রাষ্ট্রসংঘ ২০২৫ সালকে আন্তর্জাতিক কোয়ান্টাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছে। ঠিক একশ বছর আগে ১৯২৫ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ম্যাট্রিক্স রূপটি আবিষ্কার করেন। পরের বছর বলবিদ্যার অন্য একটি সমীকরণ দেন অপর এক জার্মান বিজ্ঞানী এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার। ১৯০০ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত সময়কে আমরা বলি প্রাচীন কোয়ান্টাম তত্ত্বের যুগ, তারপর শুরু হয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কাল। প্রাচীন কোয়ান্টাম তত্ত্বের যুগের চারটি মূল স্তম্ভ হল প্লাঙ্কের কৃষ্ণ বস্তু বিকিরণের তত্ত্ব, আইনস্টাইন কর্তৃক আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা, বোরের হাইড্রোজেন পরমাণুর মডেল এবং বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান। গত বছর আমরা বোস সংখ্যায়নের শতবর্ষ পালন করেছি। শ্রয়ডিঙ্গারের সমীকরণের পিছনে সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণার বিশেষ ভূমিকা আছে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আবিষ্কারের স্বীকৃতিতে ১৯৩২ সালে হাইজেনবার্গকে এবং ১৯৩৩ সালে শ্রয়ডিঙ্গারকে নোবেল পুরষ্কারে সম্মানিত করা হয়।
আমাদের চিন্তার জগতে যে বিপ্লব কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ঘটিয়েছে, তার তুলনীয় ঘটনা ইতিহাসে কম সন্দেহ নেই। বিজ্ঞানের ইতিহাসের স্মরণীয় দিকচিহ্নের মধ্যে পড়বে ১৬০৯ সালে গ্যালিলিওর নিজের তৈরি দূরবিন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ; সেই পর্যবেক্ষণ থেকেই আধুনিক পদার্থবিদ্যার জন্ম হয়েছিল। ১৬৬৬ সালে মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে আইজ্যাক নিউটন আকাশের গ্রহ নক্ষত্র ও পৃথিবীকে একই নিয়মে বেঁধে ফেলেছিলেন। কোপার্নিকাস পৃথিবীকে ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত করে যে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন, তা পূর্ণতা পেল ১৮৫৭ সালে; ডারইউন ও ওয়ালেসের বিবর্তন তত্ত্ব দেখাল জীবজগতে মানুষের কোনো কেন্দ্রীয় স্থান নেই। ১৯০৫ থেকে ১৯১৫- দশ বছরে আইনস্টাইনের বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দেশ কাল সম্পর্কে আমাদের ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে এই সমস্ত যুগান্তকারী আবিষ্কারের পাশেই রাখতে হবে। সেই তত্ত্ব অনুযায়ী প্রকৃতিতে নিশ্চয়তার কোনো স্থান নেই, বস্তুজগতের সব থেকে মৌলিক স্তরে অর্থাৎ অণুপরমাণুর জগৎ হল সম্ভাবনার রাজত্ব। অনেক বিজ্ঞানীই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার এই বিশেষ চরিত্রকেই শেষ কথা বলে মেনে নিতে পারেননি, তাঁদের মধ্যে আইনস্টাইনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিরুদ্ধে আইনস্টাইনের যুক্তিকে ভুল প্রমাণ করার জন্য তিন বিজ্ঞানীকে ২০২২ সালের পদার্থবিদ্যার নোবেল দেওয়া হয়েছে। আবিষ্কারের এক শতাব্দী পরেও বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা এই বলবিদ্যার তাৎপর্য নিয়ে তর্কবিতর্ক করে চলেছেন। অণুপরমাণুর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগৎ কোয়ান্টাম বলবিদ্যা মেনে চলে, আবার আমাদের পরিচিত জগতে নিউটনিয় বলবিদ্যা রাজত্ব করে। কিন্তু ঠিক কোনখানে এক জগতের শুরু এবং অন্যের শেষ? তা নিয়েও বিজ্ঞানীরা কাজ করে চলেছেন।
তাৎপর্য নিয়ে বিতর্ক থাকলেও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এখনো পর্যন্ত তাকে যেখানে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে, সর্বত্রই সঠিক উত্তর আমরা পেয়েছি। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন এ ছাড়া প্রায় অচল; জীব বিজ্ঞানের শাখাগুলিতেও এর ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমান যুগের প্রায় সমস্ত প্রযুক্তি এই বলবিদ্যার উপর ভিত্তি করে নির্মিত। সলিড স্টেট ইলেকট্রনিক্স, কম্পিউটার, লেজার, ন্যানোপ্রযুক্তি, জৈবপ্রযুক্তি, রসায়ন শিল্প -- এক শতাব্দী আগে যে সমস্ত প্রযুক্তির অস্তিত্ব কল্পনাতেও ছিল না, সেগুলি এখন আমাদের জীবনের সিংহভাগকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই সমস্ত প্রযুক্তির পিছনে চালিকা শক্তি হল কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। বিজ্ঞান প্রযুক্তি দর্শনের বাইরের বৃহত্তর সমাজকেও প্রভাবিত করেছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা; তার ছাপ পড়েছে সাহিত্যে, শিল্পকলাতে। আমাদের চিন্তার জগতে নিউটনিয় বিজ্ঞানের পরে সেরা অ্যাডভেঞ্চারের নাম কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কিন্তু শুধু চিন্তা নয়, আমাদের জীবনকেও সে পালটে দিয়েছে।
সম্পাদকীয়, জ্ঞান ও বিজ্ঞান, জানুয়ারি 2025
No comments:
Post a Comment