেষণা শুধুমাত্র কয়েকজন ব্যক্তির কৃতিত্ব নয়,  কোনো যুগের বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে সে সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। আবার জে ডি বার্নালের উপরোক্ত লেখা থেকে উদ্ধৃত করি। নিউটন বা ডারউইনের কৃতিত্ব আলোচনা প্রসঙ্গে সোভিয়েত প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, ‘It was the age that formed and found the man rather than the man who found the age.’  তীব্র অভাবের মধ্যেও নতুন সরকার শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রতিভার উপর নির্ভর না  করে অনেকগুলি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন যেখানে বিশেষ বিষয়ে একত্রে অনেক গবেষক কাজ করতেন এবং মতামত বিনিময়ের মাধ্যমে সমস্যাগুলি দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করতেন। এক্স-রে, রেডিও, এরোডায়নামিক্স, এরা সবাই পদার্থবিজ্ঞানের অঙ্গ --– কিন্তু বিপ্লবের পরে পরেই এই বিষয়গুলিতে গবেষণার জন্য আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়। অনেক পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির সময় এই পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছিল। আজ যৌথ ভাবে গবেষণা করাটাই স্বাভাবিক, অনেক বড়ো বড়ো কোলাবরেশনে বহু দেশের শতশত বিজ্ঞানী একত্রে কাজ করেনতাঁরা গবেষণার বিষয়টাকে ক্ষুদ্র ঠিক করে নিয়ে তাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে সেগুলিকে পৃথক পৃথকভাবে সমাধান করেন। হিগস বোসন কণা আবিষ্কার হয়েছিল যে গবেষণাগারে, সেই সার্নের সঙ্গে প্রায় ষাটটি দেশের ছ’হাজার বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদ জড়িত আছেন সোভিয়েত ইউনিয়নই সচেতন ভাবে ও পরিকল্পনামাফিক এই ধরনের সমবেত সহযোগিতার মাধ্যমে গবেষণার সূচনা করেছিল
       আজ আমরা যে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণের সময় বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে অভ্যস্ত। কোন ফসল চাষ  হবে, খনিজ উত্তোলন কোন পদ্ধতিতে সবচেয়ে লাভজনক হবে, বাঁধ নির্মাণ কোথায় হবে, এ সমস্তের জন্য আমরা বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হই। এরও শুরু করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন যেখানে সরকারি পরিকল্পনা গ্রহণের স্তরে বিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। একশো বছর আগে এই ঘটনা ছিল প্রায় সারা বিশ্বেই অভূতপূর্ব এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আকাদেমি অফ সায়েন্সেস যা সারা দেশের বিজ্ঞান গবেষণা সংগঠনের দায়িত্ব নেয়। লেনিন আকাদেমিকে শিল্প স্থাপন ও রাশিয়ার পুনর্গঠনের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণে বিশেষজ্ঞের ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। আকাদেমি সোভিয়েত দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ চিহ্নিত করার ও তাকে ব্যবহার করার পরিকল্পনা তৈরি করে এবং বিজ্ঞান গবেষণার দিক নির্ণয় করে। তারই সহায়তায় প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ১৯২৯ সালে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির উপর কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, তা একটা মাত্র তথ্য থেকে বোঝা যায় --- দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে জাতীয় আয়ের এক শতাংশ বরাদ্দ হয়েছিল বিজ্ঞানের জন্য। এই অংশটা সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বরাদ্দের তিনগুণ এবং ব্রিটেনের বরাদ্দের দশ গুণ। একটা অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া অর্থনীতিতে এই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেখিয়ে দেয় যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিজ্ঞানপ্রযুক্তিকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছিল।
সে সময় চীন বা ভারতের মতো পিছিয়ে পড়া দেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের এই নীতি বিশেষ আগ্রহের জন্ম দেয়। ১৯২০-র দশকেই চিনের কুয়োমিনতাং সরকার সোভিয়েত পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের চেষ্টা করে। সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পরে পরাধীন ভারতেই  ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি তৈরি করেন। তাতে ছিলেন দুজন প্রথম সারির বিজ্ঞানী – মেঘনাদ সাহা ও জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ, এবং একজন স্বনামধন্য ইঞ্জিনিয়ার এম বিশ্বেশ্বরাইয়া। স্বাধীনতার পরে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণে অপর এক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রেরণা নিয়ে বিজ্ঞানীদের দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনার জন্য তৈরি হয়েছিল দুটি সংগঠন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ সায়েন্টিফিক ওয়ার্কার্স এবং সায়েন্টিফিক ওয়ার্কার্স  অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া
উন্নত দেশেও সোভিয়েত প্রয়াস বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স ১৯৩৩ সালে তার রাজনীতি থেকে দূরে থাকার নীতি পরিত্যাগ করে, ঘোষণা করে যে বিজ্ঞানীর পক্ষে আর সাধারণ মানুষের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা সম্ভব নয়। জে ডি বার্নাল, জোসেফ নিডহ্যাম, জে বি এস হ্যালডেন বা হাইম্যান লেভির মতো বিশিষ্ট ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের ইতিহাস ও সমাজ পরিবর্তনে তার ভূমিকা বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। এ সমস্ত ঘটনার পিছনে ১৯৩১ সালে বিজ্ঞানের ইতিহাস কংগ্রেসে সোভিয়েত প্রতিনিধিদের প্রভাব ছিল। রাশিয়ার ঘটনাবলী ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাডারের উপর গবেষণারত বিজ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য প্রতি রবিবার যে সভায় মিলিত হতেন, তার নাম তাঁরা দিয়েছিলেন সানডে সোভিয়েত।
ফ্রান্সে সোভিয়েত ইউনিয়নের নীতির প্রভাব ছিল আরো ব্যাপকপদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার জয়ী জাঁ পেরিন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানীদের মতো সুযোগসুবিধা আদায়ের জন্য চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ১৯৩২ ও ১৯৩৬ সালে নির্বাচনে প্রগতিশীল বামপন্থী শক্তির জয়ের সুযোগে বিজ্ঞানীরা ফরাসি বিজ্ঞানের কাঠামোকে সোভিয়েত মডেল অনুসারে পাল্টানোর কাজ শুরু করেন। সারা দেশে গবেষণার অর্থ সংস্থানের জন্য একটি  সংস্থা সিএনআরএস তৈরি হয় ১৯৩৫ সালে চার বছরের মধ্যেই ফ্রান্সের বিজ্ঞানীদের প্রায় অর্ধেক তাঁদের  গবেষণার কাজে এই নতুন সংস্থার সাহায্য পেয়েছিলেন। পেরিন ও আর এক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আইরিন কুরি সরকারের বিজ্ঞান দপ্তরের মন্ত্রী হয়েছিলেন। বিজ্ঞানীদের সরাসরি রাজনীতিতে যোগদানের এই প্রেরণারও উৎস সোভিয়েত ইউনিয়ন। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বিজ্ঞানীরা নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করেছিলেন। ব্রিটেনের মতোই সে দেশেও তৈরি হয়েছিল বামপন্থী সংগঠন আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অফ সায়েন্টিফিক ওয়ার্কার্স।
       শিক্ষার বিস্তার ছাড়া বিজ্ঞান গবেষণা সম্ভব নয়। ১৯১৪-১৫ সালে রাশিয়ায় মোট ৯১টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক লক্ষ বারো হাজার ছাত্র পড়াশোনা করত। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া জড়িয়ে পড়ার সময় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে হয় আটশোর বেশি, সেখানে পড়ত ছ’লক্ষ সাতষট্টি হাজার ছাত্রছাত্রীএরা এসেছিল সমাজের সমস্ত অংশ ও দেশের সমস্ত প্রান্ত থেকে কৃষক, শ্রমিক, জাতিগত সংখ্যালঘু ও মহিলাদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্য আলাদা উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাদের জন্য বিনা ব্যয়ে শিক্ষা এবং প্রয়োজনে বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়। সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য কোটার ব্যবস্থা হয়। তাদের এমনকি শিক্ষার কোনো কোনো ধাপ এড়িয়ে পরের স্তরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
       সোভিয়েত ইউনিয়ন যে নীতি গ্রহণ করেছিল, তা ছিল সুসংবদ্ধ। আংশিকভাবে তা রূপায়ণ করার মধ্যে সমস্যা আছে।  যেমন ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান গবেষণাকে সরিয়ে নিয়ে কয়েকটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের সোভিয়েত নীতির অন্ধ অনুসরণ দেশের গবেষণার ভিত্তিকে সংকুচিত করেছে। কারণ সোভিয়েত নীতির এক অপরিহার্য অঙ্গ ছিল বিজ্ঞানসহ উচ্চশিক্ষাকে পিছিয়ে পড়া মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার সচেতন প্রয়াস, আমাদের দেশে ওই মাপের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
       সোভিয়েত নীতির মধ্যে সমস্যা কি ছিলনা? তখনও ছিল, এবং সেই সব সমস্যার অনেকগুলির সমাধান আজও আমাদের অধরা। সরকারি নীতি রূপায়ণ করতে গিয়ে এবং সরকারি নির্দেশ মতো চলার ফলে প্রশাসন অতিরিক্ত আমলা নির্ভর হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। বর্তমানেও আমলাতান্ত্রিকতা বিজ্ঞানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে পড়েছে। যে দেশেই বিজ্ঞান গবেষণার মূল দায়িত্ব নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সেখানেই এই সমস্যা আছে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও আজকাল এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। জে ডি বার্নাল ১৯৩৯ সালে তাঁর The Social Function of Science বইতে সাধারণ ভাবে বিজ্ঞানপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে সোভিয়েত নীতিকে সোচ্চারে সমর্থন করেও অন্য এক সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সাবধান করে দিয়েছিলেন যে বিজ্ঞানের ট্রাডিশনের অভাব, যৌবনের উৎসাহের আধিক্য এবং বিদেশের বিজ্ঞান জগতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের যোগাযোগের অভাব স্বাভাবিকভাবেই সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে সমালোচনামূলক মনোভাবকে দুর্বল করে দিয়েছে। এর ফলে যান্ত্রিকভাবে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ প্রয়োগের প্রবণতা বাড়ে এবং অনেক সময় সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই তত্ত্ব নির্মাণের ঝোঁক দেখা দেয়। বিশেষ করে বলতেই হবে কৃষিক্ষেত্রের কথা যেখানে এই ত্রুটি বিপদ ডেকে এনেছিল।
       এ ধরনের নানা দুর্বলতা সত্ত্বেও বলতেই হবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সোভিয়েত পদ্ধতিগুলির ভূমিকা সুদূরপ্রসারী, সারা পৃথিবীর বিজ্ঞান গবেষণাকে তা প্রভাবিত করেছিল। সবসময়ই যে সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রথম এই পদ্ধতিগুলিকে ব্যবহার করেছিল তা নয়। আমরা দেখেছি বিদ্যুৎ শিল্প ও সেই সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগের ইতিহাস প্রাচীনতর। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের নীতি প্রণেতারা সচেতন ভাবে এই নীতিগুলিকে প্রয়োগ করেছিলেন। তার ফলস্বরূপ আমরা দেখতে পাই যে একশো বছর আগে রাশিয়াতে বিজ্ঞান গবেষণার যে নতুন ধারার সূচনা হয়েছিল, তখন তা উপহাসের বা অবহেলার পাত্র হলেও আজ সারা বিশ্ব সেটাকেই অনুসরণ করছে। নভেম্বর বিপ্লবের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে চমকপ্রদ অগ্রগতি দেখিয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সে দেশ দ্রুত উন্নতির পথে ফিরে আসে এবং পশ্চিমী উন্নত দেশগুলির সঙ্গে সমান তালে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে বিপ্লবোত্তর নীতিগুলিই এর পিছনে রয়েছে, কারণ ১৯১৭ সালের আগে রাশিয়া বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। বিপ্লব বঞ্চিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসে। তারাও এই সুযোগ গ্রহণ করে বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে নিশ্চিত করে। পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজমের কেন পতন ঘটে সে বিষয়ে অনেকে আলোচনা করেছেন, তা আমাদের এই লেখার পরিধির বাইরে। কিন্তু পরে যাই ঘটুক না কেন, সে দেশে বিপ্লবী সরকার বিজ্ঞান গবেষণার যে নীতি অবলম্বন করেছিল, তার প্রভাব পড়েছে সারা বিশ্বে – সে কথাকে কখনোই ভোলা যাবে না।

(প্রকাশঃ জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার শারদীয় ২০১৭)