Tuesday 6 October 2020

গ্রহ চুরির গল্প

গ্রহ চুরির গল্প

 

টাকা গয়না জমি বাড়ি এমনকি পুকুর চুরি পর্যন্ত শুনেছি, কিন্তু গ্রহ চুরি! সে আবার কী? গ্রহ তো পকেটে বা থলিতে পুরে নিয়ে আসা যায় না, ব্যাঙ্কের ভল্টে বা মাটির নিচে পুঁতে রাখাও সম্ভব নয়। কিন্তু সত্যিই গ্রহ চুরির গল্প বেরিয়েছিল যে সে জায়গায় নয়, সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকার 2004 সালের ডিসেম্বর সংখ্যায়, শিরোনাম ছিল ‘‘The Case of the Pilfered Planet’, অর্থাৎ গ্রহ চুরির মামলা। সেই মামলার কথা জানতে গেলে আমাদের কিছুটা বিজ্ঞান আর কিছুটা ইতিহাস শুনতে হবে।

আমাদের সৌরজগতে আটটা গ্রহ আছে। অবশ্য আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন গ্রহের সংখ্যা ছিল নয়, পরে প্লুটোকে বামন গ্রহ বলে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটাতে আমরা বাস করি। খালি চোখে দেখা যায় বুধ, শুক্র, মঙ্গল বৃহস্পতি আর শনি, এই পাঁচটা গ্রহকে; মানুষ যেদিন থেকে আকাশের জ্যোতিষ্কদের চিনতে শিখেছে, প্রায় সেই সময় থেকেই এদের কথা জেনেছে। প্রাচীনকালে অবশ্য সূর্য ও চাঁদকেও গ্রহ ধরা হত, তার সঙ্গে আমাদের দেশে রাহু ও কেতু বলে দুটো গ্রহের কথা ধরে নবগ্রহের কথা চালু ছিল।

আমাদের সৌরজগতে ইউরেনাস ও নেপচুন এই দুটো, প্লুটোকে ধরলে তিনটে, গ্রহ দূরবিন দিয়ে আবিষ্কার হয়েছে। ইউরেনাস অবশ্য খুব অনুকূল পরিস্থিতিতে খালি চোখে দেখা যায়। যেমন প্রাচীন গ্রীক বিজ্ঞানী হিপ্পার্কাস 128 খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেখেছিলেন, কিন্তু গ্রহ বলে চিনতে পারেননি। অন্য নক্ষত্রজগতে অবশ্য কয়েক হাজার গ্রহ গত পঁচিশ বছরে আবিষ্কার হয়েছে, সেই আলোচনা এই বইয়ে পরে পাওয়া যাবে। এখানে আমরা নেপচুন আবিষ্কারের কথা শুনব, তবে তার ভূমিকা হিসাবে ইউরেনাসের কথাও আসবে। সেই ইতিহাসের মধ্যেই গ্রহ চুরির মামলা লুকিয়ে আছে।

গ্রহ কাকে বলে আমরা সবাই জানি। সহজ কথায় নক্ষত্রের চারদিকে ঘোরে, নিজের অভিকর্ষের প্রভাবে গোলকাকার হয়ে গেছে এবং তার রাস্তা থেকে ছোটখাটো পাথরের টুকরোটাকরা সব পরিষ্কার করে দিয়েছে, এমন বস্তুদের বলে গ্রহ। এ কথাও অবশ্য মনে রাখতে হবে যে গ্রহের ভিতরে নিউক্লিয় বিক্রিয়া হয় না। অনেক সময় দুই বা তারও বেশি তারকা একে অন্যকে প্রদক্ষিণ করে, তাদের আমরা নিশ্চয় গ্রহ বলব না।

দূরবিন দিয়ে তো লক্ষ লক্ষ জ্যোতিষ্ক দেখা যায়। তার মধ্যে কোনটা গ্রহ আর কোনটা গ্রহ নয় বুঝব কেমন করে? ছোটবেলায় পড়েছি গ্রহের আলো স্থির, তারার আলো মিটমিট করে। কিন্তু সেটা কাছের গ্রহদের জন্য সঠিক। তারারা আমাদের চোখে বিন্দুর মতো দেখতে, তাই বাতাসের প্রতিসরণের জন্য মনে হয় মিটমিট করছে। কিন্তু প্রথম যুগের দূরবিনে ইউরেনাস বা নেপচুনকেও বিন্দুর মতোই দেখাত, তখনকার জ্যোতির্বিদদের পক্ষে কোনোভাবেই শুধু কেমন দেখতে লাগছে তা দিয়ে গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যে তফাত করা সম্ভব ছিল না। তাঁদের তাই অন্য রাস্তা বেছে নিতে হয়েছিল।

আকাশের তারারা অনেক দূরে আছে, তাই তাদের স্থির মনে হয়। অবশ্য পৃথিবীও স্থির নয়, সে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে; কিন্তু তার জন্য তারকাদের অবস্থানে খুব কম পার্থক্য হয়। সেই পার্থক্যও মাপা গেছে, তার থেকে আমরা আমাদের কাছের তারকাদের দূরত্ব নির্ণয় করি। এই বইয়ের পরের একটা লেখাতে সেই পদ্ধতির কথা বলা আছে। তারকাদের জন্য এই পার্থক্যটা প্রথম যুগে দেখা সম্ভব ছিল না। আমাদের সৌরজগতের গ্রহরা যেহেতু সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, তাই আকাশে তাদের স্থান পরিবর্তন হয়। সেই দেখে গ্রহ আর নক্ষত্রের মধ্যে তফাত করা সম্ভব।

একটা উদাহরণ দেখা যাক। উইলিয়াম হার্শেল দূরবিনে দেখে 1781 সালের মার্চ মাসে ইউরেনাস আবিষ্কার করেন। কেমন করে তিনি বুঝলেন যে সেটা গ্রহ তা পরের পাতার ছবি থেকে বোঝা যাবে। মার্চ মাসের 13 থেকে 18 তারিখ প্রত্যেকদিন তিনি আকাশের একটা বিশেষ অঞ্চল দেখছিলেন এবং বিভিন্ন জ্যোতিষ্কের অবস্থান নোট করছিলেন। তাঁর দূরবিনে সেই জায়গাতে বিভিন্ন জ্যোতিষ্ককে কেমন দেখা যাচ্ছিল তা ছবিতে দেওয়া আছে। খুব ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে এর মধ্যে মাত্র একটা আলোকবিন্দুই জায়গা পাল্টেছে। যেমন A, B, C এগুলোর আপেক্ষিক অবস্থান স্থির, সুতরাং এগুলো নক্ষত্র। এদের সাপেক্ষে D চিহ্নিত আলোকবিন্দুটি স্থান পরিবর্তন করছে। সুতরাং D হল নতুন গ্রহ, এটাই ইউরেনাস। D একটা চাকতির মতো দেখাচ্ছে, সেটা গ্রহ হওয়ারই কথা। 


হার্শেল দূরবিন দিয়ে ইউরেনাসকে যেমন দেখেছিলেন


যত সহজে বোঝা যাচ্ছে, বিষয়টা তত সহজ ছিল না ছবিতে রাতের আকাশে ফটো তুললে কেমন হতো সেটা দেখানো হয়েছে, 1781 সালে ফটোগ্রাফির কথা কল্পনাতেও ছিল না। হার্শেল প্রথমে ভেবেছিলেন এটা একটা ধূমকেতু। ইউরেনাস নামটাও হার্শেলের দেওয়া নয়, তিনি ইংল্যান্ডের তখনকার রাজা পঞ্চম জর্জের নামে গ্রহটার নাম দিয়েছিলেন। সে নাম অবশ্য বিশেষ কেউ মানেননি। ইউরোপে প্রচলিত গ্রহদের নামগুলো ছিল গ্রিক বা রোমান দেবতাদের নামে, সেই অনুযায়ী গ্রিক পুরাণের আকাশের দেবতার নামে গ্রহটার নাম দেওয়া হল ইউরেনাস।

হার্শেলকে গ্রহ আবিষ্কারের জন্য বছরের পর বছর আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছিল। মনে রাখতে হবে শনির পরে যে আরও গ্রহ থাকতে পারে, সেটাই অনেকে বিশ্বাস করতে পারতেন না। নেপচুনও আবিষ্কার হয়েছিল দূরবিন দিয়ে দেখে, কিন্তু মাত্র একরাতের মধ্যে। তার কারণ আকাশের কোথায় সেটা পাওয়া যাবে তা বিজ্ঞানীরা আগেই অঙ্ক কষে বার করেছিলেন। এর পিছনে একটা বড় গল্প আছে যেটা আবিষ্কারের দেড়শো বছর পরে অমাপ্তিতে পৌঁছেছে। আজ আমরা সেটাই শুনব।

লে ভেরিয়ের  
অ্যাডামস

ইউরেনাস আবিষ্কার হল বটে, কিন্তু নিউটনের মাধ্যাকর্ষণের সূত্র থেকে তার চলাফেরার হিসেব মেলানো যাচ্ছিল না। নিউটনের সূত্রটা শুনতে সোজা, দুটো বস্তু থাকলে তাদের কক্ষপথ বার করাও খুবই সহজ। কিন্তু দুইয়ের বেশি বস্তু থাকলে অঙ্কটা প্রচণ্ড শক্ত। এই হিসাবটা আমরা এখনো কম্পিউটার ছাড়া খুব নিখুঁতভাবে করতে পারি না। 1845 সালে কম্পিউটারের প্রশ্নই আসে না। এ  ক্ষেত্রে সূর্য, বৃহস্পতি, শনি ইউরেনাস, সবাইকে একসঙ্গে ধরে অঙ্কটা কষতে হয়েছিল। তাতেও যখন মিলছিল না, তখন দুই বিজ্ঞানী জন অ্যাডামস বা তাঁর পরে উরবাইন লে ভেরিয়ের আরও একটা অজানা গ্রহকে হিসেবে এনে অঙ্কটা মেলানোর চেষ্টা করেন। তার থেকে তাঁরা দুজনে আলাদা আলাদা ভাবে নতুন গ্রহটার ভর কক্ষপথ ইত্যাদি বার করেছিলেন, বলেছিলেন আকাশের কোথায় এই নতুন গ্রহটাকে পাওয়া যাবে। উরবাইন লে ভেরিয়ের ছিলেন ফরাসি, জন অ্যাডামস ব্রিটিশ। তাঁরা কেউই নিজেরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন না, কাজেই তাঁরা অন্যদের সাহায্য চেয়েছিলেন।

 

গ্যালে
ডি অ্যারেস্ট

 লে ভেরিয়ের নিজের দেশের জ্যোতির্বিদদের অনুরোধ করলেন কিন্তু তাঁরা কেউ পাত্তা দেন নি। তিনি তখন নানা দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে চিঠি লিখে আকাশে তাঁর নির্দেশিত জায়গা পর্যবেক্ষণ করার অনুরোধ জানান। তাঁর কথার গুরুত্ব দিয়েছিলেন জার্মানির বার্লিন মানমন্দিরের বিজ্ঞানী জোহান গ্যালে। তিনি আর তাঁর এক অল্পবয়সী সহযোগী হাইনরিখ ডিঅ্যারেস্ট চিঠির কথা মতো আকাশের ঠিক জায়গায় দূরবিন তাক করেন। সেই দিনটা ছিল 1846 সালের 23 সেপ্টেম্বর। ডিঅ্যারেস্টের হঠাৎ মনে পড়ল রাতের আকাশে ঠিক ওই জায়গার তারাদের অবস্থানের একটা পুরানো ছবি বার্লিন মানমন্দিরে আছে। দুজনে মিলে সেই ছবিটার সঙ্গে সেদিন রাতের তারাগুলোর অবস্থান একটা একটা করে মেলাচ্ছিলেন, হঠাৎ ডিঅ্যারেস্ট বললেন, ‘ম্যাপে এই তারাটা নেই!’ আধঘণ্টাতেই একটা গ্রহ আবিষ্কার হয়ে গেল। পরের দিন দেখা গেল সেটা সত্যিই একটু জায়গা পাল্টেছে। গ্যালে সঙ্গে সঙ্গে লে ভেরিয়েরকে লিখে পাঠালেন যে তাঁর গণনা অনুযায়ী গ্রহটা পাওয়া গেছে। রোমানদের সমুদ্রের দেবতার নামে তার নাম দেওয়া হয় নেপচুন।

এবার আসি অ্যাডামসের কথায়। নেপচুন আবিষ্কারের ঘোষণার পরে রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনোমার অর্থাৎ ব্রিটেনের গ্রিনউইচ মানমন্দিরের প্রধান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জর্জ এয়ারি বলেন যে জন অ্যাডামস বলে একজন তাঁকে আগেই বলেছিলেন ঠিক কোথায় নতুন গ্রহটাকে পাওয়া যাবে। নেপচুন আবিষ্কারের পরে তাঁর কাগজটা খুলে তিনি দেখেছেন যে অ্যাডামসও আকাশের প্রায় একই জায়গার কথা লিখেছিলেন। তাই নেপচুন আবিষ্কারের সমান গৌরব অ্যাডামসেরও প্রাপ্য। ফ্রান্স আর ব্রিটেনের বিজ্ঞানীরা কিছুদিন এই নিয়ে তর্কাতর্কি করেন, শেষে সবাই মেনে নিয়েছিলেন যে সেই দুজনেই আবিষ্কারের সমান ভাগীদার।

নেপচুন আবিষ্কারের যে গল্পটা চালু আছে, তার এই জায়গাটা বেশ ইন্টারেস্টিং। 1845 সালের অক্টোবর মাসে বিকেল সাড়ে তিনটের সময় লণ্ডনে এয়ারির বাড়িতে একজন দেখা করতে এসেছিলেন। আগেও তিনি দুবার এসেছিলেন, কিন্তু কোনোবারই এয়ারি বাড়ি ছিলেন না। এয়ারি পরিবার তখন রাতের খাবার খেতে বসেছিলেন। এয়ারির নির্দেশ ছিল কোনো কারণেই যেন ডিনারের সময় তাঁদের বিরক্ত করা না হয়। তাই বাড়ির খানসামা তাঁকে ফিরিয়ে দেয়। আগন্তুক তখন একটা কাগজে কিছু লিখে এয়ারির জন্য রেখে যান। দুপুর সাড়ে তিনটের সময় রাতের খাবার! এয়ারি একটু অদ্ভুত মানুষ ছিলেন সন্দেহ নেই। তবে সন্ধে হলেই জ্যোতির্বিদরা আকাশ পর্যবেক্ষণে লেগে যান, তাই তাঁদের অফিসের সময় অন্যদের সঙ্গে মেলে না। সেই আগন্তুকই ছিলেন জন অ্যাডামস।

অ্যাডামস ওই অঙ্কটা কষেছিলেন 1845 সালের সেপ্টেম্বর মাসে, দূরবিন দিয়ে কোথায় দেখলে গ্রহটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে, সেই কথা তিনি এয়ারিকে লিখে দিয়েছিলেন। সে যা হোক, প্রচলিত গল্প হল এয়ারি অ্যাডামসকে পাত্তা দেননি। প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী তরুণের কথা শোনেননি বলেই নেপচুন আবিষ্কারের গৌরব ইংরেজদের হাত থেকে ফসকে যায়। পরবর্তীকালে অনেকেই এর জন্য এয়ারিকে প্রচুর গালমন্দ করেছেন। বিখ্যাত বিজ্ঞান লেখক আইজ্যাক আসিমভের মতে এয়ারি ছিলেন অহংকারী সংকীর্ণমনা ও হিংসুটে, তিনি গ্রিনউইচ মানমন্দিরটাকে নিজের জমিদারির মতো চালাতেন, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে তিনি এতটাই ব্যস্ত থাকতেন যে একটা গ্রহ আবিষ্কারের গুরুত্বও তিনি বুঝতে পারেন নি। এই সমালোচনা এয়ারির প্রাপ্য নয়, কিন্তু অন্য একটা অত্যন্ত অন্যায় কাজ তিনি করেছিলেন। সেই কথায় আমরা পরে আসব।

এই গল্পটা চালু বটে, কিন্তু আসলে সত্যি নয়। নেপচুন আবিষ্কারের পরে পরেই এয়ারি পুরো বিষয়টা লিখেছিলেন, অ্যাডামস তার কোনো প্রতিবাদ করেননি। আমরা এয়ারির বিবরণী থেকে ঘটনাপরম্পরা জেনে নিই। এয়ারি অ্যাডামসের কথা খুব ভালোই জানতেন, কারণ অ্যাডামস গবেষণা করতেন কেমব্রিজে। কেমব্রিজ মানমন্দিরের বিজ্ঞানী জেমস চ্যালিস এয়ারিকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে অ্যাডামস এই বিষয়ে কাজ করছেন, চ্যালিস মারফত এয়ারি অ্যাডামসকে ইউরেনাসের কক্ষপথ সম্পর্কে নিজের পর্যবেক্ষণও পাঠিয়েছিলেন।

ডিনারের সময় এয়ারির বাড়িতে অ্যাডামসের আসার গল্পটাও ঠিক নয়। চ্যালিস এয়ারিকে জানিয়েছিলেন অ্যাডামস তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। অ্যাডামস সেপ্টেম্বর মাসের শেষে এয়ারির বাড়ি গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তখন ফ্রান্সে। তিনি ফিরে চ্যালিসকে চিঠি লিখে জানান যে অ্যাডামসের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি, অ্যাডামস যেন চিঠিতে বিষয়টা ব্যাখ্যা করেন। অ্যাডামস তারপর গিয়েছিলেন গ্রিনউইচ মানমন্দিরে এয়ারির অফিসে, সেটা সে বছর অক্টোবর মাসের শেষের দিক। এয়ারি সেদিনও ছিলেন না, অ্যাডামস তখন তাঁর হিসেবের কাগজটা রেখে আসেন। তাতে লেখা ছিল যে ইউরেনাসের কক্ষপথ যে হিসেবের সঙ্গে মিলছে না, তার জন্য দায়ী এক অনাবিষ্কৃত গ্রহ। আকাশের কোথায় সেই গ্রহটাকে খুঁজতে হবে, সেটাও তিনি লিখে দিয়েছিলেন। গল্পে যেমন শোনা যায়, এয়ারি কাগজটাকে মোটেই তেমন উপেক্ষা করেন নি। তিনি তার পরেই কয়েকটা ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে অ্যাডামসকে চিঠি লিখেছিলেন, কিন্তু অ্যাডামস উত্তর দেননি।

আমাদের কাহিনি এবার পৌঁছবে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ফ্রান্সে। 1845 সালের 10 নভেম্বর প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে লে ভেরিয়ের দেখান ইউরেনাসের কক্ষপথ হিসাবের সঙ্গে মিলছে না। পরের বছর 1 জুন এক লেখাতে হিসাব না মেলার কারণ হিসাবে এক নতুন গ্রহের প্রস্তাব করেন তিনি। এয়ারি এই লেখাটা পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই কিছু ব্যাখ্যা চেয়ে লে ভেরিয়েরকে চিঠি পাঠান। তাঁর উত্তর আসার আগেই এক মিটিঙে এয়ারি, চালিস ও জন হার্শেলের দেখা হয়। জন হার্শেল হলেন উইলিয়াম হার্শেলের ছেলে এবং সে যুগের বিখ্যাত বিজ্ঞানী। সেই সময় তাঁরা এই নতুন গ্রহ দেখার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন, অ্যাডামসের কথাও ওঠে। ইতিমধ্যে লে ভেরিয়েরের ব্যাখ্যা এয়ারির কাছে এসে পৌঁছায়। এর পরই এয়ারি চালিসকে চিঠি লিখে নতুন গ্রহ খোঁজার উপর জোর দেন।

চ্যালিস সেই কাজ শুরু করেন 1846 সালের 29 জুলাই। ইতিমধ্যে অ্যাডামস আবার নতুন করে গণনা করেন এবং সেপ্টেম্বরের গোড়াতে এয়ারিকে সেটা পাঠান। লে ভেরিয়েরও 31 আগস্ট আবার গণনা করেন। এয়ারি দেখেন যে দু’য়ের মধ্যে অনেকটাই মিল আছে। চ্যালিস সেই অনুযায়ী খোঁজা শুরু করেন, কিন্তু বিশেষ এগোতে পারেন নি। তার কারণ হল নেপচুন আকাশে খুব ধীরে সরে। তার বছর হল আমাদের 165 বছরের সমান। তার মানে আকাশে 165 বছরে নেপচুন ঘোরে 360 ডিগ্রি, এক মাসে 0.18 ডিগ্রি। তুলনার জন্য বলা যায় চাঁদ আমাদের চোখে 0.5 ডিগ্রি কোণ উৎপন্ন করে, অর্থাৎ তিন মাসে নেপচুন আকাশে দূরের নক্ষত্রদের সাপেক্ষে চাঁদের ব্যাসের পরিমাণ সরবে। তাই বেশ কিছুদিন পর্যবেক্ষণ না করলে কখনোই নিশ্চিত হওয়া যায় না যে আলোকবিন্দুটা সরেছে কিনা। সেই সময় চ্যালিস পাননি। কারণ লে ভেরিয়েরের অনুরোধ বার্লিনের মানমন্দিরে পৌঁছোয় সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে, আর 23 তারিখ রাতেই গ্যালে ও ডিঅ্যারেস্ট গ্রহটা আবিষ্কার করেন। পরে বোঝা গেছে চালিস 4 আগস্ট গ্রহটাকে দেখতেও পেয়েছিলেন, কিন্তু আকাশের ভালো ম্যাপ না থাকার ফলে চিনতে পারেননি।

এর পরে এয়ারি আর অন্য সব ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা অনেক লেখালেখি করে প্রমাণ করেন যে অ্যাডামস লে ভেরিয়েরের আগেই অঙ্কটা কষেছিলেন, কিন্তু ঘটনাচক্রে তাঁর গবেষণার কথাটা জনসমক্ষে আসে নি। তাই লে ভেরিয়েরের থেকে তাঁর কৃতিত্ব কোনো অংশে কম নয়। আমি উপরের আলোচনাতে এয়ারির সেই বিবরণের সাহায্য নিয়েছি। লে ভেরিয়ের মোটেই এতে খুশি হন নি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এয়ারির বিবরণ মেনে নিয়ে অ্যাডামস ও লে ভেরিয়ের দুজনকেই সমান কৃতিত্ব দেওয়া হয়। আমরা দেখলাম যে এয়ারিকে তাহলে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না, তিনি অ্যাডামসের কাজকে যথেষ্টই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। নেহাতই ঘটনাচক্রে ইংল্যান্ডে নেপচুন আবিষ্কার হয়নি; জার্মানদের কাছে কিছুদিন আগের আকাশের মানচিত্র ছিল, চালিসের কাছে ছিল না। সুতরাং ব্রিটিশ আর ফরাসি বিজ্ঞানীদের কৃতিত্ব সমান।

এত বিস্তারিত আলোচনার কি দরকার ছিল? ছিল, তার কারণ এই গল্পটাও পুরোপুরি সত্যি নয়, তবে সেটা বোঝা গেছে অনেক পরে। 1960 সাল পর্যন্ত রয়্যাল গ্রিনউইচ অবজারভেটরি নেপচুন আবিষ্কার সংক্রান্ত কাগজপত্র কাউকে দেখতে দেয়নি। তার পরে ফাইলটা হারিয়েই যায়। ফাইলটা শেষ নিয়েছিলেন রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনোমারের সহকারী ওলিন এগেন, তিনি 1960 সাল নাগাদ এয়ারি ও চালিসের জীবনী লিখছিলেন। এগেনকে জিজ্ঞাসা করলেই বলতেন যে ফাইল তিনি ফেরত দিয়ে দিয়েছিলেন। এগেন তার পর ইংল্যান্ড ছাড়েন, অস্ট্রেলিয়া ও সবশেষে চিলির মানমন্দিরে কাজ করছিলেন। 1998 সালে তিনি মারা যান। তারপর অর্থাৎ নেপচুন আবিষ্কার হওয়ার দেড়শো বছর পরে তাঁর কাগজপত্রের মধ্যে গ্রিনউইচ মানমন্দিরের সেই ফাইলটা পাওয়া যায়। সমস্ত কাগজপত্র আবার কেমব্রিজে ফেরত আসে।



বার্লিন মানমন্দিরের আকাশের ম্যাপ

 

খুঁজে পাওয়া সেই কাগজপত্রই আমাদের নেপচুন আবিষ্কারের কাহিনিকে নতুন করে লিখতে বাধ্য করেছে। সঙ্গের ছবিটা বার্লিন মানমন্দিরের সেই আকাশের ম্যাপ, যার উপর গ্যালে ভেরিয়েরের ভবিষ্যৎবাণী ও নেপচুনের প্রকৃত অবস্থান এঁকে দিয়েছিলেন। অ্যাডামসের প্রথম হিসাবটা একই ছবিতে দেখানো হয়েছে মনে রাখতে হবে গ্যালে অ্যাডামসের কথা জানতেন না। দেখতে পাচ্ছি অ্যাডাম প্রথমে যে হিসেব দিয়েছিলেন সেটা নেপচুনের প্রকৃত অবস্থানের বেশ কাছাকাছি, কিন্তু ভেরিয়েরের হিসাবটা অবশ্যই আরও নিখুঁত। কিন্তু এও জানা গেছে যে অ্যাডামস পরবর্তীকালে যে হিসাব দিয়েছিলেন, সেটা অনেক বেশি ভুল ছিল। এয়ারি সেই কথাটা এড়িয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, অ্যাডামস প্রথম যে হিসাবটা দিয়েছিলেন, সেটা কেমন করে পেয়েছিলেন তা লেখার প্রয়োজন বোধ করেন নি – শুধু কতগুলো সংখ্যার উপর নির্ভর করে কোনো জ্যোতির্বিদই কাজ শুরু করতে রাজি হতেন না। এয়ারি যখন গণনার ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন, তখন অ্যাডামস কোনো উত্তর দেননি। লে ভেরিয়েরের গণনা এতই বিশ্বাসযোগ্য ছিল যে সেটা জার্মানি ও ইংল্যান্ড দুই দেশের জ্যোতির্বিদদের প্রভাবিত করেছিল। অ্যাডামস যে একই কাজ করেছেন, সে কথা এয়ারি লে ভেরিয়েরকে কখনো লেখেন নি – কাজেই তিনি আদৌ অ্যাডামসের কথায় বিশ্বাস করেছিলেন কিনা সে প্রশ্ন থেকে যায়। বাস্তবটা হল ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা নিজেদের দেশের লোকের কৃতিত্বকে অনেক বড় করে দেখিয়েছিলেন - তার জন্য সুবিধামতো কিছু তথ্য বেছেছিলেন ও কিছু বাদ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ চালিস ও বিশেষত এয়ারি মোটেই অ্যাডামসকে অবজ্ঞা করেন নি, বরঞ্চ তাঁর যা স্বীকৃতি পাওনা তার থেকে অনেক বেশি পাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকার সেই প্রবন্ধের উপশিরোনাম ছিল ‘Did the British Steal Neptune?’ তাই এই প্রবন্ধে গ্রহ চুরি কথাটা বোধহয় খুব ভুল নয়। গ্রহটাকে চুরি না করলেও তার আবিষ্কারের কৃতিত্বটা চুরি নিশ্চয় হয়েছিল, এবং করেছিলেন ব্রিটেনের কয়েকজন বিজ্ঞানী।

এখানেই একটা কথা বলে রাখা ভালো। অ্যাডামস তো বটেই, এমনকি লে ভেরিয়েরও নেপচু্নের কক্ষপথ বা ভর যা বার করেছিলেন, তার সঙ্গে প্রকৃত মানের অনেকটাই পার্থক্য আছে। 1846 সালে কক্ষপথের ফারাকটা কমই ছিল, কিন্তু যদি জ্যোতির্বিদরা সেই সময়ে পর্যবেক্ষণ না করে কয়েক বছর দেরি করতেন, তাহলে তাঁরা হিসাবের সঙ্গে অনেকটাই তফাত পেতেন। সেটার কারণ অবশ্য পুরোটাই অঙ্কের ভুল নয়। ইউরেনাসের কক্ষপথ সম্পর্কে আমাদের পর্যবেক্ষণে বেশ কিছু ত্রুটি ছিল, তার জন্যও অঙ্কে ভুল রয়ে গিয়েছিল।

 

আমরা কি চালিসকে নেপচুন প্রথম চোখে দেখার কৃতিত্বটা দেব? সেটা ঠিক নয়, কারণ আগেও নিশ্চয় কেউ কেউ নেপচুনকে দেখেছিলেন, কিন্তু গ্রহ বলে চেনাটাই হল আসল। নেপচুনকে প্রথম কে দেখেছিলেন, সে বিষয়ে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত – তিনি গ্যালিলিও। তিনি এমনকি সেই জ্যোতিষ্কটা যে আকাশে জায়গা পরিবর্তন করে, সেটাও বুঝতে পেরেছিলেন। আমরা জানি গ্যালিলিও বৃহস্পতির চারটে উপগ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন। সেই প্রথম পৃথিবী ছাড়া অন্য কোনো গ্রহের উপগ্রহের খবর আমরা জানতে পেরেছিলাম। গ্যালিলিও মনে করলেন বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে যদি উপগ্রহ ঘোরে, তাহলে বাইবেলে যে বলা আছে পৃথিবী ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে, কথাটা ভুল। ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে গ্যালিলিওর বিরোধের সেই ইতিহাস সকলের জানা, কিন্তু আজ আমরা তা নিয়ে কথা বলতে বসিনি।

 

 

উপরের ছবিদুটো গ্যালিলিওর নোট থেকে নেওয়া। ছবিতেই লেখা আছে প্রথম ছবিটা ডিসেম্বর 27, 1612 আর দ্বিতীয় ছবিটা হল পরের বছর জানুয়ারি মাসের 29 তারিখের।এই নোটদুটো গ্যালিলিওর বৃহস্পতি পর্যবক্ষণের। ছবিদুটোর মাঝখানে বড় গোলটা হল বৃহস্পতি, ছোট ছোট গোল দিয়ে গ্যালিলিও উপগ্রহগুলোর অবস্থান দেখিয়েছেন। ছবিতে বাঁদিকে ভাঙ্গা রেখা দিয়ে যে তারকাচিহ্নটি যুক্ত, এখন আমরা জানি যে সেটাই ছিল নেপচুন। গ্যালিলিও প্রথমে ওটাকে সাধারণ তারকাই ভেবেছিলেন নিশ্চয়, কিন্তু পরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে সেই জ্যোতিষ্কটা যে একমাসের মধ্যে জায়গা পাল্টেছে সেটা গ্যালিলিও বুঝতে পেরেছিলেন। কেন তিনি তা প্রকাশ করেননি, তা অনুমানের বিষয়। এমন হতেই পারে যে সৌরজগতে যে আরও কোনো অজানা গ্রহ থাকতে পারে, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হতে পারেন নি। মনে রাখতে হবে হার্শেল আরো সত্তর বছর পরে ইউরেনাস আবিষ্কার করেছিলেন। এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে গ্যালিলিওর আগে কেউ নেপচুন দেখতে পাননি -- কারণ খালি চোখে তা সম্ভব নয় গ্যালিলিওই প্রথম দূরবিন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, এবং সেই সময় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দূরবিনটি ছিল গ্যালিলিওর কাছে, তিনি নিজের হাতে সেটা বানিয়েছিলেন।

  নেপচুনের কক্ষপথ নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র দিয়ে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না, সেজন্য বিজ্ঞানীরা নতুন গ্রহ খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছিলেন। 1905 সাল থেকে খোঁজ চলছিল। অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাওয়েল মানমন্দিরে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লাইড টমবাউ 1930 সালে প্লুটোকে আবিষ্কার করেন। তার অবস্থান অঙ্কের সঙ্গে মোটামুটি মিলেও গিয়েছিল। কিন্তু আমরা এখন জানি প্লুটোর ভর খুবই কম, তাই নেপচুনের কক্ষপথ পরিবর্তনে তার ভূমিকা সামান্যইতখনকার গ্রহ পর্যবেক্ষণে প্রচুর ভুল ছিল। তাই অঙ্কের সঙ্গে প্লুটো অবস্থান মিলে যাওয়া একেবারেই সমাপতন অর্থাৎ অ্যাক্সিডেন্ট।

 এই লেখাটা প্রকাশিত হয়েছিল চার পর্বে বিবিধ ডট ইন অনলাইন ওয়েব ম্যাগাজিন কাম পোর্টালে। পর্বগুলোর লিঙ্ক , ,



 

1 comment: