Saturday 2 December 2023

জ্যোতির্বিজ্ঞান ও উনিশ শতকের কয়েকজন মহিলা বিজ্ঞানী


জ্যোতির্বিজ্ঞান ও উনিশ শতকের কয়েকজন মহিলা বিজ্ঞানী

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


আধুনিক বিজ্ঞানের প্রথম যুগ নারীদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল। সমাজের বাধা অতিক্রম করে বিজ্ঞানের অঙ্গনে প্রবেশ করতে তাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম জ্যোতির্বিদ্যার থেকে, নানা বাধা পেরিয়ে সেই বিজ্ঞানেও কয়েকজন মহিলা অবদান রেখে গেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সব থেকে পুরানো সংগঠন হল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি অফ লন্ডন। ১৮২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সোসাইটি ১৮৩১ সালে নাম পরিবর্তন করে হয় রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি। কিন্তু ১৯১৫ সালের আগে মহিলারা এই সোসাইটির সদস্য হতে পারতেন না। তবে সাম্মানিক সদস্য হওয়ার সুযোগ ছিল, কয়েকজন নারী সেই সম্মান পেয়েছিলেন। এই লেখাতে আমরা তাঁদের মধ্যে চারজনের কথা সংক্ষেপে শুনব।

১৮৩৫ সালে প্রথম দুই মহিলাকে সোসাইটির সাম্মানিক সদস্য করা হয়, তাঁরা হলেন ক্যারোলাইন লুক্রেশিয়া হার্শেল ও মেরি সমারভিল। ক্যারোলাইন হার্শেলের তাঁর জন্ম ১৭৫০ সালে জার্মানির হ্যানোভারে। তাঁর দাদা বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেল। ইউরেনাস গ্রহের আবিষ্কার, তারাদের সাপেক্ষে সূর্যের প্রকৃত গতি, আমাদের ছায়াপথের প্রথম মডেল, শ্বেত বামন নক্ষত্র, যুগ্ম নক্ষত্র উইলিয়ামের আবিষ্কারের তালিকা শেষ হবে না। সেই সময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেলের অনেক আবিষ্কারের সময় তাঁকে সাহায্য করেছিলেন ক্যারোলাইন। 

ক্যারোলাইন হার্শেল

 

উইলিয়ামের প্রথম জীবন বেশ কষ্টে কেটেছিল। তিনি জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডে চলে আসেন। জ্যোতির্বিদ্যা ছিল তাঁর শখ। তাঁকে বাড়ির কাজে সাহায্যের জন্য ক্যারোলাইন ইংল্যান্ডে আসেন। ক্যারোলাইন বাড়িতে পড়াশোনার বিশেষ সুযোগ পাননি। দশ বছর বয়সে টাইফাস রোগের জন্য তাঁর বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাঁর উচ্চতা ছিল মাত্র চার ফুট তিন ইঞ্চি। হার্শেল তাঁকে নিজের কাজের সহকারী করে নিয়েছিলেন; সে যুগের সেরা দূরবিনগুলি তাঁর হাতেই তৈরি। ক্যারোলাইন তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। ইউরেনাস আবিষ্কারের পর উইলিয়ামের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, রাজার অনুগ্রহে একজন সহকারী রাখার অর্থও মঞ্জুর হয়।

তখনো ফটোগ্রাফি আবিষ্কার হয়নি, ক্যারোলাইন উইলিয়ামের পর্যবেক্ষণ লিখে রাখতেন। সেই সমস্ত পর্যবেক্ষণ সুশৃঙ্খলভাবে প্রকাশের উপযোগী করতেন। নিজে পর্যবেক্ষণ করতেন, এবং অঙ্ক কষে জ্যোতিষ্কের অবস্থান ও কক্ষপথও নির্ণয় করতেন। তাই দাদা বোনকেই সহকারী বেছে নেন। ক্যারোলাইন হলেন প্রথম পেশাদার মহিলা জ্যোতির্বিদ, এবং ইংল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথম বেতনভুক মহিলা সরকারী কর্মচারী। উইলিয়ামের জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষণের রেকর্ড প্রকাশের উপযোগী করেন ক্যারোলাইন। ১৭৯৮ সালে রয়্যাল সোসাইটির গবেষণাপত্রিকা ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে সেই তালিকাতে তাঁর নামও লেখক হিসাবে আছে। তিনিই প্রথম মহিলা যাঁর গবেষণা ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল। তিনি রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির প্রথম মহিলা স্বর্ণপদক বিজয়ী এবং তার প্রথম দুজন সাম্মানিক মহিলা সদস্যের একজন। উইলিয়ামের ছেলে জন তাঁর সময়ের অন্যতম সেরা জ্যোতির্বিদ ছিলেন, ক্যারোলাইন ও জন চিঠিপত্রে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে আলোচনা করতেন।

উইলিয়ামকে যখন সাহায্য করতে হত না, ক্যারোলাইন নিজে তখন একটি ছোট দূরবিন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন। ধূমকেতু খোঁজার জন্য সেটি উইলিয়াম ক্যারোলাইনের জন্যই বানিয়েছিলেন। ১৭৮৩ সালে তিনি তিনটি নীহারিকা খুঁজে পেয়েছিলেন। ১৭৮৬ থেকে ১৭৯৭ সালের মধ্যে আটটি ধূমকেতু ক্যারোলাইন আবিষ্কার করেছিলেন। প্রথম আবিষ্কারের দিনটা ছিল ১ আগস্ট, ১৭৮৬। সেটি নিঃসন্দেহে পুরোপুরি ক্যারোলাইনের একার কৃতিত্ব, দাদা সেই সময় সেখানে ছিলেন না।

হার্শেলদের আকাশ পর্যবেক্ষণ নিরুপদ্রব ছিল না। উত্তর ইউরোপের শীতে সারা রাত বাইরে কাটানোর মূল্য হিসবে নিউমোনিয়া ছিল খুব স্বাভাবিক ঘটনা। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে নিউমোনিয়া ছিল প্রাণঘাতী রোগ। একবার অন্ধকারে বরফে ঢাকা মাঠের উপর দিয়ে দৌড়োতে গিয়ে এক লোহার গজাল ক্যারোলাইনের পায়ে ঢুকে গিয়েছিল। অনেক দিন তাঁকে বিছানাতে কাটাতে হয়েছিল। কিন্তু নিজের আঘাত নয়, ক্যারোলাইন চিন্তিত ছিলেন তাঁর দুর্ঘটনার ফলে উইলিয়ামের আকাশ পর্যবেক্ষণে কতটা অসুবিধা হবে তাই নিয়ে। তিনি সবসময়েই বিশ্বাস করতেন যে উইলিয়ামই আসল, তাঁর নিজের কাজটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়।

উইলিয়ামের মৃত্যুর পরে ক্যারোলাইন জার্মানি ফিরে যান। সেখানে তিনি উইলিয়ামের রেকর্ড থেকে আড়াই হাজার নীহারিকার এক তালিকা বানিয়েছিলেন। তাঁর তৈরি করা জ্যোতিষ্কের তালিকাগুলি এখনো আকাশ পর্যবেক্ষণে ব্যবহার হয়। বিশেষ করে জার্মানিতে প্রকাশিত তালিকাটির উপর ভিত্তি করে পরের নিউ গ্যালাকটিক ক্যাটালগ (NGC) তৈরি হয়েছিল। এখনো আকাশে অনেক আলোকউৎসকে NGC সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। তাঁর ছিয়ানব্বই বছর বয়সে প্রুশিয়ার সম্রাট তাঁকে এক স্বর্ণপদকে ভূষিত করেন। তাঁর আবিষ্কৃত ধূমকেতুগুলি ছাড়াও একটি গ্রহাণু, চাঁদের বুকে একটি গহ্বর, দুটি নক্ষত্রমণ্ডল ও একটি কৃত্রিম উপগ্রহের নাম তাঁর নামে দেওয়া হয়েছে।

মেরি সমারভিল ছিলেন রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির প্রথম দুই সাম্মানিক নারী সদস্যের অপরজন। তাঁর জন্ম ১৭৮০ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্কটল্যান্ডে। তাঁর বাবা উইলিয়াম ফেয়ারফ্যাক্স ছিলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ভাইস অ্যাডমিরাল। ক্যারোলিনের সঙ্গে মেরির একটা পার্থক্য ছিল, তিনি একাই গবেষণা করেছিলেন। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত, বই পড়ে তিনি বীজগণিত, জ্যামিতি, ক্যালকুলাস, গতিবিদ্যা ইত্যাদি শিখেছিলেন। নিউটনের বিখ্যাত বই 'প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা' তিনি পড়েছিলেন। ক্যালকুলাসের কিছু সমস্যার সমাধান করে তিনি ছদ্মনামে প্রকাশ করেছিলেন। পিয়ের-সিমোঁ লাপ্লাসের লেখা গ্রহনক্ষত্রদের গতিবিধি ও মাধ্যাকর্ষণ সংক্রান্ত বিখ্যাত বইটি তিনি ফরাসি থেকে ইংরাজিতে অনুবাদ করেছিলেন, বহুদিন সেটি ইংল্যান্ডে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে ব্যবহার হত। 

মেরি সমারভিল

 

মেরির প্রথমবার বিয়ে হয় ১৮০৪ সালে তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয় স্যামসন গ্রেগের সঙ্গে। তাঁরা লন্ডনে থাকতেন। কিন্তু তাঁর স্বামী মেয়েদের বিদ্যাচর্চার প্রয়োজন আছে মনে করতেন না। ১৮০৭ সালে স্যামসনের মৃত্যু হলে মেরি স্কটল্যান্ডে ফিরে যান। ১৮১২ সালে তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ হয় অপর এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় ডাক্তার উইলিয়াম সমারভিলের সঙ্গে। ইউলিয়াম মেরিকে পড়াশোনা ও গবেষণা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। সূর্যালোকের বেগুলি রশ্মির চৌম্বক ধর্ম বিষয়ে তাঁর গবেষণা প্রবন্ধ ১৮২৬ সালে ফিলোজফিকাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল, সেটিই এই পত্রিকাতে প্রকাশিত কোনো মহিলার একক লেখা প্রথম প্রবন্ধ। ইউরেনাসের তার গতিবিধি ব্যাখ্যা করার জন্য আরো দূরের একটি গ্রহের কথা যাঁরা প্রথম বলেছিলেন, মেরি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

জ্যোতির্বিদ্যা ছাড়াও অনেক বিষয়ে তাঁর উৎসাহ ছিল। বেশ কয়েকটি বই লিখেছিলেন মেরি সমারভিল। ১৮৩১ সালে তাঁর লেখা প্রথম বই দি মেকানিজম অফ দি হেভেন্‌স' প্রকাশিত হয়। তিন বছর পরে প্রকাশিত হয় অন দি কানেকশন অফ দি ফিজিক্যাল সায়েন্সেস। বইটির পনের হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল; জার্মান ও ইতালিয়ান ভাষাতে অনূদিত হয়েছিল। ডারউইনের অরিজিন অফ স্পিসিস প্রকাশের আগে বিজ্ঞান বিষয়ক কোনো ইংরাজি বই এত সংখ্যায় বিক্রির নজির নেই। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত হয় 'ফিজিক্যাল জিওগ্রাফি’, ইংরাজি ভাষায় এই বিষয়ের প্রথম বই। ১৮৬৯ সালে ঊননব্বই বছর বয়সে প্রকাশিত হয় 'মলিকিউলার এন্ড মাইক্রোস্কোপিক সায়েন্স’, বইটি লিখতে তিনি সময় নিয়েছিলেন দশ বছর। ১৮৭২ সালের ২৯ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। তার পরের বছর প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনী 'পার্সোনাল রিকালেকশনস'। সে যুগের অনেক বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল ও নিয়মিত চিঠি বিনিময় হত। তাঁর নামে একটি গ্রহাণু, চাঁদের বুকে একটি গহ্বর ও একটি কৃত্রিম উপগ্রহের নাম রাখা হয়েছে। ২০১৭ সালে জনগণের ভোটে ব্যাঙ্ক অফ স্কটল্যান্ডের নতুন দশ পাউন্ডের নোটে তাঁর ছবি ছাপার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১৯০৩ সালে সোসাইটি মার্গারেট লিন্ডসে হাগিন্স ও অ্যাগনেস মেরি ক্লার্ককে সাম্মানিক সদস্যপদ দেয়। মার্গারেট লিন্ডসে হাগিন্সের জন্ম ১৮৪৮ সালে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে। তাঁর বাবা জন মারে ছিলেন উকিল। মার্গারেটের মা হেলেন লিন্ডসে মারা যাওয়ার জন আবার বিয়ে করেন। সেই সময় থেকে জনের বাবা রবার্ট ছিলেন মার্গারেটের সঙ্গী। রবার্ট ছিলেন শৌখিন জ্যোতির্বিদ, তিনি মার্গারেটের মনে এই বিষয়ে আগ্রহ জাগিয়েছিলেন। মার্গারেট জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে নানা বইপত্র পড়ে নিজে নিজে শিখতেন। ১৮৭৩ সালে একটি প্রবন্ধে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম হাগিন্সের তৈরি একটি বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্রের কথা পড়ে নিজেই একটি বর্ণালীবীক্ষণ তৈরি করেন। এক যন্ত্রনির্মাতার মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে উইলিয়াম হাগিন্সের আলাপ হয়, ১৮৭৫ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। দুজনে একসঙ্গে কাজ শুরু করেন। 

মার্গারেট লিন্ডসে হাগিন্স

 

উইলিয়াম সবসময়েই তাঁদের গবেষণাকে দুজনের যৌথ কাজ বলতেন। মার্গারেটের দায়িত্ব ছিল দূরবিনের মাধ্যমে নক্ষত্রটিকে দেখা, তারপর দুজনে মিলে তার বর্ণালীর ফটোগ্রাফ তুলতেন। সেই সময় ফটোগ্রাফির অনেক উন্নতি হয়েছিলেন,। মার্গারেট ও উইলিয়াম প্রথম জ্যোতির্বিদ্যাতে সেই নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ করেন। তাঁরা অভিজিৎ নক্ষত্রের হাইড্রোজেনের বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ১৮৮৯ সালে মার্গারেটের নাম প্রথম কোনো গবেষণাপত্রিকাতে লেখক হিসাবে প্রকাশিত হয়; সেটির বিষয় ছিল গ্রহের বর্ণালী পর্যবেক্ষণ। অন্য অনেক নক্ষত্র ও নীহারিকার বর্ণালী তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। নীহারিকের বর্ণালীতে তাঁরা অনেক অচেনা চিহ্ন খুঁজে পান। প্রথমে ভাবা হয়েছিল এ কোনো অজানা মৌলের চিহ্ন, মার্গারেটের বন্ধু অ্যাগনেস মেরি ক্লার্ক সেই প্রস্তাবিত মৌলের নাম দেন নেবুলিয়াম। অনেক বছর পরে বোঝা যায় সেটি ছিল আয়নিত অক্সিজেনের বর্ণালী। ১৮৯২ সালে দেখতে পাওয়া নোভা পর্যবেক্ষকদের একদম প্রথম সারিতে ছিলেন হাগিন্স দম্পতি। তাদের পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায় যে নোভার থেকে হাইড্রোজেন গ্যাস প্রচণ্ড গতিতে বাইরের দিকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁদের যৌথ বই, 'ফটোগ্রাফিক আটলাস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ স্টেলার স্পেকট্রা'। এরপর থেকে তাঁরা পরীক্ষাগারে বর্ণালী পর্যবেক্ষণে মন দেন। তাঁরা সূর্যের বর্ণালীতে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের পরিমাণ নির্ণয়ের কাজ করেছিলেন। পরবর্তীকালে মেঘনাদ সাহার সমীকরণ তাঁদের পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা দেবে। মার্গারেট প্রাচীনযুগে জ্যোতির্বিদ্যাতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন ও এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাতে সেই বিষয়ে লিখেছিলেন। তিনি ও উইলিয়াম ১৯০৩ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়েও গবেষণা করেছিলেন। উইলিয়ামের মৃত্যু হয় ১৯১০ সালে। পাঁচ বছর পরে ১৯১৫ সালের ১৪ মার্চ মার্গারেট প্রয়াত হন।

অ্যাগনেস মেরি ক্লার্ক মুলত জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক বেশ কয়েকটি বই লেখার জন্য পরিচিত হয়েছিলেন। তাঁর বইগুলি সমকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল, পেশাদার বিজ্ঞানীদের তা সাহায্য করেছিল। অ্যাগনেসের জন্ম ১৮৪২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আয়ারল্যান্ডের কর্কে। তাঁর বাবা জন উইলিয়াম ক্লার্ক ছিলেন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। জন ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে পড়েছিলেন; অ্যাগনেসের মা ক্যাথরিনও ছিলেন উচ্চ শিক্ষিতা। তিন ছেলেমেয়েকে তাঁরা বাড়িতেই শিক্ষা দিয়েছিলেন। জনের একটি টেলিস্কোপ ছিল, অ্যাগনেস ছোটবেলা থেকেই সেটি ব্যবহার করতেন। মাত্র পনের বছর বয়সেই তিনি জ্যোতির্বিদ্যার এই ইতিহাস লেখা শুরু করেন।

অ্যাগনেসের স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। দিদি এলেন ও তিনি সেই জন্য ১৮৬৭ থেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত ইতালির ফ্লোরেন্সেই বেশি সময় কাটান। ১৮৭৭ সাল থেকে তাঁদের পরিবার লন্ডনে বাস শুরু করেন। সেই বছরেই সুপরিচিত এডিনবার রিভিউ পত্রিকাতে অ্যাগনেসের দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে একটি ছিল কোপার্নিকাসের সময়ে ইতালির জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাস। প্রবন্ধগুলি উচ্চপ্রশংসিত হয়েছিল, এরপর থেকে তিনি প্রতিবছর দুটি করে প্রবন্ধ লেখার আমন্ত্রণ পান। শেষ পর্যন্ত মোট পঁয়ত্রিশটি প্রবন্ধ তিনি এডিনবার রিভিউতে লিখেছিলেন। 

অ্যাগনেস মেরি ক্লার্ক

 

সমকালীন জ্যোতির্বিদ্যার গবেষণার সম্পর্কে লেখার জন্য বিজ্ঞানী মহলে অ্যাগনেসের পরিচিতি হয়। ১৮৮০ সালে তিনি প্রকাশ করেন 'দি কেমিস্ট্রি অফ স্টারস'। সেই প্রবন্ধকে কেন্দ্র করেই জন্ম হয় তাঁর প্রথম বইয়ের, 'এ পপুলার হিস্ট্রি অফ অ্যাস্ট্রোনমি অফ দি নাইনটিন্‌থ সেঞ্চুরি'। ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত এই বইটি পেশাদার জ্যোতির্বিদদের কাছেও অবশ্যপাঠ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর আগে এই ধরনের সমস্ত বইতে কোপার্নিকাস থেকে নিউটনের কাল পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথা লেখা হত। অ্যাগনেসের বইতে প্রথম আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার বিবরণ পাওয়া গেল। সমস্ত প্রধান ইউরোপিয় ভাষা জানতেন অ্যাগনেস, তিনি সব সময় মূল প্রবন্ধ পড়ে তবেই তার সম্পর্কে লিখতেন। বইটির চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। এমন কি প্রকাশের তিরিশ বছর পরে সুদূর ভারতবর্ষে মেঘনাদ সাহার গবেষণার প্রেরণা ছিল এই বই।

বই প্রকাশের আগে অ্যাগনেসের সংগে কোনো পেশাদার জ্যোতির্বিদের সরাসরি পরিচয় ছিল না। এর পরেই তাঁর সঙ্গে মার্গারেট হাগিন্সের পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার মানমন্দির থেকে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি তিন মাস সেখানে কাটান। সেখানে করা তাঁর পর্যবেক্ষণ মানমন্দিরে প্রকাশিত হয়। ১৮৯০ সালে তিনি তাঁর দ্বিতীয় বই দি সিস্টেম অফ দি স্টারস প্রকাশ করেন। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় বই 'প্রবলেমস ইন অ্যাস্ট্রোফিজিক্স'। ১৯০৫ সালে প্রকশিত হয় 'মডার্ন কসমোজেনিস'। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার একাদশ সংস্করণে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস এবং তিরিশ জন জ্যোতির্বিদের জীবনী লেখেন। ব্রিটেনে ১৮৮২ সালে থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে ডিকশনারি অফ ন্যাশনাল বায়োগ্রাফি সংকলন। সেখানে অন্তত ১৬৫টি প্রবন্ধ লিখেছিলেন অ্যাগনেস। ১৯০৭ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যু পর্যন্ত লিখে গেছেন অ্যাগনেস। তাঁর মৃত্যুর পরে এডিনবার রিভিউতে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা শেষ প্রবন্ধ, সেটি ছিল আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণার বিবরণ। চাঁদের বুকে একটি গহ্বরের নাম তাঁর নামে দেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি তাঁর নামে একটি পদক চালু করেছে; জ্যোতির্বিদ্যা বা ভূপদার্থবিদ্যার ইতিহাস বিষয়ে গবেষণার জন্য এই পদক দেওয়া হয়।

১৯১৫ সালের আগে আরো তিনজন মহিলাকে সোসাইটির সাম্মানিক সদস্যপদ দেওয়া হয়েছিল। জ্যোতির্বিদ্যার জন্য অর্থ সাহায্য করার জন্য অ্যানে শিপশ্যাঙ্কসকে ১৮৬২ সালে সাম্মানিক সদস্যপদ দেওয়া হয়েছছিল। তিনি কেমব্রিজ মানমন্দিরকে দশ হাজার পাউন্ড দিয়েছিলেন। সেই অর্থে কেনা দূরবিনের নাম তাঁর নামে রাখা হয়েছিল। চাঁদের বুকে একটি গহ্বরও তাঁর নাম বহন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্টের হার্ভার্ড মানমন্দিরের দুই কর্মী উইলেমিনা ফ্লেমিং ও অ্যানি জাম্প ক্যাননকেও যথাক্রমে ১৯০৭ ও ১৯১৪ সালে সাম্মানিক সদস্য পদ দেওয়া হয়েছিল। জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে দুজনেরই বিপুল অবদান আছে, এই প্রবন্ধে স্বল্পপরিসরে তার পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়। সামান্য সুযোগ পেয়েই এই নারীরা প্রতিবন্ধকতার পাহাড় জয় করতে পেরেছিলেন। সেই সমস্ত বাধা কিছুটা হলেও দূর হয়েছে সন্দেহ নেই, তার পিছনে আছে এঁদের মতো নারী বিজ্ঞানীদের অবদান। 

 

প্রকাশ জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার, শারদীয় ২০২৩  






No comments:

Post a Comment