শিল্পোদ্যোগী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ও বেঙ্গল কেমিক্যাল
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
আমরা সকলেই জানি যে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস (সংক্ষেপে বেঙ্গল কেমিক্যাল) তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতবর্ষে আধুনিক রসায়ন শিল্পের জন্ম হয়। ১৮৯২ থেকে ১৯৩৯, এই পাঁচ দশক ধরে প্রফুল্লচন্দ্র এই সংস্থাকে নানা ঝড়ঝাপটার মধ্যে দিয়ে পরিচালনা করেছেন। এই লেখাতে আমরা সেই ইতিহাস সংক্ষেপে ফিরে দেখব। এই বিষয়ে অনেকেই আলোচনা করেছেন। প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনী 'আত্মচরিত'i-এ বেঙ্গল কেমিক্যালের শুরুর দিনগুলির কথা লিখেছেন। ভারতী পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৩৩ সংখ্যাতে প্রকাশিত তাঁর একটি প্রবন্ধেii ১৯২০-র দশকে বেঙ্গল কেমিক্যালের কথা পাওয়া যায়। তাছাড়াও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে নিয়ে লেখা শ্যামল চক্রবর্তীর গ্রন্থiii ও বেঙ্গল কেমিক্যাল বিষয়ে তাঁর প্রবন্ধiv, ঔপনিবেশিক সরকার ও বেঙ্গল কেমিক্যালের সম্পর্ক বিষয়ে অনুরাধা রায় সেনের প্রবন্ধv, এবং ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে রসায়ন শিল্পের উপর মালিকা বসুর গ্রন্থvi ইত্যাদি সুত্র বর্তমান লেখাতে ব্যবহৃত হয়েছে। ‑
খুব অল্প কথায় প্রফুল্লচন্দ্রের জীবনকথা স্মরণ করা যাক। তাঁর জন্ম পূর্ব বাংলার যশোহর জেলার রাড়ুলি গ্রামে ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট। জমিদার বংশের সন্তান হলেও তাঁদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বিশেষ ছিল না। সেই কারণেই কলকাতাতে পড়তে এসে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি না হয়ে বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউশন অর্থাৎ বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজে পড়েছিলেন। এরপর ব্রিটেনে পড়াশোনার জন্য গিলক্রাইস্ট বৃত্তির পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হন, সেই বছর মাত্র দুজন ভারতীয় এই বৃত্তি পেয়েছিলেন। স্কটল্যান্ডের এডিনবার বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর পড়ার পরে বিএসসি উত্তীর্ণ হয়ে সেখানেই গবেষণা শুরু করেন ও দু’বছর পর ডক্টর অফ সায়েন্স ডিগ্রি পান। দেশে ফিরে ১৮৮৯ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপকের চাকরিতে যোগ দেন; সেখানে তাঁর সহকর্মী ছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র। এর পর ১৮৯২ সালে তিনি বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৭ সালে পদোন্নতির পরে তাঁকে রাজশাহী সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করা হয়, কিন্তু গবেষণা ও বেঙ্গল কেমিক্যালের স্বার্থে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাড়তে রাজি হননি। সে জন্য তিনি পদোন্নতিও ছেড়ে দিতে তৈরি ছিলেন। ১৯০৫ সালে তিনি পূর্ণ অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ১৯১২ সালে Companion of the British Empire এবং ১৯১৯ সালে Knight Bachelor উপাধিতে ভূষিত করে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর নিয়ে ১৯১৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৩৬ সালে সেখান থেকে অবসর নেওয়ার পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমিরিটাস অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেছিলেন। ১৯৪৪ সালের ১৬ জুন তাঁর মৃত্যু হয়।
সাধারণভাবে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা গজদন্ত মিনারে বাস করতেই অভ্যস্ত, তাঁদের বিজ্ঞান শিক্ষাকে সরাসরি বৃহত্তর সমাজের কাজে লাগানোর চিন্তা তাঁরা বিশেষ করেন না। প্রফুল্লচন্দ্র ছিলেন ব্যতিক্রম। আধুনিক ভারতে রসায়ন গবেষণা এবং রসায়ন শিল্প দুইই তাঁর উদ্যোগে শুরু হয়। এই লেখাতে আমরা দ্বিতীয়টির কথাই বলব, কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে দুইয়ের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক প্রফুল্লচন্দ্রের চোখ এড়ায়নি। 'আত্মচরিত'-এ তিনি লিখেছেন, "ইউরোপ ও আমেরিকায় শিল্পের যে বিরাট উন্নতি হইয়াছে, তাহার সঙ্গে বীক্ষণাগারে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ।"i পাশাপাশি প্রফুল্লচন্দ্র দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে বিজ্ঞান শিক্ষার আগে দেশে শিল্প স্থাপন প্রয়োজন। তাঁর কথায়, "প্রত্যেক দেশেই শিল্প-বাণিজ্যের উন্নতি হইয়াছে, তাহার পরে বিজ্ঞান ও বিবিধ শিল্পবিদ্যা প্রভৃতি আসিয়াছে।"i
শুধু বিজ্ঞানের প্রসার নয়, শিল্প স্থাপনের পিছনে তাঁর আরো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল। ইংল্যান্ডের থাকার সময় ছাত্র প্রফুল্লচন্দ্র 'ইন্ডিয়া: বিফোর এন্ড আফটার দি মিউটিনি’ নামের যে বিখ্যাত প্রবন্ধটি লিখেছিলেন, তাতে তিনি দেখিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসনে দেশের জনগণের অবস্থা আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। দেশে ফিরেও তিনি এই বিষয়ে চিন্তা করছিলেন। তাঁর কথায়, “মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অনাহারক্লিষ্ট যুবকদের মুখে অন্ন যোগাইবার ব্যবস্থা করা যায় কিরূপে?”i তিনি দেখলেন বাংলার প্রাকৃতিক সম্পদ বিশাল, কিন্তু তার সঠিক ব্যবহার হয় না। ইতিহাস দেখায় যে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়াতে কয়েকজন বাঙালি নানা শিল্পোদ্যোগের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বিভিন্ন কারণে শতাব্দীর মাঝামাঝি সেই চেষ্টায় ভাঁটা পড়েছিল। ১৮৮৯ সালের এক সমীক্ষা বাংলায় ভারতীয়দের মূলধনের উপর ভিত্তি করে স্থাপিত এবং ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণাধীন একটিও যৌথ কারবারি প্রতিষ্ঠানের (Joint Stock Company) খোঁজ পায়নি।vii এই সময়েই প্রফুল্লচন্দ্র দেশে ফেরেন; বলা বাহুল্য এই পরিস্থিতি বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন। পড়ানোর সময় তিনি লক্ষ করেছিলেন বাঙালি ছাত্ররা যে কোনোভাবে একটা চাকরি জোগাড় করতেই ব্যস্ত; জী্বিকা নির্বাহের বিকল্প এক পথও তিনি তাদের সামনে রাখতে চেয়েছিলেন। বেঙ্গল কেমিক্যালের সাফল্যের পরে প্রফুল্লচন্দ্র লিখেছিলেন, “বেঙ্গল কেমিক্যাল পুরাপুরি বাঙ্গালীর প্রতিষ্ঠান। এইখানে বাঙ্গালীর অর্থ, বাঙ্গালীর বুদ্ধি, বাঙ্গালীর সামর্থ্য সবই বাঙ্গালীর। আমাদের দেশের যে সকল অতি পণ্ডিত লোকেরা বাঙ্গালীর কর্মকুশলতায় আস্থাবান নহে, তাহারা একবার বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা দেখিয়া আসিলে বুঝিতে পারিবে, কেমন করিয়া কেবল বাঙ্গালীর দ্বারা এত বড় কল কব্জার ব্যাপার চলিতে পারে।"ii
আধুনিক ভারতে রসায়ন শিল্পের ইতিহাস থেকে আমরা দেখি কলকাতার কাছে কাশীপুরে প্রথম আধুনিক কারখানা ডি ওয়াল্ডি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক ইংরাজ ডেভিড ওয়াল্ডি। তিনি নিজেই ছিলেন বিজ্ঞানী, ক্লোরোফর্ম আবিষ্কারে তাঁর বিশেষ ভূমিকা আছে। বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রথম যুগে প্রফুল্লচন্দ্র ডি ওয়াল্ডি কোম্পানি থেকেই সালফিউরিক অ্যাসিড কিনতেন। আরো কয়েকটি ছোটখাটো অ্যাসিডের কারখানা কলকাতার আশেপাশে তৈরি হয়েছিল, তবে বেঙ্গল কেমিক্যালই সঠিক অর্থে ভারতীয় মালিকানাধীন প্রথম রসায়ন শিল্পোদ্যোগ। বেঙ্গল কেমিক্যালের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বদেশী আন্দোলন ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আরো কয়েকটি রসায়ন শিল্প কলকাতা ও তার আশপাশে গড়ে উঠেছিল। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পিতা সুরেন্দ্রনাথ ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস নামে একটি কোম্পানি তৈরি করেছিলেন। ভূতনাথ পালের কথা আমাদের আলোচনায় আসবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা স্থাপন করেন। ১৯০৭ সালে বরোদাতে আলেম্বিক কেমিক্যাল ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠা করেন দুই অধ্যাপক টি কে গজ্জর ও এ এস কোটিভাস্কর এবং শিল্পোদ্যোগী বি ডি আমিন। তার আগেই অবশ্য ১৯০৩ সালে শেষোক্ত দুজন বম্বের কাছে পারেলে একটি ছোট রসায়ন কারখানা তৈরি করেছিলেন; অধ্যাপক গজ্জরও মুম্বাইতে তৈরি করেছিলেন টেকনো-কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি।vi তবে বেঙ্গল কেমিকালকেই সবাই পথ প্রদর্শক বলে মানতেন, সে জন্য ১৯৩৮ সালে যখন ইন্ডিয়াল কেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হয়, প্রফুল্লচন্দ্র তার প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত বাংলাই ভারতে রসায়ন শিল্পে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল।
প্রফুল্লচন্দ্রের আত্মজীবনীর পাঠকদের কাছে বেঙ্গল কেমিক্যালের জন্মের ইতিহাস বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। তরুণ প্রফুল্লচন্দ্রের সামনে কোনো উদাহরণ ছিল না, ফলে 'দেখে শেখা'-র পরিবর্তে 'ঠেকে শেখা'-র পথই তাঁকে বেছে নিতে হয়েছিল। টালিগঞ্জের কাছে সোদপুর গ্রামে এক অ্যাসিড কারখানা তিনি কিনেছিলেন, কিন্তু তার পিছনে অনেক অর্থ ও পরিশ্রম ব্যয়ের পর তিনি বুঝলেন যে এত ছোট কারখানা লাভজনকভাবে চালানোর কোনো উপায় নেই। সেটি বন্ধ করে দিতে হল। এক হাজার টাকা দিয়ে কারখানাটি কিনেছিলেন, সিসার পাত বিক্রি করে তিন চারশো টাকা উদ্ধার হয়েছিল। তাঁর সামান্য মূলধনের পক্ষে সেই ক্ষতি কম ছিল না। শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কোথায় কোথায় পাওয়া যাবে, তা তিনি নিজেই শহরে ঘুরে ঘুরে খুঁজে বার করতেন। প্রতিদিন কলেজের পরে তিনি আগের দিনের অর্ডারগুলি দেখে সেগুলি পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। তাঁর নিজের কাছে এ ছিল বিশ্রামের সমান; যে সমস্ত জিনিস বিদেশ থেকে আমদানি করতে হত সেগুলি দেশেই তৈরি করতে পারছেন এই ছিল তাঁর আনন্দ।
শিল্পস্থাপনের মাধ্যমে দেশের উন্নতির কথা যে একা প্রফুল্লচন্দ্রই ভেবেছিলেন তা নয়। বিশেষ করে ১৯০৫ সালের স্বদেশি আন্দোলনের সময় আরো অনেকগুলি শিল্প স্থাপিত হয়। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্টেvii ১৯০৭-০৮ সালের এক সমীক্ষার উল্লেখ করে দেখানো হয় যে সেই সময় বাঙ্গালি মধ্যবিত্তদের উদ্যোগে নানা ছোটখাটো কারখানা তৈরি হয়েছিল; কিন্তু কোনোটিই বৃহৎ পুঁজিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়নি, এবং শেষ পর্যন্ত মূলধন ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে তাদের প্রায় কোনোটিই ফলপ্রসূ হয়নি। প্রথমেই অনেক বড় আকারে শুরুর পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি। উদাহরণ হিসাবে রিপোর্টে উল্লেখিত একটি উদ্যোগের কথা বলা যায়। সেটির জন্য প্রয়োজন ছিল পাঁচ লক্ষ টাকা, কিন্তু শেয়ার বিক্রি করে পঁচাশি হাজার টাকার বেশি ওঠেনি। তা সত্ত্বেও চড়া সুদে টাকা ধার করে কারখানা কেনা হয়েছিল, ফলে কোম্পানিটি ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছিল।
ওই রিপোর্টেই আলাদা করে বেঙ্গল কেমিক্যালের সাফল্যের উল্লেখ করা হয়, বলা হয় যে ১৮৯২ সালে খুব ক্ষুদ্র আকারে শুরু করে ১৯১৫ সালে কোম্পানির মূলধন সাড়ে তিন লক্ষ টাকায় পৌঁছেছে, এবং শেয়ারহোল্ডাররা নিয়মিত ডিভিডেন্ড পাচ্ছেন। আমরা জানি প্রফুল্লচন্দ্র বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠার সময় তাঁর যাবতীয় সঞ্চয় এই উদ্যোগে বিনিয়োগ করেছিলেন। তার পরিমাণ ছিল মাত্র সাতশো থেকে আটশো টাকাviii, যা আজকের হিসাবে চার লক্ষ টাকার বেশি হবে না। শিল্প তৈরির জন্য এ যে নেহাতই নগণ্য সন্দেহ নেই। কিন্তু এই সামান্য মূলধন থেকে শুরু করেও বেঙ্গল কেমিক্যাল সাফল্য পেয়েছিল, এবং তার পিছনে ছিল প্রফুল্লচন্দ্রের পরিকল্পনা ও স্বচ্ছ চিন্তা। প্রতিষ্ঠার ন' বছর পরে মূলধন দাঁড়িয়েছিল প্রায় আড়াই হাজার টাকা, কিন্তু তা প্রফুল্লচন্দ্রের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। তিনি তাই ১৯০১ সালের ১২ এপ্রিল বেঙ্গল কেমিক্যালকে লিমিটেড কোম্পানির রূপ দিলেন। ইতিমধ্যে বেঙ্গল কেমিক্যালের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। বাজার থেকে পঁচিশ হাজার টাকা তোলার লক্ষ্যে শেয়ার বিক্রি করে তেইশ হাজার পাঁচশো টাকা পাওয়া যায়।
মনে রাখতে হবে যে স্বদেশি আন্দোলন দেশীয় প্রতিষ্ঠানদের পৃষ্ঠপোষণাতে উৎসাহ জুগিয়েছিল, তা তখনো শুরু হয়নি। কয়েক বছর পরে বিখ্যাত ব্যারিস্টার রাসবিহারী ঘোষ দু' বারে মোট দু' লক্ষ টাকার বেঙ্গল কেমিক্যালের শেয়ার কিনেছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্রের মৃত্যুর পরে ভারতবর্ষ পত্রিকাতে মনোরঞ্জন গুপ্তের স্মৃতিচারণix থেকে জানা যায় ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত আরো তিনবার শেয়ার ছাড়া হয়েছিল, মূলধন দাঁড়িয়েছিল বাইশ লক্ষ টাকা। বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ এক কোটি টাকা অতিক্রম করেছিল। ১৯০৮ সালে বেঙ্গল কেমিক্যালে সত্তর জন চাকরি করতেন, ১৯৪৪ সালে কর্মী সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মালিকা বসু বেঙ্গল কেমিক্যালের বার্ষিক সভার কার্যবিবরণী থেকে কয়েকটি নির্দিষ্ট বছরে মূলধন ও বিক্রয়ের পরিমাণ উদ্ধৃত করেছেনvi, সেই তথ্য প্রথম সারণীতে দেখানো হয়েছে।
সারণী ১ঃ কয়েকটি বিশেষ বছরে বেঙ্গল কেমিক্যালের মূলধন ও বিক্রয়ের পরিমাণ
-
-
-
-
সাল
মূলধন (টাকায়)
বিক্রয় (টাকায়)
১৯০১
২৩,৫০০
২৫,২৩১
১৯১০
৩৫,০০০
৩,০০,০০০
১৯১৫-১৬
৪,০০,০০০
৫,০০,০০০
১৯২৬-২৭
১৯,০০,০০০
২৫,০০,০০০
-
-
-
প্রফুল্লচন্দ্র প্রথম থেকেই তিনি ওষুধ তৈরির কথা ভেবেছিলেন, তাই কোম্পানির নাম দিয়েছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস। সেই সময়ে প্রায় সমস্ত রাসায়নিক দ্রব্যই ভারতে আমদানি করতে হত। একমাত্র অ্যাসিড দেশে তৈরি হত, কারণ জাহাজের খোলে অ্যাসিড রাখা যেত না। খোলা ডেকে আনার খরচা অনেক বেশি পড়ত। দোকানদার এবং ক্রেতা কেউই দেশি জিনিসের উপর ভরসা করতেন না। প্রফুল্লচন্দ্রকে এই সমস্ত বাধার বিরুদ্ধেই লড়াই করতে হয়েছিল। প্রথম যুগে তাঁর সহায়ক হয়েছিলেন তাঁর একদা সহপাঠী ডাক্তার অমূল্যচরণ বসু। তিনি প্রফুল্লচন্দ্রের প্রয়াসের কথা জানতে পেরে সাগ্রহে তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন। এছাড়া যাঁরা সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়নের ডেমোনস্ট্রেটর চন্দ্রভূষণ ও তাঁর ভাই কূলভূষণ ভাদুড়ির নাম উল্লেখযোগ্য। কূলভূষণ ছিলেন রসায়নে এমএ ও স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। চন্দ্রভূষণই কারখানার আধুনিকীকরণের কাজ দায়িত্ব নিয়ে করেছিলেন।
অমূল্যচরণ যে শুধুমাত্র মূলধন জুগিয়েছিলেন তা নয়, অন্য ডাক্তারদেরও বেঙ্গল কেমিক্যালের তৈরি ওষুধ ব্যবহারে রাজি করিয়েছিলেন। তিনি ছাড়াও এই কাজে প্রফুল্লচন্দ্রকে সাহায্য করেছিলেন রাধাগোবিন্দ কর, নীলরতন সরকার, সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারীর মতো কয়েকজন বিখ্যাত চিকিৎসক। এঁদের পৃষ্ঠপোষণাতে বেঙ্গল কেমিক্যালের তৈরি এট্কিন্স সিরাপ, সিরাপ অফ হাইপোফসফাইট অফ লাইম, টনিক গ্লিসেরো ফসফেট, প্যারিস কেমিক্যাল ফুড ইত্যাদি ওষুধ বাজারজাত করা সম্ভব হয়েছিল। কলকাতার সব থেকে বড় ওষুধ ব্যবসায়ী মেসার্স বটকৃষ্ণ পাল এন্ড কোম্পানির মালিক ভূতনাথ পালও কোম্পানির ওষুধ নিয়ে প্রফুল্লচন্দ্রকে সাহায্য করেছিলেন। অমূল্যচরণের পরামর্শে কালমেঘ, কুর্চি বা জোয়ানের আরক, বাসকের সিরাপ ইত্যাদি আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি শুরু করে ভালো সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। প্রথমে প্রফুল্লচন্দ্র ৯১ নম্বর আপার সার্কুলার রোডের (বর্তমান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড) নিজের ভাড়া বাড়ি থেকেই কোম্পানির কাজ চালাতেন। সেখানে স্থানাভাব ও অন্যান্য নানা অসুবিধার জন্য কলকাতার মানিকতলাতে একটি জমিতে কাজ শুরু হয়। ১৯০৫ সালে সেখানেই প্রথম পূর্ণাবয়ব কারখানা চালু হয়। ওষুধ ছাড়াও প্রথম যুগে বেঙ্গল কেমিক্যালের উৎপদিত দ্রব্যের মধ্যে ছিল আয়রন সালফেট বা হিরাকস, ফসফেট অফ সোডা, সুপারফসফেট অফ লাইম, ইত্যাদি রাসায়নিক পদার্থ।
বেঙ্গল কেমিক্যালের চলার পথ মসৃণ ছিল না -- ভিতরে ও বাইরে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। তাঁর মূলধন ছিল খুবই কম; অধ্যাপক হিসাবে বেতন ছিল আড়াইশো টাকা, তার থেকে জমানো সামান্য পুঁজিতে কারখানা চালানো সহজ ছিল না। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে সমস্যার কথা আগেই বলেছি, কিন্তু মূলধনের অভাবে ধার বাকিতে দেওয়ার সুযোগ বিশেষ ছিল না। তার উপরে প্রথম কয়েক বছরে দুটি মৃত্যু বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। অমূল্যচরণের ভগ্নীপতি সতীশচন্দ্র সিংহ ছিলেন রসায়নে এমএ। তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালে রসায়নবিদ হিসাবে যোগ দেন। একজন দক্ষ সহকারী পেয়ে প্রফুল্লচন্দ্রের বিশেষ সুবিধা হয়েছিল, কিন্তু ১৮৯৪ সালে বেঙ্গল কেমিক্যালের পরীক্ষাগারে কাজের সময় হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিডের বিষক্রিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়। তার কয়েক বছর পরে ১৮৯৮ সালে অমূল্যচরণেরও মৃত্যু হয়, এক প্লেগ রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে তিনি সেই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই সমস্ত বিপর্যয়ের মধ্যেও প্রফুল্লচন্দ্র অবিচল ছিলেন।
১৯০১ সালের ৫ মে নতুন লিমিটেড কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের প্রথম সভা প্রফুল্লচন্দ্রের বাড়িতেই অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র, কার্তিকচন্দ্র বোস, ভূতনাথ পাল, চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ী, চারুচন্দ্র বোস, প্রমুখ। অমূল্যচরণ ও সতীশচন্দ্রের বিধবা পত্নীদেরও লিমিটেড কোম্পনির শেয়ার দেওয়া হয়েছিল।
কোম্পানি বড় হওয়ার পরে স্বাভাবিকভাবেই একা প্রফুল্লচন্দ্রের পক্ষে তার দৈনন্দিন কাজকর্ম দেখা যম্ভব ছিল না। সেই কাজের জন্য প্রফুল্লচন্দ্র যে মানুষদের বেছে নিয়েছিলেন, সেখানেও তাঁর অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। রাজশেখর বসু, পরশুরাম এই ছদ্মনামে যিনি সাহিত্যজগতে বিখ্যাত, রসায়নে বিএ ও এমএ দুই পরীক্ষাতেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালে যোগ দেন ১৯০৩ সালে, পরের বছর ফ্যাক্টরি ম্যানেজারের পদে উন্নীত হন। পরে হয়েছিলেন কোম্পানির সেক্রেটারি। তিনি শুধু রসায়ন নয়, বিক্রয় ও হিসাব সবই দেখতেন। ১৯৩৩ সালে অবসর নিলেও ১৯৬০ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছিলেন সংস্থার অন্যতম ডায়রেক্টর। সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত রাজশেখরের সঙ্গে একই সময় কোম্পানিতে যোগ দেন এবং অল্পদিন পরেই ফ্যাক্টরি ম্যানেজার হন। তিনিও রসায়নে এমএ। 'ফায়ার কিং' নামের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র তিনি তৈরি করেছিলেন; প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তা কোম্পানির এক মুখ্য পণ্য হয়ে দাঁড়ায়। সতীশচন্দ্র ১৯২৬ সালে চাকরি ছেড়ে গান্ধীজীর আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। গান্ধীজীর অনুরোধে তিনি যে দেশীয় কালি তৈরি করেছিলেন, সেই সুলেখা কালি আমরা অনেকেই ব্যবহার করেছি। লিমিটেড কোম্পানির প্রথম ম্যানেজিং ডায়রেক্টর হয়েছিলেন ডাক্তার কার্তিকচন্দ্র বোস। তিনি ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্রের মতোই আরেক শিল্পোদ্যোগী, অনেকগুলি প্রতিষ্ঠানের তিনি সূচনা করেছিলেন। ঔষধ ব্যবসায়ী ভূতনাথ পাল ১৯০১ সালে ডায়রেক্টর বোর্ডের সদস্য হওয়ার পাশাপাশি কোম্পানির প্রধান এজেন্টের দায়িত্ব নেন। চন্দ্রভূষণ হয়েছিলেন শিল্প রসায়নবিদ; চারুচন্দ্র বোস হয়েছিলেন কোম্পানির ম্যানেজার। সুপরিচিত কবিরাজ ও অনেকগুলি কবিরাজি চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থের লেখক উপেন্দ্রনাথ সেন ১৯০৪ সালে কোম্পানির অন্যতম ডায়রেক্টর হন; মাণিকতলার জমিটি কেনার জন্য তিনি অর্থ দিয়েছিলেন। এঁদের সকলের তত্ত্বাবধানে সংস্থার অনেক উন্নতি হয়।
কোম্পানির বাইরের সমস্যাও কম ছিল না। ক্রেতা ও দোকানদারদের উৎসাহের অভাবের কথা আগেই বলেছি; কিন্তু তার থেকেও বড় সমস্যা ছিল ইউরোপীয় কোম্পানিদের চাপ ও তাদের সুবিধা করে দেওয়ার সরকারি নীতি। বেঙ্গল কেমিক্যাল ও ব্রিটিশ সরকারের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেছেন অনুরাধা রায় সেনv। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রসায়ন শিল্পের আমদানি ও রপ্তানির চিত্র আলোচনা করে তিনি দেখিয়েছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত ভারত ছিল কাঁচামালের জোগানদার ও শিল্পজাত রাসায়নিক দ্রব্যের অন্যতম প্রধান আমদানিকারক। ভারতে রপ্তানিকারক দেশগুলির মধ্যে প্রথম ছিল ব্রিটেন; জার্মানি ও ইতালি ছিল অনেক পরে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে। ১৯১৭ সালে বরোদাতে এক বক্তৃতাতেx প্রফুল্লচন্দ্র ভারতে রসায়ন শিল্পের বাজার ও আমদনির বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। আত্মজীবনীতেও তিনি এ বিষয়ে লিখেছিলেন। আমদানি হত মূলত ইউরোপীয় কোম্পানির মাধ্যমে। বিদেশি কোম্পানিরা চেম্বার অফ কমার্স তৈরি করে নিজেদের স্বার্থরক্ষায় তৎপর ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই ঔপনিবেশিক শাসনও তাদের সাহায্য করেছিল। যেমন অপর এক স্বদেশী উদ্যোগ বেঙ্গল ইমিউনিটির তৈরি সিরামের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখতেও সরকারি অফিসাররা রাজি হয়নি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে যে উপনিবেশকে শিল্পশূন্য করার নীতি বিপজ্জনক, কারণ সুদূর ব্রিটেন থেকে যুদ্ধের প্রয়োজনীয় মালমশলা সরবরাহ সবসময় সম্ভব হবে না। বিশেষ করে পূর্ব রণাঙ্গনে মূল সরবরাহ ভারত থেকেই হতে হবে। রসায়ন শিল্প যুদ্ধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; সেই কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বেঙ্গল কেমিক্যালকে নানা সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে অনেকটা জমির ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। বেঙ্গল কেমিক্যাল সোডিয়াম থায়োসালফেট, ম্যাগনেশিয়াম সালফেট, থাইমল, পটাশিয়াম সালফেট, ক্যাফিন, জীবাণুমুক্ত সার্জিকাল ব্যান্ডেজ ইত্যাদি প্রস্তুতিতে হাত লাগায়। এই কাজে সতীশচন্দ্রের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি যে সমস্ত রাসায়নিক আগে থেকেই কোম্পানিতে তৈরি হত, সেগুলির পরিমাণও অনেকগুণ বাড়ানো হয়। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছিল যে কাজের চাপ সামলাতে ১৯১৬ সালে এক নতুন ল্যাবরেটরি তৈরি করতে হয়েছিল। বেঙ্গল কেমিক্যালের উৎপাদনের পঁচানব্বই শতাংশই এই সময় সরকার কিনে নিত। প্রফুল্লচন্দ্রের তৈরি কোম্পানি যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পেরেছিল। সরকারের পক্ষে বেঙ্গল কেমিক্যালের উৎপাদন কেনা লাভজনকও হয়েছিল, কারণ যুদ্ধের জন্য আমদনির খরচ বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ, বেঙ্গল কেমিক্যাল সপ্তাহে পাঁচশো অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র 'ফায়ার কিং' তৈরি করে সরকারকে সরবরাহ করছিল, তাদের দাম পড়েছিল আমদানি করা যন্ত্রের অর্ধেক।v অনুরাধা রায় সেন অনুমান করেছেন যুদ্ধের সময় সাহায্য করার জন্যই ১৯১৯ সালে প্রফুল্লচন্দ্রকে নাইট ব্যাচেলর উপাধি দেওয়া হয়।
জীবাণুমুক্ত ব্যান্ডেজ প্যাকেটে ভরার জন্য স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির প্রসঙ্গ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। যুদ্ধের জন্য স্বাভাবিকভাবেই সেই মুহূর্তে সে সমস্ত বিদেশ থেকে আমদানি করা সম্ভব ছিল না। এখানেই কাজে লাগল কর্মীদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা। সাধারণ করাতকে ব্যান্ডেজ কাটার মতো স্বয়ংক্রিয় রূপ দেওয়া হল; তেলের ড্রামকে জীবাণুমুক্ত করার কক্ষে রূপান্তরিত করা হল; স্টিলের বার ও স্ক্রু-এর সাহায্যে ব্যান্ডেজকে চাপ দিয়ে ছোট করে প্যাকেটে ভরার উপযোগী করা হল। এক কর্মী প্রবোধচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক 'অক্সিজেন যন্ত্র' তৈরি করে তার পেটেন্ট নেন। বেঙ্গল কেমিক্যাল ১৯১৩ সালে সেই যন্ত্র তৈরি শুরু করে এবং তার লভ্যাংশের অর্ধেক প্রবোধচন্দ্রকে দেয়। একই ভাবে ফায়ার কিং তৈরির জন্য সতীশচন্দ্র লাভের অর্ধেক অংশ হিসাবে দু' লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন। বোঝা যায় প্রফুল্লচন্দ্র কোম্পানিতে এমন এক পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছিলেন যা কর্মীদের নতুন নতুন উদ্ভাবনে উৎসাহ দিত। প্রফুল্লচন্দ্র গর্ব করে বলতেন বিদেশ থেকে প্রযুক্তিবিদ আনার প্রয়োজন বেঙ্গল কেমিক্যালে পড়ে না, সমস্ত যন্ত্রই ভারতীয় কর্মীরাই বানায়।
প্রথম সারণী থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতি বেঙ্গল কেমিক্যালের বিকাশে অনেকটা সাহায্য করেছিল। যুদ্ধের সময়ের বাড়তি চাহিদাকে ব্যবহারে কোম্পানি এতটাই সফল হয়েছিল যে মানিকতলার পুরানো কারখানা উৎপাদনের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। ১৯২০ সালে উত্তর চব্বিশ পরগণার পানিহাটিতে সরকারের সহযোগিতাতে অনেকটা জমি কিনে নতুন কারখানা তৈরি হয়। তারপরে ১৯৩৮ সালে মুম্বাইতে তৃতীয় ও ১৯৪৯ সালে কানপুরে বেঙ্গল কেমিক্যালের চতুর্থ কারখানা স্থাপিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি আক্রমণের আশঙ্কাতে কলকাতা থেকে লাহোরে একটি ছোট ইউনিট স্থানান্তরিত হয়েছিল, সেখানে ইথার ও ক্লোরোফর্মের মতো চেতনানাশক ওষুধ বানানো হত। যুদ্ধের পরে তা আবার ফিরিয়া আনা হয়।
অবশ্য সরকারের আনুকূল্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। যুদ্ধের সময় গোলাবারুদ তৈরির জন্য ইউরোপে যে বিরাট রসায়ন শিল্পগুলি গড়ে উঠেছিল, যুদ্ধের পরে সেগুলি সাধারণ পণ্য উৎপাদনের দিকে নজর দেয়। ইউরোপের অনেক দেশের মুদ্রা দুর্বল হওয়াতে আমদানির খরচ কমে যায়। তার পরেই আসে বিশ্বব্যাপী মহামন্দা। এই সব কারণে অনেক আমদানি করা রাসয়ানিকের দাম ভারতে তৈরি পদার্থের থেকে অনেক কম পড়ছিল। অন্যান্য নানা সুবিধা বিদেশি বা বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানিরা ভোগ করছিল। যেমন রেলভাড়া ও আভ্যন্তরীণ শুল্কের জন্য মুম্বাইতে ইউরোপ থেকে ফটকিরি আমদানি করা কলকাতা থেকে কেনার চেয়ে লাভজনক ছিল। আবার মাদ্রাজ থেকে কলকাতাতে বক্সাইট আনতে বেঙ্গল কেমিক্যালকে ডি ওয়ালডি কোম্পানির থেকে বেশি রেল ভাড়া দিতে হচ্ছিল।v যুদ্ধের সময় ভারতে কেম ফার্মা, ইন্দো ফার্মা, ইউনিকেম ইত্যাদি বেশ কিছু বড় রসায়ন শিল্পোদ্যোগ শুরু হয়। ইউরোপীয় কোম্পানিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সঙ্গে যোগ হল এই সব দেশিয় কোম্পানিদের মধ্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
রসায়ন শিল্পে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান খুঁজতে তৈরি হয় টারিফ বোর্ড; তা পরিবহনের ভাড়া কমানো ও আমদানির উপর শুল্ক বসানোর সুপারিশ করে। সরকার কিছু কিছু পণ্যে মাত্র দেড় বছরের জন্য আমদানি শুল্ক বসায়; ভাড়া কমানোর সুপারিশ অগ্রাহ্য হয়। তাছাড়া নানা ভুঁইফোড় কোম্পানির নিম্ন মানের ওষুধের জন্য বেঙ্গল কেমিক্যালের মতো প্রতিষ্ঠিত সংস্থাদের বাজার সঙ্কুচিত হচ্ছিল, কিন্তু সরকার ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি।
বেঙ্গল কেমিক্যাল নানাভাবে এই সব সমস্যার মোকাবিলার চেষ্টা করে। শিল্পে ব্যবহৃত রাসায়নিকের চাহিদা কমে গিয়েছিল, সেই ক্ষতিপূরণ করতে কোম্পানি ওষুধ ও গৃহস্থালির দিকে নজর দেয়। টিটেনাস অ্যান্টিটক্সিন, নানা রকম সাবান, তেল, পাউডার ও অন্যান্য প্রসাধনী দ্রব্য, ফিনাইল, ন্যাপথলিন বল, এমন কি নলকূপ ইত্যাদি তৈরি শুরু হয়। বয়স্কদের অনেকেরই হয়তো বেঙ্গল কেমিক্যালের ক্যান্থারাইডিন তেলের কথা মনে আছে। মালিকা বসু দেখিয়েছেন যে ১৯৩০ সালে বেঙ্গল কেমিক্যাল ৩৮০ রকম ওষুধ তৈরি করত। ১৯৩২ সালে ভিটামিন তৈরির জন্য একটি আলাদা বিভাগ খোলা হয়। ১৯৩৪ সালে কোম্পানি আয়ুর্বেদের গুণাগুণ প্রচারে দেশীয় ঔষধ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। ওষুধের বিক্রি বাড়াতে কেবলমাত্র চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ শেয়ার ছাড়া হয়। কোপানহাগেনের পরীক্ষাগার থেকে ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে বিদেশে রপ্তানির চেষ্টা করা হয়। আমদানি করা রাসায়নিকের পরিবর্তে দেশীয় উৎপাদন ব্যবহার বিষয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে ১৯৩৭ সালে প্রফুল্লচন্দ্রের নামাঙ্কিত একটি নতুন ল্যাবরেটরি তৈরি হয়, প্রথম দু' বছরে তার জন্য সেই বছর কোম্পানির মোট বিক্রয়লব্ধ অর্থের প্রায় ০.৫ শতাংশ খরচ হয়। মুম্বাইয়ের কারখানা তৈরির উদ্দেশ্য ছিল পরিবহন ব্যয় হ্রাস, বিশেষ করে স্পিরিটের উপর আভ্যন্তরীণ শুল্ক ছিল খুব বেশি। ১৯৩৪ সাল থেকে মুম্বাইতে উৎপাদন শুরু হয়, ১৯৩৮ সালে সেখানে একটি পূর্ণাবয়ন কারখানা চালু হয়।vi পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের দিকেও নজর দেওয়া হয়। ডাক্তারদের কাছে বেঙ্গল কেমিক্যালের ওষুধকে পরিচিত করানোর জন্য একজন ডাক্তারকেই নিয়োগ করা হয়। ১৯১৯ থেকে ১৯২৬-এর মধ্যে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৬৫,০০০ টাকা বিজ্ঞাপনের জন্য খরচ করা হত, ১৯৩৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল তিন লক্ষ টাকার বেশি।
প্রাণাধিক প্রিয় বেঙ্গল কেমিক্যালের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত প্রফুল্লচন্দ্রের বিচ্ছেদ হয়েছিল, এবং তা মধুর ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলিতে যে ডিভিডেন্ড দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, তা স্বাভাবিক ভাবেই পরে কমে এসেছিল। শেয়ারহোল্ডারদের একাংশ ১৯২১ সাল থেকে আরো বেশি ডিভিডেন্ড দাবি করছিল। সেই দাবি গৃহীত হয়নি, বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। প্রফুল্লচন্দ্রের পরিকল্পনা ছিল বেঙ্গল কেমিক্যালের আরো বিস্তার; শেয়ারহোল্ডারদের দাবি মানলে তা সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে ১৯৩৯ সালের ২৬ আগস্ট প্রফুল্লচন্দ্র বোর্ড অফ ডায়রেক্টরস থেকে পদত্যাগ করেন। শেয়ার হোল্ডারদের সাধারণ সভা সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেনি, কিন্তু প্রফুল্লচন্দ্র আর সেই প্রতিষ্ঠানে পা রাখেননি। বেঙ্গল কেমিক্যালের পরের ইতিহাস আমাদের পরিধির বাইরে। সংক্ষেপে বলা যায় যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কোম্পানির লাভ ক্রমশই কমতে থাকে, এবং ১৯৬৯-৭০ সালে তা প্রথম ক্ষতির মুখ দেখে। ১৯৮০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এটি অধিগ্রহণ করে। নানা সমস্যা কাটিয়ে উঠে বেঙ্গল কেমিক্যাল আবার ২০১৬-১৭ আর্থিক বর্ষ থেকে নিয়মিত লাভ করছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি হাতে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কর্মীরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন।
শেষ করার আগে বলা দরকার যে প্রফুল্লচন্দ্র কর্মীদের সুযোগসুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখতেন, তাই মানিকতলার কারখানাতে তৈরি হয়েছিল কর্মী ও তাদের ছেলে মেয়েদের জন্য স্কুল, হাসপাতাল, ক্লাব। অনেক কর্মীকে বিনা ভাড়ায় বাসস্থান দেওয়া হয়েছিল। কোম্পানিকে যতটা সম্ভব স্বয়ংসম্পূর্ণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। বিজ্ঞাপন, লেবেল, ক্যাটালগ, মোড়ক ইত্যাদি কোম্পানির নিজের ছাপাখানায় ছাপানো হত। কোম্পানি নিজস্ব ফায়ার ব্রিগেড তৈরি করেছিল। প্রফুল্লচন্দ্র নিজে কখনো ডায়রেক্টরের প্রাপ্য অর্থ গ্রহণ করেননি, তিনি তা কর্মচারী কল্যাণ তহবিলে দান করতেন। তাঁর নিজের শেয়ারের অর্থমূল্য ছিল ছাপ্পান্ন হাজার টাকা, পুরোটাই তিনি বিধবাদের কল্যাণের জন্য গঠিত এক তহবিলে দান করে দিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে বেঙ্গল কেমিক্যালের সংগ্রামের দীর্ঘ আলোচনা প্রবন্ধের পরিসরে সম্ভব নয়, আগ্রহী পাঠকরা এই লেখাতে উল্লেখিত উৎসগুলি থেকে আরো অনেক তথ্য পাবেন। এমন নয় যে বেঙ্গল কেমিক্যালই একমাত্র শিল্পোদ্যোগ যার সঙ্গে প্রফুল্লচন্দ্র যুক্ত ছিলেন। বেঙ্গল এনামেল ওয়ার্কস, ক্যালকাটা পটারি ওয়ার্কস (পরবর্তীকালের বেঙ্গল পটারিজ), বেঙ্গল স্টিম নেভিগেশন ইত্যাদি নানা দেশীয় কোম্পানির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। নামকরণ থেকে অনুমান করি এই সমস্ত কোম্পানির অনেকগুলিই বেঙ্গল কেমিক্যালের সাফল্য থেকে উৎসাহিত হয়েছিল। বঙ্গ শ্রী কটন্ মিলস্ও প্রফুল্লচন্দ্রের উদ্যোগেই তৈরি হয়, এবং তার পরিচালনাতেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্রের কাজ ও সাধারণ জীবনযাপন মানুষের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিল। তাই এই উদ্যোগটিও সাধারণ মানুষের সমর্থন পেয়েছিল, যদিও তা শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সেখানে প্রফুল্লচন্দ্র শুধুই শিল্পোদ্যোগী; বেঙ্গল কেমিক্যালের ক্ষেত্রে তাঁর আরো বড় পরিচয় তিনি রসায়নবিদ। তাঁর পরিচালনাতেই এক পরাধীন দেশে স্থাপিত শিল্প এশিয়ার বৃহত্তম রসায়ন শিল্পোদ্যোগে পরিণত হয়েছিল। একই সঙ্গে সফল শিল্পপতি ও প্রথম শ্রেণির বিজ্ঞানী । আমাদের দেশে এমন উদাহরণ আর নেই।
iপ্রফুল্লচন্দ্র রায়, আত্মচরিত, প্রথম প্রকাশ ১৯৩৭। বর্তমান প্রবন্ধের উদ্ধৃতিগুলি ২০১১ সালে প্রকাশিত শ্যামল চক্রবর্তী সংকলিত দে'জ সংস্করণ থেকে গৃহীত।
iiপ্রফুল্লচন্দ্র রায়, বেঙ্গল কেমিক্যাল, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রচনা সংকলন, প্রথম খণ্ড, পৃ ৮৮৯, সম্পাদনা অনিল ভট্টাচার্য, ২০০৮, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ।
iiiশ্যামল চক্রবর্তী, ঐতিহ্য উত্তরাধিকার ও বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র, ২০০৯, সাহিত্য সংসদ।
ivSyamal Chakrabarti, Shaping the Chemical Industry and Saving the Cotton Industry: Role of Sir P C Ray, a Visionary Entrepreneur of British India, 2018, Indian Journal of History of Science, Vol. 53, p. 100.
vAnuradha Ray Sen, Imperial Policy and Travails of Indigenous Enterprise: A Study in Bengal Chemical Pharmaceutical Works, Journal of Scientific and Industrial Research, 1999, Vol. 58, p. 63.
viMalika Basu, History of Indigenous Pharmaceutical Companies in Colonial India (1855-1947), 2021, Routledge.
vii Bengal Industries (Report of Mr. J.A.L. Swan, ICS), Journal of the Royal Society of Arts, 1915, Vol 63, p. 690.
viii https://bengalchemicals.co.in/our-founder-history/
ixমনোরঞ্জন গুপ্ত, আমাদের আচার্যদেব, ভারতবর্ষ, ১৩৫১ বঙ্গাব্দ (ইং ১৯৪৪) ভাদ্র, পৃ ১৯২।
xPrafulla Chandra Ray, Possibilities of Chemical Industries in India, Acharya Prafulla Chandra Ray: A Collection of Writings, Vol IA, p. 450, Edited by Anil Bhattacharya, 2008, Acharya Prafulla Chandra College.
প্রকাশঃ কোরক পত্রিকা, বইমেলা ২০২৫
No comments:
Post a Comment