Monday 13 November 2023

একুশ শতক পত্রিকাতে বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহের অবিচুয়ারি

গত ১১ আগস্ট, ২০২৩ প্রয়াত হলেন বিজ্ঞানী বিকাশ চন্দ্র সিংহ। বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তাঁর জন্ম মুর্শিদাবাদে কান্দির পুরানো রাজপরিবারে ১৯৪৫ সালের ১৬ জুন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনার পরে তিনি ইংল্যান্ডে যান এবং কেমব্রিজ থেকে বিএ ও এমএ সম্পূর্ণ করে লন্ডনের কিংস কলেজে গবেষণা করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি মুম্বাইয়ের ভাভা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে যোগ দেন।

১৯৮৪ সালে তিনি কলকাতার ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার বা ভিইসিসি-তে একটি বিভাগের প্রধান হয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৯৮৭ থেকে ২০০৯ সালে অবসর নেওয়া পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভিইসিসির অধিকর্তা। একই সঙ্গে ১৯৯২ থেকে ২০০৯ কলকাতার সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের অধিকর্তার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। এর মধ্যেই কিছুদিন পশ্চিমবঙ্গ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়েছিলেন। একই সঙ্গে দুটি বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে তিনি সফলভাবে পরিচালনা করেছেন। নিজে তত্ত্বীয় পদার্থবিদ হলেও পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দিয়ে বহু নতুন বিষয়ে গবেষণার সূচনাতে সাহায্য তিনি করেছিলেন। ভিইসিসি-তে মেডিক্যাল সাইক্লোট্রনের পরিকল্পনা সেই সময়েই নেওয়া হয়। এই সাইক্লোট্রনে যে সমস্ত তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ তৈরি হয় তারা ক্যান্সার সহ বহু রোগের নিরাময় বা নির্ধারণে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সেই সাইক্লোট্রন এখন অনেক কম খরচে তেজস্ক্রিয় পদার্থ বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ করছে। কনিষ্ঠ বিজ্ঞানী ও ছাত্রদের দিকে বিশেষভাবে নজর রাখতেন বিকাশ সিংহ।

নিউক্লিয় বিক্রিয়া বিষয়ে গবেষণা দিয়ে বিকাশ সিংহের বিজ্ঞানী জীবনের সূচনা হয়েছিল। দেশে ফিরে কয়েক বছর পরে তিনি কোয়ার্ক গ্লুয়ন প্লাজমা বিষয়ে মন দেন। এই বিষয়ে তিনি পৃথিবীর পথিকৃৎদের মধ্যে অন্যতম; চল্লিশ বছর আগে ১৯৮৩ সালে এই বিষয়ে তাঁর প্রথম প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল। বিগ ব্যাঙের পরে ব্রহ্মাণ্ডের অতি ঘন অতি উত্তপ্ত অবস্থাতে কোয়ার্ক গ্লুয়ন প্লাজমার অস্তিত্ব ছিল; পৃথিবীর পরীক্ষাগারে দুটি ভারি নিউক্লিয়াসের মধ্যে উচ্চশক্তির সংঘর্ষ ঘটিয়ে সেই আদি অবস্থাকে পুনরায় সৃষ্টি করা সম্ভব। বিকাশ সিংহ জোর দিয়েছিলেন তার থেকে বেরিয়ে আসা ফোটন, ইলেকট্রন ও মিউয়ন কণা পর্যবেক্ষণের উপরে। তাঁর উদ্যোগেই এই নিয়ে তাত্ত্বিক ও পরীক্ষামূলক গবেষণার দুটি দল দেশে তৈরি হয়েছিল।

এই ধরনের পরীক্ষা করে দেখার মতো যন্ত্র আছে পৃথিবীর দুটি পরীক্ষাগারে; একটি হল আমেরিকার ব্রুকহাভেনের রিলেটিভিস্টিক হেভি আয়ন কোলাইডার, অন্যটি হল সার্নের লার্জ হ্যাড্রনিক কোলাইডার। বিকাশ সিংহের চেষ্টাতে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা এই পরীক্ষাগারের গবেষণাতে অংশ নেন। তাঁর চেষ্টাতেই ভারতীয় বিজ্ঞানীরা নিজেরা যন্ত্র বানিয়ে পরীক্ষাতে ব্যবহার করেছেন; তাঁদের তৈরি ফোটন মাল্টিপ্লিসিটি ডিটেক্টর এবং মিউয়ন চেম্বার এখন এই সমস্ত পরীক্ষাগারে কাজ করে চলেছে। দেশে তৈরি হয়েছে মানস নামের সেমিকন্ডাক্টর চিপ, এই প্রযুক্তি যে ভারতে সম্ভব তা কেউ কল্পনাই করতে পারত না। ভারতে একের পর এক আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্র আয়োজন করে সেখানে সারা পৃথিবীর প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের তিনি নিয়ে এসেছিলেন।

কোনো ভারতীয় ব্যক্তিগতভাবে কী করল, তার থেকে বিকাশ সিংহের কাছে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে দেশ হিসাবে ভারত কী কাজ করছে। ভারত এখন সার্নের সহযোগী সদস্য। জার্মানিতে তৈরি হচ্ছে আর সর্বাধুনিক নতুন পরীক্ষাগার ফেসিলিটি ফর অ্যান্টিপ্রোটন এন্ড আয়ন রিসার্চ; অংশীদারত্বের হিসাবে ভারত এখন সেই প্রকল্পে তৃতীয়। এই সমস্ত প্রচেষ্টার নেতৃত্বে ছিলেন বিকাশ সিংহ। শুরুতে ভারত থেকে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান এই ধরনের আন্তর্জাতিক পরীক্ষাতে অংশ নিচ্ছিল। এখন সারা ভারতের মোট পঁচিশটি গবেষণা কেন্দ্র ও পনেরটি শিল্প প্রতিষ্ঠান এখন ফেয়ার-এ কাজের অংশীদার। শিল্প প্রতিষ্ঠানের কথা আলাদা করে বলতেই হয়, কারণ আন্তর্জাতিকমানের যন্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রযুক্তির উন্নতি করতে পারছে এবং ব্যবসার পরিমাণ বাড়াতে পারছে।

পঁচাত্তর বছর বয়সেও পৃথিবীর প্রথম সারির গবেষণা পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একক গবেষণা। বিজ্ঞান প্রসারে ও প্রচারেও সক্রিয় ছিলেন, নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকাতে বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখি করতেন। 'সৃষ্টি এবং কৃষ্টি: বন্ধনহীন গ্রন্থি' এবং 'স্থান, কাল ও বিশ্বলোক', এই দুই বইতে তাঁর রচনাগুলি গ্রন্থিত হয়েছে। তিনি ছিলেন বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের উপদেষ্টামণ্ডলীর ও পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের কাউন্সিলের সদস্য। সাহিত্য বা ইতিহাসেও তাঁর উৎসাহ ছিল। পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ সম্মান, রবীন্দ্র পুরস্কার, সত্যেন্দ্রনাথ বসু জন্মশতবার্ষিকী পুরস্কার, মেঘনাদ সাহা পুরস্কার, ইত্যাদি তিনি পেয়েছেন।

নিজে যা বিশ্বাস করেন তা সোজাসুজি বলতেন তিনি, অবিজ্ঞান ও পবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। ২০২০ সালে কলকাতার টেলিগ্রাফ পত্রিকাতে এক সাক্ষাৎকারে বিকাশ সিংহ বলেন সমস্ত পশ্চিমী চিন্তাভাবনার মূল ভারতীয় চিন্তাতে পাওয়া যাবে, এটা একেবারেই ভুল ধারণা এবং তা হয় একান্তই অজ্ঞতাপ্রসূত বা তার পিছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে। ভারতীয় দর্শনের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও তিনি বলেছিলেন পাশ্চাত্যের অনেক চিন্তাই সেখানে পাওয়া যাবে না। তিনি সাক্ষাৎকারে চারটি উদাহরণের কথা বলেছিলেন। আইজ্যাক নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, রেনে দেকার্তের দর্শনের পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেছিলেন মার্ক্স ও এঙ্গেলসের শ্রেণি ও শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্বের কথা। কখনো কোনো বামপন্থী দলের সদস্য না হয়েও মার্ক্স-এঙ্গেলসের তত্ত্বের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। তাঁর প্রয়াণে ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষণাতে এক বিরাট শূন্যস্থানের সৃষ্টি হল। 

 

সৃষ্টির একুশ শতক পত্রিকার সেপ্টেম্বর ২০২৩ সংখ্যাতে প্রকাশিত 

No comments:

Post a Comment