Monday 3 January 2022

চেনা অচেনা সুভাষ কুণ্ডু

চেনা অচেনা সুভাষ কুণ্ডু

 

আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, সেই উনিশশো আশির দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান অনার্সের তালিকার উপর দিকে কলকাতার কলেজগুলোর একচেটিয়া প্রাধান্য থাকত। তখন মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, দুই চব্বিশ পরগণা, কলকাতা, হাওড়া এবং হুগলির কিছু অংশের কলেজগুলি ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। এখন অনেকগুলি জেলার কলেজই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও কলকাতার কলেজদের সেই প্রাধান্য আর নেই। এর কৃতিত্ব নিশ্চয় সেই সব কলেজের শিক্ষকদের যাঁরা বিশ্বাস করতেন, এবং তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে  এই বিশ্বাসটা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন যে ভালো পড়াশোনা সমস্ত জায়গাতেই সম্ভব, তার জন্য কলকাতাতে দৌড়ানোর দরকার নেই। আর একজনের নাম জানতাম ছিলেন যিনি ঘটনাচক্রে কলেজে পড়াতেন না, কিন্তু এক বিরাট অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের একই রকম বা আরো বেশি উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তিনি সুভাষ কুন্ডু।

সুভাষবাবুর নাম অনেকদিন আগে থেকে জানি বটে, কিন্তু নামটা তেমন কেউ বলত না। সুভাষবাবু প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি করেছিলেন, তখন সেই কলেজ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। ঘটনাচক্রে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে আমি পড়াই। বসিরহাট বা তার কাছাকাছি কলেজগুলো কয়েক বছর আগে পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই ছিল, ফলে সেখান থেকে অনেক ছাত্র আমাদের বিভাগে পড়তে আসত। তাদের কেউ যখন স্যারের কথা বলত, বুঝে নিতে হত সুভাষ কুন্ডুর কথা বলছে। তাই একদা ছাত্র পরে সহকর্মী অরিত্র ব্যানার্জি যখন সুভাষ বাবুর ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্সের এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালো, সম্মতি দিতে বিশেষ ভাবতে হয়নি। সেই প্রথম তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছিল, তখন জানি না যে সেই হবে শেষ দেখা।

আগে থেকেই তাঁর সম্পর্কে আরো অনেক কথা শুনেছি। বসিরহাট কলেজে শিক্ষকতা, নকশাল আমলে তাঁর বন্দিত্বের কথা, পুলিশের নৃশংস অত্যাচারে শরীর ভেঙে পড়ার কথা। জেল থেকে বেরিয়ে বসিরহাট স্কুলে চাকরি, স্কুলের বাইরে বিনা মাইনেতে ছাত্রদের শেখানো, তাঁর অসাধারণ পড়ানোর কথা, তারপর ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্স তৈরি করার কথা। সুভাষ কুন্ডু আর ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্স মনে হত প্রায় সমার্থক। কখনো কখনো ভেবেছি, আজকের দিনে এ আবার হয় নাকি? একজন মানুষ দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, নিজের পয়সা খরচ করে ছাত্রদের পড়িয়ে যাচ্ছেন?

আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। ছাত্ররা গুরুগৃহে প্রতিপালিত হত। সেই খরচ জোগাত রাজা বা স্থানীয় জমিদার। কয়েকশো বছর আগের কথা বলি কেন? আমার একাধিক শিক্ষকের কাছে শুনেছি যে তাঁরা স্কুলের কোনো শিক্ষকের বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করেছেন, এবং সমস্ত খরচ সেই শিক্ষকই বহন করেছেন। তাহলে কেন আজকের দিনে এ ধরনের ঘটনা অসম্ভব মনে হল? মনে হল কারণ ভেবেছিলাম যে সেই সমস্ত উদাহরণ এখন অচল, কারণ আমাদের জীবনের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সেই পরিবর্তন ভালো না খারাপ তার বিচারে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু আশপাশে যা দেখছি তার বাইরেও আরো কিছু থাকা এ যুগেও সম্ভব, যুগের হুজুকই শেষ কথা বলে না, সুভাষবাবুর মতো মানুষরা সেটাই আমাদের দেখিয়ে দিয়ে যান।

দীর্ঘদিন পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষকতা করার সুবাদে একটা কথা আমার প্রায়শই মনে হয়। আমাদের দেশে পদার্থবিজ্ঞানকে প্রায় গণিতের মতো সম্পূর্ণ থিয়োরেটিকাল বা তাত্ত্বিক বিষয় বলে দেখার একটা প্রবণতা আছে। এর জন্য অনেকটা দায়ী সম্ভবত আমাদের প্রাচীন জাতিভেদ প্রথা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র দেখিয়েছিলেন যে যে দিন থেকে সমাজের তথাকথিত উঁচু তলার লোকরা হাতে কলমে কাজ করাকে তাচ্ছিল্য করতে লাগল, সেই দিন থেকেই আমাদের দেশে বিজ্ঞানের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে পশ্চিমবঙ্গে এই ঝোঁকটা আরো বেশি। হয়তো তার কারণ আমরা ছাত্রছাত্রীদের শেখাই যে আমাদের বাংলাতেই জন্মেছিলেন মেঘনাদ সাহা বা সত্যেন্দ্রনাথ বসু, বা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে অমলকুমার রায়চৌধুরির মতো বিজ্ঞানীরা যাঁরা তত্ত্বীয় বিজ্ঞানের বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। কিন্তু এই কলকাতাতেই সি ভি রমন, মেঘনাদ বা সত্যেন্দ্রনাথ যে ল্যাবরেটরি তৈরির জন্য প্রাণপাত করেছেন সে ইতিহাস আমরা ছাত্রদের কাছে নিয়ে যাই না। যে কারণেই হোক, হাতে কলমে বিজ্ঞান শেখার প্রতি আমাদের অনীহা প্রবল। অথচ পদার্থবিজ্ঞান তো বটেই, আধুনিক বিজ্ঞান বলতে আমরা যে বিষয়টাকে বুঝি সেটা কিন্তু পরীক্ষামূলক বিদ্যা। পরীক্ষানিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে তা গড়ে উঠেছে। তত্ত্বের গুরুত্ব তাতে কম নয়, কিন্তু শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা বিবর্জিত যুক্তির উপর নির্ভর করে বিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করার অ্যারিস্টটলিয় আদর্শকে আমারা অনেকদিন ত্যাগ করেছি।

সুভাষবাবুও নিশ্চয় পড়াতে গিয়ে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের এই মনোভাব অনুভব করেছিলেন। তাই ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্স একটা ফ্রি কোচিং সেন্টার হয় নি, হয়েছিল সত্যিকারের বিজ্ঞান শেখার জায়গা যেখানে ছেলেমেয়েদের থিওরির পাশাপাশি প্র্যাকটিকাল হাতে ধরে শেখাতেন সুভাষবাবু। ফিজিক্সের ল্যাবরেটরি তৈরির খরচ অনেকটাই বেশি, এমনকি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজগুলোতেও অনেক সময় প্রয়োজনীয় সমস্ত যন্ত্রপাতি কেনা সম্ভব হয় না। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টাতে এবং নিজের খরচে ইন্সটিটিউটের বাড়ি তৈরি করে সেখানে যে অত্যন্ত উন্নত মানের ল্যাবরেটরি তৈরি করেছিলেন সুভাষবাবু, কলকাতার অনেক কলেজেও সেই ধরনের ল্যাবরেটরি নেই।

সেদিন ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্স-এর অনুষ্ঠানে আলাপ হল। প্রতিষ্ঠান ঘিরে ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। একটা বড় হলঘর পুরোপুরি পরিপূর্ণ। তারা মূলত স্কুল পড়ুয়া, মোটেই সুভাষ বাবুর ছাত্র নয়। এত ছাত্রছাত্রী এসেছে একটি প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে, যার কেন্দ্রে রয়েছেন একজন মানুষ। ছোটখাটো চেহারার মানুষটির সঙ্গে বিশেষ কথা বলার সুযোগ হল না। তিনিও ব্যাস্ত, সবাই ব্যাস্ত। কয়েকদিন আগে বন্ধু অরিত্র আমার লেখা মেঘনাদ সাহার একটা ছোট্ট জীবনী ওনাকে দিয়েছিল, ওনার পছন্দ হয়েছিল সেই কথা ব্যাস্ততার মধ্যেও জানালেন। শুনেছিলাম অসুস্থ, আদৌ আসতে পারবেন কিনা সন্দেহ ছিল। তবু এসেছিলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্সের অনুষ্ঠানে। তাই জীবনে অন্তত একবার সেই মানুষটিকে দেখার সুযোগ পেলাম যিনি জীবৎকালেই কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন।

সুভাষ বাবুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর অনেক ছাত্রই আমার বন্ধু বা বিশেষ পরিচিত। তাঁদের মধ্যে যাঁরা আমাকে অন্তত একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। একজন শিক্ষকের সাফল্যের বিচার দুই মাপকাঠিতেই হয়, প্রথমত কত সংখ্যায় সফল ছাত্রছাত্রী তিনি তৈরি করতে পেরেছেন, এবং দ্বিতীয়ত কতজনকে তিনি নিজের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছেন। দুটি ক্ষেত্রেই সুভাষবাবুর সাফল্য বিস্ময়কর। প্রায় সর্বত্রই কোনো নতুন উদ্যোগের পিছনে থাকেন এক বা খুব অল্প কয়েকজন ব্যক্তি। আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য হল সেই এক বা একাধিক ব্যক্তি না থাকলে উদ্যোগটি সাধারণত মুখ থুবড়ে পড়ে। স্যারের ছাত্রছাত্রীরা অনেকদিন আগে থেকেই স্যারের পাশে ছিলেন। আমার বিশ্বাস ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্স-কে তাঁরা এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

        গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

 

(শ্রদ্ধেয় সুভাষচন্দ্র কুণ্ডুর স্মৃতিতে প্রকাশিত 'স্মৃতির কণায় ঊর্মিমালায়' বইতে সংকলিত। বইটির সম্পাদনা করেছেন চন্দ্রা মিত্র, শুভঙ্কর ঘোষ, নীরজ নাথ, অরিত্র ব্যানার্জী, রথীন রায়, জয়দীপ মিত্র ও ব্যাসদেব গায়েন।)   

No comments:

Post a Comment