Thursday, 4 July 2024

বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানীদের জীবনচরিত

 


বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানীদের জীবনচরিত

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


স্মরণীয় ব্যক্তিদের জীবনী লেখার রীতি অনেক আগে থেকেই আছে। প্রাচীনকালে সাধারণত রাজাবাদশা বা তাঁদের পারিষদদের জীবন সাহিত্যের বিষয় হত। আমাদের দেশে বাণভট্টের হর্ষচরিত, কল্‌হনের রাজতরঙ্গিনী -- এমন আরও অনেক উদাহরণ আছে। তার সহজ কারণ হল কবি বা লেখকরা সমাজের উঁচুতলার লোকদের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করতেন। ছাপাখানা আবিষ্কার হওয়ার আগে বইয়ের দাম ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, সুতরাং তাঁদের অন্য কোনো উপায়ও ছিল না।

এই কারণে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অভিজাত নয় এমন মানুষদের সম্পর্কে আমাদের কাছে প্রায় কোনো খবরই এসে পৌঁছায়নি। যেমন সংস্কৃত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি কালিদাস, তাঁর সম্পর্কে আমরা খুব কম জানি। কোথায় তাঁর জন্ম, কোথায় তিনি কাব্য রচনা করেছিলেন, কোন রাজার রাজসভায় ছিলেন, তাঁর রচনা থেকে সেই সব খবর বার করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তার অনেকটাই অনুমান; পণ্ডিতরাও তা নিয়ে একমত নন। একই কথা প্রাচীন যুগের বিজ্ঞানীদের সম্পর্কেও বলা চলে। আবার আমাদের দেশে সাল তারিখ লেখার ব্যাপারে এক অদ্ভুত ঔদাসীন্য ছিল, সেই কারণে প্রাচীন বিজ্ঞানীদের মধ্যে একমাত্র আর্যভাট ছাড়া আর কোনো বিখ্যাত বিজ্ঞানীর জন্মকাল আমরা জানি না। আর্যভাট নিজের বইতে নিজের জন্মকাল লিখে গেছেন, কিন্তু তিনি ভারতের কোন অংশের মানুষ ছিলেন, তা জানা নেই।

আরো একটা কারণে সাধারণ মানুষের কথা সাহিত্যে লেখা হত না। পুরানো কালে মানুষের চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে ছিল ঈশ্বর, ধর্ম, পরলোক, ইত্যাদি। তাই সে যুগের সাহিত্যেও এই সমস্ত নিয়েই বেশি ব্যাস্ত ছিল। রামায়ণ মহাভারতের মতো মহাকাব্য হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ ধর্মগ্রন্থ হিসাবে ভক্তিভরে পড়ে আসছে। রাজাদের ছাড়া তাই জীবনী লেখা হয়েছিল ধর্মপুরুষদের। যেমন শ্রীচৈতন্যদেবের জীবন নিয়ে লেখা কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃত। লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল বা বৃন্দাবন দাসের লেখা চৈতন্য ভাগবত বাংলা সাহিত্যের প্রথম যুগের জীবনীদের মধ্যে পড়বে।

আধুনিক যুগে কিন্তু মানুষ ও প্রকৃতি এসে দাঁড়িয়েছিল আমাদের চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে; তখন থেকে যাঁরা আমাদের সেই চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করেছেন, সেই সব মানুষের জীবনী লেখার প্রয়োজন মনে হয়েছিল। আধুনিক যুগকে যে আমরা বিজ্ঞানের যুগ বলি, তার কারণ নিছক এই নয় যে এই যুগে অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবন হয়েছে। বিজ্ঞানের একটা বৈশিষ্ট্য হল যে যা আমরা জানি, তাকেই আরো ভালোভাবে জানতে চাওয়া, তাকে প্রশ্ন করা, পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে তাকে যাচাই করা। মধ্য যুগে এই কথা বিশেষ কারো মাথায় আসেনি। ধর্মগ্রন্থে যা লেখা আছে বা প্রাচীন মনীষিরা যা বলে গেছেন, তাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করাটাই ছিল অভ্যাস। আধুনিক বিজ্ঞান ঠিক এই জায়গাকে ধাক্কা দিয়েছিল; তার ফলেই আধুনিক যুগের জন্ম হয়েছিল। এখনি আমরা যে সমস্ত লেখার কথায় আসব, তাদের একটির থেকে উদ্ধৃত করি, “তৎকালীন লোকদিগের এই রীতি ছিল, পূবাচার্যেরা যাহা নির্দেশ করিয়া গিয়াছিলেন, কোনও বিষয়, তাহার বিরুদ্ধ বা বিরুদ্ধবৎ আভাসমান হইলে, তাঁহা শুনিতে চাহিতেন না।" আজ থেকে একশো পঁচাত্তর বছর আগে এই কথাটা কে লিখেছিলেন? ছাত্রদের জন্য লেখা 'জীবনচরিত' বইতে লিখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

সেটা ছিল উনিশ শতক, যখন বিদেশি শাসনের হাত ধরে আসা আধুনিক দর্শন ও সংস্কৃতি যখন আমাদের সমাজকে ধাক্কা মারতে শুরু করেছে। জীবনী কেন পড়ব, তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বইয়ের ভূমিকাতে বলেছেন, "প্রথমতঃ, কোন কোন মহাত্মারা অভিপ্রেতসাধনে কৃতকার্য্য হইবার নিমিত্ত যেরূপ অক্লিষ্ট পরিশ্রম, অবিচলিত উৎসাহ, মহীয়সী সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তর অধ্যবসায় প্রদর্শন করিয়াছেন ... তৎসমুদায় আলোচনা করিলে এক কালে সহস্র উপদেশের ফল প্রাপ্ত হওয়া যায়। দ্বিতীয়তঃ, আনুষঙ্গিক তত্তদ্দেশের তত্তৎকালীন রীতি, নীতি, ইতিহাস ও আচার পরিজ্ঞান হয়।" বিদ্যাসাগর যেমন মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী থেকে প্রেরণা ও উপদেশ নিতে বলছেন, তেমনি তাঁরা যে সমাজের মানুষ সেই সমাজ সম্পর্কেও জ্ঞানলাভ করতে বলছেন।

এটি বিদ্যাসাগরের মৌলিক রচনা নয়, রবার্ট চেম্বার ও উইলিয়াম চেম্বার্স ইংরাজিতে যে সমস্ত জীবনী লিখেছিলেন, তাদের কয়েকটির অনুবাদ। বিদ্যাসাগর বিজ্ঞানজগতের লোক ছিলেন না; সেই সময় আমাদের দেশে আধুনিক বিজ্ঞানের পড়াশোনাও শুরু হয়নি। কিন্তু তিনি অনুবাদের জন্য যাঁদের জীবনী বেছে নিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই বিখ্যাত বিজ্ঞানী। তোমরা সবাই তাঁদের নাম জানো -- কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, উইলিয়াম হার্শেল, ক্যারোলাস লিনিয়াস। বিদ্যাসাগর ছিলেন সব অর্থেই একজন আধুনিক মানুষ। নারীদের শিক্ষা বিস্তার, বিধবা বিবাহের প্রচলন, এ সমস্ত কথা তোমরা সবাই জানো। তিনি বুঝেছিলেন যে এঁদের মতো বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকেই আধুনিক যুগের জন্ম। তাঁর আশা ছিল যে এই সব জীবনী আমাদের দেশের মানুষকে আধুনিক বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সচেতন করবে, পুরানো রীতিনীতিকে প্রশ্ন করতে শেখাবে এবং এক আধুনিক সমাজের দিকে নিয়ে যাবে। বিদ্যাসাগরকে আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়; অর্থাৎ বাংলা গদ্যের প্রায় সূচনালগ্নেই বিজ্ঞানীদের জীবনী ছাত্রদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।

বিদ্যাসাগর এর বাইরে বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানী নিয়ে বিশেষ কিছু লেখেননি, কিন্তু তাঁর অন্য সূত্র থেকে তাঁর মত সম্পর্কে জানা যায়। তোমরা বড় হয়ে বিজ্ঞানের দর্শন সম্পর্কে পড়বে। ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনকে আধুনিক বিজ্ঞানের দর্শনের জনক বলে অনেকে মনে করেন; তিনি পরীক্ষানিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের উপর জোর দিয়েছিলেন । বিদ্যাসাগরের চিঠি ও অন্যান্য কিছু কাগজপত্র থেকে জানা যায় তিনি বেকনের মতকেই অনুসরণ করতেন। বিদ্যাসাগরের বন্ধু অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন বেকনের আর একজন ভাবশিষ্য, তিনি বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান নিয়ে অনেক বই লিখেছিলেন।

অক্ষয়কুমারের পরে বাংলায় বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখিতে যাঁর নাম করতে হয়, তিনি হলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। প্রেসিডেন্সি কলেজ যখন থেকে বিজ্ঞানে মাস্টার্স পড়ানো শুরু করে, সেই বছর তিনি রসায়নে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন। বিজ্ঞান বিষয়ে অনেক লেখালেখি করলেও বিজ্ঞানীদের জীবনী তিনি একটি মাত্র লিখেছেন, তা হল হেরমান ফন হেলমহোলজ্‌-এর জীবনী। হেলমহোলজ্‌ উনিশ শতকের বিখ্যাততম বিজ্ঞানীদের অন্যতম, তোমরা স্কুলে যে শক্তির নিত্যতা সূত্র পড়েছ, তার কথা তিনিই প্রথম বলেছিলেন। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত ও শারীরবিদ্যা নানা বিষয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। তিনি ১৮৯৪ সালে প্রয়াত হন। তাঁর মৃত্যুর কয়েক মাস পরে রামেন্দ্রসুন্দর এক প্রবন্ধে তাঁর গবেষণার বিস্তারিত পরিচয় দিয়েছিলেন।

ছোটরা এই লেখাটি পড়ে নিশ্চয় লাভবান হবে, কিন্তু এই লেখাটি তিনি আলাদা করে ছোটদের জন্য লেখেননি। তিনি কলেজে পড়াতেন, তাই তাঁর অধিকাংশ বিজ্ঞান লেখাই বড় ছাত্রদের জন্য। এবার আর একজনের কথা বলি, আঁর লেখা তোমরা সবাই পড়েছ, তিনি সুকুমার রায়। মজার মজার নানা লেখার জন্য বিখ্যাত হলেও তিনি বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর প্রবন্ধ লিখেছেন, সে সবই ছোটদের জন্য। সুকুমার ১৯০৭ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে একই সঙ্গে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে অনার্স নিয়ে পাস করেন। তাঁর বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি তাঁকে ইংল্যান্ডে পাঠান। সেখানে তিনি ফটোগ্রাফি ও প্রিন্টিং, অর্থাৎ আলোকচিত্র ও মুদ্রণ বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। বিজ্ঞানের অনেক প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন, আর ছোটদের জন্য লিখেছিলেন আর্কিমিডিস, গ্যালিলিও, লুই পাস্তুর ও ডারউইনের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবনী। খুব অল্পবয়সে সুকুমার মারা যান, এ বাংলা সাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি।

আমরা তাঁর ডারউইন প্রবন্ধটার দিকে একটু চোখ রাখি। সুকুমার বিজ্ঞানের মূল কথাটাই কত সহজ করে লিখেছেন দেখো; "ছেলেবেলায় ভাবিতাম, পণ্ডিতদের খুব বুদ্ধি বেশি, তাই তাঁহারা অনেক কথা জানিতে পারেন। কিন্তু এখন দেখিতেছি কেবল তাহা নয়। বুদ্ধি ত বটেই, তাছাড়া আরও কয়েকটি জিনিস চাই, যাহা না থাকিলে কেহ কোনদিন যথার্থ পণ্ডিত হইতে পারে না। তাহার মধ্যে একটি জিনিস, ঠিকমতো দেখিবার শক্তি। সাধারণ লোকে যেমন দুই-একবার চোখ বুলাইয়া মনে করে ইহার নাম 'দেখা'—পণ্ডিতের দেখা সেরকম নয়। তাঁহারা একই বিষয় লইয়া দিনের পর দিন দেখিতেছেন, তবু দেখার আর শেষ হয় না।" বারবার একই জিনিস দেখতে হবে, সেই দেখাকেও প্রশ্ন করতে হবে -- বিজ্ঞানের এক মূল কথা।

একটু বড় উদ্ধৃতি হলেও দেখো কি চমৎকার ভাষায় সুকুমার ডারউনের বিবর্তনতত্ত্ব বুঝিয়েছেন! "ডারুইন দেখিলেন, মানুষের বুদ্ধিতে যেমন নানারকম বাছাবাছি চলে, প্রাণিজগতেও সর্বত্রই স্বাভাবিকভাবে সেইরূপ বাছাবাছি চলে। যারা রুগ্ন যারা দুর্বল মরিবার সময় তাহারাই আগে মরে, যাহারা বাহিরে নানান অবস্থার মধ্যে আপনাকে বাঁচাইয়া রাখিতে পারে, তাহারাই টিকিয়া যায়। কাহারও গায়ে জোর বেশি, সে লড়াই করিয়া বাঁচে; কেহ খুব ছুটিতে পারে, সে শত্রুর কাছ হইতে পলাইয়া বাঁচে; কাহারও চামড়া মোটা, সে শীতে কষ্ট সহিয়া বাঁচে; কাহারও হজম বড় মজবুত, সে নানা জিনিস খাইয়া বাঁচে; কাহারও গায়ের রং এমন যে হঠাৎ চোখে মালুম হয় না, সে লুকাইয়া বাঁচে। বাঁচিবার মতো গুণ যাহার নাই সে বেচারা মারা যায়, আর সেই সব গুণ আর লক্ষণ যাহাদের আছে তাহারাই বাঁচিয়া থাকে, তাহাদেরই বংশ বিস্তার হয়, আর বংশের মধ্যে সেইসব বাছা বাছা গুণগুলিও পাকা হইয়া স্পষ্ট হইয়া উঠে। এইরূপ আপনাকে বাঁচাইবার জন্য সংগ্রাম করিতে করিতে, বাহিরের নানা অবস্থার মধ্যে প্রত্যেক জন্তুর চেহারা নানারকম গড়িয়া ওঠে।"

এবার কয়েকজন জীবনীকারের কথা বলব, যাঁরা নিজেরাও বিখ্যাত বিজ্ঞানী। তোমরা সবাই তাঁদের নাম জানো। প্রথমজন হলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, যিনি আমাদের দেশে আধুনিক রসায়ন গবেষণার সূচনা করেন। তিনি বাংলাতে অনেক লেখালেখি করেছেন, এমনকি স্কুলের ছাত্রদের জন্য জীবন বিজ্ঞান বইও লিখেছেন। তবে জীবনী প্রবন্ধ তিনি একটি লিখেছেন, লুই পাস্তুরের উপর সেই লেখাটিতে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন সত্যপ্রসাদ রায়চৌধুরী।

পরের দু'জন প্রফুল্লচন্দ্রের ছাত্র সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা। দুজনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব ছিল; তাঁরা একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন, গবেষণা করেছেন, আবার একসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁরা লেখালেখি করেছেন, এবং সেখানে কয়েকজন বিজ্ঞানীর সম্পর্কে লিখেছেন। সেই লেখার সবগুলিকে ঠিক জীবনী বলব না। অনেক সময় তাঁরা তাঁদের পরিচিত সমসাময়িক কয়েকজন বিজ্ঞানীর গবেষণা সম্পর্কে লিখেছেন, সেই প্রসঙ্গে হয়তো কখনো কখনো জীবনের কথাও এসেছে। যেমন ১৯২১ ও ১৯২২ সালে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত তিন বিজ্ঞানীর কথা লিখেছেন মেঘনাদ, তাঁরা হলেন আলবার্ট আইনস্টাইন, নিলস বোর ও ফ্রান্সিস অ্যাস্টন। মেঘনাদের সঙ্গে এঁদের সকলেরই আলাপ ছিল। বিজ্ঞানের বাইরেও আইনস্টাইন ও অ্যাস্টনের জীবনের কিছু কথা সেখানে জানতে পারি। সত্যেন্দ্রনাথ কয়েকজন বিজ্ঞানীর জীবন নিয়ে লিখেছেন; তাঁদের মধ্যে আছেন গ্যালিলিও, আইনস্টাইন, মাদাম কুরি। তোমরা নিশ্চয় আইনস্টাইন ও সত্যেন্দ্রনাথের সম্পর্কের কথা জানো, কলেজে পদার্থবিদ্যাতে বোস-আইনস্টাইন সমীকরণ পড়ানো হয়। মাদাম কুরির ল্যাবরেটরিতে সত্যেন্দ্রনাথ কয়েকমাস কাটিয়েছেন। লেখা থেকে দেখতে পাই দুজনের প্রতিই সত্যেন্দ্রনাথের ছিল অসীম শ্রদ্ধা।

মেঘনাদ বা সত্যেন্দ্রনাথের মতো বিজ্ঞানীরা কেন হঠাৎ বিজ্ঞানীদের জীবন নিয়ে লিখতে বসলেন? গ্যালিলিওর সম্পর্কে প্রবন্ধের শেষে সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ (গ্যালিলিও) বলেছিলেন নিজে পরীক্ষা, বিচার ও যাচাই করে নিতে হবে সব সত্যকে -- শুধু আপ্তবাক্যকে বিশ্বাস করে জীবনকে গড়ে তুললে ভুল হবে।" আমরা বুঝতে পারি যে সত্যেন্দ্রনাথ গ্যালিলিও জীবনের মাধ্যমে আমাদের বিজ্ঞানের পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষা দিতে চাইছেন। অ্যাস্টন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মেঘনাদ লিখেছেন তিনি পড়াশোনাতে মোটেই ভালো ছিলেন না। "তাঁহার খুব প্রখর বুদ্ধি বা প্রতিভা নাই। কিন্তু আছে অদম্য উৎসাহ, ও অধ্যবসায় ও চেষ্টা।" তার জোরেই তিনি নোবেল পুরস্কারের যোগ্য কাজ করেছেন। সুকুমারও প্রায় একই কথা লিখেছেন ডারউইন সম্পর্কে, “তাঁহাকে কেহ বুদ্ধিমান বলিয়া জানিত না, মাস্টারেরা তাঁহার উপর কোনদিনই কোন আশা রাখেন নাই—বরং সকলে দুঃখ করিত 'এ ছেলেটার আর কিছু হইবে না।' অথচ এই ছেলেই কালে এক অসাধারণ পণ্ডিত হইয়া সমস্ত পৃথিবীতে আপনার নাম রাখিয়া গিয়াছেন।" তোমাদেরও বলি, একটা দুটো পরীক্ষাতে খারাপ হয়েছে বলে ভেঙে পড়ার কিছু নেই। ডারউইন বা অ্যাস্টনের জীবন আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।

আমরা যে সব লেখার কথা বললাম, সেগুলি এক একটা প্রবন্ধ, অল্প কথায় যেখানে জীবনের পরিচয় দেওয়া আছে। সাধারণত সেগুলি নানা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সুকুমার রায়ের প্রায় সব লেখাই ছোটদের পত্রিকা সন্দেশ-এ বেরিয়েছিল। প্রফুল্লচন্দ্রের লেখা পাস্তুরের জীবনীটি প্রকাশিত হয়েছিল বিখ্যাত প্রবাসী পত্রিকাতে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান প্রচারের জন্য সত্যেন্দ্রনাথ বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরিষদের পত্রিকা জ্ঞান ও বিজ্ঞান-এ তঁর অনেকগুলি লেখা বেরিয়েছিল।

তোমাদের হয়তো মনে হচ্ছে, এতক্ষণ শুধু বিদেশী বিজ্ঞানীদের কথাই বললাম, আমাদের ভারতবর্ষের বিজ্ঞানীদের জীবনী নিয়ে কি কেউ লেখেননি? নিশ্চয় লিখেছেন, কিন্তু ভালো লেখা এসেছে অনেক পরে। তার একটা কারণ আগেই বলেছি, প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে আমরা খুব কম খবর পেয়েছি। তাই তাঁদের জীবনীতে তথ্য কম, গল্প বেশি। ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়েছিল দুজনের হাত ধরে, আচার্য জগদীশচন্দ্র ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র। সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ দুজনেই এঁদের সম্পর্কে লিখেছেন। কিন্তু তাঁরা এঁদের ছাত্র, তাই সেই সব লেখাকে জীবনী না বলে স্মৃতিচারণ বলাই ভাল। পরবর্তীকালে ভারতীয় ও বিদেশী বিজ্ঞানীদের পূর্ণাঙ্গ জীবনীও লেখা হয়েছে বেশ কিছু, তার মধ্যে অনেকগুলিতে তাঁদের গবেষণার কথা আলোচনা আছে। তোমরা আরো বড় হলে তা বুঝতে পারবে। কিন্তু পুরোপুরি না বুঝলেও সেইসব বই পড়তে তোমাদের ভাল লাগবে বলেই আমার বিশ্বাস। প্রকৃতিবিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের জগদীশচন্দ্রের অধীনে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে গবেষণা করেছিলেন, তিনি লিখেছেন জগদীশচন্দ্রের জীবনী। সত্যেন্দ্রনাথের ছাত্রী পূর্ণিমা সিংহ প্রথম মহিলা যিনি ভারতের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যাতে ডক্টরেট করেছেন। তিনি তাঁর মাস্টারমশায়ের জীবনী লিখেছেন। মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথের ছাত্ররা অনেকেই বিজ্ঞানে নাম করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের শিক্ষকদের কথা লিখেছেন। এঁদের মধ্যে জয়ন্ত বসু ও শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। প্রফুল্লচন্দ্র, সি ভি রামন, মেঘনাদ, সত্যেন্দ্রনাথ, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, গোপালচন্দ্র, শ্রীনিবাস রামানুজন, হোমি ভাভা বা তাঁদের সমসাময়িক ভারতীয় বিজ্ঞানীদের জীবনকথা আরো অনেকেই লিখেছেন। এই লেখাতে আমরা আর সেই সব কথাতে যাব না, তোমরা তোমাদের বাবা মা বা স্কুলের শিক্ষকশিক্ষিকাদের থেকে অনেক বিজ্ঞানীর জীবনীর খবর পাবে। পুরানো লেখা উদ্ধৃতির সময় সেই যুগের বানান ও ভাষা পাল্টালাম না, আশা করি তোমাদের পড়তে অসুবিধা হবে না।

 

ছোটদের আলোলিকা শারদীয় ২০২৪