Friday, 19 September 2025

মহাবিশ্বে প্রাণের সন্ধান

 

মহাবিশ্বে প্রাণের সন্ধান 

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়  


আমাদের সৌরজগতে পৃথিবী ছাড়া উন্নত সভ্যতা কোথাও নেই, কিন্তু অন্য কোথাও কি প্রাণের সন্ধান পাওয়া যাবে? কারোর মতে প্রাণ এতই বিরল ঘটনা যে আমাদের ছায়াপথ কেন, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডেই আমরা ছাড়া অন্য কোনো উন্নত সভ্যতাই নেই। আবার কারো মতে প্রাণের অনুকূল পরিবেশ থাকলেই প্রাণের জন্ম হবে। সমস্যা হল যে আমাদের কাছে মাত্র একটাই উদাহরণ আছে। তাই আমরা আমাদের সৌরজগতে প্রাণের সন্ধান করছি। যদি আমরা সফল হই, তাহলে দ্বিতীয় দলের যুক্তি অনেক জোরদার হবে সন্দেহ নেই।

প্রাণের জন্য তরল জল প্রয়োজন বলেই আমাদের অনুমান। সৌরজগতে আটটি গ্রহ আছে, তার মধ্যে তরল জল আছে বা কখনো ছিল এমন গ্রহ হল পৃথিবী ও মঙ্গল। তাই মঙ্গলই আমাদের প্রথম লক্ষ্য। মঙ্গলের সঙ্গে পৃথিবীর অনেক মিল। মঙ্গলের ব্যাস পৃথিবীর অর্ধেক। মঙ্গলের দিন পৃথিবীর দিনের থেকে মাত্র ঊনচল্লিশ মিনিট বড়। মঙ্গলও তার কক্ষপথের সঙ্গে প্রায় পৃথিবীর মতোই কোণ করে আছে; ফলে সেখানেও ঋতু পরিবর্তন হয়। মঙ্গলের দুই মেরুতে বরফ দেখা যায়। তাই মঙ্গলে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা নিয়ে অনেকেই চিন্তা করেছিলেন। ১৮৭৭ সালে ইতালির জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিওভান্নি শিপারেল্লি ঘোষণা করেন যে তিনি দূরবীন দিয়ে মঙ্গলগ্রহে canali দেখেছেন ইতালিয় ভাষায় তার মানে হল channel অর্থাৎ খাত, ইংরাজি অনুবাদে ভুল করে হয়ে গেল canal অর্থাৎ খাল পার্সিভাল লাওয়েল নামের এক বিজ্ঞানী 1892 সালে ঘোষণা করলেন খালগুলো কৃত্রিম। লাওয়েল যথেষ্ট খ্যাতনামা বিজ্ঞানী, কাজেই অনেকেরই ধারণা হয়েছিল যে মঙ্গলে নিশ্চয় বুদ্ধিমান প্রাণী আছে। মঙ্গলের অধিকাংশই বর্তমানে মরুভূমি, তাই তারা দুই মেরু থেকে খাল কেটে জল এনে কৃষিকাজ চালায়। বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞানকার এইচ জি ওয়েলস ওয়ার অফ দি ওয়ার্ল্ডস উপন্যাসে মঙ্গলবাসীদের পৃথিবী আক্রমণের কাহিনি লিখলেন। সেই গল্প এতটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়েছিলে যে একবার রেডিওতে তার নাট্যরূপ প্রচারের সময় বহু লোক সেটাকে সত্যি ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে মঙ্গল গ্রহে সভ্যতার অস্তিত্ব তখন সাধারণভাবে স্বীকৃত ছিল। বাংলাতেও হেমেন্দ্রকুমার রায়ের 'মেঘদূতের মর্তে আগমন' বা প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মঙ্গলগ্রহে ঘনাদা' অনেকেই হয়তো পড়েছেন।

মাঙ্গলিক ও মঙ্গলের খাল (চ্যাট জিপিটির সাহায্যে আঁকা) 

অবশ্য এই ধারণা বেশিদিন টিকল না। শিগগিরি বোঝা গেল যে মঙ্গলগ্রহের বায়ুর চাপ পৃথিবীতে সমুদ্রতলে বায়ুচাপের একশো ভাগের এক ভাগের থেকেও কম, সেখানে জল তরল অবস্থায় খোলা জায়গায় থাকাই সম্ভব নয় -- বাষ্প হয়ে উবে যাবে তা একমাত্র বরফ অবস্থাতেই থাকতে পারে। কাজেই খাল সেখানে কোনো কাজে লাগবে না।

তবে মঙ্গলে এই অবস্থা চিরকাল ছিল না। মঙ্গলের উদ্দেশ্যে অনেক অভিযান পাঠানো হয়েছে। মহাকাশ থেকে ছবি তোলা হয়েছে, গ্রহের মাটিতেও ল্যান্ডার বা রোভার নামানো হয়েছে। তাই আমরা এখন জানি যে একসময় মঙ্গলের বুকে সত্যিই তরল জল ছিল; তখন বায়ুচাপ ছিল বেশি। মঙ্গলের বুকে শুকনো নদীখাত পাওয়া গেছে, প্রাচীন সমুদ্রের সম্ভাবনাও পাওয়া গেছে। তাই একসময় প্রাণের অনুকূল পরিবেশ মঙ্গলে একসময় ছিল। তারপর কোনো এক বিপর্যয়ে মঙ্গল এক শীতল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হল একসময় যদি প্রাণের জন্ম হয়ে থাকে, তার পক্ষে কি বর্তমান অবস্থায় টিকে থাকা সম্ভব?

ঙ্গলের বুকে জলের প্রবাহের চিহ্ন- সাদা দাগগুলো হল জলে থাকা নুন (ছবি- NASA/JPL-Caltech/MSSS)

 

এখানে একটা ঘরের কাছের গল্প বলি। ১৯৬৭ সালে চাঁদে নেমেছিল রোবট যান সার্ভেয়র-৩। দু’ বছর পরে অ্যাপোলো-১২ অভিযান যখন চাঁদে নামে, মহাকাশচারীরা সার্ভেয়রের ক্যামেরাটিকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনেন। উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের এককোশী জীবের সন্ধান, হয়ত মাঝের দু’ বছরে সার্ভেয়রে তারা কোনোভাবে চলে আসতে পারে। পৃথিবীতে এনে সন্ধান পাওয়া গেল নেহাতই পার্থিব ব্যাকটেরিয়া স্ট্রেপ্‌টোকক্কাসের স্পোরের। দেখা গেল তারা তখনো জীবিত, সুযোগ পাওয়া মাত্র তারা বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করল। কাজেই মঙ্গলে এককোশী প্রাণের টিকে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই বেশ কিছু অভিযান মঙ্গলে চালানো হয়েছে। ফলাফল কী?

এখনো পর্যন্ত মঙ্গলে নিশ্চিতভাবে প্রাণের চিহ্ন পাওয়া যায় নি। জৈব যোগের সন্ধান পাওয়া গেছে। কাজেই তরল জল ও জৈব যৌগ, অর্থাৎ প্রাণের সব উপাদান একসময় মজুত ছিল। মঙ্গলের মাটির তলায় এবং দুই মেরুতে এখনো জলের বরফ আছে তার অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে সব থেকে বেশি কৌতূহলের বিষয় হল ঋতুপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মিথেনের পরিমাণ বাড়ে কমে। বায়ুমণ্ডলের মিথেন গ্যাস অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ভেজগে যায়,। তারপর সেই টুকরোগুলো হাইড্রোকার্বন অর্থাৎ জৈবযৌগ তৈরি করে। কিন্তু এভাবে চললে বায়ুমণ্ডল থেকে মিথেন শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। বৃহস্পতির মতো দানব গ্রহের বায়ুমণ্ডলের ভিতরের স্তরে হাইড্রোকার্বন ভেঙে আবার মিথেন তৈরি হয়। কিন্তু পৃথিবীর মতো ছোট গ্রহে তার অনুকূল পরিবেশ নেই। আমাদের বায়ুমণ্ডলে মিথেনের উৎস হল জীবজগৎ। মঙ্গলে মিথেন কোথা থেকে আসে? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনো আমরা জানি না। পৃথিবীতে ব্যাকটেরিয়া মিথেন তৈরি করে, মঙ্গলে কি একই ঘটনা ঘটছে? পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোও হয়েছে, কিন্তু নিশ্চিত উত্তর পাওয়া যায়নি। পাঁচ বছর আগে পার্সিভিয়ারেন্স রোভারকে পাঠানোই হয়েছিল বিশেষ করে প্রাচীন প্রাণের চিহ্ন খুঁজতে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমরা জানি না, সত্যিই কোনোদিন মঙ্গলে প্রাণ ছিল কিনা।


পার্সিভিয়ারেন্সের সেল্‌ফি (ছবি নাসা)

মঙ্গলের থেকেও আমাদের কাছের গ্রহ হল শুক্র, শুক্রের আয়তন এবং ঘনত্বও পৃথিবীর কাছাকাছি। শুক্ৰে প্ৰাণ আছে কি? শুক্রপৃষ্ঠে প্রাণ থাকা সম্ভব নয়। সেখানে তাপমাত্রা সাড়ে চারশো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, বায়ুর চাপ পৃথিবীর নবই গুণ, আকাশ থেকে যেখানে হয়তো ঝরে পড়তে পারে ঘন সালফিউরিক অ্যাসিডের বৃষ্টি, জল বা অক্সিজেন নেই বললেই চলে। শুক্রপৃষ্ঠে নয়, বিজ্ঞানীরা প্ৰাণের অস্তিত্ব খুঁজছেন বায়ুমণ্ডলে। বায়ুমণ্ডলের উপরদিকে চাপ তাপমাত্রা অনেক কম, প্রায় পৃথিবীরই কাছাকাছি। সেখানে হয়তো এককোশী জীবের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। বায়ুমণ্ডলে ফসজিন গ্যাসের চিহ্ন পাওয়া গেছে, মিথেনের মতো পৃথিবীর প্রাকৃতিক ফসজিনের উৎসও জীবজগৎ। আবার একটা পর্যবেক্ষণ দেখায় মাটি থেকে আশি কিলোমিটার উঁচুতে সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি শোষিত হয়ে যাচ্ছে। কোন পদ্ধতিতে এই শোষণ ঘটে, তা নিশ্চিত ভাবে বলা এখনই সম্ভব নয়। কেউ কেউ মনে করছেন যে এর জন্য দায়ী কোনো নতুন ধরনের জীবাণু।

দূরের গ্রহে প্রাণের নিশ্চিত চিহ্ন কী? কোন সঙ্কেত দেখলে বুঝব প্রাণ আছে? পৃথিবী হল আমাদের জানা একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রাণ আছে। তাই শুক্র অভিযানে পাঠানো ভেনাস এক্সপ্রেস পৃথিবীতে প্রাণের সন্ধান করেছে। তার ক্যামেরা পৃথিবীর ছবি তুলেছে। বিজ্ঞানীরা সেই ছবি থেকে পৃথিবীতে প্রাণের চিহ্ন সন্ধানের চেষ্টা করছেন । যদি এমন কিছু দেখা যায় যাকে নিশ্চিতভাবে জীবনের সঙ্কেত বলে চিহ্নিত করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে অন্য গ্রহের ছবিতে সেই চিহ্নকে খোঁজা হবে।

সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহে প্রাণ খুঁজে পাওয়ার আশা আমরা করি না। বুধের তাপমাত্রা খুব বেশি ওঠানামা করে, ৪৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে -১৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত। সেখানে জল নেই, নেই বায়ুমণ্ডল। বৃহস্পতি, শনির মতো গ্যাসদানব গ্রহে কোনো স্থলভাগ নেই, নেই অক্সিজেন। যদিও কল্পবিজ্ঞানকাররা অবশ্য বৃহস্পতির বায়ুতে ভেসে থাকা বিরাট প্রাণের কল্পনা করেছেন, তবে তার সম্ভাবনা বিশেষ নেই।

সৌরজগতে আরো অন্তত দুটি জায়গা আছে যেখানে প্রাণ থাকতেও পারে। কিছু বিশেষ পরিস্থিতি সেখানে প্রাণের অনুকূল কিছু পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এবার আর গ্রহ নয়, প্রাণের সন্ধানে যাব উপগ্রহে। বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা ও শনির উপগ্রহ টাইটান -- এই দুই জায়গা নিয়ে বিজ্ঞানীরা চিন্তা করেছেন। প্রথমে আসি ইউরোপার কথায়। ইউরোপা গ্যালিলিওর আবিষ্কৃত বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহের মধ্যে সব থেকে ছোট, আবার বৃহস্পতির থেকে সব থেকে দূরেও বটে। ইউরোপা আমাদের চাঁদের মতোই বড়। তার উপরটা বরফে ঢাকা। গ্যালিলিও মহাকাশযান দীর্ঘদিন বৃহস্পতির চারদিক পর্যবেক্ষণ করেছে, তার পাঠানো ছবি থেকে দেখা গেছে পৃথিবীর উত্তর মেরুতে যেমন ফাটল দেখা যায় ইউরোপার উপরিতল একেবারেই সেই রকম ফাটলে ভর্তি। উত্তর মেরুতে এর কারণ হল বরফের তলাতে আছে তরল জল, সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে উপরের বরফে ফাটল ধরে। ইউরোপা গোল্ডিলক্‌স অঞ্চলের অনেক বাইরে, সেখানে উপরের তাপমাত্রা হল -২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, সেখানে তরল জল আসবে কোথা থেকে?

অনেকদিন আগে থেকেই মনে করা হচ্ছিল ইউরোপাতে জল আছে। ইউরোপার বায়ুমণ্ডল নেই, কাজেই উপরে তরল জল থাকার উপায় নেই। তাই মহাসমুদ্রের উপরটা জমে গেছে। কিন্তু বৃহস্পতির টানে যে জোয়ারভাঁটা হয়, তা সেই বরফের স্তরের তলার জলকে জমতে দেয়নি। গ্যালিলিও দেখিয়েছে ইউরোপার একটা দুর্বল চৌম্বক ক্ষেত্র আছে। এর একমাত্র ব্যাখ্যা হল ইউরোপার ভিতরে এমন কোনো তরল আছে যা তড়িৎ পরিবহন করতে পারে। ইউরোপা এতই ছোট যে তার অভ্যন্তর বহুদিন শীতল হয়ে গেছে, কাজেই পৃথিবীর মতো তরল লোহার স্রোতের সাহাযযে তার চৌম্বক ক্ষেত্রের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। এর সব থেকে সহজ ব্যাখ্যা হল জল; নোনা জল তড়িৎ পরিবহন করতে পারে। দু একটা ছোটখাটো পুকুর নয়, ইউরোপাতে আছে এক উপগ্রহব্যাপী মহাসমুদ্র। হাবল টেলিস্কোপের সাম্প্রতিক ছবি থেকে মনে হয় সেই জল মাঝে মাঝে পিচকারির মতো বাইরে বেরিয়ে আসে। তা যদি সত্য হয়, তাহলে প্রায় দু’শো কিলোমিটার উঁচু জলের ফোয়ারার সন্ধান পাওয়া গেছে।

গ্যালিলিওর চোখে ইউরোপা (NASA/JPL-Caltech/SETI Institute


বৃহস্পতির এক শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র আছে, সে তার উপগ্রহগুলিকে মহাজাগতিক রশ্মির আঘাত থেকে রক্ষা করে। তাই তরল জল এবং মহাজাগতিক রশ্মির বর্ম, প্রাণের এই দুই শর্ত ইউরোপা পূরণ করে। কিন্তু সেখানে অক্সিজেন থাকার কোনো সুযোগ নেই, সূর্যের আলোও খুবই দুর্বল। তাহলে প্রাণ থাকলে কেমন হবে তার সম্ভাবনা তা জানতে ইউরোপা থেকে ফিরে আসতে হবে পৃথিবীতে।

কয়েক দশক আগে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক প্রাণের সন্ধান পৃথিবীতে পাওয়া গেছে। গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের কথা আমরা সবাই শুনেছি, সেখানকার পাণীজগতের বৈচিত্রই ডারউইনকে তাঁর বিখ্যাত প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের পথ দেখিয়েছিল। ১৯৭৭ সালে সেই দ্বীপপুঞ্জের কাছে সমুদ্রের নিচে এক সম্পূর্ণ নতুন ধরনের জীবমণ্ডল আবিষ্কার হয় যার জন্য গোল্ডিলক্‌স অঞ্চলের তত্ত্ব পুরোপুরি খাটবে না। সমুদ্রের গভীরে অনেক জায়গা আছে যেখানে ফাটল থেকে গরম জল বেরিয়ে আসে। এগুলিকে বলে জলতাপীয় রন্ধ্র (Hydrothermal vent)। এগুলি সাধারণত দুটি মহাদেশীয় পাতের সযোগস্থলে বা আগ্নেয়গিরির কাছে হয়। এই সব গঠনে যে ফাঁক থাকে তা দিয়ে সমুদ্রের জল ভূঅভ্যন্তরে প্রবেশ করে গরম হয় ও অন্য ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। সেই জলের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। তার সঙ্গে বেরিয়ে আসে নানা রাসায়নিক পদার্থ। এই রাসায়নিক পদার্থের উপর নির্ভর করে জলতাপীয় রন্ধ্রদের আশেপাশে সম্পূর্ণ নতুন এক জীবজগৎ গড়ে উঠেছে; সূর্যের আলো বা মুক্ত অক্সিজেনের উপর তা একেবারেই নির্ভর করে না। এখন শুধু গ্যালাপাগোস নয়, আরো অনেক জায়গায় এমন জীবজগতের সন্ধান পাওয়া গেছে। বৃহস্পতির টানে ইউরোপাতে শুধু তরল জল নয়, সমুদ্রের তলাতে আগ্নেয়গিরিও থাকা সম্ভব। তাহলে সহজেই জলের ফোয়ারার ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে কি আমরা ইউরোপার অভ্যন্তরে প্রাণের আশা করতে পারি? নাসার ইউরোপা ক্লিপার মহাকাশযান ২০২৪ সালের ১৪ অক্টোবর যারা করেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ সে ইউরোপা পৌঁছে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করবে। অবশ্য সমুদ্রের অভ্যন্তরে সন্ধান এখনো আমাদের ক্ষমতার বাইরে।

অপর এক সম্ভাব্য জায়গা হল আমাদের সৌরজগতের সবই থেকে বড় উপগ্রহ টাইটান। শনির এই উপগ্রহটা প্রায় মঙ্গলের মতোই বড়। তার একটা বায়ুমণ্ডল আছে যার মুখ্য উপাদান হল নাইট্রোজেন, আর্গন ও মিথেন। আগেই দেখেছি যে মিথেন সাধারণভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। মঙ্গলের ক্ষেত্রে আমরা জৈব উৎস্বের কথা বলেছিলাম, কিন্তু টাইটানের ক্ষেত্রে মিথেনের পরিমাণ এতই বেশি যে তা কোনভাবেই জৈব হতে পারে না। শনিতে পর্যবেক্ষণ চালিয়েছিল ক্যাসিনি মহাকাশযান, সেই সময় তা মিথেনের রহস্য উদ্ধারে টাইটানে হাইজেন্স নামের একটি অনুসন্ধানী যন্ত্র নামিয়েছিল।

হাইজেন্সের ছবি দেখাচ্ছে পৃথিবীর সঙ্গে টাইটানের ভূপ্রকৃতির অনেক মিল আছে। টাইটানে আছে নদী, সম্ভবত সেখান দিয়ে তরল মিথেন প্রবাহিত হয়। জল বরফ রূপেই আছে, কারণ টাইটানের তাপমাত্রা -১৮০ ডিগ্রি। হাইজেন্স নেমেছিল কাদার মধ্যে, সেই কাদাতে জল নয়, আছে মিথেন। সম্ভবত টাইটানের ভিতরের মিথেন আগ্নেয়গিরির থেকে বেরিয়ে আসে।

হাইজেন্সের ক্যামেরাতে টাইটান 

মিথেনের উৎস জৈব না হলে বিজ্ঞানীদের টাইটান নিয়ে আগ্রহের কারণ কী? আমরা পরে দেখব পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির সময় কোন ধরনের বায়ুমণ্ডল ছিল বলে মনে করা হয়। টাইটানের সঙ্গে তার অনেক মিল আছে। কাজেই টাইটানে কি আদি প্রাণের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে?

সৌরজগৎ নিয়ে আলোচনা শেষ করার আগে আরেকটা কথা বলে নেওয়া যাক। যদি সত্যিই মঙ্গল বা সৌরজগতে অন্য কোথাও প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়, কিন্তু দেখা যায় তার সঙ্গে পৃথিবীর প্রাণের মিল অনেক, তাহলে আমাদের সিদ্ধান্ত করতে হয় যে তাদের উৎস এক। সেটা খুব অসম্ভব নয়। গ্রহ বা উপগ্রহদের সঙ্গে গ্রহাণু বা ধূমকেতুদের সংঘর্ষে অনেক সময়ই কিছু পাথরের টুকরো মহাকাশে উৎক্ষিপ্ত হয়। তার স্নগে ব্যাকটেরিয়ার মতো এককোশী জীব চলে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক, আমরা চাঁদের ক্ষেত্রে দেখেছি যে ব্যাকটেরিয়ার স্পোর বায়ুশূন্য অবস্থায় জীবিত থাকতে পারে, সুযোগ পেলে সে আবার বংশবিস্তার করে। এভাবে সৌরজগতের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে প্রাণের চলাচলের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অবশ্য অন্য কোথাও প্রাণের সন্ধান পাওয়ার আগে পর্যন্ত এই মতের সত্যমিথ্যা নির্ণয় করা সম্ভব নয়।

সৌরজগতের বাইরে প্রাণের সন্ধান কেমনভাবে করা যাবে? গ্রহের বায়ুমণ্ডল কী দিয়ে তৈরি জানতে পারলে তার মধ্যে প্রাণের সম্ভাবনা বোঝা যায়। যেমন কোনো গ্রহের বায়ুমণ্ডলে যদি অক্সিজেন গ্যাস থাকে, তাহলে সেখানে প্রাণ আছে আমরা ধরে নিতেই পারি। অক্সিজেন সাধারণত অন্য সব মৌলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে, তাই তাকে স্বাভাবিকভাবে মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় না। আমাদের পৃথিবীতে অক্সিজেনের উৎস উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষ।

গ্রহের বায়ুমণ্ডলের উপাদান কেমনভাবে জানা যাবে? মহাকাশের দুই টেলিস্কোপ হাবল ও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এ ক্ষেত্রে খুব কাজে লাগছে। নক্ষত্রের আলো যখন বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে আসে, তখন সেখানকার অণুপরমাণুরা কিছু কম্পাঙ্কের আলো শোষণ করে। সেই আলোর বর্ণালীবিশ্লেষণ করে কোন কোন কম্পাঙ্ক শোষণ করেছে জানলে বায়ুমণ্ডল কী দিয়ে তৈরি জানা যায়। ২০২৫ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যলয়ের গবেষকরা জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ব্যবহার করে কে২-১৮ বি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে মিথেন ও ডাইমিথাইল সালফাইড ও ডাইমিথাইল ডাইসালফাইডের সন্ধান পেয়েছেন।

কে২-১৮ বি গ্রহের বায়ুমণ্ডলের উপাদান এই বর্ণালী থেকে পাওয়া গেছে। কার্বন ডাই অক্সাইডের সঙ্গে ডাইমিথাইল সালফাইড (DMS) ও মিথেনের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। (সৌজন্যে নাসা, ইএসএ, সি এস এ, র‍্যালফ ক্রফোর্ড ও জোসেফ অমস্টেড)

কে২-১৮ বি গ্রহটা পৃথিবীর থেকে বড় কিন্তু নেপচুনের থেকে ছোট। মূল তারা কে-২ আমাদের থেকে একশো কুড়ি আলোকবর্ষ দূরে আছে, তারাটা সূর্যের থেকে ছোট ও শীতল। আগেই বলেছি মিথেনের সম্ভাব্য উৎস হল প্রাণ। বাকি দুটি যৌগকে প্রাণের আরো নিশ্চিত সঙ্কেত মনে করা হয়। তাই পৃথিবীর বাইরে প্রাণের সম্ভাবনা আরো বেড়েছে। অবশ্য প্রাণ থাকলেই যে উন্নত সভ্যতা থাকবে এমন কথা বলা যায় না, কে২-১৮ বি-তে তার সম্ভাবনা নেই, কারণ বায়ুমণ্ডলে মুক্ত অক্সিজেন নেই। কিন্তু আর একটা গ্রহে যদি নিশ্চিত ভাবে প্রাণের খোঁজ পাওয়া যায়, তাহলে ছায়াপথের অন্যত্র উন্নত সভ্যতা থাকার সম্ভাবনা বাড়বে। 

 

(প্রকাশঃ বিজ্ঞান অন্বেষক, সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ২০২৫)  

Monday, 15 September 2025

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সালতামামি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সালতামামি

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


ইদানীং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স বিষয়ে বহু কথা শোনা যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাকে বলে, তার বিভিন্ন দিক, তার বৈজ্ঞানিক, প্রাযুক্তিক ও সামাজিক তাৎপর্য এই সংখ্যার নানা প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে। নিউরাল নেটওয়ার্ক, মেশিন লার্নিং, ডিপ লার্নিং এই ধরনের কিছু পরিভাষা এই লেখাতে ব্যবহৃত হয়েছে, যাদের ব্যাখ্যা সেই সব প্রবন্ধে পাওয়া যাবে। এই লেখাতে আমরা শুধুমাত্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিহাসের বিভিন্ন মাইলফলকের কথা শুনব।

আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স বাক্যবন্ধটি অপেক্ষাকৃত নতুন, ১৯৫৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজে আয়োজিত এক আলোচনাচক্রে এক গবেষণাপত্রে এটি প্রথম ব্যবহার হয়। লেখক ছিলেন চারজন -- জন ম্যাকার্থি, মার্ভিন মিনস্কি, নাথানিয়েল রচেস্টার ও ক্লড শ্যানন। তবে বাস্তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তির জন্ম বিংশ শতকে হলেও তার অনেক আগেই মানুষের কল্পনাতে তা এসেছে; সাহিত্যে তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। জোনাথন সুইফট তাঁর গালিভার্স ট্রাভেলস-এ লাপুটা দ্বীপে এমন এক 'ইঞ্জিন'-এর কথা বলেছিলেন যার হাতল ঘুরিয়ে দর্শন, কবিতা বা গণিত বিষয়ক বই পাওয়া যায়। প্রথম সার্থক কল্পবিজ্ঞান হিসাবে অনেকেই মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইন-এর (১৮২১) কথা বলেন। সেই উপন্যাসে ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যে মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন, তাকে আমরা হয়তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্তরে ফেলতে পারি। তবে তার মস্তিষ্ক মানুষের শবদেহ থেকে পাওয়া গিয়েছিল। যন্ত্রের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা প্রথম বলেছিলেন স্যামুয়েল বাটলার। ১৮৬৩ সালে তিনি ডারউইন অ্যামং দি মেশিন্‌স- প্রবন্ধে তিনি যন্ত্রের বিবর্তন ও বুদ্ধির উন্মেষ বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। তার চার বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল ডারউইনের যুগান্তকারী গ্রন্থ অরিজিন অফ স্পিসিস। বাটলারের চিন্তার মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্যতম অঙ্গ মেশিন লার্নিং-এর সূত্র খুঁজে পাই। বিংশ শতাব্দীতে আরো অনেকেরই নাম করা যেতে পারে। ক্যারল চাপেক-এর নাটকে যন্ত্রমানব মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। সেই নাটক থেকেই ইংরাজি ভাষাতে রোবট শব্দটির আবির্ভাব হয়। আর্থার সি ক্লার্ক ২০০১-এ স্পেস ওডিসি উপন্যাসে কম্পিউটার HAL মানসিক দ্বন্দ্বের শিকার হয়েছে, আবার তার পরের উপন্যাস ২০১০-এ স্পেস ওডিসিতে কম্পিউটার বিজ্ঞানী চন্দ্র তাকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলেছেন। বাস্তবে না হোক, সাহিত্যে অনেকদিন আগেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক বুদ্ধির কাছে এসে পৌঁছেছে।

গালিভার্স ট্রাভেলস হল মূলত ব্যাঙ্গধর্মী রচনা, সুইফটের গল্পের 'ইঞ্জিন'-ও রেমন লুল ও গটফ্রিড লিবনিৎজের এমন এক প্রস্তাবকে বিদ্রূপ করেছিলেন, যার মধ্যে আধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক চিন্তার সন্ধান আমরা পাই। রেমন লুল (১২৩২-১৩১৬) ছিলেন স্পেনের এক ধর্মযাজক, তিনি খ্রিস্টধর্মের সত্যতা প্রমাণের জন্য কতকগুলি সাধারণ নীতির উপর নির্মিত এক যুক্তিশাস্ত্রের কথা বলেছিলেন। লুলের চিন্তাকে প্রসারিত করে ক্যালকুলাসের অন্যতম আবিষ্কারক লিবনিৎজ ১৬৬৬ সালে প্রস্তাব করেন যে মানুষের চিন্তারও এক বর্ণমালা আছে, এবং যে কোনো জটিল ধারণাকে স্বল্পসংখ্যক সরল ধারণার সাহায্যে প্রকাশ করা যায়। লিবনিৎজ অবশ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা বলেন নি, কিন্তু চিন্তাকে এভাবে প্রকাশের কথা বলে তিনি সেই পথ খুলে দিয়েছিলেন।

মেশিন লার্নিং-এর এক স্তম্ভ হল বেইজের উপপাদ্য। ইংরাজ দার্শনিক গণিতবিদ ও যাজক টমাস বেইজ এই উপপাদ্যটি আবিষ্কার করেন, তবে তিনি সেটি নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দু' বছর পরে ১৭৬৩ সালে সেটি প্রকাশিত হয়। এর পর ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ইংরাজ গণিতবিদ জর্জ বুল বলেন যে মানুষ যেভাবে যুক্তি দিয়ে চিন্তাভাবনা করে, তাকে গণিতের সমীকরণের আকারে প্রকাশ করা সম্ভব। বুলের প্রস্তাবিত বীজগণিত হল আধুনিক কম্পিউটারের প্রাণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূলত কম্পিউটারের মাধ্যমেই রূপায়িত করা হচ্ছে। চার্লস ব্যাবেজকে মনে করা হয় যন্ত্রের সাহায্যে গণনা অর্থাৎ কম্পিউটারের আবিষ্কারক। ১৮২০-র দশকে তাঁর তৈরি ডিফারেন্স ইঞ্জিনকে প্রথম যন্ত্রগণক বা কম্পিউটার বলা হয়। কাউন্টেস আডা লাভলেস ব্যাবেজের ইঞ্জিনের জন্য প্রথম প্রোগ্রাম লিখেছিলেন।

উনিশশো চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশককে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সূচনাপর্ব বলা যেতে পারে। ১৯৪৩ সালে দুই মার্কিন গবেষক ওয়ারেন ম্যাকুলোক ও ওয়াল্টার পিটস এক গবেষণাপত্রে স্নায়ুতন্ত্রকে কতকগুলি আদর্শায়িত কৃত্রিম নিউরোন অর্থাৎ স্নায়ুকোষের জালিকা বা নেটওয়ার্ক হিসাবে প্রকাশ করেন। তাঁদের প্রস্তাবিত কৃত্রিম নিউরোনগুলি বুলের বীজগণিতকে রূপায়িত করতে পারে। এ থেকেই পরবর্তীকালে নিউরাল নেটওয়ার্ক ও ডিপ লার্নিং-এর চিন্তা আসে। ১৯৫৬ সালে মার্ভিন মিনস্কি ও ডিন এডমন্ডস তৈরি করেছিলেন প্রথম কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক SNARC (Stochastic Neural Analog Reinforcement Calculator)। তখন ছিল ভ্যাকুয়াম টিউবের যুগ, তিন হাজার ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করে চল্লিশটি কৃত্রিম নিউরোনের নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করা হয়।

ব্রিটিশ বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং-কে আধুনিক কম্পিউটার বিজ্ঞানের জনক মনে করা হয়, তিনি ১৯৫০ সালে এমন এক পরীক্ষার কথা বলেন যাতে উত্তীর্ণ হলে কোনো যন্ত্রকে বুদ্ধিমান বলা যাবে। টুরিং অবশ্য বাস্তব বুদ্ধিমান যন্ত্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন এমন নয়, তিনি সেই যন্ত্রের মূলনীতিগুলি স্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন। প্রথম যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সন্দেহাতীতভাবে টুরিং পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হয় তা হল GPT-4.5 ; ২০২২ সালে নেচার পত্রিকাতে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে সেই খবর প্রকাশ করা হয়। এই লেখার জন্য ChatGPT-র সাহায্য নেওয়া হয়েছে, তা GPT-4.5-এর উপরেই তৈরি। ১৯৫৯ সালে আর্থার স্যামুয়েল প্রথম মেশিন লার্নিং এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন; এক বিশেষ খেলাতে কম্পিউটার প্রোগ্রাম যদি তার স্রষ্টা প্রোগ্রামারের থেকেও বেশি ভালো খেলতে পারে, সেই ধরনের প্রোগ্রামকে তিনি মেশিন লার্নিং নাম দিয়েছিলেন। 

অ্যালান টুরিং

১৯৫০-এর দশকের গবেষকরা ভেবেছিলেন অল্পদিনের মধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সৃষ্টি করা যাবে, তাই বিভিন্ন সরকার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গবেষণাখাতে অনেক অর্থ বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু উনিশশো সত্তরের দশক থেকে বোঝা যায় যে বিষয়টা অত সহজ হবে না, তারপর থেকে অর্থের স্রোত শুকিয়ে এসেছিল। মাঝে উনিশশো আশির দশকের সূচনাতে আবার এই বিষয়ে আগ্রহের সৃষ্টি হলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯০-এর দশকে আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা পুরোদমে শুরু হয়। টুরিং টেস্টে উত্তীর্ণ না হলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বেশ কিছু সাফল্য পেতে শুরু করে। প্রথম কোনো কম্পিউটার দাবাতে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার রেটিং পায় ১৯৮১ সালে। ১৯৯৭ সালে দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভ ডিপ ব্লু সুপার কম্পিউটারের কাছে পরাজিত হন। ডিপ ব্লু আইবিএম কোম্পানির তৈরি, তাদেরই নির্মিত ওয়াটসন ২০১১ সালে জিওপার্ডি খেলাতে মানুষ চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে দেয়।

ডিপ ব্লু-তে ছিল ২৫৬টি প্রসেসর যারা সমান্তরালভাবে কাজ করে এক সেকেন্ডে কুড়ি কোটি সম্ভাব্য চাল গণনা করতে পারে। ফলে ডিপ ব্লু যে কোনো পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের চোদ্দটি চাল পর্যন্ত বিশ্লেষণ করে। ভাষাতত্ত্ববিদ নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন যে এভাবে দাবা খেলা জেতা আর বুলডোজারের মেশিনের অলিম্পিকে ওয়েটলিফটিং স্বর্ণপদক জেতা একই ব্যাপার। চিনের এক প্রাচীন খেলা গো দাবার থেকেও জটিল। ২০১৬ সালে গুগলের আলফাগো কম্পিউটার বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় দক্ষিণ কোরিয়ার লী সেডলকে হারিয়ে দেয়। আলফাগো ডিপ ব্লু-এর মতো অসংখ্য চালের বিশ্লেষণ করে না, নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাকে মানুষের মতো খেলতে শেখানো হয়েছে। তার স্ট্র্যাটেজির মৌলিকত্ব দর্শকদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল

২০১২ সালে আলেক্স ক্রিজেভস্কি তৈরি করেন আলেক্সনেট। তাঁকে সাহায্য করেছিলেন ইলিয়া সুতস্কেভার ও জিওফ্রে হিনটন। আলেক্সনেট হল এক নিউরাল নেটওয়ার্ক যা ছবির বস্তুকে চিনতে পারে। আলেক্সনেটে ছিল সাড়ে ছয় লক্ষ নিউরোন ও ছ' কোটি প্যারামিটার। আলেক্সনেট থেকেই ডিপ লার্নিং-এর সূচনা হল বলা যেতে পারে।

একুশ শতকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে বিকাশ ঘটেছে তার সমস্ত বিবরণ এই লেখার পরিসরে দেওয়া অসম্ভব। শতাব্দীর সূচনা থেকেই আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স সাধারণ দৈনন্দিন কাজেও ব্যবহার হতে শুরু হয়ে গেছে। ২০০২ সালে রুম্বা কোম্পানি প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ভ্যাকুয়াম ক্লিনার নিয়ে আসে। তার সব থেকে বড় গুণ ছিল সে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যেত না। ২০০৯ সালে গুগল চালকবিহীন গাড়ি তৈরি করে। এখন বহু দেশেই এই ধরনের গাড়িকে রাস্তায় দেখতে পাওয়া যায়। ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ আমরা অনেকেই ব্যবহার করি। সেগুলি তো বটেই, গোটা ইন্টারনেটই এআই-এর উপর নির্ভর করে। ২০১০-এর দশকে ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট তৈরি হয়। অ্যাপলের সিরি (২০১১), মাইক্রোসফটের কর্টানা (২০১৪), বা আমাজনের আলেক্সার (২০১৪) মতো ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম মোবাইল বা কম্পিউটারে মুখের কথাকে কম্পিউটারের ভাষাতে পরিবর্তন করে, কম্পিউটার বা মোবাইল সেই নির্দেশ পালন করে

গত এক দশকে আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্সে লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলদের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে। এই সমস্ত মডেলে মানুষের ভাষাকে ও কম্পিউটারের ভাষাতে রূপান্তরিত করে, আবার কম্পিউটারের ভাষাকেও মানুষের বোধ্য আকারে অনুবাদ করে। অনেক মডেলে ২০১৮ সালে উদ্ভাবিত Bidirectional encoder representations from transformers (BERT) ব্যবহার করা হয় । আগে GPT-র কথা এসেছে, এটি একটি লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল। আরো অনেক এই ধরনের মডেল আছে, যেমন Qwen, Gemini, Granite ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ছাপ রেখেছে বিজ্ঞানের নানা শাখাতে, তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ এই লেখাতে নেই। উল্লেখ করা যায় যে ২০২৪ সালে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন দুই বিভাগেই নোবেল পুরস্কারজয়ীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়েছেন। পদার্থবিজ্ঞানে দুই নোবেলজয়ী জন হপফিল্ড ও জিওফ্রে হিন্টন নিউরাল নেটওয়ার্কের সাহায্যে মেশিন লার্নিং পদ্ধতির বিকাশের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে প্রোটিনের গঠন সংক্রান্ত এক পঞ্চাশ বছরের পুরানো সমস্যার সমাধানের জন্য ডেমিস হাসাবিস ও জন জাম্পারকে রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এই পুরস্কারের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এই যুগে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

এই লেখাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রাযুক্তিক বিকাশের কয়েকটি বিশেষ ধাপের কথাই বলা হল। বিশেষ করে চেতনা ও বুদ্ধিমত্তার সম্পর্ক, বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নৈতিক দিক নিয়ে আরো অনেক গবেষণা হয়েছে যাদের উল্লেখ এই লেখার সীমাবদ্ধ পরিসরে সম্ভব হল না। কম্পিউটার প্রযুক্তির যে দ্রুত বিকাশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্মেষে সাহায্য করেছে তার বিষয়েও এই প্রবন্ধে কিছু বলা হল না। এই সংখ্যার অন্যান্য লেখাতে আরো অনেক বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ এই লেখা তৈরি করতে ChatGPT-র সাহায্য নেওয়া হয়েছে। শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের লেখা বোধবিজ্ঞান বইটি থেকেও নানা তথ্য পেয়েছি। বন্ধু নবেন্দু চাকি লেখাটি পড়ে তাঁর মতামত জানিয়েছেন।


প্রকাশঃ জ্ঞান ও বিজ্ঞান, জুলাই 2025

Saturday, 23 August 2025

বোধবিজ্ঞান – কগনেটিভ সায়েন্স-এর একটি পর্যালোচনা

 

বোধবিজ্ঞান – কগনেটিভ সায়েন্স-এর একটি পর্যালোচনা

লেখক: শুভাশিস মুখোপাধ্যায়

প্রকাশক: সাহিত্য সংসদ

প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০২৫

মূল্য: ৩০০ টাকা


বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলে, নানা ধারায় সে ভাগ হয়ে নতুন নতুন বিষয়ের জন্ম দেয়। মধ্যযুগে যার নাম ছিল ন্যাচারাল ফিলোসফি বা প্রাকৃতিক দর্শন, তা পরবর্তীকালে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা জীববিদ্যা ইত্যাদি শাখাতে বিভক্ত হয়েছে। প্রতিটি শাখা আবার নানা উপশাখার জন্ম দিয়েছে। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের আর এক নতুন চরিত্রের বিকাশ আমরা প্রত্যক্ষ করছি  দেখছি নানা শাখা এসে এক জায়গায় মিলে সম্পূর্ণ নতুন এক ক্ষেত্রের জন্ম দিচ্ছে। তেমনই এক নতুন বিষয় হল বোধবিজ্ঞান বা কগনেটিভ সায়েন্স, যেখানে এসে মিলেছে কম্পিউটার বিজ্ঞান, তথ্যবিজ্ঞান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মনোবিদ্যা, নৃবিজ্ঞান সহ আরো নানা আপাত-সম্পর্কহীন বিষয়। আমার সীমিত জ্ঞানে এই বিষয়ে সাধারণের জন্য লেখা কোনো বইয়ের কথা আমার জানা নেই। জ্ঞানচর্চার এই অপেক্ষাকৃত নবীন ক্ষেত্রটি নিয়ে বাংলা ভাষাতে বই প্রকাশ করার জন্য লেখক ও প্রকাশককে ধন্যবাদ জানাই।

আমাদের মস্তিষ্ক সম্পর্কে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে, তা সত্ত্বেও অনেক কিছুই এখনো আমাদের অজানা থেকে গেছে। যন্ত্র বা 'মনুষ্যেতর' প্রাণীর ক্ষেত্রে যেভাবে ব্যবচ্ছেদ করে অনুসন্ধান করা যায়, মানব মস্তিষ্কের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। অবশ্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও ব্যবচ্ছেদ নিয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন উঠেছে, এবং তা মোটেই তুচ্ছ নয়। মস্তিষ্ক সম্পর্কে গবেষণা, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্যবিজ্ঞান, এই তিনের মিলনে আধুনিক বোধবিজ্ঞানের জন্ম। ক্ষেত্রটি নতুন বলেই সূচনাতে লেখক তিনটি অধ্যায় বোধবিজ্ঞান কী, এবং তার উৎস কোথা থেকে তা নিয়ে ব্যয় করেছেন। শুরুর কাজ চালানোর জন্য তিনি বোধবিজ্ঞান সম্পর্কে একটা ধারণাকে প্রথমেই সংজ্ঞায়িত করেছেন। প্রাথমিকভাবে তা মানবদেহের সঙ্গে সংযুক্ত, কিন্তু বিষয় থেকে যত বিষয়ান্তরে গেছেন, ততই সেই ধারণাটা আরো বিমূর্ত রূপ নিয়েছে। এই প্রসঙ্গে আসে চোমস্কির সার্বজনীন ব্যাকরণের কথা, যা হয়তো মানুষের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে না। চোমস্কি দেখিয়েছেন, Poverty of stimulus বা উদ্দীপনের অভাব সত্ত্বেও শিশুরা ভাষা শিখতে সক্ষম; অর্থাৎ ব্যাকরণের হয়তো ভাষানিরপেক্ষ অস্তিত্ব আছে। সেই ধারণা থেকেই মনে হয় যে বোধবিজ্ঞানকে আর শুধুমাত্র মানবিকীবিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সমীচীন নয়, প্রকৃতিবিজ্ঞানের বৃহত্তর কাঠামোর মধ্যেই তার চর্চা করতে হবে।

কম্পিউটার বলতে আমরা সাধারণত প্রযুক্তির কথাই ভাবি। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় তার অভাবনীয় উন্নতির কথা, যার ফলে এখন বিশাল বিশাল তথ্যভাণ্ডারকে মুহূর্তের মধ্যে বিশ্লেষণ ও ব্যবহার করা যাচ্ছে। লেখক চার্লস ব্যাবেজ, অ্যালান টুরিং বা জন ফন নয়ম্যানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন; ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে এই বিশেষ বিষয়টিতে অন্তত প্রযুক্তির আগে প্রয়োজন হয়েছে বিজ্ঞানের, যা প্রযুক্তি বিকাশের পথ দেখিয়েছে। ব্যাবেজের যুগে তাঁর পরিকল্পিত অ্যানালিটিক ইঞ্জিন বানানো সম্ভব হয়নি, কিন্তু কম্পিউটার প্রযুক্তি সেই মৌলিক কাঠামোকে স্বীকার করেই অগ্রসর হয়েছে। আধুনিক কম্পিউটারের কর্মপদ্ধতি ইউনিভার্সাল টুরিং মেশিনের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছিল, এক অর্থে সমস্ত আধুনিক কম্পিউটারই হল ইউনিভার্সাল টুরিং মেশিনের রূপভেদ।

মানুষের মন কে কি যন্ত্র হিসাবে দেখা যায়? এই আলোচনা প্রসঙ্গে দেখলাম মন যে ঠিক কী, তা নিয়ে এখনো কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। নানা যুগ তাদের কালের সর্বোচ্চ যন্ত্রকে মডেল হিসাবে রেখে মানুষের মনকে বুঝতে চেয়েছে। সেই কারণে চার্লস ব্যাবেজ ভিক্টোরিয়ার যুগে তাঁর প্রস্তাবিত কম্পিউটারকে ইঞ্জিন নাম দিয়েছিলেন; আধুনিক যুগে আমরা কম্পিউটারকে দিয়ে মানব মনের বিচার করার চেষ্টা করি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে মানুষের মন কি 'কম্পিউটেবল' বা 'গণনাক্ষম’ এই প্রশ্ন নিয়ে অনেক বিজ্ঞানীই চিন্তা করেছেন; অ্যালান টুরিং, রজার পেনরোজ বা কুর্ট গোডেল তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। যন্ত্র হোক বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা,তার পক্ষে কি সত্যিই মানব মনের প্রতিরূপ হওয়া সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের অজানা। তার একটা কারণ হল মানব মনেরও অনেক কিছুই এখনো আমাদের জ্ঞানের বাইরে। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে তা বিজ্ঞানের অতীত। তবে এ বিষয়ে আধুনিক চিন্তাভাবনা সম্প্রতিই শুরু হয়েছে, এখনো অনেকটা পথ আমাদের যেতে হবে।

এই সংক্ষিপ্ত আলোচনাতে বইটির অনেক দিকই তুলে ধরা সম্ভব হল না। বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্র বোধবিজ্ঞানে অবদান রেখেছে, বা বর্তমানেও রাখছে। তাদের অনেকগুলি সম্পর্কেই বর্তমান আলোচকের জ্ঞান নিতান্তই সীমিত। আধুনিক যুগ হলে ইন্টারডিসিপ্লিনারি বা আন্তঃবিভাগীয় গবেষণার যুগ। আমরা ক্রমশই বুঝতে পারছি যে বিজ্ঞানকে নানা ভাগ করে আমরা যে আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠে রাখতাম, সেগুলি নিতান্তই কৃত্রিম; বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব নেই। সেই কারণেই রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় জীববিজ্ঞানীকে, কম্পিউটার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পদার্থবিদ্যাতে পুরস্কার পান। যদি আপনি বিজ্ঞানের আধুনিকতম বিষয় নিয়ে উৎসাহী হন, তাহলে এই বইটি আপনার অবশ্যপাঠ্য। তবে মনে রাখবেন, ‘বোধবিজ্ঞান' এমন বই নয় যে খবরের কাগজের প্রবন্ধের মতো করে তাকে পড়া যাবে। যে সমস্ত বিষয়ের বই আমাদের মাতৃভাষাতে প্রথম প্রকাশিত হচ্ছে, তাদের ভাষা আপাতভাবে একটু কঠিন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রই আছে, যেখানে শব্দচয়ন মোটেই সরল নয়; কিন্তু বহু বছর ধরে সেই শব্দগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে বলে এখন আর আমাদের সেগুলি পড়তে সমস্যা হয় না। যে কোনো ভাষাতে যখন প্রথম কোনো বিষয় আলোচিত হয়, তখন অনেক শব্দই অচেনা ঠেকে। এমন বইকে আত্তীকরণের জন্য সময় দিতে হবে, তবে সেই সময় দিলে পাঠক যে লাভবান হবেন তাতে সন্দেহ নেই।

লেখক এই জটিল এবং নতুন বিষয়টিকে অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে দুই মলাটের মধ্যে উপস্থাপন করেছেন। বইটির মুদ্রণ খুবই সুন্দর, চোখে পড়ার মতো কোনো প্রমাদ নেই। অসাধারণ প্রচ্ছদ নির্মাণ করেছেন সৌম্যেন পাল। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলা জনপ্রিয় বিজ্ঞান বইয়ের তালিকার প্রথমদিকেই থাকবে 'বোধবিজ্ঞান'

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


প্রকাশঃ জ্ঞান ও বিজ্ঞান আগস্ট ২০২৫