Friday 30 October 2020

বেকনপন্থী অক্ষয়কুমার: দ্বিশতবর্ষে ফিরে দেখা


বেকনপন্থী অক্ষয়কুমার: দ্বিশতবর্ষে ফিরে দেখা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

একটি বেকন্‌ – একটি বেকন্‌ – একটি বেকন্‌ তাঁহাদের আবশ্যক হইয়াছিল।

       ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনের (১৫৬১-১৬২৬) চিন্তাধারা আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জন্ম দিয়েছিল। তাঁকে দর্শনে এম্পিরিসিজম বা অভিজ্ঞতাবাদের জনক বলা হয়। অভিজ্ঞতাবাদ অনুযায়ী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে জ্ঞানলাভ সম্ভব, এবং জ্ঞানের একমাত্র বা প্রাথমিক উৎস হল অভিজ্ঞতা। বেকন মনে করতেন যে প্রকৃতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ ও আরোহী যুক্তির প্রয়োগই হল বিজ্ঞানের নিয়ম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র পথ। এর সঙ্গে তিনি জোর দিয়েছিলেন পরীক্ষা করে সেই সিদ্ধান্তের সত্যতা যাচাইয়ের উপর। বিজ্ঞানীকে সবসময়েই নিজের সিদ্ধান্ত সম্পর্কেও সন্দিহান থাকতে হবে। অভিজ্ঞতাবাদ ও আরোহী যুক্তির সম্মিলনই ইউরোপে মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান ধ্যানধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানের নবজন্ম ঘটিয়েছিল। বেকনের মতে বিজ্ঞানের লক্ষ্য হল মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি। আমাদের দেশে বেকনের প্রথম অনুসারী রামমোহন রায়, পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থনে ১৮২৩ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে লেখা রামমোহনের সেই বিখ্যাত চিঠিতে তিনি বারবার বেকনের মতকেই নিজের সমর্থনে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তিনি বেকনের পাশাপাশি বেদান্তের চর্চাও চেয়েছিলেন, স্পষ্টতই তা স্ববিরোধী। বেদান্তের ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’, এই উক্তির সঙ্গে অভিজ্ঞতাবাদকে মেলানো সম্ভব নয়। আধুনিক বিজ্ঞানের ভগীরথ বেকনের আমাদের দেশে প্রথম সার্থক শিষ্য তাহলে কে?
       এই বছর আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষ পালন করছি। সমাজ সংস্কার, নারী শিক্ষার প্রসার, আধুনিক শিক্ষাচিন্তা – নানা দিক দিয়ে বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর সমবয়সী ও ঘনিষ্ঠ একজনের কথা আমরা প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। এ বছর তাঁরও জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে, তিনি অক্ষয়কুমার দত্ত। বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান রচনাতে তিনি পথিকৃৎ, সেই কথা যদিও বা মনে রেখে থাকি, আমরা ভুলতে বসেছি তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা ও দর্শনচিন্তার কথা। এই দুই ক্ষেত্রে অক্ষয়কুমারের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দিয়েছিল বেকনের দর্শন। বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দু’জনেই বেকনের অভিজ্ঞতাবাদের অনুসারী ছিলেন। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে তা জানতে পারি বারাণসীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ব্যালান্টাইনের নির্ধারিত সংস্কৃত কলেজের পাঠক্রম বিষয়ে তাঁর চিঠি ও রিপোর্টে, কিন্তু সেই সময় তা প্রকাশ্যে আসে নি।  বিদ্যাসাগর এ বিষয়ে তাঁর মত আলোচনাতে উৎসাহী ছিলেন না, তাঁর সেই সময়ও ছিল না। যিনি প্রথম আমাদের দেশে অভিজ্ঞতাবাদকে আত্মস্থ করে তার ধ্বজা প্রকাশ্যে তুলে ধরেছিলেন তিনি অক্ষয়কুমার দত্ত।


       খুব সংক্ষেপে অক্ষয়কুমারের জীবন সম্পর্কে জেনে নিই। তাঁর জন্ম ১৮২০ সালের ১৫ জুলাই বর্ধমানের চুপীগ্রামে। বাবার নাম পীতাম্বর দত্ত, মা দয়াময়ী। একসময়ে অবস্থাপন্ন হলেও অক্ষয়কুমারের জন্মের সময় তাঁদের পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল না। ন’বছর বয়সে তাঁর জাঠতুতো দাদা হরমোহন দত্ত তাঁকে খিদিরপুরে নিজের কাছে এনে রাখেন। কিন্তু আগে বাবা বা পরে দাদা কেউই অক্ষয়কুমারের পড়াশোনা নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতেন না। তাঁদের অবহেলাতে ছ’টা বছর নষ্ট হওয়ার পরে কিশোর অক্ষয়কুমারের শিক্ষালাভের আগ্রহেই তাঁকে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ভর্তি করতে হয়। সেই সময় তিনি থাকতেন অন্য এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কাছে, তাঁর আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভালো ছিল না। এক সময় স্কুলে মাইনে বাকি পড়েছিল, কিন্তু প্রধান শিক্ষক গৌরমোহন আঢ্য তাঁর অসাধারণ ছাত্রটিকে সেই কারণে স্কুল ছাড়তে দেন নি।
       কিন্তু পারিবারিক কারণে স্কুল ছাড়তেই হয়েছিল তাঁকে, ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে তিনি পড়তে পেরেছিলেন মাত্র আড়াই বছর। আগেই পনেরো বছর বয়সে বাবা মায়ের চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছেন, স্ত্রীর নাম নিমাইমণি। তাঁর যখন উনিশ বছর বয়স, বাবা মারা গেলেন। মা তাঁকে পড়া ছেড়ে অর্থ উপার্জন শুরু করতে বাধ্য করেন। অঙ্ক ও ইংরাজি শিখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন।পাশাপাশি স্কুল ছাড়লেও নিজে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এমন কি মেডিক্যাল কলেজেও ক্লাস করেছিলেন। শিখেছিলেন সংস্কৃত, ফারসি, ইংরাজি, লাতিন, গ্রিক, হিব্রু, ফরাসি ও জার্মান ভাষা।
       তাঁর লেখালেখি শুরু হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকাতে। তাঁর রচনা তাঁকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নজরে এনেছিল। দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা চালু করেছিলেন, অক্ষয়কুমার নিযুক্ত হলেন সম্পাদক। দুজনের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থায়ী হয়নি, সেই প্রসঙ্গে পরে আসব। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনার সময় তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের, তিনি তাঁকে নর্মাল স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে নিয়োগ করেন। অক্ষয়কুমার অনিচ্ছার সঙ্গে সেই চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনিচ্ছার কারণ, পড়াশোনাতে ব্যাঘাত ঘটবে। খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিন বছর পরে তিনি সেই কাজ ছাড়তে বাধ্য হন। বিদ্যাসাগর তাঁর জন্য মাসিক পঁচিশ টাকার বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। অবশ্য তার কিছুদিন পরেই তিনি সেই বৃত্তি প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর লেখা বইয়ের বিক্রি থেকে যে টাকা তিনি সেই সময় আয় করতে শুরু করেছিলেন, তাতে তিনি কলকাতা ও তার আশেপাশে একাধিক বাড়ি কিনতে সক্ষম হয়েছিলেন। বালিতে নিজের বাড়িতে একটা ভূতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা ও ল্যাবরেটরি তৈরি করেছিলেন, বাড়ির বাইরে স্থাপন করেছিলেন বোটানিক্যাল গার্ডেন। প্রচণ্ড শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও লেখালেখি ও গবেষণা চালিয়ে গিয়েছিলেন অক্ষয়কুমার। শেষ পর্যন্ত  ২৮ মে ১৮৮৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
       বাংলা ভাষার বিজ্ঞান সাহিত্যের সূচনা করেছিলেন অক্ষয়কুমার। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে ‘ভূগোল’ (প্রকাশকাল ১৮৪১), ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ (প্রথম ভাগ, ১৮৫১; দ্বিতীয় ভাগ ১৮৫৩) ‘চারুপাঠ’ (প্রথম ভাগ ১৮৫৩; দ্বিতীয় ভাগ ১৮৫৪; তৃতীয় ভাগ ১৮৫৯),‘পদার্থবিদ্যা’ (১৮৫৬), ধর্মনীতি (১৮৫৬), ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ (প্রথম ভাগ ১৮৭০; দ্বিতীয় ভাগ ১৮৮৩) প্রভৃতি। প্রথম দিকের বইগুলি মূলত অনুবাদ ও সংকলন। অনুবাদ বলে তাদের তুচ্ছ করার কোনো কারণ নেই, বিজ্ঞানের সিঁড়িতে পা রাখার ক্ষেত্রে অনুবাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধ্য যুগে আরব সভ্যতাতে বিজ্ঞানের চোখ-ধাঁধানো বিকাশের সূচনা হয়েছিল গ্রিক ও সংস্কৃত থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা অনুবাদের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে আবার আরবি থেকে লাতিন ভাষায় অনুবাদ ইউরোপের বিজ্ঞানে জোয়ার আনে।  অক্ষয়কুমারের অনুবাদ কিন্তু শুধুমাত্র ভাষান্তর নয়, তাতে যথেষ্ট মৌলিক চিন্তাভাবনার ছাপ আছে। বাংলাতে বিজ্ঞান রচনার জন্য একই সঙ্গে তাঁকে সৃষ্টি করতে হয়েছিল পরিভাষার। এক কথায় বলতে গেলে বাংলাতে বিজ্ঞান লেখার গদ্যরীতিই তাঁকে গড়ে নিতে হয়েছিল।  
       একটি প্রবন্ধে অক্ষয়কুমারের কর্মজীবনের সমস্ত দিকের প্রতি সুবিচার করা অসম্ভব। আগেই বলেছি, বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে অক্ষয়কুমারের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। যখন ভারতীয়রা বিদেশী শাসনের গুণগানে ব্যস্ত সেই সময় তিনি সরাসরি বিদেশী শাসনকে দেশবাসীর দুরবস্থার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। নীলকরদের অত্যাচার ও চিরস্থায়ী ব্যবস্থাতে সৃষ্ট জমিদারদের প্রজাশোষণ সম্পর্কে সমালোচনা করতে তিনি পরাঙ্মুখ ছিলেন না। শেষ বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ জমিদার দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে অক্ষয়কুমারের বিবাদে সরাসরি না এলেও নিশ্চয় তার ছায়া পড়েছিল। ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ রচনা করতে গিয়ে তিনি তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে জাতিপ্রথা মানেন নি। পঞ্জিকাতে যে সময়কে অশুভ বলা হত, কুসংস্কার বিরোধী অক্ষয়কুমার সেই সময়কেই যাত্রা শুরুর জন্য বেছে নিতেন। কোনো পুজোর দিনে অন্যরা যখন স্নানের উদ্দেশ্যে গঙ্গার দিকে চলেছে, তখন গঙ্গানদীর পাশে বাড়ি থাকা সত্ত্বেও অক্ষয়কুমার সবাইকে দেখিয়ে পুকুরে চান করতেন। অক্ষয়কুমারের বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরোধিতা, বিধবা বিবাহের প্রতি সমর্থন তাঁকে সেই যুগে সংস্কার আন্দোলনের সামনের সারিতে স্থান করে দেয়। বিবাহিত জীবনে স্বামী ও স্ত্রীর সমানাধিকারের প্রতি তাঁর সমর্থন এক স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে এমনই সমর্থন পেয়েছিল যে অভিভাবকরা স্কুলটাই পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এই ক্ষুদ্র লেখাতে আমরা শুধু অক্ষয়কুমারের বেকন অনুরাগের প্রতিই দৃষ্টি রাখব।
       অক্ষয়কুমারকে আকর্ষণ করেছিল বিজ্ঞান, তা পড়তে গিয়ে তাঁর পরিচয় হয় বেকনের অভিজ্ঞতাবাদের সঙ্গে। অভিজ্ঞতাবাদই সেই যুগে সবচেয়ে আধুনিক ও সার্থক বিজ্ঞানদর্শন। প্রথম জীবনে স্কটল্যান্ডের চিন্তাবিদ জর্জ কুম্বের মতের দ্বারা অক্ষয়কুমার প্রথম দিকে বিশেষ প্রভাবিত ছিলেন, তাঁর ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ হল কুম্বের ‘Constitution of Man in Relation to External Objects’ বইটির ভাবানুবাদ। ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ প্রকাশের পরে পরেই তিনি তা পড়েছিলেন। হয়তো অক্ষয়কুমারই আমাদের দেশে প্রথম ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের বৈপ্লবিক তাৎপর্য বুঝতে পেরেছিলেন। ডারউইন ছিলেন স্বঘোষিত ভাবেই বেকনের অনুগামী। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও তার থেকে সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ আধুনিক পাঠককেও চমকে দেয়।  ডারউইনের মত প্রচারে জীববিদ টমাস হাক্সলির অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। অর্থনীতিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল বেকনের আরোহী যুক্তিবাদকে আরও শাণিত করেছিলেন। আইজ্যাক নিউটনের চিন্তাধারার উপর বেকনের প্রভাব স্পষ্ট। নিউটনের একটি বিখ্যাত উক্তি, “Hypothesis non fingo”, আমি কোনো রকম পূর্বানুমান করি না। আগে থেকে কোনো ধারণা না করে পরীক্ষার মাধ্যমে যা পাওয়া যায়, তাই মেনে নেওয়ার এই চিন্তা বেকন দর্শনেরই অনুরূপ। রামমোহন যে বিখ্যাত চিঠিতে সুস্পষ্টভাবে বেকনের দর্শনকেই ব্রিটেন তথা ইউরোপের উন্নতির কারণ হিসাবে বর্ণনা করেছেন, তা অক্ষয়কুমার তাঁর বইতে উদ্ধৃত করেছিলেন। নিজের বাড়িতে রামমোহন, নিউটন, ডারউইন, টমাস হাক্সলি  ও জন স্টুয়ার্ট মিলের ছবি টানিয়ে অক্ষয়কুমার তাকে দেবালয় আখ্যা দিয়েছিলেন। লক্ষণীয় যে এই পাঁচজনই বেকনের দর্শনের অনুসারী। বেকনই হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর আরাধ্য। অনেকের মতে জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি হয়ে পড়েছিলেন অজ্ঞেয়বাদী, তিনি মনে করতেন ঈশ্বর থাকা বা না থাকার কোনো প্রমাণ নেই, যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যাবে না। এই কথা নিয়ে এই লেখাতে পরে বিস্তারিত আলোচনা করব।
       অক্ষয়কুমারের প্রার্থনা-ইকুয়েশন একসময় কলকাতায় ঝড় তুলেছিল। হিন্দু হস্টেলের একদল ছাত্র একবার তাঁকে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার উপযোগিতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, কৃষক পরিশ্রমের মাধ্যমে কী পায়? উত্তর আসে শস্য। পরের প্রশ্ন হল পরিশ্রমের সঙ্গে প্রার্থনা যদি করে, তাহলে কী পাবে। আবারও উত্তর এলো শস্য। সুতরাং অক্ষয়কুমার বীজগণিতের সমীকরণ লিখলেন:
পরিশ্রম = শস্য
পরিশ্রম + প্রার্থনা = শস্য
অতএব, প্রার্থনা = ০
বেকনীয় অভিজ্ঞতাবাদের ছাপ এখানে স্পষ্ট। আধুনিক যুগের দৃষ্টিতে এই যুক্তির মধ্যে যে ফাঁকি ধরা পড়বে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু উনিশ শতকের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে এই যুক্তিবিন্যাস কলকাতার শিক্ষিত মহলে আলোড়ন তুলেছিল। অক্ষয়কুমার কিন্তু তাতে খুশি হননি, বলেছিলেন, “বিশুদ্ধবুদ্ধি বিজ্ঞানবিৎ লোকের পক্ষে যাহা অতি বোধ-সুলভ, তাহা এদেশীয় লোকদের নূতন বোধ হইল এটি বড় দুঃখের বিষয়।” অর্থাৎ বিজ্ঞান দর্শনের প্রাথমিক পাঠই ভারতবর্ষে প্রসারিত হয়নি।
       দেবেন্দ্রনাথের স্থাপিত তত্ত্ববোধিনী সভার সঙ্গে অব্রাহ্মরাও যুক্ত হয়েছিলেন, বিদ্যাসাগরের নাম তাঁদের মধ্যে স্মরণীয়। অক্ষয়কুমার কিন্তু ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, দেবেন্দ্রনাথ সহ প্রথম একুশ জন ব্রাহ্মের মধ্যে তিনিও একজন। সাধারণে চলিত হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতাতে তিনি আগেই বিশ্বাস হারিয়েছিলেন, কারণ বিশ্বইতিহাস পাঠ তাঁকে দেখিয়েছিল যে গ্রিক বা রোমান সভ্যতার যুগে ইউরোপের প্রচলিত ধর্মের দেবদেবীদের স্থান রয়েছে শুধু বইয়ের পাতায়। ব্রাহ্মধর্মের একেশ্বরবাদ তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল।
       ব্রাহ্মধর্মের দর্শন নির্ধারণে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। হিন্দুধর্মের বিশ্বাস বেদ অপৌরুষেয় অর্থাৎ মানুষের সৃষ্টি নয়, ঈশ্বরপ্রণীত; তাই তা অভ্রান্ত। প্রথম প্রথম দেবেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য  ব্রাহ্মরাও তাই বিশ্বাস করতেন। অক্ষয়কুমার বেদ ও বেদান্তের অভ্রান্ততা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। ধর্মগ্রন্থ যে যুক্তিনিরপেক্ষ বিশ্বাসের কথা বলে, তাঁর বেকনীয় দর্শনের সঙ্গে তা একেবারেই মেলে না। তাঁর যুক্তির যথার্থতা মেনে দেবেন্দ্রনাথ বেদবেদান্তের অভ্রান্ততার ধারণা পরিত্যাগ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সাধে কি আর তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘বেকন পড়িয়া করে বেদের সিদ্ধান্ত’? অনেক পরে ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইতে অক্ষয়কুমার লিখেছেন, ‘বেদের যে অংশ যে ব্যক্তির কৃত স্পষ্টই লিখিত আছে, এবং তন্মধ্যে নানা স্থানে ও নানা কালে বিদ্যমান লোকসমূহের ভক্তি শ্রদ্ধা, রাগ দ্বেষ, কাম ক্রোধ, বিপদ আপদ, যুদ্ধ বিবাদ, ব্যসন বাণিজ্য ইত্যাদি অশেষ প্রকার ব্যাপারের বিবিধ বৃত্তান্ত বিনিবেশিত রহিয়াছে, তথাপি জৈমিনি মহাশয়ের মত-প্রভাবে তাহা অপৌরুষেয়, ... এইরূপ অঙ্গীকার করিতে হইবে।
       অক্ষয়কুমার কালক্রমে বুঝেছিলেন যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ধর্মের সত্যাসত্য নির্ণয় বাঙালি ভদ্রলোকের কাছে খুব গ্রহণযোগ্য হবে না। নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে তা আরও পরিষ্কার হয়। ভবানীপুর  ব্রাহ্মসমাজের এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘ভাস্কর ও আর্য্যভট্ট এবং নিউটন্‌ ও লাপ্লাস্‌ যে কিছু যথার্থ বিষয় উদ্‌ভাবন করিয়াছেন, তাহাও আমাদের শাস্ত্র। গৌতম ও কণাদ এবং বেকন ও কোন্ত্‌ যে-কোন প্রকৃত তত্ত্ব প্রচার করিয়াছেন, তাহাও আমাদের শাস্ত্র।‘ লাপ্লাস ও কোঁত ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না, খোদ সম্পাদকের বক্তৃতাটি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে ছাপার সময় সেই দুটি নাম তাঁর অজ্ঞাতসারেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। অক্ষয়কুমারের পত্রিকা সম্পাদনা সম্পর্কে দেবেন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়ে লিখেছিলেন ‘‘কতগুলান নাস্তিক গ্রন্থাধ্যক্ষ হইয়াছে, ইহাদিগকে এ পদ হইতে বহিষ্কৃত না করিয়া দিলে ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারের সুবিধা নাই।’ এই ‘নাস্তিক’-রা স্পষ্টতই ছিলেন অক্ষয়কুমার ও বিদ্যাসাগর। ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ পড়ে দেবেন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি কোথায়, আর তিনি কোথায়। আমি খুঁজিতেছি ঈশ্বরের সঙ্গে আমার কী সম্বন্ধ; আর তিনি খুঁজিতেছেন, বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির কী সম্বন্ধ; আকাশ পাতাল প্রভেদ।’ এই প্রভেদের জন্য অক্ষয়কুমারকে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয়েছিল।
       আধুনিক মনে প্রশ্ন জাগে, ধর্মের সত্যতা বিচারে বৈজ্ঞানিক যুক্তির প্রয়োগ কি সম্ভব? অক্ষয়কুমারের অবস্থান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। বেদবেদান্তের অভ্রান্ততা বিষয়ে তাঁর মত আগেই আলোচনা করেছি। এও দেখেছি যে প্রার্থনার সাহায্যে কোনো বাস্তব ফল পাওয়া যায় বলে তিনি বিশ্বাস করতেন না। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার পাতাতে তিনি যে বিজ্ঞানের প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেছিলেন, তার মূল লক্ষ্য ছিল প্রকৃতির নিয়ম জানা। প্রকৃতি নিয়ম মেনে চলে, এবং সেই নিয়ম একজন নিয়মস্রষ্টা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ, অক্ষয়কুমারের এই অবস্থানকে বলা যায় ডীইস্‌ম। জর্জ কুম্বও ছিলেন ডীইস্ট।  ডীইস্টরা ধর্মগ্রন্থের আপ্তবাক্যে বিশ্বাস করেন না, তাঁরা যুক্তি ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জগৎস্রষ্টা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চান। তাই অক্ষয়কুমারের শাস্ত্রকারদের মধ্যে আর্যভট্ট, নিউটন, লাপ্লাসদের স্থান পাওয়া মোটেই আকস্মিক নয়। যুক্তি ও পর্যবেক্ষণ – বেকনীয়  দর্শনের এই দুই মূল স্তম্ভের সঙ্গে ডীইস্‌মের উপর উপর মিল খুঁজে পেয়েছিলেন অক্ষয়কুমার। কিন্তু সম্ভবত তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
       এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে হয় একটি বিখ্যাত উক্তি, ‘ডীইস্ট হল সেই যে নাস্তিক হয়ে ওঠার আগেই মারা গেছে। অক্ষয়কুমার নাস্তিক না হলেও সম্ভবত অজ্ঞেয়বাদী হওয়া পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। ডারউইনের আগে বিশ্বাসীরা ঈশ্বরের সমর্থনে যে যুক্তি দেখাতেন, তাকে বলা যায় Intelligent design-এর যুক্তি। সেই অনুসারে প্রতিটি জীব তার পরিবেশের সঙ্গে এমন ভাবে খাপ খেয়ে যায় যে কোনো বুদ্ধিমান স্রষ্টা ছাড়া তা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে ডীইস্‌মের মিল খুব স্পষ্ট। অক্ষয়কুমারও লিখেছেন, ‘জীবের শরীর অতি আশ্চর্য্য শিল্প-কার্য্য। তাহার প্রত্যেক অঙ্গ পরাৎপর পরম শিল্পকরের নিরুপম নৈপুণ্য-পক্ষে নিরন্তর সাক্ষ্যদান করিতেছে।  ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব সেই যুক্তিকে নস্যাৎ করে দেয়। বিবর্তনতত্ত্বের পাঠ অক্ষয়কুমারকেও নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করেছিল। অক্ষয়কুমার আগে লিখেছিলেন, ‘যে পক্ষী যেরূপ দ্রব্য আহার করে জগদীশ্বর তাহার চঞ্চু তদুপযোগী করিয়া দিয়াছেন।‘ ফিঞ্চ পাখির ঠোঁট সম্পর্কে ডারউইনের বিখ্যাত আলোচনা পড়ে অক্ষয়কুমার নিশ্চয় বুঝেছিলেন যে তাঁর যুক্তি ঘোড়ার আগে গাড়িকে জুড়ছে, প্রকৃতপক্ষে পাখির খাদ্যাভ্যাসই তার চঞ্চুর গঠন নির্ধারণ করেছে। সুগভীর ঈশ্বরবিশ্বাসী ডারউইন তাঁর নিজের তত্ত্বের যুক্তি মেনে অজ্ঞেয়বাদের পথ ধরেছিলেন। অক্ষয়কুমার শেষ জীবনে নিজেকে আস্তিক বেকনের সঙ্গে সঙ্গে নাস্তিক অগুস্ত কোঁতেরও অনুগামী বলে ঘোষণা করেছিলেন। তবে এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে শেষ বয়সে অক্ষয়কুমারর অজ্ঞেয়বাদী হয়ে গিয়েছিলেন, সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সবাই একমত নন। অক্ষয়কুমার নিজে সে বিষয়ে তাঁর জীবনীকার মহেন্দ্রনাথ রায়ের প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেননি।  
       অক্ষয়কুমারের অক্ষয় কীর্তি ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’। এই বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়াও সীমিত পরিসরের মধ্যে সম্ভব নয়। এটি তাঁর পুরোপুরি মৌলিক রচনা। ভারতের দুই খণ্ডে বিভক্ত বইয়ের দুটি দীর্ঘ উপক্রমণিকা আছে, যেখানে তিনি বেকনের পদ্ধতির প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন যে ভারতীয় ষড়দর্শনের অনেকাংশই নিরীশ্বরবাদী। কেন আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম ভারতে হল না তিনি আলোচনা করেছেন। দীর্ঘ আলোচনা না করে বেকনের নামোল্লেখ আছে এমন কয়েকটি অংশ উদ্ধৃত করি।
       সাংখ্য দর্শন আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘সাঙ্খ্য-শাস্ত্রের কোন কোন অংশে সমধিক বুদ্ধির প্রাখর্য্য প্রদর্শিত হইয়াছে তাহার সন্দেহ নাই। কিন্তু এ অংশটি নিতান্ত মনঃকম্পিত এখন একথা বলা বাহুল্য। যে সময়ে, ভূমণ্ডলে বিজ্ঞান-রাজ্যের পথ-প্রদর্শক বেকন্‌ ও কোন্তের জন্ম হয় নাই, সে সময়ে আর অধিক প্রত্যাশা করাই বা কেন?’ অর্থাৎ তিনি পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা ছাড়া শুধুমাত্র চিন্তার মাধ্যমে সত্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনাকে অস্বীকার করছেন।
       কণাদ প্রবর্তিত বৈশেষিক দর্শনে পরমাণুর কথা আছে। সে সম্পর্কে সমধিক শ্রদ্ধা সত্ত্বেও তাঁর আক্ষেপ, ‘... সূত্রপাতেই অবশেষ হইল। অঙ্কুর রোপিত হইল, কিন্তু বর্ধিত, পুষ্পিত ও ফলিত হইল না। উহা সংস্কৃত, পরিবর্দ্ধিত ও বহুলীকৃত করিয়া ফল-পুষ্প-শোভায় সুশোভিত করা ভারতভূমির ভাগ্যে ঘটিল না। কালক্রমে সে সৌভাগ্য বেকন্‌, কোন্ত্‌ ও হম্বোল্‌টের জন্মভূমিতে গিয়া প্রকাশিত ও প্রাদুর্ভূত হইয়া উঠিল। তথাপি আমাদের সুশ্রুত, চরক, আর্য্যভট্টাদির পদ-কমলে বার বার নমস্কার!’
       পরে তিনি লিখেছেন, ‘... দার্শনিক গ্রন্থকারের অনেকেই সতেজ বুদ্ধির সুপুষ্ট বীজ লইয়া জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। যদি তত্ত্বানুসন্ধানের প্রকৃত পথাবলম্বন পূর্ব্বক বিশুদ্ধ বিজ্ঞান-মার্গে বিচরণ করিতে পারিতেন, তবে বহুকাল পূর্বে ভারত-ভূমিও ইয়ুরোপ-ভূমির ন্যায় এ অংশে ভূ-স্বর্গ-পদে অধিরূঢ় হইতেন তাহার সন্দেহ নাই। তাঁহারা বিশ্বের যথার্থ প্রকৃতি ও সেই প্রকৃতি-সিদ্ধ নিয়মাবলী নির্দ্ধারণ পূর্ব্বক কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য-নিরূপণের নিশ্চিত উপায় চেষ্টা না করিয়া কেবল আপনাদের  অনুধ্যান-বলে দুই একটি প্রকৃত মতের সহিত অনেকগুলি মনঃকল্পিত মত উদ্ভাবন করিয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের একটি পথ প্রদর্শকের অভাব ছিল। একটি বেকন্‌ – একটি বেকন্‌ – একটি বেকন্‌ তাঁহাদের আবশ্যক হইয়াছিল।  স্পষ্টতই অক্ষয়কুমার অভিমত প্রকাশ করছেন যে প্রকৃত বিজ্ঞান দর্শনের অভাবেই ভারতে বিজ্ঞানের বিকাশ হতে পারেনি।
       অপ্রাসঙ্গিক হলেও অক্ষয়কুমারের একটি উদ্ধৃতি তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। বেকনের প্রয়োজনের কথা বলে তিনি লিখছেন যে সুসজ্জিত সৈন্যদলও দক্ষ সেনাপতির অভাবে ব্যর্থ হয়। ‘একটি রণজিৎ - একটি বোনাপার্ত্‌ – একটি ওয়াশিংটন্‌ আবশ্যক। যে তিনজন সেনাপতির নাম করেছেন, একজনও ইংরেজ ছিলেন না; নেপোলিয়ন ও ওয়াশিংটন তো ব্রিটেনের বিরুদ্ধেই লড়াই করেছেন। 
       প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের মধ্যে নিরীশ্বরবাদের প্রভাবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন অক্ষয় কুমার। তিনি কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন যে ঈশ্বরকে অস্বীকার করলেও বেদের অভ্রান্ততাকে বিষয়ে অধিকাংশ দর্শন একমত। বেদের অভ্রান্ততা বিষয়ে তাঁর মত আমরা আগে দেখেছি। নিরীশ্বরবাদী সাংখ্য দর্শনের প্রবর্তক কপিল সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘চিরকাল হিন্দু-সমাজে বেদের কি অতুল প্রভাব ও দুর্জ্জয় পরাক্রমই চলিয়া আসিয়াছে। কপিল ঈশ্বরের  অস্তিত্ব অক্লেশে অস্বীকার করিলেন, কিন্তু বেদের মহিমা অগ্রাহ্য করিতে পারিলেন না। তিনিও বেদার্থ প্রামাণিক বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছেন। পরবর্তীকালে টীকাকাররা বৈশেষিক দর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সাক্ষ্য খোঁজার চেষ্টা করেছেন, সে বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘কণাদ ঋষির সেইরূপ বিশ্বাস থাকিলে, সূত্রের মধ্যে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ সুস্পষ্ট না লিখিয়া তাহার অন্তর্গত শব্দ-বিশেষের অভ্যন্তর-গুহায় তাহা প্রচ্ছন্ন রাখা কি কোনরূপে সম্ভব হয়?’ সবশেষে তাঁর সিদ্ধান্ত, ‘প্রথমে কিছু ছিল না, কেবল একমাত্র অদ্বিতীয় পরমেশ্বরই বিদ্যমান ছিলেন, তিনিই পশ্চাৎ সমুদয় জগৎ সৃজন করেন, যাঁহারা কেবল ইহাকেই আস্তিকতাবাদ বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন, তাঁহাদের মতে প্রায় সমুদয় ষড়্‌দর্শনকে নাস্তিকতা-প্রতিপাদক বলিয়া উল্লেখ করিতে হয়।
        বেকনের দর্শন বিষয়ে পরবর্তীকালে নানা সমালোচনা হয়েছে, তার অধিকাংশই অবশ্য অক্ষয়কুমারের অনেক পরে। সেই সমালোচনা ঠিক না ভুল তা নিয়েও বিতর্ক আছে। এই লেখাতে তার মধ্যে যাওয়ার অবকাশ নেই। বিদ্যাসাগর জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশনের কাছে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্তদর্শন, সে সম্বন্ধে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই। তবে ভ্রান্ত হলেও এই দুই দর্শনের প্রতি হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে। সংস্কৃতে যখন এইগুলি পড়াতেই হবে তখন তার প্রতিষেধক হিসেবে ছাত্রদের ভাল ভাল ইংরেজি দর্শনশাস্ত্রের বই পড়ানো দরকার। (অনুবাদ সূত্র, বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ) এর বেশি লেখার তিনি প্রয়োজন বোধ করেন নি। অক্ষয়কুমার কোথায় ভারতীয় দর্শন কানাগলিতে ঢুকে পড়েছে বা উদ্দেশ্যহীন তর্কে সময় নষ্ট করেছে তার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এবং এই কাজে তাঁর সহায় হয়েছেন বেকন।
       আমাদের দেশে আধুনিক বিজ্ঞানদর্শনের প্রয়োজনীয়তা প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন অক্ষয়কুমার, তাঁকেই আমরা ভুলতে বসেছিলাম। আশার কথা দ্বিশতবর্ষে অক্ষয়কুমারকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ প্রকাশিত ‘দ্বিশতজন্মবর্ষে অক্ষয় কুমার দত্ত’ বইটিতে কয়েকটি ছোট কিন্তু তথ্যবহুল প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কোরক পত্রিকার বইমেলা ২০২০ সংখ্যাটিতে তাঁর জীবন ও কর্ম বিষয়ে অনেকগুলি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে।  
তথ্যসূত্র
১। আশীষ লাহিড়ী, অক্ষয়কুমার দত্ত: আঁধার রাতে একলা পথিক, দ্বিতীয় সংস্করণ, দেজ পাবলিশিং
২। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, কামারের এক ঘা, দ্বিতীয় সংস্করণ, পাভলভ ইন্সটিটিউট
৩। বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান
       অক্ষয়কুমারের লেখার উদ্ধৃতিগুলিতে বানান অপরিবর্তিত রাখা হল।

প্রকাশঃ নিশিত সাহিত্যপত্র, উৎসব সংখ্যা, অক্টোবর ২০২০
      
        
      
      

4 comments:

  1. এই লেখাটার জন্যে একঝুড়ি কৃতজ্ঞতা রেখে গেলাম।

    ReplyDelete
  2. বেদান্ত এর থেকে কারা কারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন দেখে নিন,

    ReplyDelete