পিটার হিগস, হিগস ক্ষেত্র ও হিগস বোসন
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
গত ৮ এপ্রিল প্রয়াত হলেন ২০১৩ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী পিটার হিগস। তাঁর জন্ম ইংল্যান্ডে ১৯২৯ সালের ২৯ মে। পড়াশোনা ব্রিস্টলে, সেই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন কিংবদন্তী পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক। ডিরাকের বিভিন্ন কৃতিত্বের কথা শুনে তাঁর পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহ জন্মায়। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে তিনি পদার্থবিদ্যাতে বিএসসি, এমএসসি ও গবেষণা করে ডক্টরেট করেন। ১৯৬০ সাল থেকে তিনি এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন, ১৯৯৬ সালে অবসর নেওয়ার পরে তাঁকে সেই প্রতিষ্ঠানেই এমিরিটাস অধ্যাপক করা হয়। ২০১২ সালে সার্নের লার্জ হ্যাড্রনিক কোলাইডার বা এলএইচসি-তে যে বোসন কণাটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, তার প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৬৪ সালে হিগস তার কথা প্রথম বলেছিলেন। সেই অত্যন্ত মৌলিক গবেষণার স্বীকৃতিতেই হিগসকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
হিগস লোকচক্ষুর অন্তরালে কাজ করাই পছন্দ করতেন, তিনি মোবাইল ফোন, ইমেল বা ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন না। হিগস বোসনের কথা আমরা সবাই জানি, কিন্তু ঘটনাচক্রে কণাটির সঙ্গে একমাত্র তাঁর নাম যুক্ত হওয়াটাকে তিনি মোটেই খুশি হননি, তার পরিবর্তন চেয়েছিলেন। সার্নে সেই কণাটি আবিষ্কার হয় ২০১২ সালে। তার পরে প্রচারমাধ্যম তাঁকে নিয়ে যে মাতামাতি শুরু করেছিল, তা তাঁর নিতান্তই অপছন্দ ছিল। ২০১৩ সালের নোবেল পুরস্কারের তালিকাতে তাঁর নাম থাকবে বলে সকলেই অনুমান করেছিলেন। ঘোষণার দিনটা ছিল ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর। সহকর্মী, সংবাদমাধ্যম, বন্ধু, আত্মীয় সবাইকে এড়াতে হিগস ঘোষণার সময়ের আধ ঘণ্টা আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। এডিনবার বন্দর তাঁর বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয়, কিছুক্ষণ সেখানে হাঁটাহাঁটি করার পরে সমুদ্রের ধারে এক পাবে বসেই দুপুরের খাবার সারলেন। তারপরে ঢুকলেন এক শিল্প প্রদর্শনীতে। ঘণ্টা চারেক পরে যখন বাড়ি ফিরছেন, এক প্রতিবেশী তাঁকে দেখতে পেয়ে গাড়ি থামিয়ে নেমে এলেন। 'প্রফেসর হিগস, অভিনন্দন। আমার মেয়ে লন্ডন থেকে ফোন করে আপনার পুরস্কারের খবরটা দিয়েছে।' মোবাইল ফোন তিনি ব্যবহার করেন না, তাই সুইডিশ অ্যাকাডেমি পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করার পরে অন্যতম প্রাপক পিটার হিগসের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারেনি। বাড়ি ফিরে গিয়ে তিনি ফোনের রেকর্ড করা মেসেজগুলো শুনে নিলেন।
এই ছিলেন পিটার হিগস; কখনোই নিজেকে সামনে আনতে চাইতেন না। যখন সার্নে সাংবাদিক সম্মেলন করে হিগস বোসন কণার আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করা হয়, হিগস সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকরা তাঁকে ঘিরে ধরতে তিনি শুধু বলেছিলেন সেই দিনটা এই সমস্ত বিজ্ঞানীর যাঁরা কয়েক বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে কণাটির সন্ধান পেয়েছেন। সেদিন তিনি কিছু বলবেন না। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে তিনি আশা করেননি যে তাঁর জীবৎকালে কণাটি খুঁজে পাওয়া যাবে। তাই সার্নের আবিষ্কারের খবর পেয়ে প্রথমে তাই তাঁর ভালো লেগেছিল, কিন্তু তার পরেই মনে হয়েছিল যে তাঁর শান্তিপূর্ণ জীবন শেষ হতে চলেছে। কিছুটা মজা করেই হয়তো বলেছিলেন, ওই একটি কণা তাঁর জীবনকে ধ্বংস করে দিল।
নিজেকে আড়াল করার এই অভ্যাস কিন্তু কোনোভাবেই দুর্বলতা নয়। অন্য অনেক বিজ্ঞানীর মতো হিগস গজদন্তমিনারে বাস করতেন না, বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগ ছিল। নিজের মত স্পষ্ট করে জানাতে তিনি ভয় পেতেন না। উনিশশো ষাট ও সত্তরের দশকে এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের সংগঠকদের উপরে শাস্তি নামিয়ে আনতে চেয়েছে, বিরোধিতা করেছেন পিটার হিগস। এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয় বর্ণবিদ্বেষী দক্ষিণ আফ্রিকার কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে; প্রতিবাদ করেছেন হিগস। এ সব কারণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। বিজ্ঞানের বিষয়েও কোনো আপোস করেন নি। নিউক্লিয় অস্ত্র বিরোধী আন্দোলন সেন্টার ফর নিউক্লিয়ার ডিসআর্মামেন্টের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন, কিন্তু তা যখন নিউক্লিয় বিদ্যুতেরও বিরোধিতা করে, তখন তিনি তার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তেমনি পরিবেশবাদী গ্রিনপিস সংগঠনের সদস্য হইয়েছিলেন, কিন্তু সেই সংগঠন যখন জিন প্রযুক্তির বিরোধিতা শুরু করে, তখন তিনি সদস্যপদ ত্যাগ করেন। প্যালেস্টাইনের প্রতি ইজরায়েলের মনোভাবের প্রতিবাদে তিনি জেরুজালেমে দিয়ে উলফ পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার এই সম্মান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। ২০১২ সালে অবশ্য তিনি অনুরূপ এক সম্মান গ্রহণ করেছিলেন, কারণ তাঁকে ভুল বোঝানো হয়েছিল যে ব্রিটেনের রাণীই সেই সম্মান দেন, তার সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী লিওন লেডারম্যান তাঁর বেস্ট সেলার বইতে হিগস কণার নাম দিয়েছিলেন গড পার্টিকল অর্থাৎ ঈশ্বরকণা; সেই নামেই কণাটি পরিচিত হয়ে যায়। হিগস ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না, তাই তিনি এতে খুব বিরক্ত হয়েছিলেন।
তাঁর গবেষণা এত স্বীকৃতি পেলেও ব্যক্তি হিগস কিন্তু অনেক দিক থেকেই বর্তমান বিজ্ঞানীমহলের অধিকাংশের থেকে আলাদা। এই 'পাবলিশ অর পেরিশ'-এর যুগেও প্রবন্ধ ছাপার ইঁদুর দৌড়ে তিনি কখনোই নাম লেখান নি। ১৯৬৪ সালের পরে তাঁর মোট প্রকাশিত বিজ্ঞানপ্রবন্ধের সংখ্যা দুই অঙ্কে পোঁঁছায়নি। তিনি নিজেই বলেছিলেন আধুনিক কালে তিনি চাকরিই পেতেন না। এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর চাকরি যায়নি তার একমাত্র কারণ ছিল যে ১৯৮০ সালেই তাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রস্তাবিত হয়েছিল, কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল যে হয়তো তিনি একদিন পুরস্কার পাবেন। হিগসের নিজের কথায়, 'না পেলে যে কোনো সময় ছাঁটাই করা যাবে।'
হিগসের গবেষণার তাৎপর্য অল্প কথায় বলা কঠিন। সংক্ষেপে বলা যায়, মৌলিক কণাদের জন্য আমাদের এখনো পর্যন্ত সব সেরা তত্ত্বের নাম হল স্ট্যান্ডার্ড মডেল। মহাবিশ্বে আমাদের জানা বল চার প্রকার, মাধ্যাকর্ষণ, তড়িৎচৌম্বক বল, পীন বা সবল বল এবং ক্ষীণ বা দুর্বল বল। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের মধ্যে প্রথমটিকে স্থান দেওয়া সম্ভব হয়নি, কিন্তু বাকি তিনটি বলের সাহায্যে মৌলিক কণারা কেমনভাবে নিজেদের মধ্যে ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া করে, তার ব্যাখ্যা স্ট্যান্ডার্ড মডেল থেকে পাওয়া যায়।
এই সমস্ত বলকে বয়ে নিয়ে যায় কয়েকটি বোসন কণা। অর্থাৎ যে সমস্ত কণা বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে, এই বছর যে পরিসংখ্যান আবিষ্কারের শতবর্ষ। এদের মধ্যে তড়িৎচৌম্বক বল যে বলকণার মাধ্যমে যায়, তা হল ফোটন। দুটি আধানযুক্ত কণা বা ইলেকট্রন কেমনভাবে পরস্পরের মধ্যে ক্রিয়াবিক্রিয়া করে? সহজ কথায় বললে, একটি ইলেকট্রন একটি ফোটন ছাড়ে, অন্যটি সেই ফোটনটিকে ধরে নেয়। পদার্থবিজ্ঞানের যে সর্বাধুনিক তত্ত্ব এই ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করে তার নাম কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডায়নামিক্স বা আলোকতড়িৎবিদ্যা। তড়িৎচৌম্বক বলের সীমা অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত, সেই তথ্যকে ব্যবহার করে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার হাইজেনবার্গ অনিশ্চয়তা সূত্র থেকে বলা যায় যে ফোটনের স্থিরভর শূন্য।
কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডায়নামিক্স পদার্থবিদ্যার সব থেকে সফল তত্ত্ব এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু এর মূলে একটা সমস্যা আছে; তা হল অসীম রাশির সমস্যা। কিছু কিছু রাশি অঙ্ক কষে বার করতে গেলে উত্তর আসে অসীম। এখন অসীম মান তো আর পরীক্ষাগারে মাপা যায় না, আর ধরুন, ইলেকট্রনের ভর বা আধান, তা তো অসীম হতে পারে না। এখানে বিজ্ঞানীরা একটা কায়দা করলেন। ধরুন ইলেকট্রনের ভর হল দুটি রাশির বিয়োগফল, তার একটা বার করার কোনো উপায় নেই, আর অঙ্ক থেকে দ্বিতীয়টা আসছে অসীম। বিজ্ঞানীরা বললেন, প্রথমটাও অসীম; আর দুটো অসীম সংখ্যার বিয়োগফল হল একটা সসীম ছোট সংখ্যা। গণিতবিদরা এটা মোটেই পছন্দ করেন না, কিন্তু দেখা গেছে যে এই কায়দা মাত্র কয়েক জায়গায় প্রয়োগ করতে পারলেই কেল্লা ফতে, তারপর অঙ্ক আর পরীক্ষার ফল একেবারে কাঁটায় কাঁটায় মিলে যাচ্ছে। এই কাজের জন্য সিন-ইতিরো তোমোনাগা, জুলিয়ান শুইঙ্গার ও রিচার্ড ফাইনম্যান নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
অসীম থেকে অসীম বাদ দেওয়ার এই পদ্ধতিটা কাজ করে, কারণ ফোটনের স্থিরভর শূন্য। সমস্যা বাঁধল দুর্বল বা ক্ষীণ বলের জন্য। তার সীমা খুব ছোট, নিউক্লিয়াসের থেকেও ছোট। অনিশ্চয়তা সূত্র ব্যবহার করে দেখা যায় যে যে বোসন কণারা এই বলকে বয়ে নিয়ে যাবে, তাদের ভর খুব বেশী হতে হবে, প্রোটনের একশো গুণের কাছাকাছি। ক্ষীণ বলের তত্ত্ব প্রথম দিয়েছিলেন এনরিকো ফের্মি, তারপর অনেক পরীক্ষানিরীক্ষার পরে তা অনেক বদলেছে। ১৯৫৭ সালে রবার্ট মার্শাক ও ভারতীয় বিজ্ঞানী জর্জ সুদর্শন প্রথম দেখান ক্ষীণ বলের রূপটা ঠিক কী। ক্ষীণ বল কাদের উপর কাজ করে? ইলেকট্রন বা কোয়ার্ক জত্তীয় কণা এবং নিউট্রিনোদের উপরে; এরা সবাই ফের্মিয়ন অর্থাৎ ফের্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান মেনে চলে। তাদেরও ভর আছে, অবশ্য নিউট্রিনোর যে ভর আছে তা আমরা অল্প দিন হল জেনেছি। সমস্যা হল যে দুর্বল বলের ওই রূপটা একমাত্র ভরহীন বোসন ও ফের্মিয়নের জন্যই কাজ করে। ভরশূন্য কণাদের তত্ত্ব থেকে অসীমকে বাদ দেওয়ার কোনো উপায় জানা নেই।
এই সমস্যার সমাধানে প্রায় একই সময়ে কয়েক দল বিজ্ঞানী আলাদা আলাদা ভাবে প্রস্তাব করেন যে মৌলিক কণাগুলি আসলে ভরহীন, কিন্তু মহাবিশ্বে এমন এক বিশেষ ফিল্ড বা ক্ষেত্র আছে যার সঙ্গে ক্রিয়ার মাধ্যমে তারা বল পায়। এই ক্ষেত্রের নাম আমরা পরে দিয়েছি হিগস ক্ষেত্র। এখানে যে পদ্ধতি কাজ করে তা হল ভগ্ন প্রতিসাম্য। এই বিষয়টা আরো জটিল, তাই এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে সেই আলোচনাতে যাচ্ছি না। মূল কথা হল যে ফের্মিয়ন বা বোসনরা গোড়াতে ভরশূন্য হিসাবেই থাকে, ফলে অসীম রাশির সমস্যা থাকে না। হিগস ক্ষেত্রের প্রতিসাম্য ভাঙার ফলে ফের্মিয়ন বা বোসনরা ভর পায়, কিন্তু তার জন্য অসীমের সমস্যাটা আর ঘুরে আসে না।
হিগস ক্ষেত্রের সঙ্গে যে কণার ক্রিয়ার পরিমাণ যত বেশি, তার ভর তত বেশি। বিজ্ঞানী মহলে একটা সুপরিচিত উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করা যাক। একটি ঘরের দুপাশে দুটি দরজা আছে; ঘরে বেশ কিছু লোক ইতস্তত ঘোরাফেরা করছেন। একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ যদি এক দরজা দিয়ে ঢুকে অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান, তাঁর বিশেষ সময় লাগবে না, কারণ তাঁর সঙ্গে কারোরই কথা হবে না। কিন্তু যদি এমন একজন ঢোকেন যাঁর কয়েকজনের সঙ্গে পরিচিতি আছে, স্বাভাবিকভাবেই তিনি দাঁড়িয়ে পড়ে বা গতি কমিয়ে অন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন, ফলে তাঁর ঘর পেরোতে সময় লাগবে। আর যদি প্রবেশকারী কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি হন, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে, সেলফি তুলতে, অটোগ্রাফ নিতে হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে; ফলে তাঁর অনেকটাই বেশি সময় লাগবে। আমাদের উপমাতে ঘরের মধ্যের মানুষজন হলেন হিগস ক্ষেত্র এবং প্রবেশকারী হলেন মৌলিক কণা; ক্ষেত্রের সঙ্গে ক্রিয়ার মাধ্যমে কণার ভরের সৃষ্টি হচ্ছে। ভরশূন্য কণা আলোর গতিতে চলাফেরা করে, ভর বৃদ্ধি পেলে তার বেগ কমে যায়। ক্রিয়া যত বেশি, ভরও তত বেশি।
প্রায় একই সময়ে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রাঁসোয়া আংলেয়ার ও রবার্ট ব্রাউট, এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটার হিগস, এবং লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের জেরাল্ড গুরালনিক, রিচার্ড হ্যাগেন, ও টমাস কিবল প্রায় একই ধরনের প্রস্তাব করেন। হিগস একটি অতিরিক্ত কথা বলেছিলেন। এই তত্ত্বকে প্রমাণ করব কেমন করে, বিজ্ঞান প্রমাণ ছাড়া কিছু মানে না। মহাবিশ্বের সর্বত্রই এই ক্ষেত্র অবস্থান করে, কাজেই আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয় সত্যিই ক্ষেত্রের বাইরে গেলে কণাদের ভর শূ্ন্য হয়ে যায় কিনা। হিগস বলেছিলেন যে এই ক্ষেত্রকে কখনো কখনো একটা কণার আকারে দেখা যাবে। আগের উপমাতে ফিরে যাই, ধরা যাক ঘরে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন, সেই কথা শুনতে অনেকে ভিড় করবে। আবার শ্রোতাদের মধ্যে একজন অন্য একজনকে বলতে গেলেন, আরো কয়েকজন শুনতে এলেন, তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালালেন। এভাবে একটা জটলা ঘরের এক পাশ থেকে অন্য পাশে চলে গেল। হিগস বোসন হিগস ক্ষেত্রের সেইরকম এক উত্তেজনা, একে আমাদের যন্ত্রে খুঁজে পাওয়া গেলে প্রমাণ হবে যে বিজ্ঞানীদের ধারণা ঠিক। এই কণাটি বোসন, কারণ এ বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে।
আমরা আগে বলেছি যে মোট চার রকমের বল আছে। বিজ্ঞানীরা অনেকেই মনে করেন যে এগুলো আসলে একটা বলেরই রকম ফের। আইনস্টাইন তাঁর জীবনের শেষ প্রায় চল্লিশ বছর এই বিষয়টা প্রমাণ করার চেষ্টা করে বিফল হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে আমরা সেই লক্ষ্যে কিছুটা এগিয়েছি। এ বিষয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হল দুর্বল এবং তড়িৎচুম্বক বলকে এক জায়গায় নিয়ে আসা। এই কাজটা মূলত করেছেন দুই মার্কিন বিজ্ঞানী স্টিভেন ভাইনবার্গ ও শেলডন গ্লাসো এবং পাকিস্তানজাত বিজ্ঞানী আবদুস সালাম। এই বলের নাম হল ইলেক্ট্রো-উইক বল। তত্ত্বটা যদি ঠিক হয় তাহলে তিনটে বলকণা পাওয়া যাওয়া উচিত। এরাই হল দুর্বল বলের কণা যাদের কথা আগে বলেছি। এদের মধ্যে দুটোকে আমরা বলি W+ ও W-; এদের আধান যথাক্রমে ইলেকট্রন ও পজিট্রনের সমান। তৃতীয় কণাটার নাম Z0, এর তড়িতাধান নেই। ১৯৭৯ সালে এই তিন বিজ্ঞানী তাদের কাজের জন্য নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন। ইলেক্ট্রোউইক বল যে সত্যিই অসীম মানদের তাডাতে পারে, তা দেখানোর জন্য জেরার্ড এট হুফ্ট ও মার্টিন ভেলটম্যানকে ১৯৯৯ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
পরীক্ষাগারে প্রোটনের থেকে ভারী কণা বানাতে হলে চাই বিশাল কণাত্বরক। তখনো এলএইচসি তৈরি হয়নি। সার্নে সুপার প্রোটন সাইক্লোট্রনে ১৯৮৩ সালে প্রোটন প্রোটন সংঘর্ষে এই দুই কণার সন্ধান পাওয়া গেলো। দেখা গেল W+ বোসনের ভর 80.4 GeV, আর Z0 বোসনের ভর 91.2 GeV। (আইনস্টাইনের সূত্র থেকে আমরা সাধারণত কণার ভরকে শক্তির এককে লিখে থাকি। 1 GeV=1000 MeV। প্রোটনের ভর হল 938.3 MeV, ইলেকট্রনের ভর 0.511 MeV।) বিরাট এক বিজ্ঞানীদল এই কাজটা করেছিলেন যার নেতৃত্বে ছিলেন কার্লো রুবিয়া এবং সাইমন ভ্যান ভার মির। পরের বছরই এঁরা দুজন তাঁদের কৃতিত্বের জন্য নোবেল পুরস্কার পান। পীন বলের তত্ত্বকেও কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের মতো একই রকম রূপ দেওয়া সম্ভব হয়েছে, সেই আলোচনাতেও আর যাচ্ছি না। সেখানে বলকণার ভর শূন্য, তাই হিগস ক্ষেত্রের কোনো ভুমিকা নেই।
ইলেক্ট্রো-উইক তত্ত্বের সাফল্যের পরে বিজ্ঞানীরা বোঝেন যে হিগসদের তত্ত্বের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। হিগস বোসন কণাকে যন্ত্রে তৈরি করা মোটেই সহজ নয়, কারণ এর ভর খুব বেশি। আধুনিক গবেষণাগারে কণাত্বরক দিয়ে উচ্চশক্তিতে দুটি কণার সংঘর্ষ ঘটিয়ে নতুন কণা সৃষ্টি করা হয়। আমরা আইনস্টাইনের ভর ও শক্তির সমতুল্যতা সূত্র জানি, সুতরাং বেশি ভরের কণা সৃষ্টি করতে হলে সংঘর্ষের শক্তি অবশ্য বেশি হতে হবে। যে কণাত্বরক যত বড়, তা দিয়ে তত উচ্চশক্তির সংঘর্ষ ঘটানো সম্ভব। অবশ্য হিগস কণার ভর কত তা স্ট্যান্ডার্ড মডেল থেকে জানা যায় না, তবে ভর কম হলে আমাদের ছোটখাটো কণাত্বরকে তাকে আগেই খুঁজে পাওয়া যেত। পৃথিবীর সব থেকে বড় কণাত্বরক, এলএইচসি, যার রিংটার পরিধি হল সাতাশ কিলোমিটার, তা দিয়েই শেষ পর্যন্ত হিগস বোসনকে খুঁজে পাওয়া গেল; দেখা গেল তার ভর প্রোটনের ভরের মোটামুটি একশো তেত্রিশগুণ, 125.1 GeV। হিগস বোসন খুবই স্বল্পস্থায়ী, সৃষ্টির পরে পরেই তা ভেঙে অন্য অনেক কণা সৃষ্টি হয়। সেই সমস্ত কণা আমাদের যন্ত্রে ধরা পড়ে, তার থেকে বোঝা গেল যে সত্যিই হিগস কণা তৈরি হয়েছিল। এই গবেষণাতে ভারত সহ অনেক দেশের বিজ্ঞানীরা যুক্ত ছিলেন। হিগস বোসনের সন্ধান পাওয়ার পরের বছরেই হিগস ও ফ্রাঁসোয়া আংলেয়ারকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
তাঁর আবিষ্কারকে ঘিরে এত উত্তেজনা হিগস নিজে অপছন্দ করতেই পারেন, কিন্তু সন্দেহ নেই যে হিগস ও অন্যান্যরা বিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছেন। নোবেল পুরস্কারের আগেই হিগস পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় সমস্ত পরিচিত পুরস্কারই পেয়েছেন, তাদের মধ্যে আছে হিউজেস পদক, রাদারফোর্ড পদক, উল্ফ পুরস্কার, ডিরাক পদক, সাকুরাই পদক, অস্কার ক্লাইন সম্মান, ইত্যাদি। নোবেল পুরস্কারের পরে পাওয়া সম্মানের মধ্যে আছে বিজ্ঞানে পৃথিবীর প্রাচীনতম পুরস্কার, রয়্যাল সোসাইটির কপলি পদক। পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
No comments:
Post a Comment