Wednesday 3 January 2024

শ্ব

 

শ্ব

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

জুরি, ওঠ!’

দুটো মাত্র শব্দ শুনতে পেলাম। তারপরেই প্রচণ্ড গর্জনের পর গর্জন। এই আওয়াজ দূর থেকে শুনেছি, তাতেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যেত । গিরিমা বলেছিল এ খাঁড়াদাঁতির ডাক। একটা খাঁড়াদাঁতি নাকি চারটে মানুষের মতো বড় হয়। তার থেকেও বড় কথা হল তারা অনেকসময় দল বেঁধে শিকার করে। ম্যামথ আমি দেখেছি, ঠিক যেন একটা ছোট পাহাড়। একদল খাঁড়াদাঁতি নাকি একটা ম্যামথকেও মেরে ফেলতে পারে।

গর্জনটা কোন দিক থেকে আসছে? ডান দিক থেকে? মা আমার হাত ধরে টানছে। ‘জুরি, লুটাকে ডাক। ওর হাত ধর।’ আমার পাশেই বোন ঘুমচ্ছিল, আমি ধাক্কা মেরে ওকে তুললাম। ডান হাত দিয়ে শক্ত করে ওর ছোট্ট বাঁ হাতটা ধরলাম। আমাদের দুজনেরই চোখে ঘুম আছে। খাঁড়াদাঁতির গর্জনের সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে আমাদের দলের লোকদের চিৎকার। শিকারিদের দু’একজন বল্লম নিয়ে আমাদের পাশ দিয়েই দৌড়ে গেল। একজনের হাতে মশাল, সব জন্তুই আগুনকে ভয় পায়। আরও কয়েকজন এদিক ওদিক দৌড়চ্ছে, বাচ্চাগুলো ভয় পেয়ে কাঁদছে। লুটা কিন্তু কাঁদে নি, আমার সাহসী বোন লুটা! মা আমাদের প্রায় টানতে টানতে উল্টো দিকে নিয়ে চলল। কেউ একজন মনে হয় মাঝখানের আগুনটাতে আরও কাঠ দিল, দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। পিছনে তাকানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছু দেখতে পেলাম না। হঠাৎ একটা খুব জোর আর্তনাদ। মানুষের গলা। মা আরও জোরে দৌড়তে লাগল।

মা, লুটা আর জোরে দৌড়তে পারছে না।’

পারতেই হবে। জন্তু যদি একটার বেশি থাকে? এদিকে চলে আসে?’ মা হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তর দিল। ‘শক্ত করে ওর হাতটা ধরে থাক।’

একটু এগোতেই গাছের আড়ালে আগুনটা ঢাকা পড়ে গেল। সামনে কী আছে দেখতে পাচ্ছি না, একটা মশালও যদি থাকত! আমাদের দলের আজকের ডেরার পাশেই একটা নদীটা আছে, আমরা সেই দিকেই দৌড়চ্ছি। পিছনে ঝুপঝাপ শব্দ। বড় কোনো জন্তু? নাকি মানুষ? খাঁড়াদাঁতি না হয়ে নেকড়ের দল হলে লুটা আর আমি গাছে উঠে পড়তাম। কিন্তু গিরিমা বলেছিল খাঁড়াদাঁতি গাছেও উঠতে পারে। ঠিকই আমরা যদি সরু ডালে চলে যাই, খাঁড়াদাঁতি সেখানে যেতে পারবে না। কিন্তু চড়তে গেলে সময় লাগবে, তার আগেই আমাদের ধরে নেবে।

দৌড়তে দৌড়তে হঠাৎ আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। বুঝতে পারিনি কখন নদীর খাতের ধারে এসে পড়েছি। মায়ের হাত ছেড়ে গেল, লুটার হাত কিন্তু ছাড়িনি। মা চিৎকার করে উঠল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দুজনে হুড়মুড় করে পড়ে গেলাম। গড়াতে গড়াতে সোজা নদীতে। গা হাত পা ছড়ে গেলো, তবে রক্ষা এই যে হাড় ভাঙেনি। জলটা বেশ ঠাণ্ডা। আর কী স্রোত। পাহাড়ের ওপরে নিশ্চয় বৃষ্টি হয়েছিল।

লুটা হাত ছাড়িস না। বাঁ দিকে যাওয়ার চেষ্টা কর।’

বললাম বটে, কিন্তু নিজেই পেরে উঠছি না। এক হাত দিয়ে সাঁতার কাটতে অসুবিধা হচ্ছে, কিন্তু লুটার হাত ছাড়ব কেমন করে? এত টান যে ভেসে থাকার বেশি কিছু করতে পারছিলাম না, নদীর স্রোত দুজনকে টেনে নিয়ে চলল। ভাগ্যিস এখানে নদীটার মধ্যে কোনো বড় পাথর নেই। না হলে অন্ধকারে ধাক্কা লেগে হাড়গোড় ভেঙে যেত। মনে মনে বললাম, ‘নদীর দেবতা, লুটা আর আমাকে বাঁচিয়ে দাও।’ যে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে নদীটা, আমরা সেটাকে টপকাতে যাচ্ছিলাম। ওর ওদিকে আমাদের দলের শীতের আস্তানা। দেবতা আমাদের উল্টোদিকে কোথায় নিয়ে চলল? মায়েদের খুঁজে পাব কেমন করে?

আর কতক্ষণ ভেসে থাকতে পারব? লুটা আর পারছে না, আমি ওকে ভাসিয়ে রেখেছি। আমারও হাত অবশ হয়ে আসছে। কিন্তু কিছুতেই তীরের দিকে যেতে পারছি না। অনেকক্ষণ পরে স্রোতটা একটু কমল। আস্তে আস্তে সাঁতার কেটে দুজনে নদীর বাঁদিকের তীরে গিয়ে উঠলাম।

কত দূরে চলে এসেছি কে জানে। এত ক্লান্ত, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। লুটাকে বললাম নদী দেবতাকে নমস্কার করতে, তার আশীর্বাদে দুজনের কারোরই সেরকম আঘাত লাগেনি। একটা উঁচু টিলার উপর উঠে দুজনে বসলাম কিছুক্ষণ। পরনের ছাল খুলে মেলে দিলাম, গা মুছলাম গাছের পাতা দিয়ে। ভাগ্যিস শীতকাল চলে গেছে, না হলে একেবারে জমে যেতাম।

জুরি, এখন আমরা কী করব?’ লুটা জিজ্ঞাসা করে।

দাঁড়া, আলো ফুটুক। ততক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিই। কেউ না কেউ নিশ্চয় খুঁজতে আসবে। ‘

কোথায় খুঁজবে?’

কেন, নদীর ধার ধরে আসবে?’

মনে আছে, পরশুদিন যাওয়ার সময়ে দেখেছিলাম একটা নদী দুটো হয়ে গেছে। স্রোত আমাদের তার কোনটায় নিয়ে এসেছে কে জানে। কোন দিকে আমাদের খুঁজবে?’

তাহলে আমরাই ওদের খুঁজতে বেরব। কিন্তু এখন নয়। সকালবেলা।’

এখন রাত কত? আকাশের দিকে তাকালাম। চাঁদ নেই। ভাল্লুক মাথার উপরে, তার মানে সকাল হতে দেরি আছে। ভাল্লুকের লেজের তারাটা যখন ঐ দূরের পাহাড়ের মাথায় আসবে, তখন সূর্যদেবতার ঘুম থেকে ওঠার সময় হবে। ‘লুটা, রাত্রিবেলা মাটিতে থাকব না। চল, ওই গাছটায় উঠি। একটু ঘুমিয়ে নে, আমি জেগে আছি। সকাল হলেই বেরিয়ে পড়ব।’ সকাল না হলে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলা নিরাপদ নয়। কত রকমের জন্তু শিকার ধরতে বেরোয়। এই জঙ্গল যে খাঁড়াদাঁতিদের ডেরা, তা তো জানতামই না।

গাছটার নিচের একটা বড় চওড়া ডালের উপর উঠে একটা লতা দিয়ে নিজেদের বেঁধে ফেললাম। এভাবে কতবার গাছে রাত কাটিয়েছি আমরা; নিশ্চিন্তে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়ল লুটা। আমি জেগে ছিলাম কিছুক্ষণ, তারপরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।

আলো ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেল, লুটাকে ডেকে তুললাম। দুজনে গাছ থেকে নেমে চামড়াগুলো গায়ে জড়িয়ে নিলাম, অনেকটা শুকিয়ে গেছে। কাল ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার সময় কয়েক জায়গায় কেটে ছড়ে গিয়েছিল, সেগুলো থেকে আর রক্ত পড়ছে না। তবু গিরিমার চিনিয়ে দেওয়া একটা গাছ খুঁজে তার কয়েকটা পাতা হাত দিয়ে পিষে দুজনের কাটা জায়গাগুলোতে লাগিয়ে নিলাম। গিরিমা বলেছিল তা না হলে ওই কাটার জায়গা দিয়ে পিশাচ আমাদের রক্তে ঢুকে পড়বে।

ঐ বড় গাছটায় উঠতে পারবি? দেখ তো গিরিমার তাঁবুটা দেখতে পাস কিনা।’ গিরিমার অনেক বয়স, ঠাণ্ডা লাগে। তাই তার জন্য একটা তাঁবু সব জায়গায় খাটানো হয়। মা বলেছিল তাঁবুর ম্যামথের চামড়াটা গিরিমাকে তার মা দিয়েছিল। তাকে দিয়েছিল তার মা, সে একা শুধু একটা বর্শা দিয়ে ম্যামথটাকে মেরেছিল। আমাদের দলের সকলেই সেই মায়ের থেকে জন্মেছি। ওই চামড়াটাতে জাদু আছে। যতদিন ওই চামড়াটা আমাদের দলের সঙ্গে থাকবে, ততদিন আমরা জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা হারাব না। গতকাল আমরা একটা উঁচু টিলার উপরে ছিলাম। দূর থেকে সব টিলাই একরকম দেখতে, কিন্তু যদি অনেক দূরে না চলে আসি, তাহলে গাছ থেকে তাঁবুটা দেখতে পাওয়া যেতে পারে।

লুটা আমার থেকে অনেক হালকা, সহজেই গাছের মগডালে পৌঁছে গেল। কতকগুলো পাখি ঝটপট করে আপত্তি জানিয়েছিল, কিন্তু সাহস করে লুটার কাছে আসেনি। নিচ থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দেখতে পাচ্ছিস?’

না।’

দক্ষিণ দিকটা ভালো করে দেখ।’ নদীর স্রোত দক্ষিণ থেকে উত্তরে বইছে, সেই স্রোতই আমাদের টেনে এখানে এনে ফেলেছে।

অনেক চেষ্টা করেও লুটা টিলাটা খুঁজে পেল না। মনে হচ্ছে অনেক দূরে চলে এসেছি। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘নদীটা কোথা দিয়ে গিয়েছে বুঝতে পারছিস? নিচে পর্যন্ত দেখতে না পেলেও দেখবি জঙ্গলের মধ্যে ফাঁক থাকবে।’

হ্যাঁ, অনেকটা দূরে এক জায়গায় একটা নদী দুটো হয়ে গেছে। আমরা দুটো নদীর মাঝখানে আছি।’

দক্ষিণ দিকে মুখ করে দাঁড়ালে এই নদীটা আমাদের বাঁ হাতে। তার মানে নদীর দেবতা কাল আমাদের পূর্বদিকের নদীটা দিয়ে এনেছে। আমাদের আস্তানাটা নদীর পশ্চিম তীরে, তাই পশ্চিম দিকের নদীটা আমাদের পেরোতেই হবে। এখন তাহলে সেই নদী পর্যন্ত যেতে হবে। দেবতাকে মনে মনে বললাম, পশ্চিমের নদীটাতে তো নিয়ে যেতে পারতে? পূর্বদিকের নদীটা আমাদের কাছে, কিন্তু সেটা টপকে কোনো লাভ নেই।

পশ্চিমের নদীটাকে কোথা দিয়ে পার হওয়া সহজ হবে দেখতে পাচ্ছিস?’

উঁচু গাছগুলোর জন্য নদীর খাত দেখা যাচ্ছে না, কাছে গিয়েই পেরোনোর জায়গা খুঁজে নিতে হবে। খিদে পেয়েছে, তবে তা সহ্য করার অভ্যাস আমাদের আছে। আগে রওনা হই, নিশ্চয় রাস্তায় খাওয়ার মতো দু একটা ফল পাওয়া যাবে। ছোটখাটো জন্তুও শিকার করা যেতে পারে। লুটা যতক্ষণ গাছে চড়ে দেখার চেষ্টা করছিল, আমি একটা মোটামুটি সোজা শক্ত দেখে গাছের ডাল জোগাড় করলাম। আমার কোমরে সবসময়েই কয়েকটা পাথরের ফলা বাঁধা থাকে, তার থেকে একটা নিয়ে ডালটার মাথায় লতা দিয়ে শক্ত করে বাঁধলাম। একটা বল্লম হল। খাঁড়াদাঁতির মুখোমুখি হলে নিশ্চয় উপকারে আসবে না, কিন্তু ছোটখাটো জন্তুর জন্য কাজে লাগবে।

লুটা নেমে এলো, দেখি মুখে একগাল হাসি। ‘জুরি, গাছের উপরে কী পেয়েছি দেখ।’ কোমরের ঝুলি থেকে চারটে বড়ো বড়ো ডিম বার করল। ও, নামার সময় একটা পাখি খুব চেঁচাচ্ছিল, সেটা এই জন্য। ‘তুই দুটো, আমি দুটো।’ বোনের নিশ্চয় আমার থেকেও বেশি খিদে পেয়েছে। কিন্তু একা একা আগে খেয়ে নেয়নি, আমার জন্যও নিয়ে এসেছে।

ডিমগুলো কোন পাখির জানি না, ফাটিয়ে খেয়ে নিলাম। নদীর থেকে আঁজলা ভরে খেলাম জল। তারপর নদীটা আমাদের পিছনে রেখে একটু তেরচা করে রওনা হলাম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাছ আর ঝোপঝাড়ের জন্য সোজা যাওয়ার উপায় নেই, সারাক্ষণ সূর্যদেবতার দিকে খেয়াল করে চলার দিক ঠিক করতে হচ্ছে।

এই জঙ্গলে কখনো কোনো মানুষের পা পড়েছে কি? ছোটখাটো জন্তু অনেক চোখে পড়ল; কিন্তু বল্লমের নাগালের মধ্যে একটাও এলো না। তাড়া করলেই ঝোপের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। মাথার উপরে গাছে গাছে একদল বাঁদর কিছুক্ষণ আমাদের সঙ্গে চলল, হুপ হাপ করে নিজেদের মধ্যে কথা বলল, তারপরে আবার অন্যদিকে চলে গেল। দু একটা চেনা ফলের গাছ চোখে পড়েছিল। কিন্তু শীত সবে গেছে, এখনো ফল পাকে নি।

সূর্য মাথার উপরে এলো। এই সময় দিক ঠিক করা শক্ত। আমরাও ক্লান্ত। তাই কিছুক্ষণ একটা গাছের তলায় বসে রইলাম।

জুরি, আর কতদূর রে?’

দাঁড়া, আগে নদীর ধারে পৌঁছোই। তারপর সেটাকে পেরোতে হবে। চল আবার হাঁটা লাগাই।’

খিদে পেয়ে গেছে, দুটো ডিমে আর কতক্ষণ চলে? লুটা আরও দু’তিনবার গাছে উঠে আমরা ঠিক দিকে যাচ্ছিলাম কিনা দেখার চেষ্টা করেছিল। তখন কয়েকটা পাখির বাসায় উঁকি মেরেছিল, কিন্তু আর ডিম পায়নি। বাঁদরগুলো যেদিকে গেছে সে দিকে গেলে হয়তো ফল কিছু পাওয়া যেত। কিন্তু আমাদের যেতে হবে অন্য দিকে। বিকেল হয়ে এসেছে। এদিকটায় গাছপালা একটু কম; হঠাৎ মাঝে দেখি অনেকটা ফাঁকা জায়গা। লুটা নিঃশব্দে আমার হাতটা চেপে ধরল।

আমিও দেখেছি। অনেকগুলো খরগোশ বেরিয়েছে। এখনো আমাদের দেখতে পায়নি, কিন্তু কাছে গেলেই পালাবে। তবে আগেও খরগোশ শিকার করেছি আমরা দুজনেই। নিঃশব্দে কোমরের ঝুলি থেকে পাথর বার করলাম। আমি ইশারা করে লুটাকে দেখালাম আমি কোনটাকে তাক করছি। দুজনে একসঙ্গে পাথর ছুঁড়লাম। ভুল হয়নি, দুটো খরগোশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, বাকিগুলো সঙ্গে সঙ্গে গর্তে ঢুকে গেল। তাড়াতাড়ি করে গিয়ে খরগোশদুটোর গলা ধারালো ফলা দিয়ে কেটে ফেললাম। পাথরগুলোও কুড়িয়ে নিলাম, অনেক কষ্ট করে ঘষে ঘষে সেগুলোকে ধারালো করতে হয়েছে।

সন্ধে হয়ে এসেছে, আজ আর বেশিদূর যাওয়া যাবে না। একটু এগিয়ে একটা বড় গাছ পেলাম যার উপরে রাত কাটানো যায়। দুজনে মিলে তার সামনে একটু খালি জায়গাতে শুকনো পাতা আর কাঠকুটো জোগাড় করা গেল, তারপর কোমর থেকে চকমকি পাথর বার করে ঘষলাম। শুকনো পাতার স্তুপে ফুলকি পড়ে আগুন ধরিয়ে দিল। ফুঁ দিয়ে দিয়ে আগুনটাকে বাড়িয়ে তুললাম। খরগোশ দুটোকে টুকরো টুকরো করে কাটলাম। কাঠির মধ্যে গেঁথে আগুনে ঝলসাতে শুরু করলাম। সারাদিন খাইনি, গন্ধে জিভে জল এসে গেল। আদ্ধেক টুকরো পোড়ানো হতেই দুজনে বসে গেলাম, বাকিটা কালকের জন্য রাখা।

কাল সকালেই নদীর কাছে পৌঁছে যাব তো?’ লুটাকে বললাম। উত্তর দিল না, জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রইল। লুটার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি অন্ধকারের মধ্যে দুটো চোখ জ্বলছে। মাটি থেকে বেশি উঁচুতে নয়, আমার কোমরের মতোই হবে। বল্লমটা শক্ত করে ধরলাম ডানহাতে। লুটাকে ইঙ্গিতে বললাম গাছটার কাছে যেতে, দরকার হলেই যাতে চড়ে পড়তে পারে।

জন্তুটা আস্তে আস্তে বাইরের দিকে আসছে, কিন্তু হাঁটাটা কেমন যেন, খুব স্বাভাবিক নয়। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল একটা ছোট নেকড়ে। একেবারে বাচ্চা নয়, তবে আমি এর থেকে অনেক বড় নেকড়ে দেখেছি। কিন্তু নেকড়ে তো কখনো একা আসে না, দল বেঁধে শিকার করে। একা বল্লম দিয়ে এক দল নেকড়ের সঙ্গেই লড়াই করার প্রশ্নই ওঠে না। আমি লুটাকে বললাম, ‘গাছে উঠে পড়। আমি তোর পিছন পিছন যাচ্ছি।’ নেকড়ে অন্তত গাছে উঠতে পারবে না।

না রে জুরি, এই নেকড়েটা একাই আছে। মনে হয় ওর কিছু হয়েছে, ওর সঙ্গীরা ওকে ফেলে চলে গেছে। দেখলি না, হাঁটাটা কেমন? একবারও দাঁত বার করে নি, গরগর করেনি।’ আমি কিছু বলার আগেই একটা কাঁচা মাংসের টুকরো নেকড়েটার দিকে ছুঁড়ে দিল লুটা।

টুকরোটা গিয়ে পড়ল নেকড়েটার থেকে কিছুটা দূরে। আমাদের থেকে চোখ সরিয়ে নেকড়েটা মাংসটার দিকে তাকাল, তারপর সেটার কাছে গেল। পিছনের একটা পা ঠিকমতো ফেলছে না, নির্ঘাত ভেঙে গেছে। গোটা টুকরোটা একসঙ্গে মুখে নিয়ে চিবিয়ে খেল জন্তুটা, তারপরে আমাদের দিকে তাকাল। যেন বলছে ‘আরও দাও।’

জুরি, আর একটু মাংস ওকে দেব? অনেকদিন খায়নি মনে হচ্ছে, শিকার ধরতে পারেনি। হাড়পাঁজরা বেরিয়ে গেছে।’ শিকারি জন্তুদের পা ভাঙা মানে তাকে না খেয়ে মরতেই হবে, শিকার ধরার উপায় নেই।

মাংস দিবি কিরে? কাল আমাদের কী জুটবে? এখন কতদিন এরকম চলবে কে জানে?’

সে খাবার আবার জোগাড় হয়ে যাবে। ফল পাব, ডিম খুঁজে নেব, আবার খরগোশ কি ধেড়ে ইঁদুর মেরে নেওয়া যাবে। দিই না, বেচারি কী রকম করে তাকিয়ে আছে দেখ।’

লুটার মাথায় যখন কিছু একটা ঢোকে তখন ও তা করে ছাড়বেই। সেটা জানি বলেই আর বাধা দিলাম না। তবে বল্লমটা নিয়ে সতর্ক থাকলাম। কয়েকটা টুকরো নিয়ে নেকড়েটাকে দূর থেকে ছুঁড়ে দিল লুটা। নেকড়েটা সেগুলো সবগুলো খেয়ে নিলো। তারপর লুটা আর দিচ্ছে না দেখে আবার খোঁড়াতে খোঁড়াতে জঙ্গলে ঢুকে গেল।

হয়েছে তো? এবার গাছে চড়ে পড়।’ এবার রাত কাটানোর পালা। আগুনটা মাটি চাপা দিয়ে নিভিয়ে দিলাম। বাকি মাংসগুলো কোমরের থলিতে নিয়ে গাছে উঠে পড়লাম। নিজেদের বেঁধে নিলাম ডালের সঙ্গে। সারাদিনের ক্লান্তি, চোখ সঙ্গে সঙ্গে জুড়ে এলো।

একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখলাম আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে, ভোর হতে আর দেরি নেই। কিসের শব্দ? নিচের দিকে চোখ ফেললাম, গাছের তলার মাটিতে এখনো অন্ধকার। মনে হল একটা জন্তু মাটি শুঁকছে। অন্ধকারে দেখতে না পেলেও গায়ের গন্ধটা আমার চেনা। সর্বনাশ, এ যে ভাল্লুক। খুব বড় নয়, কিন্তু সে আরও বিপদ। ছোটো ভাল্লুক সহজেই গাছ বাইতে পারে। আমার কোমরের থলের মাংসের গন্ধ তো পাবেই, আমাদের গায়ের গন্ধও পেতে পারে। প্রথমে লুটার মুখে হাত চাপা দিলাম, যাতে আওয়াজ না করে। ও জেগে উঠতেই হাত দিয়ে নিচের দিকটা দেখালাম, তারপর ইশারায় বোঝালাম ভাল্লুক যদি গাছে উঠতে শুরু করে, তাহলেই যেন ও গাছটার একেবারে মগডালে উঠে পড়ে। অতদূর হয়তো ভাল্লুকটা যেতে পারবে না। কাল রাতে আমরা বোকার মতো একেবারে নিচের একটা ডাল বেছেছিলাম।

একটা কাজ করি। মাংসটা ছুঁড়ে ফেলে দিই, যদি ওটা পেয়ে ভাল্লুকটা চলে যায় তো বেঁচে গেলাম। হাতটা ঝুলির মধ্যে ঢুকিয়ে যে কটা টুকরো এলো বার করে দূরে ছুঁড়ে ফেললাম। আওয়াজ পেয়ে ভাল্লুকটা ঘুরে তাকাল, তারপর সেদিকে যেতে লাগল। মনে মনে বনের দেবতার কাছে বললাম, ‘ভাল্লুকটাকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দাও।’

হঠাৎ শুনি গরগর শব্দ। ভালো করে তাকিয়ে দেখি নেকড়েটা চলে যায়নি, ঐখানেই ছিল। ও নির্ঘাত ভেবেছে মাংসগুলো ওকে দিয়েছি, ভাল্লুকটা কেড়ে নিতে এসেছে। যাক গে, ও বেটারা লড়াই করে মরুক, আমরা বেঁচে যাই। তবে লড়াইতে কি হবে সে তো জানা কথা। নেকড়েটা একে খুব বড় নয়, তার উপর খোঁড়া।

শুধু আমি নই, লুটাও সেই কথা বুঝতে পেরেছিল। বারণ করার আগেই ও ওর কোমরের থলি থেকে একটা পাথর নিয়ে ভাল্লুকটাকে ছুঁড়ে মারল।

কী করছিস?’ আমি ফিসফিস করে বললাম।

আমার নেকড়েটাকে মেরে ফেলত যে, তাড়িয়ে দিচ্ছিলাম।’ লুটা উত্তর দেয়।

তোর নেকড়ে?’ এইটুকু বলার সুযোগ পেয়েছি। ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। ভাল্লুকটার গায়ে লেগেছে পাথরটা। খেপলে ভাল্লুক সাংঘাতিক। জন্তুটা ঘুরে তাকাল, গাছের উপর আমাদের দেখতে পেয়ে গেল। গাছের নিচে এসে দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। এবার গাছে উঠবে, বল্লমটা শক্ত করে ধরলাম। শিকারে আমি অনেকবার বেরিয়েছি, বল্লম চালাতে ভালোই পারি। কিন্তু একা কখনো শিকার করিনি। একটাই সুযোগ পাব।

ভাল্লুকটা গাছ বেয়ে উঠতে শুরু করেছে, বল্লমটা তাক করেছি। এমন সময় একটা অদ্ভুত কাণ্ড হল। খেয়াল করিনি যে নেকড়েটা ভাল্লুকের পিছন পিছন এসেছে। হঠাৎ সে ভাল্লুকটার পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভাল্লুকটা এক মুহূর্তের জন্য থেমে মুখ তুলে আর্তনাদ করেছে, সেই সুযোগটা পেয়ে আমি নিচু হয়ে বল্লমটা ওর গলার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। ভাল্লুকটার চিৎকার করে নিচে পড়ে গেল, আমার হাত থেকে বল্লমটা সেই ঝটকায় ওর সঙ্গেই গেল। নিচে পড়া মাত্র নেকড়ে আর ভাল্লুকে ঝটাপট শুরু হয়ে দেল। তারপর নেকড়েটা দেখি টলতে টলতে পিছিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়ল। মুখ থেকে গা থেকে রক্ত পড়ছে। ভাল্লুকটা একটু ছটফট করে স্থির হয়ে গেল। ভাল করে দেখে বুঝলাম নেকড়েটা কামড়ে ওর টুঁটি ছিঁড়ে নিয়েছে।

নেকড়েটা কি বেঁচে আছে? আমি কিছু বলার আগেই লুটা লাফ দিয়ে নামল। ‘কাছে যাস না,’ বলে চিৎকার করলাম। কিন্তু পাত্তা না দিয়ে মেয়েটা সোজা নেকড়েটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাধ্য হয়ে আমিও গাছ থেকে নামলাম। ভাল্লুকটার বুকে পা রেখে বল্লমটা টেনে বার করলাম। তারপর লুটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সকাল হয়ে গেছে। আলোতে দেখলাম নেকড়েটার বুকের কাছে এক জায়গা গভীর আর লম্বা হয়ে কেতে গেছে, নির্ঘাত ভাল্লুকের নখের আঁচড়। আমাদের দুজনকে দেখতে পেয়ে নেকড়েটা দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না, আবার চোখ বুজে শুয়ে পড়ল।

জুরি, কিছু একটা কর। রক্ত বন্ধ করতে হবে। গিরিমার দেখানো কোনো একটা গাছের পাতা নিয়ে আয়।’

লাগাব কী করে? ওর গায়ে হাত দিতে গেলে তো কামড়ে দেবে।’

না দেবে না। দেখবি?’ কিছু বোঝার আগেই লুটা নিচু হয়ে নেকড়েটার পিঠে হাত দিল। জন্তুটা চোখ খুলে লুটাকে দেখে আবার চোখ বন্ধ করল।

তুই ওখান থেকে সরে আয়, আমি দেখছি।’ কাছেই সেরকম একটা লতা পাওয়া গেল, তার পাতা বেটে বুকের কাটাটার উপর লাগিয়ে দিল লুটা। আমার কোনো বারণই শুনল না। ওর কথাতে বাধ্য হয়ে আমি নেকড়েটার ভাঙা পায়ের সঙ্গে একটা লাঠি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলাম। এই কায়দাটাও গিরিমা আমাকে দেখিয়েছিল, হাত পা ভাঙলে কাজে লাগে। কিন্তু সে যে নেকড়ের উপর আমাকে প্রথম ব্যবহার করতে হবে তা কে জানত? যা হোক, নেকড়েটা সব সহ্য করল।

মরা ভাল্লুকটার গা থেকে অনেকটা মাংস কেটে নিলাম। লুটা আর আমি মিলে কিছুটা পুড়িয়ে খেলাম, বাকিটা সঙ্গে নিয়ে যাব। নেকড়েটা দেখি ইতিমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমি ভেবেছিলাম যে প্রথমেই নিজের পায়ের বাঁধনটা কামড়ে ছিঁড়ে ফেলবে। সেরকম কিছু না করে আমাদের কাছে এসে দাঁড়াল।

দেখেছিস? ও বুঝতে পেরেছে আমরা ওর ভালো করেছি।’ এক টুকরো মাংস ছুঁড়ে দিয়ে লুটা বলল।

কিংবা সহজে খাবার জোগাড়ের উপায় খুঁজে পেয়েছে।’ বললাম বটে, কিন্তু মনে মনে ভাবলাম লুটাই ঠিক বলেছে। ইচ্ছে করলে ও তো নিজেই মরা ভাল্লুকটার থেকে মাংস ছিঁড়ে নিতে পারত।

লুটা আরও কয়েকটা টুকরো ছুঁড়ে দিল। তারপর দুজনে উঠে দাঁড়ালাম। আবার রওনা হতে হবে। যতটা পারি মাংস থলিতে ভরলাম। বাকিটা শকুনে কি হায়নতে খাবে। লুটা আবার একটা গাছে উঠল। নেমে এসে বলল নদীটা কাছেই, একটু পরে পৌঁছে যাব।

এই জায়গাটা একটু উচুনিচু, আস্তে আস্তে হাঁটতে হচ্ছে। হঠাৎ ফিরে দেখি, নেকড়েটা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আসছে। লুটা বলল, ‘আসুক না, কোনো ক্ষতি তো করছে না।’ চাইলেও বা তাড়াব কেমন করে, তাই আমি আর কিছু বললাম না। নেকড়েটা দেখলাম বেশ সাহস পেয়ে গেছে, প্রায়ই লুটার খুব কাছাকাছি চলে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরে আমিও আর ওর দিকে খেয়াল রাখছিলাম না।

একটা আওয়াজ কানে আসছিল। যত এগোচ্ছি, তত বাড়ছে। মেঘের ডাকের মতো, কিন্তু আকাশে তো মেঘ নেই। তাছাড়া মেঘের ডাক এরকম টানা হয় নাকি? শেষকালে জঙ্গল থেকে বেরিয়েই দুজনে দাঁড়িয়ে গেলাম।

আমাদের সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা, তারপরেই নদী। বাঁদিকের জমিটা একটু উঁচু, একটা বড় গাছের থেকেও অনেক বেশি। নদীটা তার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ছে। আমি আগে একবার এইরকম দেখেছিলাম, একে বলে জলপ্রপাত। জলের ছিটে চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তার উপর আলো পড়ে কতরকম রঙ বেরিয়েছে। লুটা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল।

আমার কিন্তু গা শিউরে উঠল। সেদিন রাত্রিবেলা যখন নদীর স্রোত আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, এদিকেও নিয়ে আসতে পারত। ওই উপর থেকে পড়লে বাঁচতাম না। নদীর দেবতা আমার প্রার্থনা শুনেছিল, তাই আমাদের অন্যদিকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আর আমি কিনা ভাবছিলাম দেবতা পশ্চিমদিকের নদীটায় কেন আনেনি! আবার দেবতাকে প্রণাম করলাম।

নদীটার কাছে গেলাম। আমাদের ওপারে যেতে হবে, কিন্তু এখান দিয়ে পেরোনোর উপায় নেই। ভীষণ স্রোত। লুটা দেখি জলপ্রপাতের দিকে গেছে। সব থেকে মজার ব্যাপারটা হল একদম নদী যেখানে লাফিয়ে পড়েছে, বোকা নেকড়েটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে -- যেন ওখান দিয়ে ও নদী পেরোবে।

আমি লুটার কাছে গেলাম, বললাম, ‘এখান দিয়ে তো পার হওয়া যাবে না, চল আরও একটু উজানে যাই। এই উঁচুটার উপরে গেলে নিশ্চয় স্রোত কম এমন জায়গা পাব।’ কিন্তু এখান দিয়ে উপরে ওঠার কোনো উপায় নেই, আবার জঙ্গলে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে রাস্তা বার করতে হবে।

দাঁড়া না একটু, জায়গাটা ভারি সুন্দর,’ লুটা বলল।

আমি আশপাশটা দেখছি। এমন সময় হঠাৎ একটু দূরের জঙ্গল দুলে উঠল। তারপর বেরিয়ে এলো একটা বড়সড় জন্তু।

আমি আগে কখনো দেখিনি, কিন্তু চিনতে ভুল হল না। চারপায়ে দাঁড়িয়েই মাথাটা প্রায় আমার সমান উঁচু। ছাই রঙ, তার উপরে কালো আর হলুদ ছোপ ছোপ। কিন্তু যেটা সবার আগে চোখে পড়ে তা হল উপরের চোয়াল থেকে দুপাশে দুটো দাঁত বাঁকা হয়ে নিচের দিকে বেরিয়ে এসেছে। আগেও বলেছি যে এই প্রাণীটার কথা গিরিমার কাছে অনেক শুনেছি, এ হল সেই খাঁড়াদাঁতি যার জন্য আমাদের দুজনের আজ এই অবস্থা।

আমি হাত বাড়িয়ে লুটার হাতটা চেপে ধরে জন্তুটাকে দেখালাম। আমাদের এখনো দেখতে পায়নি। দুজনে একদম নড়াচড়া না করে দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখতে পেলে পালানোর কোনো উপায় নেই। একটা বল্লম দিয়ে এর সঙ্গে লড়াই করার প্রশ্নই ওঠে না। নেকড়েটাও নিশ্চয় ভয় পেয়ে গেছে। খাঁড়াদাঁতিকে ভয় পায় না জঙ্গলে এমন কে আছে? একটাই ভরসা, জলপ্রপাতের জন্য আমাদের কোনো আওয়াজ শুনতে পাবে না জন্তুটা।

আমি জানতাম খাঁড়াদাঁতি দিনে সাধারণত বেরোয় না। এ মনে হয় সারা রাত শিকারের পরে নদীতে জল খেতে এসেছে। হে বনের দেবতা, জন্তুটা যেন আমাদের দেখতে না পায়।

কিন্তু দেবতা আমার কথা শুনল না। ভয়ঙ্কর জন্তুটা নদীর কাছে এসে মাথা নামাল, জল খাচ্ছে। তারপরে ঘুরে ফেরত যাচ্ছে, হঠাৎ আমাদের দিকে চোখ পড়ল। কয়েক পা এগিয়ে এলো, যেন বুঝতে চাইছে এ আবার কোন নতুন জানোয়ার। আমি আর লুটা পায়ে পায়ে পিছিয়ে যাচ্ছি।

আর পিছানোর জায়গা নেই। জন্তুটা তেড়ে এলে নদীতে লাফ দেব, তাতে যা হয় হোক। যদিও এখনে এমন স্রোত যে বাঁচার আশা কম। নদীর দেবতা, আমাদের রক্ষা কোরো। জন্তুটা আরও এগিয়ে এলো। গায়ের গন্ধটা নাকে এসে লাগল। বিরাট এক হাঁ করল, মুখে দু’সারি ধারালো দাঁত। লুটা আমার হাত ধরে টানছে। আমি খাঁড়াদাঁতির থেকে চোখ সরাতে পারছি না।

লুটা হেঁচকা মেরে টানল, বাধ্য হয়ে ওর দিকে তাকালাম। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে চিৎকার করে বলল, ‘জলের পিছনে লুকোনোর জায়গা আছে। নেকড়ে সেখানেই গেছে।’

একবার বাঁদিকে তাকালাম। প্রপাতের পিছনে দাঁড়াবার জায়গা আছে? জলের ছিটের জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আবার খাঁড়াদাঁতির দিকে ফিরলাম। গুঁড়ি মেরে বসেছে, লেজটা এপাশ ওপাশ করছে। এবার লাফ দেবে। লুটা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল প্রপাতের পিছন দিকে।

জলের ছিটের জন্য কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। পা দিয়ে বুঝতে হল পাথর কিছুটা বেরিয়ে আছে। মাথার উপরে পাহাড়টা একটু এগিয়ে আছে, নদীটা সেখান থেকে লাফ দিয়ে নামছে। তার জলের পিছনে একটুখানি পা রাখার মতো জায়গা, কোনো রকমে একজন হাঁটা যায়, কিন্তু প্রচণ্ড পিছল আর অন্ধকার। দুজনে হাত ধরে এগোচ্ছি, পা ফসকালেই আর রক্ষা নেই। ভিজে যাচ্ছি, কিন্তু এই রাস্তায় খাঁড়াদাঁতি আমাদের পিছু নিতে পারবে না এটা নিশ্চিত। শিকার ফসকে যেতে খাঁড়াদাঁতিটা নিশ্চয় হতাশ হয়েছে, এমন জোরে গর্জন করল যে প্রপাতের শব্দের উপরেও শুনতে পেলাম।

ফেরার প্রশ্নই ওঠে না। তাই দাঁড়াব না, দেখি কতদূর যেতে পারি। এগোতে এগোতে একসময় দেখলাম উপরের জলের স্রোত কমে এসেছে। অবশেষে প্রপাতের পিছন থেকে বেরিয়ে এলাম। নদীটা টপকে ফেললাম! ওপারে তাকিয়ে দেখলাম জন্তুটা জঙ্গলে ঢুকে গেল। আমার কথা বনের দেবতা না শুনলেও নদীর দেবতা তুমি শুনেছ, প্রণাম তোমাকে।

লুটা বলল, ‘দেখলি, আমার নেকড়েটা আবার বাঁচিয়ে দিল।’ সত্যিই তাই। নদী পেরোনোর এই রাস্তাটা নেকড়েটা জানত, আমরা কোনোদিনই খুঁজে পেতাম না। দেখি সে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে, যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

আবার রওনা দিলাম, এবারও নেকড়ে আমাদের সঙ্গী। এবার নদীর ধার ধরেই যাচ্ছি, রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত সহজ। দুপুর হতে এক জায়গায় বিশ্রাম নিলাম। আবার খানিকটা মাংস শেষ করলাম, লুটাও নেকড়েকে খাওয়াল।

কিছুটা গিয়ে চোখে পড়ল একটা মাঠ, তার পাশে একটা বটগাছ। এই জায়গাটা আমাদের চেনা। তিনদিন আগেই আমরা এইখান দিয়ে গিয়েছিলাম। দুজনেই মনে জোর পেলাম, যাক অন্তত ঠিক পথে যাচ্ছি। আর বেশি দূর নেই।

কিছু চিন্তা মাথায় এলেও লুটাকে বলিনি। খাঁড়াদাঁতির আক্রমণে আমাদের দলের অবস্থা কী হয়েছে জানি না। আমরা যখন পালাচ্ছিলাম, তখন আমাদের পিছনে আওয়াজ শুনেছিলাম। সেটা আর একটা খাঁড়াদাঁতি ছিল কি! মা কি পালাতে পেরেছিল? হয়তো আমাদের খোঁজার চেষ্টাই কেউ করেনি। কিংবা খুঁজে না পেয়ে হয়তো হাল ছেড়ে দিয়েছে। হয়তো খাঁড়াদাঁতির ভয়ে সবাই এই আস্তানা ছেড়ে চলে গেছে। তাহলে আমরা কী করব? রাস্তা চিনে ওদের পিছুপিছু গিয়ে ধরতে পারব? দলের সঙ্গে থাকলে যে সব বিপদের সহজেই মোকাবিলা করা যায়, দুজনে তার কটা সামলাতে পারব? তার মধ্যে লুটা তো নেহাতই ছোট। এই সব নানা কথা মাথাতে আনাগোনা করছিল। লুটা অবশ্য তার নতুন বন্ধুকে নিয়ে ব্যস্ত। তাকে কত কথা বলে যাচ্ছে। নেকড়ে আর মানুষের যে এরকম সম্পর্ক হতে পারে তা কে জানত?

সন্ধে হয়ে এসেছে। আমাদের পুরানো আস্তানার জায়গাটা কতটা দূর বুঝতে পারছি না। অন্ধকারের মধ্যে আরও হাঁটব নাকি সকালের জন্য অপেক্ষা করব সে কথা ভাবছি। এমন সময় হঠাৎ লুটা বলল, ‘দেখ দেখ, শ্ব কেমন করছে।’ এর মধ্যে নেকড়েটা নামও দিয়েছে লুটা -- শ্ব। কথাটার কোনো মানে নেই। আমি জিজ্ঞাসা করাতে লুটা বলেছিল ইচ্ছা হয়েছে, তাই ওই নাম।

তাকিয়ে দেখি নেকড়েটার ঘাড়ের লোম সব খাড়া হয়ে গেছে, দাঁত বার করেছে। হঠাৎ গরগর করতে শুরু করল। নিশ্চয় সামনে কোনো বিপদ টের পেয়েছে। আমরা দুজনই দাঁড়িয়ে গেলাম, আবার কোন জন্তু কে জানে?

হঠাৎ একটা গলা এলো, ‘জুরি, লুটা, তোরা নেকড়েটার থেকে সরে যা, তোদের জন্য নেকড়েটাকে তাক করতে পারছি না।’ এ তো সুমারুর গলা। আমাদের দলে তীরধনুকে ওর মতো ভালো তাক কারো নেই। যাক, দলের লোকদের তাহলে খুঁজে পাওয়া গেছে, ওরা এখনো আমাদের ফেলে চলে যায়নি। এত আনন্দ হল যে বলার নয়।

লুটার কিন্তু ঠিক উলটো। ও হঠাৎ করে নেকড়ের গলাটা জড়িয়ে ধরল। চেঁচিয়ে বলল, ‘শ্ব কারোর কোনো ক্ষতি করবে না, ওকে মেরো না।’

লুটা কী করছিস? ওটা নেকড়ে, এক কামড়ে তোর টুঁটি ছিঁড়ে নিতে পারে।’ সামনের একটা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো সুমারু। ধনুকে তীর লাগানো, নেকড়েটার দিকে তাক করা। সেও আবার গোঁ গোঁ আওয়াজ করতে শুরু করল।

আমি বললাম, ‘না সুমারু, ও আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। কাল থেকে আমাদের সঙ্গে আছে।’

সুমারু ধনুক নামাল, ‘এমন আশ্চর্য কাণ্ড না দেখলে বিশ্বাস হত না। লুটা নেকড়েটার গলা জড়িয়ে আছে, ও কিছু করছে না। আমি দু দিন ধরে তোদের খুঁজছি, অন্য দু একজনও বেরিয়েছে। আজকের মধ্যে না পেলে আমরা কালই চলে যেতাম। আর দেরি করা যাবে না, খাঁড়াদাঁতি আবার আসতে পারে। সেদিন তাড়িয়ে দেওয়া গেছে বটে, কিন্তু আমাদের কিরিচ মরে গেছে। আরও দু একজন শিকারির কম বেশি চোট লেগেছে।’

আমি খুব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আর মা?’

তোর মাকেই তো বোঝানো যাচ্ছে না। খালি বলছে ওর দোষেই নাকি ছেলেমেয়েদুটো নদীতে ভেসে গেল। আমরা চলে গেলেও ও একাই অপেক্ষা করবে তোদের জন্য।’

লুটা কিছুতেই নেকড়েটার কাছ থেকে নড়ছিল না; সে আবার সুমারুর কাছে যাচ্ছে না। শেষে বাধ্য হয়ে সুমারু ও আমি এগিয়ে গেলাম, লুটা আর নেকড়ে পিছন পিছন চলল। বেশি দূর ছিল না। সন্ধে হওয়ার একটু পরেই পৌঁছে গেলাম। সুমারু সঙ্গে ছিল, তাই আমার আর একদম ভয় করছিল না।

মা আমাদের দেখতে পেয়ে এসে জড়িয়ে ধরল। নেকড়েটা কিছুতেই অন্যদের কাছে আসতে রাজি হয় নি, কিন্তু চলেও যায়নি। আগুনের ধারে বসে গত দুদিনের গল্প আমি যখন বলছিলাম, এই প্রথম দলের সবাই আমার কথা শুনতে সেখানে জড়ো হয়েছিল। ছিল না শুধু লুটা, সে আগুন থেকে অনেক দূরে শ্বয়ের গলা জড়িয়ে বসেছিল।

No comments:

Post a Comment