Monday 13 November 2023

ওপেনহাইমারের তিন ছাত্র

 

ওপেনহাইমারের তিন ছাত্র

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


ক্রিস্টোফার নোলান নির্মিত সিনেমাটির জন্য অনেকেই এখন জে রবার্ট ওপেনহাইমার ও মার্কিন প্রশাসনের সংঘাতের কাহিনি জেনে গেছেন। মার্কিন পরমাণু বোমা প্রকল্প মানহাটান প্রজেক্টের বৈজ্ঞানিক দিকের প্রধান ছিলেন ওপেনহাইমার। জাপানের উপর বোমা ফেলাতেও তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল। যুদ্ধের পরে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা করে পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদ কমানোর কথা বলেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল পরস্পরের সহযোগী, কিন্তু তার পরে শীতল যুদ্ধে তারা হয়ে দাঁড়াল একে অপরের প্রতিপক্ষ। মার্কিন সরকারের কমিউনিজম বিরোধিতার ইতিহাস আমরা জানি, শীতল যুদ্ধের গোড়ার দিকে তা চরমে পৌঁছেছিল। কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা না করেও সেনেটর জোসেফ ম্যাকার্থির উদ্যোগে তৈরি এক কমিটি (House Un-American Activities Committee সংক্ষেপে HUAC) কমিউনিস্টদের খুঁজে বার করে তাদের শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর হয়। হলিউডের প্রায় তিনশো শিল্পী ও কলাকুশলীকে ব্ল্যাকলিস্ট করা হয়, তাঁদের হলিউডে কাজ পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এঁদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন, তিনি দেশ ছাড়েন।

সেই তীব্র সোভিয়েত বিরোধিতার পরিবেশে পারমাণবিক অস্ত্র বিষয়ে ওপেনহাইমারের মতো নেতৃত্বস্থানীয় বিজ্ঞানীর মত প্রশাসনের কাছে প্রায় বিশ্বাসঘাতকতার সমতুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাছাড়া ওপেনহাইমার হাইড্রোজেন বোমা তৈরিরও বিরোধী ছিলেন, তাই অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে তাঁর প্রভাব খর্ব করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সেই কারণে বামপন্থার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নিরাপত্তার বিপদ, এই অভিযোগ আনা হয় এবং শেষ পর্যন্ত অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সঙ্গে তাঁর সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করা হয়।

কখনো কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হলেও উনিশশো তিরিশের দশকে ওপেনহাইমারের সঙ্গে বামপন্থী আন্দোলনের গভীর যোগাযোগ ছিল। তাঁর ঘনিষ্ঠদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য। এই লেখাতে আমরা সেই আলোচনাতে যাব না। তবে মনে রাখতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বামপন্থাকে চিরকালই সন্দেহের চোখে দেখা হয়, সেখানে ওপেনহাইমার ছিলেন বিরল ব্যতিক্রম। তাই তিনি ছিলেন বামপন্থী ছাত্রদের স্বাভাবিক আকর্ষণের কেন্দ্র। তাঁর ছাত্র জিওভান্নি রসি লোমানিজের কথায়, বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় সমস্ত ছাত্রই ছিলেন উদারপন্থী, এবং অনেকেরই বামপন্থী ঝোঁক ছিল।

ওপেনহাইমার যখন পরমাণু বোমা প্রকল্পের দায়িত্ব পান, তিনি তাঁর ছাত্রদের সেই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু সন্দিহান স্বভাবের মার্কিন সামরিকবাহিনির কাছে তাঁদের অনেকেই প্রথম থেকেই ছিলেন না-পছন্দ। ফলে মানাহাটন প্রকল্পের মূল কেন্দ্র লস আলামসে কাজের সুযোগ তাঁদের সামনে আসেনি। ওপেনহাইমার নিজেও পরবর্তীকালে সুরক্ষা বিষয়ক শুনানির সময় তাঁদের কয়েকজনকে বামপন্থী বলে চিহ্নিত করেন, ফলে তাঁদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তবে তাতে করে ওপেনহাইমারও রেহাই পাননি, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে যে জিওভান্নি রসি লোমানিজ, জোসেফ ওয়াইনবার্গ, ডেভিড বোম, ম্যাক্স ফ্রিয়েডমান ও ডেভিড হকিন্স, এঁদের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির যোগাযোগের কথা জেনেও তিনি তাঁদের পরমাণু বোমা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। আরো অভিযোগ আসে যে তাঁর ভাই ফ্রাঙ্ক ও তিনি নিজেও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।

ওপেনহাইমারের বিচার এই প্রবন্ধের আলোচ্য নয়। ওপেনহাইমার শুনানির সময় যাঁদের নাম করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বেশ কয়েকজন তাঁর ছাত্র। এঁদের মধ্যে তিনজনের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য, ঘটনাচক্রে তিনজনই ছিলেন ইহুদি। ওপেনহাইমারের সেই তিন ছাত্রকে নিয়েই এই লেখা।

জিওভান্নি রসি লোমানিজের নাম এই লেখাতে আগে এসেছে, তিনি ছিলেন পোলিশ আমেরিকান। তাঁর বাবা রাশিয়া অধিকৃত পোল্যান্ডের বাসিন্দা, জারের সৈন্যবাহিনিতে বাধ্যতামূলকভাবে যোগ দেওয়ার পরিবর্তে তিনি দেশ ছাড়েন। কিছুদিন ব্রাজিলে কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি আমেরিকাতে কৃষিবিষয়ক রসায়ন বিষয়ে পড়াশোনা করে সেই বিষয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করেছিলেন। জিওভান্নির জন্ম আমেরিকাতে ১৯২১ সালের ১০ অক্টোবর, মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে তিনি স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি ওকলাহামা কলেজে ভর্তি হন। কলেজের পরে তিনি আরো উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বিভিন্ন সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেন। বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বৃত্তি দিয়েছিল, তাই সেখানেই তিনি পড়াশোনা শুরু করেন। এই সময়েই তিনি বার্কলের রেডিয়েশন ল্যাবে ওপেনহাইমারের সংস্পর্শে আসেন। একই সঙ্গে তিনি আর্নেস্ট লরেন্সের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। দুজনেই তাঁকে পরমাণু বোমা সংক্রান্ত কাজে যুক্ত করেছিলেন।

লোমানিজের স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল বামপন্থার দিকে। বার্কলের রেডিয়েশন ল্যাবে তিনি ফেডারেশন অফ আর্কিটেক্টস ইঞ্জিনিয়ার্স, কেমিস্টস এন্ড টেকনিশিয়ান্‌স (FAECT)-এর এক শাখা গঠন করেছিলেন। কার্যক্ষেত্রে ইউনিয়ন করার অধিকার দিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এক আইন করেছিলেন, অথচ সেই রাষ্ট্রপতির অফিস থেকেই নির্দেশ যায় যে কোনোভাবে এই ইউনিয়নকে বন্ধ করতে হবে। ইউনিয়ন ভাঙার লক্ষ্য নিয়ে লোমানিজকে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য হিসাবে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। লরেন্স ও ওপেনহাইমার দুজনেই আলাদা আলাদা চিঠিতে পরমাণু বোমা প্রকল্পে লোমানিজের গুরুত্বের কথা বলে তাঁকে ছাড় দেওয়ার অনুরোধ করেন, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বহু বছর পরে যখন মার্কিন আইন অনুসারে গোপন কাগজপত্র প্রকাশ্যে আসে, তখন লোমানিজ দেখেন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়ো অভিযোগ আনা হয়েছিল। ওপেনহাইমার ও লরেন্স সুপারিশ করেছিলেন সৈন্যবাহিনি যেন তাঁর বিশেষ জ্ঞানের সাহায্য নেয়, কিন্তু সেই চেষ্টা হয়নি। তাঁর উপর আলাদা করে নজর রাখা হয়েছিল; দু'বার তাঁর ডিভিশনকে ইউরোপে যুদ্ধে পাঠানো হলেও তাঁকে বদলি করে আমেরিকাতেই রেখে দেওয়া হয়।

১৯৪৩ সালেই ওপেনহাইমার মার্কিন সৈন্যবাহিনির গোয়েন্দাদের জানিয়েছিলেন যে লোমানিজ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, তবে তিনি তাঁর সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করবেন। ১৯৫৪ সালে শুনানির সময় তিনি সম্পূর্ণ ঘুরে গিয়ে বলেন যে তিনি যদি জানতেন লোমানিজ পার্টিসদস্য, তাহলে তিনি এই চিঠি লিখতেন না। যুদ্ধের পরে লোমানিজ কিছুদিন বার্কলেতে কাজ করার পরে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট করার সুযোগ পান, ওপেনহাইমার তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। সেখানে তিনি কিংবদন্তী পদার্থবিদ রিচার্ড ফেইনম্যানের কাছে গবেষণা করেছিলেন। ১৯৪৯ সাল নাগাদ তিনি ফিস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর চাকরি পান। কিন্তু তারপরেই তাঁকে HUAC-এর সামনে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়। পরে ওপেনহাইমারের আর এক ছাত্র ডেভিড বোমের কথা আসবে, প্রায় একই সময় তাঁকেও ডেকে পাঠানো হয়েছিল। তাঁরা দুজনে ওপেনহাইমারের সঙ্গে দেখা করেন। লোমানিজ বলেছেন যে ওপেনহাইমার ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন।

লোমানিজের নিজের কথায়, সেই সময় যাঁরা সরকারী নীতির বিরোধিতা করতেন, কিংবা শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বিভেদ দূর করার বা কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নতির বলতেন, প্রশাসন তাঁদের কমিউনিস্ট বলে চিহ্নিত করত। কমিউনিজম হয়ে দাঁড়িয়েছিল মূল শত্রু। মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। হলিউডের কয়েকজন চিত্রনাট্যকারকে যখন HUAC-এর সামনে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়, তাঁরা সংবিধানের সেই ধারার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে তাঁরা নিজেদের বক্তব্য প্রকাশ করেছেন, মার্কিন কংগ্রেসের সেই নিয়ে প্রশ্ন করার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি, কংগ্রেসকে অবজ্ঞা করার অভিযোগে তাঁদের কারাদণ্ড হয়েছিল। লোমানিজকে কমিটি প্রশ্ন করেছিল তিনি নিজে কি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বা তিনি কি কোনো সদস্যকে চেনেন? লোমানিজের ইচ্ছা ছিল নিজের সমর্থনে প্রথম সংশোধনীকে ব্যবহার করার, কিন্তু চিত্রনাট্যকারদের কথা মনে রেখে তিনি পঞ্চম সংশোধনী ব্যবহার করেন। সেই সংশোধনীতে বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। তাঁর বিরুদ্ধে গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগ বা বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনা হয়েছিল, তিনি তীব্রভাবে তা অস্বীকার করেন।

প্রথমবার শুনানির পরেই ফিস্ক বিশ্ববিদ্যালয় লোমানিজকে বরখাস্ত করে। লোমানিজের স্ত্রী একটা সামান্য কাজ শুর করেন, লোমানিজ নিজে ইউনিয়নে নাম লিখিয়ে ট্রাক চালানোর কাজ নেন। সেই কাজও একসময় চলে যায়। লোমানিজ আবার কর্নেলে ফিরে থিসিসের কাজ শেষ করেন। তাঁর থিসিসের শেষ বাক্যটি ছিল, “The author is also very glad that no money channeled through the Army or Navy was required to finance this work.” ফেইনম্যান আপত্তি করেননি।

এরপরে কংগ্রেসকে অবজ্ঞা করার অভিযোগে লোমানিজের বিচার হয়। ওয়াশিংটনে বিচার, টাকা ধার করে তাঁকে সেখানে যেতে হয়। উকিলের পয়সা তাঁর ছিল না, বিনা পয়সায় কেউ তাঁর কেস নিতে রাজি হচ্ছিল না। একই সঙ্গে ডেভিড বোমেরও বিচার হচ্ছিল, তাঁর নিযুক্ত উকিল শেষ পর্যন্ত লোমানিজের পক্ষে দাঁড়ান। বিচারে দুজনেই মুক্তি পান।

এরপরে কয়েক বছর লোমানিজকে জীবনের জন্য সংগ্রাম করতে হয়। কখনো ট্রাক চালিয়েছেন, কখনো রঙের কারখানা, ব্যাগ সেলাইয়ের কারখানা বা রেললাইন মেরামতির শ্রমিকের কাজ করেছেন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছিল বলে রঙের কারখানার মালিক তাঁকে ছাঁটাই করেন। চার বছর তাঁর থাকার কোনো জায়গা ছিল না, তিনি ও তাঁর স্ত্রী প্যাকিংবাক্সের কাঠ দিয়ে একটা ঘর বানিয়ে সেখানে থাকতে বাধ্য হন, সেখানে জল বা বিদ্যুতের প্রশ্নই ওঠে না। অবশেষে ১৯৬০ সালে তিনি এক কলেজে পড়ানোর চাকরি পান। দু' বছর পরে নিউ মেক্সিকো টেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি চাকরি নেন। ১৯৯১ সালে অবসর নেওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। ৩১ ডিসেম্বর ২০০২ তাঁর মৃত্যু হয়।

লোমানিজ বা তাঁর মতো কয়েকজন এই বিরূপ পরিস্থিতিতেও দেশ ছাড়েননি। অনেক পরে চাকরি তাঁরা পেয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবে তাদের গবেষক জীবনের ইতি ঘটেছিল। এর পরে যে দুজনের কথা বলব তাঁরা দেওয়ালের লিখন পড়তে পেরেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই বুঝে তাঁরা দেশ ছাড়েন। তাঁদের একজন ভারতে প্রায় আট বছর কাটিয়েছিলেন, তাঁর নাম বার্নার্ড পিটার্স।

দেশত্যাগ অবশ্য পিটার্সের কাছে নতুন নয়। তাঁর আসল নাম বার্নার্ড পিয়েত্রোভস্কি। তাঁর জন্ম ১৯১০ সালে জার্মানি অধিকৃত পোল্যান্ডে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে খাদ্যাভাবের সময় তাঁর বাবা তাঁকে ব্ল্যাক ফরেস্টে এই চাষীর কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখানে বালক বার্নার্ড ভেড়া চরাতেন এবং ক্ষেতের ছোটখাটো কাজ করতেন, বিনিময়ে খেতে পেতেন। বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরে তিনি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে তিনি মিউনিখ টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করেন, সে বছরই হিটলার ক্ষমতায় আসেন। বার্নার্ড ছাত্রদের মধ্যে নাৎসিবিরোধী প্রচার করতেন, সেজন্য নাৎসিদের ক্ষমতা দখলের কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁকে গ্রেপ্তার করে দাচাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। তিন মাস পরে বার্নার্ড সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন। পুলিশকে এড়িয়ে এক সাইকেল সম্বল করে আল্পস পর্বতমালা পার হয়ে তিনি ইতালিতে যান। সেখানে পদুয়াতে তাঁর বান্ধবী হান্না লিলিয়ান সেই সময় ডাক্তারি পড়ছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করার পরে বার্নার্ড ইংল্যান্ডে যান। ১৯৩৪ সালে তিনি যান আমেরিকা, সেখানে হান্না তাঁর সঙ্গে যোগ দেন ও তাঁরা বিয়ে করেন।

ইতিমধ্যে পিয়েত্রোভস্কি হয়েছেন পিটার্স। তিনি আমেরিকাতে এক আমদানি কোম্পানিতে কাজ করছিলেন। ১৯৩৭ সালে হান্না ডাক্তারি পড়াশোনা শেষ করার পরেই তিনি চাকরি ছাড়েন। দুজন মিলে সানফ্রান্সিস্কোতে যান, হান্না সেখানে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারে কাজ নেন। বার্নার্ড বন্দরে শ্রমিক হিসাবে কাজ শুরু করেন। পরের বছর হান্নার সূত্রে বার্নার্ডের সঙ্গে ওপেনহাইমারের আলাপ হয়, ওপেনহাইমার তাঁকে পদার্থবিজ্ঞান পড়তে উৎসাহিত করেন। তিনি বার্কলেতে ভর্তি হন এবং ওপেনহাইমারের সঙ্গেই কাজ করে ডক্টরেট করেন। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট করলেও এর পর তিনি লরেন্সের সঙ্গে পরীক্ষামূলক বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। পরের তিন বছর তিনি মূলত পরমাণু বোমা প্রকল্পের কাজেই যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করেন। এই সময় তিনি কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং সেই বিষয়ে প্রথম সারির বিশেষজ্ঞ হিসাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃত হন।

বার্নার্ড পিটার্স বার্কলেতে FAECT-এর সদস্য হয়েছিলেন। লোমানিজ বা বোমের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। সেটাই তাঁর বিপক্ষে অনুসন্ধানের জন্য যথেষ্ট কারণ বিবেচিত হয়েছিল। ওপেনহাইমার একবার মার্কিন গোয়েন্দাকে বলেছিলেন পিটার্স ‘very red’, ১৯৪৯ সালে গোপন শুনানির সময় তিনি আবার বলেন যে বার্নার্ড কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, 'a dangerous man and quite red’ । তার যুক্তি হিসাবে তিনি বলেন যে পিটার্স জার্মানিতে নাৎসিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন ও দাচাউ থেকে পালিয়েছিলেন! গোপন শুনানি হলেও সেই খবর কাগজে বেরিয়ে যায়। পিটার্স কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেন। তাতে কোনো কাজ হয়নি, রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বরখাস্ত করে। আমেরিকাতে কাজ পাওয়ার সুযোগ তাঁর সামনে বন্ধ হয়ে যায়।

হোমি ভাভার সঙ্গে পিটার্স গবেষণা করেছিলেন, ভাভা তাঁকে ভারতে নবনির্মিত টাটা ইন্সটিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে আমন্ত্রণ জানান। পিটার্স আট বছর বম্বেতে ছিলেন, টাটা ইন্সটিটিউটের মহাজাগতিক রশ্মি সংক্রান্ত গবেষণা তাঁর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছায়। তাঁর কাজের স্বীকৃতিতে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে। এর পরে তিনি কোপেনহাগেনে নিল্‌স বোর ইন্সটিটিউট অফ থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সে যোগ দেন। কয়েক বছর পরে তিনি ডেনমার্কের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের অধিকর্তা হয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।

সব শেষে আসি ডেভিড বোমের কথায়। বোমের জন্ম আমেরিকার পেনসিলভেনিয়াতে ১৯১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর। তাঁরা বাবা স্যামুয়েল ছিলেন হাঙ্গারিয়ান ইহুদি, আমেরিকাতে এসে তিনি আসবাবপত্রের ব্যাবসা শুরু করেছিলেন। মা ছিলেন লিথুনিয়ান ইহুদি। তাঁর বাড়িতে ইহুদি রীতিনীতি মেনে চলা হত, কিন্তু বোম তরুণ বয়সেই অজ্ঞেয়বাদী হয়ে যান। পেনসিলভেনিয়া কলেজে পড়াশোনার পরে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে এক বছর কাটান। তার পরে বার্কলেতে রবার্ট ওপেনহাইমারের সঙ্গে কাজ শুরু করেছিলেন। মহামন্দার সময় তাঁর শহরে খনিশ্রমিকদের দুর্দশা দেখে তিনি আগেই প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়েছিলেন। তিনি অল্পদিনের জন্য আমেরিকান কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হয়েছিলেন। তাঁর নিজের কথায়, ইহুদিদের উপর নাৎসিদের অত্যাচারের কথা জানতে পেরে তিনি বুঝেছিলেন যে কমিউনিস্টরা নাৎসিদের প্রকৃত বিরোধী। তবে তিনি স্ট্যালিনের কার্যকলাপকে সমর্থন করতেন না।

ওপেনহাইমার বোমকে লস আলামসে মানহাটান প্রকল্পে যোগ দেওয়ার জন্য বলেছিলেন, কিন্তু কমিউনিস্ট যোগাযোগের জন্য তাঁকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। এদিকে যে গবেষণা তিনি ডক্টরেটের জন্য করছিলেন, পরমাণু বোমাতে তার গুরুত্ব থাকায় তাকে গোপনীয় বলে ঘোষণা করা হয়। ফলে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যেখানে বোমের পক্ষে থিসিস লেখা বা তার জন্য পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে না। শেষকালে থিসিস ছাড়াই ওপেনহাইমারের সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়। বোমের অন্য এক কাজও পরমাণু বোমা তৈরিতে লেগেছিল। যুদ্ধের পরে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন, সেই সময়ে আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়েছিল।

বোমকে ওপেনহাইমারের সুরক্ষা শুনানিতে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়েছিল, কিন্তু মার্কিন সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর উল্লেখ করে তিনিও সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন, তাঁর সহকর্মীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতেও তিনি রাজি হননি। সেই জন্য ১৯৫০ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, অবশ্য তিনি জামিনে ছাড়া পান। আগেই বলেছি যে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ার জন্য পরের বছর তিনি অভিযোগ থেকে মুক্ত পান। ইতিমধ্যে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বরখাস্ত করে, মুক্তি পাওয়ার পরেও তাঁকে আর নিয়োগ করা হয়নি। আইনস্টাইন তাঁকে সহকারী নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ওপেনহাইমার তাঁকে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেন। তার কারণ ওপেনহাইমার জানতেন যে সুরক্ষা শুনানিতে তিনি বোমের নামে অভিযোগ এনেছেন, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর কাজ পাওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া ওপেনহাইমার অনুমান করেছিলেন যে অনতিবিলম্বেই তিনিও অভিযুক্ত হবেন, বোমের প্রিন্সটনে থাকা তাঁর বিরুদ্ধে যাবে। আইনস্টাইন ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তাঁর জন্য সুপারিশ করেছিলেন, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি ব্রাজিলে সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পান।

১৯৫১ সালে ব্রাজিলে যাওয়ার পরে সে দেশের মার্কিন কনসাল তাঁর পাসপোর্ট বাজোয়াপ্ত করেন যাতে তিনি ব্রাজিল থেকে আমেরিকা ছাড়া অন্য কোথাও না যেতে পারেন। এটা ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। বাধ্য হয়ে বোম ব্রাজিলের নাগরিকত্ব নেন। মাঝে দু’ বছর ইজরায়েলে কাটিয়ে ১৯৫৭ সালে তিনি ব্রিটেনের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসাবে যোগ দেন। ইতিমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে হাঙ্গারিতে আন্দোলন দমন করেছিল তার সঙ্গে একমত হতে না পেরে তিনি মার্ক্সবাদে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৮৭ তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন। ১৯৯২ সালের ২৭ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়।

তিন ছাত্রের মধ্যে বোমই পরবর্তীকালে বিজ্ঞানে সব থেকে বেশি অবদান রেখেছেন। বিজ্ঞান আলোচনার সুযোগ এই নিবন্ধে নেই, খুব সংক্ষেপে কয়েকটা কথা বলি। আইনস্টাইনের সঙ্গে প্রিন্সটনে আলোচনার সময়েই বোম কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তাৎপর্য নিয়ে আগ্রহী হয়েছিলেন। তিনি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। খুব কম বিজ্ঞানীই প্রথম প্রথম সেই ব্যাখ্যাতে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, এমনকি আইনস্টাইনও একমত হতে পারেননি। কিন্তু পরবর্তীকালে জন স্টুয়ার্ট বেল তাঁর লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন এবং এক অসমীকরণের প্রস্তাব করেন। সেই বিষয়ে পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণের জন্য তিন বিজ্ঞানীকে ২০২২ সালে পদার্থবিদ্যার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। বর্তমান বোমের তত্ত্ব সাধারণভাবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম ব্যাখ্যা হিসাবে স্বীকৃত।

এই তিনজন ছাড়াও ডেভিড হকিন্স, মাক্স ফ্রিয়েডমান, জোসেফ ওয়াইনবার্গ, ফিলিপ মরিসন বা ডেভিড ফক্সের মতো পরমাণু বোমা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীদের নাম করা যেতে পারে যাঁরা আমেরিকান প্রশাসনের বিরাগভাজন হয়েছেন, জেল খেটেছেন বা চাকরি হারিয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন ওপেনহাইমারের ছাত্র। সকলের কথা আলাদা করে বলার হয়তো প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে পিটার্সের বিষয়ে ওপেনহাইমারের আচরণ সহকর্মীদের কাছে অপ্রত্যাশিত লেগেছিল। ওপেনহাইমারকে লেখা এক চিঠিতে তাঁর সহযোগী ভিক্টর ভাইসকফ লিখেছিলেন যে পিটার্সই রাজনৈতিক মতের জন্য চাকরি হারানো প্রথম বিজ্ঞানী নন, কিন্তু কোনো বিজ্ঞানীর অভিযোগের জন্য চাকরি হারানো বিজ্ঞানী হিসাবে তিনিই প্রথম। শুধু ভাইসকফ নয়, হান্স বেথে, ফ্রাঙ্ক কন্ডনের মতো বিজ্ঞানীরাও এই ঘটনার পরে ওপেনহাইমারকে চিঠি লিখে তাঁর কাজের নিন্দা করেছিলেন ও যে কোনো মূল্যে সমস্যার সমাধানের কথা বলেন। ওপেনহাইমার পিটার্সের কাছে তাঁর ভুল স্বীকার করেন ও প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। সব থেকে বড় কথা হল যে যারা মার্কিন সৈন্যবাহিনির হাতে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র তুলে দিয়েছিল, তাদের কয়েকজনের উপরেই শাস্তি নেমে এসেছিল; ওপেনহাইমার নিজেও রেহাই পাননি।


তথ্যসূত্র

  • Interview of G. Rossi Lomanitz by Shawn Mullet, Niels Bohr Library & Archives, American Institute of Physics, College Park, MD USA

  • Interview of David Bohm by Maurice Wilkins, Niels Bohr Library & Archives, American Institute of Physics, College Park, MD USA

  • Brighter than a Thousand Suns, Robert Junk, Mariner Books, 1970

  • Robert Oppenhreimer: A Life from Begining to End, Hourly History, 2002

  • In the Shadow of the Bomb: Oppenheimer, Bethe and Moral Responsibility of the Scientist, S.S. Schweber, Princeton University Press, 2020

     

    সৃষ্টির একুশ শতক পত্রিকার ২০২৩ উৎসব সংখ্যায় প্রকাশিত







1 comment:

  1. তপন কুমার বিশ্বাস22 November 2023 at 18:18

    অনবদ্য লেখা। প্রাসঙ্গিক অনেক তথ্যসমৃদ্ধ এবং সুগ্রন্থিত। তিনজনের জীবনী থেকেই অনেক কিছু শেখার আছে।
    অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী জিওভান্নি রসি লোমানিৎজকে কাটাতে হয়েছে প্যাকিং বাক্সের ফেলে দেওয় কাঠ দিয়ে তৈরি আলো পাখাহীন একটুকু মাথা গোঁজার চিলতে আশ্রয়ে একথা ভাবলে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। বাধ্য হয়ে বিজ্ঞানী চালাচ্ছেন ট্রাক, রঙের কারখানায় কাজ নিচ্ছেন, সেটুকুও চলে যাচ্ছে এমন কত কথা। কিন্তু উঠে দাঁড়িয়ে আবার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিজ্ঞানী হিসাবে, এমন মানুষকে শ্রদ্ধা জানালেই শেষ হয় না, তার অনুরণন থেকে যায়।
    বার্নার্ড পিটার্স বা ডেভিড বোহমের কাহিনিও অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন,
    " প্রেরণা দিয়েছে শক্তি দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী নারী " - এই তিনজনের কাহিনী থেকে আবার যেন তারই প্রতিধ্বনি খুঁজে পাওয়া গেল। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিস্ট ভীতি, ম্যাকার্থিবাদ ও ঠান্ডা লড়াইয়ের খন্ডচিত্র খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। ওপেনহাইমারের প্রতি শ্রদ্ধা একটু হলেও টলে গেল।
    অতি মূল্যবান তথ্যসূত্রগুলির জন্য ধন্যবাদ।

    ReplyDelete