Sunday 29 September 2019

পর্যায়সারণির দেড়শ বছর




পর্যায়সারণির দেড়শ বছর

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       যারা স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়, তার নিশ্চয় পর্যায়সারণির কথা জানো। কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির দেওয়ালে টাঙানোও হয়তো অনেকে দেখেছ। সেই পর্যায়সারণির বয়স হল দেড়শ বছর। রুশ বিজ্ঞানী দমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভ মৌলিক পদার্থগুলিকে একটা সারণি বা টেবিলের মতো করে সাজান। এরই নাম পর্যায় সারণি বা পিরিয়ডিক টেবিল। ১৮৬৯ সালের ১৮ মার্চ মেন্দেলিয়েভ রাশিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির সভায় তাঁর গবেষণার কথা প্রকাশ করেছিলেন। পর্যায়সারণি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার যে রাষ্ট্রসংঘ ২০১৯ সালকে আন্তর্জাতিক পর্যায়সারণি বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু এক দিনে এই আবিষ্কার হয়নি। আজ আমরা এই পর্যায় সারণি ধাপে ধাপে কেমন করে তৈরি হল, সেই গল্প শুনব।

       মৌলিক পদার্থ কাকে বলে সকলেরই জানাসহজ কথায়, যে পদার্থকে ভাঙতে ভাঙতে একই রকম পরমাণু পাওয়া যায়, তাকে বলে মৌলিক পদার্থ বা মৌল। যেমন লোহার মধ্যে লোহা ছাড়া অন্য কোন পরমাণু পাওয়া যাবে না। কিন্তু জল ভেঙে দুই রকম মৌল হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পাওয়া যায়, তাই জল মৌল নয়, যৌগ। এ কথাটা এখন আমরা জানি বটে, কিন্তু প্রাচীনকালে বিষয়টা বোঝা মোটেই সহজ ছিল নাযৌগিক পদার্থ ভেঙে মৌল বার করার মতো বিজ্ঞান রপ্ত করতে মানুষের সময় লেগেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ বিশ্বাস করত যে চারদিকে যে কোটি কোটি নানা বস্তু দেখা যায়, তারা মাত্র কয়েকটা মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। আমাদের দেশে মনে করা হত মৌলিক পদার্থের সংখ্যা পাঁচ – ক্ষিতি অর্থাৎ পৃথিবী বা কঠিন পদার্থ, অপ অর্থাৎ জল বা তরল, মরুৎ অর্থাৎ বায়ু, তেজ অর্থাৎ আগুন বা শক্তি এবং ব্যোম অর্থাৎ শূন্য। এদের বলা হত পঞ্চভূত। সব প্রাচীন সভ্যতাই এই রকম কয়েকটা মৌলের কল্পনা করেছিল। প্রাচীন গ্রিকরাও প্রথমে চারটে, পরে পাঁচটা মৌলিক পদার্থের কথা বলেছিল। চীনদেশের কল্পনায় পাঁচটা মৌলিক পদার্থ ছিল মাটি, ধাতু, কাঠ, জল ও আগুন। সবাই পাঁচটা মৌলের কথাই বলেছিল,  তাই মনে করা হয় যে প্রাচীন সভ্যতাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল।

 




পঞ্চভূত: প্রাচীন ভারতবর্ষ, গ্রিস ও চীনে

       এগুলো যে সত্যি সত্যি মৌলিক পদার্থ  নয় -- কোনো কোনোটা আদৌ পদার্থই নয় -- তা বুঝতে সময় লেগেছিল। সোনা, রুপো, তামা, টিন, কার্বন, গন্ধক, পারদ, সিসা, লোহা, অ্যান্টিমনি, দস্তা, আর্সেনিক এই বারোটা মৌলের আবিষ্কার হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগে এগুলো হয় প্রকৃতিতে মৌলিক পদার্থের রূপে পাওয়া যায়, নয়তো এদের আকরিক থেকে আলাদা করা বেশ সহজ। যেমন, সোনা প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। আকরিক থেকে তামা নিষ্কাশন খুব শক্ত নয়। আবার লোহাকে আকরিক থেকে পৃথক করা বেশ শক্ত, কিন্তু মানুষ প্রথম যে লোহা ব্যবহার করে, তা এসেছিল উল্কাপিণ্ড থেকে। সে যুগে এদের কোনোটাকেই অবশ্য মৌলিক পদার্থ বলে মনে করা হত না।

       প্রথম মৌলগুলো কে বা কারা আবিষ্কার করেছিল জানা সম্ভব নয়। মধ্যযুগে অ্যালকেমিস্টরা সস্তার ধাতুকে সোনাতে পরিবর্তন করার নানা চেষ্টা করত, তার থেকেই রসায়ন শাস্ত্র বা কেমিস্ট্রির জন্ম অ্যালকেমিস্টদের মধ্যেই আমরা মৌলিক পদার্থের প্রথম আবিষ্কারকের নাম খুঁজে পাই; ১৬০৯ সালে হেন্নিগ ব্র্যান্ড ফসফরাস আবিষ্কার করেছিলেন। ১৬৬১ সালে রবার্ট বয়েল প্রথম মৌলিক পদার্থের আধুনিক সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। তখন অবশ্য পরমাণুর কথা আসতে পারে না, বয়েল বলেছিলেন যে পদার্থকে কখনোই  ভেঙে অন্য পদার্থ পাওয়া যাবে না, তাই মৌল।

       চলে আসি অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে। রসায়নের জনক ফরাসি বিজ্ঞানী আঁতোয়া ল্যাভসিয়ের ১৭৮৯ সালে মৌলিক পদার্থের প্রথম তালিকা তৈরি করেছিলেন, তাতে ছিল তেত্রিশটি নামএদের মধ্যে সবাইকে অবশ্য আজ মৌল বা এমনকি পদার্থ বলাও যাবে না; তেইশটি পদার্থ ছিল মৌলিক। তাহলেও বোঝা যাচ্ছে যে ফসফরাস আবিষ্কারের পরের একশো আশি বছরে আরো দশটা নতুন মৌল আবিষ্কার হয়ে গেছে। ফরাসি বিপ্লবের সময় ল্যাভসিয়েরকে গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

       আধুনিক পরমাণুবাদের জনক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন ডালটন ১৮০৩ সালে হাইড্রোজেন অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ও গন্ধক -- পাঁচটি মৌলিক পদার্থের এক তালিকা তৈরি করেছিলেন। ১৮০৮ সালে তিনি এই তালিকাতে আরো পনেরটি নাম সংযোজন করেন। ১৮২৭ সালে তাঁর তালিকাতে মৌলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬সঙ্গের ছবিতে সেই ৩৬টি মৌলিক পদার্থের নাম দেওয়া আছে।  দেখতে পাচ্ছ যে এই তালিকাতে সবগুলোই সত্যিকারের মৌলিক পদার্থ। ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, বেরিয়াম, স্ট্রনসিয়াম ও বোরন – এই সমস্ত মৌলিক পদার্থকে তাদের যৌগ থেকে পৃথক করেছিলেন ব্রিটিশ রসায়নবিদ হামফ্রে ডেভি মাত্র দু বছরে ১৮০৭ ও ১৮০৮ সালেডালটনের তালিকাতে অবশ্য বোরনের নাম নেই  

      


ডালটনের ৩৬টি মৌলিক পদার্থ ও তাদের চিহ্ন

       ছবিতে দেখতে পাচ্ছ ডালটন মৌলিক পদার্থদের জন্য আলাদা আলাদা চিহ্ন ব্যবহার করতেন। সেই চিহ্নগুলো জনপ্রিয় হয়নি, কারণ সেগুলোকে  মনে রাখাটা মোটেই সহজ ছিল না। এখন আমরা যে এক বা দুই অক্ষর ব্যবহার করে মৌলিক পদার্থ এবং তাদের পাশাপাশি লিখে যৌগিক পদার্থ বোঝাই, তা শুরু করেছিলেন সুইডিশ বিজ্ঞানী জোয়ানস জ্যাকব বার্জেলিয়াস। যেমন ধরো অক্সিজেন আর ক্যালসিয়ামের চিহ্ন হল যথাক্রমে O Ca তাহলে পোড়া চুন বা ক্যালসিয়াম অক্সাইডের সঙ্কেত হল CaO ঠিক তেমনি হাইড্রোজেনের চিহ্ন H বলে জলের সঙ্কেত হল H2OH-এর পরে 2 দিয়ে বোঝানো হয়েছে জলের অণুতে হাইড্রোজেনের দুটো পরমাণু আছে। O-এর পরে কোনো সংখ্যা না লেখার অর্থ জলের অণুতে অক্সিজেনের পরমাণু আছে একটা।  সিলিকন, সেলেনিয়াম, সেরিয়াম – এই তিনটি নতুন মৌল আবিষ্কারের সঙ্গেও বার্জেলিয়াসের নাম যুক্ত আছে।




জন ডালটন (উপরে) ও জ্যাকব বার্জেলিয়াস

       ১৮৩০ সালে নাগাদ মৌলের সংখ্যা পঞ্চাশ পেরিয়ে গেল। এবার চেষ্টা শুরু হল তাদের শ্রেণিবিন্যাসের। ধরো  বাঘ, সিংহ, চিতা, বিড়াল, তাদের মধ্যে অনেক মিল আছে, তাই তাদের জীববিজ্ঞানে একই গোত্রে ফেলা হয়।  সেই রকম একই ধরণের মৌলদের নিয়ে পরিবার তৈরির চেষ্টা শুরু হল।

       এ ব্যাপারে মৌলদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ধর্মের কথা বলতে হয় তা হল পারমাণবিক গুরুত্বহাইড্রোজেন পরমাণুর থেকে কোনো মৌলের পরমাণু যত গুন ভারি, তাকে বলে ঐ মৌলের পারমাণবিক গুরুত্ব। যেমন একটা অক্সিজেনের পরমাণু একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর থেকে মোটামুটি ষোল গুন ভারি, তাই অক্সিজেনের পারমাণবিক ভর ১৬১৮০৩ সাল থেকেই মৌলদের পারমাণবিক গুরুত্ব নির্ণয় করা শুরু হয়ে গিয়েছিল, এ কাজেও ডালটন ও বার্জেলিয়াসের বিশেষ ভূমিকা ছিল

       মৌলের শ্রেণিবিন্যাসের প্রথম উদাহরণ হল ১৮২৯ সালে প্রকাশিত জার্মান বিজ্ঞানী জোহান ডোবারেইনারের ট্রায়াড বা ত্রয়ীর সূত্র একটা উদাহরণ দেখা যাক। তিনটি মৌল লিথিয়াম, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম; এদের পারমাণবিক গুরুত্ব যথাক্রমে ৬., ২৩ ও ৩৯.ডোবারেইনার দেখলেন যে সোডিয়ামের পারমাণবিক গুরুত্ব লিথিয়াম ও পটাশিয়ামের গুরুত্বের গড়ের সমান। আবার তিনটে মৌলই ক্ষার (alkaline) ধাতু, অর্থাৎ তারা জলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন তৈরি করে। পটাশিয়ামের বিক্রিয়ার হার সবচেয়ে বেশি, সোডিয়ামের তার থেকে কম, আর লিথিয়ামের সব চেয়ে কম। এই তিনটি মৌলকে তিনি বললেন ট্রায়াড বা ত্রয়ী। এই রকম আরো ট্রায়াড খুঁজে পাওয়া গেল, যেমন গন্ধক-সেলেনিয়াম-টেলুরিয়াম, হ্যালোজেন গ্যাসত্রয়ী ক্লোরিন-ব্রোমিন-আয়োডিন; মৃৎক্ষার (alkaline-earth) ধাতুত্রয়ী ক্যালসিয়াম-স্ট্রনশিয়াম-বেরিয়ামসবার ক্ষেত্রে যে মাঝের মৌলের পারমাণবিক গুরুত্ব  বাকি দুটোর গুরুত্বের গড়ের একদম সমান  তা নয়, কিন্তু তার কাছাকাছি।

       ট্রায়াডের সূত্র নিয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ শুরু করলেন, দেখলেন যে একই ধরনের ধর্ম অনেক সময় তিনটের বেশি মৌলিক পদার্থের মধ্যেও পাওয়া যায়। হ্যালোজেন গ্যাসের দলে সবচেয়ে হালকা মৌল ফ্লুরিনের সন্ধান পাওয়া গেল, গন্ধকের আগে নাম ঢুকল অক্সিজেনের। নাইট্রোজেন, ফসফরাস, আর্সেনিক, অ্যান্টিমনি, বিসমাথ নিয়ে নতুন পরিবার তৈরি হল। কিন্তু সে যুগে অনেক মৌলের পারমাণবিক গুরুত্ব নির্ণয়ে ভুল ছিল, তাই এ বিষয়ে গবেষণা খুব একটা এগোল না।




জোহান ডোবারেইনার (উপরে) ও জন নিউল্যান্ডস

       ১৮৬৩ সালে ব্রিটিশ রসায়নবিদ জন নিউল্যান্ডস তখনকার জানা ৫৬টি মৌলকে এগারটা শ্রেণিতে ভাগ করেন। তিনি এটাও দেখান যে পারমাণবিক গুরুত্ব অনুযায়ী সাজালে প্রতি অষ্টম মৌলের ধর্ম একই রকম। যেমন ক্ষার ধাতু লিথিয়াম দুই নম্বর, সোডিয়াম নয় নম্বর, পটাশিয়াম ষোল নম্বর। আবার হ্যালোজেনদের মধ্যে ফ্লুরিন সাত নম্বর, ক্লোরিন চোদ্দ নম্বর। কিন্তু  এই নিয়মটা ক্যালসিয়ামের পরে আর খাটে না। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন অক্টেভ বা অষ্টকের সূত্র। কিন্তু বিজ্ঞানী মহলে তাঁর আবিষ্কারকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় নি।  

       অনেকেই এই সময়ে মৌলিক পদার্থদের শ্রেণি বিন্যাসের চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হলেন মেন্দেলিয়েভ। মেন্দেলিয়েভের জন্ম ১৮৩৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার সাইবেরিয়াতে। তাঁরা সম্ভবত সতের ভাইবোন ছিলেন, তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ। তাঁর বাবা ইভান ছিলেন শিক্ষক, কিন্তু মেন্দেলিভের জন্মের পরেই তিনি অন্ধ হয়ে যান, ফলে চাকরিটি চলে যায়। কয়েক বছর পরে তিনি মারা যান। মা মারিয়া তাঁদের পারিবারিক একটা কাচের কারখানা নতুন করে খোলেন, কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই সেটি আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়। তাঁদের আর্থিক দুরবস্থা চরমে পৌঁছায়।

দমিত্রি বেশ মেধাবী ছাত্র ছিলেন, তাই তাঁর যখন পনের বছর বয়স, তখন মারিয়া নিয়ে যান বাইশশো কিলোমিটার দূরে মস্কোতে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য, সঙ্গে ছিলেন দমিত্রির ঠিক উপরের দিদি এলিজাবেথ। সে যুগে সাইবেরিয়া থেকে মস্কোতে যাওয়া মোটেই সহজ ছিল না, স্লেজ, ঘোড়ার গাড়ি, কখনো বা হেঁটে, সেই যাত্রা নিঃসন্দেহে তিন থেকে চার সপ্তাহ লেগেছিল। কিন্তু মস্কো তাঁদের হতাশ করে, অধ্যাপকরা সাইবেরিয়ার কোনো ছাত্রকে ভর্তি নিতে রাজি হননি। সেখানে সুযোগ না পেয়ে তাঁরা যান সাতশো কিলোমিটার দুরে সেন্ট পিটার্সবার্গে। সেখানে ইভানের এক পূর্বপরিচিতের সাহায্যে মেন পেডাগজিকাল ইন্সটিটিউটের ভর্তির পরীক্ষাতে বসার সুযোগ পান দমিত্রি, এবং পাস করে ভর্তি হন। সাফল্যের সঙ্গে সেখানকার পড়াশোনা শেষ করলেন মেন্দেলিয়েভ, কিন্তু একই সঙ্গে যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন। ইতিমধ্যেই একই রোগে তাঁর মা ও দিদি মারা যান। স্বাস্থ্যের কারণে কৃষ্ণ সাগরের তীরে ক্রিমিয়া উপদ্বীপে এক স্কুলে চাকরি নেন মেন্দেলিয়েভ। এক সপ্তাহের মধ্যেই রাশিয়া ও ব্রিটেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, এবং ব্রিটিশ সৈন্যরা ক্রিমিয়ার সমুদ্রতীর দখল করে। মেন্দেলিয়েভ বাধ্য হয়ে আরো উত্তরদিকে ক্রিমিয়ার রাজধানী ওডেসার এক স্কুলে যোগ দেন। অবশেষে সুস্থ হয়ে তিনি আবার সেন্ট পিটার্সবুর্গে ফিরে আসেন ও গবেষণা শুরু করেন। ১৮৬৪ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গ টেকনোলজিক্যাল ইন্সটিটিউট এবং পরের বছর সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। তাঁর নেতৃত্বে সেন্ট পিটার্সবুর্গ রসায়ন গবেষণাতে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিল। ১৯০৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।

পর্যায়সারণি তৈরির জন্য মেন্দেলিয়াভের নাম বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৮৬৯ সালে মেন্দেলিয়েভ তখনো পর্যন্ত জানা ষাটটি মৌলকে পারমাণবিক গুরুত্ব এবং রাসয়ানিক ধর্ম অনুসারে একটা সারণি বা টেবিলের আকার সাজান। নিচের টেবিলটা হুবহু মেন্দেলিয়েভের ১৮৬৯ সালের সারণির সংগে মিলবে না, কিন্তু আমাদের সুবিধার জন্য এটা নিয়েই আলোচনা করা যাক।

        


মেন্দেলিয়েভের পর্যায় সারণি

       উপরে RH, RH2 এই সমস্ত দিয়ে বোঝানো হয়েছে মৌলটি (R) হাইড্রোজেনের সঙ্গে মিলে হাইড্রাইড যৌগ গঠন করলে তার সঙ্কেত কী হবে তেমনি RO, RO2 এ সমস্ত দেখাচ্ছে মৌলের অক্সাইডের সঙ্কেত কী। যেমন লিথিয়াম (Li) হাইড্রোজেনের সঙ্গে মিলে যে যৌগ বানাবে, তার সঙ্কেত LiH, আবার লিথিয়াম অক্সাইডের সঙ্কেত হল LiO2 একটি কলম বা স্তম্ভের সমস্ত মৌল হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সঙ্গে একইরকম ভাবে যৌগ গঠন করবে যেমন ক্ষারধাতুরা সবাই আছে IA স্তম্ভে, তাদের হাইড্রাইড অণুতে আছে একটা ধাতুর পরমাণু, আর একটা হাইড্রোজেন পরমাণু  আবার তাদের অক্সাইডে একটা অক্সিজেন পরমাণুর সংগে দুটো ধাতুর পরমাণু যুক্ত হয় আমাদের চেনা মৃৎক্ষার ধাতুরা আছে IIA স্তম্ভে, হ্যালোজেন গ্যাসেরা  VIIA স্তম্ভে পর্যায় শব্দের একটা মানে হল পালা করে ঘুরে আসা এইভাবে রাসয়ানিক ধর্ম ঘুরে ঘুরে আসে বলে এর নাম পিরিয়ডিক টেবিল বা পর্যায় সারণি শুধু এই কাজ করলেই মেন্দেলিয়েভের নাম বিখ্যাত হয়ে থাকত, কিন্তু পর্যায় সারণি তৈরিতে তিনি আরো অনেক প্রতিভার পরিচয় রেখেছেন।  তার কয়েকটা উদাহরণ দেখা যাক।

       বিজ্ঞানীরা তখন ভেবেছিলেন বেরিলিয়াম (Be) ধাতুর  অক্সাইডের সঙ্কেত হল Be2O3, সেই অনুযায়ী তার পারমাণবিক গুরুত্ব হয় ১৪। মেন্দেলিয়েভ দেখলেন যে বেরিলিয়ামের অন্যান্য রাসয়ানিক ধর্মের সঙ্গে বরঞ্চ মৃৎক্ষার ধাতুদের মিল আছে। মৃৎক্ষার ধাতুর অক্সাইডে একটা ধাতুর পরমাণু আর একটা অক্সিজেনের পরমাণু থাকে, যেমন CaO তাই তিনি বেরিলিয়াম অক্সাইডের সঙ্কেত লিখলেন BeOএর থেকে তার পারমাণবিক গুরুত্ব কমে তা বোরনের (B) আগে গিয়ে ক্ষারধাতু ম্যাগনেসিয়ামের (Mg)  ঠিক উপরে বসল। আবার টেলুরিয়ামের (Te) পারমাণবিক গুরুত্ব আয়োডিনের (I) থেকে বেশি হওয়া সত্ত্বেও তিনি রাসয়ানিক ধর্ম বিচার করে টেলুরিয়ামকে আগে রেখেছিলেন। ঠিক তেমনি কোবাল্ট(Co) ও নিকেলের(Ni) জায়গাও তিনি উলটে দিয়েছিলেনপরে দেখা গেছে মেন্দেলিয়েভ সব কটি ক্ষেত্রেই ঠিক কাজ করেছিলেন। সেই কথায় আমরা এই লেখার শেষে আসব।

       তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলে যে মেন্দেলিয়েভ তাঁর সারণিতে কয়েকটা শূন্যস্থান রেখেছিলেন, বলেছিলেন যে সেখানে এমন মৌলরা বসবে যাদের তখনো আবিষ্কার হয়নিঅ্যালুমিনিয়ামের (Al) নিচের শূন্যস্থানের মৌলের তিনি নাম দেন এক-অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকনের(Si) নিচে বসালেন এক-সিলিকনকে। এই ‘এক’ শব্দটা মেন্দেলিয়েভ নিয়েছিলেন সংস্কৃত ভাষা থেকে। তিনি বলেছিলেন যে এই মৌলগুলো এখনো আবিষ্কার হয় নি, কিন্তু পর্যায় সারণি থেকে তিনি তাদের ধর্ম সম্পর্কে নানা ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। এখন আমরা এক-অ্যালুমিনিয়ামকে গ্যালিয়াম (Ga) আর এক-সিলিকনকে জার্মেনিয়াম (Ge) নামে চিনি। কী রকম ধর্ম মেন্দেলিয়েভ বলেছিলেন, আর কী পরে পাওয়া গেল তার কয়েকটা উদাহরণ নিচের সারণিতে দেওয়া হয়েছে। দেখা যাবে মেন্দেলিয়েভের হিসাব আসল মাপের খুব কাছাকাছি।

 

এক-অ্যালুমিনিয়াম

গ্যালিয়াম

এক-সিলিকন

জার্মেনিয়াম

পারমাণবিক গুরুত্ব

৬৮

৬৯.৭

৭২

৭২.৬

মৌলের ঘনত্ব (গ্রাম/ঘনসেমি)

৬.০

৫.৯

৫.৫

৫.৩

অক্সাইডের ঘনত্ব

(গ্রাম/ঘনসেমি)

৫.৫

৫.৯

৪.৭

৪.৭

অজানা মৌল সম্পর্কে মেন্দেলিয়েভের অনুমান ও তাদের আবিষ্কারের পরের মাপ

       এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। গ্যালিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী পল এমিল লেকক।  মেন্দেলিয়েভ তাঁকে লেখেন যে এই মৌলটিই তাঁর এক-অ্যালুমিনিয়াম। লেকক মনে করেছিলেন যে মেন্দেলিয়েভ তাঁর কৃতিত্বে ভাগ বসাতে চাইছেন, তিনি বলেন যে এক-অ্যালুমিনিয়াম আর গ্যালিয়ামের ধর্মে অনেক পার্থক্য আছে। পরে দেখা যায় মেন্দেলিয়েভই ঠিক। এই বিতর্কের ফলে পর্যায়সারণির কথা বিজ্ঞানী মহলে ছড়িয়ে পড়ে।

       মেন্দেলিয়েভ অবশ্য সমস্ত কথা ঠিক বলেন নি। যেমন, মেন্দেলিয়েভ বিভিন্ন সময়ে মোট আঠারটা নতুন মৌলের কথা বলেছিলেন, যার মধ্যে ন’টার অস্তিত্ব আছে। তবে সে আলোচনায় আর যাচ্ছি না। একই সময়ে জার্মান বিজ্ঞানী জুলিয়াস লোথার মেয়ার প্রায় একই রকম এক পর্যায়সারণি তৈরি করেছিলেন, তিনি অবশ্য কোন নতুন মৌলের কথা বলেন নি। মেয়ার কাজটা করেছিলেন ১৮৬৮ সালে, কিন্তু তাঁর প্রকাশক পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলায় বই ছাপতে দেরি হয়ে যায় দু’বছর। মেন্দেলিয়েভও অবশ্য ১৮৬৮ সালে থেকেই পর্যায় সারণি বানানো শুরু করেছিলেন। কে আগে কাজটা করেছিলেন তা নিয়ে দুজনের মধ্যে বেশ বিতর্ক হয়েছিল।




দমিত্রি মেন্দেলিয়েভ (উপরে) ও জুলিয়াস লোথার মেয়ার

       মেন্দেলিয়েভের জীবৎকালেই পর্যায় সারণীর একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছিল। সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের মৌল খুঁজে পাওয়ার পরে পর্যায় সারণিতে তাদের জন্য একটা নতুন স্তম্ভ তৈরি করতে হয়। তারা হল নিষ্ক্রিয় গ্যাস। প্রথম যে নিষ্ক্রিয় গ্যাস খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, তা হল হিলিয়াম। পৃথিবীতে নয়, তার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল সূর্যে। সেই আবিষ্কারের সঙ্গে আমাদের দেশের একটা সম্পর্ক আছে, সেই গল্প তোমরা এখানে পড়তে পার। হিলিয়াম পৃথিবীতে আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম র‍্যামজে। শুধু হিলিয়াম নয়, নিয়ন, আর্গন, ক্রিপটন, জেনন ও রেডন -- সব কটি নিষ্ক্রিয় গ্যাসের আবিষ্কারের সঙ্গেই র‍্যামজের নাম যুক্ত। ১৯০৪ সালে র‍্যামজেকে এই জন্য রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। বর্তমান আরো অনেক মৌল কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা হয়েছে, এখন আমাদের জানা মৌলের সংখ্যা ১১৮। এই সব নতুন মৌলরা তেজস্ক্রিয়, এদের আয়ু খুব কম। এই সব মৌলদের নিয়ে বড়দের জন্য একটা লেখা লিখেছিলাম, ইচ্ছা করলে এখানে পড়ে দেখতে পার। একেবারে আধুনিক পর্যায়সারণির একটা ছবি নিচে দেওয়া হল। দেখতে পাচ্ছ মেন্দেলিয়েভের পর্যায়সারণির থেকে এ অনেকটাই আলাদা। আলাদা হলেও সাজানোর মূল নীতিটা একই আছে, তবে আধুনিক সারণির বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে এই লেখাটা অনেক বড় হয় যাবে।



আধুনিক পর্যায় সারণী

       পর্যায় সারণি নিয়ে একটা সমালোচনা অনেক দিন ছিল। ধরা যাক ক্যালসিয়াম আর ঠিক তার পরের মৌল স্ক্যান্ডিয়ামের(Sc) কথা। প্রথমটার পারমাণবিক গুরুত্ব হল প্রায় ৪০ আর দ্বিতীয়টার প্রায় ৪৫। যদি ৪২ বা ৪৩ গুরুত্বের কোনো মৌল আবিষ্কার হয়, তাহলে পর্যায় সারণিতে তাকে জায়গা দেব কেমন করে? মেন্দেলিয়েভের পক্ষে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেওয়া সম্ভব ছিল না।

       আধুনিক পর্যায় সারণিটাকে দেখ প্রতিটি মৌলের পাশে একটা সংখ্যা আছে, যা হাইড্রোজেনকে ১ ধরে শুরু করে পর্যায় সারণিতে সেটি কত নম্বর মৌল তা বোঝাচ্ছে। এই সংখ্যাকে বলে পরমাণু ক্রমাঙ্ক। ১৯০৭ সালে মেন্দেলিয়েভ মারা গিয়েছিলেন। তার দু’বছর পরে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড পরমাণুর নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেন। ১৯১৩ সালে তরুণ ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরি মোসলে মৌলিক পদার্থের এক্স-রশ্মি বর্ণালী থেকে দেখান যে কোনো মৌলে থেকে বেরোনো একটা নির্দিষ্ট ধরনের এক্স রশ্মির কম্পাঙ্ক ঐ মৌলের পরমাণু ক্রমাঙ্কের বর্গের সমানুপাতী। দু বছর পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মাত্র আঠাশ বছর বয়সে নিহত হয়েছিলেন মোসলে।




উইলিয়াম র‍্যামজে (উপরে) ও হেনরি মোসলে

       খুব তাড়াতাড়ি বোঝা গেল যে পরমাণু ক্রমাঙ্ক আসলে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যার সমান। তাহলে আধুনিক পর্যায়সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে প্রোটনের সংখ্যা ক্যালসিয়ামের নিউক্লিয়াসে হল ২০ আর স্ক্যান্ডিয়ামের ক্ষেত্রে ২১। প্রোটনকে টুকরো করা যায় না, তাই এই দুই মৌলের মধ্যে অন্য কোনো মৌল থাকতে পারে নাশুধু তাই নয়, আগেই বলেছি মেন্দেলিয়েভ কোবাল্ট-নিকেল এবং টেলুরিয়াম-আয়োডিনের এই মৌলদের নিজেদের মধ্যে জায়গা পালটেছিলেন, তিনি ভেবেছিলেন যে হয়তো ওদের পারমাণবিক গুরুত্ব ভুল মাপা হয়েছে। আসলে নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা ধরে হিসাব করলে মেন্দেলিয়েভের সাজানোটাই পাওয়া যায়। যেমন টেলুরিয়ামের পারমাণবিক গুরুত্ব আয়োডিনের থেকে বেশি হলেও পরমাণু ক্রমাঙ্কের বিচারে সে আগে বসবে।

       পারমাণবিক গুরুত্ব তাহলে কী? পরমাণুর নিউক্লিয়াসে মোট কতগুলো প্রোটন আর নিউট্রন আছে, তা হল তার ভর সংখ্যা। কোন মৌলের নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা পালটায় না, কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা এদিক ওদিক হতে পারে। কাজেই তাদের ভর সংখ্যা আলাদা আলাদা। এই ধরনের পরমাণুদের বলে মৌলের আইসোটোপ। কোনো মৌলের পারমাণবিক গুরুত্ব মাপলে আমরা পাই তার আইসোটোপদের ভর সংখ্যার গড়।

       মেন্দেলিয়েভের পর্যায় সারণির গুরুত্ব সব রসায়নবিদ স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু কেন মৌলগুলো পর্যায়সারণিতে এই ভাবেই সাজানো থাকে, তা বুঝতে সময় লেগেছে আরো অনেক দিন। শেষ পর্যন্ত কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এর সমাধানের পথ দেখিয়েছে। কিন্তু সে আলোচনা অনেক জটিল ও দীর্ঘ, আজ আর সেখানে আমরা যাব না। ১৮৮২ সালে মেন্দেলিয়েভ ও লোথার মেয়ার একসঙ্গে ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটির হামফ্রে ডেভি পদক পেয়েছিলেন। চাঁদের বুকে একটি গহ্বরের নাম দেয়া হয়েছে মেন্দেলিয়েভ। র‍্যামজে নোবেল পেলেন, কিন্তু মেন্দেলিয়েভের নাম দুবার নোবেল পুরস্কারের জন্য ওঠা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত দেওয়া হল না কেন -- সে পৃথক আলোচনার বিষয়। কিন্তু নোবেল পুরস্কারের থেকেও বড় সম্মান মেন্দেলিয়েভ পেয়েছেন। আধুনিক সারণিতে দেখ ১০১ নম্বর মৌলের চিহ্ন হল Mdওই মৌলের নাম মেন্দেলেভিয়াম।

       



এই লেখাটা প্রকাশিত হয়েছে একপর্ণিকা পত্রিকার জুলাই ২০১৯ সংখ্যায়। কিছুটা পরিবর্তন করে ব্লগে দিলাম। 

No comments:

Post a Comment