Saturday 30 November 2019

চন্দ্রযান -২ঃ সাফল্য ও ব্যর্থতাকে অতিক্রম করে বিজ্ঞান গবেষণা




চন্দ্রযান -২ঃ সাফল্য ও ব্যর্থতাকে অতিক্রম করে বিজ্ঞান গবেষণা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       এই পত্রিকার আগস্ট সংখ্যায় চন্দ্রযান-২ এর উৎক্ষেপণের খবর দেওয়া হয়েছিল। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন যে বিক্রম ল্যান্ডারকে সফ্‌ট ল্যান্ডিং (পুরানো এক লেখায় পড়েছিলাম পালকের মতো অবতরণ) শেষ পর্যন্ত করানো সম্ভব হয়নি।সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখে পূর্বনির্ধারিত সূচী অনুযায়ী বিক্রমকে চন্দ্রযান থেকে বিচ্ছিন্ন করাতে বিজ্ঞানীরা সফল হয়েছিলেন, কিন্তু সে যখন চন্দ্রপৃষ্ঠের দু’কিলোমিটার উপরে তখন রকেটের নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দেয়। তিনশো তিরিশ মিটার উচ্চতায় বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই সময় তার নামার বেগ ছিল সেকেন্ডে ৫৮ মিটার, যা নিরাপদ মাত্রার উপরে। বিক্রম সম্ভবত চন্দ্রপৃষ্ঠে ৫০ মিটার প্রতি সেকেন্ড বেগ নিয়ে নেমেছিল, যা অনেকটাই বেশি। এই হার্ড ল্যান্ডিঙের পর বিক্রমের চিহ্ন অবলোহিত ক্যামেরাতেখুঁজে পাওয়া গেলেও তার সঙ্গে আর যোগাযোগ স্থাপন করা যায় নি। মূল চন্দ্রযান অবশ্য চাঁদের চারপাশে আবর্তন করছে এবং তথ্য পাঠাচ্ছে।
       এই অভিযানকে নিয়ে নানা পরস্পরবিরোধী খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে উৎক্ষেপণের দিন ছিল ১৪ জুলাই, কিছু ত্রুটি ধরা পড়ার জন্য তা শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে করা হয় ২২ জুলাই। উৎক্ষেপণ আটদিন পিছিয়ে গেলেও অবতরণের দিন পালটানো হয় নি। সমালোচনা হয়েছে যে নতুন কেন্দ্রীয় সরকারের একশোতম দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যেই অবতরণের দিন অপরিবর্তিত রাখার জন্য সরকারের থেকে হয়তো চাপ এসেছিল। ভারত এই প্রথম সফ্‌ট ল্যান্ডিঙের চেষ্টা করেছিল। এর আগে কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন চাঁদের বুকে মহাকাশযান নামাতে সক্ষম হয়েছে। মাত্র কয়েকমাস আগে ইজরায়েলের অবতরণ যান চাঁদে নামার সময় দুর্ঘটনাতে পড়েছিল। বিষয়টা মোটেই সহজ নয়, নানা সমস্যা আছে। যেমন চাঁদের খুব কাছে যখন ব্রেক করার জন্য ল্যান্ডিং রকেট চালানো হবে, তখন চাঁদের থেকে ক্ষুদ্র ধূলিকণা ছিটকে এসে রকেটের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে, সেই কথা মাথায় রেখে রকেট ডিজাইন করতে হয়। এ ধরনের নানা সমস্যার জন্য অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই কাজে এলো না। ভন্দ্রযান-২ অবশ্য কক্ষপথ থেকে ভচাঁদ সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধানের কাজ করে চলেছে, তার সময়কাল বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
       এই অভিযান নিয়ে এক অদ্ভুত উন্মাদনা দেশে সৃষ্টি করা হয়েছিল, যা অনেক বিজ্ঞানীই পছন্দ করেননি। রেটিং বানানোর জন্য গণমাধ্যম এ ধরনের কাজ করেই থাকে, কিন্তু এবারে সরকারি স্তরেও তাতে মদত ছিল।  অবতরণের লাইভ টেলিকাস্ট খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু সেই সময় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়।অবতরণের ঘটনার সাক্ষী হওয়ার জন্য আগে থেকে বাছাই করে কিছু ছাত্রছাত্রীকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অনেকেই ঐতিহাসিক ঘটনা চোখে দেখবেন বলে টেলিভিশনের সামনে রাত জেগে বসেছিলেন।এই সমস্ত ঘটনা বিজ্ঞানীদের উপরে চাপ সৃষ্টি করে।
       চন্দ্রযান-১ বা মঙ্গলযানের সাফল্য যেমন এসেছে, তেমনি কোনো কোনো অভিযানে ব্যর্থতা আসবে সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের ভারতীয়দের একটা সমস্যা হল যে আমরা সাদা এবং কালোর বাইরে যে ধূসর এলাকা রয়েছে, তা সাধারণত মনে রাখতে পারি না। বিরাট কোহলি দুই তিন ইনিংসে রান না পেলেই তার সমালোচনাতে মুখর হই। এক্ষেত্রেও ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার সমালোচনা হয়েছিল, কিন্তু মহাকাশ গবেষণা সংস্থার কর্মকাণ্ডের প্রতি সমর্থন তার থেকে বেশি এসেছে। সেই কথাটা ভালো, কিন্তু সম্ভবত অবিমিশ্র ভালো নয়। সংস্থার প্রধান সাংবাদিক সম্মেলনে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন অভিযান ৯৫ শতাংশ সফল। পরে ৯৮ শতাংশ সাফল্যের কথাও শোনা গেছে। এ ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনে বাধ্য হওয়াটা নিজেদেরভুলত্রুটি খুঁজে বার করাতে বাধা সৃষ্টি করে।
       বিজ্ঞান এগোয় সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার মধ্যে  দিয়ে।  কিন্তু সমালোচনা ঐ বিশেষ ক্ষেত্রের  বিশেষজ্ঞদের থেকে আসতে হবে। স্টুডিওতে বসে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞও তা নিয়ে মতামত দেবেন, বিজ্ঞান গবেষণা ঠিক ততটা সহজ নয়। বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও স্বাভাবিক, শুধু তাই নয় ব্যর্থতার ভূমিকাও ভবিষ্যতের সাফল্যের পিছনে কম নয়। Failures are the pillars of success, এই প্রাচীন প্রবাদটা বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণার ক্ষেত্রে যতটা প্রযোজ্য, অন্য কোনো ক্ষেত্রে তত নয়। মনে রাখতে হবে যে কোনো কিছু প্রথমবারের জন্য করতে গেলে পা রাখতে হবে এমন এলাকায় যেখানে আগে কারোর পদচিহ্ন পড়েনি। ভুল পথে যাওয়াটা সেখানে স্বাভাবিক, তার মধ্যে দিয়েই এগোতে হবে। তা না হলে বুঝতে হবে যে নতুন কিছু নয়, পুরোনো পথেই চলেছে বিজ্ঞান। কিন্তু বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালের সঙ্গে যদি চন্দ্রযানের অবতরণকে একই আসনে বসানো হয়, তাতে বিজ্ঞানীদের উপরে চাপ আসতে বাধ্য। বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের শরীরি ভাষা সেই ইঙ্গিতই দিয়েছিল। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থারঅতীত ইতিহাস দেখায় যে ভবিষ্যতে সাফল্য আসবেই,  প্রয়োজন সরকার ও দেশবাসীর সমর্থন।  একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক লাভের জন্য  বিজ্ঞান গবেষণাকে ব্যবহার শেষ পর্যন্ত সুফল নাও দিতে পারে।
নাসার ক্যামেরাতে তোলা বিক্রমের অবতরণস্থলের চিত্র 



No comments:

Post a Comment