Sunday, 17 November 2024

নিউক্লিয় প্রযুক্তি - কিছু ব্যবহার

নিউক্লিয় প্রযুক্তি - কিছু ব্যবহার

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


নিউক্লিয় প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব, তেমনি পরমাণু অস্ত্রেও তার প্রয়োগ হয়। এই দ্বিতীয়টির জন্য নিউক্লিয়াস কথাটা শুনলেই অনেকেই ভয় পেয়ে যান। অথচ এই প্রযুক্তি এখন বহু জায়গায় ব্যবহার হয়। চিকিৎসাতে ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই), পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি (পেট) ইত্যাদি যে সমসত কথা আমরা প্রায়ই শুনতে পাই, এগুলি সবই তার অবদান। ক্যান্সারের চিকিৎসাতেও যুগান্তর আনছে এই প্রযুক্তি। চিকিৎসা বা শক্তি উৎপাদনের কথা লিখতে গেলে প্রবন্ধ দীর্ঘ হয়ে যাবে, কিন্তু তার বাইরেও নিউক্লিয় প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তার সামান্য কয়েকটা উদাহরণ এই লেখাতে আমরা দেখব।

আমাদের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে খাবারদাবার তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়, তাই তা সংরক্ষণে রাসায়নিক প্রিজার্ভেটিভ ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতির অনেক সমস্যা আছে, পরিবর্তে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ প্রয়োগ করা যায়। খাবার মূলত নষ্ট হয় তার মধ্যে থাকা জীবাণুর জন্য। আবার আলু বা পিঁয়াজের মতো সবজির ক্ষেত্রে বেশিদিন রাখলে কল বেরিয়ে নতুন চারা জন্ম হলে সেটি খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায়। বাইরে থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ খাবারের উপর ফেললে জীবাণু মারা যায়, সবজিরও নতুন গাছ জন্মানোর ক্ষমতা লোপ পায়। ফলে খাবার বহুদিন পর্যন্ত ভালো থাকে। ভারত সহ অনেক দেশে এখন এই পদ্ধতি চালু হয়েছে। এই পদ্ধতিতে এমন বিকিরণ ব্যবহার করা হয় যার থেকে খাবারের মধ্যে তেজস্ক্রিয়তা জন্মানোর কোন সম্ভাবনা নেই। তবে তেজস্ক্রিয়তার শুনলেই অনেকে ভয় পান, তাই বহু পরীক্ষানিরীক্ষাতেও কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ার খবর না থাকলেও অনেকে এই ধরনের খাবার খেতে চান না। আবার বর্তমানে বিকিরণের সাহায্যে শহরের জঞ্জালকে জীবাণুমুক্ত করা শুরু হয়েছে, তারপর তাকে কৃষিতে সার হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ আছে। একই ভাবে চিকিৎসাতে ব্যবহৃত সামগ্রী, প্রসাধনী দ্রব্য, কন্ট্যাক্ট লেন্স ইত্যাদিকে জীবাণুমুক্ত করা হয়।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ এক প্রধান হাতিয়ার হল নিউক্লিয় বিজ্ঞান। বিকিরণ কোশের মৃত্যু ঘটায়। কিন্তু স্বল্পমাত্রার বিকিরণ অনেক সময় জীবকোশে ডিএনএ-র পরিবর্তন ঘটায়, ফলে তার মধ্যে নতুন কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হতে পারে যা আমাদের পক্ষে উপকারী। প্রকৃতিতেও স্বাভাবিক ভাবে এই পরিবর্তন ঘটে, তাকে বলে পরিব্যক্তি (Mutation)। এর ফলেই নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রকৃতিতে এই পরিবর্তন ঘটে অনেক ধীরে, বহু যুগ ধরে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ প্রয়োগ করে পরিব্যক্তির হার বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব; তার পর তার থেকে প্রয়োজনীয় গুণগুলি বেছে নেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে এমন শস্য বা গাছ তৈরি সম্ভব হয়েছে যার ফলন বা রোগপ্রতিরোধক্ষমতা অনেক বেশি। অন্যান্য অনেক ধরনের উপকারী উদ্ভিদও সৃষ্টি করা গেছে।

ক্ষতিকর পোকামাকড় কমানোর ক্ষেত্রে নিউক্লিয় প্রযুক্তি প্রয়োগ করে বিশেষ সুফল পাওয়া গেছে। উত্তর ও মধ্য আমেরিকার স্ক্রু-ওয়ার্ম মাছি ছিল গবাদি পশুর পক্ষে বিপজ্জনক। গামা রশ্মির সঠিক পরিমাণ প্রয়োগের মাধ্যলে পুরুষ মাছিদের বন্ধ্যা অর্থাৎ বংশ বিস্তারে অক্ষম করা হয়। বহু সংখ্যক এমন মাছিকে পরিবেশে ছেড়ে দেওয়া হয়। নারী স্ক্রু-ওয়ার্ম মাছি জীবনে একবারই মিলিত হয়, বন্ধ্যা পুরুষ মাছিদের সঙ্গে সঙ্গমের ফলে সে আর বংশবিস্তার করতে পারে না। পরবর্তী প্রজন্মে মাছির সংখ্যা হ্রাস পায়। এভাবে উত্তর ও মধ্য আমেরিকা থেকে এই বিপদকে নির্মূল করা গেছে। একে বলে স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক। এই পদ্ধতির দুটি সুবিধা, প্রথমত পরিবেশে নতুন ধরনের কোনো জীবকে প্রবেশ করানো হল না। বন্ধ্যা হওয়ার ফলে এই জিন ছড়িয়ে পরার আশঙ্কা নেই। দ্বিতীয়ত রাসায়নিক কীটনাশকের মতো পরিবেশ দূষণের ও সম্ভাবনা নেই। আফ্রিকার সিসি মাছি, ভূমধ্যসাগর ও মেক্সিকোর ফ্রুট ফ্লাই ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে এই পদ্ধতি সফল হয়েছে। বর্তমানে আফ্রিকাতে ম্যালেরিয়া দূর করার জন্য অ্যানোফিলিস মশার উপরে তার প্রয়োগ চলছে। ফুড এন্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন ও ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এজেন্সির ডাটাবেসে তিনহাজার চারশোরও বেশি প্রজাতির তালিকা আছে যাদের জিনে বিকিরণের মাধ্যমে পরিবর্তন করা হয়েছে। একমাত্র চালেরই আটশো তিয়াত্তর রকম ভ্যারাইটি আছে।

কোনো যৌগের পরমাণুতে সাধারণ আইসোটোপের বদলে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করলে তাকে বলে ট্রেসার। অনেক শিল্পে পাইপের মাধ্যমে তরল বা গ্যাসীয় জ্বালানি পাঠানো হয়; সন্দেহ করা হচ্ছে যে কোনো জায়গায় ছিদ্র বা ফাটল হয়েছে কিন্তু পাইপের দৈর্ঘ্য এত বেশি বা এমন ভাবে রয়েছে যে খুঁটিয়ে দেখা প্রায় অসম্ভব। যদি ওই জ্বালানির সঙ্গে কোনো তেজস্ক্রিয় আইসোটোপকে ট্রেসার হিসাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সে ওই ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে আসবে। তেজস্ক্রিয়তা অনেক দূর থেকেই যন্ত্রে ধরা পড়ে, তখন সেই ছিদ্র কোথায় হয়েছে সহজেই বোঝা সম্ভব। তেমনি যদি পাইপলাইনে কোথাও বাধা তৈরি হয়, তাও বাইরে থেকে ট্রেসারের সাহায্যে বোঝা সম্ভব। ট্রেসার ঐ জায়গায় জমা হবে, ডিটেক্টর দিয়ে পাইপের বাইরে থেকেই বোঝা যাবে বাধাটা কোথায়; তার জন্য পাইপ খোলার দরকার পড়বে না। রক্তসঞ্চালনের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি কাজে লাগে। ট্রেসারের সাহায্যে পাইপের মধ্যে দিয়ে তরল বা গ্যাসের প্রবাহের মাত্রা সহজেই বাইরে থেকে মাপা সম্ভব। একই পদ্ধতি শহরের দূষিত জল পরিশুদ্ধ বা নিষ্কাশনী পদ্ধতিতে কাজে লাগানো হচ্ছে।

ভূগর্ভস্থ অর্থাৎ মাটির তলার জলের বয়স ও কোন পথে তা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে নেমে আসে তা দেখতে সাহায্য করে নিউক্লিয় প্রযুক্তি। বায়ুমণ্ডলের নানা পরমাণু ও মহাজাগতিক রশ্মির বিক্রিয়াতে নানা তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস তৈরি হয় এবং পৃথিবীপৃষ্ঠের জলে মেশে। জল মাটির তলায় যাওয়ার পরে নতুন করে এই সব নিউক্লিয়াস আর তার সঙ্গে মেশে না। তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের পরে কত পরিমাণ আইসোটোপ অবশিষ্ট আছে তা জেনে সেই জলের বয়স বা সে কোন পথে ঢুকেছে এই সমস্ত জানা যায়। অস্ট্রেলিয়াও সাহারা মরুভূমির ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি খুব সাফল্য পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার মধ্যভাগের গ্রেট আর্টেজিয়ান বেসিনের জলের পরিমাণ64,900 ঘন কিলোমিটার, জানা গেছে তার বয়স দশ লক্ষ বছরেরও বেশি। আমরা জানি যে পৃথিবীতে জল সঙ্কট আসন্ন, সেই সমস্যার কিছুটা সমাধান করতে ভূগর্ভস্থ জলের উৎস ইত্যাদি অনুসন্ধানে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জলে আর্সেনিক দূষণের সমস্যার সমাধানে ভূগর্ভস্ত জলের মধ্যে আর্সেনিকের পরিমাণ ও তার বয়স এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করা হয়েছে।

হিরে, নীলনান্তমণি, পোখরাজ ইত্যাদি অনেক ধরনের দামি পাথরের রং ও জৌলুষ বাড়াতে নিউক্লিয় প্রযুক্তি কাজে লাগানো হয়। এই সমস্ত পাথরের উপর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ফেলা হয়। এরা সবাই হল কেলাস বা ক্রিস্টাল। কেলাসের মধ্যে পরমাণুরা নির্দিষ্ট সজ্জায় থাকে, পরমাণুর ইলেকট্রনগুলি নিজেদের মধ্যে বন্ড বা বন্ধনী তৈরি করে। বিকিরণের আঘাতে বন্ড ভেঙে যায়, ফলে কেলাসের আলোক শোষণ ও নির্গমন ধর্মের পরিবর্তন ঘটে। এই ভাবে কেলাসের মধ্যে কালার সেন্টার তৈরি হয় এবং তার রঙ বদলে যায়। এই সমস্ত পাথর রঙ ও দীপ্তির জন্য অনেক বেশি দামে বিক্রি হয়। অবশ্য অনেক সময়ে বিকিরণের প্রভাবে তেজস্ক্রিয় মৌল পাথরের মধ্যে তৈরি হয়, তখন তেজস্ক্রিয়তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বিকিরণ সীমার নিচে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

তেজস্ক্রিয়তার আর একটা ব্যবহার আমরা সবাই প্রায়ই দেখতে পাই। অগ্নিকাণ্ডের জন্য সাবধানতা হিসাবে আধুনিক অফিস, হোটেল, শপিং মল, এমনকি অনেক বাড়িতেও আজকাল স্মোক ডিটেক্টর ব্যবহার করা হয়। এই ডিটেক্টরের মধ্যে থাকে আমেরিসিয়ামের তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস, এর থেকে আলফা কণা বেরোয়। এই কণা বায়ুকে আয়নিত করে অর্থাৎ বায়ুর গ্যাসের অণু থেকে ইলেকট্রনকে বার করে দেয়। আয়নিত বায়ুর বিদ্যুৎপরিবাহিতা বেশি। ধোঁয়া হল খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার সমষ্টি। যদি ডিটেক্টরের মধ্যে ধোঁয়া ঢোকে, তাহলে আলফা কণা সেই ধোঁয়ার কণার সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে বেশিদূর যেতে পারে না। ফলে তার আয়নন ক্ষমতা কমে যায়, বায়ুরও পরিবাহিতাও কম যায়। ডিটেক্টর তখন অ্যালার্ম বাজিয়ে সাবধান করে দেয়। আলফা কণা ব্যবহারের দুটো কারণ আছে; প্রথমত তার বায়ুকে আয়নিত করার ক্ষমতা বিটা বা গামা বিকিরণের থেকে বেশি। দ্বিতীয়ত আলফা কণা সহজেই আটকে যায়, ফলে ডিটেক্টরের প্লাস্টিকের আবরণ ভেদ করে তেজস্ক্রিয়তা বাইরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা হিসাব বলছে যে স্মোক ডিটেক্টর ব্যবহারের ফলে সেদেশে প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে।

তালিকা আর বাড়িয়ে লাভ নেই। এই প্রযুক্তিকে ব্যবহারের আরো নানা পদ্ধতি উদ্ভাবন হচ্ছে। যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করলে নিউক্লিয় প্রযুক্তিতে বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই, বরঞ্চ তার সাহায্যে আমাদের জীবনকে বহুভাবে উন্নত করা যায়।

প্রকাশ- সাথী হাতিয়ার শারদ ১৪৩১  

Friday, 15 November 2024

ফ্যাসিবাদ বিরোধী রবীন্দ্রনাথ

 

ফ্যাসিবাদ বিরোধী রবীন্দ্রনাথ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়




ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনির নেতৃত্বে ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি ক্ষমতায় এসেছিল ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে। তার এক দশক পরে জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতা দখল করেন। হিটলারের দলের নাম ছিল ন্যাশনাল সোশালিস্ট পার্টি (সংক্ষেপে নাৎসি) বা জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল; অবশ্য সমাজতন্ত্র শুধুমাত্র দলের নামে সীমাবদ্ধ ছিল। ফ্যাসিবাদ আদতে কী? সাম্রাজ্যবাদের এক চরম এবং বিকৃত রূপ হল ফ্যাসিবাদ। প্রায়শই সে গণতন্ত্রের রূপ ধরে শুরু করে, সমাজতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষের আশাআকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে বৃহৎ পুঁজির স্বার্থই রক্ষা করে। ইউরোপ যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আঘাতে বিপর্যস্ত, তখন শ্রমিককৃষকের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম গণআন্দোলনকে নতুন শক্তি জুগিয়েছিল। বৃহৎ পুঁজিপতিরা সেই আন্দোলনকে ধ্বংস করতে তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী ফ্যাসিবাদকে ব্যবহার করেছিল। ফ্যাসিবাদ প্রায়শই এক শ্রেণির মানুষকে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে এবং তাদের বলির পাঁঠা বানায়। জাতীয়তাবাদের প্রতি আবেদন ছিল ইতালি ও জার্মানির দুই ফ্যাসিস্ট দলেরই মূল মন্ত্র, এবং সেই জাতীয়তাবাদের মূল মন্ত্রই ছিল জাতিবিদ্বেষ। মুসোলিনির একটি বক্তৃতা উদ্ধৃত করি, “I would say we can easily sacrifice 500,000 barbaric Slavs for 50,000 Italians ...”নাৎসিদেরও এক মূল নীতি ছিল ইহুদি বিরোধিতা। নাৎসিরা ইহুদিদের নিচু শ্রেণির মানুষ মনে করত এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় ও তার পরের দুঃখকষ্টের জন্য তাদের দায়ী করেছিল। নাৎসিরা সরকারে আসার পরে তাদের উপর নিপীড়ন চরমে উঠেছিল। নাৎসিরা ষাট লক্ষ ইহুদিকে খুন করেছিল।

ফ্যাসিবাদ সাধারণভাবে মুক্তচেতনার বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের বিরোধী। জার্মান সাহিত্যকে ‘অ-জার্মান’ প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আগুনে নিক্ষেপ করা হয় সিগমুন্ড ফ্রয়েড, কার্ল মার্ক্স, বের্টোল্ট ব্রেখট, স্টিফেন জুইগ, আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো ইহুদি দার্শনিক বিজ্ঞানী বা সাহিত্যিকদের বই। এভাবেই জার্মানিতে চিন্তার জগতে আধিপত্য কায়েম করেছিল নাৎসিরা। প্রশ্ন করার স্বাধীনতা, যা উদারনৈতিক চিন্তার মূল ভিত্তি, তা ফ্যাসিবাদের পক্ষে অসহ্য ছিল। এখনি সাধান না হলে আমাদের দেশও ভবিষ্যতে নাৎসি জার্মানির পথ নেবে, বিশেষ করে শিক্ষার স্বাধিকার যখন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণের সুযোগে মুক্ত চিন্তার উপরে আক্রমণ যখন ক্রমবর্ধমান।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যেসব বিদেশি সাহিত্যিকের বই জার্মান ভাষায় সব থেকে বেশি অনুবাদ হয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদকে অন্তর থেকে ঘৃণা করতেন, তাঁর লেখায় বারবার তা আমরা দেখেছি। কাজেই ফ্যাসিবাদের তিনি বিরোধী হবেন, তাতে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। তাই জার্মানিতে ফ্যাসিবাদী শাসনের আগুন থেকে রবীন্দ্রনাথের বইও বাদ যায়নি। কিন্তু বাস্তব বড় বিচিত্র, রবীন্দ্রনাথের মতো মনীষিও গোড়াতে ফ্যাসিবাদকে চিনতে ভুল করেছিলেন। তবে একবার নিজের ভুল বুঝতে পারার পরে তিনি সারা জীবন আপোসহীনভাবে তার বিরোধিতা করে গেছেন।

মুসোলিনি বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বমানবের সমর্থন ফ্যাসিবাদকে আন্তর্জাতিকক্ষেত্রে কিছুটা গ্রহণযোগ্য করতে পারে। তাই তিনি দুই অধ্যাপকের মারফত বিশ্বভারতীর জন্য অনেক বই উপহার পাঠান ও রবীন্দ্রনাথকে ইতালিতে আমন্ত্রণ জানান। ১৯২৬ সালে ইতালি ভ্রমণকালে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সরকারের অতিথি। সেখানে তাঁকে ঘিরে রেখেছিল ফ্যাসিস্ট পার্টির সদস্যেরা। তাঁকে তাদের পছন্দমতো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। মুসোলিনি নিজে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। রবীন্দ্রনাথ ইতালির প্রকৃত অবস্থা না বুঝে মুসোলিনির প্রশংসা করেন; তাকে ফ্যাসিবাদের প্রতি সমর্থন বলে ফলাও করে দেশে বিদেশে প্রচার করা হয়।

রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়াতে প্রমাদ গুণেছিলেন প্রগতিশীল ফরাসি সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ রোমা রোলাঁ। তিনি প্রথম থেকেই ফ্যাসিবাদের বিরোধী। রবীন্দ্রনাথের ইতালি থেকে যান সুইজারল্যান্ড, সেখানে তিনি ছিলেন রোমা রোলাঁর অতিথি। রোলাঁ প্রথমে তাঁকে বোঝান যে মুসোলিনির স্বৈরশাসন কোনোরকম বিরোধিতাকে বরদাস্ত করে না। যে সমস্ত সরকার বিরোধীরা দেশ ছাড়তে পারেননি, তাঁদের অনেককেই হত্যা করা হয়েছে, বাকিদের স্থান হয়েছে কারাগারে। তারপরে তিনি মুসোলিনির অত্যাচারের শিকার কয়েকজনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ করান। রবীন্দ্রনাথ তখন বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে পারেন। আলোচনার সময় একটা কথা উঠে এসেছিল, ফ্যাসিস্টরা উচ্চকণ্ঠে বলত মুসোলিনি ইতালিকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছেন, যদিও সেটা আদৌ সত্য ছিল না। প্রসঙ্গত বলা যায়, আধুনিক কালে আমাদের দেশেও শাসকের ফ্যাসিবাদী আচরণের পক্ষে একই যুক্তি দেখানো হয়। তাই রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া আমাদের স্মরণে রাখা প্রয়োজন; তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে কেউ যদি রাজনৈতিক ক্ষমতা ও বস্তুগত লাভের জন্য মানবতার আদর্শকে বিসর্জন দেয়, তাহলে তার নিন্দাই প্রাপ্য।

এর পরে দীনবন্ধু চার্লস এন্ড্রুজকে রবীন্দ্রনাথ এক চিঠি লিখেছিলেন যা লন্ডনের ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি ফ্যাসিবাদের নিন্দা করে লেখেন, “ফ্যাসিবাদের কর্মপদ্ধতি ও নীতি সমগ্র মানবজাতির উদ্বেগের বিষয়। যে আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করে, বিবেকবিরোধী কাজ করতে মানুষকে বাধ্য করে এবং হিংস্র রক্তাক্ত পথে চলে বা গোপনে অপরাধ সংঘটিত করে-সে আন্দোলনকে আমি সমর্থন করতে পারি এমন উদ্ভট চিন্তা আসার কোনো কারণ নেই। আমি বারবারই বলেছি, পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলো সযত্নে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব লালন করে সারা পৃথিবীর সামনে ভয়াবহ বিপদের সৃষ্টি করেছে।” এর পরে ইতালির সংবাদমাধ্যম একযোগে রবীন্দ্রনাথের নিন্দা শুরু করে। পরে ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ানকে এই প্রসঙ্গেই এক সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ বলেন যে কোনো দেশ যদি সমৃদ্ধির জন্য যদি অন্যায় পথ অবলম্বন করে, তা সমগ্র মানবজাতির পক্ষেই উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

এই সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদী বিপদের স্বরূপ সম্যকভাবে উপলব্ধি করেন। ১৯২৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্যারিতে আঁরি বারব্যুস ও রোল্যাঁর নেতৃত্বে প্রথম ফ্যাসিবাদবিরোধী সম্মেলন হয়, তার ঘোষণাপত্রে ভারতবর্ষ থেকে একমাত্র রবীন্দ্রনাথই স্বাক্ষর করেছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি বারব্যুসকে চিঠিতে লেখেন, “এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, আপনার আহ্বানে আমার সহানুভূতি আছে এবং আমি নিশ্চিতভাবে মনে করি যে এটা অন্যান্য অসংখ্য মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্ব করে আর যারা সভ্যতার গর্ভ থেকে হিংসার আকস্মিক বিস্ফোরণে হতাশ বোধ করছেন..."

আমাদের বুঝতে হবে যে সেই সময় ভারতের একমাত্র জওহরলাল নেহরু ছাড়া অন্য কেউই ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। অন্যান্য বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক নেতারা হয় সে বিষয়ে কিছুই জানতেন না, নয়ত তার গুণমুগ্ধ ছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মডার্ন রিভিউ পত্রিকাতে তার প্রশংসা করেন। সুভাষচন্দ্র বিদেশ থেকে এক বিবৃতিতে বলেন মুসোলিনি হলেন সেই যুগে জগতের শ্রেষ্ঠ মানুষ। রোমা রোলাঁ এই সমসস্যার কথা জানতেন এবং ফ্যাসিবাদের বিরোধিতার জন্য নানা ভাবে ভারতীয়দের প্রতি আবেদন জানিয়েছিলেন।

সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ছিলেন ইহুদি; হিটলার ক্ষমতায় আসার ঠিক আগে তিনি দেশ ছাড়েন। নাৎসি জার্মানি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দখল করে নেয়, তাঁর তত্ত্ব ক্লাসে পড়ানো বন্ধের নির্দেশ দেয় এবং নানাভাবে তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা করে। জার্মানিতে ইহুদিদের উপর অত্যাচারের খবর শুনে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৪ সালে ইজরায়েল মেসেঞ্জার সংবাদপত্রে এক চিঠিতে লেখেন, "…if the brutalities we read of are authentic, then no civilised conscience can allow compromise with them. The insults offered to my friend Einstein have shocked me to the point of torturing my faith in modern civilisation.”

ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যের সম্পর্ক রবীন্দ্রনাথের কাছে ধরা পড়েছিল। তাই ১৯৩৩ সালে 'কালান্তর' প্রবন্ধে তিনি লেখেন, "সভ্য য়ুরোপের সর্দার-পোড়ো জাপানকে দেখলুম কোরিয়ায়, দেখলুম চীনে, তার নিষ্ঠুর বলদৃপ্ত অধিকার লঙ্ঘনকে নিন্দা করলে সে অট্টহাস্যে নজির বের করে য়ুরোপের ইতিহাস থেকে। আয়র্লণ্ডে রক্তপিঙ্গলের যে উন্মত্ত বর্বরতা দেখা গেল, অনতিপূর্বেও আমরা তা কোনোদিন কল্পনাও করতে পারতুম না। তার পরে চোখের সামনে দেখলুম জালিয়ানওয়ালাবাগের বিভীষিকা। যে-য়ুরোপ একদিন তৎকালীন তুর্কিকে অমানুষ বলে গঞ্জনা দিয়েছে তারই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে প্রকাশ পেল ফ্যাসিজ্‌মের নির্বিচার নিদারুণতা। একদিন জেনেছিলুম আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা য়ুরোপের একটা শ্রেষ্ঠ সাধনা, আজ দেখছি য়ুরোপে এবং আমেরিকায় সেই স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ প্রতিদিন প্রবল হয়ে উঠছে। ... পোলিটিকাল মতভেদের জন্যে ইটালি যে দ্বীপান্তরবাসের বিধান করেছে, সে কীরকম দুঃসহ নরকবাস, সে-কথা সকলেরই জানা আছে। য়ুরোপীয় সভ্যতার আলোক যে-সব দেশ উজ্জ্বলতম করে জ্বালিয়েছে, তাদের মধ্যে প্রধান স্থান নিতে পারে জর্মনি। কিন্তু আজ সেখানে সভ্যতার সকল আদর্শ টুকরো টুকরো করে দিয়ে এমন অকস্মাৎ, এত সহজে উন্মত্ত দানবিকতা সমস্ত দেশকে অধিকার করে নিলে, এও তো অসম্ভব হল না। যুদ্ধপরবর্তীকালীন য়ুরোপের বর্বর নির্দয়তা যখন আজ এমন নির্লজ্জভাবে চারিদিকে উদঘাটিত হতে থাকল তখন এই কথাই বার বার মনে আসে, কোথায় রইল মানুষের সেই দরবার যেখানে মানুষের শেষ আপিল পৌঁছবে আজ। মনুষ্যত্বের 'পরে বিশ্বাস কি ভাঙতে হবে-- বর্বরতা দিয়েই কি চিরকাল ঠেকাতে হবে বর্বরতা। কিন্তু সেই নৈরাশ্যের মধ্যেই এই কথাও মনে আসে যে, দুর্গতি যতই উদ্ধতভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠুক, তবু তাকে মাথা তুলে বিচার করতে পারি, ঘোষণা করতে পারি তুমি অশ্রদ্ধেয়, অভিসম্পাত দিয়ে বলতে পারি "বিনিপাত", বলবার জন্যে পণ করতে পারে প্রাণ এমন লোকও দুদিনের মধ্যে দেখা দেয়, এই তো সকল দুঃখের, সকল ভয়ের উপরের কথা।"

১৯৩৬ সালে স্পেনের জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদ স্পেনে নির্বাচিত গণতন্ত্রী পপুলার ফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। জার্মানি ও ইতালি ফ্রাঙ্কোকে সাহায্য করেছিল, কিন্তু ফ্রান্স বা ব্রিটেন নিরপেক্ষ থাকে। দেশ বিদেশের বুদ্ধিজীবী দল পপুলার ফ্রন্টের পক্ষে গৃহযুদ্ধে অংশ নেন। ভারত থেকে অংশ নিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের তরুণ গোপাল হুদ্ধার। শহিদ হন র‌্যালফ ফক্স, ক্রিস্টোফার কডওয়েল, জন কর্নফোর্ড, জুলিয়ান বেল, ফ্রেডরিকো গার্সিয়া লোরকার মতো বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীরা প্রমুখ। এক ক্ষোভবার্তায় রবীন্দ্রনাথ বলেন, “স্পেনে বিশ্বসভ্যতাকে বিপদগ্রস্ত ও পদদলিত করা হচ্ছে। স্পেনীয় জনগণের গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে ফ্রাঙ্কো বিদ্রোহের পতাকা উড্ডীন করেছে। আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ বিদ্রোহীদের সহায়তা করার জন্য সৈন্য ও অর্থ ঢালছে। ভাড়াটে সৈনিকেরা ও বিদেশী ফৌজ স্পেনের সুন্দর ভূমির উপর দিয়ে যাচ্ছে- আর পিছনে যাচ্ছে মৃত্যু, নির্জনতা...। স্পেনীয় জনগণের এই চরম পরীক্ষা এবং দুর্দশার মুহূর্তে আমি মানবতার বিবেকের নিকট আবেদন করছি। স্পেনের জনগণের ফ্রন্টকে সাহায্য করা হোক। স্পেনের জনগণকে সাহায্য করা হোক, লক্ষ লক্ষ কণ্ঠকে সাহায্য করা হোক; স্পেনের জনগণকে সাহায্য করা হোক, লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে গর্জে উঠুক প্রতিক্রিয়া। অভিযান বন্ধ কর, গণতন্ত্রের সপক্ষে কোটি কোটি মানুষ এগিয়ে আসুক-এগিয়ে আসুক সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক সাফল্যের জন্য।”


১৯৩৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ব্রাসেলসে যে বিশ্বশান্তি কংগ্রেস অনুষ্টিত হয় সেখানে ‘ভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘ’ থেকে একটি ইস্তাহার প্রকাশ করা হয়। লেখা হয়, "ভারত অপেক্ষা ভারতের বাহিরে অবস্থা অধিকতর তমসাচ্ছন্ন। ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটরি খাদ্যের পরিবর্তে অস্ত্র যোগাইয়া এবং সংস্কৃতির সুযোগের পরিবর্তে সাম্রাজ্য গঠনের প্রলোভন দেখাইয়া নিজের সমরবাদের মুখোশ খুলিতেছে। আবিসিনিয়াকে পদানত করিতে ইটালি যে উপায় অবলম্বন করিয়াছে, তাহা যুক্তি ও সভ্যতার প্রতি বিশ্বাসী সকলকে আঘাত করিয়াছে।" ইস্তাহারে স্বাক্ষর করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মুন্সী প্রেমচাঁদ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, জওহরলাল, প্রমথ চৌধুরী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এবং নন্দলাল বসু। রবীন্দ্রনাথ পৃথক এক বাণীতে বলেছিলেন, “...উন্নত প্রতিক্রিয়া ও জঙ্গীবাদ আজ সভ্যতার ভাগ্য নিয়ে খেলা করছে আর সংস্কৃতি ধ্বংসের উপক্রম করছে। এ সময়ে আমাদের নীরব থাকা হবে অপরাধ। সমাজের প্রতি আমাদের যে কর্তব্য তার ঘোর ব্যত্যয় করা হবে। ...যুদ্ধকে আমরা ঘৃণা করি। যুদ্ধকে আমরা চিরতরে পরিহার করতে চাই, যুদ্ধে আমাদের কোনো স্বার্থ নেই। যুদ্ধ মারফৎ কদর্য ফ্যাসিজম চিরস্থায়ী করতে চায়।"

১৯৩৭ সালে ভারতে তৈরী হল রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধ বিরোধী সঙ্ঘ। এই সংগঠনে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের লেখক, শিল্পী, রাজনীতিবিদরা যুক্ত হলেন। তাঁদের মধ্যে মুন্সী প্রেমচাঁদ, নন্দলাল বসু, জওহরলাল নেহেরু, তুষারকান্তি ঘোষ, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়েছিলেন সাধারণ সম্পাদক।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জাগ্রত বিশ্ববিবেকের প্রতিভূ। যেখানেই ফ্যাসিবাদ তার নখদাঁত বার করেছে, রবীন্দ্রনাথ তার প্রতিবাদ করেছেন। ১৯৩৫ সালে ইতালি সাম্রাজ্যবিস্তারের লক্ষে বিনা প্ররোচনায় আবিসিনিয়া আক্রমণ করে। সেই প্রেক্ষিতে অমিয় চক্রবর্তীর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি। এই কবিতার প্রায় প্রতিটি স্তবক ফ্যাসিবাদের হাতে নিপীড়িত মানবসভ্যতার হাহাকারের চিৎকার, “আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে/ প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,/ যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল/ অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল,/ এসো যুগান্তের কবি,/ আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে/দাঁড়াও, ওই মানহারা মানবীর দ্বারে;/ বলো ‘ক্ষমা করো’/ হিংস্র প্রলাপের মধ্যে/ সেই হোক/ তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।”

১৯৩৭ সালে জাপানের চিন আক্রমণের পরে তিনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন এবং অসুস্থতার মধ্যেও চিনের জনগণের উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠান। চিনা শহর নানকিং-এর পতনের পর তিনি ‘যেদিন চৈতন্য মোর’ কবিতায় লিখছেন,
“…
মহাকালসিংহাসনে/ সমাসীন বিচারক, শক্তি দাও, শক্তি দাও মোরে,/ কন্ঠে মোর আনো বজ্রবাণী, শিশুঘাতী নারীঘাতী/ কুৎসিত বীভৎসা পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন/ নিত্যকাল রবে যা স্পন্দিত লজ্জাতুর ঐতিহ্যের/ হৃৎস্পন্দনে, রুদ্ধ কন্ঠ ভয়ার্ত এ শৃঙ্খলিত যুগ যবে/ নিঃশব্দে প্রচ্ছন্ন হবে আপন চিতার ভস্মতলে।”

জাপানের হাতে ১৯৩৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর নানকিং শহরের পতন ঘটে। তিন লক্ষ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে জাপানি সৈন্য। এই ঘটনায় বিচলিত হয়ে ২৫ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,

'‌নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,/ শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস/ বিদায় নেবার আগে তাই/ ডাক দিয়ে যাই/ দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে/ প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।'‌ (প্রান্তিক-১৮)
জাপানের সৈনিকেরা যুদ্ধযাত্রার পূর্বে ‘ভগবান বুদ্ধে’র মূর্তির সামনে যুদ্ধ জয়ের জন্য প্রার্থনা করছে। একদিকে হিংসার আগুনে সভ্যতাকে পুড়িয়ে দেওয়া, অন্যদিকে এই অপকর্মের সমর্থনে অহিংস নীতির পথিকৃৎ ‘ভগবান বুদ্ধে’র শরণ নেওয়া সৈনিকদের এই দ্বিচারিতা ও ভণ্ডামি দেখে রচনা করেন সুপরিচিত ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ কবিতাটি —
যুদ্ধের দামামা উঠল বেজে।/ ওদের ঘাড় হল বাঁকা, চোখ হল রাঙা/ কিড়মিড় করতে লাগল দাঁত।/
মানুষের কাঁচা মাংসে যমের ভোজ ভরতি করতে/ বেরোলো দলে দলে।/ সবার আগে চলল দয়াময় বুদ্ধের মন্দিরে/ তাঁর পবিত্র আশীর্বাদের আশায়।”

জাপানি কবি নোগুচি আগে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সাদরে বরণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে নোগুচি এক খোলা চিঠিতে তাঁর সমালোচনা করে জাপানি যুদ্ধোন্মাদনাকে সমর্থন করেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর তীব্র বাদানুবাদ হয়েছিল। রাসবিহারী বসু তখন জাপানে, তিনিও রবীন্দ্রনাথকে এক বার্তা পাঠিয়ে ভারতের জাপানবিরোধী আন্দোলন বন্ধ করার জন্য প্রয়াসের আহ্বান জানান, রবীন্দ্রনাথ কড়া ভাষায় তাঁকে ভর্ৎসনা করেন এবং সেই বার্তাবিনিময় সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে দেন।

১৯৩৮ সালে মিউনিখ চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড চেকোশ্লোভাকিয়া ভাগ করে জার্মানির হাতে তুলে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন তার বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু ইঙ্গ-ফরাসি সরকার তার কথা শুনতে অস্বীকার করে। কারণ তাদের পরিকল্পনা ছিল নাৎসি জার্মানি ও সভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধানো। এই সময় রবীন্দ্রনাথ চেক রাষ্ট্রপ্রধান এডুয়ার্ড বেনেসকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। মিউনিখ চুক্তির ছাপ পড়েছে নবজাতকের এই কবিতাতে।

উপর আকাশে সাজানো তড়িৎ-আলো-- / নিম্নে নিবিড় অতিবর্বর কালো / ভূমিগর্ভের রাতে--/ ক্ষুধাতুর আর ভূরিভোজীদের / নিদারুণ সংঘাতে / ব্যাপ্ত হয়েছে পাপের দুর্দহন,/ সভ্যনামিক পাতালে যেথায় / জমেছে লুটের ধন।…/

বিদীর্ণ হল ধনভাণ্ডারতল,/ জাগিয়া উঠিছে গুপ্ত গুহার / কালীনাগিনীর দল।/ দুলিছে বিকট ফণা,/ বিষনিশ্বাসে ফুঁসিছে অগ্নিকণা। …/ ঐ দলে দলে ধার্মিক ভীরু/ কারা চলে গির্জায় / চাটুবাণী দিয়ে ভুলাইতে দেবতায়।/ দীনাত্মাদের বিশ্বাস, ওরা / ভীত প্রার্থনারবে / শান্তি আনিবে ভবে।"

১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। পোল্যান্ডের সমর্থনে কলকাতায় ইন্দো-পোলিশ সমিতি গঠিত হয়, রবীন্দ্রনাথ তার সভাপতি হতে রাজি হন। রবীন্দ্রনাথ ১৯৪০ সালের ২০শে জুন অমিয় চক্রবর্তীকে চিঠিতে লিখলেন, “‌এই যুদ্ধে ইংল্যান্ড ফ্রান্স জয়ী হোক একান্ত মনে এই কামনা করি। কেননা মানব – ইতিহাস ফ্যাসিজমের নাৎসিজমের কলঙ্ক প্রলেপ আর সহ্য হয় না।”‌ তার আগে ২৪ মে লিখেছিলেন, ইংরাজের পরাজয়ে "যারা উত্তেজিত উৎসাহ প্রকাশ করছে তারা কাপুরুষ। তারা নিজেরা অক্ষম বলেই সক্ষমদের সংকটে উল্লাস বোধ করছে।"

ফ্যাসিবাদবিরোধী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রেরনা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নাৎসিদের সাথে যুদ্ধে যেদিন প্যারির পতন হয় সেদিন স্বাধীন প্যারি বেতার কেন্দ্রে সবশেষ যে নাটকটি পরিবেশিত হয় তা হল আন্দ্রে জিদ অনুদিত রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’। নাটকের শেষ পংক্তিতে ছিল অমলকে বলো সুধা তাকে ভোলে নি। একসঙ্গে তারা একটি পংক্তি যোগ করে ‘স্বাধীনতাকে বলো প্যারি তাকে ভোলে নি’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নানা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দিরা মৃত্যুর মুখোমুখি পরিস্থিতিতে একশো পাঁচবার ডাকঘর নাটক অভিনয় করেছিল। তার মধ্যে ওয়ারশতে এক অনাথআশ্রমের শিশুদের অভিনয় ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। সেই শিশুদের নৃশংসভাবে গ্যাসচেম্বারে হত্যা করা হয়েছিল, তার আগে ডাকঘর অভিনয় করে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার সাহস তারা পেয়েছিল।

ফ্যাসিস্ট আক্রমণে ফ্রান্সের পতনের সংবাদে রবীন্দ্রনাথ এতটাই উত্তেজিত ও বিচলিত হয়ে পড়েন যে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জরুরী তারবার্তা পাঠিয়ে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করতে আহ্বান জানান৷ ইতিহাস অন্য পথে চলেছিল; পশ্চিম রণঙ্গনে জয়লাভের পরে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেছিল। ফ্যাসিস্টদের প্রতিরোধে দুই কোটি মানুষের জীবনের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে মূল ভূমিকা পালন করেছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ সালে সেই দেশ ভ্রমণ করে লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বই রাশিয়ার চিঠি। সাধারণ মানুষের উন্নয়নের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রচেষ্টার প্রতি তাঁর পক্ষপাত ছিল স্পষ্ট। রোগশয্যাতেও রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিস্ট বাহিনির বিরুদ্ধে সোভিয়েত জনগণের প্রতিরোধের খবর রাখতেন৷ ‘বাইশে শ্রাবণ’ গ্রন্থে রানী মহলানবিশের বর্ণনা থেকে জানা যায়, যেদিন জার্মানদের অগ্রগতিতে একটু বাধা পড়ার খবর থাকত সেদিন কবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাগজ পড়তেন৷ যেদিন জার্মান বাহিনির সাফল্যের খবর থাকত হেডলাইন পড়েই কাগজ ছুঁড়ে ফেলে দিতেন৷ মৃত্যুর আগেও তার অন্যথা হয়নি। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “১৯৪১ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ। কবি মৃত্যুশয্যায়। তবু উদ্বিগ্ন হয়ে বার বার জানতে চাইছেন, প্রশান্ত মহলানবিশের কাছে – ‘কী পরিস্থিতি রণাঙ্গণের? প্রশান্ত মহলানবিশ জানান, ‘এখনো এগিয়ে চলেছে দস্যু বাহিনী,’ কবি ডুবে যান নীরব বিষণ্ণতায়।…অবশেষে শেষবারের জন্য সংজ্ঞা এলো কবির। চোখে একই স্বপ্ন। কিন্তু প্রশান্ত মহলানবিশের উত্তর এবার ভিন্ন। ‘সোভিয়েত বাহিনী প্রতিরোধ করেছে।’ রবীন্দ্রনাথ উৎসাহে অধীর হয়ে উঠেন, বলেন, ‘পারবে, দানবকে ঠেকাতে ওরাই পারবে।” ফ্যাসিবাদের পরাজয় কবি দেখে যাননি, কিন্তু তার অন্তিম পরিণতি সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। মানুষের উপর বিশ্বাস তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রেখেছিলেন।



তথ্যসূত্রঃ

ভারতে জাতীয়তা আন্তর্জাতিকতা ও রবীন্দ্রনাথ - নেপাল মজুমদার

রবিজীবনী - প্রশান্তকুমার পাল

বাইশে শ্রাবণ - রানী মহলানবীশ

রবীন্দ্র রচনাবলী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত সংস্করণ

রবীন্দ্রজীবনকথা - প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

 

 প্রকাশ নিশিত  ২০২৪