প্রয়াত হলেন এম এস স্বামীনাথন
ভারতের সবুজ বিপ্লবের রূপকার
বিজ্ঞানী এম এস স্বামীনাথন গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুর সময়
তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। তাঁর জন্ম হয়েছিল বর্তমান তামিলনাড়ুর কুম্ভকোনমে
১৯২৫ সালের ৭ অগস্ট। ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হওয়ার, কিন্তু ১৯৪৩ সালের বাংলার
দুর্ভিক্ষ তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে এয়। এই দুর্ভিক্ষে তিরিশ লক্ষ লোক মারা
গিয়েছিল। ভারতের খাদ্য সমস্যা মেটানোর দিশা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি
কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি
করার পরে দিল্লির ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট (আইএআরআই)
থেকে জেনেটিক্স ও উদ্ভিদপ্রজনবিদ্যা নিয়ে এমএসসি করেন। স্বল্পকাল ইউনেস্কো
বৃত্তি নিয়ে হল্যান্ডে গবেষণার পরে তিনি কেমব্রিজ থেকে ডক্টরেট করেন।
আমেরিকার উইন্সকন্সিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পনেরো মাস গবেষণার পরে সেখানে
অধ্যাপনার সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে ১৯৫৪ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কয়েক মাস
পরে তিনি আইএআরআইতে চাকরি পান।
স্বাধীনতার আগেই ভারতে ফলন ছিল
জনসংখ্যার অনুপাতে কম। ব্রহ্মদেশ, পুর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাঞ্জাবের মতো
উর্বর অঞ্চল ভারত থেকে আলাদা হওয়ার পরে সমস্যা আরো বাড়ে। অন্যদিকে
স্বাধীনতার পরে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটতে থাকে; কৃষি কোনোভাবেই তার
সঙ্গে তাল রেখে উঠতে পারছিল না। ফলে ভারতকে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি
করতে হত। বয়স্কদের হয়তো আমেরিকার পিএল ৪৮০ গমের কথা মনে আছে, সেই গমের
গুণমান ছিল অত্যন্ত খারাপ, এবুং সেই সাহায্যের পরিবর্তে আমেরিকার শর্ত মেনে
নিতে হত। স্বামীনাথনের মতো তরুণ বিজ্ঞানীরা এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটান।
মার্কিন কৃষিবিজ্ঞানী নর্মান বোরলাগের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গবেষণা করে
স্বামীনাথন মেক্সিকোর বামন প্রজাতির গম ও জাপানি গমের মিলন ঘটিয়ে ভারতে
চাষের উপযোগী নতুন এক ধরনের গমের জন্ম দেন। পরে এক সাক্ষাৎকারে স্বামীনাথন
বলেছিলেন মহেঞ্জোদড়োর যুগ থেকে চারহাজার বছরের ইতিহাসে যে ফলন হত, ১৯৬৪
থেকে ১৯৬৮ এই চার বছরেই তাকে দ্বিগুণ করা সম্ভব হয়েছিল। চাষীদেরও সেই উচ্চ
ফলনশীল শস্য ব্যবহারে সম্মত করার পরে ১৯৬৮ সালে গমের ফলন আগের বছরের তুলনায়
তিরিশ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পায়। বোরল্যাগ শুধু ভারত নয়, এশিয়ার অনেক
দেশকেই উচ্চফলনশীল শস্য গবেষণাতে সাহায্য করেছিলেন; সেই অবদানের
স্বীকৃতিতে ১৯৭০ সালে তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।
বোরল্যাগ তার ঠিক আগে স্বামীনাথনকে লিখেছিলেন যে সবুজ বিপ্লবের কৃতিত্ব
ভারত সরকারের অফিসারদের, বিজ্ঞানীদের, নানা সংস্থার ও চাষীদের; কিন্তু
মেক্সিকোর বামন প্রজাতির গমের গুরুত্ব স্বামীনাথনই বুঝতে পেরেছিলেন। তা না
হলে হয়তো এশিয়াতে সবুজ বিপ্লব সম্ভব হতো না। যে কোনো রকম বিপ্লবের মতো
সবুজ বিপ্লবেরও নিঃসন্দেহে ভালো ও খারাপ দুই দিকই আছে, তা নিয়ে আলোচনার
পরিসর ভিন্ন। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে ভারতকে খাদ্যে স্বনির্ভর করার
পিছনে আছে সবুজ বিপ্লব।
স্বামীনাথনের সভাপতিত্বে ন্যাশনাল কমিশন অন
ফার্মারস শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে উৎপাদন খরচের দেড়গুণ রাখার সুপারিশ
করেছিল। সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনের এই প্রধান দাবি কেন্দ্রীয় সরকার মেনে
নিলেও এখনো রূপায়িত করেনি। তিনি পরিবেশ রক্ষা করে কৃষির জন্য সচেষ্ট ছিলেন।
স্বামীনাথন ১৯৭২ থেকে ১৯৮০ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চের
অধিকর্তা ছিলেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ তিনি ছিলেন ফিলিপাইন্সের ইন্টারন্যাশনাল
রাইস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অধিকর্তা। চিন, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা, পাকিস্তান,
কেনিয়া সহ বহু দেশের কৃষি গবেষণাতে তিনি সাহায্য করেছিলেন।
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজের প্রথম প্রাপক স্বামীনাথন, সেই অর্থে গড়ে তুলেছিলেন
স্বামীনাথন রিসার্চ ফাউন্ডেশন। আলবার্ট আইনস্টাইন পুরস্কার, ম্যাগসেসে
পুরস্কার, পদ্ম বিভূষণ সহ বহু সম্মান তিনি পেয়েছেন। ২০০৭ সাল থেকে তিনি ছ'
বছর রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য ছিলেন। টাইমস পত্রিকার বিচারে বিংশ শতাব্দীর সব
থেকে প্রভাবশালী কুড়ি জন এশীয়ের তালিকাতে তিন ভারতীয়ের একজন ছিলেন
স্বামীনাথন, অন্য দুজন গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ।
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
সৃষ্টির একুশ শতক পত্রিকার নভেম্বর ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত
সুন্দর । অনেক টা জানানোর জন্য।
ReplyDelete