Sunday 1 May 2022

লিমেরিকা

 

লিমেরিকা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

তোমরা কেউ লিমেরিকা বলে কোনো দেশের নাম শুনেছ? না না, ছাপার ভুল নয়, আমেরিকা নয়, এমনকি আয়ারল্যান্ডের লিমেরিক বলে যে জায়গা আছে সেটাও নয়। লিমেরিকার লোকজন কাছাকাছি থাকলে খবরদার এমন ভুল করো না, তারা শুনলে ভারি রাগ করে। তবে এ কথা সত্যি যে লিমেরিকাতে মানুষ বিশেষ থাকে না, আর যারা থাকে তারাও দেশ ছেড়ে খুব একটা বেরোয় না। তাই হয়তো তোমরা নাম শোনোনি।

তা সেই লিমেরিকাতে গিয়েছিল এক রাজপুত্র। কোন দেশের? অচিন দেশের। কী বললে, সে রকম কোনো দেশ নেই? কী যে বলো, চিন দেশ থাকতে পারে আর অচিন দেশ থাকতে পারে না?

কী বললে, অচিন দেশে কি শুধু রাজপুত্র আছে, রাজা নেই? কেন থাকবে না? রাজা রানি না থাকলে কি রাজপুত্র হয় নাকি? রাজা ছিল, রানি ছিল, হাতিশালে হাতি ছিল, ঘোড়াশালে ঘোড়া ছিল, গোলাভরা ধান ছিল। প্রজারা সুখে শান্তিতে ছিল।

তা সেই অচিন দেশের রাজপুত্র কেন লিমেরিকা গিয়েছিল? সেই কথাই তো তোমাদের বলছি। বারবার এরকম বাধা দিলে গল্প এগোবে না। গল্প বলছি বটে, তবে এ কিন্তু বানানো নয়, সত্যি গল্প।

একবার অচিন দেশের রানির হল ভারি অসুখ, দিনদিন শুকিয়ে যেতে লাগলেন। দেশবিদেশের বদ্যি হাকিম চিকিৎসকেরা হার মেনে গেল। রানির চেহারা হয়ে গেল কঙ্কালসার। রাজার ভারি দুঃখ। রাজপুত্র রূপকুমার মায়ের ঘর থেকে নড়তেই চায় না। শেষে রাজা ঢ্যাঁড়া দিলেন যে রানিকে সুস্থ করে দিতে পারবে, তাকে এক লক্ষ সোনার মোহর দেবেন। মোহরের লোভে কত লোক এলো, কিন্তু রানির অসুখ আর সারে না।‘

একদিন রাজা সভাতে বসে আছেন। রাজা পাত্র মিত্র অমাত্য সকলেরই মন খারাপ, কেউ কথা বলছেন না। এমন সময় সভাতে এলেন এক ফকির। বললেন, ‘মহারাজের জয় হোক।‘

রাজা মুখ তুলে তাকালেন, ‘বলুন ফকিরবাবা, কী চান আপনি।‘

শুনেছি রানিসাহেবার ভারি অসুখ। লিমেরিকার ঠিক মাঝখানে এক কুয়ো আছে। সেই কুয়োর জল খাওয়ালে মৃতপ্রায় রুগিও সেরে ওঠে। আপনি সেই জল আনানোর বন্দোবস্ত করুন।‘

রাজার মুখে একটু আশার আলো ফুটেও নিভে গেল। ‘কিন্তু লিমেরিকাতে মানুষ যাবে কেমন করে। সে তো চারদিকে মেঘ সমান উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা। তাছাড়া সে দেশে শুনেছি মানুষ থাকে না। ঘন বন, ভীষণ হিংস্র সব জন্তুজানোয়ারের দেশ।‘

আমি নিজে রাস্তা জানি না, তবে যাওয়ার পথ আছে । আমার গুরুদেব সেখানে গিয়েছিলেন, তিনি আমাকে এই খবরটা দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন আপনার সভায়। যে কোনো ভালো কাজে বিপদ তো আসবেই। সাহস করে না গেলে রানিসাহেবার প্রাণ বাঁচানো যাবে কেমন করে?’

কিন্তু আপনিও যদি পথ না জানেন, তাহলে কী করে সেই জল আনতে কেউ যাবে?’

ফকির একটু হেসে বললেন, ‘সে ব্যবস্থা আমার সঙ্গেই আছ। আমার হাতে এই লাঠি দেখছেন, এ হল মন্ত্রপূত জাদুকাঠি।‘

মন্ত্রীমশাই বললেন, ‘তাহলে আর চিন্তা কী? জাদুদণ্ডকে হুকুম করলেই তো সে জল নিয়ে চলে আসবে।‘

রাজা একমত হলেন না। ‘না মন্ত্রী, বিষয়টা এত সোজা নয়। তাহলে ফকিরবাবা তো একেবারেই কুয়োর জল নিয়েই আসতে পারতেন।‘

ঠিকই ধরেছেন মহারাজ। জাদুকাঠিকে আদেশ করলাম আর সে করে দিল এমন হয় না। এ আরব দেশের  জিন নয় যে গোটা একটা প্রাসাদকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তাছাড়া জিনের সাহায্যও এখন পাওয়া যাবে না, সে আলাদিনের সঙ্গে পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়েছে। জাদুবলে এই দণ্ডের লিমেরিকা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান আছে, তাই নিয়ে পরামর্শ দিতে পারে, কিন্তু তার বেশি নয়। যে যাবে, নিজের সাহসের আর ক্ষমতার উপর ভরসা রেখে নিজেকেই কাজটা করতে হবে। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা,’ ফকির একটু ইতস্তত করতে লাগলেন।

বলুন, আর কী বলবেন।’

একমাত্র ছড়ার মতো করে কথা বলতে শুরু করলে তবেই জাদুকাঠি উত্তর দিতে রাজি হয়। তাও যেরকম সেরকম ছড়া নয়। আমার গুরুদেব মুখে মুখে এমন ছড়া বানাতে পারতেন। যেমন আমাকে জাদুদণ্ডটা দেওয়ার সময় বলেছিলেন,

জাদুদণ্ডের আছে লিমেরিকা জ্ঞান,

ফিরিয়ে দিতে পারে রানিমার প্রাণ,

শুধু রেখো মনে

ছন্দের বিহনে

প্রশ্ন বিফলে যাবে, না পাবে সন্ধান।

ছড়া এমনই হতে হবে। পাঁচ লাইনের কবিতা, প্রথম দু লাইন আর শেষ লাইনে মিল থাকতে হবে। আবার তিন নম্বর আর চার নম্বর লাইনে মিল থাকবে। তা না হলে, উত্তরই দেয় না।‘

সে আর এমন কি! সভাকবি তো আছেই। কবি, জাদুদণ্ডকে জিজ্ঞাসা করো লিমেরিকার কুয়োর জলে রানির অসুখ সারবে কিনা।‘ রাজা নিশ্চিন্তভাবে বললেন।

সভাকবি সম্ভবত ঝিমোচ্ছিলেন, পাশ থেকে বিদূষকের খোঁচা খেয়ে ধড়মড় করে উঠে বললেন, ‘হ্যাঁ মহারাজ। আপনি যখন বলছেন, নিশ্চয় তাই।‘

মন্ত্রী, ওনাকে একটু বুঝিয়ে বলুন।‘

বোঝানো হল। কবি জাদুকাঠিটা হাতে নিয়ে একটু ভাবলেন, তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন,

রানির মোদের ভারি অসুখ প্রাণ বাঁচানো ভার

এই বিপদে জানি না তো কেমনে পাই পার।

লিমেরিকার মাঝে

গভীর কুয়া আছে,

তার জলে কি যাবে অসুখ, সারবেন রানি আবার?

সবাই অধীর আগ্রহে জাদুকাঠির দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু নিস্তব্ধতা, তার পরেই জাদুকাঠির গলা শোনা গেল, ‘শেষ লাইনে ছন্দ মেলেনি। তাছাড়া ‘আছে’ আর ‘মাঝে’ মেলে কিনা তাই নিয়ে সন্দেহ আছে।‘

কবি বিড়বিড় করে বললেন, ‘সকলেই বিরাট কাব্য সমালোচক হয়ে গেছে। লাঠিই বা বাদ যায় কেন?‘ তারপর জোরে বললেন, ‘আমার কথার উত্তর দাও জাদুকাঠি।‘

হ্যাঁ, সেই জল খাওয়ালে প্রায় সব রোগ সেরে যায়।‘

সভাসদরা সবাই সমস্বরে বললেন, ‘জয়, ফকিরবাবার জয়।‘

জয়ধ্বনি থামলে রাজা বললেন, ‘ফকিরবাবা, রানির অসুখ সারলে আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব, লক্ষ স্বর্ণমুদ্রাও আপনি পাবেন।

ফকির হেসে বললেন, ‘আমার জয়ধ্বনিরও দরকার নেই, স্বর্ণমুদ্রারও দরকার নেই। সোনাদানা সঙ্গে থাকার বড় জ্বালা, রাস্তায় ডাকাত পড়ে, রাত্রে ঘুম আসে না। এই জাদুলাঠি আপনাকে দিলাম। এবার আমায় আমার গুরুর কাছে ফিরে যেতে আজ্ঞা দিন।‘

ফকির যাওয়ার পরে সেনানী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ’মহারাজ, লিমেরিকা অভিযানের বন্দোবস্ত করি তাহলে।‘

রাজা বলল, ‘সে দেশে তো কেউ যায় কখনো যায় নি। আগে জাদুকাঠিকে জিজ্ঞাসা করুন পথ জানে কিনা, কতদিন লাগবে।‘

কবি তাড়াতাড়ি জাদুদণ্ড সেনানীর হাতে দিয়ে দিলেন। সেনানী হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর বললেন,

জাদুদণ্ড করো অবধান,

বাঁচাও মহারানির প্রাণ।

সাজিয়ে আনি সমর রথ

চেনাও লিমেরিকার পথ

তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে ভেবে শেষে পাদপূরণ করলেন,

অচিন দেশ করবে অভিযান।

জাদুদণ্ড কোনো উত্তর দিল না। সেনাপতি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘মহারাজ, এ কাজ কবির, আমার নয়। শত্রুকে দেখিয়ে দিন, আমি যুদ্ধ করতে ভয় পাই না। কিন্তু কাব্যচর্চা আমার সাধ্যাতীত।‘

রাজা বিবেচনা করলেন। ‘ঠিক। কবিরাজ, এ আপনারই দায়িত্ব।‘

কবি নিতান্ত অনিচ্ছুকভাবেই জাদুদণ্ড হাতে নিলেন। ‘আমি কি ছড়া লিখি নাকি? নেহাত মহারাজের হুকুম আর মহারানির প্রাণসংকট।‘

জাদুকাঠি জানো কি সেই কুয়োয় যাওয়ার পথ?

ঘোড়ায় চড়ে যাব, নাকি লাগবে সেথায় রথ?

সৈন্য যাবে কত?

একশো না পাঁচশত?

আসতে যেতে কদিন লাগে বলোগো চটপট।

জাদুদণ্ড এবার কথা বলল বটে, কিন্তু বিদ্রূপের স্বর স্পষ্ট। ‘তু্মি সভাকবি? রথের সঙ্গে চটপট মেলাচ্ছ, তুমি কবিতার কিছু জানো? আমার কপালেই এমন জোটে। আমার এক মাসতুতো দাদা আছে যাকে চতুষ্পদীতে প্রশ্ন করতে হয়। ছন্দ বা মিলের সামান্য ভুল থাকলে সে কথাই বলে না।‘

কবির মুখ লাল হয়ে গেল। ‘এ কি কাব্য নাকি, এ তো ছড়া। আমার কপালেও তেমন জোটে। যদি মন্দাক্রান্তা ছন্দের প্রশ্নে উত্তর দিতে, তাহলে দেখতে কাব্য কাকে বলে। এখন আমার কথার উত্তর দাও।‘

পথ আমি জানি। কিন্তু সেখানে একশো কি পাঁচশো লোকলস্কর নিয়ে কাজ হবে না। লিমেরিকার বিপদ আপদ এমনই যে এক দল লোক গেলে রক্ষা নেই। হয়তো সফল হবে, কিন্তু অনেক প্রাণহানি হবে, সময়ও লাগবে প্রচুর। একজন পায়ে হেঁটে চুপিসারে জল নিয়ে ফিরে আসতে পারে। তা ছাড়া এ কাজ এমন লোককে করতে হবে যে সমস্ত বিপদ অগ্রাহ্য করে মনের টান থেকে জল আনতে যাবে। জোর করে পাঠালে বা টাকার লোভে গেলে লিমেরিকার কুয়োই খুঁজে পাওয়া যাবে না।‘

রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সভাসদরা, আপনাদের মধ্যে এমন কে আছেন যে আমার আদেশে নয়, নিজের ইচ্ছায় মহারানির জন্য লিমেরিকা যাবেন? সত্য কথা বলবেন।‘

সকলেই মাথা নিচু করে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে রাজা উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘ঠিক আছে, তাহলে আমিই যাব।‘

রাজপুত্র সভাতেই ছিল, কিন্তু এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। এবার বলল ‘আমি যাব, আমাকে অনুমতি দিন।‘

রাজা সহজে অনুমতি দিতে চায়নি, কিন্তু ছেলের জেদের কাছে হার মানতেই হল। মাকে বাঁচানোর জন্য সে কোনো বিপদকেই ভয় করে না।

দেরি না করে সেদিনই বেরিয়ে পড়ল রূপকুমার। সঙ্গে তার প্রিয় ঘোড়া হয়রাজ। কোমরে তরোয়াল, কাঁধে তিরধনুক, বুকে সাহস। একটা থলিতে কিছু শুকনো খাবার, ভিস্তিতে জল। আর আছে চকমকি পাথর, দড়িদড়া, আরো নানা রকম জিনিস যা অজানা জায়গায় কাজে লাগতে পারে। আর অবশ্যই হাতে আছে জাদুকাঠি।

লিমেরিকের সীমানা বেশি দূরে নয়, সেই পর্যন্ত যেতে অসুবিধা হল না। পরের দিন দুপুরেই পৌঁছে গেল পাহাড়ের কাছে। কিন্তু তারপর? পাহাড় পেরোবে কেমন করে? রাস্তা তো আর জানা নেই।   

রাজপুত্র ঘোড়া থেকে নামল। অনেক সময় পেয়েছে ভাবার, তাই চট করে বলল,

জাদুকাঠি কৃপা করে দেখাও আমায় পথ,

লিমেরিকার রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে পর্বত।

মাতা আমার হীনবল

আনতে হবে কুয়ার জল

তবেই মা উঠবে সেরে পুরবে মনোরথ।

জাদুদণ্ড রূপকুমারের হাতে একটু নড়েচড়ে উঠল। বলল, ‘রাজকুমার, তোমার সাহস আছে। আর কবিতাও তুমি তোমাদের সভাকবির থেকে খারাপ লেখো না। শব্দচয়ন একটু পুরানো ধরনের, তবে চলবে। তার থেকেও বড় কথা বড়দের সম্মান দিতে জানো। তোমাকে আমি সাহায্য করব। ঘোড়াটাকে ছেড়ে দাও, আমরা যে রাস্তায় যাব ঘোড়া ছুটিয়ে যাওয়ার নয়। লিমেরিকাতে ঢুকতে হবে গোপনে, ভিতরে অনেক বিপদ।‘

রাজার ছেলে হয়ে চোরের মতো ঢুকব?’ রাজপুত্রের প্রশ্ন।

কুমার, তোমার বয়স কম। সব যুদ্ধই সামনাসামনি হয় না। আমি তোমাকে কোনো অন্যায় কাজ করতে বলব না কোনোদিন, কিন্তু তা বলে ঢাকঢোল বাজিয়ে তোমার আসার খবর ঘোষণা করাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ওই যে বড় পাথরটা উত্তরদিকে দেখতে পাচ্ছে, ওর পিছনে আছে এক গুহা। ওই গুহা হল লিমেরিকাতে ঢোকার এক পথ। খুব সরু, কোনোরকমে একজন লোক ওই পথে যেতে পারবে।‘

রাজপুত্র ঘোড়ার পিঠ থেকে থলি নামিয়ে নিজের কোমরে বেঁধে নিলো। হয়রাজকে বলল, ‘আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরব, কাছাকাছি থেকো।’ জন্ম থেকে হয়রাজকে দেখাশোনা করেছে রাজপুত্র, তার সব কথাই ঘোড়া বুঝতে পারে। চিঁহি আওয়াজ করে বুঝিয়ে দিল যে সে রাজপুত্রের জন্য অপেক্ষা করবে।

কয়েকটা শুকনো ডাল জোগাড় করে আনল রাজপুত্র, মশালের কাজে লাগবে। গুহার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মুখটা মাকড়সার জালে ভর্তি, একটা শুকনো ডাল দিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিল, তারপরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ভিতরে ঢুকল। বাইরে চড়া রোদ, কিন্তু কয়েক পা এগোতেই গুহার ভিতরটা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। খাড়াই ভাবে নিচের দিকে নেমে গেছে গুহা। কোমর থেকে চকমকি পাথর বার করে একটা শুকনো ডাল জ্বালল।

একটু এগোতেই গুহার পথটা আর নিচে নামছে না, সোজা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে ডালটা নিভে গেল। আরেকটা মশাল জ্বালাতে গিয়ে থমকে গেল রাজপুত্র। চোখটা সয়ে গেলে বুঝতে পারল সেই রকম গাঢ় অন্ধকার আর নেই, একটা হালকা নীল আলো চারদিকের দেয়াল থেকে আসছে। গুহার স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালে হয়েছে ছত্রাক, তা থেকে ওই আলো বেরোচ্ছে। সেই আলোতেই চলতে শুরু করল রাজার কুমার।

কতক্ষণ হাঁটছে বোঝার কোনো উপায় নেই। খিদে পেয়েছে, মানে কয়েক ঘণ্টা তো হবেই। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থলিতে যেটুকু খাবার অবশিষ্ট ছিল তার সদ্ব্যবহার করল রাজপুত্র, কোমরের ভিস্তিটাও উপুড় করে জলটাও শেষ করল। কয়েক জায়গায় ছাদ এমন নেমে এসেছে যে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে পেরোতে হল। অনেকক্ষণ পরে খেয়াল হল যে একটা আওয়াজ আসছে। প্রথমে ছিল খুব আস্তে, কিন্তু ক্রমশ জোর হচ্ছে। ভালো করে শুনে রাজপুত্র বুঝল এ হল জলের আওয়াজ। সামনে কোথাও একটা পাতাল ঝর্না আছে।

আওয়াজটা ক্রমশই বাড়ছে। একটা মোড় ফিরতেই হঠাৎ জলের ছিটে লাগল, চোখেমুখে। আর একটা অদ্ভুত গন্ধ। দাঁড়িয়ে গেল রাজপুত্র। চকমকি বার করে একটা মশাল জ্বালল। তার আলোতে দেখল সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে এক জলের স্রোত। রাস্তা জলের কাছে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। নদীর কাছে গিয়ে গন্ধটা খুব জোর হল। রাজপুত্র একবার এক উষ্ণ প্রস্রবণে চান করেছিল, তার জলে এমনই একটা গন্ধ ছিল। রাজবৈদ্য বলেছিলেন জলে গন্ধক আছ। সে যা হোক, এখন উপায়? ঝর্না অনেকটাই চওড়া, কত গভীর বোঝার উপায় নেই। ভীষণ স্রোত, নামলেই টেনে নিয়ে পাথরে আছাড় মারবে।

পেরিয়ে এলাম গুহার অন্ধকার,

জাদুকাঠি, ডাকি তোমায় আবার,

সামনে দারুণ স্রোত

খুঁজে না পাই পথ

ভয়াল ঝোরা কেমনে হই পার?

রাজপুত্রের কথায় বোধহয় ঘুম ভাঙল জাদুদণ্ডের। বলল, ‘এবারেও একটু ছন্দপতন ঘটেছে। তবে উন্নতি হচ্ছে। যা হোক, একটু পিছিয়ে যাও রাজপুত্র, এই আওয়াজে তোমার সঙ্গে কথা বলা যাবে না।‘

রাজকুমার ঝর্ণার থেকে দূরে সরে গেল। জাদুকাঠি বলল, ‘এই ঝর্ণাটা সাধারণত হেঁটেই পেরিয়ে যাওয়া যায়। পাহাড়ের উপরে কোথাও খুব বৃষ্টি হয়েছে, তাই এইরকম স্রোত। এখনো পথ আছে, কিন্তু সামনে খুব বিপদ। এই পাতাল গুহার প্রহরীর পাশ দিয়ে যেতে হবে। সে এক ভয়ঙ্কর জীব, যুদ্ধ করে তাকে হারানো একজন কেন দশজন মানুষেরও অসাধ্য। সে টের পেলে আর রক্ষা নেই। মন শক্ত করতে হবে।

প্রহরীর গন্ধ আর আওয়াজ ধরার ক্ষমতা খুব জোরালো। প্রথমে জলে জামাকাপড় গা হাত পা ভিজিয়ে নাও। তাহলে তোমার গায়ের গন্ধ ঢাকা পড়ে যাবে। নিঃশব্দে যেতে হবে। ঝর্নাটা পাথর কেটে চলে গেছে, নিচেটা বেশি কেটেছে, উপরদিকে একটা সরু পাথরের তাকের মতো ডানদিকে চলে গেছে, জলের জন্য দেখা যাচ্ছে না। ওই আমাদের রাস্তা। একটা সরোবর পাবে, তার ওপার দিয়ে যেতে হবে। সাবধান সরোবরের কাছে যেও না। ওপারে দেখবে একটাই গুহার মুখ, সেই আমাদের পথ।‘

আলো ছাড়া ওই সরু তাকের উপর দিয়ে যাব কেমন করে?’

আলো ছাড়া কেন? তোমার হাতে তো মশাল আছে।’

প্রহরী দেখে ফেলবে তো।‘

আমি কি প্রহরীর দৃষ্টিশক্তির কথা বললাম? এত বছর অন্ধকারে আছে, চোখ খুলতেই ভুলে গেছে। এই সামান্য মশালের আলো টেরই পাবে না।‘

রাজপুত্র ধনুক নামিয়ে রাখল, ছিলা ভিজে গেলে শুকোনোর আগে ব্যবহার করা যাবে না। শুকনো ডালগুলোও সরিয়ে রাখল। হাঁটু গেড়ে বসে জল নিয়ে গা মাথা জামাকাপড় ভালো করে ভেজালো। গন্ধটা বেশ জোরালো। আবার সব তুলে নিয়ে পা বাড়াল।

ঝর্নার কাছে গিয়ে ডানদিকে পা বাড়িয়ে দিলো প্রথম, সত্যিই একটা সরু তাক বেরিয়ে আছে, কোনোরকমে একটা মানুষ দাঁড়াতে পারে। দেয়ালের দিকে মুখ করে তার উপর দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে আসে আস্তে চলল। অল্প সময় পরেই একটা বিশাল গুহার মধ্যে ঢুকে পড়ল রূপকুমার। মশালের আলোতে দূরের দেওয়াল দেখা যাচ্ছে না। জাদুকাঠি যেমন বলেছিল, মাঝখানে একটা বিরাট সরোবর, ঝর্নাটা সেখানে গিয়ে পড়ছে।

দেয়ালের কাছ দিয়ে চলল রাজপুত্র। মশালটা বাঁ হাতে, নিঃশব্দে খাপ থেকে তরোয়ালটা বার করে ডান হাতে ধরেছে। দূরে আর একটা গুহার মুখ দেখা যাচ্ছে, সেখানেই যেতে হবে। সেটাও অন্ধকার, কিন্তু সরোবরের উপরটা যেন আরো চাপ চাপ অন্ধকার, তাকাতেই ভয় করে। কলকল জলের শব্দ ছাড়া কোনো আওয়াজ নেই।

বেশ তো এতক্ষণ চুপ করে ছিলে, আবার কী হল? ঝর্নাটা সরোবরে এসে পড়ছে কিন্তু জল বেরিয়ে যাচ্ছে না কেন? সরোবরের তলা দিয়ে জল বেরোনোর কোনো পথ আছে। কী বললে? সেই পথে কি পাতালের কোনো ভয়ঙ্কর এসে বাসা বেঁধেছে জলের অতলে? চুপ করো, এই সময় বেশি কথা বললে রাজপুত্রের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটবে। ওই দেখো, বিরক্ত করতে বারণ করেছিলাম শুনলে না তো। ব্যাস, রাজপুত্র হোঁচট খেয়েছে। এখন দেখো কী হয়!

সরোবরের দিকে চোখ রাখতে গিয়ে সামনে খেয়াল ছিল না, একটা পাথরে হোঁচট খেয়েছে রাজপুত্র। তরোয়ালের খাপটা পাথরে লেগে ঠং করে আওয়াজ করল, সেই আওয়াজ গুহার মধ্যে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে সরোবরের জলে আলোড়ন উঠল, ঠিক মাঝখান থেকে ঢেউ ছুটে গেল তীরের দিকে।

আর চুপিচুপি যাওয়ার কোনো মানে হয় না, রাজপুত্র দৌড় লাগাল। গুহার মুখে প্রায় পোঁছে গেছে, কিন্তু একটা বিরাট মোটা শুঁড় বিদ্যুতের মতো এসে রাজপুত্রের কোমরে জড়িয়ে গেল। এক টানে ফেলে দিলো মাটিতে, টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল জলের দিকে। গুহার মেঝে থেকে বেরিয়ে আছে একটা পাথর,    রাজপুত্রের হাতে ঠেকল। বাঁহাতের মশালটা ছেড়ে দিয়ে জোর করে আঁকড়ে ধরল, তারপর ডানহাতের তরোয়াল দিয়ে কোপ বসাতে লাগল শুঁড়টাতে। কিন্তু এতই শক্ত যে তরোয়াল তরোয়ালটাতাতে দাগও ফেলতে পারছে না। সরোবরের দিকে চোখ পড়তে রাজপুত্র দেখল অন্ধকারের বিশাল একটা স্তূপ উঠে আসছে জল থেকে, আরো কয়েকটা শুঁড় তার দিকে এগোচ্ছে। আর কয়েক মুহূর্ত সময়, তার পরে আর রক্ষা নেই।

তলোয়ারটা কাজ লাগছে না, সেটা ছেড়ে দিয়ে মশালটা ডানহাত বাড়িয়ে তুলে নিলো রূপকুমার। সেটা তখনো জ্বলছে, আগুনটা শুঁড়ের উপর চেপে ধরল। একটা বিকট কানফাটানো চিৎকার ভেসে এলো অন্ধকারের স্তূপের দিক থেকে, কোমরের বাঁধনটা খুলে গেলো। তলোয়ারটা তুলে নিয়ে রাজপুত্র গুহার ভিতরে ঢুকে দৌড় লাগাল। গুহার মুখের কাছে একটা দড়াম করে শব্দ হল, দেয়াল আর মাটি কেঁপে উঠল। আরো কিছুটা দৌড়ে ফিরে তাকাল রাজকুমার। বিশাল দেহ প্রহরীর পক্ষে সরু গুহার পথে ঢোকার কোনো উপায় নেই। একটা শুঁড় ঢুকিয়ে দিয়েছে, কিন্তু কুমার তখন তার নাগালের বাইরে।

পথ এবার উপর দিকে উঠেছে। কোমরের কাছটা যন্ত্রণা করছে, তার মধ্যেই আস্তে আস্তে চলল রূপকুমার। আশেপাশে আরো কয়েকটা ছোটছোট গুহার মুখ, কিন্তু এই গুহাটা সোজা চলে গেছে। কিছুক্ষণ পরে দূরে একটা আলো মতো দেখা গেল। তাহলে কি পেরিয়ে এল পাতাল গুহা? রাজপুত্র চলার বেগ বাড়িয়ে দিল।

কিন্তু হঠাৎই থমকে যেতে হল, আর এগোনোর পথ নেই। আলোটা আসছে মাথার উপর থেকে। কিছুটা উপরে একটা গর্ত, মাঝখান দিয়ে একটা মোটা শিকড় চলে গেছে। তার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। সকাল হয়েছে, মানে এক বেলার বেশি লেগেছে এই গুহা পেরোতে। বাইরে বেরোতে হবে, কিন্তু কেমন করে? জাদুকাঠিকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, কিন্তু ঘুম নেই, খিদেতে তেষ্টাতে রাজপুত্র ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এই সময় কোনো কবিতা আর মনে আসছে না। তা ছাড়া জাদুকাঠি বলবেই বা কী? বেরোতে তো নিজেকেই হবে।

উপরের শিকড়টা মোটা, তাতে একটা দড়ি পরাতে পারলে উঠে পড়া যাবে। দড়ির প্রান্তে একটা পাথর বেঁধে অনেক চেষ্টা করল রূপকুমার, কিন্তু কিছুতেই শিকড়ের একপাশ দিয়ে অন্য পাশে গলাতে পারল না।

হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি জানি তোমরা বুদ্ধিমান, এখনই গর্ত থেকে বেরোনোর কায়দাটা বলে দিতে পারো। ওই দেখো, দেরিতে হলেও রাজপুত্রের মাথায়ও বুদ্ধিটা এসেছে। এবার শোনো।

রাজপুত্র পিঠের তূণীর থেকে একটা বাণ হাতে নিলো। থলি থেকে বেরোল মোটা সুতোর একটা কুণ্ডলী। তার একটা প্রান্ত বাঁধল বাণের পিছনে। তারপর ধনুকে বাণ লাগিয়ে উপর দিকে ফেরাল। একটু তেরচা করে ছুঁড়ল তীর। দক্ষ তিরন্দাজ রাজপুত্র, তার লক্ষ্য ঠিকই ছিল, শিকড়ের পাশ দিয়ে বাণটা উপরে উঠে গেল।

তির গিয়ে পড়েছে দূরে কোথাও, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। শিকড়ের অন্যদিকে আছে, সেটাই আসল কথা। আস্তে আস্তে সুতোতে টান দিয়ে বাণটাকে কাছে আনল রাজপুত্র। একসময় বাণটা শিকড়ের অন্য দিকে ঝুলে পড়ল। এবার সুতো ছাড়ার পালা। বাণটা এসে মাটিতে পড়ল।

মোটা সুতোটার উলটো দিকে দড়িটা বাঁধল রূপকুমার। সুতো ধরে টেনে টেনে দড়িটাকে শিকড়টাকে পাড় করে নামিয়ে আনল। তারপর দেয়াল থেকে বেরিয়ে থাকা একটা পাথরের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধল। এবার দড়ি বেয়ে উঠে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। উঠে গিয়ে অবশ্য দড়িটা কিছুটা কাটতে হল, সে আর কী করা যায়!

পাহাড়ের অনেকটা উপরে দাঁড়িয়ে আছে রাজকুমার। যতদূর চোখ যায় শুধু বন, কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না। আবার জাদুদণ্ডকেই জিজ্ঞাসা করতে হবে।

সামনে দেখি লিমেরিকার দেশ,

কিন্তু সেথা না পাই পথের রেশ।

বলো এবার ঠিক

যাব যে কোন দিক,

কেমন করে যাত্রা হবে শেষ?

জাদুকাঠির গলায় যেন একটু জোর এসেছে। বলল, ‘কুমার, এ হল জাদুর দেশ। যেসব রাক্ষস খোক্কসের গল্প তুমি রূপকথাতে পড়েছ, তারা সবাই এখানে থাকে। তেমনি আছে পরি, আছে পক্ষিরাজ ঘোড়া, মনপবনের নৌকো, সব কিছু। এবার খুব সন্তর্পণে যেতে হবে। অথচ তোমার হাতে সময় কম। আমাদের যেতে হবে উত্তর পশ্চিমে। কিন্তু প্রথমে আমরা সেই দিকে যাব না। বনের রাস্তার বিপদ অনেক। উত্তর পূর্ব দিকে চলো, কিছু দূর গিয়ে একটা নদী পাবে। সেই নদীতে ভেলা ভাসিয়ে যাব।‘

কিন্তু ভেলা বানাব কেমন করে, তরোয়াল দিয়ে কি আর গাছ কাটা যায়?’

সে কথা পরে ভাবা যাবে। লিমেরিকা জাদুর দেশ, এখানে অনেক কিছু হয়। অনেক ঝর্না আছে, জল তেষ্টা পেলে তার থেকে খেয়ে নিও। আর একটা কথা, তোমার খিদে পেয়েছে, পথে অনেক ফলপাকড় দেখতে পাবে। চেনা ফল দেখলে খেতে পারো। কিন্তু খবরদার জন্তুজানোয়ার মারতে যেও না। লিমেরিকাতে সব হরিণ হরিণ নয়, সব খরগোশও খরগোশ নয়। আর খুব সাবধান। চোখ আর কান খোলা রেখো। ‘   

সূর্য দেখে যাওয়ার দিক ঠিক করল রূপকুমার। ফলের গাছ অনেক, তার থেকেও আশ্চর্য হল গ্রীষ্ম শীত বসন্ত সব ঋতুর ফল পাশাপাশি গাছে হয়েছে। খিদে মিটল। কোমরের ভিস্তিটাও একটা ঝর্ণা থেকে ভরে নেওয়া গেল। ঘুম আর পাচ্ছে না। গুহার মধ্যের বদ্ধ হাওয়া আর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে মনে বেশ স্ফূর্তি এসেছে।

বনের মধ্যে কোথাও কোথাও পথ আছে, আবার অনেক জায়গায় নেই। কিন্তু ঝোপঝাড় বিশেষ নেই বলে চলতে অসুবিধা হচ্ছিল না। জন্তু জানোয়ার পাখি অনেক, সবই চেনা, কিন্তু তাদের এরকম অদ্ভুত আচরণ রাজপুত্র কখনো দেখে নি। এক জায়গায় কতগুলো খরগোশ গোল হয়ে বসে আছে, ঠিক যেন সভা করছে। মাঝখানে একটা খরগোশ সামনের দু পা নেড়ে বক্তৃতা দিচ্ছে, রূপকুমারকে দেখতে পেয়ে চুপ করে গেলো। একটা খরগোশও কিন্তু পালাল না, যতক্ষণ রূপকুমার আড়ালে না যাচ্ছে ততক্ষণ সবাই তার দিকে তাকিয়ে রইল, দৃষ্টিতে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।

হঠাৎ বাঁদিক থেকে ঝুপঝুপ আওয়াজ। সামনে দিয়ে হঠাৎ একটা চিতাবাঘ এক লাফে রাস্তা পার হল। রাজকুমার থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কিছু বোঝার আগেই এবার একটা হরিণ তার পিছন পিছন রাস্তা পেরোল, কোনোদিকে তাকালই না।

কি বললে, হরিণটা কি চিতাবাঘকে তাড়া করেছে? তা জানি না। লিমেরিকাতে সবই সম্ভব।

তোমাদের মতোই ভাবছিল নিশ্চয় রাজপুত্র, একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। হঠাৎই পা দিল একটা দড়ির ফাঁসে। দেয়া মাত্র ফাঁসটা পায়ে বসে গেল, আর এক হেঁচকা টানে রাজপুত্র একটা গাছের মগডাল থেকে নিচের দিকে মাথা করে ঝুলতে লাগল। পিঠের বাণগুলো আর ধনুকটা পড়ে গেল। জাদুকাঠিটা অবশ্য হাত থেকে ছাড়ে নি। তরোয়ালটাও কোমরে রয়ে ছিল, কিন্তু সেটা দিয়ে দড়িটা কাটলে সোজা নিচে। ঘাড় যদি নাও ভাঙে, হাড়গোড় আস্ত থাকার আশা কম। কাজেই জাদুকাঠিই ভরসা।

রূপকুমারের এই ছড়াটার নিন্দে করার আগে একটা কথা তোমরা বুঝে নাও, উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখলে পৃথিবীর কোনো ছড়াকারের মাথাতেই ভালো কিছু আসবে না, রাজপুত্রের তো বটেই।   

আছি ঝুলে হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদে,

বনমাঝে পড়িলাম কি বিপদে!

জাদুকাঠি ভাই,

উপায় কি নাই?

উদ্ধার পাই আজ কী মতে?

জাদুদণ্ড বলল, ’এটা একটা ছড়া? কী মতে মানে কী? একটু দেখে পথ চলতে পারো না? তোমার জ্বালায় একটু বিশ্রাম নেওয়ার উপায় নেই। যা হোক, ভালোই হয়েছে, আমাদের আর খুঁজতে যেতে হল না।‘ তারপর গলা তুলে বলল, ‘কে আছ, তোমাদের ফাঁদে আমরা পড়েছি। আমাদের নামাও।‘

বেশিক্ষণ থাকতে হল না, একদল বাঁদর হুপ হাপ দুপ দাপ করতে করতে এসে দড়িটা ধরে আস্তে আস্তে রাজপুত্রকে মাটিতে নামাল। বাঁদর হলে কি হবে, দস্তুর মতো জামাকাপড় পরা। তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে অভিবাদন করল। রাজপুত্র অবাক হয়ে প্রত্যভিবাদন করতে যাবে, সে সুযোগ না দিয়েই বলল ...

কী বললে, বাঁদরে কথা বলতে পারে না? এতক্ষণ ধরে লাঠির কথা বলা শুনে তো মনে হয়নি লাঠি কথা বলতে পারে না? ও জাদু লাঠি কথা বললে আপত্তি নেই! ঠিক আছে, তাহলে মনে করো এ হল জাদু বাঁদর। যা হোক, এখন জাদু বাঁদরের কথা শোনো।

জাদুর লাঠি জানাই নমস্কার,

সময় মোদের হল কি এবার?

অভিশাপের শেষে

ফিরব নিজের বেশে

এই আশাতেই বুক বাঁধি আবার।

লাঠি বলল, ‘হয়তো সময় কাছে এসেছে, কিন্তু তা আগে থেকে তো জানার উপায় নেই। এই হল রাজপুত্র রূপকুমার। এ এক অভিযানে বেরিয়েছে, মায়ের অসুখ সারানোর জন্য জাদু কুয়ার জল লাগবে।‘

জাদু কুয়ার জল?’ বাঁদরের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ‘সেই কুয়ার পাশেই তো বদমাইশটা থাকে। সে জল আনতে যারা গেছে, কেউ তো ফেরেনি।‘

এতক্ষণে রূপকুমার কথা বলল, ‘আমি যাবই, জল না হলে মাকে বাঁচানো যাবে না।‘

জাদুদণ্ড বল, ‘রূপকুমার, এ হল বাঁদরদের নেতা সুন্দর। এরা সবাই আগে ছিল মানুষ, কিন্তু এক বদমায়েশ ঐন্দ্রজালিকের জাদুতে বাঁদর হয়ে গেছে।‘

সেই ঐন্দ্রজালিকই ঐ কুয়ার কাছে বাস করে। জাদু কুয়ার জলের অনেক গুণ। আমাদের আগের রূপও ফিরিয়ে আনতে পারে এই আশাতে আমার বাবা সেখানে গিয়েছিলেন, কিন্তু আর ফিরে আসেন নি।’ সুন্দর লেজ দিয়ে পকেট থেকে রুমাল বার করে নিজের চোখ মুছল। রূপকুমার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘জাদুকাঠিকে তুমি চিনলে কেমন করে?’

আমার বাবার সঙ্গেই ছিল।‘

তার মানে জাদুকাঠি তুমিও কি আসলে মানুষ? অভিশাপে লাঠি হয়ে গেছ?’

এই প্রশ্নটা ঠিক ছড়ার মতো করে না করা হলেও লাঠি উত্তর দিল, গলা শুনে মনে হল তাকে অপমান করা হয়েছে। ‘মানুষ হতে যাব কেন, আমি লাঠিই ছিলাম। আমি সুন্দরের বাবা সত্যবানকে বলেছিলাম, জাদু কুয়ার জলে অসুখ সারে, কিন্তু অভিশাপ কাটে না। কিন্তু তুচ্ছ লাঠির কথা কে শোনে! সে যা হোক, সুন্দর তুমি কি রূপকুমারকে সাহায্য করবে? আমরা নদীপথে যাব, একটা ভেলা দরকার।’

রূপকুমার ওর মাকে সুস্থ করার জন্য যাবে, ভেলা তো দেবই। আমিও সঙ্গে যাব। বাবা যদি বেঁচে থাকে, তাহলে তাকে উদ্ধার করে আনব। অন্তত চেষ্টা করব।‘

সেদিন রাতটা নিশ্চিন্তে কাটল। পরের দিন ভোরবেলা সুন্দর আর রূপকুমার কাছের নদীতে গিয়ে ভেলাতে চড়ল। ভেলা খুব বড় নয়, কিন্তু দুজনের পক্ষে যথেষ্ট। কিছু খাবারদাবারও নেয়া গেছে। সুন্দরও নিজের এলাকা ছেড়ে কখনো বেরোয় নি। ও শুধু শুনেছে নদীটা কুয়ার কাছ দিয়েই গেছে।

রাজপুত্র জাদুলাঠিকে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করল,

জাদুর লাঠি জানাও তাড়াতাড়ি

কোন পথেতে চলবে মোদের তরী?

জাদুকুয়ার কাছে

চিহ্ন কিবা আছে,

শেষ লাইনটা রূপকুমারের মাথায় আসছিল না, সুন্দর পাদপূরণ করে দিল,

গহিন নদী আমরা দেব পাড়ি।

জাদুর লাঠি বলল, ‘দুজনে মিলে ছড়া বানালে? তাহলে কার প্রশ্নের উত্তর দেব?    ঠিক আছে আপাতত মেনে নিলাম, কিন্তু পরের বার থেকে শুধু রূপকুমারই জিজ্ঞাসা কোরো। নদীই তোমাদের নিয়ে যাবে। ডান তীরের দিকে খেয়াল রেখো, দেখবে দুটো অবিকল একই দেখতে পাথর একেবারে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে, তার ভিতর দিয়ে দূরে একটা টিলা দেখা যাচ্ছে। ওইখান দিয়েই জাদু কুয়ার পথ। কিন্তু আজ নয়, সব ঠিকঠাক চললে কাল দুপুরে তোমরা সেখানে পৌঁছবে। তবে সাবধান, পথে অনেক বিপদ।‘

নদীর স্রোতেই ভেলা ভেসে চলেছে, দাঁড় টানার দরকার পড়ছে না। রূপকুমার লিমেরিকার সম্পর্কে গল্প শুনছিল। সুন্দররা শুধু দেখতেই বাঁদরের মতো হয়ে গেছে, কিন্তু বাকি কিছু পাল্টায় নি। তারা মানুষের মতোই কথা বলতে পারে, লেখাপড়া করতে পারে, চাষ করে শিকার করে ফলমূল জোগাড় করে আর মাছ ধরে খায়। কিন্তু আশপাশের এলাকার কোনো মানুষের সঙ্গে লজ্জায় যোগাযোগ রাখতে পারেনি।

ঐন্দ্রজালিক তোমাদের অভিশাপ দিয়েছিল কেন সুন্দর?’

আমি জানি তোমরা সবাই অনেক রূপকথা পড়েছ, উত্তরটা তোমাদের জানা। কিন্তু রূপকুমার জানে না। রূপকুমারও রূপকথার গল্প পড়তে খুব ভালোবাসে, কিন্তু অচিন দেশের রূপকথার বইতে রোবটের কথা আছে, ট্রেন এরোপ্লেন রকেট এই সবের গল্প আছে। বদমাইশ জাদুকরদের কথা সেদেশের ইতিহাস বইতে থাকে, আর কে না জানে ইতিহাস পড়তে বসলেই ঘুম পায়। তাই এই ব্যাপারে রূপকুমারের জ্ঞান বড় কম, সুন্দরের কথাটা ওকে শুনতে দাও।

বদমাশ জাদুকরটা আমার বোনের রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। তার অনেক বয়স, তাই বোন রাজি হয় নি। বাবা বলেছিল যে বোন যাকে পছন্দ করবে তাকেই বিয়ে করবে। মনের মিলটাই আসল। তখন জাদুকর বলে, “ঠিক আছে, দেখব তোমাদের চেহারা যদি কুৎসিত হয়, তারপর তোমার এই কথা থাকে কিনা।” এই বলে সে চলে যায়। তার কিছুদিন পরেই হঠাৎ ঘন কুয়াশাতে আমাদের রাজ্য ঢেকে যায়। মেঘ কেটে গেলে দেখি আমরা সব এই রকম হয়ে গেছি। জাদুকর একদিন আমাদের সবাইকে বিদ্রূপ করতে এসেছিল। কিন্তু আমরা কিছু করতে পারিনি, তার সাংঘাতিক জাদুর কাছে আমরা অসহায়।‘

লিমেরিকাতে কি অনেক মানুষ থাকে?’

মানুষ থাকে পাহাড়ের কাছাকাছি, ভিতর দিকে রাক্ষস দৈত্য এদের বাস। খুব বেশি লোক নেই এখানে। খুব বিপদের জায়গা।‘

তুমি কখনো লিমেরিকার বাইরে গেছ?’

আমি কেন, কেউই যায়নি। লিমেরিকার বাইরে বেরোনোর উপায় কারোর জানা নেই। তুমিই প্রথম লিমেরিকার বাইরের লোক যাকে আমি দেখেছি।‘

রূপকুমার ব্যাখ্যা করল কেমনভাবে সে লিমেরিকাতে ঢুকেছে। সুন্দর সব শুনে বলল, ‘একটা কথা আমি ভাবছি। আমার বাবা জাদুলাঠিকে নিয়ে কুয়ার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন। সে ঐ ফকিরের গুরুর হাতে গেল কেমন করে? জাদুকাঠি কি নিজে নিজে কোথাও যেতে পারে?’

ওকেই জিজ্ঞাসা করা যাক।‘

লিমেরিকাতে ছিলে সত্যবানের সাথে,

কেমন করিয়া গেলে ফকিরবাবার হাতে?

মেঘের তুল্য উঁচু পাহাড়

কে তোমাকে করালে পার,

অচিন দেশে পাড়ি দিলে সে কোন প্রভাতে?

সত্যবান যখন জাদুকুয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল, পথের মাঝে এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সব শুনে সন্ন্যাসী তাকে বলে যে যদি ওই ঐন্দ্রজালিকের হাতে আমার মতো মন্ত্রপূত জাদুদণ্ড পড়ে, তাহলে তার ক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। সত্যবান তখন সন্ন্যাসীর কাছে জাদুদণ্ড গচ্ছিত রাখে। কথা ছিল যে এক সপ্তাহের মধ্যে সত্যবান ফিরে না এলে সন্ন্যাসী জাদুদণ্ড নিয়ে তার যা সমীচীন মনে হয় করবে। এক সপ্তাহের বেশি অপেক্ষা করার পরেও যখন সত্যবান ফেরে না, তখন সন্ন্যাসী লিমেরিকা থেকে অচিন দেশে ফিরে যায়, পথ সে আগেই জানত। সেই সন্ন্যাসীরই শিষ্য ওই ফকির, আমাকে যে তোমাদের কাছে এনেছিল।‘

শীগগিরি তারা সুন্দরের চেনা জায়গা সব পেরিয়ে গেল। ক্ষেত শেষ হয়ে দুইপারেই ঘন জঙ্গল। নদীতে মাছ আছে, কিন্তু সেই রকম মাছ রূপকুমার কখনো দেখেনি। সুন্দর সাবধান করে দিল, ‘জলে হাত দিও না, কামড়ে দেবে।‘   

কি কামড়াবে, কুমির?’

কুমির তো আছেই, মাছেদেরও দাঁত আছে। তাছাড়া জলে আরো অনেক কিছু থাকে শুনেছি, তাদের সঙ্গে দেখা না হওয়াই ভালো।‘

সন্ধে হতে ভেলা নদীর ধারে বাঁধল দুজন। রূপকুমার অবশ্য অধৈর্য, কিন্তু সুন্দর বলল লিমেরিকাতে রাত্রিতে চলাফেরা নিরাপদ নয়। অনেক কিছু আছে যারা দিনের আলোতে বেরোতে পারে না, কিন্তু রাত্রে তাদের মুখোমুখি হলে আর রক্ষে নেই। দুজনে একটা বড় গাছের উপর আশ্রয় নিলো। দড়ি দিয়ে রূপকুমার নিজেকে ডালের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধল যাতে পড়ে না যায়। সুন্দরের অবশ্য সে ভয় নেই।

রাত গভীর, চারদিক নিস্তব্ধ। চাঁদের আলোতে চারদিক ভেসে যাচ্ছে।    হঠাৎ ধুপ ধুপ আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল রাজপুত্রের।    শব্দটা কাছে আসছে। জঙ্গল ঠেলে বেরিয়ে এলো একটা ...

জানি জানি, তোমরা আগেই বুঝে গেছ যে আসছিল একটা দৈত্য। কিন্তু ওর নাম তো জানো না। বিরাট লম্বা, বনের সবচেয়ে উঁচু গাছটাও তার কোমরের উপরে যায়নি; এই দৈত্যটার নাম হল দ। ওইরকম আকাশপ্রমাণ দৈত্যের এত ছোট নাম কেন জানতে চাইছ। দৈত্যদের নামের নিয়ম জানো না? জন্মের সময় তাদের একটা বিরাট বড় নাম দেওয়া হয়। দ-এর ছোটবেলার নামটা লিখতে শুরু করলে এই গল্পটাই আর শেষ হবে না। তারপর দৈত্যরা যত বড় হতে থাকে, তাদের নাম তত ছোট হতে থাকে। শেষকালে দৈত্যদের নামে একটা অক্ষরই পড়ে থাকে। কী বলছ? তাহলে দৈত্যদের নাম কম পড়ে কিনা? কম পড়বে কেন? তুমি জীবনে কটা দৈত্য দেখেছ? দৈত্যরা লুপ্তপ্রায় প্রজাতিদের মধ্যে পড়ে।

দ যাচ্ছিল নিজের কাজে, এমন সময় নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে যে একটা গাছের ডালে পুতুলের মতো দুটো প্রাণী, একটা বাঁদর আর একটা মানুষ। ভারি মজা পেল, ভাবল নিয়ে যাবে, মেয়ে খেলবে। একেবারে জ্যান্ত পুতুল পেলে নিশ্চয় খুশি হবে। প্রথমে বাঁদরটাকে ধরল, তারপর মানুষটাকে ধরতে গিয়ে দেখে সে গাছের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা। ডালটাকেই মটকে ভেঙে নিলো, তারপর সব একসঙ্গে নিজের ঝুলিতে ভরে নিলো।

রূপকুমার প্রথম প্রথম প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। নিজেকে শক্ত করে ভাঙা ডাল থেকে নিজের বাঁধনটা খুলল, গড়িয়ে সোজা চলে গেল ঝুলির একেবারে তলায়। সুন্দর আগে থেকেই সেখানে ছিল।    ফিসফিস করে আলোচনা করতে বসল দুজনে।   

তরোয়ালটা আছে তো তোমার?’ সুন্দর জিজ্ঞাসা করে।

রূপকুমার খাপ থেকে তরোয়াল বার করল। সুন্দর বলল, ‘থলির নিচটা কেটে একটা মানুষ বেরোনোর মতো গর্ত করো। তারপর সেখান দিয়ে বেরিয়ে গেলেই চলবে।‘

দানবের ঝুলিটা প্রচণ্ড শক্ত একটা চামড়া দিয়ে তৈরি। সুন্দর বলল ড্রাগনের চামড়া।

মানে দৈত্যটা ড্রাগন শিকার করে। ওরে বাবা!’

সুন্দর অবাক হয়ে বলল, ‘ড্রাগন শিকার? কেন? খামোখা ড্রাগন মারতে যাবে কেন? ড্রাগনরা সবাই ঝানু ব্যাবসাদার। বছর বছর সাপের মতো খোলস ছাড়ে, তারপর সেটাকে বিক্রি করে দেয়। লিমেরিকাতে খুব চাহিদা ড্রাগনের চামড়ার।‘

তরোয়াল তো আর করাত নয়, অনেকক্ষণ চেষ্টার পরে তবে একটা বড় গর্ত হল। সুন্দর মাথা বার করে বলল, ‘মাটি অনেক নিচে। একটু অপেক্ষা করি। যখন নিচে একটা গাছ আসবে, তখন লাফ দেব।‘

একটু পরেই একটা বড় গাছ দেখে সুন্দর বলল, ‘রাজকুমার, আমার পিঠের দিক থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো, তুমি তো আর আমার মতো লাফাতে পারবে না।‘ দুই বন্ধু যে পালাল তা দৈত্য বুঝতেও পারল না।

বেশ তো চুপ করে ছিলে, আবার কী হল? যখন বুঝল যে পুতুল পালিয়েছে তখন দ-এর অবস্থা কিরকম হয়েছিল? সেদিন সন্ধেবেলা দ মেয়েকে বলেছিল, ‘তোর জন্য দুটো জ্যান্ত পুতুল এনেছি, একটা মানুষ একটা বাঁদর।‘ তারপর পুতুল দিতে গিয়ে তার মুখের অবস্থা কী হয়েছিল, তার মেয়ে কেমন জোরে কেঁদেছিল, কিংবা মেয়ের মা দ-এর বুদ্ধিশুদ্ধি সম্পর্কে কী মন্তব্য করেছিল, সে কথা আমি জানি না। শুধু জানি সেদিন সন্ধেবেলা একটা প্রচণ্ড ঝড় উঠেছিল লিমেরিকার এক অংশে।

গাছের ডাল থেকে ঝুলছে সুন্দর, তার পিঠে রূপকুমার। সুন্দর বলল, 'কুমার, আর রাখতে পারব না, হাত ছেড়ে যাবে । তুমি আমার উপর দিয়ে উঠে ডালটাকে ধরো।’ রূপকুমার তাই করল, তারপর দুজনেই ডালের উপর উঠে বসল। সবে ভোর হয়েছে, পাখি ডাকছে।

'আমরা কোথায় আছি?’

সুন্দর তরতর করে মগডালে উঠে গেল, চারদিক দেখে নেমে এল। বলল, 'এ সব জায়গায় তো কখনো আসিনি, ভাবলাম নদীটা যদি দেখতে পাই। কিন্তু গাছ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। জাদুকাঠিকে জিজ্ঞাসা করো।’

দানবের থেকে পেয়েছি উদ্ধার

জাদুলাঠি পথ দেখাও আবার,

কোন দিকে গেলে পরে

পাব সেই কুয়ারে

বিলম্ব সহে না মোর আর।

জাদুদণ্ড বলল, 'রাজকুমার অধৈর্য হলে চলবে না। দৈত্য লম্বা লম্বা পা ফেলে আমাদের অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে, কিন্তু একটু অন্যদিকে চলে এসেছে। প্রথমে দৈত্য ঝাঁকানি দিল তারপর তোমরা এমন লাফালাফি করলে, সারা রাত ভালো ঘুম হয়নি। গাটা ম্যাজম্যাজ করছে। এদিকটা এখন ভালো চিনতে পারছি না। মনে হচ্ছে এবার একটু পূর্বদিকে যেতে হবে। একটু জেনে নিই। এই যে দিদি, শুনছেন?’

কার সঙ্গে কথা বলছে জাদুদণ্ড, কে আছে জঙ্গলের মধ্যে? রূপকুমার অবাক হয়ে তাকাল। দেখল সামনের গাছের নিচু ডালে একটা কাঠবিড়ালি লেজ উঁচু করে বসে আছে।

কী বলছ, জাদুদণ্ড কাঠবিড়ালিকে প্রশ্ন করতে পারে কিনা? সে তো তুমিও পার, কথাটা হল কাঠবিড়ালি উত্তর দেয় কিনা। একটা কথা তোমাদের বলে রাখি, কাঠবিড়ালিরা সবাই খুব গম্ভীর, তাদের সব সময় সম্মান করে কথা বলবে, তবেই উত্তর পেলেও পেতে পার।    ঐরকম 'পিয়ারা তুমি খাও, গুড়মুড়ি খাও'  বললে তারা পাত্তাই দেবে না।

কাঠবিড়ালিটা খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকাল। বলল, কী চাই? দেখতে পাও না ব্যস্ত। প্রাতরাশের জোগাড় করতে হবে, সকালবেলা কথা বলার সময় হয় কখনো?’

'আমাদের জাদুকুয়োর রাস্তাটা যদি একটু বলে দেন তো বড় উপকার হয়।’ জাদুদণ্ড বলল।

'আর আমার উপকার কিসে হয়?’

'রাস্তাটা বলে দিলে আপনাকে একটা বড় আখরোট দেব।'

'আর আমার কর্তাটি কি না খেয়ে থাকবে?’

'আচ্ছা, দুটো। '

'আগে দেখি। আজকাল এমন সব বাজে আখরোট হয়েছে, আমার কর্তাটি সে সব মুখে তোলেন না। আমারই হয়েছে জ্বালা, খুঁজে খুঁজে ভালো জিনিস নিয়ে আসতে হয়। বাজে মাল দিলে চলবে না বাপু।'

রূপকুমার তাড়াতাড়ি করে ঝুলি থেকে দুটো আখরোট বার করে দিল। কাঠবিড়ালি একটাতে একটা কামড় দিয়ে বলল, ‘হুঁ, বিদেশি জিনিস। চলবে। ঠিক আছে, মন দিয়ে শোনো। একবারের বেশি বলতে পারব না। সঙ্গে  একটা মানুষ চাকর এনেছ, সে তো আবার গাছ বেয়ে যেতেও পারবে না। তাই তোমাদের ঘুর রাস্তাতে যেতে হবে। ওই যে জারুল গাছটা দেখছ, ওর ডানদিক দিয়ে একটা পথ চলে গেছে।    সেই পথ দিয়ে গেলে একটা দেখবে একটা বড় সরোবর, অনেক পাখি মাছ ধরছে। সরোবরকে বাঁ হাতে রেখে আধ ক্রোশ হাঁটবে, একটা ঝর্না    পেরোতে হবে। তারপর সামনে পাবে একটা টিলা। খুব সাবধান, টিলাটার থেকে যতটা পারো দূরে থেকো, সেখানে এক ভয়ঙ্কর রাক্ষস থাকে। সেটা পেরোলে পাবে একটা বিরাট বাগান। সত্যি কিনা জানি না, শুনেছি তার মাঝখানে সেই কুয়ো। শুনেছ তো, এবার বিদায় হও। সকালবেলাতে অনেকক্ষণ সময় নষ্ট হলে তোমাদের জন্য।' এক মুহূর্ত দেরি না করে লাফাতে লাফাতে কাঠবিড়ালি গিয়ে একটা কোটরে ঢুকে পড়ল।

'এবার বুঝেছি কোথায় আছি। ঐ টিলাটার কথা তোমাদের বলেছিলাম। নৌকাতে এলেও আমাদের ওটাকেই খুঁজে বার করতে হত। ভালো হয়েছে। যাহোক, তোমরা এবার রওনা হও। ভোরবেলাতে ঘুমটা ভাঙিয়ে দিয়েছ, আমি একটু বিশ্রাম করি।' জাদুলাঠি বলল।   

হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের কাছে গিয়ে পড়ল সুন্দর আর রূপকুমার। রাজপুত্র দাঁড়িয়ে পড়ল। অবাক হয়ে বল, 'দেখো দেখো, পাখিরা কেমন করে মাছ ধরছে!’

'সে তো কাঠবিড়ালি গিন্নি বলল।'

'হ্যাঁ, কিন্তু তা বলে ছিপ দিয়ে?’

'আর কোন ভাবে ধরবে, জাল ফেলে?’

দুজনের গলাই একটু জোর হয়ে গিয়েছিল, একটা মাছরাঙা বিরক্ত হয়ে ফিরে তাকাল। ডানা দিয়ে ইশারা করে চুপ করে থাকতে বলল।

বেলা ক্রমশ বাড়ছে। খিদে পেয়েছিল দুজনেরই। সুন্দর থাকাতে ভারি সুবিধা হল, গাছে উঠে ফলপাকড় পেড়ে নিয়ে এল, সেই দিয়ে পেট ভরাল দুজনে। একটু পরেই ঝর্নাটা। তেষ্টা পেয়েছিল, ঝর্নার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে দুজনে আঁজলা করে তুলে জল মুখে দিল।

উঠে দাঁড়াতেই হঠাৎ একটা চিঁচিঁ আওয়াজ কানে এল, 'এই আমার ঝর্নার জল চুরি করছিস, কে রে তোরা?’

দুজনে অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, কাউকে চোখে পড়ছে না। 'কে আপনি, সামনে আসুন।' রূপকুমার বলল।

'সামনেই তো আছি, চোখে দেখতে পাস না?’

নিচে তাকিয়ে দেখল দুজনে ...

এই তো, তোমাদের আবার প্রশ্ন শুরু হয়ে গেল। গল্পটা বলব না তোমাদের প্রশ্নের উত্তর দেব? নিচে তাকাল কেন? কারণ আওয়াজ আসছিল পায়ের দিক থেকে। পায়ের দিক থেকে কেন? সেই কথাই তো বলছি, এত বাধা দিলে আর বলব কেমন করে? পায়ের দিক থেকে আওয়াজ আসছিল কারণ কথা বলছিল একটা নেংটি ইঁদুর।

সুন্দর আর রূপকুমারকে তাকাতে দেখে ইঁদুর বলল, 'এত বড় চেহারা করেছিস, দেখিস না কী লেখা আছে?’ হাতের লাঠিটা দিয়ে একটা খুব ছোট্ট বোর্ডের দিকে দেখাল।

দুজনে মিলে অনেক চেষ্টা করেও বোর্ডের উপরে কিছু লেখা আছে কিনা দেখতে পেল না। রূপকুমার জিজ্ঞাসা করল, 'কী লেখা আছে?’

'যত সব অশিক্ষিত! লেখা আছে ... উম... লেখা আছে এই ঝর্নার জল ... উম ... ১০৮ শ্রী শ্রীল শ্রীযুক্ত মূষিক সম্রাট মহারাজ শ্রী সিংহদমনের সম্পত্তি। যে কেহ এই জল ... উম ... বিনা অনুমতিতে পান করিবে সে মহারাজকে ... উম ... উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকিবে। অন্যথায় মহারাজের ... উম ... বিচারে তাহার দণ্ড হইবে।' ইঁদুর বোর্ডের দিকে না তাকিয়েই বলে গেল।

'এত কথা ওইটুকু জায়গায় লেখা আছে?’ রূপকুমার অবিশ্বাসের সুরে বলে।' আমি তো একটা আঁচড়ও দেখতে পাচ্ছি না।'

'তা না তো কি? রাজকরণিককে পই পই করে এই কথাগুলো লিখতে বলেছিলাম, নিশ্চয় লিখেছে।    জলপানের পূর্বে কি মহারাজের অনুমতি নিয়েছিলি?’

'মহারাজ কোথায়? কেমন করে তাঁর অনুমতি নিতে হয়?'   

'মহারাজ শ্রী সিংহদমন স্বয়ং তোদের সম্মুখে দণ্ডায়মান।'

', মহারাজকে প্রণাম। আমরা তো জানতাম না, আপনার অনুমতি লাগবে। জল তেষ্টা পেয়েছে, তাই খেয়ে ফেলেছি,’ রূপকুমার বলল।

'আইন না জানাটা কোনো অজুহাত নয়। তোরা কি ক্ষতিপূরণ দিতে প্রস্তুত?’

'ঝর্নার জল তো বয়ে চলে যাচ্ছে, তার আবার ক্ষতিপূরণ কি? আমরা না খেলে কি ওই জলটা এখানে থেকে যেত?’

আমার ঝর্নার জল আমি যা খুশি করব, তাতে তোদের কি? দুইজনের ক্ষতিপূরণ দ্বিশত স্বর্ণমুদ্রা।’   

'দু'শো মোহর! দু'ঢোক জলের দাম!’ রূপকুমারের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। 'আমার কাছে তো এক স্বর্ণমুদ্রাও নেই। এবারের মতো মার্জনা করে দিন।’

'তাহলে শাস্তির জন্য প্রস্তুত হও।' হাতের লাঠিটা দুজনের দিকে তুলে ধরে নেংটি।   

সুন্দর এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবার বলল, 'হে মূষিককূলশ্রেষ্ঠ মহারাজাধিরাজ চক্রবর্তীসম্রাট নেংটীশ্বর, আপনি আপনার ক্রোধ সংবরণ করুন। আপনি ক্ষণমাত্র অপেক্ষা করুন, আমাদের সঙ্গী অনতিবিলম্বে এখানে আসিবে, তার নিকটের সহস্র স্বর্ণমুদ্রা আপনাকে নজরানারূপে দিব।'

'বাঃ, বাঃ, মূষিককূলশ্রেষ্ঠ! মহারাজাধিরাজ চক্রবর্তীসম্রাট! আর কী বললে, নেংটীশ্বর! বাঃ বাঃ। সহস্র স্বর্ণমুদ্রা। বাঃ বাঃ। তা তোমাদের সঙ্গীটি কোথায়? তার কত দেরি হবে?’

'হে গণেশবাহন, আমরা আমাদের গৃহপালিত মার্জারের সঙ্গে এই স্থানে আসিয়াছি। সে নিকটেই কোথাও আছে। মহারাজা সিংহদমনের আসিবার সংবাদ পাইলে সে অতি অবশ্যই শীঘ্র পদচারণে এখানে উপস্থিত হইবে। ওই ওই, মনে হইতেছে তার পদধ্বনি শুনিতে পাইতেছি।'

মুহূর্তের মধ্যে মহারাজ সিংহদমন অদৃশ্য হয়ে গেল, এমন কি তার লেজের ডগাও আর দেখা গেল না। সুন্দর বলল, ‘চলো, যাওয়া যাক। জানি না ইঁদুরটা বচনসর্বস্ব, নাকি ওর হাতের লাঠির কোনো জাদু ক্ষমতা আছে। তাই ভাবলাম একটা কায়দা করে দেখি।'

রূপকুমার বলল, 'লিমেরিকাতে ইঁদুর বিড়াল সম্পর্কটা অন্তত অচিন দেশেরই মতো।' দুজনে হাসতে হাসতে হেঁটে ঝর্নাটা পার হল।   

একটু পরেই দূরে একটা নিচু পাহাড় দেখা গেল, রাস্তাটা সেদিকে না এগিয়ে দুপাশে ভাগ হয়ে গেছে। এটাই নিশ্চয় সেই    টিলাটা, যার কাছে যেতে কাঠবিড়ালি গিন্নি বারণ করেছিল। দাঁড়িয়ে পড়ল দুজনে। রূপকুমার জাদুর লাঠি বার করল।

সম্মুখেতে দেখি ভয়াল পাহাড়,

করাল বিপদ আছে মাঝে তাহার।

দক্ষিণে না বামে

যাব কোন পানে,

কোন দিকেতে পথ সে জাদু কুয়ার?

সোজা টিলার দিকে যেতে হবে।‘ জাদুকাঠি বলল।

সে কি, সেখানে যে ভয়ঙ্কর রাক্ষস।‘ রূপকুমার আর সুন্দর একসঙ্গে বলল।

তা হোক। তবু ওটাই আমাদের পথ। টিলায় উঠতে শুরু করলেই দেখতে পাবে একটা গাছ বাজ পড়ে মাঝখান থেকে দু’টুকরো হয়ে গেছে। তার পাশে একটা গুহার মুখ। ওইখানে ঢুকতে হবে। ভয় পেয়ো না, আমি তো আছি। ‘

খুব একটা ভরসা না পেলেও অন্য কোনো উপায় নেই। জাদুদণ্ডই একমাত্র পথ চেনে। এত কাছে এসে পিছিয়ে যাওয়া যায় না, তাছাড়া রূপকুমারের মাকে তো বাঁচাতেই হবে। দুজনে সোজা টিলার দিকে রওনা দিল।

গুহা খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। কিন্তু তার ভিতরটা ঘন অন্ধকার, যেন কোনো রাক্ষস মুখব্যাদান করে আছে। রূপকুমারের লিমেরিকাতে ঢোকার গুহার প্রহরীর কথাটা মনে পড়ে গেল। শুকনো কাঠকুটো কুড়িয়ে নিলো দুজনে, মশাল বানাতে কাজে লাগবে। চকমকি ঠুকে একটা গাছের ডাল জ্বালিয়ে নিয়ে ভিতরে পা বাড়াল দুজনে।

গুহা তো নয় যেন গোলকধাঁধা। কোন পথে যেতে হবে জাদুদণ্ড নিজে থেকেই নির্দেশ দিতে লাগল, জিজ্ঞাসা করার দরকার হল না।

আর কত দূর?’ একটু পরে রূপকুমার জিজ্ঞাসা করল।

উত্তর না দিয়ে জাদুদণ্ড শুধু বলল, ‘ডানদিকের গুহাটাতে ঢোকো।‘

ঢুকেই থমকে গেল দুজনে। বিরাট একটা গুহা, তার মাঝখানে একটা আগুন জ্বলছে। তার পাশে বসে একটা ঝলসানো হরিণের ঠ্যাং চিবোচ্ছে একটা বিশাল চেহারার রাক্ষস। পাশে রাখা একটা মুগুর, সেটা লম্বাতে রূপকুমারের থেকেও বড়।

ওটা যে রাক্ষস কি করে জানল রূপকুমার? কেন, রাক্ষস কেমন দেখতে জানো না তোমরা? বসে বসেই মানুষের থেকে লম্বা, কুলোর মতো কান, মুলোর মতো দাঁত, দড়ির মতো চুল – রূপকুমারও জানে, তাই দেখেই বুঝতে পেরেছে যে সেটা রাক্ষস। তাড়াতাড়ি করে পালাতে গেল, পিছন পিছন সুন্দর।

ভয় পেও না। তোমরা আমার পুরানো বন্ধুকে এনেছ দেখছি।‘ কে বলল কথাটা? এত নরম হয় রাক্ষসের গলা! দাঁড়িয়ে গেল দুজনে।

কে তোমার বন্ধু?’ অবাক হয়ে বলল রূপকুমার। কোমর থেকে তরোয়ালটা বার করে হাতে নিয়েছে।

রাক্ষস জাদুকাঠির দিকে ইঙ্গিত করল।

দেখা হল অনেক দিনের পর

জাদুকাঠি বলো তোমার খবর।

এলো কি সময়?

যাবে দূরে ভয়?

প্রশ্ন করি রক্ষ নিশাচর।

রূপকুমারের হাতে লাঠি নড়ে চড়ে উঠল। বলল, ‘এতদিনেও তোমার কবিতার কোনো উন্নতি হয়নি। এই হল আমার পুরানো বন্ধু রক্ষ। ভয় পেয়ো না, ওর চেহারাটা ভয়ঙ্কর হলে কি হবে, মনটা খুব নরম।‘

এতদিনেও তোমার স্বভাবের কোনো উন্নতি হয়নি, আগে বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়।‘

হ্যাঁ, এই হল সুন্দর, ওর বাবা সত্যবানের সন্ধানে এসেছে। তিনি জাদু কুয়া খুঁজতে বেরিয়েছিলেন, আর ফেরেননি।‘

জাদুকরের বাড়িতে অনেককে চাকর বানিয়ে রেখেছে। তাদের মধ্যে হয়তো তোমার বাবা আছেন। বাগানে কয়েকটা বাঁদর ফলগাছের দেখাশোনা করে আমি জানি।’

আর এ হল রূপকুমার, মায়ের অসুখ সারানোর জন্য জাদু কুয়োর জল নিতে এসেছে। ও হল অচিন দেশের রাজপুত্র।‘

ভুরু কুঁচকে তাকাল রক্ষ। বলল, ‘এই কি সেই?’

তা জানি না।‘ জাদুদণ্ড বলল।

রূপকুমার বলল, ‘মানে? কে আমি?’

যে সুন্দরদের অভিশাপ দিয়েছিল, সেই বদমায়েশ জাদুকরের সঙ্গে লড়ার ক্ষমতা কারো নেই। কিন্তু একটা কথা অনেকে বলে, লিমেরিকার বাইরে থেকে এক রাজার কুমার একদিন আসবে, তার উপর কোনো জাদু কাজ করবে না। সে নাকি ঐ জাদুকরের ভয়ের রাজত্বের অবসান ঘটাবে। তুমি কে সেই রাজপুত্র? ‘ রক্ষ বলল।

জাদুদণ্ড বলল, ‘সে কথাটা ঠিক কিনা কেউ জানে না। ঠিক হলেও রূপকুমারই কি সেই রাজপুত্র? ও তো মায়ের অসুখ সারানোর জন্য জাদু কুয়ার জল নিতে এসেছে, তুমি যদি ওর পথ ছেড়ে দাও, তাহলে ও এখনি জল নিয়ে চলে যেতে পারে। জাদুকরের সঙ্গে লড়তে ও আসেনি।‘

রূপকুমার বলল, ‘রক্ষ পথ ছেড়ে দিলেই জল নেওয়া যাবে?’

জাদুকরের আদেশে আমাকে কুয়ো পাহারা দিতে হয়। আমি নাচার, ওর সঙ্গে লড়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমার ছেলে আর মেয়েকে বন্দি করে রেখেছে। বেশি কেউ জানেনা যে কুয়োটা গুহার মধ্যে। তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ সেটা?’ একটু সরে গিয়ে পিছন দিকে ইঙ্গিত করল রক্ষ।

রক্ষের বিশাল চেহারা গুহার অনেকটা ঢেকে রেখেছিল, সে সরে যেতেই দেখা গেল পিছনে একটা গোল গর্ত।

এটাই সেই কুয়ো?’ যার জন্য রূপকুমার বহু দূর থেকে এসেছে, সে এখন তার নাগালে।

সুন্দর বলল, ‘কোথায় কুয়ো?’

রূপকুমার অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। ‘দেখতে পাচ্ছ না, ঐ তো।’

রক্ষ বলল, ‘সবাই দেখতে পায় না। যার খুব প্রয়োজন, সেই শুধু দেখতে পায়। আমি কিন্তু সুন্দরের মতোই দেখতে পাই না, কারণ তার জলে আমার কোনো দরকার নেই। যে কুয়োর জলকে কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে বা নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়, সেও কুয়োকে দেখতে পাবে না। জাদুকর নিজেও দেখতে পায় না, যার প্রয়োজন তাকেও ব্যবহার করতে দেবে না। সে জন্য আমাকে এখানে বসিয়ে রেখেছে। কেউ এলে আমি মোটেই বাধা দিতাম না, কিন্তু এত বছরেও কেউ জল নিতে আসেনি।‘

জাদু লাঠি বলল, ‘তোমার চেহারা যা, সবাই দূর থেকেই পালিয়ে যায়।‘

রাক্ষসদের এই রকমই দেখতে হয়। আমি কি মানুষ খাই না কাঁচা মাংস খাই? খিদে পেলে হরিণ কি বাঘ কি হাতি মেরে ঝলসে খাই।‘ রক্ষ বলল। সুন্দর নিজের অজ্ঞাতসারেই রক্ষের থেকে একটু দূরে সরে গেল।

জাদুদণ্ড বলল, ‘আমি সত্যবানকে বলেছিলাম যে কুয়োর জলে ওর কোনো কাজ হবে না। সুন্দরদের অভিশাপ তো রোগ নয় যে জল খেয়ে সারবে।‘

রূপকুমার ইতিমধ্যে গিয়ে কুয়োর পাশে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘জল তুলব কেমন করে?’

তোমার সঙ্গে জল নেওয়ার ভিস্তি আছে। সেটা বার করে কুয়োকে মনে মনে তোমার প্রয়োজনটা বলো। কুয়ো যদি মনে করে, তাহলে সে তোমাকে সাহায্য করবে।‘ রক্ষ নির্দেশ দেয়।

দেখতে দেখতে ভিস্তিটা জলে ভরে উঠল, তার মুখটা বেঁধে নিলো রাজপুত্র। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল রক্ষ ও সুন্দর ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

কী করবে রূপকুমার? জল নিতে এসেছিল, সেই কাজ হয়ে গেছে। তার সঙ্গীদের কিন্তু কোনো উপকার হয়নি। সুন্দর বাঁদর, রক্ষ রাক্ষস; কিন্তু লিমেরিকাতে এসে দানব রাক্ষস ড্রাগন এসব সম্পর্কে এত দিনের সব ধারণা ওলটপালট হয়ে গেছে রূপকুমারের। আবার জল না নিয়ে গেলে মায়ের কী হবে? কিন্তু সুন্দরও ছেলে, সে তার বাবার খোঁজ পায়নি। রক্ষও বাবা, তার ছেলেমেয়ে জাদুকরের বন্দি।

রূপকুমার বলল, ‘সত্যিই কি আমার ওপর জাদুকরের জাদু কাজ করবে না?’

সবাই চুপ। রূপকুমার নিজের হাতের জাদুদণ্ডের দিকে তাকিয়ে বলল,

সবাই যাকে পাচ্ছে এমন ভয়

মোর হাতে তার হবে পরাজয়?

মায়া হবে বিফল,

পাবে পাপের ফল?

জাদুকাঠি এমন কি গো হয়?

জাদুদণ্ড বলল, ‘কবিতাতে প্রশ্ন করো নি বলে আমি চুপ করে আছি, এমন নয়। তাছাড়া এত খারাপ কবিতার উত্তরে আমি সাধারণভাবে কথা বলি না। কুমার, তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি দিইনি কারণ উত্তরটা আমার জানা নেই। মিথ্যে আশ্বাস আমি দেব না। আমিও চাই যে ঐ বদমাইশটা পরাজিত হোক, সুন্দরদের উপর থেকে অভিশাপ উঠে যাক, সত্যবান ঘরে ফিরে আসুক। কিন্তু পৃথিবীতে কত রাজ্য আছে, তাদের সবার রাজপুত্র আছে; তুমিই ভবিষ্যৎবাণীর সেই রাজপুত্র কিনা আমি জানি না।‘

একটা নিশ্বাস ফেলল রূপকুমার। বলল, 'ঠিক আছে, জাদুকরকে হারানোর চেষ্টাটা আমি করব। যদি আমার কিছু হয়, কেউ একজন এই জল আমার মায়ের কাছে নিয়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করো। জাদুদণ্ড, কি করতে হবে আমাকে?’

'এখন বাইরে রাত্রি হয়ে গেছে, জাদুকর নিশ্চয় ঘুমোচ্ছে। জাদুকরের প্রাসাদে ঢোকার জন্য একটা রাস্তা এই গুহা থেকে আছে। রক্ষের ভয়ে কেউ এই গুহাতে আসে না, তাই সেই দরজাতে প্রহরী থাকবে না আশা করছি। থাকলেও অন্য প্রবেশপথগুলোর মতো কড়া পাহারা নিশ্চয় থাকবে না। প্রাসাদে ঢোকার পরে যেতে হবে জাদুকরের ধনাগারে। জাদুকরকে সরাসরি হারানো যাবে না, তার সমস্ত ক্ষমতার উৎস হল এক মকরত মণি, সে রাখা আছে ধনাগারের এক সিন্দুকে। সেখানে নিশ্চয় পাহারা আছে, তাদের পরাস্ত করতে হবে। তারপর সিন্দুক খুলে সেই মণিটাকে চূর্ণ করতে হবে। তবেই জাদুকরের সমস্ত ক্ষমতা চলে যাবে। সুন্দর আবার আগের রূপ ফিরে পাবে।’

'ধনাগার কোথায় তুমি জানো?’

জাদুদণ্ড ভালো করে বুঝিয়ে দিল। রূপকুমার বলল, 'সত্যিই কি যে জাদুকরকে কেউ কখনো হারাতে পারেনি, তাকে আমি একা পরাস্ত করতে পারব?’

সুন্দর ও রক্ষ একসঙ্গে বল, 'একা কেন, আমিও তো আছি তোমার সঙ্গে।’ বাঁদর ও রাক্ষস দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসল।

প্রাসাদে ঢুকতে অসুবিধা হল না। যে প্রহরী সেই দরজার পাহারায় ছিল, সে ঘুমোচ্ছিল। কিছু বোঝার আগেই রক্ষ তার মুখে চাপা দিয়ে দুহাতে তুলে আনল, তারই পাগড়ি খুলে হাত আর মুখ বেঁধে দিল রূপকুমার। গুহার মধ্যে তাকে ফেলে রাখা হল।

রাত্রি হয়ে গেছে বলে বিশেষ কেউ বাইরে নেই। দু-একজন প্রহরী দরজার পাশে বসে ঢুলছিল, তারা সবাই মানুষ। তাদের ব্যবস্থা করতে বিশেষ সময় লাগলো না। দেয়ালে মশাল জ্বলছে, সেই আলোতে পথ দেখা যাচ্ছে।

একটা মোড় ঘুরলেই ধনাগার। খুব সাবধানে উঁকি মারল রূপকুমার। তার সামনের প্রহরী কিন্তু জেগে বসে আছে, রূপকুমাররা মোড় ঘুরলেই দেখতে পাবে। সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা, তাই তাকে হঠাৎ আক্রমণ করার সুযোগ নেই। একবার যদি চিৎকার করে তাহলেই অন্য প্রহরীরা চলে আসবে, জাদুকরও নিশ্চয় বুঝতে পেরে যাবে। কী উপায়?

তিনজনে পিছিয়ে এলো। ফিসফিস করে পরামর্শ করতে লাগল।

আমি জানি তোমরা রূপকুমারদের এখনি বলে দিতে পার কী করতে হবে। অ্যাডভেঞ্চার আর গোয়েন্দা গল্প পড়ে তোমরা সবাই শিখে গেছ। কিন্তু আগেই বলেছি, অচিন দেশে এসব বই পাওয়া যায় না, তাই ওদের সময় লাগছিল। শেষে সুন্দর বলল, 'রূপকুমার অন্য প্রহরীদের কারো পোশাক পরে গেলে কেমন হয়? তাহলে হয়তো ও বোঝার আগেই কাছাকাছি পৌঁছানো যেতে পারে।‘

তাই হল, একজন পাহারাদারের পোশাক পরে নিলো রূপকুমার। পাগড়িটা এমনভাবে বাঁধল যেন মুখের অনেকটা ঢাকা পড়ে যায়। তারপর তার বর্শাটা হাতে নিয়ে সোজা গুপ্তকক্ষের দিকে রওনা দিল। একেবারেই দ্বিধা করল না, যেন ওর ওখানে যাওয়ারই কথা।

প্রহরী প্রথমে ভেবেছিল যে রূপকুমার ওদেরই একজন। কাছে আসতেই সন্দেহ হল, উঠে দাঁড়াল। বলল, 'কে তুমি?’

রূপকুমার অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘দরজা খুলতে হবে, হুকুম আছে।’

'আমার কাছে তো কোনো হুকুম নেই, কই তোমার মুখ দেখাও। ঢেকে রেখেছ কেন? বর্শাটা হাত থেকে নামাও আগে।’ সোজা রূপকুমারের বুকের সামনে সূচাল বর্শাটা তুলে ধরল প্রাসাদের প্রহরী।

রূপকুমার বর্শাটা দেয়ালের গায়ে ঠেকিয়ে দাঁড় করাল, প্রহরীর বর্শাটা বুকের থেকে একটুও নড়ল না। আস্তে আস্তে মুখের থেকে কাপড়টা সরাতে গেল রাজপুত্র।

বইতে লেখা থাকে কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে পড়ল ঠিক সেইরকমই হল প্রহরীর। সে যখন রূপকুমারের দিকে লক্ষ রাখছিল, আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে রক্ষ, একটা পাথর ছুঁড়ে মেরেছে প্রহরীকে। অব্যর্থ টিপ, সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেল প্রহরী, তারপর কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে পড়ল।

তাড়াতাড়ি করে প্রহরীর কোমর থেকে চাবির গোছাটা নিয়ে রূপকুমারের হাতে দিল সুন্দর। রাজপুত্র দরজাতে একটার পর একটা করে লাগাতে থাকল। তৃতীয় চাবিটা সহজেই ঘুরল, কিন্তু মানুষের তিনগুণ উঁচু দরজার পাল্লাদুটো রূপকুমারের ধাক্কাতে নড়ল না। রক্ষের কাছে অবশ্য সেটা কোনো সমস্যাই হল না।

প্রহরীকে ভিতরে এনে দরজা বন্ধ করতে হবে,’ রূপকুমার বলল।

পালানোর রাস্তা বন্ধ করে দেব?’

দরজা খোলা থাকলে বা অজ্ঞান প্রহরী বাইরে পড়ে থাকলে কারোর চোখে পড়ে যেতে পারে। পালানোর সুযোগ আমাদের হবে না। হয় জাদুকরের ক্ষমতা ধ্বংস করতে পারব, না হয় ওর হাতে ধরা পড়ব কি মারা যাব।‘

রক্ষ প্রহরীকে বাঁহাত দিয়ে তুলে ভিতরে ঢুকিয়ে নিলো।

রূপকুমার জিজ্ঞাসা করল, ‘মরে যায় নি তো? আমরা পারতপক্ষে কারোর প্রাণ নিতে চাই না।’

রক্ষ বলল, ‘মরেনি, হাড়ও ভাঙেনি। খালি কটা কালশিটে পড়বে। তবে শীগগিরি জ্ঞান ফিরে পাবে না।‘

জাদুকরের ধনাগারে একটা নয়, অনেকগুলো ঘর। কোন ঘরে আছে সেই মকরত মণি? জাদুদণ্ডকে জিজ্ঞাসা করার সময় নেই, তবে সে বলেছিল যে সেই ঘরে নিশ্চয় আরো পাহারা থাকবে। একটার পর একটা দরজা খুলছে রূপকুমার। কোনোটাতে স্বর্ণমুদ্রার স্তূপ, মশালের আলোতে ঝলমল করে উঠল। কোনটাতে মণিমাণিক্যের পাহাড়, লাল নীল সবুজ নানা রঙের আলোতে বিচ্ছুরণ হচ্ছে। আচ্ছা এর মধ্যে মকরত মণিটা নেই তো? না, তা কি করে হবে? সে তো আলাদা সিন্দুকের রাখা আছে।

আচ্ছা, এটা কি প্রশ্ন করার সময়? আমাদের বীর নায়করা এই রকম বিপদের মুখোমুখি, আর তোমরা এখন মকরত মণি কেমন দেখতে জানতে চাইছ। আগে জিজ্ঞাসা করতে পারতে। ঠিক আছে, চট করে বলে দিচ্ছি, আমরা কথায় বলি পান্না, সবুজ রঙের সেই পাথরই হল মকরত । জাদুদণ্ড তাহলে পান্না বলেনি কেন? সে কথা তাকেই জিজ্ঞাসা কোরো। আমি রূপকুমার, সুন্দর আর রক্ষের অবস্থা দেখি।

হঠাৎই একটা দরজা খোলা মাত্র ভিতর থেকে একটা ভয়ঙ্কর গর্জন এলো। ছিটকে পিছিয়ে এলো রূপকুমার। দরজা দিয়ে সাবধানে উঁকি মেরে দেখতে যাবে, তার আগেই বেরিয়ে এলো একটা বিরাট বাঘ। রূপকুমার আর সুন্দরের দিকে তাকিয়ে আবার গর্জন করলো, তারপর গুঁড়ি মেরে বসল, এবার নিশ্চয় লাফ দেবে। রূপকুমারের হাতে তরোয়াল, সুন্দরের হাতে একটা বর্শা। দুজনে সে দুটো সামনে এগিয়ে ধরল।

বাঘটা লাফানোর আগেই একটা বিরাট হাত এসে তার ঘাড় ধরল, তারপর ঠিক মেনি বিড়ালের মতো তাকে তুলে নিলো। ছটফট করছিল বাঘটা, রক্ষের মুগুরের এক ঘায়ে নেতিয়ে পড়ল।

এই ঘরটাই নিশ্চয়, সুন্দর আর রূপকুমার ঢুকে পড়ল। রক্ষের দরজা দিয়ে ঢোকার উপায় নেই, তার তুলনায় সেটা নিতান্তই ছোট। সে বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা সিন্দুক। কিন্তু খুলবে কেমন করে? গোছার কোনো চাবিই লাগল না। শেষে বর্শার ফলা ঢুকিয়ে চাপ দিতে গেল সুন্দর। ফলাটাই ভেঙে গেল।

আমার দামি সিন্দুকটাকে ভাঙিস না,’ দরজা থেকে কে যেন বলল।

কী বলছ, শেষ দৃশ্যে জাদুকর আসার কথাই ছিল? বানানো গল্পে ওসব আগে থেকে বলা যায়। এটা যদি সেরকম গল্প হতো, তাহলে শুরুর আগেই শেষটা বলে দেওয়া যেত। শুরুতেই বলেছি এটা হল সত্যি গল্প। তাই রূপকুমাররা মোটেই জাদুকরের জন্য তৈরি ছিল না। দুজনেই দরজার দিকে ঘুরে তাকাল।

দরজায় দাঁড়িয়ে আছে জাদুকর। সব বদমাইশ জাদুকরদের যেমন দেখতে হয়, ঠিক তেমনি। বয়সে মুখের চামড়া ঝুলে গেছে, লম্বা সাদা দাড়ি, পাকা চুল, বাঁকা নাক। ঘরের বাইরে রক্ষ, মুগুরটা উপরে তোলা, কিন্তু পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।

জাদুকর পিছন দিকে ইঙ্গিত করল। ‘বড্ড সাহস হয়েছে রাক্ষসটার। কালকে ওকে সাপ আর ওর ছেলেমেয়েকে ব্যাঙ বানিয়ে বাইরে ছেড়ে দেব। তখন পর্যন্ত এভাবেই থাকুক। আর তোরা কি ভেবেছিলি, এই ঘরের দরজা খুলবি আর আমি টের পাব না?’

হঠাৎই জাদুকরের চোখ পড়ল রাজপুত্রের কোমরবন্ধনীর দিকে, সেখানে জাদুকাঠি গোঁজা আছে। ‘আরে, এ তো মেঘ না চাইতেই জল! এই রাজ্যের সব খবর যার কাছে পাব, কোথায় কী লুকানো আছে, কে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, সব কথা যে বলতে পারবে, যাকে আমি এতদিন খুঁজে বেড়াচ্ছি, সে নিজেই আমার কাছে এসে হাজির।‘ হাত বাড়িয়ে বলল,

হুকুম তোমায় শুনতে হবে আমার

জাদুর লাঠি নেইকো তোমার ছাড়,

এসো আমার হাতে

থাকো আমার সাথে,

খবর আমায় দেবে লিমেরিকার।

জাদুর লাঠি নড়েচড়ে উঠল। রূপকুমার তাকে হাত দিয়ে চেপে ধরল, কিন্তু রাখতে পারছে না। কী করবে এখন?

সুন্দর বলল, ‘তুমিও একটা ছড়া বলো রূপকুমার, জাদুদণ্ডকেই ঠিক করতে দাও ও কার কাছে থাকবে, কার কথা শুনবে।‘

রূপকুমার এক মুহূর্ত ভেবে বলল,

অত্যাচারী দুরাচারী দুষ্ট জাদুকর

হুকুম তাহার চলবে নাকো কভু তোমার পর,

নিজেই করো বিচার

থাকবে পাশে কাহার,

কে হবে তোমার আপন, কে বা হবে পর।

জাদুদণ্ড বলল, ‘জাদুকর, লিমেরিকার খবর নেওয়ার আগে গুনতে শেখো, তোমার ছড়াতে মাত্রাই ঠিকঠাক মেলেনি।‘ রাগে জাদুকরের মুখ বেগুনি হয়ে গেল।

বাকিদের লাল হয়, জাদুকরের মুখ রাগে বেগুনি হল কেন? এ বাবা, জানো না, রামধনুর যেদিকে লাল তার ঠিক উল্টোদিকে বেগুনি রঙ থাকে? বদমাইশ জাদুকরদের অনেক কিছু উলটো-রকম হয়।

জাদুকর এত রেগে গেল যে কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করেছে। বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে পড়তে হাত উপরে তুলল। একটা লাল আগুনের গোলা হাতে তৈরি হল। ‘ঠিক আছে, তুই আমার থেকে ভালো ছড়া লিখিস। কিন্তু সেই আনন্দ তোর এখনি ঘুচিয়ে দেব। তোর সঙ্গে তোর পেয়ারের ঐ জাদুকাঠিকেও পুড়িয়ে মারব।‘ আগুনের গোলাটা ছুঁড়ে মারল রূপকুমারের দিকে। কিন্তু গোলাটা রাজপুত্রের সামনে এসে তাকে স্পর্শ না করে দু’ভাগ হয়ে দু’পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। রাজপুত্র কোমর থেকে তরোয়াল হাতে নিয়ে জাদুকরের দিকে এক পা বাড়াল।

একটু থমকে গেল জাদুকর। এবার ভয় পেয়েছে, বুঝতে পেরেছে যে এই মানুষটার উপরে তার জাদু খাটবে না। এ নিশ্চয় সেই ভিনদেশি রাজপুত্র যে জাদুকরকে পরাস্ত করতে পারবে বলে কথা ছিল। মুহূর্তে পরিকল্পনা পাল্টাল; মানুষটার উপরে তার জারিজুরি চলবে না, কিন্তু বানরটার জন্য তো তা নয়। ‘ওইখানেই দাঁড়িয়ে থাক, আর এক পাও এগোবি না। নাহলে তোর সঙ্গীর কি অবস্থা করব তুই ভাবতেও পারছিস না।‘

থমকে গেল রূপকুমার। সুন্দর বলল, ‘আমার কথা ভেবো না। আমার যা হয় হোক, এই বদমাইশটাকে হারাতেই হবে। তুমিই সে কাজ করতে পারো, না হলে এই জাদুকর আরো কতদিন লিমেরিকার সকলের উপর অত্যাচার চালাবে।‘

খুব সাহসী না? ওরে বাঁদর, তোকে মারব না, মেরে ফেললে তো আর তোর বন্ধু আমার কথা শুনবে না। কিন্তু জ্যান্ত রেখেও এমন করব যে তা মৃত্যুযন্ত্রণার থেকেও ভয়ঙ্কর। তোর বন্ধু তখন আমার পায়ে ধরে তোকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ভিক্ষা চাইবে।‘ আবার মন্ত্র পড়ে একটা নীল আগুনের গোলা ছুঁড়ে মারল জাদুকর, এবার লক্ষ্য সুন্দর।

সুন্দর ছিল সিন্দুকের একেবারে সামনে। বাঁদরের ক্ষিপ্রতায় লাফ দিয়ে সরে গেল, নীল গোলাটা এসে লাগল সিন্দুকে। এক মুহূর্তে সিন্দুক ভেঙে চৌচির হয়ে গেল, তার ভিতর থেকে একটা গাঢ় সবুজ রঙের মণি বাইরে গড়িয়ে রূপকুমারের সামনে পড়ল। জাদুকর কিছু বোঝার আগেই রূপকুমার তার উপরে পা চাপিয়ে দিল।

রাজপুত্রের মনের মধ্যে কে যেন বলল, ‘আমাকে ধ্বংস করবে কেন? জাদুকরের থেকে সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তোমাকে দিচ্ছি। আমি তোমাকে অমরত্ব দেব, অসীম সম্পদ দেব, পৃথিবীর সম্রাট বানিয়ে দেব।‘

জাদুকর চিরকাল এমন বদমাইশ ছিল না, কিন্তু সে ছিল মনের দিক থেকে দুর্বল। হঠাৎই একদিন এই মকরত মণি তার হাতে এসেছিল, মণি তাকে এইরকম প্রলোভনই দেখিয়েছিল। লোভ সংবরণ করতে পারেনি জাদুকর, কিন্তু রূপকুমার অন্য ধাতুতে গড়া। সে মনে মনে বলল ‘ আমি অমর হতে চাই না, পৃথিবীর সম্রাট হতেও চাই না।‘ পা দিয়ে চাপ দিল মণিটাতে। এক মুহূর্ত মণিটা যেন বাধা দিল, মনের জোর বাড়াল রূপকুমার। মণিটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল।

এক আর্ত চিৎকার করে জাদুকর মাটিতে পড়ে গেল। জাদুর জোরে মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রেখেছিল এতদিন, সেই ক্ষমতা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহের আর কিছু অবশিষ্ট রইল না, পড়ে রইল শুধু পোশাকটা ।

কে যেন রূপকুমারকে জড়িয়ে ধরল, ‘পেরেছ, তুমি পেরেছ।‘

রূপকু্মার অবাক হতে দেখল ভারি সুন্দর দেখতে একটি তরুণ তাকে জড়িয়ে ধরেছে। এ কোথা থেকে এলো? ওহ, এ নিশ্চয় সুন্দর। জাদুকরের ক্ষমতা ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে আসল রূপ ফিরে পেয়েছে। রাজপুত্রও তাকে জড়িয়ে ধরল, বলল, ‘না, আমি পারিনি। বলো, আমরা পেরেছি। তুমি, আমি, রক্ষ, জাদুদণ্ড, আমরা সবাই মিলে জিতেছি।‘

দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দুজনে দেখল রক্ষ সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে বলল, ‘জানো আমি সব দেখতে সব শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু একটুও নড়তে পারছিলাম না, তোমাদের কোনো সাহায্য করতে পারছিলাম না। তোমাদের অনেক ধন্যবাদ, এবার নিশ্চয় আমার ছেলে মেয়েকে খুঁজে পাব।‘ রক্ষ হাত নেড়ে চলে গেল।

আমিও দেখি আমার বাবা এখানে আছে কিনা।‘

রূপকুমারের মুখে কালো মেঘ ঘনিয়ে এল। ‘আমাকে ফিরে যেতে হবে। অনেকটা রাস্তা, আবার সেই পাহাড়ের গুহা পেরোতে হবে। আমার জল নিয়ে ফেরা পর্যন্ত মা বেঁচে থাকবে তো?’

দরজা থেকে এক অচেনা গলা ভেসে এল। ‘তুমিই নিশ্চয় সেই রাজকুমার যে আমাদের শাপমুক্ত করেছে।‘

বাবা, বাবা,’ সুন্দর গিয়ে জড়িয়ে ধরল।

সুন্দরের পিঠে হাত রেখে সত্যবান বললেন, ‘চিন্তা কোরো না ভিনদেশি রাজকুমার। জাদুকরের প্রাসাদের বাইরে বাঁধা আছে মনপবনের নাও। তুমি কোথায় যেতে চাও ওকে বলো, সে তোমাকে এক দণ্ডে সেখানে নিয়ে যাবে।‘

তাই হল। জাদুকরের প্রাসাদ আর সম্পত্তির সমস্ত দায়িত্ব সত্যবান আর সুন্দরের। যাদের থেকে যা লুঠ করে এনেছে, সম্ভব হলে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। যা অবশিষ্ট থাকবে, তাই দিয়ে বাকি যারা জাদুকরের শিকার তাদের সাহায্য করা হবে।

জাদুদণ্ড কী করবে? রক্ষ তার বন্ধু, সত্যবানের সঙ্গে ছিল, আবার রূপকুমারকেও সাহায্য করেছে। কার সঙ্গে থাকবে সে? রূপকুমার জিজ্ঞাসা করল,

বন্ধুজনের থেকে নেব বিদায়,

জাদুর লাঠি বলো তুমি আমায়,

পথের হল শেষ

ফিরবে অচিন দেশ?

অথবা কি থাকবে লিমেরিকায়?

কুমার, তোমার সঙ্গ কদিন খুব ভালো লেগেছে। তুমি মানুষটি খুব ভালো। সময় যখন আসবে, তুমি যখন রাজা হবে, অচিন দেশের মানুষের অনেক ভালো তুমি করতে পারবে। কিন্তু আমার জাদুবলে আমি শুধু এই দেশের খবরই রাখি, লিমেরিকার বাইরে আমার জাদু কাজ করে না। সত্যবানদের সামনে অনেক কাজ, আমি তাদের সাহায্য করতে পারব। তাই আমার জায়গা এই লিমেরিকাতেই। হয়তো আবার কখনো দেখা হবে।‘

রূপকুমারের মন একটু খারাপ হল, ভারি মায়া পড়ে গিয়েছিল তার উপর। কিন্তু যখন মনে পড়ল যে জাদুদণ্ডের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রতিবার ছড়া বানাতে হবে, তখন মন খারাপটা কিছুটা হলেও কমল।

সুন্দর, সত্যবান, রক্ষ, সবাই বার বার করে বলল আবার আসার কথা। রক্ষ তার ছেলেমেয়েকে ফিরে পেয়েছে। সবাই মিলে রূপকুমারকে ছাড়তে এল। মনপবনের নৌকা তো হাওয়াতে চলে, তার জন্য জল লাগে না। সেটা প্রাসাদের দরজার সামনে বাঁধা ছিল।

নৌকাতে উঠে কোমরের ভিস্তিটা ভালো করে দেখে নিলো রূপকুমার। সবাইকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে নৌকাকে বলল,

ওগো আমার মনপবনের নাও,

ভাসিয়ে নিয়ে আমায় তুমি যাও,

    সাতখানি পাল তুলে

    হাওয়ায় দুলে দুলে

আমার দেশে পৌঁছে তুমি দাও।

নৌকা একটু গা ঝাড়া দিল, তারপর রূপকুমারকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ তোমার দেশ কোথায়? সেখানে   কি সবাই এই রকম এইরকম অদ্ভুত ভাবে ছড়াতে কথা বলে?’

তারপর? তারপর আবার কী? রাজপুত্র ফিরে এল, ফেরার পথে হয়রাজকে নৌকাতে তুলে নিতে ভুলে যায়নি। কুয়োর জলে রানির রোগ সেরে গেল, আমার কথাটি ফুরোল, নটেগাছটি মুড়োল।




No comments:

Post a Comment