ভারতে বিজ্ঞানঃ বস্তুবাদী দর্শন বনাম ভাববাদী আগ্রাসন
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
বিজ্ঞানের মূলে আছে বস্তুবাদ। সেই মতবাদ বিশ্বাস করে বস্তুই সব কিছুর মূল; নানা বস্তু ও তাদের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া থেকেই সমস্ত ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। অবশ্য খুব সহজে এ ধারণাতে পৌঁছানো যায়নি। বস্তুবাদকে প্রথম থেকেই সংগ্রাম করতে হয়েছে ভাববাদের বিরুদ্ধে। ভাববাদের মূল কথা হল যে চেতনাই প্রথম, বস্তুর উদ্ভব তার থেকে। সমস্ত ধর্মের মূলে আছে ভাববাদ, যেখানে এক বা একাধিক দেবদেবীর কল্পনা করা হয়েছে। বিজ্ঞানে ভাববাদ ও বস্তুবাদের সেই সংগ্রাম এখনো চলছে। এই লেখাতে আমরা আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকেই ভাববাদ কেমনভাবে বিজ্ঞানের দর্শনের উপর আগ্রাসন চালিয়েছে, তার ইতিহাস সংক্ষেপে ফিরে দেখব।
প্রাচীন যুগের বিজ্ঞানের কথা আলোচনার সময় একটা কথা মনে রাখতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞানের মূলে আছে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা। তার থেকে যে জ্ঞান লাভ করা যায়, তার থেকে আরোহী দর্শনের যুক্তিজাল প্রয়োগ করে আমরা সাধারণ সত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করি। পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষাতে ভুল বা সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তাই বিজ্ঞান সাধারণ সত্যকেও পরিবর্তন করতে সবসময়েই প্রস্তুত থাকে। আধুনিক বিজ্ঞান পরীক্ষানিরীক্ষার উপর যে গুরুত্ব দেয়, কোনো প্রাচীন সভ্যতাই তা দেয়নি। বিজ্ঞানের তখন শৈশব অবস্থা, তার পক্ষে অধিকাংশ প্রাকৃতিক ঘটনার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব ছিল না। কাজেই প্রাচীন যুগের বিজ্ঞান মূলগতভাবে আমরা এখন বিজ্ঞান বলতে যা বুঝি তার থেকে পৃথক। কিন্তু প্রাচীন যুগের বিজ্ঞানের সুচনাতেও ছিল বস্তুবাদ, তাকে ছাড়া প্রকৃত বিজ্ঞানের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। অপরদিকে চেতনা বা চিন্তাই যেহেতু ভাববাদে প্রথম, তার মূলগত দর্শন তাই অবরোহী। অর্থাৎ সেখানে সিদ্ধান্ত আসে আগে, তার থেকে পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষার ব্যাখ্যা হাজির করা হয়।
আমাদের দেশে কণাদ ছিলেন পরমাণুবাদের উদ্গাতা। পরমাণুবাদের মুল কথা হল আমরা যা কিছু দেখতে পাই সব কিছুর মূলেই আছে পরমাণু। বিভিন্ন রকম পরমাণু নানা ভাবে পরষ্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জগতের সমস্ত কিছু গটয়হন করেছে। পরমাণুদের বাস্তব অস্তিত্ব আছে, তাদের সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। প্রাচীন যুগের পরমাণুবাদের সঙ্গে আধুনিক পরমাণুবাদের বিশেষ মিল নেই, কিন্তু দুটি মতই বলে বস্তুর সমস্ত ধর্ম তার ভিতরের পরমাণুদের থেকেই আসে, তার সঙ্গে ঈশ্বর বা চেতনার কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ তারা নিখাদ বস্তুবাদী।
কণাদের পরে বৌদ্ধ ও জৈন দার্শনিকরা পরমাণুবাদের চর্চা করেছিলেন। এই দুই দর্শনে ঈশ্বর বা ভগবানের বিশেষ স্থান নেই, তাই প্রথমে অন্তত পরমাণুবাদের সঙ্গে তাদের মূলগত কোনো বিরোধ হয়নি। নবম শতাব্দীর সূচনাতে শঙ্করাচার্য যখন বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানের নেতৃত্ব দেন, তখন তিনি পরমাণুবাদের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। শঙ্করাচার্যের মায়াবাদ বলে যে ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। স্পষ্টতই তা ভাববাদী, কারণ সেখানে একমাত্র চেতনাকেই বাস্তব বলে স্বীকার করা হয়েছে। পরমাণুর সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, তাকে মায়াবাদের সঙ্গে মেলানো সম্ভব নয়। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর বিখ্যাত বই A History of Hindu Chemistry-তে লিখেছেন, “The Vedanta philosophy, as modified and expanded by Sankara, which teaches the unreality of the material world is also to a large extent responsible for bringing the study of physical science into disrepute. Sankara is unsparing in his stricture on Kananda and his system.” আমাদের দেশে প্রাচীন কালে বিজ্ঞানের অগ্রগতি বন্ধ হওয়ার পিছনে জাতিভেদ প্রথার পাশাপাশি এই ভাববাদী প্রতিক্রিয়াকে একটা বড় কারণ বলেই প্রফুল্লচন্দ্র সিদ্ধান্ত করেছেন। বৌদ্ধ দর্শনেও একই ঘটনা ঘটেছিল। দ্বিতীয় শতাব্দীতে বিখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন যে শূন্যবাদ প্রচার করেন তা অনুযায়ী জগৎ অবর্ণনীয়। স্বাভাবিক ভাবেই যাকে বর্ণনা করা যায় না, তার উপাদান বা গঠন নিয়ে চর্চাও অর্থহীন। বিপরীতে বিজ্ঞানের একটা মূল লক্ষ্য হল বস্তুজগতের সম্পর্কে জ্ঞানলাভ। একই সঙ্গে শঙ্করাচার্য বা নাগার্জুনের দর্শন কার্য-কারণ সম্পর্ককে অস্বীকার করে। বিজ্ঞানের একটা মূল কথা হল যে কোনো কার্যের পিছনেই একটা কারণ আছে, এবং সেই কারণ অবশ্যই আমাদের বাস্তব জগতের মধ্যেই অবস্থান করে। এখানে কোন রকম দৈব বা ঈশ্বরের কোনো স্থান নেই।
প্রাচীন ভারতে যে বিজ্ঞান কিছুটা বস্তুবাদকে আশ্রয় করে বিকশিত হয়েছিল তা হল আয়ুর্বেদ অর্থাৎ চিকিৎসাশাস্ত্র। চরক বা সুশ্রুত সংহিতার তুলনীয় কিছু কোনো প্রাচীন সভ্যতাতে পাওয়া যাবে না। চিকিৎসাশাস্ত্র স্বাভাবিক ভাবেই বস্তুবাদী, কারণ তা রোগের কারণ নির্ণয় করে তাকে উপশমের চেষ্টা করে। সেখানে দৈবের কোনো স্থান নেই। দুই সংহিতাতেই তাই প্রত্যক্ষ অর্থাৎ পর্যবেক্ষণের উপরে জোর দেওয়া হয়েছে, তাকে সব রকম সাক্ষ্যের উপরে বসানো হয়েছে। দেবদেবী বা পরলোকের অস্তিত্বের কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই, প্রত্যক্ষ প্রমাণের উপর নির্ভর করতে শুরু করলে তাঁদের থেকে মানুষের বিশ্বাস টলে যাবে। ধর্মশাস্ত্রে তাই ঠিক উল্টো কথা পাওয়া যায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে, 'পরোক্ষ-প্রিয়াঃ ইব হি দেবাঃ, প্রত্যক্ষ-দ্বিষঃ।’ দেবতারা পরোক্ষ প্রিয়, প্রত্যক্ষের প্রতি তাঁদের বিদ্বেষ।
প্রত্যক্ষ প্রমাণের অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে এসেছে বস্তুবাদ। সুশ্রুত সংহিতাতে বলা হয়েছে, 'ভূতেভ্যঃ হি পরং যস্মৎ নাস্তি চিন্তা চিকিৎসিতে', অর্থাৎ ভূতবাদ বাদ দিয়ে চিকিৎসা সম্ভব নয়। এখানে ভূত অর্থ পঞ্চভূত, যা বস্তুকেই সূচনা করে। দেহের চিকিৎসা করতে হবে, সে জন্য দেহ কী থেকে উৎপন্ন জানতে হবে। চরক সংহিতাতে বলা হয়েছে, 'দেহঃ হি আহার সম্ভবঃ', আহার থেকেই দেহের উৎপত্তি। চরক সংহিতাতে হাজারের বেশী গাছগাছড়া এবং দেড়শোর বেশী জন্তুজানোয়ারের কথা আছে। ফলমূল শিকড়বাকড় থেকে শুরু করে জন্তুজানোয়ারের রক্তমাংস থেকে মূত্র পর্যন্ত কীভাবে ব্যবহার করতে হবে তার আলোচনা করা আছে। প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের এ এক অসাধারণ সংকলন। প্রাচীন ভারতে চিকিৎসাবিদ্যা কোন স্তরে পৌঁছেছিল এ থেকে অনুমান করা যায়।
বস্তুবাদের প্রতি এই আনুগত্য সমাজপতিদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রাচীন ভারতের ধর্মের একটা মূল কথা ছিল যে জাগতিক সমস্ত দুঃখের কারণ হল পূর্বজন্মের কর্ম। যাগযজ্ঞের মাধ্যমে কর্মফল থেকে নিস্তার পাওয়া যেতে পারে। চিকিৎসক যদি রোগজ্বালার উপশম ঘটাতে সক্ষম হন, তাহলে যাগযজ্ঞ বা পূজাআচ্চার উপর মানুষের বিশ্বাস টলে যেতে পারে। সেই কারণে ঋক্বেদে চিকিৎসক উচ্চ আসনে থাকলেও যজুর্বেদ বা মনুসংহিতাতে তাকে নামানো হয়েছে চণ্ডালের স্তরে। তাকে সামাজিকভাবে বর্জন করার কথা বলা হয়েছে।
চরক ও সুশ্রুত দুই সংহিতাতেই তাই অনেক পরস্পরবিরোধী কথা পাওয়া যায় যেগুলি স্পষ্টতই পরে ঢোকানো হয়েছে। চরক সংহিতাতে প্রয়োজনে রোগীকে গোমাংস খাওয়ানোর বিধান দেওয়া হয়েছে। এবং সেখানেই বহু জায়গায় গোব্রাহ্মণের জয়গান গাওয়া হয়েছে। বারবার সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে মোক্ষ বা মুক্তির কথা এসেছে। চরক সংহিতাতে কোথাও বলা আছে যে রোগের নিরাময় চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকে -- রোগী, চিকিৎসক, পরিচর্যাকারী এবং ঔষধপথ্য। আবার অন্যত্র বলা হয়েছে ব্রাহ্মণের স্থান চিকিৎসকের উপরে, সে ব্রাহ্মণের কথামতো চলতে বাধ্য। স্পষ্টতই ভাববাদের আগ্রাসনের সামনে পড়ে সমাজপতিদের সন্তুষ্ট করে চিকিৎসাশাস্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই এই সমস্ত কথা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে প্রায় একই ধরনের নানা উদাহরণ পাওয়া যায়। চাঁদ ও পৃথিবীর ছায়াই যে সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের সঠিক কারণ তা আমাদের দেশে প্রথম বলেছিলেন আর্যভাট। কিন্তু পরবর্তীকালে বরাহমিহির, লল্ল, ব্রহ্মগুপ্তের মতো জ্যোতির্বিদরা তাঁর বিরোধিতা করেন। বিশেষ করে কৌতূহল জাগায় ব্রহ্মগুপ্তের আচরণ। ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্তে তিনি ঘোষণা করেন বেদে আছে বা মনু বলেছেন রাহুগ্রাসই গ্রহণের জন্য দায়ী, সেটাই সত্য। আর্যভাটের ধারণা সত্য হলে ব্রাহ্মণরা গ্রহণের সময় যে সমস্ত আচরণ পালন করে, তা অর্থহীন হয়ে পড়বে। কিন্তু সেই একই বইতে কিছু পরে ব্রহ্মগুপ্ত চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর ছায়ার মাপ বার করেছেন বা সূর্যগ্রহণের সময় চাঁদের ব্যাস মাপার চেষ্টা করেছেন। ভাববাদের আগ্রাসনের মুখে পড়ে বস্তুবাদী ব্যাখ্যাকে বাঁচাতে ব্রহ্মগুপ্তকেও ছলনার আশ্রয় নিতে হল।
ভাববাদ ও বস্তুবাদের এই বিরোধ আজও চলে আসছে। প্রফুল্লচন্দ্রের মৃত্যুর পরে তাঁর A History of Hindu Chemistry-র নতুন সংস্করণের সম্পাদনা করেন তাঁর অন্যতম প্রিয় ছাত্র প্রিয়দারঞ্জন রায়। সেখানে তিনি ভারতীয় বিজ্ঞানে অধোগতিতে শঙ্করাচার্যের বেদান্তের ভূমিকা সম্পর্কে প্রফুল্লচন্দ্রের মন্তব্যগুলি কোনো মন্তব্য না করেই বর্জন করেন। প্রফুল্লচন্দ্রের বইতে দুটি অধ্যায় লিখেছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। চরকসংহিতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন যে প্রাচীন দার্শনিকরা শুধুমাত্র চিন্তা করেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পৌঁছেছিলেন, চিকিৎসকরা সেই পদ্ধতি অবলম্বন করেন। তিনি লিখলেন, '... the various Pramana-s, proofs, i.e. source of valid knowledge, in Hindu Logic, ... are only operations subsidiary to the ascertainment of Truth'। অবরোহী দর্শনের প্রভাব এখানে স্পষ্ট। ব্রজেন্দ্রনাথের মতো দার্শনিকও এই ভাববাদী প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে পারেননি!
অপেক্ষাকৃত আধুনিক যুগে আমরা ভাববাদী আগ্রাসনকে নানা রূপে দেখতে পাই। সরকারি উচ্চমহল থেকে বিজ্ঞানের কথা প্রচার করা হচ্ছে, কিন্তু বিজ্ঞানের মূল দর্শন বস্তুবাদকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। ইন্টারনেট, স্টেম সেল চিকিৎসা বা এরোপ্লেনের মতো আধুনিক উদ্ভাবন ও আবিষ্কারকে পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থের মধ্যে খুঁজে পাওয়ার মধ্যেই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহ সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে এগুলি ভাববাদী আগ্রাসনের উদাহরণ। ধরা যাক বৈমানিক শাস্ত্রের কথা। দাবি করা হয় যে প্রাচীন মুনিঋষিরা শুধুমাত্র চিন্তা করেই বিমান নির্মাণের প্রযুক্তি আয়ত্ত করেছিলেন। যে কোনো প্রযুক্তির পিছনে থাকে পরীক্ষানিরীক্ষা, ভুল করা ও তাকে সংশোধন করা, ইত্যাদি; হাতে কলমে কাজ ছাড়া যা সম্ভব নয়। বস্তুত ভাষাতত্ত্বের সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় বইটি নিতান্তই অর্বাচীন, সহজ কথায় জাল। তার কোনো পুরানো পুঁথি কোথাও পাওয়া যায়নি।
ভাববাদ আমাদের বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশকে আজও আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী পুষ্প মিত্র ভার্গব ও ঐতিহাসিক আবদুর রহমান ১৯৬৪ সালে স্থাপন করেছিলেন সোসাইটি ফর সায়েন্টিফিক টেম্পার। সদস্য হয়েছিলেন বিদেশের অনেক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, যাঁদের মধ্যে নোবেলজয়ী ফ্রান্সিস ক্রিকের নাম উল্লেখযোগ্য। সংস্থার সদস্যপদ লাভের জন্য একটি বিবৃতিতে সই করতে হত। বিবৃতিটির অনুবাদ করলে হয়, 'আমি বিশ্বাস করি যে একমাত্র মানুষের প্রচেষ্টাটার মাধ্যমেই জ্ঞান অর্জন সম্ভব, কোনো দৈবানুগ্রহে নয়। আধিদৈবিক শক্তির কাছে প্রার্থনা না করে মানুষের বৌদ্ধিক ও নৈতিক শক্তির সাহায্যেই সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।' তাঁরা দেশের বহু বিজ্ঞানীর কাছে সেই বিবৃতিটি স্বাক্ষরের জন্য পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো সাড়া পাননি বললেই চলে।
আধুনিক যুগেও ভাববাদের কাছে এই আত্মসমর্পণের কারণ কী? আমাদের দেশে বিজ্ঞানর্চার একটা মূল সমস্যা হল আমাদের সমাজে কোনো বৈজ্ঞানিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি। আমাদের নবজাগরণ আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের ভালোমন্দ বিচার না করেই তার সঙ্গে সমঝোতা করেছিল। প্রাচীন সমাজের পশ্চাদমুখী ধ্যানধারণা এবং তার উপর চাপিয়ে দেওয়া উপনিবেশিক চিন্তাধারা দেশে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারে বাধা দিয়েছে। ফলে অনেক বিজ্ঞানীই প্রকৃত অর্থে বিজ্ঞানমনস্ক নন। তাই মহাকাশযান উৎক্ষেপণের আগে তাঁরা মন্দিরে পুজো দিতে যান, থিসিস জমা দেওয়ার আগে গঙ্গাস্নান করেন। পাঠক্রমে ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের নাম করে গাল্পগল্প ও কল্পনাকে জায়গা করে দেওয়ার বিপক্ষে বিশেষ প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় না।
সম্পূর্ণ ভাববাদী অবৈজ্ঞানিক তত্ত্বও কখনো কখনো প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন লাভ করে। ডারউইন-ওয়ালেসের বিবর্তন তত্ত্বের বিরোধিতাতে ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন নামের ভাববাদী তত্ত্বকে খাড়া করা হয়েছে; কলকাতার এক বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এই বিষয়ে এক বক্তৃতা পর্যন্ত আয়োজন করা হয়েছিল। অনেক সময়েই এই ধরনের সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক মতকেও প্রচারের ব্যবস্থা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই করা হয়, যুক্তি দেখানো হয় যে খোলা মনে সমস্ত কিছু বিচার করা প্রয়োজন। এই যুক্তি প্রসঙ্গে বলতে হয় যে একটা ন্যূনতম মাপকাঠিকে না পূরণ করতে পারলে কোনো মতকে বিজ্ঞানে প্রবেশাধিকার দেওয়া উচিত নয়। তা না হলে পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্ব বা ডাইনি প্রথাকেও আমাদের খোলা মনে বিচার করতে হবে। এই ধরনের ছিদ্র দিয়েই পশ্চাৎমুখী ভাববাদ মূলধারার বিজ্ঞানে প্রবেশ করে।
ইন্টালিজেন্ট ডিজাইনকে ভাববাদী বলছি কেন? ডারউইন-ওয়ালেস প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের যে তত্ত্বের প্রস্তাব করেছিলেন, আজ প্রায় পৌনে দু'শো বছর পরে তা দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। জীববিদ্যার বহু ক্ষেত্রকে একমাত্র সেই তত্ত্বের মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। বিবর্তন সম্পূর্ণ এলোমেলো বা বিশৃঙ্খল (random), তার কোনো উদ্দেশ্য নেই। প্রথম সরল প্রাণ থেকে বর্তমানের জীবজগতের সৃষ্টির পিছনে কোনো চিন্তা কাজ করে না। সেই কারণে বিবর্তন তত্ত্ব সম্পূর্ণ বস্তুবাদী, এবং স্বাভাবিকভাবেই ভাববাদীদের চক্ষুশূল। প্রথম যুগে বিবর্তন তত্ত্বের বিরোধিতা করেছিল বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব। তার পরাজয়ের পরে তাকে ইন্টালিজেন্ট ডিজাইনের নতুন মোড়কে হাজির করা হয়েছে। এই তত্ত্বে বলা হয় যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও জীবগগতের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে গেলে ধরে নিতে হবে যে আদিতে কোনো এক চিন্তা কাজ করেছিল। সহজ কথায় জটিল ডিজাইন থাকলে ধরে নিতে হবে যে তার পিছনে এক ডিজাইনার আছে, এভাবেই ঈশ্বর সম্পর্কিত চিন্তাকে আধুনিক বিজ্ঞানের দর্শনে ঢোকানোর চেষ্টা চলছে। প্রাচীন সৃষ্টিতত্ত্বের মতোই ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্বের স্বপক্ষেও কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, তবু বিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে একে বিবর্তনবাদের বিপক্ষে দাঁড় করানো হয়েছে। এর পিছনে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠান ডিসকভারি ইনস্টিটিউট। কোনো প্রতিষ্ঠিত জীববিজ্ঞানী ইন্টালিজেন্ট ডিজাইনকে সমর্থন করেন না, কিন্তু ডিসকভারি ইনস্টিটিউটের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার জন্য এই মতকে প্রায়ই খবরের শিরোনামে দেখা যায়।
আমাদের দেশেও বিবর্তন তত্ত্বকে ভাববাদী আগ্রাসনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে আক্রমণের দুটি রূপ আছে। একটি হল সরাসরি অস্বীকার, যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের মন্ত্রী সরাসরি বলেন বিবর্তন তত্ত্ব মিথ্যা, কারণ কেউ এক জীবকে অন্য জীবে বিবর্তিত হতে দেখেনি। বিবর্তন তত্ত্ব সম্পর্কে সামান্য পড়াশোনা করলেই জানা যায় যে সাধারণভাবে বিবর্তন অত্যন্ত ধীর প্রক্রিয়া, কাজেই তাকে মন্ত্রীমশায় যা দেখতে চেয়েছিলেন, সেই বানরকে মানুষে হতে দেখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু অতি সরল জীবের ক্ষেত্রে বিবর্তন সহজেই দেখা যায়। মন্ত্রীমশায় কি ড্রাগরেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার কথা শোনেন নি? তাকে তিনি কেমনভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
দ্বিতীয় একটি আক্রমণ ইন্টালিজেন্ট ডিজাইনেরই অন্য রূপ। মাঝেমাঝেই শোনা যায় আমাদের প্রাচীন ভারতীয় পুরাণের দশাবতার তত্ত্ব অর্থাৎ মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন ইত্যাদি হল প্রাচীন ভারতীয়দের যে বিবর্তন তত্ত্ব জানা ছিল তার প্রমাণ। এখানেও সেই একই কথা বলতে হয়। পুরাণ অনুযায়ী বিষ্ণু এই সমস্ত রূপ পরিগ্রহণ করেছিলেন। বাস্তবে জলচর থেকে উভচর, তার থেকে স্থলচর প্রাণী কোনো দেবতার ইচ্ছায় হয়নি; হয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে, যার উল্লেখ ছাড়া বিবর্তন তত্ত্ব অর্থহীন।
এই লেখাতে অন্য দেশে বা সমাজে বিজ্ঞানের উপর ভাববাদের আগ্রাসনের কথা আসেনি, কিন্তু তার অনেক উদাহরণ আমরা সবাই জানি। গ্যালিলিওকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাঁর সমসাময়িক বিজ্ঞানী রেনে দেকার্তে ধর্ম ও বিজ্ঞানের জগৎকে আলাদা করে বিজ্ঞানকে ভাববাদী আক্রমণ থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। সেই যুগে তিনি সফল হয়েছিলেন, কিন্তু তার ফলেই ভবিষ্যতে বিজ্ঞানদর্শনের উপর ভাববাদী আক্রমণের পথ খোলা থেকে গেছে। সবসময় তাকে চেনা সহজ নয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে মার্কসবাদকে সঠিকভাবেই বস্তুবাদ বলা হত। অথচ তার বিকৃত ব্যাখ্যাকে যেভাবে জেনেটিক্স বা কসমোলজির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছিল, তা ভাববাদী আগ্রাসনেরই অন্য রূপ। সূচনাকাল থেকেই বিজ্ঞানকে ভাববাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেই সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি।
প্রকাশঃ পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা কমিটির পত্রিকা শতমুখীতে প্রকাশিত। (নভেম্বর ২০২৪ সংখ্যা)।