Saturday, 23 November 2024

রেডিওথেরাপি, রেডিওডায়াগনসিস ও নিউক্লিয় বিজ্ঞান

 

রেডিওথেরাপি, রেডিওডায়াগনসিস ও নিউক্লিয় বিজ্ঞান

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


রেডিওথেরাপি কথাটার সঙ্গে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। রেডিয়েশন অর্থাৎ বিকিরণের সাহায্যে দেহের অভ্যন্তরে ক্যান্সার বা ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের কোষকে ধ্বংস করাকে বলে রেডিওথেরাপি। রেডিওডায়াগনসিস কথাটা অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত হলেও তার মানে বুঝতে অসুবিধা হয় না -- বিকিরণের সাহায্যে রোগনির্ণয়। এই লেখাতে আমরা রেডিওথেরাপি ও রেডিওডায়াগনসিসে নিউক্লিয় বিজ্ঞানের প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করব।

এই দুই ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিকিরণ নানা রকম হতে পারে। ক্যান্সারের রেডিওথেরাপিতে এক্স রশ্মির ব্যবহারের কথা অনেকেই জানি। অন্য ধরনের বিকিরণের মধ্যে পড়বে বিটা ও গামা রশ্মি, নিউট্রন, উচ্চশক্তির প্রোটন, ইত্যাদি। এদের সাধারণ একটা ধর্ম আছে যা রেডিওথেরাপিতে কাজে লাগানো হয়। কোনো পদার্থের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় বিকিরণ সেই পদার্থকে আয়নিত করে। দেহের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় বিকিরণ যে আয়ন সৃষ্টি করে, তা কোশের ডিএনএ-কে ধ্বংস করে কোশের মৃত্যু ঘটায়।

১৯১১ সালে ম্যানচেস্টারে বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড পরমাণুর নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেন। নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের আগেই কিন্তু নিউক্লিয় প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল। তেজস্ক্রিয়তার উৎস হল পরমাণুর নিউক্লিয়াস। ১৮৯৬ সালে তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার হওয়ার কিছু দিন পর থেকেই বোঝা গিয়েছিল যে ক্যান্সারের চিকিৎসাতে তাকে কাজে লাগানো যায়। ১৯০৩ সালের নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রথমে তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারের জন্য আঁরি বেকেরেল ও সেই বিষয়ে গবেষণার জন্য পিয়ের কুরিকে মনোনীত করা হয়। পিয়ের নোবেল কমিটিকে লিখে পাঠিয়েছিলেন যে তাঁর স্ত্রী মেরি ও তিনি একসঙ্গে সমস্ত কাজ করেছেন, তাই মেরির নামও থাকা উচিত। কমিটি তখন বাকি দুজনের সঙ্গে মেরির নামে জমা পড়া এক মনোনয়ন ব্যবহার করে মেরির নাম তালিকাতে ঢুকিয়েছিলেন। সেই মনোনয়ন দিয়েছিলেন শার্ল বৌশার্ড নামের এক ডাক্তার; চিকিৎসাতে রেডিয়ামের প্রয়োগের জন্যই তাঁর মাথায় পিয়ের ও মেরির কথা মনে এসেছিল।

রেডিওথেরাপিতে নানা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। অনেক সময়েই ক্যান্সারগ্রস্ত টিউমারের কাছে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ রেখে তাকে ধ্বংস করা হয়। সাধারণভাবে তিন রকমের তেজস্ক্রিয়তা হয়। আলফা তেজস্ক্রিয়তাতে নিউক্লিয়াস থেকে আলফা কণা অর্থাৎ হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস বেরিয়ে আসে। বিটা কণা হল ইলেকট্রন বা পজিট্রন। গামা তেজস্ক্রিয়তাতে নিউক্লিয়াস থেকে উচ্চশক্তির ফোটন কণা নির্গত হয়। তেজস্ক্রিয়াতে নির্গত আলফা কণার ভেদনক্ষমতা খুব কম, চামড়ার বাইরের মৃত কোশের স্তরই তাকে আটকে দেয়। তেজস্ক্রিয় পদার্থের প্রয়োগের ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপিতে কার্যকর বিকিরণটি হল মূলত বিটা রশ্মি।

বিটা রশ্মির ভেদনক্ষমতা আলফা রশ্মির থেকে বেশি হলেও খুব বেশি নয়, অর্থাৎ তা দেহের মধ্যে বেশিদূর যেতে পারে না। ফলে শুধুমাত্র টিউমার বা তার আশপাশের কোশগুলিই ধ্বংস হয়। সুতরাং বিটা তেজস্ক্রিয় পদার্থকে টিউমারের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তার জন্য নানা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক থাইরয়েডের ক্যান্সারের কথা। দেহের অধিকাংশ আয়োডিন থাইরয়েড গ্রন্থিতে শোষিত হয় ও জমা থাকে। আয়োডিনের একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ হল I-131 এই 131 হল ওই আয়োডিন আইসোটোপের ভরসংখ্যা অর্থাৎ নিউট্রন ও প্রোটনের মোট সংখ্যা। কোনো নির্দিষ্ট মৌলের নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা নির্দিষ্ট, কিন্তু নিউট্রন সংখ্যার হেরফের হতে পারে। পরিবেশে সাধারণ যে আয়োডিন পাওয়া যায়, তা হল I-127, তার নিউক্লিয়াসে আছে 53টা প্রোটন ও 74টা নিউট্রন। অন্যদিকে I-131-এর মধ্যে আছে 78টা নিউট্রন। একটা ক্যাপসুলের মাধ্যমে সোডিয়াম আয়োডাইড লবণ রোগীকে খাওয়ানো হয়, তার আয়োডিনটা হল I-131আইসোটোপ, এর থেকে বিটা কণা বেরোয়। আয়োডিন রক্তের মাধ্যমে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাইরয়েডে গিয়ে জমা হয় এবং তার থেকে নির্গত বিটা বিকিরণ সেখানকার ক্যান্সার কোশদের ধ্বংস করে।

প্রকৃতিতে এই I-131 পাওয়া যায় না; কেমন ভাবে তা তৈরি করা হয়? নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টরে তৈরি হয় প্রচুর নিউট্রন। সেই নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়ামের আইসোটোপ U-235-এর নিউক্লিয়াসকে আঘাত করলে তা ভেঙে যায়, একে বলে ফিশন বা বিভাজন বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়াতে আরো অনেক নতুন মৌলের সঙ্গে I-131 তৈরি হয়; তাকে রাসয়ানিক পদ্ধতিতে আলাদা করা হয়। অন্য এক উপায়ে রিঅ্যাক্টরের নিউট্রন দিয়ে টেলুরিয়ামের আইসোটোপ Te-130-কে ধাক্কা দিলে সে নিউট্রনকে ধরে নিয়ে হয় Te-131। এটি ক্ষণস্থায়ী আইসোটোপ, বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে তা I-131-এ রূপান্তরিত হয়।

আধিকাংশ সময় এত সহজে একটা নির্দিষ্ট অঙ্গ বা গ্রন্থিকে নিশানা করা যায় না, তার জন্য অন্য পদ্ধতি আছে। যকৃতের টিউমারের ক্ষেত্রে ইট্রিয়াম বা হোলমিয়ামের তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ Y-90 বা Ho-166 কে কাচের তৈরি অতি ক্ষুদ্র গোলকের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। গোলকগুলির ব্যাস তিরিশ মাইক্রনের কাছাকাছি, মোটামুটি চারটে লোহিত রক্তকণিকার কোশের মতো। সেগুলিকে সরাসরি ইঞ্জেকশনের সাহায্যে যকৃতের ধমনীতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। গোলকগুলি যকৃতের গিয়ে জমা হয় ও তার থেকে নির্গত বিকিরণ মাধ্যমে সেখানকার টিউমারের কোশগুলিকে অনেকটা মারতে সক্ষম হয়। সাধারণত টিউমারের আয়তন কমাতে এর ব্যবহার হয়, এর পরে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে টিউমারটিকে সরানো হয়। ইট্রিয়াম বা হোলমিয়ামের এই তেজস্ক্রিয় আইসোটোপদেরও রিঅ্যাক্টরে নিউট্রন বিক্রিয়ার সাহায্যে তৈরি করা হয়।

রেডিওথেরাপির এই পদ্ধতির পোশাকি নাম Selective Internal Radiation Therapy (SIRT)এর সব থেকে বড় সুবিধা হল যে বিকিরণ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে, অন্য অঙ্গের ক্ষতি করে না। আরো একটা বড় সুবিধা হল যে কোনো দীর্ঘস্থায়ী তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থাকে না। ধরা যাক I-131-এর কথা। এর অর্ধায়ু কাল হল আট দিন, অর্থাৎ আট দিন পরে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা কমে অর্ধেক হয়। তার অর্থ ওই আইসোটোপ থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা মাসখানেকের মধ্যে কমে দশ শতাংশে পৌঁছে যায়। ইট্রিয়াম বা হোলমিয়েমের অর্ধায়ু কাল আরো কম, ফলে দীর্ঘস্থায়ী কোনো প্রভাব থাকে না। সেই কারণে বিকিরণের মাত্রা বা ডোজ অনেকটা বাড়ানো যায়।

এইরকম বহু তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ চিকিৎসা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। এই সমস্ত আইসোটোপের অধিকাংশই হল কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ, প্রকৃতিতে তাদের পাওয়া যায় না। নিউক্লিয় গবেষণা ছাড়া এই সমস্ত আইসোটোপ পাওয়া যেত না। কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেছিলেন মাদাম কুরির মেয়ে আইরিন জোলিও-কুরি ও তাঁর স্বামী ফ্রেডরিক জোলিও-কুরি। এ জন্য তাঁরা ১৯৩৫ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

রোগ নির্ণয়ে তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহারের উদাহরণ হল পেট (PET) স্ক্যান, পুরো কথাটা হল পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি। সাধারণ এক্স-রশ্মির বড়ো সমস্যা হল যে তা দিয়ে হাড়ের ছবি ভালো উঠলেও নরম কলা বা পেশী ইত্যাদির ছবি ভালো ওঠে না। কোনো কোনো কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়াতে পজিট্রন তৈরি হয়। পজিট্রন হল ইলেকট্রনের বিপরীত কণা, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই দুটি বিপরীত কণা একে অপরকে ধ্বংস করে দেয় ও দুটি 511 keV (কিলো ইলেকট্রনভোল্ট) গামা রশ্মি পরস্পর বিপরীতদিকে বেরোয়। এই গামারশ্মিগুলিকে ধরে কোন জায়গায় তারা সৃষ্টি হয়েছে জানা সম্ভব। সঙ্গের ছবিটাতে বিষয়টি সহজ করে দেখানো হয়েছে।


  পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি


পেট স্ক্যানের একটা উদাহরণ দেখা যাক। ক্যান্সারের কোশ দ্রুত বিভাজিত হয় বলে সেখানে বিপাক ক্রিয়ার হার বেশি। রক্তের মধ্যে গ্লুকোজের অনুরূপ একটা অণু ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যার মধ্যে থাকে ফ্লোরিনের তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ F-18। এই আইসোটোপ থেকে পজিট্রন বেরোয়। বিপাকের হার বেশি বলে ক্যান্সারগ্রস্ত কোশ বেশি গ্লুকোজ নেয়। সেখানে এই অণুটিও বেশি জমা হয় ও তার থেকে পজিট্রন বেরোয়। ইলেকট্রন পজিট্রন ধ্বংসের মাধ্যমে সেখানে গামা রশ্মি তৈরি হয়, ফলে বাইরের গামা ক্যামেরার তোলা ছবিতে ওই জায়গাটি অনেক বেশি উজ্জ্বল দেখায়।

কোনো যৌগের পরমাণুতে সাধারণ আইসোটোপের বদলে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করলে তাকে বলে ট্রেসার। এভাবে সাধারণ অণুর মধ্যে ট্রেসার ব্যবহার করাকে বলে ট্যাগিং। এখন ট্রেসার ব্যবহারের সঙ্গে সিটি (CT) স্ক্যানের সংযোগ ঘটিয়ে চালু হয়েছে স্পেক্ট (SPECT: Single Photon Emission Computed Tomography)। এই পদ্ধতিতে শিরা ও ধমনীর মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন অঙ্গে রক্তের প্রবাহকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। এখানেও গামা ক্যামেরার সাহায্যে আইসোটোপ থেকে বেরোনো গামা রশ্মিকে ধরা সম্ভব হয়। গামা ক্যামেরার কথা আগেও এসেছে। এতে থাকে একটি প্রতিপ্রভ পদার্থ, সাধারণত সোডিয়াম আয়োডাইড। গামা রশ্মি এসে সোডিয়াম আয়োডাইডে পড়লে তার থেকে আলোর ঝলক বেরোয়, সেই ঝলক পরে রাখা ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউব নামের যন্ত্রে ধরা পড়ে। এভাবে একটি গামা ফোটনকেও (Single Photon) ধরা সম্ভব, তাই এই পদ্ধতির সুবেদিতা খুব বেশি। এই পদ্ধতিতে কিছু কিছু ক্যান্সার অন্য স্ক্যানের থেকে আগে ধরা পড়ে।

রিঅ্যাক্টর ছাড়াও নিউক্লিয়ার অ্যাক্সিলারেটরে বা কণাত্বরকে নিউক্লিয় বিক্রিয়ার মাধ্যমে এখন চিকিৎসাতে ব্যবহৃত আইসোটোপ তৈরি হয়। ১৯৪০-এর দশকে ভারতের প্রথম সাইক্লোট্রন অ্যাক্সিলারেটর তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা, তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ তৈরি করা। সেই সাইক্লোট্রনের জন্য প্রথম অর্থসাহায্য করেছিল টাটা চ্যারিটিজ ট্রাস্ট যারা তখন বম্বেতে ক্যান্সার হাসপাতাল বানাচ্ছিল। সেই পুরানো সাইক্লোট্রন অবশ্য বহুদিন বাতিল হয়ে গেছে, কিন্তু আধুনিক চিকিৎসার চাহিদা মেটাতে কলকাতার কাছেই নিউ গড়িয়াতে বসেছে এক নতুন সাইক্লোট্রন। ভারতের অন্য কণাত্বরকরা কখনো কখনো এইসব আইসোটোপ বানায়, কিন্তু এই নতুন সাইক্লোট্রনের প্রধান উদ্দেশ্যই হল তাই।

দেখা যাক কোন ধরনের আইসোটোপ এই সাইক্লোট্রনে তৈরি হয়। অক্সিজেনের একটা আইসোটোপ হল O-18। এটি তেজস্ক্রিয় নয়, সাধারণ অক্সিজেনের প্রতি পাঁচশো পরমাণুর মধ্যে একটি O-18-এর পরমাণু পাওয়া যায়।এই সাইক্লোট্রনে লক্ষ্যবস্তু হিসাবে যে জল ব্যবহার করা হয়, তাতে অবশ্য O-18 কিছু বেশি থাকে, যে পদ্ধতিতে তা করা হয় তাকে বলে এনরিচমেন্ট। সাইক্লোট্রন থেকে উচ্চশক্তি সম্পন্ন প্রোটন দিয়ে এই অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়াতে তৈরি হয় পেট স্ক্যানে ব্যবহৃত F-18। এছাড়াও অন্য নানা পদ্ধতিতে তৈরি হচ্ছে Ge-68, I-123, Tl-201 এই সমস্ত আইসোটোপ। এদের থেকে গামা রশ্মি বেরোয়। স্পেক্ট-Ge-68, I-123 এই আইসোটোপদের ব্যবহার করা হয়। থ্যালিয়ামের আইসোটোপ Tl-201 হৃৎযন্ত্রের অবস্থা নির্ণয়ে ব্যবহার হয়।

স্পেক্ট-এ গ্যালিয়ামের আইসোটোপ, Ga-68 ব্যবহার হয়। কিন্তু তার অর্ধায়ু কাল খুব কম, মাত্র আটষট্টি মিনিট। তাই অন্যত্র তৈরি করে এনে রোগীর দেহে ব্যবহার সম্ভব নয়, তার আগেই সমস্ত পরমাণুর ক্ষয় হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে জার্মেনিয়ামের আইসোটোপ Ge-68-কে উৎস বা জেনারেটর হিসাবে ব্যবহার করা হয়। জার্মেনিয়ামের এই আইসোটোপটির অর্ধায়ু হল 271 দিন, ফলে একবার তৈরি করলে অনেক দিন চলে। জার্মেনিয়ামের বিটাক্ষয় থেকে গ্যালিয়াম তৈরি হয়, স্পেক্ট-এ ব্যবহারের সময় জেনারেটর থেকে গ্যালিয়ামকে বার করে নিয়ে কাজে লাগানো হয়।

যে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপটি চিকিৎসাক্ষেত্রে সব থেকে বেশি ব্যবহার হয়, তা হল টেকনিশিয়ামের আইসোটোপ, Tc-99। টেকনিশিয়ামের সমস্ত আইসোটোপই তেজস্ক্রিয়, পৃথিবীতে তাদের পাওয়া যায় না। টেকনিশিয়ামের এই আইসোটোপের অর্ধায়ু কাল ছ' ঘণ্টা, ফলে প্রয়োগের এক দিনের মধ্যেই তার সমস্ত পরমাণু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সেকারণে দীর্ঘস্থায়ী তেজস্ক্রিয়তার সমস্যা নেই। এর থেকে যে গামা রশ্মিটি বেরোয় তার শক্তি 140 keV। এই শক্তির গামা রশ্মি ক্যামেরাতে সহজেই ধরা পড়ে। প্রতি বছর কোটি কোটি রোগীর দেহে স্পেক্ট, বোন স্ক্যান সহ নানা রকম পদ্ধতিতে রোগনির্ণয়ে ট্রেসার হিসাবে ব্যবহার হয় এই আইসোটোপ।

এবার আমরা ক্যান্সারের চিকিৎসাতে একটা অপেক্ষাকৃত আধুনিক পদ্ধতির কথা বলব। শরীরের ভিতরে কোনো অংশের ক্যান্সারের চিকিৎসা করা বেশ শক্ত। রেডিওথেরাপিতে এর জন্য নানারকম পদ্ধতি নেওয়া হয়, থাইরয়েডের ক্যান্সারের কথা যেমন আগে বলেছি। অস্ত্রোপচার না করে বাইরে থেকে বিকিরণ দিয়ে ক্যান্সার ধ্বংসের জন্য সাধারণত এক্স রশ্মি ব্যবহার করা হয়। এর প্রধান সমস্যা হল যে এক্স রশ্মি যে শুধু ক্যান্সারের টিউমারের কোশগুলিকেই মারবে এমন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, তার আগে ও পরে শরীরের যে অঙ্গের মধ্যে দিয়ে যাবে সেখানকার কোশগুলিও ধ্বংস হবে। তার পরিবর্তে প্রোটন বা কার্বনথেরাপি ব্যবহার শুরু হয়েছে। এর পোশাকি নাম পার্টিকলথেরাপি বা হ্যাড্রনথেরাপি। প্রোটন, নিউট্রন বা তাদের দিয়ে তৈরি নিউক্লিয়াস, এরা হল হ্যাড্রন। ইলেকট্রন কিন্তু হ্যাড্রন নয়। তাই হ্যাড্রনথেরাপি শব্দটাই সঠিকতর, তবে পার্টিকলথেরাপিই বেশি চালু।

দেহের কলার মধ্যে বিভিন্ন বিকিরণের শক্তি ক্ষয়

সঙ্গের ছবিতে কেমনভাবে দেহের কলার মধ্যে এক্স রশ্মি, প্রোটন এবং কার্বন আয়নের শক্তি ক্ষয় হয় দেখানো হয়েছে। যত বেশি শক্তি কোনো বিশেষ জায়গায় জমা পড়ে, সেখানে আয়নন তত বেশি হয়। দেখা যাচ্ছে দেহের গভীরে অবস্থিত টিউমারের মধ্যে আয়নন ঘটাতে গেলে এক্স রশ্মির অধিকাংশ শক্তিটাই আগে ও পরে জমা পড়ে, টিউমারে যায় কম। ফলে টিউমারের থেকে দেহের স্বাভাবিক কোশের ক্ষতি হয় বেশি। এই কারনে বিকিরণের মাত্রা বেশি করা সম্ভব নয়। মাত্রা কম হলে আয়ননও কম হবে। কিন্তু আয়নন কম হলে সাধারণত ডিএনএ-র দুটি তন্তুর একটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ধরণের ক্ষতি সারানো কোশের পক্ষে অনেক সহজ, ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে টিউমার কোশের মৃত্যু হয় না। প্রোটন বা কার্বন পার্টিকল থেরাপিতে অধিকাংশ শক্তি খুব কম একটা অংশে জমা পড়ে। পথের একদম শেষের এই অংশটাকে বলে ব্র্যাগ পিক, উইলিয়াম ব্র্যাগ এটি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। প্রচুর পরিমাণ শক্তি খুব অল্প জায়গায় জমা পড়ে, তাই হ্যাড্রনথেরাপিতে অনেক বেশি আয়নন হয়। সেই কারণে দুটি তন্তুই সাধারণত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে কোশের মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাছাড়া এক্স রশ্মি রেডিওথেরাপি কোশের মধ্যের অক্সিজেনকে আয়নিত করে ডিএনএ তন্তু ভাঙে। কিছু টিউমার আছে যাদের কোশে অক্সিজেন কম থাকে, এক্স-রশ্মি দিয়ে তাদের ধ্বংস করা কঠিন। হ্যাড্রনথেরাপিতে এই সমস্যা নেই।

দেহের অভ্যন্তরে কতদূরে টিউমারটি আছে, তা বিচার করে কণার গতিশক্তি ঠিক করা হয়। যেমন পঁচিশ সেন্টিমিটার ভিতরে টিউমার থাকলে প্রোটনের গতিশক্তি হতে হবে 200 MeV (মেগা ইলেকট্রনভোল্ট), কার্বনের জন্য প্রয়োজন 4500 MeV। কার্বন নিউক্লিয়াসের আধান প্রোটনের ছয় গুণ, তাই একই গভীরতাতে যেতে অনেক বেশি শক্তি প্রয়োজন হয়। সেই কারণে প্রোটনের থেকে কার্বন নিউক্লিয়াস টিউমারের মধ্যে বহু গুণ বেশি শক্তি জমা করে, ফলে কোশের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।

প্রোটনথেরাপিতে প্রোটন কণা অর্থাৎ হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে অ্যাক্সিলারেটরের সাহায্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি দেওয়া হয়। কার্বন থেরাপিতে প্রোটনের জায়গা নেয় কার্বনের নিউক্লিয়াস। কোন গতিশক্তির প্রোটন বা কার্বন নিউক্লিয়াস মানবদেহের ভিতরে কতদূরে প্রবেশ করতে পারে, তা খুব নির্দিষ্ট। শুধু তাই নয়, প্রোটন বা কার্বনের নিউক্লিয়াসের আধান আছে, ফলে তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করে খুব সরু রশ্মি (চালু কথায় পেনসিলের) আকারে পাঠানো সম্ভব; এক্স রশ্মি অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে টিউমারকে লক্ষ্য করে প্রোটন বা কার্বনকে পাঠানো যায়, অন্য কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কণাগুলি পথে খুব একটা বেশি শক্তি খরচ করে না, যাত্রাপথের শেষে গিয়ে প্রায় সমস্ত শক্তিটা একবারে ছেড়ে দেয়। তার ফলে টিউমারের আগে বা পরে কণাদের পথে যে সমস্ত কোশ পড়ে তাদের ক্ষতি হয় অনেক কম। সেই কারণে চিকিৎসার সময় বিকিরণের মাত্রা অনেক বেশি করা সম্ভব। ফলে চিকিৎসার সময়ও কমানো যায়। কার্বনথেরাপিতে প্রোটনের থেকেও আরো সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করে শুধুমাত্র টিউমারকে ধ্বংস করা সম্ভব। যে সব ক্ষেত্রে টিউমারটি মস্তিষ্কের মতো খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গের কাছে অবস্থিত, সেখানে পার্টিকল থেরাপি খুব কার্যকর হয়। প্রোটন বা কার্বনথেরাপিতে আরো একটা সুবিধা হল যে এর ফলে দেহের মধ্যে জমা হয় হাইড্রোজেন বা কার্বন। এই দুটি মৌল শরীরের মুখ্য উপাদানের মধ্যে পড়ে ও তারা আদৌ তেজস্ক্রিয় নয়। ফলে তেজস্ক্রিয়তার বিপদ নেই।

প্রোটনথেরাপির কথা প্রথম বলেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লরেন্স বার্কলে ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী রবার্ট উইলসন ১৯৪৬ সালে, কিন্তু তা পরীক্ষামূলকভাবে চালু হতে আট বছর পেরিয়ে যায়। হাসপাতালে প্রোটনথেরাপি প্রথম শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯০ সালে। এখন পৃথিবীতে প্রায় দেড়শো প্রোটনথেরাপি কেন্দ্র আছে। আমাদের দেশে মুম্বাই-এর টাটা মেডিক্যাল সেন্টার ও চেন্নাই-এর অ্যাপোলো হসপিতালে এই ব্যবস্থা আছে। কার্বন থেরাপি শুরু হয় ১৯৯৪ সালে জাপানে। পার্টিকলথেরাপি কো-অপারেটিভ গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে পৃথিবীতে মোট পনেরটি কার্বনথেরাপি সেন্টার চালু আছে, তার মধ্যে সাতটিই জাপানে। বছরে পনের থেকে কুড়িহাজার রোগীর প্রোটন ও পাঁচ হাজার রোগীকে কার্বন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা হয়।

হ্যাড্রনথেরাপি শুরু হয়েছিল দ্রুতগতির নিউট্রন দিয়ে ১৯৩৮ সালে, কিন্তু তা চিকিৎসার পক্ষে সুবিধাজনক ছিল না। আবার ১৯৬০-এর দশকে নতুন ভাবে অনেক জায়গায় শুরু হলেও বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য একটি কেন্দ্র ছাড়া বাকি সব গুলি বন্ধ হয়ে গেছে। তবে নতুন এক পদ্ধতি পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে। একে বলে বোরন নিউট্রন ক্যাপচার থেরাপি (BCNT)। এই পদ্ধতিতে টিউমারটিতে প্রথমে বোরনের আইসোটোপ B-10 প্রবেশ করানো হয়। এটি তেজষ্ক্রিয় নয়, তাই নিজে থেকে কোশের কোনো ক্ষতি করে না। এর পরে রিঅ্যাক্টর থেকে ধীরগতির নিউট্রন দেহের সেই অংশে ফেলা হয়। টিউমারের মধ্যের বোরন নিউট্রনের সঙ্গে বিক্রিয়াতে লিথিয়াম (Li-7) ও হিলিয়াম (He-4) নিউক্লিয়াস তৈরি করে। এই দুই নিউক্লিয়াসই খুব অল্প দূরত্ব গিয়েই থেমে যায়, ফলে তাদের পুরো গতিশক্তিটাই কোশের মধ্যে জমা পড়ে এবং টিউমারের কোশের মৃত্যু ঘটে।

তেজস্ক্রিয় নয় এমন নিউক্লিয়াসের ধর্মকেও রোগনির্ণয়ে ব্যবহার করা হয়, তার উল্লেখ করে শেষ করি। আমরা সবাই এমআরআই কথাটা শুনেছি। পুরো কথাটা হল নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং, কিন্তু নিউক্লিয়াস শুনলেই অনেকে ভয় পান বলে প্রথম শব্দটা আর ব্যবহার হয় না। বিজ্ঞানের পরীক্ষাগারে কিন্তু পুরো নামটাই চালু। অনেক নিউক্লিয়াসের চৌম্বক ভ্রামক (Magnetic moment) আছে, অর্থাৎ তারা শক্তিশালী চৌম্বকক্ষত্রের সঙ্গে ক্রিয়া করে। এই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে দেহের ভিতরের বিভিন্ন অঙ্গের ছবি তোলা সম্ভব, সেটাই হল ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং। এই পদ্ধতি সব থেকে বড় সুবিধা হল যে এতে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। এক্স-রে দেহের ক্ষতি করে, এমনকি বেশি এক্স-রে থেকে ক্যান্সারও হতে পারে। এমআরআই-তে সেই সম্ভাবনা নেই। এমআরআই-এর সাহায্য টিউমারটিকে চিহ্নিত করা সম্ভব হলে তাকে ধ্বংস করার জন্য পার্টিকলথেরাপিতে কত শক্তি হওয়া প্রয়োজন তা নির্ণয় করা খুব সহজ। নিউক্লিয় ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স পদ্ধতি আবিষ্কার ও তার উন্নতির জন্য ১৯৪৪ সালে ইসিডোর রাবি এবং ১৯৫২ সালে ফেলিক্স ব্লখ ও এডওয়ার্ড মিলস পার্সেল পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

বিজ্ঞানের অগ্রগতি যে এই একটি ক্ষেত্রে অন্তত মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হচ্ছে সন্দেহ নেই। মনে রাখতে হবে যে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে; অন্য সমস্ত পদ্ধতিরও প্রয়োজন আছে। ক্যান্সারের চিকিৎসায় পার্টিকলথেরাপির ব্যবহার ক্রমশই বাড়ছে। তবে সাধারণ চিকিৎসার থেকে পার্টিকলথেরাপির খরচ অনেক বেশি, তার কারণ যন্ত্রপাতির দাম। সেই কারণেও রোগীদের খুব কম অংশই এর সুযোগ নিতে পারে। এমন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশেও কোনো কার্বনথেরাপি কেন্দ্র এখনো চালু হয়নি। আশা করা যাক ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি একে সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে আনবে।


আরো জানতে হলে

Scientific and technological development of hadrontherapy, Saverio Braccin, Astroparticle, Particle and Space Physics, Detectors and Medical Physics Applications. World Scientific (2010)

Particle Therapy Cooperative Group (PTCOG) website https://www.ptcog.site/

VECC Medical Cyclotron Facility website https://www.vecc.gov.in/r-d-activities/742

প্রকাশ - জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার, শারদ ২০২৪

Wednesday, 20 November 2024

আইনস্টাইন ও সত্যেন্দ্রনাথ - কিছু তথ্য, কিছু প্রশ্ন

 

আইনস্টাইন ও সত্যেন্দ্রনাথ - কিছু তথ্য, কিছু প্রশ্ন

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়




এই বছর আমরা বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়নের শতবর্ষ পালন করছি। দুজনের নাম একই তত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত হলেও তাঁরা একসঙ্গে এই বিষয়ে গবেষণা করেননি। বিজ্ঞানে এমন ঘটনা অবশ্য একেবারে বিরল নয়। অন্য যে সংখ্যায়নটি তার পরেই আবিষ্কার হয়, সেই ফের্মি-ডিরাক সংখ্যায়ন তার আরেক উদাহরণ। এই লেখাতে আমরা সত্যেন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের যোগাযোগ ও সম্পর্ক ফিরে দেখব। সেই প্রসঙ্গে উঠে আসা কিছু প্রশ্ন ও তথ্যের কিছু ফাঁক নিয়ে অনেকেই আলোচনা করেছেন, সেগুলি সম্পর্কেও আমরা সংক্ষেপে জানব।

আইনস্টাইনের জন্ম ১৮৭৯ সালে। পাঠকরা সবাই জানেন যে ১৯০৫ সালে তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, আলোকতড়িৎ বিক্রিয়ার কোয়ান্টাম ব্যাখ্যা ইত্যাদি সংক্রান্ত গবেষণাপত্রগুলি প্রকাশের পরে তিনি পদার্থবিজ্ঞানী মহলে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সেই সময়ে তিনি ছিলেন পেটেন্ট অফিসের কেরানি, অল্পদিনের মধ্যেই নানা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অধ্যাপক পদে নিয়োগের জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। সেটি অবশ্য এতই জটিল যে খুব কম বিজ্ঞানীই তার মর্মোদ্ধার করতে পেরেছিলেন। তিন বছর পরে এক সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের পাশ দিয়ে আসা তারার আলো কতটা বাঁকে তা পরীক্ষা করে সাধারণ আপেক্ষিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এর পরেই বিজ্ঞানী মহলের বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯১৫ থেকে তিনি ছিলেন বার্লিনে প্রাশিয়ান আকাডেমি অফ সায়েন্সে। হিটলারের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বুঝে ইহুদি আইনস্টাইন প্রাণ বাঁচাতে ১৯৩২ সালে সপরিবারে দেশত্যাগ করেন।

সত্যেন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৯৪ সালে। প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি ১৯১১ থেকে ১৯১৩ এই দুই বছর গণিত নিয়ে বিএসসি ও সেখান থেকেই পরের দু' বছরে মিশ্র গণিত নিয়ে এমএসসি করেন। দুই পরীক্ষাতেই তিনি হয়েছিলেন প্রথম, মেঘনাদ সাহা দ্বিতীয়। তাঁদের পাঠক্রমে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের কোনো তত্ত্ব ছিল না। জহুরি আশুতোষ মুখোপাধ্যায় জহর চিনতেন, তিনি দুই গণিতের ছাত্রকে ডেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবপ্রতিষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়ানোর দায়িত্ব দেন। মেঘনাদ পড়াবেন কোয়ান্টাম তত্ত্ব, সত্যেন্দ্রনাথ আপেক্ষিকতা। ১৯১৬ সালে তাঁরা দুজনে পড়ানো শুরু করেন।

পড়ানোর প্রথম সমস্যা হল বইয়ের অভাব। পাঠক্রমে লেখা ছিল শিক্ষকরা গবেষণাপত্র থেকে পড়াবেন। পড়াতেনও তাই, পরীক্ষার প্রশ্ন থেকে দেখতে পাই নানা নতুন আবিষ্কার দু' তিন বছরের মধ্যেই পাঠক্রমে স্থান করে নিত, এখন যা অচিন্ত্যনীয়। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভাষা। কারণ এই সব নতুন বিষয়ে অধিকাংশ অগ্রগতিই হত জার্মানিতে, ফলে সেই গবেষণাপত্র ও বইগুলি জার্মান ভাষাতেই পাওয়া যেত। দুই বন্ধু তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মান শেখার ক্লাসে ভর্তি হয়ে যান।

কিন্তু শুধু শিক্ষকরা জার্মান জানলেই তো পড়ানো হবে না, ছাত্রদের কী হবে? দুই বন্ধু তাই পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত করলেন আপেক্ষিকতা বিষয়ে আইনস্টাইন ও অপর এক বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের একদা শিক্ষক হেরমান মিনকাওস্কির কয়েকটি গবেষণাপত্র তাঁরা অনুবাদ করে ছাপাবেন। দুই বন্ধুর অনুরোধে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বোস অনুমতি চেয়ে আইনস্টাইনকে চিঠি লেখেন। আইনস্টাইন সম্মতি দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বইটি প্রকাশ করে, ভূমিকা লিখেছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ। এটিই ছিল আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বিষয়ক গবেষণাপত্রগুলির প্রথম ইংরাজি অনুবাদ। চারটি প্রবন্ধের মধ্যে একটির অনুবাদ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ, সেটি ছিল ১৯১৬ সালে প্রকাশিত সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বিষয়ক আইনস্টাইনের গবেষণাপত্রটি। এই বই নিয়ে পরে আইনস্টাইন ও তাঁর প্রকাশকের মধ্যে সমস্যা হয়েছিল। প্রকাশকের শর্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় ভারতবর্ষের বাইরে সেই বই বিক্রি বন্ধ করে দেয় ও সমস্ত অবিক্রীত কপি বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনে।

দেবেন্দ্রমোহনের কথা আমাদের কাহিনিতে ফিরে ফিরে আসবে, তাই তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া যাক। তিনি ডি এম বোস নামেই পরিচিত। ্তিনি ছিলেন জগদীশচন্দ্রের ভাগনে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার পরে তিনি যান ইংল্যান্ডে। সেখানে কেম্ব্রিজে আবার বিএসসি করেন, সেই সময় দুই বিখ্যাত নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ইলেকট্রনের আবিষ্কর্তা জে জে টমসন ও মেঘকক্ষের উদ্ভাবক সি টি আর উইলসনের সঙ্গে তিনি কাজ করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন বিজ্ঞান পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তাঁকে ও সি ভি রামনকে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নিয়োগ করা হয়। চাকরির শর্ত অনুযায়ী তাঁর দুই বছর বিদেশে গবেষণা করার কথা, তিনি জার্মানিতে যান। সেটা ছিল ১৯১৪ সাল। তার পরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ও তিনি জার্মানিতে আটকে পড়েন। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত তিনি সে দেশেই থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই সময় আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল। বিজ্ঞানী হিসাবে তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট খ্যাতিসম্পন্ন ছিলেন।

সত্যেন্দ্রনাথ ১৯২১ সালে কলকাতা ছেড়ে নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার রিডার পদে যোগ দেন। সেখানে আধুনিক পদার্থবিদ্যা পড়ানোর অন্য কেউ ছিলেন না। পূর্ণ অধ্যাপক অর্থাৎ প্রফেসর ও বিভাগের প্রধান পদে ছিলেন ওয়াল্টার জেনকিন্স নামের এক ইংরাজ। মানুষটি ভালো, তবে সত্যেন্দ্রনাথের মতে পদার্থবিদ্যার থেকে ফুটবলে তাঁর দখল বেশি ছিল। স্বাভাবিকভাবেই আধুনিক সব তত্ত্ব সত্যেন্দ্রনাথকেই পড়াতে হত। দেবেন্দ্রমোহন যখন বিদেশ থেকে ফেরেন, সঙ্গে করে এনেছিলেন মাক্স প্লাঙ্কের লেখা তাপগতিতত্ত্ব বিষয়ক বই, যেটি তিনি সত্যেন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন। তাপগতিতত্ত্বে প্লাঙ্কের সূত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়েই সত্যেন্দ্রনাথের তাঁর বিখ্যাত আবিষ্কারে পৌঁছেছিলেন।

কোয়ান্টাম তত্ত্বের সূচনা হয়েছিল প্লাঙ্কের সেই সূত্র থেকে। তিনি ১৯০০ সালে কৃষ্ণবস্তু থেকে বেরোনো আলোর চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ধরেছিলেন আলো যে কোন পরিমাণ বেরোতে পারে না; তার একটা নির্দিষ্ট ক্ষুদ্রতম মান আছে, যাকে তিনি বলেছিলেন কোয়ান্টাম। প্লাঙ্ক দেখিয়েছিলেন যে আলোর ধর্ম ব্যাখ্যা করতে গেলে ধরে নিতে হবে কোয়ান্টামকে আর ভাঙা যায় না। পাঁচ বছর পরে আইনস্টাইন সেই ধারণা থেকে শুরু করে আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা দেন। এই কোয়ান্টামের পরে নাম হয় আলোর কণা ফোটন। এই সমস্তের মধ্যে একটা সমস্যা থেকেই গিয়েছিল। তা হল প্লাঙ্কের সূত্রে একই সঙ্গে আলোর কণিকা ও তরঙ্গ এই দুই আপাত পরস্পরবিরোধী ধর্ম কল্পনা করতে হয়। এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন প্লাঙ্ক, আইনস্টাইন সহ অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী। আইনস্টাইনের সেই প্রয়াস পরবর্তীকালে লেজারের জন্ম দেবে। কিন্তু কেউই পুরোপুরি সফল হননি।

এই সমস্যার প্রতি সত্যেন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মেঘনাদ। অল্প দিন চিন্তা করেই সত্যেন্দ্রনাথ সমস্যার এক সমাধান করেন ও একটি গবেষণাপত্র লেখেন। সত্যেন্দ্রনাথ দেখান যে কণিকা ধর্মের সাহায্যেই প্লাঙ্কের সূত্রের ব্যাখ্যা সম্ভব, তরঙ্গ ধর্মের কোনো প্রয়োজন নেই। সেটি তিনি ব্রিটেনের বিখ্যাত জার্নাল ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য পাঠান। সেখানে কী হয়েছিল জানা নেই, কিন্তু কয়েকদিন পরেই তিনি আইনস্টাইনকে গবেষণাপত্রটি পাঠান। সঙ্গের চিঠিতে তিনি আইনস্টাইনকে তাঁর প্রবন্ধ অনুবাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন যে তাঁর জার্মান সেইরকম ভালো নয়, আইনস্টাইন যদি কাজটি ছাপার যোগ্য মনে করেন তাহলে তিনি যেন সেটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে জাইটশক্রিফট ফার ফিজিক গবেষণা পত্রিকাতে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। চিঠিটি তিনি পাঠিয়েছিলেন ১৯২৪ সালের ৪ জুন। আইনস্টাইনের উত্তরের অপেক্ষা না করেই এগারো দিন পরে তিনি সেই বিষয়ে দ্বিতীয় একটি গবেষণাপত্র পাঠান। প্রথম প্রবন্ধটি পড়ে আইনস্টাইন অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি সেটিকে নিজেই অনুবাদ করেন এবং ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। একটা পরিবর্তন তিনি করেছিলেন, সে কথা আসবে পরে। বন্ধু পল এহরেনফেস্টকে আইনস্টাইন লিখেছিলেন, ‘The Indian Bose has given a beautiful derivation of Planck’s law…’আইনস্টাইন এক পোস্টকার্ডে প্রবন্ধটি প্রকাশের খবর সত্যেন্দ্রনাথকে পাঠান ২ জুলাই, সেদিনই তিনি প্রবন্ধটি প্রকাশের জন্য জমা দেন। তিনি লেখেন কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সব কথার সঙ্গে তিনি একমত নন, কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে এটা এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।

ব্যক্তিগত জীবনে আইনস্টাইনের সেই পোস্টকার্ডের ফল অবিলম্বে পেয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পরে মুসলিম সমাজের নেতারা ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করে ঢাকাতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানান। ব্রিটিশ সরকার সেই দাবি মেনে নিয়েছিল। ঢাকার প্রথম উপাচার্য হয়েছিলেন ফিলিপ হার্টগ, তিনি ভারতের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে বেশি মাইনে দিয়ে যোগ্য শিক্ষকদের ঢাকাতে টেনে নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ ছাড়াও ছিলেন জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুশোভন সরকার, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, মহম্মদ শহিদুল্লা, মোহিতলাল মজুমদার, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিখ্যাত পণ্ডিতরা।

সত্যেন্দ্রনাথ ঢাকাতে মাইনে চেয়েছিলেন চারশো টাকা, কলকাতায় পেতেন আড়াইশো। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নথি ও অন্যান্য সূত্র থেকে অনুমান হয় রিডারদের সর্বনিম্ন বেতন হয়েছিল সাতশো টাকা, ইনক্রিমেন্ট বাৎসরিক পঞ্চাশ টাকা। সেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’ একজন ছাড়া বাকি প্রফেসরদের মাইনে ছিল পাঁচশো টাকা। কিন্তু এই বেশি মাইনে দিতে গিয়ে দু’বছর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়ে। সত্যেন্দ্রনাথকে প্রস্তাব দেওয়া হল তঁর মাইনে কমে হবে পাঁচশো টাকা। সত্যেন্দ্রনাথ রাজি নন, তিনি জানিয়ে দিলেন মাইনে কমালে তিনি পদত্যাগ করবেন। উপাচার্য হার্টগ সত্যেন্দ্রনাথের মতো শিক্ষককে হারাতে তিনি চান না, কিন্তু অন্য দিকে আর্থিক সমস্যা। তিনি বারবার চিঠি লিখলেন, সত্যেন অনড়। শেষকালে এই সমস্যার সমাধানেই একটা কমিটি তৈরি হল, বোস কমিটি। সদস্য হার্টগ, সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু ও সহকর্মী জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ এবং এক আইনজ্ঞ পি কে ঘোষ; জেনকিন্স আমন্ত্রিত সদস্য। কমিটির দায়িত্ব হল বোসের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁকে ঢাকাতে রাখার ব্যবস্থা করা। সত্যেন্দ্রনাথ চাইলেন বিদেশে গবেষণার জন্য দু’বছরের সবেতন ছুটি ও সাড়ে বারো হাজার টাকা অনুদান।

এই সমস্ত আলোচনাতে প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেল। ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কমিটি সত্যেন্দ্রনাথের ছুটির আবেদন মেনে নেওয়ার সুপারিশ করল। সাড়ে বারো হাজার টাকাটা শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছিল তেরো হাজার আটশো টাকা। সুপারিশে সত্যেন্দ্রনাথের মাইনেও অপরিবর্তিত রইল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ তখনো ছুটি দিতে টালবাহানা করছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ ডক্টরেট নয়, হার্টগ তাঁকে আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইছিলেন যে বিদেশে থাকার সময় তাঁর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে সেই ডিগ্রিটা নিয়ে আসা উচিত। সত্যেন্দ্রনাথ একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে আইনস্টাইনের পোস্টকার্ডটি দেখালেন। হার্টগ সেটি পড়ে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনি যেমন ভালো বোঝেন করুন।’ সেই পোস্টকার্ডের জেরে ছুটি সহজেই অনুমোদন করল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল, কলকাতার জার্মান দূতাবাসও সেই পোস্টকার্ড দেখে বিনা পয়সায় ভিসা মঞ্জুর করে দিল।

এই অবধি আমাদের কাহিনি সরলরেখায় এগিয়েছে, কিন্তু এর পরের দু’ বছর নানা প্রহেলিকায় ভরা। সত্যেন্দ্রনাথ জাহাজ থেকে নামলেন ইতালির ভেনিসে। সেখান থেকে বার্লিন কাছেই, কিন্তু তিনি গেলেন প্যারি। সেখানেই কাটাবেন প্রথম বছর। প্যারিতে অনেক ভারতীয় বন্ধু ছিলেন, কিন্তু বিজ্ঞানী পল লাজভাঁ ছাড়া কোয়ান্টাম তত্ত্ব বিষয়ে গবেষণারত কোনো বিজ্ঞানীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়নি। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লুই দি ব্রয়লি প্যারিসেই গবেষণা করেন, সত্যেন্দ্রনাথ সময় কাটালেন তাঁর দাদা মরিসের এক্স-রে ল্যাবরেটরিতে, কিন্তু লুইয়ের সঙ্গে আলাপ করেননি। কিছুদিন ছিলেন মাদাম কুরির গবেষণাগারে, সেখানেও এই বিষয়ে আলোচনার কেউ ছিলেন না।

ভারত থেকে আইনস্টাইনকে কোনো চিঠিতে তাঁর ইউরোপ আসার খবর জানাননি সত্যেন্দ্রনাথ। ১৯২৪ সালের অক্টোবর মাসে তিনি ইউরোপে পৌঁছান। ২৬ অক্টোবর তিনি আইনস্টাইনকে চিঠি লিখে দ্বিতীয় পেপারটির খবর জানতে চান। আরো লেখেন যে তিনি দু’বছরের জন্য ইউরোপে এসেছেন, আইনস্টাইনের অধীনে কাজ করতে চান।

এই দ্বিতীয় পেপারটিও তিনি ফোটনের সংখ্যায়নের উপর লিখেছিলেন। এটিও অনুবাদ করেন আইনস্টাইন কিন্তু পুরোটা তাঁর মনঃপূত হয়নি, এবং ছাপানোর সময় আইনস্টাইন সেই কথা শেষে লিখে দিয়েছিলেন। আইনস্টাইনের বিকিরণ সংক্রান্ত যে গবেষণা থেকে লেজারের উদ্ভব, সত্যেন্দ্রনাথের পেপারটি তার কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক রাজিন্দর সিং দুই বিজ্ঞানী ফন লউ ও সমারফেল্ডের মধ্যে পত্র বিনিময় থেকে এই দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটি বিষয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য সংযোজন করেছেন। সেই সময়েই কয়েকজন জার্মান বিজ্ঞানী ইহুদিদের তথা অ-জার্মানদের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেছেন। ফন লউ সমারফেল্ডকে লেখেন যে সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণাপত্র ইংরাজিতে প্রকাশের ব্যাপারে অনেকেই আপত্তি জানিয়েছেন। রাজিন্দর অনুমান করেছেন যে আইনস্টাইন বোসের দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটি অনুবাদ না করেই সুপারিশ করেছিলেন, কারণ সেটির সমস্ত বক্তব্যের সঙ্গে তিনি একমত হতে পারেননি। তাছাড়া সেটি ছিল বেশ দীর্ঘ, কাজেই অনুবাদও বেশ পরিশ্রমসাধ্য ছিল। বিতর্কের মুখে পড়ে সম্পাদক আইনস্টাইনকে সেটিও অনুবাদ করতে বলেন। আইনস্টাইন অনুবাদের সঙ্গে প্রায় এক পাতা মন্তব্য জুড়েছিলেন। সম্ভবত সেই কারণে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের কপিগুলি সত্যেন্দ্রনাথের কাছে না পাঠিয়ে আইনস্টাইনের কাছে পাঠানো হয়, এবং সত্যেন্দ্রনাথ সেটি প্রকাশের কথা তখন জানতেই পারেননি। কেন আইনস্টাইন আগে সেকথা সত্যেন্দ্রনাথকে জানাননি অনুমান করতে পারি না। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন যে সত্যেন্দ্রনাথ গবেষণাপত্রিকাতেই দেখেছেন যে সেটি প্রকাশিত হয়েছে এবং সে বিষয়ে আইনস্টাইনের মতও জেনে গেছেন। এই চিঠিটি পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আইনস্টাইন উত্তর দেন এবং ওই গবেষণাপত্র সম্পর্কে তাঁর মত জানান। তিনি এও লেখেন যে সত্যেন্দ্রনাথ যখন বার্লিনে আসবেন, তাঁদের মধ্যে কথা হবে।

আইনস্টাইনের মন্তব্য পড়ে বেশ আঘাত পেয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ, তিনি চিরকাল এই দ্বিতীয় পেপারটিকে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ মনে করতেন। তখনই কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি এই বিষয়ে আর একটি পেপার লেখেন, এবং সেটি আইনস্টাইনকে পাঠান ১৯২৫ সালের ২৭ জানুয়ারি। তিনি লেখেন যে শীতের পরে তিনি বার্লিন যাবেন। কিন্তু আইনস্টাইন সে বছর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ছিলেন দক্ষিণ আমেরিকাতে, কাজেই সেই সময় দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। অক্টোবরের আগে সত্যেন্দ্রনাথ প্যারি ছাড়েননি। বার্লিনে পৌঁছে ৮ অক্টোবর তিনি আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখে করতে চেয়ে চিঠি পাঠান। আইনস্টাইন তখন বার্লিনে ছিলেন না, ফেরার পরে নভেম্বর মাসে তাঁদের দেখা হয়। ততদিনে সত্যেন্দ্রনাথের ইউরোপবাসের এক বছর পূর্ণ হয়েছে।

এই তৃতীয় পেপারের কথা ফিরে আসবে, কিন্তু এই এক বছরের মধ্যে আইনস্টাইন কী করেছেন দেখা যাক। সত্যেন্দ্রনাথের প্রথম পেপারটার শেষে আইনস্টাইন লিখেছিলেন এই পদ্ধতি তিনি ভরযুক্ত কণার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দেখাবেন। সেই কাজ তিনি করবেন ১৯২৪ সালের ১০ জুলাই প্রাশিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সে এক বক্তৃতায়। এর পরে আরো দুটি পেপার নিয়ে আইনস্টাইন প্রাশিয়ান অ্যাকাডেমিতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসে। এর পরে আইনস্টাইন আর কখনো এই বিষয়ে কোনো কাজ করেননি। এই তিনটি অত্যন্ত মৌলিক কাজের জন্যই সঠিকভাবেই নতুন সংখ্যায়নে সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর নাম যুক্ত হয়ে যায়।

এই প্রসঙ্গে মনে প্রশ্ন আসে যে ভারত থেকে চিঠি না লিখে বা ইউরোপে নেমে সরাসরি জার্মানি না গিয়ে কি এক সোনার সুযোগ হারিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ? ১৯২৪ সালের জুলাই মাসের বক্তৃতার আগে সত্যেন্দ্রনাথের পক্ষে আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করা নিশ্চয় সম্ভব হিল না, কিন্তু তার পরে? কেউ কেউ আইনস্টাইনকে দোষারোপ করেন যে তিনি সত্যেন্দ্রনাথের কাজকে ব্যবহার করে নিজের গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু তাঁকে সেই গবেষণাতে অংশ নেওয়ার জন্য আহ্বান করেননি। এই মত সম্ভবত আইনস্টাইনের প্রতি সুবিচার করে না। বিজ্ঞানীমহলে সবাই জানেন যে একবার গবেষণা প্রকাশ করার পরে তাকে অন্য যে কেউ নিজের ব্যবহার করতে পারে। আইনস্টাইন ঠিক সেই কাজটাই করেছেন। তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না যে সত্যেন্দ্রনাথের সামনে ইউরোপে আসার সুযোগ এসেছে, জানা থাকলেও তিনি নিশ্চয় তাঁর জন্য নিজের গবেষণাকে থামিয়ে রাখবেন না। আইনস্টাইন কাজ করতেন মূলত একা। মাত্র ছ’মাস তিনি এই নতুন স্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে চিন্তা করেছিলেন, তারপরেই তিনি তাঁর আগের কাজে ফিরে যান। কিন্তু ওই ছ’মাসের মধ্যে চারমাস সত্যেন্দ্রনাথ ইউরোপেই ছিলেন, কিন্তু আইনস্টাইনের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেননি। প্রশ্ন আসে কেন?

এর উত্তর এখন আর জানার উপায় নেই। তবে অনুমান করি আইনস্টাইনের বিপুল প্রতিভার সামনে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। একই ঘটনা ঘটেছিল মাদাম কুরির ল্যাবরেটরিতে। মাদাম তাঁকে বলেন আগে ফরাসি শিখে আসতে, তারপর তিনি মাদামের প্রতিষ্ঠানে জায়গা পাবেন। সত্যেন্দ্রনাথ মাদামের মুখের উপর বলে উঠতে পারেননি যে ফরাসি তিনি ভালোই জানেন।

প্রথম পেপারটির কোনো মূল কপি পাওয়া যায়নি। জার্মান অনুবাদে লেখকের নাম দেওয়া আছে বোস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিমধ্যে আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথের নাম বিস্মৃত হয়েছিলেন, ফলে জুলাই মাসের বক্তৃতাতে ও ছাপা পেপারে এস এন বোস হয়ে গেছেন ডি বোস। স্পষ্টতই তাঁর মাথায় ছিল দেবেন্দ্রমোহনের কথা। জানুয়ারি মাসে অবশ্য আইনস্টাইন বোস-এ ফিরে যান; ইতিমধ্যে সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর আরো পত্র বিনিময় হয়েছে। আইনস্টাইনের এই স্মৃতিভ্রংশের জন্যই সম্ভবত পরেও সমস্যা হয়েছে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব বিষয়ক এক বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রণ এসেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোস-এর নামে, স্বাভাবিকভাবেই যোগ দিয়েছিলেন দেবেন্দ্রমোহন। অনুমান করা হয় ওটি সত্যেন্দ্রনাথের কাছেই আসার কথা ছিল। আবার জার্মানিতে একই বানানে বোসে পদবী আছে, ফলে অনেকের ধারণা ছিল এই কাজ এক জার্মান বিজ্ঞানীর করা।

সত্যেন্দ্রনাথ আইনস্টাইন সাক্ষাৎ বেশি হত ৫ নম্বর হেবেরল্যান্ডস্ট্রাসের আইনস্টাইনের ছোট্ট ফ্ল্যাটে। (কয়েকমাস আগে বার্লিনে আমি সেই ফ্ল্যাটের খোঁজ করেছিলাম, জানতে পারি বাড়িটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গেছে।) আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথকে বোস পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে দুটি সমস্যার কথা বলেছিলেন। প্রথমটি হল ফোটনদের নিজেদের মধ্যে কোনোরকম ক্রিয়া করে কিনা দেখা। দ্বিতীয়টির কথা সত্যেন্দ্রনাথ নিজেই পরবর্তীকালে বলেছিলেন, তা হল পরমাণুর শক্তিস্তরের ফোটন নির্গমন বা শোষণ। তাই ছিল সত্যেন্দ্রনাথের তৃতীয় পেপারের বিষয়। সত্যেন্দ্রনাথ ঠিক কী করেছিলেন জানা নেই, তবে আইনস্টাইনকে পাঠানো চিঠি ও পরের স্মৃতিচারণ থেকে কিছু অনুমান করা যায়। সমস্যাটার সমাধান করবে কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব, তা অনেকাংশে সত্যেন্দ্রনাথের অনুমানকেই সমর্থন করবে।

কোনো সমস্যাটিতেই বিশেষ এগোতে পারেননি সত্যেন্দ্রনাথ। পুরানো কোয়ান্টাম তত্ত্বের দিন তখন শেষ, জন্ম নিচ্ছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। এখন আমরা বুঝি যে পুরানো কোয়ান্টাম তত্ত্ব ছিল ধ্রুপদি পদার্থবিজ্ঞান ও কোয়ান্টাম সম্পর্কিত ধারণা মিলিয়ে দেওয়ার এক প্রয়াস, তা সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। এই তত্ত্বের চারজন স্থপতির তিনজন -- প্ল্যাঙ্ক, আইনস্টাইন, ও সত্যেন্দ্রনাথ – কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো অবদান রাখতে পারেননি। একমাত্র নিলস্‌ বোর তাকে খোলা মনে গ্রহণ করেছিলেন, যদিও তাতে তাঁর অবদান পদার্থবিদ্যার থেকে দর্শনের দিকেই বেশি। পদার্থবিদ্যার যে তরুণতম প্রজন্ম পরের দুই বছরে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সৃষ্টি করেছিলেন একমাত্র এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার ছাড়া তাঁরা কেউই তখন পঁচিশ বছর পেরোননি। শ্রয়ডিঙ্গারও নিজের তত্ত্বের তাৎপর্য প্রথমে বুঝতে পারেননি। সনাতনী পদার্থবিজ্ঞান ও পুরানো কোয়ান্টাম তত্ত্বে শিক্ষিত বত্রিশ বছরের সত্যেন্দ্রনাথ তখন বয়স্কের দলে। সেই কারণেই সম্ভবত দুই সমস্যার সমাধানের পথে সত্যেন্দ্রনাথ এগোতে পারেননি। এই তরুণ দলের অভিভাবক ছিলেন নিলস বোর, ফিরে তাকালে মনে হয় বার্লিন বা প্যারি নয়, সত্যেন্দ্রনাথের সঠিক গন্তব্য ছিল কোপেনহাগেনে বোরের ইনস্টিটিউট।

একটা উদাহরণ থেকে বোঝা যায় যে আইনস্টাইন তখন বিজ্ঞানে কতটা রক্ষণশীল। সত্যেন্দ্রনাথের কথা ও অন্য প্রমাণ থেকে বোঝা যায় যে সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম পেপারে ফোটনের স্পিন বা নিজের চারদিকে ঘূর্ণনের কথা লিখেছিলেন, আইনস্টাইন সেটি কেটে দেন। অল্পদিন পরেই পল এহ্‌রেনফেস্টের দুই ছাত্র ইলেকট্রনের ঘূর্ণনের কথা বলেন। এহ্‌রেনফেস্ট জানতেন যে ধ্রুপদি পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে তা অসম্ভব, কিন্তু তিনি তাঁদের পেপারটি ছাপতে পাঠিয়ে দেন। এখন আমরা জানি যে এই ঘূর্ণন বা স্পিন-এর সঙ্গে কণার নিজের চারদিকে ঘোরার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু স্পিন-এর আবিষ্কারক হিসাবে আমরা সেই দুই ছাত্র জর্জ উহ্‌লেনবেক ও স্যামুয়েল গৌডস্মিটকেই মনে রেখেছি।

শুধু বিজ্ঞান নয়, নানা বিষয়ে আলোচনা হত সত্যেন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের। মিল ছিল অনেক। দুজনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে ভালবাসতেন। কিন্তু অমিলও ছিল। ভারতে ইংরেজশাসন সম্পর্কে তাঁদের মত কখনোই মেলেনি। আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন যে ঔপনিবেশিক পশ্চিমী জাতিদের মধ্যে ইংরেজরা ভালো। তিনি একবার সত্যেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ধরো তোমার হাতের কাছে একটা বোতাম রয়েছে, যেটি টিপলে সব ইংরাজ তোমাদের দেশ থেকে চলে যাবে তা হলে সত্যই কি তুমি সেই বোতাম টিপে দেবে?’ সত্যেন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘ভগবান যদি এমন একটা সুযোগ আমাকে দেন, তো ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করে সেটি আমি টিপে দেব।’ সত্যেন্দ্রনাথ উল্টে জিজ্ঞাসা করেন আইনস্টাইন কেন ইহুদিদের জন্য নতুন দেশ ইজরায়েল প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করেন। আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথের বক্তব্য বুঝতে পারলেন, বললেন ‘অবশ্য এবার আমি তোমার কথা বুঝেছি -- এটা প্রাণের আবেগের কথা -- একে যুক্তিতর্কে বোঝা যায় না।’

বার্লিনে থাকাকালীনই ঢাকাতে প্রফেসর পদ ফাঁকা হয়। সত্যেন্দ্রনাথ আবেদন করেন, কিন্তু ডক্টরেট নেই বলে তাঁকে কয়েকটা সুপারিশপত্র পাঠাতে হবে। আইনস্টাইনকে অনুরোধ করলেন। আইনস্টাইন অবাক হলে বললেন, ‘আপনারও সুপারিশ লাগবে?’ লিখে দিলেন, ‘The recent works of Mr S N Bose, specially his theory of radiation equilibrium, signify in my opinion an important and enduring progress of the physical theory. Also in personal discussion with Mr Bose, I have got the impression that he is a man of unusual gift and depth, from whom science has much to expect.’ প্যারি থেকে পল লাজভাঁ ও জার্মানিতে সত্যেন্দ্রনাথ যে এক্স-রশ্মি ল্যাবরেটরিতে অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন সেখানকার বিজ্ঞানী হেরম্যান মার্কও তাঁর সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করে চিঠি পাঠালেন।

এত প্রশংসা সত্ত্বেও কিন্তু নির্বাচনী কমিটির প্রথম পছন্দ হল ডি এম বোস, দ্বিতীয় সত্যেন্দ্রনাথ। এখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিল মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর্নল্ড সমারফেল্ডের মতামত, তিনি ছিলেন কমিটির বিশেষজ্ঞ। তাঁর মত ছিল দুজনেই খুব ভালো। কিন্তু ডি এম বোস একই সঙ্গে তত্ত্ব ও পরীক্ষানিরীক্ষাতে দক্ষ, তাই তিনিই সবচেয়ে যোগ্য। সমারফেল্ড কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রধান রূপকারদের অন্যতম, তাঁর সাতজন ছাত্র নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য উঠেছে চুরাশি বার, কিন্তু পুরস্কার তাঁর অধরা থেকে গেছে। এ সব অবশ্য কয়েক বছর পরের কথা, কিন্তু তখনও কমিটির পক্ষে তাঁর মত অগ্রাহ্য করা সম্ভব ছিল না। তাই আইনস্টাইনের সুপারিশও শেষ কথা বলল না।

ডি এম বোস কেন প্রফেসর পদের জন্য আবেদন করেছিলেন বোঝা শক্ত। তিনি কলকাতাতে নিজের ল্যাবরেটরি বানিয়েছেন, মামার তৈরি করা বসু বিজ্ঞান মন্দিরের দায়িত্ব যে তাঁকেই নিতে হবে, সেটা তখনই জানা। অবশ্য মাইনেটা অনেকটাই বাড়ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এক হাজার টাকা বেতন দেবে, কলকাতায় তখন পান সাড়ে সাতশো টাকা। শেষ মুহূর্তে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি কলকাতা ছাড়বেন না। সত্যেন্দ্রনাথের পথ পরিষ্কার হয়ে গেল।

আইনস্টাইনের প্রতি সত্যেন্দ্রনাথের ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা। আইনস্টাইনও সত্যেন্দ্রনাথের প্রতিভার সমঝদার ছিলেন। কিন্তু তাঁদের সম্পর্ক কখনোই দানা বাঁধেনি। তার কারণ কী হতে পারে? এই নিয়ে অনুমান করা ছাড়া উপায় নেই, এই লেখার শেষে আমরা তাই করার চেষ্টা করি। সত্যেন্দ্রনাথের তৃতীয় পেপারটির কোনো খোঁজা পাওয়া যায় না। বার্লিনে দুজনের এই পেপার নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সত্যেন্দ্রনাথের কথা থেকে জানা যায় যে আইনস্টাইন একেবারেই সেটিকে মেনে নিতে পারেননি। সত্যেন্দ্রনাথ সেই কারণে সেটা ছাপাননি, কোনো কপিও রাখেননি। অথচ লাজভাঁর মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানী তার আগে পেপারটির প্রশংসা করেছিলেন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রায় সমস্ত অগ্রগতির বিরোধিতা করেছিলেন আইনস্টাইন, কিন্তু তার জন্য পেপার ছাপানো কেউ বন্ধ করেনি।

আমার অনুমান এ সমস্যা আংশিকভাবে হলেও দুই সংস্কৃতির পার্থক্য। আইনস্টাইনের প্রতি সত্যেন্দ্রনাথের ভক্তি অনেককেই দ্রোণাচার্য ও একলব্যের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে গুরু-শিষ্যের যে পরম্পরা সেখানে শিষ্য গুরুর কথার প্রতিবাদ সাধারণত করে না। সত্যেন্দ্রনাথ প্রায় সব চিঠিতে আইনস্টাইনকে সম্বোধন করেছেন Master বলে -- Respected Master, কখনো বা Dear Master। আইনস্টাইনের উত্তর এসেছে Dear Colleague-এর উদ্দেশ্যে। আইনস্টাইন খুঁজেছেন সহকর্মীকে, সত্যেন্দ্রনাথ চেয়েছেন গুরুকে।

আইনস্টাইনের প্রতি সত্যেন্দ্রনাথের মনোভাব তাঁর ছাত্রদের কাছে তাঁর এক স্মৃতিচারণ থেকে স্পষ্ট হয়। আইনস্টাইনের লেখা এক চিরকুটে প্রাশিয়ান অ্যাকাডেমির লাইব্রেরির থেকে তাঁকে বই ইস্যু করা হয়েছিল। আইনস্তাইনের লেখা কাগজটি লাইব্রেরি জমা রেখেছিল, সেটি সত্যন্দ্রনাথ আনতে পারেননি। পরিবর্তে যে কাগজটি দিয়ে মুড়ে বই দেওয়া হত, সেটি তিনি দেশে ফেরার সময় সঙ্গে করে এনেছিলেন। খুবই সাধারণ ঘটনা, কিন্তু এই কথাও যে তিনি ভোলেননি, ছাত্রদের বলতেন, তার থেকেই বোঝা যায় তিনি আইনস্টাইনকে কোন শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতেন।

আরো এক পার্থক্য দুজনের মধ্যে ছিল। আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানী, সত্যেন্দ্রনাথের মূল শিক্ষা গণিতে। দুজনের দৃষ্টিভঙ্গীর তাই ফারাক ছিল। আইনস্টাইন বার্লিনে তাঁকে একটা সমস্যার সমাধান করতে দিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ তিনদিন ভেবে ভেবে একটা সমাধান করে নিয়ে গেলেন। পুরোটা দেখে আইনস্টাইন বললেন, “সমাধানটাতে ভুল নেই, কিন্তু এটা আমি চাইনি। এভাবে করে নতুন কিছু পাওয়া যাবে না। এইসব নিয়ে আমার সময় নষ্ট করবেন না।”

গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিজ্ঞানীর পার্থক্যের আরো উদাহরণ আছে। আইনস্টাইনের কাজের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন সত্যেন্দ্রনাথ। ১৯৫০ সালে আইনস্টাইন তাঁর The Meaning of Relativity’ বইটি প্রকাশ করেছিলেন। এখানে তিনি এক বিশেষ তত্ত্বের চৌষট্টিটি সমীকরণের প্রস্তাব করেন। কিন্তু তাদের একসঙ্গে সমাধান করাটা এতই জটিল যে প্রথম প্রথম আইনস্টাইন বা অন্য কেউ তা পারেননি। শ্রয়ডিঙ্গারের মতো বিশেষজ্ঞও হাল ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন এ কাজ প্রায় অসম্ভব। সত্যেন্দ্রনাথ সমীকরণগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করলেন, একদিকে ছিল চল্লিশটি, অন্যদিকে চব্বিশটি। এই দুটি ভাগের আলাদা আলাদা করে সমাধান করেছিলেন তিনি। আইনস্টাইনকে তিনি সেই সমাধান পাঠিয়েছিলেন। গণিত বিষয়ে তাঁর অসামান্য দখলের প্রমাণ এই পদ্ধতি, কিন্তু আইনস্টাইনের তা পছন্দ হয়নি। প্রায় একই সময়ে আরও কয়েকজন এই সমীকরণগুলিকে নানা ভাবে সমাধান করেছিলেন, আইনস্টাইন নিজেও সত্যেন্দ্রনাথের পরে পরেই একটা সমাধান বার করেছিলেন। প্রত্যেকের সমাধানের পদ্ধতি ছিল আলাদা আলাদা। কিন্তু আইনস্টাইন নিজে একটাতেও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যা আশা করেছিলেন, এই সমাধানগুলো তা পূরণ করেননি। তিনি সত্যেন্দ্রনাথকে সেই কথা লিখেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ উত্তরে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন, কিন্তু আইনস্টাইনের মৃত্যুতে এতই দুঃখ পেয়েছিলেন যে তা ছিঁড়ে ফেলেন। আর কখনো এই বিষয়ে তিনি হাত দেননি।

একদিকে সংস্কৃতি, অন্যদিকে বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গী, এই দুই পার্থক্যের জন্যই হয়তো দুই মহাবিজ্ঞানীর সম্পর্ক ফলপ্রসূ হয়নি।


যে সব বইয়ের সাহায্য লেগেছে

আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুঃ জীবন ও কৃতী - তপনমোহন চক্রবর্তী (সম্পাদিত), বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ

আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু জন্ম শতবর্ষ স্মারক – বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ

সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সংকলন (তৃতীয় সংস্করণ)- বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ

সোনাঝরা দিনগুলি - গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ও অনির্বাণ কুণ্ডু, জয়ঢাক

সত্যেন বোস – গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়, খোয়াবনামা প্রান্তজনের কথা

Einstein Rediscovered: Interactions with Indian Academics – Rajinder Singh, Shaker Verlag

 

প্রকাশঃ সন্ধিৎসা, নভেম্বর ২০২৪