Sunday 5 June 2022

ভুলে যাওয়া বিজ্ঞানী ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ

ভুলে যাওয়া বিজ্ঞানী ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


বিজ্ঞানের গবেষণাতে প্রায়শই আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের চোখধাঁধানো আলোতে ঢাকা পড়ে যান পার্শ্বচরিত্ররা। বিশেষ করে যাঁরা গবেষণার পরিকাঠামো নির্মাণে প্রাণপাত করেন, ইতিহাস প্রায়শই তাঁদের ভুলে যায়। অথচ তাঁদের প্রয়াস ছাড়া পরবর্তী প্রজন্মের পক্ষে কাজ শুরু করাই সম্ভব হত না। প্রায়-বিস্মৃত ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ, বা পি এন ঘোষ তেমনই এক ব্যক্তিত্ব। 

ফণীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৮৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বর্তমান দক্ষিণ ২৪ পরগণার মজিলপুর গ্রামে। ছোটবেলাতেই তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটে, তারপর বেশ কষ্টের মধ্যেই তাঁকে পড়াশোনা চালাতে হয়েছিল। বঙ্গবাসী কলেজে থেকে পদার্থবিদ্যার অনার্স নিয়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হওয়ার পরে স্নাতকোত্তর শিক্ষার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এম এ পরীক্ষাতেও প্রথম হওয়ার ফলে সরকারি চাকরির সুযোগ তাঁর সামনে এসেছিল। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা ছিল প্রযুক্তির দিকে, তাই জেসপ ইঞ্জিনিয়ারিঙ ওয়ার্ক্সে তিনি শিক্ষানবীশ হিসাবে কাজ শুরু করেন। তবে ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক অনটনের জন্য আপাতত আশা ছাড়তে হল, ১৯১০ সাল থেকে তিনি বঙ্গবাসী কলেজে পড়ানো শুরু করেন। একই সঙ্গে তিনি নানা শিল্পকে প্রযুক্তি বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। তাঁর পড়ানোর বিশেষ খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল, তাই আশুতোষের আগ্রহে ১৯১৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজ পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রথম দুই পূর্ণসময়ের শিক্ষকের মধ্যে একজন হিসাবে ১৯১৬ সালে যোগ দেন। মাইনে ছিল ২০০ টাকা, বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট ২৫ টাকা। একই সময়ে গবেষক হিসাবে যোগ দিয়ে যাঁরা পদার্থবিদ্যা বিভাগে ক্লাস নিতে শুরু করেন, তাঁদের মধ্যে দুজন আমাদের সুপরিচিত, মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

পরের বছর চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রামন বিভাগে পালিত অধ্যাপকের পদে যোগ দিলেন। ফণীন্দ্রনাথের তখন ৩৩ বছর বয়েস, গবেষণা শুরুর পক্ষে বয়সটা বেশিই। কিন্তু রমনের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি তাঁর সঙ্গে গবেষণা শুরু করেন। ১৯১৮ সালে রমনের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি প্রথম গবেষণাপত্র ছাপেন। নেচার পত্রিকাতে প্রকাশিত সেই চিঠিটির শিরোনাম ছিল, “Colour and Striae in Mica”। এই চিঠিতে লেখকদের ঠিকানা দেওয়া ছিল ২১০ বৌবাজার স্ট্রিট, সেটি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স-এর সেই সময়ের ঠিকানা। রামন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনেও কাজ করতেন। চিঠিটি ছোট হলেও নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী লর্ড র‍্যালের মতো বিশেষজ্ঞের প্রশংসা পেয়েছিল; চিঠির ঠিক নিচে তাঁর যে মন্তব্য ছাপা হয়েছিল আর থেকে একটি বাক্য উদ্ধৃত করি। “Doubtless the Foucault method shows them in a more manner, and, in any case, the colour effects are novel, so far as I know, and worthy of a closer examination”এই বিষয়ে আরো বিস্তৃতভাবে কাজ করে ফণীন্দ্রনাথ পরের বছর এককভাবে প্রসিডিংস অফ দি রয়্যাল সোসাইটিতে একটি গবেষণাপত্র ছাপিয়েছিলেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে পালিত ল্যাবরেটরিতেই কাজটি হয়েছে, এবং লেখকের ঠিকানা ছিল বিজ্ঞান কলেজ। সেই বছরই ফিজিক্যাল রিভিউ পত্রিকাতে আরো একটি গবেষণাপত্র ছাপান পি এন ঘোষ। এই তিনটি ও ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের প্রসিডিংসে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের উপর ভিত্তি করে তিনি “The colours of the striae in mica and other optical investigations” থিসিস জমা দেন ও ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অফ ফিলোজফি ডিগ্রি পান।

বিজ্ঞান কলেজে শুরু হয়েছিল ১৯১৪ সালে দুই ব্যারিস্টারের অর্থসাহায্যে; তারকনাথ পালিত দিয়েছিলেন প্রায় চোদ্দ লক্ষ টাকা, রাসবিহারী ঘোষ দিয়েছিলেন দশ লক্ষ টাকা। তাঁদের দুজনের সেই মোট দান আজকের হিসাবে একশো কোটি টাকারও অনেক বেশি। ১৯১৯ সালে রাসবিহারী ঘোষ আবার এগারো লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন, সেই টাকাতে ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের (Applied Physics Applied Chemistry) দুটি অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা হয়। ডক্টরেট করার পরেই ফণীন্দ্রনাথ ঘোষকে পদার্থবিদ্যাতে পাঁচশো টাকা বেতন ও একশো টাকা গৃহভাতাতে ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যার ঘোষ অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকাতে প্রযুক্তি কেন্দ্রে কাজ করার জন্য দু’বছরের ছুটির জন্য আবেদন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পূর্ণ বেতনে ছুটি অনুমোদন করে, একই সঙ্গে তাঁর বিদেশে খরচের জন্য তিন হাজার টাকা মঞ্জুর হয়। পরের বছর পি এন ঘোষ লন্ডন থেকে যন্ত্র কেনার জন্য একশো পাউন্ডের জন্য আবেদন করেন, ম্যানেজমেন্ট বোর্ড সেই অর্থও মঞ্জুর করে, শর্ত ছিল যন্ত্রটি হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি। জার্মানিতে সিমেন্স কোম্পানিতেও তিনি কিছুদিন কাটান। তিনি কলকাতাতে ফিরে আসেন ১৯২২ সালের নভেম্বর মাসে। অল্পদিন জার্মানিতে কাটালেও তিনি জার্মান ভাষাতে অনর্গল কথা বলতে পারতেন।

১৯২৫ সালে থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যা আলাদা বিষয় হিসাবে পড়ানো শুরু হয়, তবে আলাদা বিভাগ হিসাবে তা রূপ নেয় ১৯৩০ সালে। কিন্তু বাস্তবে ফণীন্দ্রনাথ আলাদা বিভাগেই কাজ করছিলেন, ১৯২৪ সাল থেকেই দেখি সেনেট বা সিন্ডিকেটের কার্যবিবরণীতে ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যা বিভাগের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। ফণীন্দ্রনাথকে নিজের হাতে করে ল্যাবরেটরি তৈরি করতে হয়েছিল। দীর্ঘদিন বিভাগে তাঁকে নিয়ে শিক্ষকের সংখ্যা ছিল মাত্র দুই। তাই হয়তো এই পর্বে তাঁর গবেষণাপত্রের সংখ্যা খুব বেশি নয়। ১৯২৯ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে তিনি ১৪টি গবেষণাপত্র ছাপিয়েছিলেন, তার মধ্যে চারটি যন্ত্রপাতি সংক্রান্ত, বাকিগুলি অণুর বর্ণালীবিশ্লেষণ বিষয়ে। একটি ছোট ঘর ও দুটি ডিসি মোটর দিয়ে শুরু করে তিনি যে ল্যাবরেটরি তৈরি করেছিলেন, ইউরোপ আমেরিকার বাইরে তার তুলনা সেই যুগে বিশেষ ছিল না। বর্ণালীবীক্ষণ, তড়িৎপ্রবাহ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি কাজ করতেন এবং ন্না যন্ত্র বানিয়েছিলেন। ১৯৪১ সালে বিজ্ঞান কংগ্রেসে তিনি পদার্থবিদ্যা বিভাগের সভাপতি হয়েছিলেন।

আজ যে শিল্প ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গাঁটছড়ার উপরে জোর দেওয়া হয়, আমাদের দেশে পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে সেই কাজটি প্রথম যাঁরা করেছিলেন, ফণীন্দ্রনাথ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি যে বিভাগের সূচনা করেছিলেন, তখন তা বিজ্ঞানের মধ্যে গণ্য হলেও বর্তমানে সেখানে বি টেক ও এম টেক পড়ানো হয়, গবেষণাও হয় প্রযুক্তি বিষয়ে। ফণীন্দ্রনাথ ইন্ডাস্ট্রিয়াল সার্ভে কমিটি অফ বেঙ্গল-এর সভাপতি ও বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ বোর্ডের সহ-সভাপতি হিসাবে কাজ করেছিলেন। ১৯৩৮ সালে মেঘনাদ সাহার উদ্যোগে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি তৈরি করেছিল; পি এন ঘোষ তার বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সংক্রান্ত উপসমিতির সভাপতি হয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।


তথ্যসূত্রঃ


Phanindra Nath Ghosh, A. K. Sengupta, Biographical Memoirs of the Members of the Indian National Science Academy

The Dazzling Dawn: Physics Department of Calcutta University (1916-1936), Gautam Gangopadhyay, Anirban Kundu and Rajinder Singh, Shaker Verlag

Minutes of the Senate and Syndicate of the University of Calcutta for various years

 

প্রকাশঃ অণুমনস্ক ২০২২ 

No comments:

Post a Comment