Tuesday 20 March 2018

স্মরণঃ ইউ আর রাও, যশপাল, পি এম ভার্গব এবং মিরিয়াম মির্জাখানি

       একই দিনে প্রয়াত হলেন ভারতের বিজ্ঞান জগতের দুই সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, ইউ আর রাও এবং যশপাল। দুজনেই দীর্ঘদিন মহাকাশ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এক আশ্চর্য সমাপতনে দুজনেই কিছুদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউটে কাজ করেছিলেন।ভারত সরকারও দুজনকেই পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করেছে।

       ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশনের অধিকর্তা মহাকাশ বিজ্ঞানী ইউ আর রাও (মার্চ ১০, ১৯৩২ – জুলাই ২৪, ২০১৭) ভারতীয় কৃত্রিম উপগ্রহ প্রোগ্রামের জনক হিসাবে পরিচিত। ১৯৭৫ সালে ভারতের প্রথম উপগ্রহ আর্যভট্ট থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন তিনি ভারতের সমস্ত উপগ্রহের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই ভারত এএসএলভি, জিএসএলভি এবং পিএসেলভি রকেট তৈরি করে। যখন ভারতকে রকেটের জন্য ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন প্রযুক্তি হস্তান্তরের উপর নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক স্তর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল, তখন তিনিই সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে ভারতে ঐ ইঞ্জিন তৈরি করে। আজ যে ভারত রকেট প্রযুক্তিতে সারা পৃথিবীতে একেবারে প্রথম সারিতে রয়েছে, এর পিছনে যদি একজন মানুষের নাম করতে হয়, তিনি ইউ আর রাও। আর্যভট্ট, ভাস্কর, রোহিণি উপগ্রহ থেকে শুরু করে চন্দ্রযান ও মঙ্গলযান অভিযান – সমস্তের পিছনেই তাঁর অবদান ভোলার নয়।তিনি মহাকাশ গবেষণাকে সাধারণ মানুষের উপকারে লাগানোর বিষয়ে সবসময় সচেষ্ট ছিলেন। মার্কিন পত্রিকা স্পেস নিউস ১৯৮৮ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে যে দশ জন ব্যক্তিত্ব মহাকাশ গবেষণাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন, সেই তালিকাতে রাওয়ের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিল। 

       যশ পাল (নভেম্বর ২৬, ১৯২৬ – জুলাই ২৪, ২০১৭) মুম্বাইয়রত টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চের মহাজাগতিক রশ্মি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে আমেদাবাদে স্পেস অ্যাপ্লিকেশনস সেন্টারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ভারত সরকারের বিজ্ঞানপ্রযুক্তি বিভাগের সচিব এবং ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য তাঁর তৈরি প্রোগ্রাম টার্নিং পয়েন্ট দূরদর্শনে একসময় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। সে জন্য তিনি আন্তর্জাতিক কলিঙ্গ পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন।

       দীর্ঘ রোগভোগের পরে প্রয়াত হলেন জীববিজ্ঞানী পি এম ভার্গব (ফেব্রুয়ারি ২২, ১৯১৮ – আগস্ট ১, ২০১৭)।  ভারতের জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে তাঁর নাম প্রথম সারিতে থাকবেরসায়নে পড়াশোনা শুরু করলেও ডক্টরেট করার পরে ব্রিটেনে গবেষণার সময় তিনি জীবপ্রযুক্তিবিদ্যা বা বায়োটেকনোলজি বিষয়ে মনোনিবেশ করেছিলেন। ১৯৭৭ সালে হায়দ্রাবাদে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেন্টার ফর সেলুলার এন্ড মলিকিউলার বায়োলজি, সংক্ষেপে সিসিএমবি, যা আজ দেশের অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান। তিনি ন্যাশনাল নলেজ কমিশনের সহসভাপতি হিসাবেও কাজ করেছিলেন। ভার্গব ছিলেন খুবই দৃঢ়চেতা এবং বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানমনস্কতার প্রতি দায়বদ্ধ। ১৯৮১ সালে দেশের প্রথমসারির বুদ্ধিজীবিরা বিজ্ঞানমনস্কতার সপক্ষে যে বিবৃতি প্রচার করেছিলে, তিনি ছিলেন সে বিষয়ে উদ্যোক্তাদের মধ্যে একজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে জ্যোতিষশাস্ত্রে বিএসসি ডিগ্রি চালু করার বিরুদ্ধে যাঁরা আদালতে গিয়েছিলেন, ভার্গবও তাঁদের মধ্যে ছিলেন। ১৮৮৬ সালে পদ্মভূষণ সম্মান পেলেও ২০১৫ সালে দেশে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি ২০১৫ সালে তা ফিরিয়ে দেন।

**********************************************************************
       মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে ক্যান্সারের কোপে প্রয়াত হলেন মিরিয়াম মির্জাখানি (মে ৩, ১৯৭৭- জুলাই ১৪, ২০১৭)গণিত জগতে সুপরিচিত এই ব্যক্তিত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। মির্জাখানির জন্ম ইরানে। সেখানে বিএসসি পাস করার পর তিনি উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার জন্য আমেরিকাতে যান। হার্ভার্ডে অধ্যাপক কার্টিস ম্যাকমুলেনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে তিনি ডক্টরেট করেন। ম্যাকমুলেন গণিত জগতে খুবই পরিচিত, অঙ্কশাস্ত্রে সর্বোচ্চ পুরস্কার ফিল্ডস মেডেলের অধিকারী। মির্জাখানিও ২০১৪ সালে রিমানিয়ান জ্যামিতির উপর তাঁর কাজের জন্য ফিল্ডস মেডেল লাভ করেন। তিনিই প্রথম মহিলা যিনি এই সম্মানে ভূষিত হন, ইরান থেকেও তিনি প্রথম ফিল্ডস মেডেল জয়ী। দীর্ঘদিন আমেরিকাতে থেকেও তিনি নিজের দেশকে ভুলে যাননি, তাঁর মেয়ের জন্য ইরানের নাগরিকত্ব তিনি চেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর ইরানের সংবাদপত্রে তাঁর যে ছবি প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে তাঁর চুল ঢাকা ছিল না- সে দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত মহিলাদের ছবিতে যা এতদিন ছিল অচিন্তনীয়। ইরানের সাংসদরা সম্মিলিত ভাবে তাঁর মেয়েকে ইরানের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাদের গণিত বিভাগের নাম দিয়েছেন মির্জাখানি।


(প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক,  আগস্ট ২০১৭)


 

       

No comments:

Post a Comment