নিউক্লিয় প্রযুক্তি - কিছু ব্যবহার
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
নিউক্লিয় প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব, তেমনি পরমাণু অস্ত্রেও তার প্রয়োগ হয়। এই দ্বিতীয়টির জন্য নিউক্লিয়াস কথাটা শুনলেই অনেকেই ভয় পেয়ে যান। অথচ এই প্রযুক্তি এখন বহু জায়গায় ব্যবহার হয়। চিকিৎসাতে ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই), পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি (পেট) ইত্যাদি যে সমসত কথা আমরা প্রায়ই শুনতে পাই, এগুলি সবই তার অবদান। ক্যান্সারের চিকিৎসাতেও যুগান্তর আনছে এই প্রযুক্তি। চিকিৎসা বা শক্তি উৎপাদনের কথা লিখতে গেলে প্রবন্ধ দীর্ঘ হয়ে যাবে, কিন্তু তার বাইরেও নিউক্লিয় প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তার সামান্য কয়েকটা উদাহরণ এই লেখাতে আমরা দেখব।
আমাদের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে খাবারদাবার তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়, তাই তা সংরক্ষণে রাসায়নিক প্রিজার্ভেটিভ ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতির অনেক সমস্যা আছে, পরিবর্তে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ প্রয়োগ করা যায়। খাবার মূলত নষ্ট হয় তার মধ্যে থাকা জীবাণুর জন্য। আবার আলু বা পিঁয়াজের মতো সবজির ক্ষেত্রে বেশিদিন রাখলে কল বেরিয়ে নতুন চারা জন্ম হলে সেটি খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায়। বাইরে থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ খাবারের উপর ফেললে জীবাণু মারা যায়, সবজিরও নতুন গাছ জন্মানোর ক্ষমতা লোপ পায়। ফলে খাবার বহুদিন পর্যন্ত ভালো থাকে। ভারত সহ অনেক দেশে এখন এই পদ্ধতি চালু হয়েছে। এই পদ্ধতিতে এমন বিকিরণ ব্যবহার করা হয় যার থেকে খাবারের মধ্যে তেজস্ক্রিয়তা জন্মানোর কোন সম্ভাবনা নেই। তবে তেজস্ক্রিয়তার শুনলেই অনেকে ভয় পান, তাই বহু পরীক্ষানিরীক্ষাতেও কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়ার খবর না থাকলেও অনেকে এই ধরনের খাবার খেতে চান না। আবার বর্তমানে বিকিরণের সাহায্যে শহরের জঞ্জালকে জীবাণুমুক্ত করা শুরু হয়েছে, তারপর তাকে কৃষিতে সার হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ আছে। একই ভাবে চিকিৎসাতে ব্যবহৃত সামগ্রী, প্রসাধনী দ্রব্য, কন্ট্যাক্ট লেন্স ইত্যাদিকে জীবাণুমুক্ত করা হয়।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ এক প্রধান হাতিয়ার হল নিউক্লিয় বিজ্ঞান। বিকিরণ কোশের মৃত্যু ঘটায়। কিন্তু স্বল্পমাত্রার বিকিরণ অনেক সময় জীবকোশে ডিএনএ-র পরিবর্তন ঘটায়, ফলে তার মধ্যে নতুন কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হতে পারে যা আমাদের পক্ষে উপকারী। প্রকৃতিতেও স্বাভাবিক ভাবে এই পরিবর্তন ঘটে, তাকে বলে পরিব্যক্তি (Mutation)। এর ফলেই নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রকৃতিতে এই পরিবর্তন ঘটে অনেক ধীরে, বহু যুগ ধরে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ প্রয়োগ করে পরিব্যক্তির হার বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব; তার পর তার থেকে প্রয়োজনীয় গুণগুলি বেছে নেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে এমন শস্য বা গাছ তৈরি সম্ভব হয়েছে যার ফলন বা রোগপ্রতিরোধক্ষমতা অনেক বেশি। অন্যান্য অনেক ধরনের উপকারী উদ্ভিদও সৃষ্টি করা গেছে।
ক্ষতিকর পোকামাকড় কমানোর ক্ষেত্রে নিউক্লিয় প্রযুক্তি প্রয়োগ করে বিশেষ সুফল পাওয়া গেছে। উত্তর ও মধ্য আমেরিকার স্ক্রু-ওয়ার্ম মাছি ছিল গবাদি পশুর পক্ষে বিপজ্জনক। গামা রশ্মির সঠিক পরিমাণ প্রয়োগের মাধ্যলে পুরুষ মাছিদের বন্ধ্যা অর্থাৎ বংশ বিস্তারে অক্ষম করা হয়। বহু সংখ্যক এমন মাছিকে পরিবেশে ছেড়ে দেওয়া হয়। নারী স্ক্রু-ওয়ার্ম মাছি জীবনে একবারই মিলিত হয়, বন্ধ্যা পুরুষ মাছিদের সঙ্গে সঙ্গমের ফলে সে আর বংশবিস্তার করতে পারে না। পরবর্তী প্রজন্মে মাছির সংখ্যা হ্রাস পায়। এভাবে উত্তর ও মধ্য আমেরিকা থেকে এই বিপদকে নির্মূল করা গেছে। একে বলে স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক। এই পদ্ধতির দুটি সুবিধা, প্রথমত পরিবেশে নতুন ধরনের কোনো জীবকে প্রবেশ করানো হল না। বন্ধ্যা হওয়ার ফলে এই জিন ছড়িয়ে পরার আশঙ্কা নেই। দ্বিতীয়ত রাসায়নিক কীটনাশকের মতো পরিবেশ দূষণের ও সম্ভাবনা নেই। আফ্রিকার সিসি মাছি, ভূমধ্যসাগর ও মেক্সিকোর ফ্রুট ফ্লাই ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে এই পদ্ধতি সফল হয়েছে। বর্তমানে আফ্রিকাতে ম্যালেরিয়া দূর করার জন্য অ্যানোফিলিস মশার উপরে তার প্রয়োগ চলছে। ফুড এন্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন ও ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এজেন্সির ডাটাবেসে তিনহাজার চারশোরও বেশি প্রজাতির তালিকা আছে যাদের জিনে বিকিরণের মাধ্যমে পরিবর্তন করা হয়েছে। একমাত্র চালেরই আটশো তিয়াত্তর রকম ভ্যারাইটি আছে।
কোনো যৌগের পরমাণুতে সাধারণ আইসোটোপের বদলে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করলে তাকে বলে ট্রেসার। অনেক শিল্পে পাইপের মাধ্যমে তরল বা গ্যাসীয় জ্বালানি পাঠানো হয়; সন্দেহ করা হচ্ছে যে কোনো জায়গায় ছিদ্র বা ফাটল হয়েছে কিন্তু পাইপের দৈর্ঘ্য এত বেশি বা এমন ভাবে রয়েছে যে খুঁটিয়ে দেখা প্রায় অসম্ভব। যদি ওই জ্বালানির সঙ্গে কোনো তেজস্ক্রিয় আইসোটোপকে ট্রেসার হিসাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সে ওই ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে আসবে। তেজস্ক্রিয়তা অনেক দূর থেকেই যন্ত্রে ধরা পড়ে, তখন সেই ছিদ্র কোথায় হয়েছে সহজেই বোঝা সম্ভব। তেমনি যদি পাইপলাইনে কোথাও বাধা তৈরি হয়, তাও বাইরে থেকে ট্রেসারের সাহায্যে বোঝা সম্ভব। ট্রেসার ঐ জায়গায় জমা হবে, ডিটেক্টর দিয়ে পাইপের বাইরে থেকেই বোঝা যাবে বাধাটা কোথায়; তার জন্য পাইপ খোলার দরকার পড়বে না। রক্তসঞ্চালনের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি কাজে লাগে। ট্রেসারের সাহায্যে পাইপের মধ্যে দিয়ে তরল বা গ্যাসের প্রবাহের মাত্রা সহজেই বাইরে থেকে মাপা সম্ভব। একই পদ্ধতি শহরের দূষিত জল পরিশুদ্ধ বা নিষ্কাশনী পদ্ধতিতে কাজে লাগানো হচ্ছে।
ভূগর্ভস্থ অর্থাৎ মাটির তলার জলের বয়স ও কোন পথে তা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে নেমে আসে তা দেখতে সাহায্য করে নিউক্লিয় প্রযুক্তি। বায়ুমণ্ডলের নানা পরমাণু ও মহাজাগতিক রশ্মির বিক্রিয়াতে নানা তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস তৈরি হয় এবং পৃথিবীপৃষ্ঠের জলে মেশে। জল মাটির তলায় যাওয়ার পরে নতুন করে এই সব নিউক্লিয়াস আর তার সঙ্গে মেশে না। তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের পরে কত পরিমাণ আইসোটোপ অবশিষ্ট আছে তা জেনে সেই জলের বয়স বা সে কোন পথে ঢুকেছে এই সমস্ত জানা যায়। অস্ট্রেলিয়াও সাহারা মরুভূমির ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি খুব সাফল্য পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার মধ্যভাগের গ্রেট আর্টেজিয়ান বেসিনের জলের পরিমাণ64,900 ঘন কিলোমিটার, জানা গেছে তার বয়স দশ লক্ষ বছরেরও বেশি। আমরা জানি যে পৃথিবীতে জল সঙ্কট আসন্ন, সেই সমস্যার কিছুটা সমাধান করতে ভূগর্ভস্থ জলের উৎস ইত্যাদি অনুসন্ধানে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জলে আর্সেনিক দূষণের সমস্যার সমাধানে ভূগর্ভস্ত জলের মধ্যে আর্সেনিকের পরিমাণ ও তার বয়স এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করা হয়েছে।
হিরে, নীলনান্তমণি, পোখরাজ ইত্যাদি অনেক ধরনের দামি পাথরের রং ও জৌলুষ বাড়াতে নিউক্লিয় প্রযুক্তি কাজে লাগানো হয়। এই সমস্ত পাথরের উপর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ফেলা হয়। এরা সবাই হল কেলাস বা ক্রিস্টাল। কেলাসের মধ্যে পরমাণুরা নির্দিষ্ট সজ্জায় থাকে, পরমাণুর ইলেকট্রনগুলি নিজেদের মধ্যে বন্ড বা বন্ধনী তৈরি করে। বিকিরণের আঘাতে বন্ড ভেঙে যায়, ফলে কেলাসের আলোক শোষণ ও নির্গমন ধর্মের পরিবর্তন ঘটে। এই ভাবে কেলাসের মধ্যে কালার সেন্টার তৈরি হয় এবং তার রঙ বদলে যায়। এই সমস্ত পাথর রঙ ও দীপ্তির জন্য অনেক বেশি দামে বিক্রি হয়। অবশ্য অনেক সময়ে বিকিরণের প্রভাবে তেজস্ক্রিয় মৌল পাথরের মধ্যে তৈরি হয়, তখন তেজস্ক্রিয়তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বিকিরণ সীমার নিচে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
তেজস্ক্রিয়তার আর একটা ব্যবহার আমরা সবাই প্রায়ই দেখতে পাই। অগ্নিকাণ্ডের জন্য সাবধানতা হিসাবে আধুনিক অফিস, হোটেল, শপিং মল, এমনকি অনেক বাড়িতেও আজকাল স্মোক ডিটেক্টর ব্যবহার করা হয়। এই ডিটেক্টরের মধ্যে থাকে আমেরিসিয়ামের তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস, এর থেকে আলফা কণা বেরোয়। এই কণা বায়ুকে আয়নিত করে অর্থাৎ বায়ুর গ্যাসের অণু থেকে ইলেকট্রনকে বার করে দেয়। আয়নিত বায়ুর বিদ্যুৎপরিবাহিতা বেশি। ধোঁয়া হল খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার সমষ্টি। যদি ডিটেক্টরের মধ্যে ধোঁয়া ঢোকে, তাহলে আলফা কণা সেই ধোঁয়ার কণার সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে বেশিদূর যেতে পারে না। ফলে তার আয়নন ক্ষমতা কমে যায়, বায়ুরও পরিবাহিতাও কম যায়। ডিটেক্টর তখন অ্যালার্ম বাজিয়ে সাবধান করে দেয়। আলফা কণা ব্যবহারের দুটো কারণ আছে; প্রথমত তার বায়ুকে আয়নিত করার ক্ষমতা বিটা বা গামা বিকিরণের থেকে বেশি। দ্বিতীয়ত আলফা কণা সহজেই আটকে যায়, ফলে ডিটেক্টরের প্লাস্টিকের আবরণ ভেদ করে তেজস্ক্রিয়তা বাইরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা হিসাব বলছে যে স্মোক ডিটেক্টর ব্যবহারের ফলে সেদেশে প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে।
তালিকা আর বাড়িয়ে লাভ নেই। এই প্রযুক্তিকে ব্যবহারের আরো নানা পদ্ধতি উদ্ভাবন হচ্ছে। যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করলে নিউক্লিয় প্রযুক্তিতে বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই, বরঞ্চ তার সাহায্যে আমাদের জীবনকে বহুভাবে উন্নত করা যায়।
প্রকাশ- সাথী হাতিয়ার শারদ ১৪৩১
বেশ জানার বিষয়। কেবল পরমাণু বোমা বানিয়ে মানবসভ্যতার ক্ষতিসাধন করা নয়। নিউক্লিও প্রযুক্তিতে পরিমিত তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহার করে মানব সভ্যতার তথা বিশ্ব পরিবেশের উন্নতিসাধন করার জন্য এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। সমৃদ্ধ হবার মতো লেখা। 🙏
ReplyDelete