Sunday 21 October 2018

উর্সুলা লেগুইনের সাহিত্য




উর্সুলা লেগুইনের সাহিত্যঃ প্রকৃত নামের ইন্দ্রজাল  

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

‘... do you know, by your own experience, what patriotism is?’
‘No’, I said,  ... ‘If by patriotism you don´t mean the love of one`s homeland, for that I do know.’
‘No, I don’t mean love, when I say patriotism. I mean fear. The fear of the other. And its expressions are political, not poetical: hate, rivalry, aggression. It grows in us
, that fear.’
                              (The Left Hand of Darkness)

      হ্যারি পটারকে নিয়ে উন্মাদনা যখন চরমে, তখন আমার এক সহকর্মী আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, গল্পগুলোর মধ্যে কী আছে আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘উর্সুলা লেগুইন যদি পি জি উডহাউসের ভাষায় ইংল্যান্ডের পাবলিক স্কুলের কাহিনি লিখতে বসতেন, তাহলে হ্যারি পটারের মতো গল্প পাওয়া যেত’ আবার ২০১৭ সালের নোবেল জয়ী সাহিত্যিক কাজিও ইশিগুরোর ‘দি বারিড জায়ান্ট’ পড়তে বসে মনে পড়ে গেছে লেগুইনের আর্থসি সিরিজের কথা। সেখানে পেয়েছি একই রকম মিতকথন, একই রকম সাদায় কালোতে মেশানো চরিত্রলেখার এই বিশেষ গুণ লেগুইনের সাহিত্যকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
      ইশিগুরোকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ‘দি বারিড জায়ান্ট’-কে তিনি কি কল্পকাহিনি মনে করেন। তাঁর উত্তর ছিল, এইসব ভাগ, জঁর বা তকমা প্রকাশকদের সৃষ্টি, তাঁদের প্রচারের পক্ষে সুবিধাজনক। লেখককে কোনো বিশেষ তকমাতে আটকে রাখা যায় না। লেগুইনের সঙ্গে এই কথা নিয়ে তাঁর প্রকাশ্য বিতর্কও হয়েছিল। লেগুইনের মনে হয়েছিল ইশিগুরো কল্পকাহিনির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করেছেন। শেষ বিচারে সম্ভবত দুজনে খুব আলাদা কথা বলেন নি -- লেগুইনও মেনে নিয়েছিলেন যে ইশিগুরো কল্পকাহিনিকে মূলধারা থেকে আলাদা করতে চান নি।
উর্সুলা কে লেগুইন (আলোকচিত্র ঃ Gorthian,  CC BY-SA 3.0)
      উর্সুলা কে লেগুইন (২১ অক্টোবর ১৯২৯ -- ২২ জানুয়ারি ২০১৮) ব্যক্তিগতভাবে কল্পকাহিনি অর্থাৎ ফ্যান্টাসি কিংবা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যিক হিসাবে পরিচিত হতে পছন্দ করতেন না মেইনস্ট্রিম বা মূলধারা তাঁর লেখায় সেই তকমা লাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। বরঞ্চ তিনিই মূলধারাকে পালটে দিয়েছিলেন, বাধ্য করেছিলেন তাঁকে স্বীকার করতে আজও কল্পবিজ্ঞান বা কল্পকাহিনি অনেকের কাছেই মূলধারার সাহিত্য হিসাবে গণ্য হয় না। তাঁদের প্রতি অনুরোধ, ২০০৭ সালের নোবেলজয়ী লেখিকা ডরিস লেসিঙের বই ‘শিকাস্টা’-র ভূমিকাটা পড়ে দেখুন।  লেসিঙের ‘ক্যানোপাস ইন আর্গসঃ আর্কাইভস’ সিরিজের পাঁচটি বই কাঠামোর দিক থেকে নিখাদ কল্পবিজ্ঞান, তার প্রথম বই ‘শিকাস্টা’ উপন্যাসটির ভূমিকায় ১৯৭৮ সালে  তিনি লিখেছিলেন যে বর্তমানে কল্পবিজ্ঞান হল সাহিত্যের সবচেয়ে উদ্ভাবনী ধারা। আমাদের চারদিকের জগতটা প্রতিদিন আরো উদ্ভট, আরো অবিশ্বাস্য হচ্ছে, তার ফলে ঔপন্যাসিকরাও বাস্তবতার বেড়া ভেঙে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন। ওলাফ স্টেপলডনের ‘লাস্ট এন্ড ফার্স্ট মেন’ এবং তথাকথিত “সিরিয়াস” উপন্যাসকে আলাদা আলাদা তাকে সাজানোর মনোভঙ্গিটা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন লেসিঙ   
      লেসিঙের কথার সূত্র ধরেই বলি, লেগুইনের কল্পবিজ্ঞান বা কল্পকাহিনি হল জীবনকে অন্যভাবে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রয়াস। আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের জগতটাকে পালটে দিয়েছিলেন লেগুইন। নারীবাদের উচ্চকিত ঘোষণা না থাকলেও নারীবাদী কল্পবিজ্ঞানের তিনি প্রথম স্রষ্টা। অনেক সমালোচকেরই মতে লেগুইনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘দি লেফট হ্যান্ড অফ ডার্কনেস’ (প্রকাশকাল ১৯৬৯) উপন্যাসের গেথেন গ্রহের মানুষরা উভলিঙ্গ, কিন্তু আমরা যে অর্থে সাধারণত শব্দটা ব্যবহার করি সেই অর্থে নয়। গেথেনের মানুষরা আমাদেরই বংশধর, কিন্তু তাদের লিঙ্গ সাধারণভাবে নির্দিষ্ট নয়। একমাত্র ঋতুকালেই তাদের মধ্যে মিলন সম্ভব এবং সেই সময় পরিস্থিতির, বিশেষ করে সঙ্গীর চরিত্রের উপর, নির্ভর করে কোনো বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে পুরুষ বা নারী রূপের প্রকাশ ঘটে। যাদের লিঙ্গ পরিবর্তন হয় না, সেরকম মানুষকে সেখানে পার্ভার্ট বা বিকৃতকাম মনে করা হয়।     
      লেগুইন গেথেন নয়, আসলে আমাদেরই সমাজব্যবস্থার উপর নারী-পুরুষের দৈহিক পার্থক্যের প্রভাব দেখতে চাইছেনপৃথিবী থেকে একজন সাধারণ অর্থে পুরুষ, জেনলি আই, সেই গ্রহে দূত হয়ে এসেছেপ্রতি মুহূর্তে তার সঙ্গে গেথেনের অধিবাসীদের ভুল বোঝাবুঝি হয়। নারী-পুরুষে বিভক্ত যে সমাজে আই-এর জন্ম, সে তার ধ্যান-চিন্তা-ধারণাকে গড়ে তুলেছে, এবং তার সঙ্গে গেথেনের সমাজের মৌলিক পার্থক্য আছে। অপরাধ গেথেনে হয়, কিন্তু দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয় না। একই ব্যক্তি একই সঙ্গে কোনো সন্তানের বাবা, আবার অন্য কোনো সন্তানের মা -- তার ফলে আমাদের চেনা পরিবারের ছক সেখানে অচল। লেগুইন নারী-পুরুষের মধ্যে স্বীকৃত সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন, আমাদের সমাজের উপর পিতৃতান্ত্রিকতার প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন
      এই গ্রহেরই পটভূমিকায় অন্য একটি গল্প ‘উইন্টার্স কিং’ (প্রকাশকাল ১৯৬৯) যখন ‘দি উইন্ডস টুয়েলভ কোয়ার্টার্স’ বইতে সংকলিত হয়েছিল, লেগুইন গল্পটিকে সামান্য পালটে দিয়েছিলেননতুন রূপে গল্পটিতে রাজা বা King-এর জন্য She সর্বনামের ব্যবহার চমকে দেয়, বারবার ফিরে পড়তে হয়। অন্যান্য কল্পবিজ্ঞান অ্যালিয়েন খুঁজতে ভিনগ্রহে যায়, লেগুইনের অ্যালিয়েনরা অন্য গ্রহে থাকলেও তারা আমাদের মতোই মানুষ – কিন্তু তাদের আর আমাদের মধ্যে উঠেছে দুর্লংঘ্য দেওয়াল। সেই দেওয়াল তৈরি করেছে আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, যা আমাদের চিন্তাভাবনাকে একটা লক্ষ্মণরেখার মধ্যে বেঁধে রাখতে চায়। লেসিঙের মতোই তিনি নতুন জগত নির্মাণ করছেন, আমাদের বহুদিনের সযত্ন লালিত ধ্যানধারণা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, আমাদের বাধ্য করছেন চেনা গণ্ডির বাইরে বেরোতে। এই প্রবন্ধের শুরুর উদ্ধৃতিটি ‘দি লেফট হ্যান্ড অফ ডার্কনেস’ থেকে নেয়া, তা আমাদের বর্তমান সমাজের ক্ষেত্রে কতটা প্রযোজ্য তা ব্যাখ্যা করে বলার বোধহয় অপেক্ষা রাখে না।
      লেগুইন তাঁর লেখাতে রূপক আরোপ করতে চাইতেন না, তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন যে তিনি শুধু একটা গল্প বলতে চান। কিন্তু ‘দি লেদ অফ হেভেন’-এর (প্রকাশকাল ১৯৭১) কোনো পাঠক যদি আমার মতো  গল্পের ভিতরে গভীর কোনো অর্থ খুঁজে পায় তাহলে তাকে বোধহয় দোষ দেয়া যাবে না। গল্পের ২০০২ সালের পৃথিবী বিশ্বউষ্ণায়নের শিকার। মধ্য প্রাচ্যে যুদ্ধ চলছে, আমেরিকাতেও জীবনযাত্রার মান ক্রমশই নামছে। জর্জ অর নামের এক ড্রাফটসম্যান গল্পের মুখ্য ভূমিকায়, সে যা স্বপ্ন দেখে তা বাস্তবে পরিণত হয়। অন্য সকলের কাছেই সেই নতুন বাস্তবটা চিরকালের জন্য সত্য, তাদের স্মৃতিতে অতীতটাও নতুন বাস্তবের অনুসারে পালটে যায়। শুধু অরের স্মৃতিতে পুরানো অতীতের ছবি ধরা থাকে। বাঁধা গতের বাইরে চিন্তা করার জন্য সমাজ জর্জ অরের উপর মনোরোগীর তকমা লাগিয়ে দেয় হেবার নামের এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তার এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে পৃথিবীর মঙ্গল করতে চায়, কিন্তু অরের কল্পনার নতুন বিশ্ব প্রতিটি পরিবর্তনের পরে খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে যায়। হেবারের উপচিকীর্ষা ক্রমশ ক্ষমতালোভে পর্যবসিত হয়। হেবারের চরিত্রের মাধ্যমে ইউটিলিটারিয়ানিজম বা হিতবাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন লেগুইন।
      সমালোচকদের মতে জর্জ অরের নাম দেওয়ার সময় লেগুইন হয়তো জর্জ অরওয়েলের কথা ভাবছিলেন। হতে পারে, কারণ ‘নাইনটিন এইটি ফোর’-এর লেখকের মতোই লেগুইনও সমাজকে নানা দিক থেকে দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর আর একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘দি ডিসপজেসডঃ অ্যান অ্যাম্বিগুয়াস ইউটোপিয়া’ (প্রকাশকাল ১৯৭৪)। এই উপন্যাসে তিনি পুঁজিবাদ, পিতৃতন্ত্র, সমাজবাদ, নৈরাজ্যবাদ নানা ধরণের সমাজব্যবস্থাকে পাশাপাশি রেখেছেন। লেগুইনের গল্পের  ইউটোপিয়া কিন্তু কল্পনার স্বর্গ নয়, অ্যাম্বিগুয়াস অর্থাৎ সন্দেহাকীর্ণ বা দ্ব্যর্থকগল্পের মূল চরিত্র শেভেক এক পদার্থবিজ্ঞানী, সে সময়ের চরিত্র নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছে, দেখিয়েছে সময় যে সবসময় সরল ভাবে এগোয় বলে আমরা মনে করি তা আসলে ভুল। শেভেকের আবিষ্কারের মতোই উপন্যাসও সময়ের সঙ্গে রৈখিকভাবে এগোয়নি। গল্প কখনো ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে ফিরে গেছে, কখনো বা এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে ঝাঁপ দিয়েছে। লেগুইন কখনো পাঠককে নিশ্চিন্তে থাকতে দেবেন না, প্রতি মুহূর্তে তাঁর মনোযোগ দাবি করেন।
      কল্পবিজ্ঞান থেকে এবার আসি লেগুইনের কল্পকাহিনিতে। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত ‘দি ওয়ার্ড অফ আনবাইন্ডিং’ গল্পটি যে জগতের ইঙ্গিত দিয়েছিল, সেই জগতেই লেগুইন রচনা করেছেন পাঁচটি উপন্যাস ও আরো কয়েকটি গল্প। এগুলি একত্রে ‘আর্থসি’ নামে পরিচিত। আর্থসির জগত হল এক দ্বীপমালা ও সমুদ্রের বিশ্ব। সেখানে সমাজে জাদুবিদ্যা এক প্রধান স্থান অধিকার করে আছে -- কিন্তু তা সংযত, নমিত, নিজেকে সে জাহির করে না। জেড নামের এক কিশোর জাদুবিদ্যার এক অসাধারণ প্রতিভা, কিন্তু কৈশোরের অপরিণামদর্শিতাতেই সে ভুলক্রমে এক ছায়াজীবকে সৃষ্টি করে, যে জেডকে ধ্বংস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কেমনভাবে জেড সেই ছায়াজীবের মুখোমুখি হল, তাই নিয়েই প্রথম উপন্যাস ‘এ উইজার্ড অফ আর্থসি’-র (প্রকাশকাল ১৯৬৮) কাহিনি। এই উপন্যাস মূলত জেডের বয়ঃপ্রাপ্তির কাহিনি -- কৈশোরের বলগাহীন প্রতিভা অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সংযমের শাসনে বাঁধা পড়ে। উপন্যাসের সমাপ্তি আমাকে বিস্মিত করেছিল, বাধ্য করেছিল পুরো উপন্যাস আবার ঘুরে পড়তে। দেখেছিলাম লেগুইন বারে বারে উপন্যাসের সমাপ্তির ইঙ্গিত দিয়েছেন, কিন্তু  লেখনীর মুনশিয়ানা এমনই যে একমাত্র দ্বিতীয়বার পাঠেই তারা আমার চোখে ধরা পড়েছিল।
      সর্বকালের সেরা কল্পকাহিনিকারদের মধ্যে লেগুইন অবশ্যই জায়গা করে নেবেনআমার বিচারে টলকিয়েনের ‘দি লর্ড অফ দি রিংস’ আর লেগুইনের ‘আর্থসি’ সিরিজের উপন্যাসগুলি একই স্থান অধিকার করে নেবে। এই সিরিজের প্রথম তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় চার বছরের মধ্যে, সেগুলি প্রথমে কিশোরসাহিত্য হিসাবেই পরিচিত হয়েছিল এবং যথেষ্ট খ্যাতি কুড়িয়েছিল কিন্তু লেগুইন তাতে খুশি হননি, তার সঙ্গত কারণও ছিল ‘দি লর্ড অফ দি রিংস’-এর মতোই দশ বছরের শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক, সকলের কাছেই এই উপন্যাসগুলির আবেদন অসাধারণ গল্প বলার নৈপুণ্যে এবং কল্পনার শক্তিতে  উপন্যাসগুলি যেমন পাঠককে ধরে রাখে, তেমনি তার অন্তর্নিহিত অর্থ আমাদের জীবন এবং, আরো বিশেষ করে বললে, মৃত্যুর মুখোমুখি হতে শেখায় মার্গারেট অ্যাটউডের মতো সাহিত্যিকও আর্থসি-র গল্পগুলির আবেদনকে সার্বজনীন বলেই মনে করেছেন, সেগুলো পরবর্তীকালে বয়স্কদের মধ্যেও বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
লেখা শুরুর সময় বলেছিলাম হ্যারি পটারের গল্পের কথা  আর্থসি-তেই প্রথম খুঁজে পাই জাদুবিদ্যা শেখার স্কুলের কথা প্রতিভাধর জেড সেই স্কুলে গিয়ে এক শত্রু তৈরি করবে যে তারই সঙ্গে এক অচ্ছেদ্য বাঁধনে বাঁধা সে প্রথম সাক্ষাতেই জেডকে আক্রমণ করে তার দেহে আঘাতের চিহ্ন এঁকে দেবে তাকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দেবে তার এক প্রিয়জন। যখনই ছায়াজীব জেডের কাছাকাছি আসে, তখনই সেই পুরানো ক্ষতচিহ্ন তাকে যন্ত্রণা দেয় গল্পটা চেনা লাগছে কি? এই প্রবন্ধ লিখতে বসে দেখলাম অনেকেই জে কে রাউলিঙের উপর লেগুইনের প্রভাবের কথা বলেছেন তবে দুজনের লেখাতে তফাতও কম নয়। রাউলিঙের লেখা উচ্চকিত, লে গুইনের ভাষা তুলনায় মৃদু রাউলিঙের জাদুকরদের জগত আমাদের বিশ্বের সঙ্গে সমান্তরালে অবস্থান করে। তারা আমাদের পাশের বাড়িতে থাকে, কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অঙ্গ নয়। তাদের জাদু অধিকাংশ সময়েই চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। লেগুইনের আর্থসিতে জাদুকররা সমাজের স্বাভাবিক অংশ, আলাদা করে সম্ভ্রমের পাত্র নয় চাষী, কামার বা জেলের মতো জাদুকরদেরও উপার্জন করে খেতে হয়।
আমার ব্যক্তিগত মত আর্থসি সিরিজের প্রথম উপন্যাসই গল্প হিসাবে সবচেয়ে সুখপাঠ্য কিন্তু পরের উপন্যাসগুলিতে লেগুইন মানবপ্রবৃত্তির আরো গভীরে প্রবেশ করেছেন, তাকে বিশ্লেষণ করেছেন একটা বিশেষ উদাহরণ দেখা যাক প্রথম দিকের গল্পে নারী চরিত্রগুলি তেমন রূপ পায়নি ‘দি লেফট হ্যান্ড অফ ডার্কনেস’-এর স্রষ্টার কাছে যে ধরনের নারীকে আমরা আশা করি, চরিত্রগুলি তার কাছাকাছিও পৌঁছায়নি দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দি টম্বস অফ আটুয়ান’-এর (প্রকাশকাল ১৯৭১) কথক টেনার নারী, উপন্যাসে সে এক মুখ্য ভূমিকা অধিকার করেছে কিন্তু গল্পে সে পশ্চাৎপট ছাড়া কিছু নয় জেডই গল্পের নায়ক, পাদপ্রদীপের সমস্ত আলোই পড়েছে তার উপরে 
      তৃতীয় উপন্যাস ‘দি ফার্দেস্ট শোর’-এর (প্রকাশকাল ১৯৭২) সমাপ্তিতে জেড তার সমস্ত জাদুক্ষমতা হারিয়ে সাধারণ মানুষে পরিণত হয়েছিল আঠারো বছর পরে লেগুইন যখন আবার আর্থসিতে ফিরে গেলেন, তখন পেলাম এক অন্য ধারার গল্প পশ্চাৎপট একই, কিন্তু সমাজকে আমরা দেখলাম অন্য চোখে। টেনারের নারীত্বকে স্বীকার করে জেডের যেন নবজন্ম হল চতুর্থ উপন্যাস ‘টেহানু’-তে (প্রকাশকাল ১৯৯০) জাদুকরশ্রেষ্ঠ জেড নয়, আমরা খুঁজে পেলাম মানুষ জেডকে লেগুইন দেখালেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সীমাবদ্ধতা, লিখলেন নারীদের প্রাপ্য স্থান ও অধিকার থেকে বঞ্চনার কাহিনি আর্থ সির জাদুবিশ্ব নিশ্চয় পৃথিবী নয়, তার সমাজও প্রথম দর্শনে আমাদের সমাজের থেকে আলাদা কিন্তু লেগুইনের লেখনীর গুণে তারা এক জায়গায় এসে মেলে
তাঁর লেখা থেকে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে ট্রু নেম অর্থাৎ প্রকৃত বা জন্মগত নামের ধারণা। অনেক প্রাচীন সমাজ বিশ্বাস করত যে প্রত্যেক জিনিসের বা প্রাণীর এক জন্মগত নাম আছে। সেই নামের মধ্যে তার সমস্ত চারিত্রবৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে, তাই তা জানতে পারলে সেই বস্তু বা প্রাণীকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়‘দি রুল অফ নেমস’ (প্রকাশকাল ১৯৬৪) গল্প থেকে শুরু করে আর্থসি-র প্রত্যেকটি গল্পে এই ধারণার অসাধারণ ব্যবহার করেছেন লেগুইন। ‘এ উইজার্ড অফ আর্থসি’ উপন্যাসে ছায়াজীবের প্রকৃত নাম আবিষ্কারের মধ্যে দিয়েই জেডের মুক্তি ঘটে।
সারা জীবন নানা সম্মান পেয়েছেন উর্সুলা লেগুইন কল্পবিজ্ঞান ও কল্পকাহিনির জন্য যে কটি পুরষ্কার দেওয়া হয়, তাদের সবগুলির তালিকাতেই তাঁর নাম পাওয়া যাবে, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশ কয়েকবার তাঁর গল্পে একাকার হয়ে গেছে নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, পরিবেশবিজ্ঞানতাই লেগুইনের লেখার ড্রাগনরা কিন্তু শুধু গল্পের মধ্যে বাস করে না। তাঁর এক সতর্ক বার্তা দিয়েই লেখা শেষ করি।
People who deny the existence of dragons are often eaten by dragons. From within.

প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, উৎসব সংখ্যা ২০১৮

1 comment:

  1. বাংলায় লেগুইনের কাজের এত ভালো মূল্যায়ন আগে হয়নি। এই অসামান্য প্রবন্ধটির মাধ্যমে লেগুইনের জগতে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য কৃতজ্ঞ হলাম।

    ReplyDelete