Monday 20 November 2023

ভারতের চন্দ্র অভিযান

 

ভারতের চন্দ্র অভিযান

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

আকাশে সূর্যের পরেই সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হল চাঁদ, তাকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল চিরদিনের। চাঁদকে নিয়ে দেশবিদেশের পু্রাণে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। মহাভারতের গল্পে কুরুপাণ্ডবদের সবার চন্দ্রবংশে জন্ম, অর্থাৎ তারা চাঁদের বংশধর। অন্য এক গল্পে আবার চাঁদের জন্ম হয়েছিল সমুদ্রমন্থনে, শিব তাকে নিজের জটায় বসিয়ে নিয়েছিলেন। 1969 সালের 20 জুলাই মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল এরোনটিক্স এন্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা নাসার মহাকাশযান অ্যাপোলো-11-এর মহাকাশচারীরা চাঁদে পা দিয়েছিলেন। গ্রহ-উপগ্রহ মিলিয়ে পৃথিবীর বাইরে একমাত্র যেখানে মানুষের পা পড়েছে তা হল চাঁদ।

ভারত সহ অনেক দেশই বিভিন্ন কারণে চাঁদে অভিযানে আগ্রহী। চার বছর আগে বাহুবলী অর্থাৎ জিএসএলভি মার্ক-৩ রকেট শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়েছিল, সে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় চন্দ্রযানকে। চন্দ্রলোকে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন সংক্ষেপে ইসরোর এটি ছিল দ্বিতীয় অভিযান। এর আগে ২০০৮ সালে প্রথম চন্দ্রযানকে চাঁদের চারদিকে কক্ষপথে স্থাপন করেছিল ইসরো। পরের অভিযানের লক্ষ্য ছিল আরো সুদূরপ্রসারী। এই দ্বিতীয় চন্দ্রযানের অরবিটার এখনো মাত্র একশো কিলোমিটার উপর থেকে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করছে। চাঁদের বুকে নামার কথা ছিল অবতরণ যান বা ল্যান্ডারের। সেই বছর অর্থাৎ ২০১৯ সাল ছিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার জনক বিক্রম সরাভাইয়ের জন্মশতবর্ষ, সেই কথা মনে রেখে ল্যান্ডারটির নাম দেওয়া হয়েছিল বিক্রম। চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের পরে চারপাশে ঘুরে তথ্য সংগ্রহের জন্য ছিল সৌরশক্তিচালিত রোভার প্রজ্ঞান। এর আগে কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন চাঁদের বুকে মহাকাশযান নামাতে সক্ষম হয়েছিল।

শুরুতে উৎক্ষেপণের দিন ঠিক করা হয়েছিল ১৪ জুলাই, কিন্তু কিছু ত্রুটি ধরা পরার জন্য তা শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে করা হয় ২২ জুলাই। কিন্তু বিক্রমকে সফ্‌ট ল্যান্ডিং (পুরানো এক লেখায় পড়েছিলাম পালকের মতো অবতরণ) শেষ পর্যন্ত করানো সম্ভব হয়নি। সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখে পূর্বনির্ধারিত সূচী অনুযায়ী বিক্রমকে চন্দ্রযান থেকে বিচ্ছিন্ন করাতে বিজ্ঞানীরা সফল হয়েছিলেন, কিন্তু সে যখন চন্দ্রপৃষ্ঠের দু’কিলোমিটার উপরে তখন রকেটের নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দেয়। তিনশো তিরিশ মিটার উচ্চতায় বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই সময় তার নামার বেগ ছিল সেকেন্ডে ৫৮ মিটার, যা নিরাপদ মাত্রার উপরে। বিক্রম সম্ভবত চন্দ্রপৃষ্ঠে ৫০ মিটার প্রতি সেকেন্ড বেগ নিয়ে নেমেছিল, যা অনেকটাই বেশি। এই হার্ড ল্যান্ডিঙের পর বিক্রমের চিহ্ন অবলোহিত ক্যামেরাতে খুঁজে পাওয়া গেলেও তার সঙ্গে আর যোগাযোগ স্থাপন করা যায় নি। মূল চন্দ্রযান অবশ্য এখনো চাঁদের চারপাশে আবর্তন করছে এবং তথ্য পাঠাচ্ছে।

সফ্‌ট ল্যান্ডিং বিষয়টা মোটেই সহজ নয়। এই ঘটনার মাত্র কয়েকমাস আগে ইজরায়েলের অবতরণ যান চাঁদে নামার সময় দুর্ঘটনাতে পড়েছিল। এই বছরও রাশিয়ার লুনা-২৫ মিশনের ল্যান্ডার চাঁদের বুকে আছড়ে পড়ে। অনেক রকম সমস্যা আসতে পারে। যেমন চাঁদের খুব কাছে যখন ব্রেক করার জন্য ল্যান্ডিং রকেট চালানো হবে, তখন চাঁদের থেকে ক্ষুদ্র ধূলিকণা ছিটকে এসে রকেটের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে, সেই কথা মাথায় রেখে রকেট ডিজাইন করতে হয়। এ ধরনের নানা সমস্যার জন্য চন্দ্রযান-২ অভিযানে অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই কাজে আসে নি।

তবে বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়েন নি। সেই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েই ভারতের তৃতীয় চন্দ্র অভিযান এ বছর সফল হল। তৃতীয় চন্দ্রযানের ল্যান্ডার ও রোভারের নাম একই রাখা হয়েছিল। গত ১৪ জুলাই শ্রীহরিকোটা থেকে এলভিএম থ্রি এম ফোর রকেটে করে চন্দ্রযান--কে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। অবতরণের জন্য ২৩ আগস্ট দিনটাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল কারণ দক্ষিণ মেরুতে তখন সকালবেলা। চাঁদের বুকে দিন রাত্রি দুইই প্রায় পৃথিবীর পনের দিনের মতো দীর্ঘ। চাঁদের ঘূর্ণন অক্ষ তার সূর্যের চারপাশে আবর্তন তলের সঙ্গে প্রায় লম্বভাবে আছে, ফলে দিন রাতের দৈর্ঘ্য দক্ষিণ মেরুতেও প্রায় এক। এবার আর সমস্যা হয় নি, চাঁদের বুকে ভালো ভাবেই নেমেছিল ল্যান্ডার বিক্রম। রোভার প্রজ্ঞান তার কাজ করেছে। প্রজ্ঞান ও বিক্রম দুইই সৌরশক্তির সাহায্যে কাজ করে, ধরা হয়েছে তারা চোদ্দ দিন মতো কাজ করবে। আলো থাকার ফলে এই দুইয়েরই ক্যামেরাতে ছবি দেখা গেছে ও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে রাতের তাপমাত্রাতে কোনো যন্ত্রের পক্ষে কাজ করাও অসম্ভব। এই লেখা তৈরির সময় বিক্রম ও প্রজ্ঞান শীত ঘুমে, তা থেকে জেগে উঠে তারা আবার কাজ শুরু করল কিনা তা আপনারা এই লেখা পড়ার সময় জেনে যাবেন। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার মুকুটে এক নতুন পালক যোগ হল। এ বর্তমানে বেশ কিছু দেশের বা সংস্থার উপগ্রহ আকাশে পাঠানোর দায়িত্ব নেয় ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। তার এই সাফল্যের ফলে আর অনেকেই তার সঙ্গে যৌথভাবে কাজে আগ্রহী হবে সন্দেহ নেই।

চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে এই প্রথম কোনো যান অবতরণ করল। চাঁদে যদি জল থাকে তা দক্ষিণ মেরুতে পাওয়ার সম্ভাবনাই সব থেকে বেশি। চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই, কাজেই তরল অবস্থায় জল থাকা সম্ভব নয়, তা বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে। জল একমাত্র থাকতে পারে বরফ রূপে। আগেই বলেছি চাঁদের ঘূর্ণন অক্ষ তার আবর্তন তলের সঙ্গে লম্বভাবে আছে, ফলে দক্ষিণ মেরুতে সুর্য সবসময়েই দিগন্তের কাছে থাকে। তাই সেখানকার অনেক গভীর গহ্বরের তলাতে সূর্যের আলো কোনোদিন পৌঁছায় না। বরফ থাকার সম্ভাবনা সেই সব জায়গাতেই বেশি। জল পাওয়া গেলে তার তাৎপর্য হবে বিশাল। চাঁদে যদি কোনোদিন স্থায়ীভাবে থাকার স্টেশন তৈরি হয়, তার জন্য জল পৃথিবী থেকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে না। পান করার পাশাপাশি জলের তড়িৎবিশ্লেষণ করে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পাওয়া যাবে। অক্সিজেন নিঃশ্বাস নিতে লাগবে, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্য উদ্বায়ী খনিজও সেই গভীর গহ্বরে থাকতে পারে। দক্ষিণ মেরুই হবে সম্ভবত স্টেশন তৈরির আদর্শ জায়গা, জল পাওয়ার পাসাপাশি আরো একটা বড় সুবিধা সেখানে আছে। সেখানে কিছু কিছু পর্বতের চূড়া প্রায় সব সময়েই সূর্যালোকে আলোকিত হয়, ফলে শক্তির জন্য সৌর প্যানেল বসানোর এ এক আদর্শ অবস্থান।

প্রজ্ঞান ও বিক্রমের মধ্যে যে সমস্ত যন্ত্রপাতি আছে তা দিয়ে চাঁদের মাটিতে কী কী মৌল আছে তা বিশেষণ করা যাবে। ফলে চাঁদের উৎপত্তি সম্পর্কে আমাদের বর্তমান যে তত্ত্ব আছে তা কতটা ঠিক বা ভুল তা বিচার করা যাবে। কী ধরনের খনিজ আছে তাও জানা যাবে। এছাড়া চাঁদের বুকে ভূমিকম্প (চন্দ্রকম্প!) হয় কিনা তা দেখবে প্রজ্ঞান। আমাদের জ্ঞান অনুযায়ী চাঁদের কেন্দ্র অনেক আগে শীতল হয়ে জমাট বেঁধে গেছে, তাই সেখানে ভূমিকম্প হওয়ার কথা নয়। তবে বিজ্ঞানে তত্ত্ব নয়, প্রমাণই শেষ কথা বলে। তাই এই ধরনের জ্ঞান জরুরি। বিজ্ঞানীরা তাই প্রজ্ঞান বা বিক্রম থেকে আসা তথ্যের জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে আছেন।

এখানে একটা বিশেষ তথ্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করি। ভেবে দেখেছেন কেন চাঁদে পৌঁছাতে চন্দ্রযানের এক মাসের বেশি সময় লাগল অথচ নিল আর্মস্ট্রংরা তিন দিনে পৌঁছে গিয়েছিলেন? কারণ সেখানে ব্যবহার হয়েছিল স্যাটার্ন ভি রকেট যাতে জ্বালানি ছিল ২৬৩০ টন। এলভিএম থ্রি-র জ্বালানির পরিমাণ ৩৫০ টন, তা দিয়ে সরাসরি চাঁদে যাওয়া সম্ভব নয়। এই রকেটের আগে নাম ছিল জিএসএলভি থ্রি, চন্দ্রযান-২ তেও এরই ব্যবহার হয়েছিল। জিওসিনক্রোনাস বা ভূসমলয় কক্ষপথ পর্যন্ত ভার বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একে তৈরি করা হয়েছিল, তার উচ্চতা হল পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৩৬,০০০ কিলোমিটার। এর সাহায্যে চন্দ্রযানকে চাঁদের উদ্দেশ্যে পাঠানোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল। এলভিএম থ্রি বেশ কয়েকবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেছে, প্রত্যেকবার যখন পৃথিবীর কাছে এসেছে, পৃথিবীর আকর্ষণকে ব্যবহার করে তার বেগ বাড়ানো হয়েছে। একে বলা হয় গ্র্যভিটি অ্যাসিস্ট, চলতি কথায় স্লিং শট। এভাবে বেগ কমানোও সম্ভব, চাঁদের চারদিকে কক্ষপথে যানকে স্থাপনের জন্য সেটাই করা হয়েছে। সাধারণত দূরে মহাকাশ যান পাঠানোর জন্য এই পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়, কারণ এতে করে অনেকটা জ্বালানি বাঁচানো যায়।নিচের অ্যানিমেশনে বিষয়টা দেখামো হয়েছে। এগুলি Phoenix0777 নির্মিত।





এই সাফল্যের আনন্দের মধ্যেও কয়েকটা কথা বলা প্রয়োজন। কিছুটা সাহায্য পেলেই ভারতীয় বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা নিজেদের চেষ্টাতে কতদূর যেতে পারেন তার উদাহরণ হল চন্দ্র অভিযান। দেশে গবেষণাখাতে বরাদ্দ যখন গত বেশ কয়েক বছর ধরে ক্রমশই কমে আসছে, তখন এই সাফল্য কিছুটা আশা জাগায়। দেশের শিল্প সংস্থা এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এও একটা আশার দিক। কিন্তু আমাদের সরকার চন্দ্রযানের সাফল্য নিতে যতটা আগ্রহী, গবেষণার পিছনে অর্থ বরাদ্দে বোধহয় ততটা নয়। প্রচার মাধ্যমে চন্দ্রযান-এর খরচ কোন সিনেমার থেকে কম তা নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস দেখা গেলেও কীভাবে এই খরচ কমানো গেল তা নিয়ে কারো আগ্রহ দেখা গেল না। ঠিকই যে স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে খরচ কিছুটা কমানো সম্ভব হয়েছে, কিন্তু সেটা একটা অংশ মাত্র। সম্ভবত সমস্ত কারণ আলোচনা করতে গেলে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছুটা সমালোচনা করতে হয়, তাই এই নীরবতা। খরচ কমাতে হয়েছে কারণ বরাদ্দ ছিল না। বিক্রম বা প্রজ্ঞান যদি শীতঘুম থেকে উঠে কাজ করে তা ভালো, কিন্তু তার ব্যবস্থা করা যায় নি। যাঁরা লুনা-২৫-এর খরচের সঙ্গে তুলনা করছেন তাঁরা ভুলে গেছেন যে রাশিয়ার অভিযান যাতে দক্ষিণ মেরুতে অন্তত এক বছর কাজ করতে পারে সেই ব্যবস্থা ছিল। চিনের চ্যাঙ্গি-ফোরের রোভার ও ল্যান্ডার চন্দ্রপৃষ্ঠে চার বছর আটমাস কাজ করে চলেছে, চ্যাঙ্গি-ফাইভ চাঁদ থেকে নমুনা পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে কতটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে আপনি চাইবেন, এবং তার জন্য কত খরচ করতে রাজি আছেন। সংবাদপত্র লিখেছে যে চন্দ্রযান অভিযানের খরচ হয়েছে সাতশো একুশ কোটি টাকা, তার মধ্যে উৎক্ষেপণ রকেটেরই খরচ সাড়ে পাঁচশো কোটি টাকা। সেই প্রযুক্তি ইসরো আগেই আয়ত্ত করেছিল। ইসরোর বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদরা অসাধারণ কাজ করেছেন সন্দেহ নেই, কিন্তু বিনিয়োগ না করলে একটা সীমার পরে এগোনো সম্ভব নয়।

যদি কেউ বলেন আমাদের মতো দেশে এর বেশি অর্থ গবেষণাতে দেওয়া সম্ভব নয়, তাঁদের মনে করিয়ে দিই ইসরো গত ন' বছরে বিভিন্ন দেশ ও বেসরকারি সংস্থার উপগ্রহ তুলে তিন হাজার তিনশো কোটি টাকা আয় করেছে। চন্দ্রযানের সাফল্যের পরে তা বাড়বে সন্দেহ নেই। সেই ইসরোর বাজেট বরাদ্দ ২০২২ সালের ১৩,৭০০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ১০,৫০০ কোটি টাকা। মনে রাখতে হবে এর একটা বড় অংশ গবেষণার খরচ যা ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ। কোনো বিজ্ঞান গবেষণাই সঙ্গে সঙ্গে লাভ দেয় না। উন্নত দেশ দূরে থাক, এমনকি অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশই জিডিপির যে অংশ বিজ্ঞান গবেষণাতে খরচ করে, আমাদের দেশ করে তার থেকে অনেক কম। ফলে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের সংখ্যাও অন্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে আনুপাতিক হারে অনেক কম। সাফল্যের জন্য মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানী প্রযুক্তিবিদদের অভিনন্দন জানাতেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে যে বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে উন্নতি করতে হলে শুধুমাত্র একদিকে মন দিলে চলবে না; প্রয়োজন সার্বিক উন্নয়ন।

চাঁদে অভিযানের জন্য এত খরচ করে আমাদের লাভ কী? বিজ্ঞানের দিক থেকে অনেক লাভই সম্ভব। চাঁদের উল্টোদিকের পিঠে যদি দূরবিন বা রেডিও টেলিস্কোপ বসাতে পারি, তাহলে তা পৃথিবীর যে কোনো টেলিস্কোপের থেকে শক্তিশালী হবে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল অনেক তরঙ্গকে শোষণ করে নেয়, বায়ুতে প্রতিসরণের জন্য অসুবিধা হয়। তাছাড়া শহরের আলো, মোবাইল টিভি রেডিওর সিগন্যাল এগুলো না আটকাতে পারলে টেলিস্কোপের পক্ষে কাজ করা শক্ত। চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই, উল্টো দিকে পৃথিবী থেকে কোনো সিগন্যাল পৌঁছবে না। অভিকর্ষ কম বলে অনেক বড় টেলিস্কোপ বানানো যাবে। চাঁদের বায়ুচাপ প্রায় শূন্য, পৃথিবীতে আমরা অনেক খরচ করে ঐরকম অত্যুচ্চ ভ্যাকুয়াম বানাতে পারি। সার্নের লার্জ হ্যাড্রনিক কোলাইডারের মতো বড় কণাত্বরক বা অ্যাকসিলারেটর চাঁদে বানানো খুব সহজ, বায়ুশূন্য স্থান আলাদা করে বানাতে হবে না, সুপারকন্ডাক্টর তারকে ঠাণ্ডা করার ঝামেলা অনেক কম।

তবে যে সমস্ত কারণে ভবিষ্যতে চাঁদে অভিযানের বা এমনকি স্থায়ী বেস তৈরির খরচা উঠে যেতে পারে তার একটা হল শিল্পোতপাদন। ইলেকট্রনিক্স শিল্পের মতো অনেক শিল্পে বায়ুশূন্য বা ধূলিকণা শূন্য স্থান লাগে, তার জন্য অনেক খরচ করতে হয়। সেগুলো সহজে চাঁদে স্থাপন করা সম্ভব। অপর একটা লাভ হতে পারে শক্তি উৎপাদনে। হিলিয়ামের এক আইসোটোপ আছে হিলিয়াম-৩ যা পৃথিবীতে নেই বললেই চলে। সূর্যে নিউক্লিয় সংযোজন বা ফিউশন প্রক্রিয়াতে শক্তি তৈরি হয়। আমরা হাইড্রোজেন বোমাতে সেই প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়েছি, কিন্তু এখনো তাকে নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে উঠতে পারিনি। তা করতে পারলে অনেক সুবিধা হবে, গ্রিন হাউস গ্যাসের সমস্যা নেই, তেজস্ক্রিয়তার ভয় নেই। ফ্রান্সে এক আন্তর্জাতিক প্রয়াসে ফিউশন রিঅ্যাক্টর বানানো হচ্ছে, আমাদের দেশও তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। পৃথিবীতে হিলিয়াম-৩ পাওয়া গেলে রিঅ্যাক্টর বানানো অনেক সহজ হতোসূর্য থেকে হিলিয়াম-৩ সৌর বায়ুর সঙ্গে বেরিয়ে আসে, কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল তাকে আটকে দেয়। চাঁদের মাটিতে কোটি কোটি বছর ধরে হিলিয়াম-৩ জমা পড়েছে, তাকে তুলে পৃথিবীতে পাঠাতে পারলে খরচ উঠে আসতে পারে।

চাঁদে মানুষ নেমেছে পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল, আমরা কবে চাঁদে থাকতে পারব? কেমন করে চাঁদে বাস করা সম্ভব অল্প কথায় দেখা যাক। প্রথমত, চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই, তাই মহাজাগতিক রশ্মি আর সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিকে আটকানোর কেউ নেই। চাঁদের দিন আর রাত দুটোই পৃথিবীর চোদ্দ দিনের সমান। বায়ুমণ্ডল না থাকার ফলে দিনের তাপমাত্রা উঠে যায় 110 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে আর রাতের তাপমাত্রা নেমে যায় -170 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। দক্ষিণ মেরুতে তা আরো নেমে -230 ডিগ্রি ছোঁয়। ছায়াতে আর রোদে তাপমাত্রার পার্থক্যও হয় বিরাট। এ সবের থেকে বাঁচতে হলে বাস করতে হবে মাটির তলায়। চাঁদে অনেক বিরাট বিরাট লাভা নল আছে, তাদের সিল করে বায়ু ধরে রেখে তার ভিতরেই থাকা যায়। শক্তির অভাব হবে না। অভিকর্ষ পৃথিবীর ছয় ভাগের এক ভাগ, তাই সহজেই বিশাল বিশাল সোলার প্যানেল বসানো সম্ভব। তার জন্য দরকারি সিলিকন চাঁদেই পাওয়া যাবে। জল থেকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাওয়া যাবে। এমনকি কৃত্রিম আলো ব্যবহার করে গাছদের সালোক সংশ্লেষ করানো সম্ভব। আর অনেকরকম পরিকল্পনা করা যায়। মানুষ শেষ চাঁদে নেমেছিল ১৯৭২ সালে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা আবার ২০২৪ সালে চাঁদে মানুষ পাঠাতে এবং ২০২৮ সাল থেকে চাঁদে স্থায়ী বেস বানাতে চাইছে। চিন চাঁদের হিলিয়াম-৩ উত্তোলনের পরিকল্পনা করছে। জাপান ২০৩০ সাল থেকে স্থায়ী ভাবে চাঁদে অভিযাত্রীদল রাখার ব্যাপারে চিন্তা করছে। চন্দ্রযান- আমাদের সেই ক্লাবের সদস্য করার দিকে একধাপ এগিয়ে দিল। 

 

প্রকাশ নিশিত, উৎসব ২০২৩ 

No comments:

Post a Comment