Tuesday 27 October 2020

বিকিরণরোধী গোময়, রাসেলের টিপট এবং কাণ্ডজ্ঞান

বিকিরণরোধী গোময়, রাসেলের টিপট এবং কাণ্ডজ্ঞান

 গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

 

খবরে দেখলাম যে গোবর দিয়ে তৈরি চিপ মোবাইল ফোনের বিকিরণ কমিয়ে দেবে বলে দাবি উঠেছে। ফেসবুক টুইটার হোয়াটসঅ্যাপের যুগে সামাজিক মাধ্যমে মাঝেমধ্যেই এরকম অদ্ভুত দাবি শোনা যায়, তাই খুব একটা পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। কিন্তু বারবার খবরটা নজরে আসতে কৌতূহল হল; দেখলাম কথাটা বলেছেন রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগের প্রধান। অগত্যা আবার ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হতে হল। জানতে পারলাম এই আয়োগ হল এক কেন্দ্রীয় সরকারী প্রতিষ্ঠান, তার কাজ হল দেশের গবাদি পশুর উন্নতি। আয়োগের প্রধান নিজে গোবরের এই ক্ষমতা দেখেছেন বলে দাবি করেছেন। তাঁর সেই পর্যবেক্ষণ কোন গবেষণা পত্রিকাতে বেরিয়েছে অথবা গোবরের কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য তা বিকিরণ রোধ করে সে বিষয়ে কোনো কথা চোখে পড়ল না।

কিছুদিন আগে কোনো একটি বিখ্যাত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে প্রতিষ্ঠানের এক শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তি অম্লানবদনে প্রাচীন ভারতে বিমান নির্মাণ আবিষ্কার হয়েছিল বলে দাবি করলেন। ইংরাজরা সেই তত্ত্ব চুরি করেছিল। কিন্তু নিজেরা এরোপ্লেন বানালে ধরা পড়ে যাবে; তাই তারা আমেরিকানদের কাছে সেই কৌশল পাচার করে দেয়। তার থেকেই রাইট ভাইয়েরা প্লেন বানায়। তাঁর এই রোমহর্ষক গল্প শোনার পরে আমার বক্তৃতাতে আমি বিনম্রভাবে প্রতিবাদ করেছিলাম। এর পরে জনৈক শ্রোতা আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কিছু একটা নিশ্চয় ছিল, তা না হলে পুরাণ মহাকাব্যে এই কথা এলো কোথা থেকে? আমাদের অনুসন্ধান করে দেখা উচিত।’ প্রশ্নকর্তা একটি বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক। মনে পড়লো আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে গণেশের ঘাড়ের উপরে হাতির মাথা যখন লাগানো হয়েছিল বলে পুরাণে আছে, কেউ তো ছিল যে এই প্লাস্টিক সার্জারিটা করেছিল।

খবরে পড়লাম ঐ আয়োগের প্রধান আরো বলেছেন যে সেই সব বিষয় নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, যাকে এতদিন গল্প মনে করা হত। প্রথমে শুনতে খারাপ লাগে না কথাটা, গবেষণা বা অনুসন্ধান করা তো ভালোই। একটু তলিয়ে দেখলে কিন্তু বিষয়টা অত সরল লাগবে না। বিজ্ঞানে ব্যবহৃত শব্দগুলি প্রতিদিনের ভাষা থেকেই নেওয়া, তার ফলে এই ধরনের সমস্যার সৃষ্টি। সাধারণ ভাষাতে আমরা অনেক সময় বলেই থাকি, ‘এটা তোমার থিওরি,’ অর্থাৎ তোমার বিশ্বাস, কিন্তু তা সত্যি নাও হতে পারে। বিজ্ঞানে ব্যাপারটা অনেকটা আলাদা। ধরুন ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের কথা। প্রথম যখন ডারউইন ও ওয়ালেস বিবর্তনের কথা বলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার নাম দেয়া হয়েছিল তত্ত্ব বা থিওরি। তারপরে গত দেড় শতাব্দীতে তার পক্ষে এত প্রমাণ জড়ো হয়েছে যে কোনো বিজ্ঞানীর আর তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তা সত্ত্বেও তার নামটা থিওরিই রয়ে গেছে, যেমন আইস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের পক্ষে অসংখ্য প্রমাণ সত্ত্বেও তাকে আমরা থিওরিই বলে থাকি। তার মানে এই নয় যে এই সব তত্ত্বে কখনো কোনো সামান্য পরিবর্তন হবে না, কিন্তু মোটের উপর কাঠামো যে এক থাকবে তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। কিন্তু যে কোনো বিশ্বাসই বিজ্ঞানের থিওরি নয়, তাকে প্রমাণ করে দেখার দায়িত্বও বিজ্ঞানের নয়।

বিজ্ঞান কি পাল্টায় না? আজ যা গল্প, কাল তা সত্যি প্রমাণিত হতেও তো পারে। একথা ঠিক বিজ্ঞানের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল যে সে শেষ কথা বলতে পারে না। প্রতিনিয়ত নতুন উদ্ভাবন নতুন পর্যবেক্ষণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হচ্ছে, বিজ্ঞান নিজেকে পরিবর্তন করছে। এই আত্মসংশোধন ও আত্মোন্নতি একান্তভাবেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অঙ্গ। তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে আজ যা জানি তা কাল ভুল প্রমাণিত হবে। একেবারে যে তা হয় না এমন নয়, কিন্তু সেই উদাহরণ খুবই কম; এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তা আরও দ্রুত কমে আসছে। কিন্তু যাঁরা বিজ্ঞানের প্রকৃতি বোঝেননি, তাঁদের অনেকের মধ্যে এক অদ্ভুত যুক্তি শোনা যায়। ‘মানুষের জীবনে গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব অবশ্যই পড়ে, আজ বিজ্ঞান সেটা ধরতে পারেনি তো কী হয়েছে, ভবিষ্যতেও পারবে না এরকম কথা কি বলা যায়? তোমরা প্রমাণ করে দেখাও যে আমি যা বলছি তা ভুল।’ এই ধরনের কথা শোনার দুর্ভাগ্য আমাদের অনেকের হয়েছে। বক্তাকে বোঝানো কঠিন যে কোনো কিছুর বিরুদ্ধ প্রমাণ নেই মানেই তা সত্যি হয়ে যায় না। তর্কশাস্ত্রে এই ধরনের কুযুক্তিকে বলে argumentum ad ignorantiam

এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ে গেল। বাইবেলে লেখা আছে ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশাল অংশের মানুষ বিবর্তন তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। (অবশ্য কারোর বিশ্বাস অবিশ্বাসের উপর বৈজ্ঞানিক সত্য নির্ভর করে না।) তাঁদের অনেকেই বলেন বিবর্তন হল একটা থিওরি, আসলে সেটা সত্যি কিনা বিজ্ঞান এখনো নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না। খোলা মনে বিচার করতে হবে। এই খোলা মনে বিচার করার কথাটা বহু দিন ধরে শুনে আসছি। অনেক বছর আগে কলকাতার এক বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান একটি বক্তৃতা আয়োজন করেছিল। বিষয় ছিল ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন। ঈশ্বর প্রাণ বা মানুষের সৃষ্টি করেছেন, এই ধারণার পোশাকি নাম ছিল ক্রিয়েশনিজম। এখন সেটা বিজ্ঞানী মহলে উপহাসের পাত্র, তাই তার নতুন নাম হয়েছে ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন। সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক বিষয়ে বক্তৃতা কেন? উত্তর এলো, সব কিছু খোলা মনে বিচার করতে হবে, বিজ্ঞান তাই বলে। গোময়ের ক্ষেত্রে বা প্রাচীন যুগের বিমানের ক্ষেত্রেও সেই কথা কি প্রযোজ্য নয়?

বিজ্ঞান কি সত্যিই সেই কথা বলে? থালা বাজানো বা বিদ্যুতের আলো নিভিয়ে প্রদীপ জ্বালানোর কথা বলার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেননি যে তাতে করোনা ভাইরাস নির্মূল হবে, কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে সেই কথার ব্যাপক প্রচার হয়েছে। খোলা মনে তার বিচার করতে হবে কি? গুজরাটের গরুর দুধে সোনা পাওয়ার কথা পরীক্ষা করে দেখতে হবে কি? খোলা মনে বিচার করলে শুধু আমাদের জীবনে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব, ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন বা গোময়ের বিকিরণরোধী ক্ষমতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব কেন? বিষাক্ত সাপে কামড়ালে ওঝা বাঁচাতে পারবে কিনা খোলা মনে বিচার করব। মাঝেমাঝে শোনা যায় অমুক জায়গায় এক বৃদ্ধাকে ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তাহলে খোলা মনে বিচার করা উচিত মৃতা সত্যি সত্যিই ডাইনি ছিল কিনা। কথাটা প্রমাণ করার দায়িত্ব কার?

বিজ্ঞানী দার্শনিক এবং সাহিত্যে নোবেলজয়ী বার্ট্রান্ড রাসেল বিজ্ঞানে প্রমাণের দায়িত্ব কার তা একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলেন। তিনি প্রস্তাব দিলেন যে পৃথিবী আর মঙ্গলের মধ্যের কোনো এক কক্ষপথে একটা টিপট সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। রাসেলকে ভুল প্রমাণ করার জন্য কি আমরা মহাকাশযান পাঠিয়ে তন্নতন্ন করে সেই চায়ের পাত্রটা খুঁজব? পৃথিবী আর সূর্যের মধ্যের ফাঁকা জায়গায় সাতাশ লক্ষ কোটি পৃথিবীকে ধরানো যায়। এই সব জায়গা আমরা খুঁজে দেখব, নাকি রাসেলকেই বলব আপনি প্রমাণ করুন। করোনা ভাইরাসের সামনে থালা বাজিয়ে দেখব তা ধ্বংস হয় কিনা, নাকি যিনি বলছেন তাঁকে বলব আপনি দেখান? ভাবিজির পাঁপড় খেয়ে ডাক্তাররা পিপিই না পরে করোনা রোগীর চিকিৎসা করতে যাবেন, নাকি যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সেই কথা বলেছিলেন তাঁকে বলবেন যে আপনি প্রমাণ দিন?

বিজ্ঞান ভুল সংশোধনের মধ্যে দিয়ে এগোয়। তা বলে আমার বা আপনার বিশ্বাস সম্পর্কে বিজ্ঞানের কথা আজ না মিললেও কাল বা পরশু কিংবা কয়েকশো বছর পরে তা মিলে যাবে, এ যুক্তি চলে না। কোনো সন্দেহ নেই যে বিজ্ঞানের মূল কথা হল সংশয় এবং তা দূর করার জন্য পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষা নিরীক্ষা। কিন্তু তার আগে কিঞ্চিৎ কাণ্ডজ্ঞানেরও প্রয়োজন হয়। ধরা যাক কোনো সুপ্রভাতে মানুষের মাথার জায়গায় হাতির মাথা বসানো সম্ভব হল। (দয়া করে এখানেই পড়া বন্ধ করবেন না, এটা একটা অসম্ভব উদাহরণ মাত্র।) হাতির মস্তিষ্ক যুক্ত এই নতুন ‘হাঁসজারু’ কি মানুষের মতো চিন্তা করবে? হাতির স্বরযন্ত্রে মানুষের মতো কথা বলা সম্ভব? এরোপ্লেন আবিষ্কার হয়ে গেছে, কিন্তু মাটিতে ঘোড়ায় টানা রথের থেকে উন্নত কোনো যান পাওয়া যাচ্ছে না এও কি মানতে হবে? গরুর পেটের ভিতরে নিউক্লিয়ার অ্যাক্সিলারেটর বা রিঅ্যাক্টর নেই; সে যে পরমাণু বাইরে থেকে খাদ্য পানীয় বা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে নেয়, দুধের মধ্যে তার বাইরে কোনো পরমাণু থাকা সম্ভব নয়। তাহলে গরুর দুধের মধ্যে সোনা রুপো প্লাটিনাম খুঁজতে যাব কেন? কোন ধরনের পদার্থ বিকিরণ রোধ করে আমরা জানি; গোবরে তার চিহ্নমাত্র নেই, তাহলে হঠাৎ করে গোবরকে নিয়েই বা পড়ব কেন? গোবরের এই অসাধারণ ক্ষমতা কোথা থেকে এলো যে বিষয়ে কোনো কথা তো শুনলাম না। যুক্তির তোয়াক্কা না করলে অসংখ্য প্রকল্প দেওয়া যায়, কাণ্ডজ্ঞান প্রয়োগ না করে সেগুলো সবই পরীক্ষা করে দেখতে হবে? তাহলে তো অন্য সমস্ত গবেষণা বন্ধ করে দিয়ে হয়।

রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগের প্রধান নাকি একথাও বলেছেন আমরা আমাদের বিজ্ঞানকে ভুলতে বসেছি। আমাদের দেশের প্রাচীন বিজ্ঞানের ঠিক কোন পুঁথিতে গোময়ের মাধ্যমে রেডিওবিকিরণ আটকানোর কথা আছে জানি না; এই ধরনের অবাস্তব দাবি আমাদের প্রাচীন সাহিত্য সংস্কৃতির উত্তরাধিকারেরই অপমান করে। আগে যে শিক্ষকের কথা বলেছিলাম, তাঁকে পাল্টা জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমাদের কল্পনাকে এত সংকুচিত ভাবছেন কেন? আজকের কল্পবিজ্ঞান লেখকদের বই দুহাজার বছর পরে পড়লে তখনকার পাঠক কি বলবেন একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ মুহূর্তের মধ্যে এক গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সিতে যাওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছিল? রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।’ আমরা কি খুঁজতে বসব যে চোখ থেকে আলো বেরোয় কিনা; নাকি সেটা বৈজ্ঞানিক সত্য নয় বলে তাঁর সেই লেখাকে বাতিল করে দেব? পুরাণ মহাকাব্য ধর্মগ্রন্থ আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ, তাদেরকে সেই ভাবেই পড়া উচিত। সেখানে বিজ্ঞান খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন।

পিপলস রিপোর্টার ওয়েব পত্রিকাতে প্রকাশিত



No comments:

Post a Comment