মৌলিক পদার্থ ও মহিলা বিজ্ঞানী
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
ঠিক একশো পঞ্চাশ বছর আগে 1869 সালের 18 মার্চ রুশ বিজ্ঞানী
দমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভ রাশিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির সভায় মৌলিক পদার্থগুলিকে
একটা সারণি বা টেবিলের মতো করে সাজানোর কথা বলেছিলেন। তাকেই আমরা আজ পর্যায়সারণি
বা পিরিয়ডিক টেবিল বলে চিনি। এ এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার যে রাষ্ট্রসংঘ 2019
সালকে আন্তর্জাতিক পর্যায়সারণি বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছে। ১৮৬৯ সালে ষাটটি মৌলের
অস্তিত্বের কথা জানা ছিল। পর্যায়সারণিতে অনেক শূন্য স্থান ছিল যা পরে নতুম মৌল আবিষ্কারের মাধ্যমে পূর্ণ হয়েছে। তাছাড়াও পর্যায়সারণির আরো সম্প্রসারণ ঘটেছে। দেড়শো বছর পরে মৌলের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে একশো আঠারোতে। এদের মধ্যে অনেকগুলি
তেজস্ক্রিয়। ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা হল 92। ইউরেনিয়ামের থেকে ভারি মৌলগুলি
সবই ক্ষণস্থায়ী, তাদের প্রকৃতিতে পাওয়া
যায় না -- পরীক্ষাগারে তৈরি করতে হয়েছে। সেগুলির সবই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের
আবিষ্কার; একজন বা দুজন নন, সাধারণভাবে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী দলবদ্ধভাবে সেই
গবেষণাতে অংশ নিয়েছিলেন।
সোনা, রুপো,
তামা, টিন, কার্বন, গন্ধক, পারদ, সিসা, লোহা, অ্যান্টিমনি, দস্তা, আর্সেনিক -- এই
বারোটি মৌলের আবিষ্কার হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগে। এগুলো হয় প্রকৃতিতে মৌলিক পদার্থের রূপে পাওয়া যায়, নয়তো এদের আকরিক থেকে
আলাদা করা বেশ সহজ ছিল। এদের আবিষ্কারকদের নাম জানার কোনো সুযোগ নেই। ইতিহাসে ইউরেনিয়াম
পর্যন্ত বাকি মৌলদের নামের পাশে তাদের আবিষ্কারকদের নাম পাওয়া যাবে। আধুনিক বিজ্ঞানের
জগতে মহিলাদের পদার্পণ খুব সাম্প্রতিক ঘটনা, তাই সেই তালিকাতে মহিলা বিজ্ঞানীর
সংখ্যা কম। তবু এদের মধ্যে অন্তত ছ’টি ক্ষেত্রে কোনো না কোনো মহিলা বিজ্ঞানীর নাম
জড়িয়ে আছে। এই প্রবন্ধে আমরা খুব সংক্ষেপে সেই সমস্ত আবিষ্কারের দিকে দৃষ্টি রাখব।
প্রথমেই আসে মাদাম
মেরি কুরির নাম। স্বামী পিয়ের কুরির সঙ্গে মিলে তিনি দুটি নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল
পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন। বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড অবশ্য আরো একটি মৌল আবিষ্কারের কৃতিত্ব
দিয়েছিলেন, সে কথায় আমরা পরে আসব। বেকারেল তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের পরে পরেই মেরি সে
বিষয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। অন্য সবাই যখন বিকিরণ দেখার জন্য ফটোগ্রাফিক প্লেট
ব্যবহার করছিলেন, মেরি কাজে লাগালেন পিয়ের ও তাঁর দাদা জ্যাকসের আবিষ্কৃত
ইলেক্ট্রোমিটার যন্ত্র। ইলেক্ট্রোমিটার তেজস্ক্রিয়তার জন্য বাতাসের যে আয়নন হয়,
তার পরিমাণ মাপতে পারে। তার ফলে মেরি তেজস্ক্রিয়তার যে পরিমাপ বার করছিলেন, তা
অন্যদের থেকে অনেক ভালো।
মেরির
অগ্রগতিতে উৎসাহী হয়ে কিছুদিন পরেই পিয়ের তাঁর সঙ্গে কাজ শুরু করেন।
ইউরেনিয়ামের দুই আকরিক হল পিচব্লেন্ড ও
চালকোলাইট, মেরিরা তাদের থেকে ইউরেনিয়াম বার করছিলেন। তাঁরা দেখলেন ইউরেনিয়ামের
আকরিকের তেজস্ক্রিয়ার মাত্রা ইউরেনিয়ামের থেকে বেশী। এর একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে,
আকরিকের মধ্যে এক বা একাধিক অজানা মৌলিক পদার্থ আছে যাদের তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা
ইউরেনিয়ামের থেকে অনেক বেশি। মেরিরা সেই মৌলিক পদার্থগুলি আবিষ্কার করার সিদ্ধান্ত
নেন। পিচব্লেন্ড হল মূলত ইউরেনিয়ামের অক্সাইড, কিন্তু তার মধ্যে প্রায় তিরিশ রকম
মৌলিক পদার্থ থাকে, তাদের একে একে পৃথক করতে হত। নতুন মৌলের রাসয়ানিক ধর্ম
সম্পর্কে তাঁদের কিছুই জানা ছিল না, তাই তাকে
খোঁজার জন্য তাঁদের রাসয়ানিক বিশ্লেষণের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হয়েছিল। 1898 সালের জুলাই মাসে
তাঁরা একটা নতুন মৌলিক পদার্থের চিহ্ন খুঁজে পেলেন। পিচব্লেন্ডের মধ্যে থাকে
বিসমাথ। নতুন মৌলটার রাসয়ানিক ধর্ম বিসমাথের খুব কাছাকাছি, তাই পিচব্লেন্ড থেকে
বিসমাথ যখন রাসয়ানিক পদ্ধতিতে আলাদা করলেন কুরিরা, তখন নতুন মৌলটাও তার সঙ্গে
বেরিয়ে এসেছিল। পরাধীন জন্মভূমি পোল্যান্ডের স্মরণে মেরি তার নাম দিলেন পোলোনিয়াম (Po)। পোলোনিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা হল 84।
মেরি কুরি
কিন্তু
পোলোনিয়াম দিয়েও পিচব্লেন্ডের তেজস্ক্রিয়তার পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না।
মেরিরা বুঝতে পারলেন আরো একটি মৌল পিচব্লেন্ডের মধ্যে আছে, সেটা শেষ পর্যন্ত অন্য
এক মৌলিক পদার্থ বেরিয়ামের সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল। বিকিরণ বা রেডিয়েশনের অনুসারে তাঁরা
এর নাম ঠিক করলেন রেডিয়াম (Ra)। সেটা ছিল 1898 সালের ডিসেম্বর মাস। যেখানে একটা
মৌল আবিষ্কারই যে কোনো বিজ্ঞানীর কাছে স্বপ্ন, মেরিরা সেই কাজে সফল হয়েছেন দুবার।
দীর্ঘ তিন বছর চেষ্টা করে কুরিরা 1902 সালের এপ্রিল মাসে রেডিয়ামকে বেরিয়াম থেকে আলাদা করতে সফল হলেন। কাজ
শুরুর সময় কুরিরা ভেবেছিলেন এক টন পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম পাওয়া যাবে দশ
কিলোগ্রাম। শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল একশো মিলিগ্রাম রেডিয়াম ক্লোরাইড। তার বর্ণালী বিশ্লেষণ করে কুরিরা বুঝেছিলেন যে
তাঁরা রেডিয়ামকে বেরিয়ামের থেকে আলাদা করতে পেরেছেন। এ কাজে তাঁদের সাহায্য
করেছিলেন দুই বিজ্ঞানী গুস্তাভ বেমন্ট ও ইউজিন ডেমার্কে। কুরিরা রেডিয়ামের পারমাণবিক
গুরুত্ব বা ভরসংখ্যা নির্ধারণ করলেন 225। পরে জানা গিয়েছিল রেডিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা অর্থাৎ তার নিউক্লিয়াসে
প্রোটনের সংখ্যা হল 88। পোলোনিয়ামকে কুরিরা কখনোই বিসমাথ
থেকে আলাদা করতে সক্ষম হন নি। তার কারণ তখন বোঝা যায়নি। তাঁদের আবিষ্কৃত
পোলোনিয়ামের আইসোটোপের অর্ধায়ুকাল হল 138 দিন, রাসয়ানিক পদ্ধতিতে এত সময় লাগত যে
পোলোনিয়াম পরমাণুর ক্ষয় হয়ে যেত।
আর্নেস্ট রাদারফোর্ড
ও তাঁর সহযোগী ফ্রেডরিক সডি প্রথম বলেছিলেন তেজস্ক্রিয়াতে এক পরমাণু অন্য পরমাণুতে
পাল্টে যাচ্ছে। সেই প্রকল্পের সূচনাতে ছিল রাদারফোর্ড ও তাঁর এক ছাত্রীর পরীক্ষা।
হ্যারিয়েট ব্রুক্সের নাম আজ বিশেষ কেউ জানে না, তিনি কানাডার প্রথম মহিলা
নিউক্লিয় বিজ্ঞানী। শুধু কানাডা নয়, গোটা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ মিলিয়েই
তাঁর এই সম্মান প্রাপ্য। 1898 সালে বিজ্ঞান ও অঙ্ক নিয়ে কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক হয়েছিলেন হ্যারিয়েট ব্রুক্স। সে সময় রাদারফোর্ড
কেমব্রিজ থেকে ম্যাকগিলে যোগ দিয়েছেন, তিনি সহকারী হিসাবে বেছে নেন হ্যারিয়েটকে।
মাঝে কিছুদিন কেমব্রিজে ইলেকট্রনের আবিষ্কর্তা জে জে টমসনের সঙ্গে কাজ করার পরে
হ্যারিয়েট আবার কানাডা ফিরে যান।
রাদারফোর্ডও
তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি ও রবার্ট আওয়েন্স দেখলেন যে থোরিয়াম থেকে
কিছু একটা নিঃসরণ হচ্ছে, যা তেজস্ক্রিয়তাতে যে আলফা বা বিটা কণা বেরোয়, তার থেকে
আলাদা। বায়ুর প্রবাহ তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাঁরা তার নামও দিয়েছিলেন থোরন। কুরিরা
এই নিঃসরণের কথা আগেই বলেছিলেন। তাঁরা দেখেছিলেন যে রেডিয়াম তার কাছাকাছি বায়ুকে
তেজস্ক্রিয় করে দেয়, কিন্তু তা নিয়ে তাঁরা আর এগোননি। আমরা এখন জানি আলফা কণা হল হিলিয়ামের
নিউক্লিয়াস যার ভরসংখ্যা হল চার। বিটা কণা হল ইলেকট্রন, তার ভরসংখ্যা শূন্য। মনে
করা হচ্ছিল এ হয়তো থোরিয়ামেরই অন্য কোন ভৌত রূপ। রাদারফোর্ড ও হ্যারিয়েট ব্রুক্স
দেখালেন যে এই নতুন নিঃসরণ হল একটা তেজস্ক্রিয় গ্যাস যার ভরসংখ্যা থোরিয়ামের থেকে
অনেক কম। সেই প্রথম কোনো তেজস্ক্রিয় গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেল। রাদারফোর্ড ও
ব্রুক্স রেডিয়াম থেকেও এই গ্যাস নির্গত হওয়ার চিহ্ন খুঁজে পান। কয়েক বছর পরে ব্রুক্স এর অর্ধায়ুকালও মাপেন,
যার থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যায় এটি একটি নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল। রেডিয়াম থেকে নির্গত
এই গ্যাসের নাম দেওয়া হল রেডন (Rn)। এর পারমাণবিক সংখ্যা হল 86। এর থেকেই রাদারফোর্ড এবং সডি ইঙ্গিত পেয়েছিলেন যে
তেজস্ক্রিয়াতে এক মৌল অন্য মৌলে পরিবর্তিত হচ্ছে।
হ্যারিয়েট ব্রুক্স
তবে রেডন আবিষ্কারের
ইতিহাস সরলরেখা নয়। রাদারফোর্ডই প্রথম রেডনকে নতুন মৌল বলেছিলে, আজকাল অনেক জায়গায়
তাঁকে রেডনের আবিষ্কর্তার সম্মান দেওয়া হয়। রাদারফোর্ড কিন্তু কুরিদের রেডন
আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিয়েছিলেন, তার কারণ তাঁরাই প্রথম রেডিয়াম থেকে এই নিঃসরণ
দেখেছিলেন। অপরদিকে মাদাম কুরি রাদারফোর্ডের মতের বিরোধিতা করেছিলেন। রাদারফোর্ড ও
সডি নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখান যে রেডন সত্যিই গ্যাস, তার রাসয়ানিক ধর্ম
নিষ্ক্রিয় গ্যাসের অনুরূপ। মাদাম কুরি তখন তা মেনে নেন। আমরা এখন জানি ব্রুক্স
রেডনের ভরসংখ্যা ঠিকঠাক মাপতে পারেন নি। তার ভরসংখ্যা আসলে থোরিয়ামের থেকে
সামান্যই কম। তাই যে পরীক্ষা থেকে রেডনকে মৌল বলে অনুমান করা গিয়েছিল, তা ছিল ভুল।
অবশ্য রেডনের অর্ধায়ুকালও ব্রুক্স মেপেছিলেন, তার থেকে বোঝা গিয়েছিল যে সেটি একটি
নতুন মৌল। রাদারফোর্ড নিজে সবসময়েই রেডন বিষয়ে গবেষণা প্রসঙ্গে ব্রুক্সের কথা
বলেছেন। রাদারফোর্ড ও ব্রুকস প্রথমে রেডন বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র ছাপান। পরে
রাদারফোর্ড একাই এই বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র লিখেছিলেন, তার ভিতরেও তিনি ব্রুক্সের
অবদানের কথা লিখেছিলেন। কিন্তু সে কথা
বিশেষ প্রচার পায়নি, ফলে হ্যারিয়েট ব্রুক্স অপরিচিতই রয়ে গিয়েছেন। তিনি অন্য কয়েকটি
গুরুত্বপূর্ণ কাজও করেছিলেন কিন্তু কৃতিত্ব পান নি। রেডনের আবিষ্কারে পিয়ের ও মেরি
কুরি, রাদারফোর্ড, আওয়েন্স, ব্রুক্স এবং সডি – সকলেরই অবদান আছে।
অবদান যাঁর
বিশেষ নেই তাঁর নামই কিন্তু রসায়নের প্রামাণিক বইতে সাধারণত রেডনের আবিষ্কর্তা
হিসাবে থাকে -- তিনি জার্মান রসায়নবিদ ফ্রিয়েডরিশ আর্ন্স্ট ডর্ন। ডর্ন শুধুমাত্র
রাদারফোর্ডরা থোরিয়ামে যে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন, তা রেডিয়ামের উপরে
করেছিলেন। কুরিরা রেডিয়ামে এই ধরনের কাজ আগেই করেছিলেন। ডর্ন কোনো নতুন মৌলের কথা
বলেনও নি। তাঁর গবেষণাপত্রটি একটি অপেক্ষাকৃত অপরিচিত গবেষণাপত্রিকাতে প্রকাশিত
হয়েছিল, ফলে সেটি বিশেষ কেউ পড়ার সুযোগ পান নি। পরের এক সুপরিচিত প্রবন্ধে নতুন
মৌলের প্রস্তাবকের কথা লিখতে গিয়ে ভুলক্রমে রাদারফোর্ডদের পরিবর্তে ডর্নের গবেষণাপত্রটিকে
উল্লেখ করা হয়েছিল। ডর্নের মূল লেখাটি না পাওয়ায় পরবর্তীকালে প্রায় সবাই ওই
প্রবন্ধটি অনুসরণ করে ডর্নকেই রেডন আবিষ্কারের সম্মান দিয়েছেন। হিসাব করে দেখা
গেছে ইন্টারনেটে নব্বই শতাংশ জায়গায় ডর্নকেই রেডনের আবিষ্কর্তা বলা হয়েছে।
আমাদের আলোচনার
চতুর্থ মৌলটির নাম হল প্রোট্যাক্টিনিয়াম (Pa)। এটিও তেজস্ক্রিয়। 1913 সালে জার্মানির
কার্লসরুহেতে পোলিশ বিজ্ঞানী কাসিমির ফাইয়ান্স ও জার্মান বিজ্ঞানী অসওয়াল্ড
গোয়েরিং ইউরেনিয়ামের ক্ষয় হয়ে যে সমস্ত
নতুন মৌল তৈরি হয়, তার মধ্যে প্রোট্যাক্টিনিয়ামের সন্ধান পান, তখনো অবশ্য এই নাম
দেওয়া হয়নি।। তাঁদের আবিষ্কৃত মৌলটির ভরসংখ্যা ছিল 234, এর অর্ধায়ু কাল এক মিনিটের সামান্য বেশি। এত ক্ষণস্থায়ী মৌল নিয়ে গবেষণা করা
তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। লাতিন ভাষায় ব্রেভিস অর্থে স্বল্পস্থায়ী, তার থেকে তাঁরা
এর নাম দিয়েছিলেন ব্রেভিয়াম। কিন্তু এ আদৌ মৌল কিনা তা পরীক্ষা না করে নিশ্চিত
হওয়া যায় না।
সেই কাজটাই
করেন পাঁচ বছর পরে জার্মানির বার্লিনে অটো হান ও লিজা মাইটনার। নিউক্লিয় বিভাজন বা
ফিশন বিক্রিয়া বিষয়ে তাঁদের গবেষণার কথা সকলের জানা। হিটলারের ইহুদিবিদ্বেষের
কারণে মাইটনারকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, ফলে নোবেল পুরস্কার থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন।
এ বিষয়ে অটো হানের ভূমিকাও ভালো ছিল না, কিন্তু সে পরবর্তীকালের কথা। মাইটনার
ছিলেন আর এক জন মহিলা বিজ্ঞানী যিনি নিউক্লিয় বিজ্ঞানের প্রথম যুগে গবেষণা শুরু
করেছিলেন।
লিজা মাইটনার
হান ও মাইটনার
পিচব্লেন্ডচূর্ণে উত্তপ্ত ঘন নাইট্রিক অ্যাসিড দিয়ে রেডিয়াম ও অন্যান্য জানা তেজস্ক্রিয়
পদার্থকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। পড়ে থাকা অধঃক্ষেপ থেকে যে আলফা বিকিরণ বেরিয়েছিল, তার ভেদনক্ষমতা
মেপে তাঁরা নিশ্চিত হন যে এক নতুন মৌলের সন্ধান তাঁরা পেয়েছেন। এটা ছিল প্রোট্যাক্টিনিয়ামের
অন্য আইসোটোপ যার ভরসংখ্যা 231। এর
অর্ধায়ুকাল হল প্রায় তেত্রিশ হাজার বছর, ফলে মৌলের রাসয়ানিক ধর্ম নির্ধারণ করা
সম্ভব হয়েছিল। দেখা গেল তা
ট্যান্টালাম মৌলের অনুরূপ। নতুন মৌলটি আলফা ক্ষয়ের মাধ্যমে অ্যাক্টিনিয়াম মৌল তৈরি করে বলে তার নাম হল
প্রোট্যাক্টিনিয়াম। ফাইয়ান্সও এই নামকরণে সায় দেন। প্রায় একই সময়ে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে সডি ও তাঁর সহযোগী
জন ক্র্যানস্টন প্রোট্যাক্টিনিয়ামের
চিহ্ন খুঁজে পেয়েছিলেন। পর্যায়সারণিতে পারমাণবিক
সংখ্যা 91-এর ঘরটা শূন্য ছিল। মেন্দেলিয়েভ
বলেছিলেন ওইখানে যে মৌল বরবে তার ধর্ম হতে হবে ট্যান্টালাম মৌলের খুব
কাছাকাছি, প্রোট্যাক্টিনিয়ামই সেই
শূন্যস্থান পূরণ করল।
এর পরে যে
মৌলিক পদার্থের কথা আসবে, তা তেজস্ক্রিয় নয়। তার আগে বলতে হয় মোসলের সূত্রের কথা।
কোনো মৌলিক পদার্থকে যথেষ্ট উত্তেজিত করলে তার থেকে এক্স রশ্মি নির্গত হয়। 1913-14
সালে ব্রিটেনে হেনরি মোসলে দেখান যে সেই এক্স রশ্মির কম্পাঙ্কের বর্গমূল হল মৌলটির
পারমাণবিক সংখ্যার সমানুপাতী। এর ফলে মৌল চেনার কাজ খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল। পর্যায়সারণিতে
75 পারমাণবিক সংখ্যার ঘরটা শূন্য ছিল,
মেন্দেলিয়েভ বলেছিলেন তার ধর্ম হবে ম্যাঙ্গানিজের মতো। 1925 সালে বার্লিনে
ওয়াল্টার নড্যাক, ইডা টাকে ও অটো বার্গ প্লাটিনামের আকরিক ও কলম্বাইট নামের এক
খনিজের মধ্যে মৌলটিকে আবিষ্কার করেছিলেন। রাইন নদীর নামে তাঁরা তার নাম দিয়েছিলেন
রেনিয়াম (Re)। নড্যাক ও টাকে কলম্বাইট থেকে চেনা মৌলগুলি রাসয়ানিকভাবে সরিয়ে দিয়ে
রেনিয়ামের ঘনত্বকে এক লক্ষ গুণ পর্যন্ত বাড়াতে সক্ষম হন। বার্গ এক্স রশ্মির
বর্ণালীতে মোসলের সূত্র প্রয়োগ করে রেনিয়ামের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছিলেন। ইডা নুরেমবার্গে
জার্মান রসায়ন ক্লাবের সামনে এই মৌল আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন, সেই প্রথম কোনো
মহিলা সেই ক্লাবে বক্তৃতা দেন। পরবর্তীকালে ইডা ও ওয়াল্টার বিবাহসূত্রে আবদ্ধ
হয়েছিলেন। ইডা অবশ্য গবেষণা বন্ধ করেননি। তিন বছর পরিশ্রম করে নড্যাক দম্পতি
বিশুদ্ধ রেনিয়াম ধাতুকেও পৃথক করতে সক্ষম হন। একই সঙ্গে তাঁরা 43 পারমাণবিক
সংখ্যার মৌলটি আবিষ্কারের ঘোষণা করেছিলেন। পর্যায়সারণিতে এর জায়গা ঠিক ম্যাঙ্গানিজ
ও রেনিয়ামের মাঝখানে, এর রাসয়ানিক ধর্মও হওয়া উচিত তাদেরই মতো। তবে নড্যাকদের দাবী
সঠিক ছিল না, কারণ ঐ মৌলটি আসলে তেজস্ক্রিয়, পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে তাকে পাওয়া
যায় না।
একমাত্র যে
মৌলটি কোনো মহিলা বিজ্ঞানী একক ভাবে আবিষ্কার করেছেন, তা হল ফ্রান্সিয়াম (Fr)। 1930-এর
দশকের শেষদিকে ইউরেনিয়ামের থেকে হালকা মৌলদের মধ্যে দুটি মাত্র অনাবিষ্কৃত ছিল,
যাদের পারমাণবিক সংখ্যা 43 ও 87। তাই তাদের খোঁজার নানা চেষ্টা চলছিল। অনেকেই দাবী
করেছিলেন যে তাঁরা সফল হয়েছেন, কিন্তু তাঁদের দাবী প্রমাণ হয়নি। মাদাম কুরির এক
সময়কার ছাত্রী মার্গারিট পেরেই প্যারির কুরি ইনস্টিটিউটে প্রথম 87 পারমাণবিক
সংখ্যার মৌলটির সন্ধান পান। তিনি অ্যাক্টিনিয়াম-227 আইসোটোপ নিয়ে কাজ শুরু
করেছিলেন। অ্যাক্টিনিয়াম বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে থোরিয়াম-227 আইসটোপে পরিবর্তিত হয়ে
যায়, এই কথাই জানা ছিল। পেরেই দেখালেন যে মাত্র এক শতাংশ ক্ষেত্রে অ্যাক্টিনিয়াম-227
ফ্রান্সিয়াম-223 আইসটোপে রূপান্তরিত হয়। এর অর্ধায়ু কাল বাইশ মিনিট, তারপর বিটা
ক্ষয়ের মাধ্যমে এর থেকে রেডিয়াম-223 সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে থোরিয়াম-227 আবার আলফা ক্ষয়ের
মাধ্যমে রেডিয়াম-223 সৃষ্টি করে। দেখা যাচ্ছে দুই ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত
অ্যাক্টিনিয়াম-227 থেকে রেডিয়াম-223 পাওয়া যাচ্ছে। এসের মধ্যে ফ্রান্সিয়ামের পথ
ধরছে মাত্র এক শতাংশ অ্যাক্টিনিয়াম নিউক্লিয়াস, তাই ফ্রান্সিয়াম অন্যদের চোখ এড়িয়ে
গিয়েছিল। পেরেই নিজের জন্মভূমির নামে মৌলটির নাম দেন। ফ্রান্সিয়ামই প্রাকৃতিক
পদার্থের মধ্যে আবিষ্কৃত শেষ মৌল।
মার্গারিট পেরেই
আমরা যে সময়ের
কথা বলছি সে যুগে মহিলা বিজ্ঞানীদের কাজ করার পরিসর ছিল যথেষ্ট কম। মেরি কুরি
দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন ব্যক্তিগত প্রয়াসে, এমনকি নোবেল পুরস্কারও তাঁর জন্য
অধ্যাপনার সুযোগ এনে দিতে পারেনি। দুর্ঘটনাতে পিয়েরের মৃত্যুর পরেই একমাত্র তাঁর
জায়গায় মেরিকে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়া হয়। হ্যারিয়েট ব্রুক্সের সামনে
কোনো সুযোগই আসেনি, বিয়ের পরে তিনি সমস্ত গবেষণা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন।
বার্লিনের কেমিস্ট্রি ইনস্টিটিউটের প্রধান মাইটনারকে প্রবেশাধিকার দিতে রাজি ছিলেন
না, কারণ মেয়েদের লম্বা চুলে আগুন ধরে যেতে পারে। ইডাই প্রথম নিউক্লিয় বিভাজন
বিক্রিয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি প্রায় সারাজীবন চাকরি পাননি,
স্বামীর গবেষণাগারে অতিথি হিসাবে কাজ করেছিলেন -- তাই অন্যান্য বিজ্ঞানীরা তাঁর
মতামতকে গুরুত্ব দেননি। এত সমস্যার মধ্যে কাজ করেই এই মহিলারা তাঁদের নাম
বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন।
প্রকাশঃ জ্ঞান ও বিজ্ঞান, শারদীয় ২০১৯, পরিমার্জিত
No comments:
Post a Comment