Friday 6 April 2018

বিজ্ঞানী মেরি কুরি


দেড়শ বছরে মেরি কুরি

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

      যে মানুষটি প্রথম দুবার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন এবছর তাঁর জন্মের দেড়শো বছর পূর্ণ হচ্ছে। আমরা সবাই তাঁর নাম জানি। মাদাম মেরি কুরির জন্ম হয় পোল্যান্ডে ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর। জন্মের সময় তাঁর নাম ছিল মারিয়া স্ক্লোদোভস্কা। ১৯০৩ সালে পদার্থবিদ্যা এবং ১৯১১ সালে রসায়নে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। অথচ তাঁর দেশ পোল্যান্ড সেই সময় ছিল রাশিয়ার জারের অধীনে, সেখানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিল খুবই কম। তার উপর ছিল দারিদ্র। স্কুলের শিক্ষা শেষ করার পর আট বছর তিনি পড়াশোনা ছেড়ে গভর্নেসের চাকরি করে দিদির প্যারিতে ডাক্তারি পড়াতে সাহায্য করেন। তারপর ১৮৯১ সালে প্যারি বিশ্ববিদ্যালয় সরবোনে পদার্থবিদ্যাতে এম এস সি পড়ার জন্য ভর্তি হন। পরের বছর একই সঙ্গে অঙ্ক নিয়ে পড়াও শুরু করেন। পরীক্ষাতে ১৮৯৩ সালে পদার্থবিদ্যাতে প্রথম ও ১৮৯৪ সালে অঙ্কে দ্বিতীয় হয়ে উত্তীর্ণ হলেন।
      ইচ্ছা গবেষণা করার, কিন্তু সুযোগ কোথায়? ইতিমধ্যে আলাপ হয়েছে এক পদার্থবিজ্ঞানী পিয়ের কুরির সঙ্গে। তিনি প্যারির মিউনিসিপ্যাল স্কুলে পড়ান, যদিও ইতিমধ্যে পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর ইউরোপে পরিচিতি হয়েছে। তিনি মেরিকে তাঁর ছোট্টো  গবেষণাগারের একদিকে কাজ করার সুযোগ দিলেন। এক বছর পরে ১৮৯৫ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন তাঁরা। মেরির উৎসাহে পিয়ের থিসিস জমা দিয়ে ডক্টরেট পেলেন।
      কোন বিষয়ে কাজ শুরু করেছিলেন মেরি? ১৮৯০-এর দশক ছিল পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানে উথালপাথালের যুগ। পদার্থবিদ্যার সে সময় পর্যন্ত অর্জিত জ্ঞান অনেক পরীক্ষার ফল ব্যাখ্যা করতে পারছিল না। ১৮৯৫ সালে রন্টজেন আবিষ্কার করলেন এক্স-রে বা রঞ্জন রশ্মি, পরের বছর বেকারেল তেজস্ক্রিয়তা বা রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি আবিষ্কার করলেন। ১৮৯৭ সালে টমসন ঘোষণা করলেন পরমাণু অবিভাজ্য নয়, তার মধ্যে থাকে ঋণাত্মক কণা ইলেকট্রন।  
      বিশেষ করে রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি ও ইলেকট্রনের ব্যাখ্যা চিরায়ত পদার্থবিদ্যাতে পাওয়া সম্ভব ছিল না। তেজষ্ক্রিয়তার কথায় আমরা পরে আসব। টমসন যখন পরমাণু ভেঙ্গে ইলেকট্রন পাবার কথা বলছেন, তখন অধিকাংশ বিজ্ঞানী পরমাণুর অস্তিত্বেই বিশ্বাস করতেন না।  সে সময় বিজ্ঞানের দর্শনে সবচেয়ে প্রভাবশালী নাম আর্নেস্ট মাখ – তাঁর যুক্তিমূলক দৃষ্টবাদ (Logical Positivism) দর্শনে যা অনুভব করা যায় না, সেই পরমাণুর কোনো জায়গা ছিল না। টমসনের কথা তাই অধিকাংশ বয়স্ক বিজ্ঞানীর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। যাঁরা পরমাণুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন, তাঁদের কাছেও পরমাণু ছিল অবিভাজ্য কণা।
      রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটির কথায় আসি --- আবিষ্কারের গল্প অনেকেরই জানা। এক্স-রে নিয়ে কাজ করার সময় আঁরি বেকারেল খানিকটা আকস্মিক ভাবেই আবিষ্কার করেন যে ইউরেনিয়াম থেকে সারাক্ষণ বিকিরণ নির্গত হয়। বেকারেল দেখালেন যে এই বিকিরণ এক্স-রে হওয়া সম্ভব নয়। এক্স-রে তড়িৎ-নিরপেক্ষ। (আজ আমরা জানি যে এক্স-রে আসলে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ অর্থাৎ আলোক।) কিন্তু ইউরেনিয়াম থেকে নির্গত বিকিরণ ধনাত্মক, ঋণাত্মক ও তড়িৎ-নিরপেক্ষ, তিন রকমই হয়। বেকারেল অনুমান করেছিলেন যে তেজস্ক্রিয়তা মৌলিক পদার্থের ধর্ম। সে সময় এই বিকিরণের নাম ছিল বেকারেল রশ্মি। কিন্তু এই রশ্মির উৎস কী, অবিরাম এই বিকিরণ শক্তির নিত্যতা সূত্র মেনে চলে কিনা, এ কি শুধু ইউরেনিয়ামের ধর্ম নাকি অন্য মৌলিক পদার্থেও একে পাওয়া যাবে – এ ধরনের নানা প্রশ্নের উত্তর তখন অজানা।
      এক্স-রে ও বেকারেল রে, এই দুয়ের মধ্যে সে সময় অধিকাংশ বিজ্ঞানী প্রথমটিকে গবেষণার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। মেরি ও পিয়ের ঠিক করলেন মেরি দ্বিতীয়টি নিয়ে কাজ করবেন। এই কাজে তাঁর সাহায্যে এসেছিল পিয়ের ও তাঁর দাদা জ্যাকসের আবিষ্কৃত ইলেক্ট্রোমিটার যন্ত্র। রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি শব্দটি মেরিরই তৈরি। মেরি দেখলেন যে শুধু ইউরেনিয়ামই নয়, থোরিয়ামও আরো এক তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ।  ইউরেনিয়াম বা থোরিয়াম কঠিন অবস্থায় থাকুক বা অন্য মৌলের সঙ্গে যৌগ রূপে দ্রবণে, ধাতুর বাঁট হিসাবে বা গুঁড়ো অবস্থায়, তাপমাত্রা যেমনই হোক না কেন, তাদের তেজস্ক্রিয়তার কোনো পরিবর্তন হয় না। এভাবেই তিনি প্রমাণ করলেন বেকারেল ঠিকই বলেছেন, তেজস্ক্রিয়তা মৌলিক পদার্থেরই ধর্ম।
      মেরি বেকারেলের থেকে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন, বললেন যে তেজস্ক্রিয়তা মৌলের পরমাণুর থেকে আসে। এখন আমরা জানি যে পরমাণুর নিউক্লিয়াস হল তেজস্ক্রিয়তার উৎস, কিন্তু তখনো নিউক্লিয়াস আবিষ্কার হয়নি কথাটা বলা তখন খুব সহজ ছিল না। মেরি যে শুধু পরমাণুর অস্তিত্বের কথা বলছেন তা  নয়, বলছেন তার ভিতর থেকে বিকিরণ বেরোয়। অর্থাৎ পরমাণুর গঠন তাহলে মোটেই সরল নয়। টমসনের পরমানুর মডেল থেকে কিছুতেই তেজস্ক্রিয়তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। এর পর দীর্ঘ দিন বিজ্ঞানীরা পরমাণুর গঠন নিয়ে গবেষণা করবেন।
      মেরির অগ্রগতিতে উৎসাহী হয়ে কিছুদিন পরেই পিয়ের তাঁর সঙ্গে কাজ শুরু করেন। ইউরেনিয়ামের আকরিক পিচব্লেন্ড থেকে মেরিরা ইউরেনিয়াম নিষ্কাশন করেন। অবাক হয়ে তাঁরা দেখলেন যে ইউরেনিয়াম বার করে নেওয়ার পরে যে অংশ পড়ে থাকে, তার তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বেড়ে গেছে। এই ঘটনার একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে, পিচব্লেন্ডের মধ্যে আরো অন্যান্য অজানা মৌলিক পদার্থ আছে যার তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ইউরেনিয়ামের থেকে অনেক বেশি। নতুন মৌল খোঁজার জন্য তাঁদের রাসয়ানিক বিশ্লেষণের নতুন পদ্ধতি  আবিষ্কার করতে হয়েছিল। প্রথমে যে নতুন মৌলিক পদার্থের চিহ্ণ মেরি ও পিয়ের খুঁজে পেলেন, তাঁর পরাধীন জন্মভূমির স্মরণে মেরি তার নাম দিলেন পোলোনিয়াম। কিন্তু পোলোনিয়াম দিয়েও পিচব্লেন্ডের তেজস্ক্রিয়তার পুরোপরি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। মেরিরা দেখলেন আরো একটি মৌল পিচব্লেন্ডের মধ্যে আছে। তাঁরা এর নাম ঠিক করলেন রেডিয়াম। যেখানে একটা মৌল আবিষ্কারই যে কোনো বিজ্ঞানীর কাছে স্বপ্ন, মেরিরা সেই কাজে সফল হয়েছেন দুবার। দীর্ঘ দিন চেষ্টা করে কুরিরা রেডিয়াম নিষ্কাশনে সফল হলেন। প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন এক টন পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম পাওয়া যাবে দশ কিলোগ্রাম। শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল একশো মিলিগ্রাম রেডিয়াম ক্লোরাইড।
      মেরি ও পিয়ের তাঁদের কোনো গবেষণার পেটেন্ট নেন নি। তাই তাঁদের গবেষণাকে ভিত্তি করে শিল্প  গড়ে উঠলেও তাঁদের আর্থিক স্বচ্ছলতা আসেনি। তাঁদের আবিষ্কৃত বিশ্লেষণ পদ্ধতি রসায়ন শিল্পে কাজে লেগেছিলপিয়ের দেখিয়েছিলে রেডিয়াম থেকে বেরোনো বিকিরণ জীব কোষ ধ্বংস করতে পারে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্যানসারের চিকিৎসাতে রেডিয়াম ব্যবহার শুরু হয়। ১৯০৩ সালে মেরি ডক্টরেট উপাধি পেলেন। সেই বছরই তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার ভাগ করে দেওয়া হয় বেকারেল, পিয়ের ও মেরির মধ্যে। নোবেল কমিটি প্রথমে মেরির নাম বিবেচনা করেনি। পিয়ের তাঁদের লেখেন যে মেরিও তাঁদের কাজে সমান অংশীদার। আগেই রেডিয়ামের ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য মেরির নাম নোবেল পুরষ্কারের জন্য প্রস্তাবিত হয়েছিল। সেই প্রস্তাবকে ধরে মেরির নাম তালিকায় ঢোকানো হয়নোবেল পাওয়ার পর পিয়ের অবশেষে সরবোনে অধ্যাপকের চাকরি পান।
      কিন্তু মেরির জীবনে সংগ্রাম কখনো থেমে থাকেনি। নোবেল পুরষ্কারের পরেও তাঁর যোগ্য সম্মান তিনি পাননি। ১৯০৬ সালে এক দুর্ঘটনায় পিয়েরের মৃত্যু হয়, সরবোনে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন মেরি। ১৯০৩ সালের নোবেল পুরষ্কারে পোলোনিয়াম বা রেডিয়ামের নাম ছিল না। কমিটির রসায়ন বিজ্ঞানীরা এই দুই মৌল আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কারের কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু তাঁরা আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সেই সময় এলো ১৯১১ সালে, দুই মৌল আবিষ্কার ও তাদের বিষয়ে গবেষণার জন্য রসায়নে এককভাবে নোবেল জিতলেন মেরি। পিয়েরের নাম তালিকায় ছিল না কারণ নোবেলের জন্য মৃতদের নাম বিবেচনা করা হয় না।
      মেরি কুরির মৃত্যু হয় ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই। মেরি ও পিয়েরের গবেষণার ফলে পরমাণুর গঠন বিষয়ে কৌতূহল জাগে। নতুন নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার হয়। রেডিয়োকেমিস্ট্রি ও ক্যানসারে রেডিয়োথেরাপির তাঁরাই পথিকৃৎ। তাঁদের মেয়ে আইরিন ও জামাই ফ্রেডরিক জোলিও কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৫ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেনআধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাসে মাদাম কুরির অবদান ভোলার নয়।


প্রকাশ ঃ নিশিত শারদীয় ২০১৭


No comments:

Post a Comment