Saturday, 29 March 2025

পুস্তক সমালোচনা দ্বি-জাতি তত্ত্বঃ ভারতের স্বাধীনতা ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়

দ্বি-জাতি তত্ত্বঃ ভারতের স্বাধীনতা ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়

ডক্টর জগদিন্দ্র মন্ডল

দিগন্ত প্রকাশনী

প্রকাশ ২০২৪

দাম ২৫০ টাকা


জগদিন্দ্র মন্ডল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত মনোবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। তিনি বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন, পাশাপাশি বিজ্ঞান অনুষদের ডীন হিসাবেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন ও প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। নবতিপর এই মানুষটি কৈশোরে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও দেশভাগের সাক্ষী হয়েছেন, ছিন্নমূল উদ্বাস্তুর জীবন যাপন করেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও স্বাধীনতালাভ দেখেছেন। এই প্রত্যেকটি ঘটনাই উপমহাদেশের ইতিহাসে মাইলফলক, এবং তাদের নিয়ে ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন। সেই সবের থেকে আলোচ্য বইটি কিছুটা পৃথক; কারণ লেখক মনোবিজ্ঞানী, তিনি নিজের বিশেষজ্ঞতার প্রেক্ষিতে সেই ঘটনাগুলি বিশ্লেষণ করেছেন।

মহাত্মা গান্ধী, মহম্মদ আলি জিন্না, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র, সেখ মুজিবর রহমান -- সেই ইতিহাসের মূল কুশীলবদের গুরুত্বপূর্ণ যুগান্তকারী সিদ্ধান্তসমূহকে মনোবিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন মহম্মদ আলি জিন্নার প্রতি; তাঁর চিন্তাধারাতে অনেক অসঙ্গতির উল্লেখ করে বলেছেন যে ডায়রেক্ট অ্যাকশনের মতো রাজনৈতিক নৈরাজ্যবাদী আহ্বানের পিছনে ছিল অহমের আধিপত্য-বাসনা। মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে দেখিয়েছেন দ্বিজাতি তত্ত্ব কতট অবাস্তব।

কয়েকটি প্রশ্ন লেখক তুলেছেন, যেগুলি আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরও মনে আসে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা সত্ত্বেও কেন গান্ধীজি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর পাঞ্জাবে যাওয়ার রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন; কেনই বা আন্দোলন শুরুর সময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরামর্শ করলেও গান্ধীজী প্রত্যাহারের সময় তাঁর সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করেন নি? কেন প্রগতিশীল জিন্নাকে সরিয়ে রেখে তিনি মুসলিম সমাজের সংস্কারাচ্ছন্ন অংশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন? দেশভাগ রুখতে কংগ্রেসের নেতারা সত্যই কতটা আগ্রহী ছিলেন? সুভাষচন্দ্র ও কংগ্রেসের সম্পর্ক ছিন্ন না হলে কি ইতিহাসের ধারা অন্য দিকে বইত?

রবীন্দ্রনাথের দুই সুবিখ্যাত সাহিত্যকীর্তি, ছোটগল্প 'কাবুলিওয়ালা' এবং 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসকে মনোবিদ্যার দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। দেখিয়েছেন সন্দীপের প্রশংসাতে কেমনভাবে বিমলার মধ্যে আত্মপ্রেমের জন্ম হয় ও দু'জনের মানসিক দ্বন্দ্ব নিরসনে 'অহম-রক্ষণ' কৌশল হিসাবে অবদমন ও অপযুক্তিকরণ কেমনভাবে কাজ করেছে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে মনোবিদ্যার এই প্রকাশ নেহাত কাকতালীয় নয়। চিঠিপত্র উদ্ধৃত করে লেখক দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ মনোবিজ্ঞানের আধুনিকতম তত্ত্বের খবর রাখতেন, এবং ইউরোপীয় সাহিত্যে তার অভিঘাত নিয়ে সচেতন ছিলেন।

বারবার রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে গেছেন লেখক; তাঁর রচনার আলোতে উপমহাদেশের ইতিহাসকে বুঝতে চেয়েছেন। বইয়ের এক বড় অংশ জুড়ে আছেন সেখ মুজিবর রহমান। লেখকের কথায়, 'মুজিবের উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যিনি, যাঁর জীবন দর্শন, দেশ-চেতনা ও আন্তর্জাতিক চেতনা সঞ্চার - তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ।' মুজিবর রহমানের জীবনের নানা ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে লেখক নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি হাজির করেছেন। অন্য সচেতন প্রগতিশীল মানুষের মতোই লেখক বাংলাদেশের জন্মের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার বিজয় ও দ্বিজাতি তত্ত্বের পরাজয় দেখেছেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী এই ব্যাখ্যার উপরে এক প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিলেও উপমহাদেশের ইতিহাসে একাত্তরের ঘটনার অভিঘাতকে অস্বীকার করা যাবে না।

বইটির মুদ্রণ, কাগজের গুণমান ও বিশেষ করে বানানের বিষয়ে আরো যত্নশীল হওয়া উচিত ছিল। চমৎকার একটি আলোচনাতে সেগুলি মাঝেমাঝেই ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। আশা করা যাক পরবর্তী সংস্করণে এই ত্রুটিগুলি সংশোধিত হবে।


গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

প্রকাশ গণশক্তি, ২২ মার্চ, ২০২৪ 







Wednesday, 19 March 2025

জড় তরঙ্গের শতবর্ষ

 

জড় তরঙ্গের শতবর্ষ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন দশকে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে যে উথালপাথাল ঘটেছিল, তার তুলনা পৃথিবীতে বিরল। কয়েক শতাব্দীব্যাপী জ্ঞানচর্চা বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে তুলেছিল, এই সময়ে একের পর এক আবিষ্কার তা চুরমার করে দেয়। ১৯০০ সালে যে বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, তা এখনো শেষ হয়নি, তার তাৎপর্য নিয়ে আজও তর্কবিতর্ক চলছে। ১৯০০ থেকে ১৯২৪ এই সময়টাকে বলা হয় পুরানো কোয়ান্টাম তত্ত্বের যুগ। এর পরই কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আবিষ্কার হয়। এই বলবিদ্যার আবিষ্কারক হিসাবে আমরা সাধারণত দু'জনের নাম বলে থাকি, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ও এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার। এই দু'জনের পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হলেও পরে দেখা গিয়েছিল তাদের মধ্যে কোনো মূলগত পার্থক্য নেই। হাইজেনবার্গের গবেষণা অবশ্যই আগে প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু আমরা এখন সাধারণভাবে শ্রয়ডিঙ্গারের তত্ত্বকেই ব্যবহার করি। শ্রয়ডিঙ্গারের আবিষ্কৃত সমীকরণটিকে বলা হয় তরঙ্গ বলবিদ্যা। কোয়ান্টাম তত্ত্বে সেই ধরনের তরঙ্গের কথা প্রথম বলেছিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী লুই দ্য ব্রয়লি। সেই জন্য অনেকেই তাঁকেও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আবিষ্কারকদের মধ্যে ধরেন। দ্য ব্রয়লির সেই গবেষণা তাঁর ডক্টরেট থিসিসে প্রকাশ করেছিলেন, সেই সালটা ছিল ১৯২৪। কিন্তু তার আগের বছরেই সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে তিনি কয়েকটি গবেষণাপত্রে তাঁর মূল কথাগুলি প্রকাশ করেছিলেন, যদিও তখন তা কারো নজরে পড়েনি। সেই হিসাবে আমরা এখন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূচনার শতবর্ষে প্রবেশ করেছি। এই লেখাতে আমরা দ্য ব্রয়লি ও তাঁর সেই আবিষ্কারের নিয়ে কিছু কথা আলোচনা করব। তার জন্য আমাদের কিছু পুরানো কথা জেনে নিতে হবে।

কোয়ান্টাম তত্ত্বের সূচনাতেই আছে মাক্স প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব। যে বস্তু তার উপরে পড়া সমস্ত তড়িৎচৌম্বক রশ্মি বা বিকিরণ সম্পূর্ণ ভাবে শোষণ করে তাকে বলে কৃষ্ণ বস্তু। এই কৃষ্ণ বস্তুকে উত্তপ্ত করলে তার থেকে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ বিকিরিত হয়। এই বিকিরণকে বলে সাম্যাবস্থার বিকিরণ, অর্থাৎ বস্তু ও বিকিরণ পরস্পরের সঙ্গে সাম্যাবস্থায় আছে; এক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কোন দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ কত পরিমাণ বিকিরণ হবে তাপগতিবিদ্যার সূত্র থেকে তা খুব নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। কিন্তু পরীক্ষাগারে পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সেই হিসাব একেবারেই মিলছিল না। তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১৯০০ সালে মাক্স প্লাঙ্ক প্রথম কোয়ান্টাম তত্ত্বের ব্যবহার করেন। প্লাঙ্ক দেখান যে বিকিরণ বা শোষণের সময় তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের শক্তির পরিমাণ যেমন খুশি হতে পারে না; একটা নির্দিষ্ট ন্যূনতম পরিমাণের গুণিতক পরিমাণ শক্তি নির্গত বা শোষিত হয়। এই ন্যূনতম শক্তির পরিমাণকে প্লাঙ্ক বললেন কোয়ান্টাম। যদি তরঙ্গের কম্পাঙ্ক n  হয়, তাহলে কোয়ান্টামের শক্তির মাপ হল hn। এখানে h একটি ধ্রুবক, এখন আমরা তাকে বলি প্লাঙ্কের ধ্রুবক।

আলোও এক ধরনের তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ; পাঁচ বছর পরে আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আইনস্টাইন দেখালেন যে আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব এই ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে। ধাতুর উপরে আলো ফেললে তার থেকে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে, একে বলে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া। আইনস্টাইন দেখান যে এই কোয়ান্টামের নির্দিষ্ট ভরবেগ আছে, অর্থাৎ সে কণার মতো আচরণ করে।

১৯১৩ সালে নিল্‌স বোর তাঁর পরমাণুর মডেল প্রকাশ করেছিলেন। তিনি দেখালেন যে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনেরা যে কোনো কক্ষপথে ঘুরছে না, তাদের নির্দিষ্ট কতকগুলি কক্ষপথ আছে, এই ধরে নিলে পরমাণু থেকে নির্গত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। সেই নির্দিষ্ট কক্ষপথগুলির কৌণিক ভরবেগের মান প্লাঙ্কের ধ্রুবকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাঁদের গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ প্লাঙ্ক, আইনস্টাইন ও বোর যথাক্রমে ১৯১৮, ১৯২১ ও ১৯২২ সালের নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন।

আধুনিক আলোক বিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিলে আইজ্যাক নিউটনের হাত ধরে। বিজ্ঞানী রেনে দেকার্তে, রবার্ট হুক এবং ক্রিশ্চিয়ান হাইজেন্স বললেন আলো হল তরঙ্গ। নিউটন অবশ্য আলোকে তরঙ্গ বলে মানতে তৈরি ছিলেন না। তিনি মনে করেছিলেন যে আলো হল কণিকার স্রোত। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়াতে টমাস ইয়ং পরীক্ষা করে প্রমাণ করেন আলো হল তরঙ্গ। মাইকেল ফ্যারাডে অনুমান করেন আলো হল তড়িৎ ও চুম্বক ক্ষেত্রের কম্পন, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব থেকে তা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বিজ্ঞানীরা যখন নিশ্চিত হয়েছিলেন যে আলো তরঙ্গ; ঠিক তখনই প্লাঙ্ক ও আইনস্টাইন আলোর কণিকাধর্ম প্রমাণ করলেন।

লুই দ্য ব্রয়লি প্লাঙ্ক ও আইনস্টাইন তত্ত্ব আত্মস্থ করলেন, কিন্তু গেলেন সম্পূর্ণ নতুন পথে। লুই যে বিজ্ঞানী হিসাবে বিশেষ পরিচিত ছিলেন তা নয়। তাঁর কাজের প্রসঙ্গে আইনস্টাইন অপর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী হেনড্রিক লরেঞ্জকে লিখেছিলেন, “আমাদের চেনা দ্য ব্রয়লির ভাই একটা খুব কৌতূহলোদ্দীপক কাজ করেছে।” দাদা মরিসের ভাই হিসাবেই তাঁর প্রাথমিক পরিচয় ছিল।

অভিজাতরা কখনো কখনো শখে বিজ্ঞান গবেষণাতে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান বিরল ঘটনা। আর্ল অফ রসে ঊনবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর বৃহত্তম দূরবিনটি বানিয়েছিলেন, কিন্তু তা দিয়ে তিনি বিশেষ কোনো পর্যবেক্ষণ করতে পারেননি। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে লর্ড ক্যাভেন্ডিশের উদাহরণকে ব্যতিক্রমের মধ্যেই ধরতে হবে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম চার দশকে প্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগে একশো তেরোজন অধ্যাপক নিয়োগ করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে মাত্র একজন এসেছিলেন অভিজাত বংশ থেকে। সুপরিচিত বিজ্ঞানী পল লাজভাঁর ঠাকুর্দা ছিলেন ক্ষুদ্র চাষী। ফরাসি নোবেলজয়ীদের মধ্যে জাঁ পের‍্যাঁর ঠাকুর্দা ছিলেন তালার মিস্ত্রি, পিয়ের কুরির বাবা ছিলেন ডাক্তার, মেরি কুরির বাবা শিক্ষক।

এই অধ্যাপকদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রমটি ছিলেন প্রিন্স এবং পরবর্তীকালের ডিউক লুই দ্য ব্রয়লি। শুধুমাত্র অভিজাত নয়, দ্য ব্রয়লিরা ছিলেন যথেষ্ট ধনী। প্যারির বাইরে ছিল তাঁদের বিরাট প্রাসাদ। সেখানেই ছিল লুইয়ের দাদা মরিসের পরীক্ষাগার। সে যুগে ইউরোপের সব থেকে উন্নত গবেষণাগারগুলোর মধ্যে তা ছিল অন্যতম। সত্যেন্দ্রনাথ বসু যখন ১৯২৪ সালে ফ্রান্সে যান, তখন সেই গবেষণাগারে তিনি অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে তাঁর গবেষণার সঙ্গে অনেক মিল লুইয়ের কাজের, কিন্তু তাঁদের সে সময় সাক্ষাৎ হয়নি।

লুই দ্য ব্রয়লির জন্ম ১৮৯২ সালের ১৫ আগস্ট। দাদা মরিস তাঁদের বংশে প্রথম বিজ্ঞান গবেষণাতে যোগ দেন। তাঁর এ বিষয়ে উৎসাহকে তাঁর পরিবার ভালো চোখে দেখেনি, তা সত্ত্বেও তিনি ১৯০৮ সালে নৌবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে বিজ্ঞান গবেষণাতেই আত্মনিয়োগ করেন। তিনিই ছিলেন ভাই লুইয়ের অনুপ্রেরণা। অভিজাতরা সাধারণত প্রশাসন, সামরিক বাহিনী বা বৈদেশিক মন্ত্রকের উচ্চপদে যোগ দিতেন। লুইও সে জন্য ইতিহাস ও আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১১ সালে প্রথম সলভে সম্মেলন হয়েছিল বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে, মরিস সেখানে সচিবের কাজ করেছিলেন; সম্মেলনের কার্যবিবরণী তৈরিও তাঁর দায়িত্বের মধ্যে ছিল। লুই সেটা পড়ে এতটাই উৎসাহিত হন যে তিনি নিজের বিষয় পরিবর্তন করে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সে সময় ইউরোপের অধিকাংশ দেশের মতোই ফ্রান্সেও সমস্ত যুবকের একুশ বছর বয়স হলে এক বছরের জন্য সামরিক বাহিনীতে কাজ করা বাধ্যতামূলক ছিল, লুই যোগ দেন ১৯১৩ সালে। পরের বছরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, ফলে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত তিনি জন্য সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই পড়াশোনাতে ছেদ পড়েছিল। লুই নিজে বলেছেন যে তার পরেও তিনি অনেকদিন বিজ্ঞানে মনোনিবেশ করতে পারেননি। 


 

যুদ্ধের পরে লুই আবার দাদার গবেষণাগারে কাজ শুরু করেছিলেন। মরিস সে সময় অণুপরমাণুর বর্ণালী এবং এক্স-রশ্মি নিয়ে কাজ করছিলেন, বিভিন্ন সময়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে আলোচনা হয়। ধাতুর উপর এক্স-রশ্মি ফেললে ইলেকট্রন বেরোয়, মরিস দেখালেন যে তার শক্তির ব্যাখ্যা একমাত্র আইনস্টাইনের আলোকতড়িৎ সূত্র মেনেই সম্ভব, অর্থাৎ আলো হল কোয়ান্টাম। মরিস এমনকি ১৯২২ সালে তাঁর এক বইতে এ কথাও লিখেছিলেন, “There is something kinetic in the vibratory radiation, and something periodic in the projection of corpuscles…the same reality manifests itself, sometimes under its kinetic face, some other times under its undulatory face.” সংক্ষেপে বলতে পারি, কণা ও তরঙ্গের মধ্যে অনেক মিল আছে, একই বাস্তবতা কখনো তরঙ্গ বা কখনো কণারূপে প্রকাশ পায়। মরিসের এই ধারণাই ভাইয়ের গবেষণাতে প্রকাশ পাবে। লুই পরে বলেছিলেন যে মরিসের সঙ্গে আলোচনা তাঁর চিন্তাধারাকে সঠিক পথে চালনা করেছিল।

মরিসের ল্যাবরেটরির পরীক্ষানিরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে লুই দ্য ব্রয়লি আইনস্টাইনের আলোর কোয়ান্টামে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন, ১৯২১ সালে তিনি প্রথম যে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, সেখানে তিনি পরমাণুর সঙ্গে এক্স-রশ্মির ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে আইনস্টাইন ও বোরের তত্ত্বের প্রয়োগ করেছিলেন। আলোর কণার স্থিরভর হল শূন্য, পরের বছর কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ বিষয়ে গবেষণাতে দ্য ব্রয়লি আলোর কণার স্থিরভর শীন্য না লে তার ফল কী হতে পারে সেই বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। সেই সময় তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে আইনস্টাইনের আলোকতড়িৎ তত্ত্ব অনুযায়ী আলোর কোয়ান্টামের শক্তি E=hn


সুতরাং তার স্থিরভর শূন্য ধরে নিলে তার ভরবেগ (p) হল hn/c; এখানে হল আলোর বেগ।1

দ্য ব্রয়লি এর মধ্যেই আলোর কণার ভর থাকলে কী হতে পারে তা নিয়ে ভেবেছিলেন; এবার তাঁর মনে হল যে আলোকতরঙ্গের কণার যদি ভরবেগ থাকে, তাহলে কি ইলেকট্রনের মতো সাধারণ কণারও কোনো তরঙ্গধর্ম থাকতে পারে? এই হলো জড় তরঙ্গ বিষয়ে প্রথম চিন্তা। ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি এই বিষয়ে তাঁর প্রথম গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন। সেই হিসাবে আমরা এখন জড় তরঙ্গের শতবর্ষ পালন করছি। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি একই বিষয়ে আরো কয়েকটি গবেষণাপত্র লেখেন।পরের বছর তিনি সরবোন অর্থাৎ প্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেটের জন্য তাঁর থিসিস জমা দেন, সেখানে তিনি জড় তরঙ্গ বিষয়ে তাঁর তাঁর চিন্তাভাবনাকে প্রকাশ করে লেখেন।

দ্য ব্রয়লির প্রকল্প নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। আমরা এখানে আধুনিক কালে দ্য ব্রয়লির তত্ত্ব কেমনভাবে পড়ানো হয় তা অনুসরণ করব। তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যাতে যে সমস্ত জটিল অঙ্ক আসে, তাদের কোনো প্রয়োজন আমাদের হবে না। দ্য ব্রয়লির কৃতিত্ব জটিল গণিতে নয়, সম্পূর্ণ নতুন এক চিন্তাতে। আইনস্টাইনের গবেষণা দ্য ব্রয়লিকে পথ দেখিয়েছিল। আগে দেখলাম, ফোটন কণার শক্তি ও আলোর কম্পাঙ্কের মধ্যে সম্পর্কটি হল E=hn এবং ফোটন কণার ভরবেগ হল hn/c। আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (l)2 সাহায্যে লিখতে পারি

                                                 p=hl
দ্য ব্রয়লি বললেন, এই সম্পর্কটা শুধু আলো নয়, সমস্ত জড়বস্তুর জন্যও সত্য। প্রত্যেক গতিশীল বস্তুর একটি ভরবেগ আছে, সুতরাং তার একটি তরঙ্গদৈর্ঘ্য পাওয়া যাবে। এই হল দ্য ব্রয়লির তত্ত্ব।

বোরের পরমাণুর মডেলকে খুব সহজে ব্যাখ্যা করলেন দ্য ব্রয়লি। বোর বলেছিলেন যে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেক্ট্রনগুলি কতকগুলো নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে। সেগুলোকে বলে স্থায়ী কক্ষপথ। কিন্তু কেন সেগুলোই স্থায়ী, অন্যগুলো নয়, তার কোন ব্যাখ্যা বোর দিতে পারেননি। দ্য ব্রয়লির ব্যাখাটা নিচের ছবি থেকে পরিষ্কার হবে। কক্ষপথের ইলেকট্রনের একটা নির্দিষ্ট ভরবেগ আছে, সুতরাং তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য আছে যা উপরের সূত্র থেকে পাওয়া যাবে। সেই কক্ষপথগুলোই স্থায়ী যেখানে কক্ষপথের দৈর্ঘ্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পূর্ণ সংখ্যার গুণিতক হবে। বাঁদিকের ছবিতে ইলেকট্রন তরঙ্গ এই শর্তপূরণ করছে, ফলে তরঙ্গশীর্ষ ও তরঙ্গপাদগুলি স্থায়ী হচ্ছে। ডানদিকের ছবিতে এই শর্ত পূরণ হয় না, ফলে তরঙ্গশীর্ষ ইত্যাদি স্থায়ী হওয়া সম্ভব নয়। তাই কিছু কিছু কক্ষপথই একমাত্র স্থায়ী হয়। বোর স্থায়ী কক্ষপথের জন্য যে প্রাথমিক সূত্র দিয়েছিলেন, তা দ্য ব্রয়লির তত্ত্বের সঙ্গে অবিকল মিলে গেল।



বিষয়টা শুনতে সহজ হলেও তার তাৎপর্য ছিল খুব গভীর। দ্য ব্রয়লির থিসিসের পরীক্ষা হয় ১৯২৪ সালের ২৫ নভেম্বর। পরীক্ষকদের মধ্যে ছিলেন পিয়ের লাঁজেভা ও নোবেলজয়ী পদার্থবিদ জাঁ পের‍্যাঁ। শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন তরুণ আমেরিকান বিজ্ঞানী রবার্ট ভ্যান ডি গ্রাফ, তাঁর স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায় দ্যা ব্রয়লি এমন নতুন কথা বলেছিলেন যে পরীক্ষকসহ উপস্থিত প্রায় সকলেরই বুঝতে অসুবিধা হয়েছিল। লাজেভাঁ ছিলেন থিসিসের সুপারভাইসার বা উপদেষ্টা। দ্য ব্রয়লি পরে বলেছেন যে লাজেভা প্রকল্পটির বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন।3 জেনেভাতে তাঁর সঙ্গে আইনস্টাইনের দেখা হয়, আলোচনা প্রসঙ্গে সেই থিসিসের কথা আসে। আইনস্টাইন আগ্রহ দেখালে লাজেভাঁ প্যারিতে ফিরে লুই দ্য ব্রয়লিকে থিসিসের একটি কপি আইনস্টাইনকে পাঠাতে বলেন। আইনস্টাইন সেটি পড়ে লাজেভাঁকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯২৪ লেখা এক চিঠিতে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। একই দিন হেনড্রিক লরেঞ্জকে আইনস্টাইন যে চিঠি লেখেন তার কথা আগেই এসেছে। সেখানে তিনি লেখেন যে দ্য ব্রয়লির কাজ হল প্রকৃতির গূঢ়তম রহস্যের উপর প্রথম ক্ষীণ আলোককিরণ।

আইনস্টাইন শুধু চিঠি লিখেই ক্ষান্ত থাকেননি। তার অল্প দিন আগে সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধটি আইনস্টাইনকে পাঠিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর সূত্রকে ভরহীন ফোটন কণার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আইনস্টাইন সেই সূত্রকে ভরযুক্ত কণিকার জন্য ব্যবহারের উপযোগী করেছিলেন, সেই নিয়ে তিনি পরপর তিনটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত চিঠিটি পাঠান ১৯২৪ সালের ২ জুন, আইনস্টাইন তাঁকে উত্তর দেন ২ জুলাই, সেদিনই তিনি প্রবন্ধটি প্রকাশের জন্য জমা দেন। এরপর ১০ জুলাই প্রুশিয়ান আকাডেমি তিনি এ বিষয়ে তাঁর প্রথম গবেষণাপত্রটি পাঠ করেন। খুব সম্ভবত এর পরে তিনি দ্য ব্রয়লির থিসিসটি হাতে পান। পরের বছর জানুয়ারি মাসের ৮ তারিখে তিনি দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটি পাঠ করেন এবং সেখানে নতুন সংখ্যায়ন এবং দ্য ব্রয়লির কণাতরঙ্গ, এই দুইকেই ব্যবহার করেন। এই লেখাটি পড়েই দ্য ব্রয়লির কাজের প্রতি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম স্রষ্টা শ্রয়ডিঙ্গারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল, এবং শেষ পর্যন্ত তার থেকেই তিনি কণাতরঙ্গের জন্য একটি সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করেন,4 যাকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার দ্বিতীয় জন্ম বলা যায়। হাইজেনবার্গ আগেই অবশ্য তাঁর ম্যাট্রিক্স বলবিদ্যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু শ্রয়ডিঙ্গারের সমীকরণের পরই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিষয়টি কিছুটা বোধগম্য হয়। শ্রয়ডিঙ্গার আইনস্টাইনকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন তাঁর জানুয়ারি মাসের গবেষণাপত্রটি তাঁর চোখে না পড়লে তিনি এ বিষয়ে চিন্তাভাবনাই শুরু করতেন না। দ্য ব্রয়লির থিসিস অ্যানালস ডে ফিজিক পত্রিকার ১৯২৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল, তবে সেটি সম্ভবত শ্রয়ডিঙ্গারের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল।5 শ্রয়ডিঙ্গার ১৯২৬ সালের মার্চ মাসে দ্য ব্রয়লিকে লেখা এক চিঠিতে তাঁর অবদানের কথা স্বীকার করেন। আইনস্টাইনের গবেষণাপত্রটিই জার্মানিতে ম্যাক্স বর্ন, সুইজারল্যান্ডে শ্রয়ডিঙ্গার বা ইংল্যান্ডে পল ডিরাকের মতো বিজ্ঞানীদের দ্য ব্রয়লির কাজ সম্পর্কে সচেতন করে। এই তিনজনই পরবর্তীকালে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেবেন।

আলোর যেমন কণিকা ধর্ম আছে, ঠিক তেমনি সমস্ত কণিকারও তরঙ্গ ধর্ম আছে। শুধু কণা নয়, সমস্ত বস্তুরই তরঙ্গ ধর্ম আছে, কিন্তু আমরা সেটা দেখতে বা মাপতে পারি না। একমাত্র খুব কম ভরের বস্তুর জন্য সেটা দেখা যাবে। ইলেকট্রন হল তখনো পর্যন্ত আমাদের জানা সব থেকে কম ভরের কণা, সুতরাং তার তরঙ্গ ধর্ম দেখা সব থেকে সহজ। আলাদা আলাদা ভাবে সেই কাজটা ১৯২৭ সাল নাগাদ করলেন ব্রিটেনে জর্জ টমসন ও আমেরিকাতে ক্লিন্টন ডেভিসন এবং তাঁর সহযোগী লেস্টার জার্মার।

তাঁদের পরীক্ষাতে তরঙ্গের একটা বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করা হয়। সামনে কোনো বাধা এলে তরঙ্গ বাঁকা পথে তাকে এড়িয়ে চলতে পারে, একে বলে অপবর্তন (Diffraction)। বাধার সামনে কোনো তরঙ্গ কতটা বাঁকবে তা তার দৈর্ঘ্যের উপর নির্ভর করে। তরঙ্গ বা ঢেউয়ের পরপর দুটো মাথার মধ্যে যে দূরত্ব তাকে বলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য। ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আরো অনেক ছোট, অবশ্য সেটা ইলেকট্রনের ভরবেগের উপর নির্ভর করে)। ইলেকট্রনের গতিশক্তি যদি একশো ইলেকট্রন ভোল্ট6 হয়, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য এক মিটারের হাজার কোটি ভাগের এক ভাগের কাছাকাছি। এই তরঙ্গের অপবর্তন দেখতে যে সূক্ষ্ম ছিদ্র লাগবে, তার মাপও এর কাছাকাছি হতে হবে।

এত সূক্ষ্ম বাধা বা ছিদ্র কোথায় পাওয়া যাবে? এক্সরশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্যও একই রকম মানের হয়, পদার্থের কেলাসের পরমাণুদের মাঝের ফাঁকা জায়গাগুলোকে ছিদ্র হিসাবে ব্যবহার করে তার অপবর্তন দেখা সম্ভব হয়েছে। একই পদ্ধতি ইলেকট্রন তরঙ্গের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হল। সংক্ষেপে জর্জ টমসনের পরীক্ষার বর্ণনা করি, ধাতুর পাতলা ফিল্মের উপরে উচ্চগতির ইলেকট্রনের স্রোত গিয়ে পড়ল, পিছনে তিনি রেখেছিলেন একটা ফটোগ্রাফিক প্লেট। অপবর্তন না হলে প্লেটের উপরে ইলেকট্রনরা একটা বিন্দুতে গিয়ে পড়ত, তা না হয়ে দেখা গেল প্লেটের উপর সুন্দর গোল গোল রিং তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ ইলেকট্রনেরও তরঙ্গ ধর্ম আছে। ডেভিসনরাও একই সময়ে প্রায় একই রকম পরীক্ষা করেছিলেন।

বিজ্ঞানীরা তখনই দ্য ব্রয়লির তত্ত্বকে প্রথমেই যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন, তাহলে হয়তো তার প্রমাণ পেতে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত না। থিসিস পরীক্ষার সময় জাঁ পের‍্যাঁ প্রশ্ন করেছিলেন দ্যা ব্রয়লি ঠিক বলছেন কিনা তা পরীক্ষা করে কেমনভাবে দেখা যাবে? পরীক্ষার্থী সঠিক উত্তরই দিয়েছিলেন যে কেলাসের সাহায্যে এক্স-রশ্মির মতোই ইলেকট্রন তরঙ্গেরও অপবর্তন দেখতে পাওয়া উচিত। তিনি দাদা মরিসের সহযোগী এক্স-রশ্মি বিশেষজ্ঞ আলেকজান্ডার দ্যভালিয়েরকে পরীক্ষাটা করে দেখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু দ্যভালিয়ের অন্য গবেষণাতে ব্যস্ত ছিলেন বলে তাঁর প্রস্তাবে সাড়া দেননি।

টমসন ও ডেভিসনদের পরীক্ষার পরে দ্য ব্রয়লির প্রকল্প নিয়ে আর কোনো সন্দেহ রইল না। তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন ১৯২৯ সালে। সেই বছর তাঁর সমর্থনে বারোটি মনোনয়ন জমা পড়েছিল; তার মধ্যে একটি ছিল তাঁর থিসিসের পরীক্ষক জাঁ পের‍্যাঁর। তার আট বছর পরে টমসন ও ডেভিসন পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠলেন। ঘটনাচক্রে ইলেকট্রনের তরঙ্গধর্ম প্রমাণকারী জর্জ টমসন হলেন ইলেকট্রন কণা আবিষ্কর্তার জোসেফ জন টমসনের ছেলে।

ইলেকট্রনের এই অদ্ভুত তরঙ্গধর্ম ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ, যা আমাদের অতি ক্ষুদ্র বস্তু দেখতে সাহায্য করে। এ দেখা মানে অবশ্য চোখে দেখা নয়, পর্যবেক্ষণ বলা যেতে পারে। আধুনিক যুগে একই পদ্ধতিতে তৈরি হয়েছে স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ বা অ্যাটমিক ফোর্স মাইক্রোস্কোপ। ১৯৮৬ সালে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ উদ্ভাবনের জন্য আর্ন্সট রুস্কা ও স্ক্যানিং টানেলিং মাক্রোস্কোপের জন্য জার্ড বিনিচ ও হাইনরিখ রোহ্‌রারকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। এই সব নতুন অণুবীক্ষণ দিয়ে একক পরমাণুকেও পর্যবেক্ষণ করাও সম্ভব। শুধু ইলেকট্রন নয়, নিউট্রনের মতো কণার তরঙ্গধর্মকে এখন বিজ্ঞানের পরীক্ষাগারে এবং শিল্পপ্রযুক্তিতে নিয়মিত ব্যবহার করা হচ্ছে।

ইলেকট্রন তাহলে কী? বস্তু না তরঙ্গ? ইলেকট্রন বা অন্য যে কোনো বস্তুই সাধারণ অর্থে তরঙ্গ হতে পারে না, কারণ তরঙ্গের ধর্ম হল ছড়িয়ে পড়া; ইলেকট্রনকে ছড়িয়ে পড়তে কেউ দেখেনি। এই তরঙ্গ তাহলে কী? এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন মাক্স বর্ন, তিনি দেখাবেন শ্রয়ডিঙ্গারের সমীকরণে যে তরঙ্গের কথা বলা হচ্ছে, তা হল সম্ভাবনা (probability); তা হল বস্তুকণার ভবিষ্যত গতিবিধির সূচক। দ্য ব্রয়লি এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তিনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তাকে বলা হয় পাইলট তরঙ্গ। তাঁর নিজের কথায়, “The corpuscle may thus be regarded as guided by the wave a kind of pilot-wave. This view provides an interesting picture of the motion of corpuscles in Wave Mechanics without there being any need to abandon classical ideas too sweepingly.” সেখানে ইলেকট্রন কণার মতোই ব্যবহার করে, তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে তার সঙ্গে যুক্ত জড় তরঙ্গ যার এক পৃথক অস্তিত্ব আছে। এখানে চিরায়ত পদার্থবিদ্যাকে কিছুটা অন্তত অনুসরণ করা যায়। এই ব্যাখ্যা অধিকাংশ বিজ্ঞানীর সমর্থন পায়নি, দ্য ব্রয়লি নিজেও জানতেন যে এই ব্যাখ্যাতে বহু সমস্যা আছে। পরে অবশ্য এই বিষয়টাকে আরো গিয়ে নিয়ে গেছেন কয়েকজন বিজ্ঞানী। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তাৎপর্যের জটিল আলোচনাতে ঢোকার সুযোগ এই লেখাতে নেই। শুধু একটা কথা বলা যেতে পারে, বহু বিজ্ঞানীর চেষ্টা সত্ত্বেও একশো বছর পরেও এই বিষয়ে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি।



তথ্যসূত্রঃ

  1. Aristocratic Culture and the Pursuit of Science: The de Broglies in Modern France, Mary Jo Nye, Vol. 88, No. 3 (Sep., 1997), pp. 397-421

  2. Matter and Light, Louise de Broglie, Translation by W.H. Johnston, 1939

  3. A Reexamination of Early Debates on the Interpretation of Quantum Theory: Louis de Broglie to David Bohm, José Gandarias Perillán, 2011

  4. The Historical development of Quantum Mechanics-Vol I Part 2, Jagdish Mehra and Helmut Rechenberg, 1982

  1. Louis Victor Pierre Raymond de Broglie, A. Abragam, Biographical Memoirs of Fellows of the Royal Society, 1988

  2. Probabilities of the Quantum World, Daniel Danin, 1983

  3. The Second Creation, Robert P. Crease and Charles P. Mann, 1996

1 আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ অনুযায়ী কোনো বস্তু বা কণার ভরবেগ, শক্তি ও স্থিরভরের মধ্যে সহজ সম্পর্কটি হল 

E2=p2c2+m2c4

2 লোর বেগ, তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্কের মধ্যে সম্পর্কটি হল c=nl

3 অন্য সূত্রেও জানা যায় যে লাজেভাঁ দ্য ব্রয়লির প্রকল্পকে কিছুটা কষ্টকল্পনাই মনে করতেন। অবশ্য তিনিই আবার ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে সলভে কনফারেন্সে সেটি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। সেখানে রাশিয়ান পদার্থবিদ আব্রাম ইওফেকে তিনি বলেছিলেন বিষয়টা যাই হোক, দ্য ব্রয়লির তত্ত্বের সৌষ্ঠব যে অসাধারণ তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

4 ফেলিক্স ব্লখ স্মৃতিচারণ করেছেন শ্রয়ডিঙ্গার একবার দ্য ব্রয়লির কাজ নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন পিটার ডিবাই মন্তব্য করেন যে তরঙ্গ থাকলে তার একটা সমীকরণ থাকা উচিত। এর কিছুদিন পরে আবার বক্তৃতা দিয়ে গিয়ে শ্রয়ডিঙ্গার বলেন যে ডিবাই যে সমীকরণটি চাইছিলেন, সেটি তিনি খুঁজে পেয়েছেন। পিওতর কাপিৎজাও এই ঘটনার কথা লিখেছেন, তবে শ্রয়ডিঙ্গার বা ডিবাই কেউই এই ঘটনার কখনো উল্লেখ করেননি।

5 দ্য ব্রয়লির থিসিস শ্রয়ডিঙ্গার কবে প্রথম দেখেছিলেন তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী সাক্ষ্য আছে। শ্রয়ডিঙ্গার সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। ফরাসি রসায়নবিদ ভিক্টর আঁরি বলেছেন তিনি ১৯২৫ সালে দ্য ব্রগলির থিসিসের এক কপি লাজেভাঁর থেকে জুরিখে নিয়ে যান, কিন্তু কিছুই বোধগম্য না হওয়াতে সেটি শ্রয়ডিঙ্গারকে পড়তে দেন। দু সপ্তাহ পরে শ্রয়ডিঙ্গার তাঁকে থিসিসটি ফেরত দেন, উপরে মন্তব্য লেখা ছিল ‘রাবিশ’। লাজেভাঁ সেই কথা শুনে বলেন শ্রয়ডিঙ্গার ভুল করছেন, তাঁরা আর এক বার দেখা উচিত।

6 একটা ইলেকট্রনকে একশো ভোল্ট বিভবপ্রভেদের মধ্যে দিয়ে পাঠালে তার গতিশক্তি হয় একশো ইলেকট্রন ভোল্ট।

 
প্রকাশ সাম্পান ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

Saturday, 15 March 2025

নিউক্লিয় বিদ্যুৎ

 

নিউক্লিয় বিদ্যুৎ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

নিউক্লিয় প্রযুক্তি বর্তমানে চিকিৎসা খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি অনেক জায়গায় ব্যবহৃত হলেও তার সবচেয়ে পরিচিত দিক হল বিদ্যুৎ ও মারণাস্ত্র। মারণাস্ত্র নিয়ে বিশেষ আলোচনা এই প্রবন্ধে থাকবে না, সেই বিষয়ে লেখার ক্ষমতাও আমার নেই। আমরা প্রথম, অর্থাৎ বিদ্যুতের দিকেই নজর দেব। কিন্তু প্রযুক্তি হল ইংরাজিতে যাকে বলে Two-edged sword; তার শুধু ভালো দিকটাকে নেব কিন্তু খারাপ দিকটার কথা ভাবব না, তা সম্ভব নয়। নিউক্লিয় বিদ্যুতের সঙ্গে নিউক্লিয় অস্ত্র জড়িত, তাই সেই বিষয়ে কিছু কথাও লেখার মধ্যে আসবে।

যাঁরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা পড়েননি, তাঁদের জন্য নিউক্লিয়াসের বন্ধন শক্তি (Binding energy) সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেয়া যাক। একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করি, তা হল ডয়টেরন অর্থাৎ ভারি হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস। এটি হল হাইড্রোজেনের আইসোটোপ1। এর বন্ধন শক্তি হল 2.2 MeV2। এর অর্থ এই নিউক্লিয়াসকে ভেঙে প্রোটন ও নিউট্রনকে আলাদা করতে গেলে 2.2 MeV শক্তি দিতে হয়। তেমনি প্রোটন ও নিউট্রন মিলে যখন ডয়টেরন তৈরি করে, তখন 2.2 MeV শক্তি বেরিয়ে আসে। আবার অক্সিজেন-16 এর নিউক্লিয়াসে থাকে আটটি প্রোটন ও আটটি নিউট্রন। এই নিউক্লিয়াসের বন্ধন শক্তি হল 127.6 MeV। এর অর্থ আটটা প্রোটন ও আটটা নিউট্রন মিলে যদি অক্সিজেনের নিউক্লিয়াস তৈরি করে, তখন ওই পরিমাণ শক্তি বেরিয়ে আসে, অথবা অক্সিজেনের নিউক্লিয়াস থেকে সবকটা প্রোটন ও নিউট্রনকে আলাদা করতে হলে ওই পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন।

 

চিত্র : বিভিন্ন নিউক্লিয়াসের গড় বন্ধনীশক্তি


 

অনেক সময় বন্ধনশক্তিকে নিউক্লিয়নের অর্থাৎ প্রোটন-নিউট্রনের মোট সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে গড় হিসাবে প্রকাশ করা হয়। উপরে ছবিটাতে গড় বন্ধনশক্তি কেমনভাবে নিউক্লিয়নের সংখ্যার সঙ্গে পাল্টায় তা দেখানো হয়েছে। দেখা যাচ্ছে গড় বন্ধনশক্তি প্রথমে বাড়তে বাড়তে নিউক্লিয়নের সংখ্যা ষাট-এর কাছাকাছি শিখরে পৌঁছায়, তারপর আবার কমতে থাকে। এই আচরণ নিউক্লিয় বলের চরিত্র থেকে ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু এই লেখাতে আমরা সেই আলোচনাতে যাব না।

নিউক্লিয় শক্তির ব্যবহার কীভাবে করা হয় তা প্রথম এই ছবি থেকে বোঝা যায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথায় পরে আসব, এখন একটা নিউক্লিয় বিক্রিয়ার কথা বলি যা সূর্যের জীবনের শেষ দিকে ঘটবে। তিনটি হিলিয়াম-4 মিলে তৈরি করবে কার্বন-12 এর নিউক্লিয়াস। ছবি থেকে দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয়টির গড় বন্ধনশক্তি প্রথমটির থেকে বেশি। হিলিয়াম-4-এর মোট বন্ধন শক্তি 28.3 MeV, এদিকে কার্বন-12-এর বন্ধন শক্তি হল 92.2 MeV। সুতরাং এই বিক্রিয়াতে মোট 92.2-3´28.3= 7.3 MeV পরিমাণ শক্তি মুক্ত হয়। দূর ভবিষ্যতে এই বিক্রিয়া হবে সূর্যের শক্তির প্রধান উৎস। এই ধরনের বিক্রিয়া যেখানে অপেক্ষাকৃত হালকা নিউক্লিয়াসরা মিলে ভারি নিউক্লিয়াস তৈরি করে, তাকে বলে সংযোজন (Fusion) বিক্রিয়া। উপরে ছবিতে শিখরের বাঁদিকে যে সমস্ত নিউক্লিয়াস আছে, তাদের সংযোজন ঘটিয়ে যদি শিখরের কাছে পৌঁছানো যায়, তাহলে এইভাবে শক্তি পাওয়া যাবে।

একবার শিখরে পৌঁছানোর পরে আর সংযোজন বিক্রিয়াতে শক্তি পাওয়া যাবে না। তবে শিখরের ডানদিকে যে সমস্ত নিউক্লিয়াস আছে, তারা যদি অপেক্ষাকৃত হালকা নিউক্লিয়াসে ভেঙে পড়ে, তাহলে শক্তি পাওয়া যাবে। এই ধরনের বিক্রিয়াকে বলে বিভাজন (Fission)। এবারেও একটা সহজ উদাহরণ নেওয়া যাক। ইউরেনিয়াম-235 (বন্ধন শক্তি 1783.9 MeV) বেরিয়াম-138 (বন্ধন শক্তি 1158.3 MeV), ক্রিপ্টন-97 (বন্ধন শক্তি 802.2 MeV)-এ ভেঙে পড়লে মোট শক্তি মুক্ত হবে 1158.3+ 802.2- 1783.9=176.6 MeV। নতুন নিউক্লিয়াসগুলিরও বিটা ক্ষয় হবে, ফলে আরো কিছু শক্তি পাওয়া যাবে। ঠিক এই বিক্রিয়াটা ঘটার সম্ভাবনা খুব কম, কারণ বিভাজনে সাধারণত কয়েকটি নিউট্রনও বেরোয়। তবে শক্তি পাওয়ার মূল নীতি এই উদাহরণ থেকে বোঝা যায়। একটি ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসের বিভাজন থেকে প্রায় 200 MeV শক্তি পাওয়া যায়। সহজ কথায় বললে যে বিক্রিয়াতে চূড়ান্ত নিউক্লিয়াস বা নিউক্লিয়াসগুলি শিখরের অপেক্ষাকৃত বেশি কাছে অবস্থান করে, সেইগুলিতে শক্তি মুক্ত হবে।

এই লেখার মূল আলোচ্য হল বিভাজন বিক্রিয়ার সাহায্যে শক্তি উৎপাদন, যদিও শেষে সংযোজন বিক্রিয়া নিয়েও কিছু কথা থাকবে। তাই বিভাজন বিক্রিয়ার আবিষ্কার সম্পর্কে কিছু কথা শুনে নেওয়া যাক। ইউরেনিয়াম হল প্রকৃতিতে পাওয়া সব থেকে ভারি মৌল। এটি তেজস্ক্রিয় বটে কিন্তু তার অর্ধায়ু কাল3 এত দীর্ঘ যে আমরা তাকে সুস্থিত বলেই ধরে নিতে পারি। ইতালির বিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি ধীরগতির নিউট্রনের সাহায্যে ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসকে আঘাত করেছিলেন। তার ফলে এমন কিছু মৌল পাওয়া গিয়েছিল যাদের ধর্ম ইউরেনিয়ামের থেকে সামান্য হালকা মৌলের ধর্মের সঙ্গে মিলছিল না। ফের্মি সিদ্ধান্ত করেন যে নিউট্রন ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করেছে, তারপর বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে নিউট্রন প্রোটনে রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ নতুন এক মৌল তৈরি হয়েছে যাকে প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। ফ্রান্সে মাদাম কুরির মেয়ে ও জামাই আইরন ও ফ্রেডরিক জোলিও কুরি পরীক্ষাটা করে দেখলেন কিন্তু ফের্মির সঙ্গে তাঁরা একমত হলেন না। জার্মানিতে অটো হান ও লিজে মাইটনার বারবার পরীক্ষাটা করছিলেন। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পোঁছানোর আগেই ইহুদি মাইটনার নাৎসিদের ভয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। হান ও তাঁর সঙ্গী ফ্রিজ স্ট্রাসমান শেষে অনুমান করেন যে আসলে নিউট্রনের ধাক্কায় ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস দু' টুকরো হয়ে যাচ্ছে। তার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন মাইটনার ও অটো ফ্রিশ। এভাবেই বিভাজন বিক্রিয়া ১৯৩৮ সালে আবিষ্কার হয়েছিল। কয়েক বছর পরে ফের্মি প্রথম নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টর তৈরি করেন।

১৯৩৮ সালেই ফের্মির নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হয়েছিল, সেখানে অন্য কাজের সঙ্গে নতুন মৌল আবিষ্কারের কথাও ছিল। ফের্মি জানতেন যে সেটা ভুল, কিন্তু তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে নোবেল পুরস্কারের তিনি যোগ্য। কথাটা ভুল নয়। ধীরগতির নিউট্রনের বিক্রিয়া, বিটা ক্ষয়ের প্রথম তত্ত্ব, ফের্মি সংখ্যায়ন, পরমাণুর টমাস-ফের্মি মডেল -- ফের্মির নানা আবিষ্কার এখনো পদার্থবিজ্ঞানীদের অন্যতম অস্ত্র। পুরস্কার নিতে যাওয়া তাঁর প্রয়োজন ছিল। তাঁর স্ত্রী লরা ছিলেন ইহুদি। জার্মানির চাপে ইতালিতেও তখন ইহুদিদের উপর অত্যাচার শুরু হয়েছে। ফের্মি সস্ত্রীক সুইডেনে পুরস্কার নিতে যান ও সেখান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেন। সেখানেই তিনি প্রথম নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টর তৈরি করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন নিউক্লিয় বোমা তৈরির মানহাটান প্রকল্পের তিনি একজন প্রধান স্থপতি।


নিউক্লিয় বিদ্যুতে ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী ভারি নিউক্লিয়াসের বিভাজন বিক্রিয়াকে কাজে লাগানো হয়। ধরা যাক ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসের কথা। কোনো নিউট্রন যখন তাকে আঘাত করে তখন সে উপরের উদাহরণের মতো দুটো বড় টুকরোতে ভেঙে পড়ে। এই প্রক্রিয়াতে অনেকটা শক্তি পাওয়া যায়, একই সঙ্গে দু-তিনটে নিউট্রন বেরোয়। সেই নিউট্রনগুলো আবার অন্য ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসকে আঘাত করে তাকে ভেঙে দেয়। প্রত্যেকটা সংঘর্ষ থেকে দু-তিনটে নিউট্রন বেরোয় যারা আবার অন্য ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে ধাক্কা মারে। এভাবে নিউট্রনের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। এই পদ্ধতি চলতেই থাকে, একে বলে শৃঙ্খল বিক্রিয়া। দ্বিতীয় ছবিতে এই বিক্রিয়ার তিনটি ধাপ দেখানো হয়েছে।

 

চিত্র ২: শৃঙ্খল বিক্রিয়ার তিনটি ধাপ


লিখতে যতটা সহজ লাগছে, আসলে বিক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার কাজটা তার থেকে অনেক শক্ত। প্রকৃতিতে পাওয়া ইউরেনিয়ামে দুটি আইসোটোপ আছে, ইউরেনিয়াম-235 238। এর মধ্যে দ্বিতীয়টির বিভাজনের জন্য নিউট্রনের শক্তি বেশি হওয়া প্রয়োজন। নিউট্রনের সঙ্গে ইউরেনিয়াম-238 বিক্রিয়া করে তৈরি করে ইউরেনিয়াম-239। নিউট্রনের শক্তি বেশি হলে এই নিউক্লিয়াসের এক অংশ সরাসরি বিভাজন বিক্রিয়াতে অংশ নেয়। অন্য অংশ থেকে পরপর দুটি বিটাক্ষয়ের মাধ্যমে পাওয়া যায় প্লুটোনিয়াম-2394। নিউট্রনের শক্তি কম হলে শুধু প্লুটোনিয়ামই পাওয়া যায়। প্লুটোনিয়ামকেও কাজে লাগানো হয়; সে কথায় পরে আসছি। তবে এই আইসোটোপের সঙ্গে নিউট্রন বিক্রিয়ার হার অত্যন্ত ধীর, ফলে তার সাহায্যে শক্তি উৎপাদনে অনেক সমস্যা আছে। পৃথিবীতে বর্তমানে মাত্র দুটি এইরকম রিঅ্যাক্টর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। এদের বলে ফাস্ট ব্রিডার, পরে আমরা এদের কথায় আসব।

প্রায় সব নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টরেই মূল জ্বালানি হল ইউরেনিয়াম-235 আইসোটোপ। কিন্তু প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামে তার পরিমাণ মাত্র 0.7 শতাংশ। আইসোটোপদের রাসায়নিক ধর্ম একই বলে তাদের আলাদা করা ভীষণ কষ্টকর ও খরচসাপেক্ষ। নিউক্লিয় বিভাজন বিক্রিয়াতে যে সমস্ত নিউট্রন পাওয়া যায় তাদের শক্তি অনেক বেশি, গড়ে 2 MeV। এই শক্তির নিউট্রন ইউরেনিয়ামের দুটি আইসোটোপের সঙ্গেই প্রায় সমান মাত্রায় ক্রিয়া করে, ফলে বিভাজনে সৃষ্ট অধিকাংশ নিউট্রনই ইউরেনিয়াম-238-এ আটকা পড়ে; শৃঙ্খল বিক্রিয়াতে তারা কাজে লাগে না। (দ্বিতীয় ছবি দ্রষ্টব্য।)

নিউট্রনের শক্তি খুব কম, অর্থাৎ 25 meV (মিলি ইলেকট্রনভোল্ট)-এর কাছাকাছি হলে কিন্তু ইউরেনিয়াম-235-এর সঙ্গে বিক্রিয়ার সম্ভাবনা 238 আইসোটোপের থেকে কয়েকশো গুণ বেশি, তখন এই সমস্যা থাকে না। এই শক্তির নিউট্রনকে বলে তাপীয় নিউট্রন, তাই যে সমস্ত রিঅ্যাক্টরে এই ধরনের নিউট্রন ব্যবহার করা হয়, তাদের বলে থার্মাল বা তাপীয় রিঅ্যাক্টর। নিউট্রনের শক্তি কমানোর জন্য মডারেটর ব্যবহার করা হয়। একটা দ্রুতগতি স্ট্রাইকার ক্যারমবোর্ডের দেওয়ালে ধাক্কা খেলে প্রায় সমান বেগ নিয়ে ফিরে যায়; কিন্তু তার সমান ভারি স্ট্রাইকারকে ধাকা মারলে তার বেগ অনেক কমে যায়। একই কারণে মডারেটর সাধারণত হয় হাল্কা পরমাণুর নিউক্লিয়াস। সব থেকে সরল মডারেটর হল জল। তার মধ্যে যে হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস অর্থাৎ প্রোটন থাকে, তার ভর নিউট্রনের প্রায় সমান। সেই প্রোটনদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে নিউট্রনের শক্তি কমে তাপীয় মাত্রায় চলে আসে।

কিন্তু জল ব্যবহারে অন্য এক সমস্যা দেখা দেয়। ডয়টেরনের কথা আগেই বলেছি; প্রতি চারটি নিউট্রন প্রোটন সংঘর্ষে একটি ডয়টেরন তৈরি হয়। ফলে নিউট্রনের সংখ্যা কমে যায়। সেই কারণে জ্বালানির মধ্যে ইউরেনিয়াম-235-এর পরিমাণ বাড়াতে হয় যাতে নির্গত নিউট্রনের একটা বড় অংশ আবার ইউরেনিয়াম-235-এর নিউক্লিয়াসের সঙ্গেই বিক্রিয়া করে শৃঙ্খল বিক্রিয়া চালু রাখে। ইউরেনিয়াম-235-এর পরিমাণকে নানা ভাবে বাড়িয়ে সাধারণত তিন থেকে পাঁচ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়, এই প্রক্রিয়াকে বলে এনরিচমেন্ট।

অন্য একটা উপায় হল সাধারণ জলের পরিবর্তে ভারি জল ব্যবহার করা। ভারি জলে প্রোটনের জায়গা নেয় ডয়টেরন। ডয়টেরনের সঙ্গে নিউট্রনের নিউক্লিয় বিক্রিয়া হয় না বললেই চলে, সেই কারণে নিউট্রনের পরিমাণ কমে না। সাধারণ জলের প্রতি তিনহাজার দুশো অণুর মধ্যে একটা ভারি জলের অণু থাকে। উচ্চ গতি সম্পন্ন সেন্ট্রিফিউজে ভারি জলকে সাধারণ জলের থেকে আলাদা করা যায়। ভারি জল ব্যবহার করলে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামই জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যায়, এনরিচ করার দরকার পড়ে না।

ভারি জলের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য ইতিহাসের একটা কাহিনি শোনা যাক। রিঅ্যাক্টরে ভারি জলের সাহায্যে যে প্লুটোনিয়াম তৈরি হয়, তাকে বোমাতে ব্যবহার করা যায়। যদিও নিউক্লিয় বোমা তখনো ভবিষ্যতে, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া সব পক্ষই এই ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির হাতে যাতে ভারি জল না পড়ে, তার জন্য এক বিশেষ অভিযান চালানো হয়েছিল। সেই সময় ইউরোপে সব থেকে বড় ভারি জল তৈরির কারখানা ছিল নরওয়ের টেলেমার্কে। সেখান থেকে প্রতি বছর বারো টন ভারি জল পাওয়া যেত। যুদ্ধের ঠিক আগে ফরাসি গোয়েন্দাবিভাগ সেই কারখানার সমস্ত ভারি জল 'ধার' হিসাবে নেয়। জার্মান গোয়েন্দা বাহিনীর চোখ এড়াতে সেই জল নরওয়ে থেকে স্কটল্যান্ড হয়ে ফ্রান্সে পৌঁছায়। যুদ্ধ বাঁধার পরে ফ্রেডরিক জোলিও কুরি তার দায়িত্ব নেন, এবং ব্যাঙ্ক অফ ফ্রান্সের ভল্টে রাখার ব্যবস্থা করেন। তারপরে তা রাখেন এক জেলখানাতে। ফ্রান্সের পতনের সময় সেই জলকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়।

যুদ্ধে জার্মানি নরওয়ে দখল করে নিলে টেলেমার্কের কারখানা পুরোদমে চালু হয়। ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ ও নরওয়ের প্রতিরোধ বাহিনী তখন কারখানাটি ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে প্রতিরোধ বাহিনীর চারজন প্যারাট্রুপারকে প্লেন থেকে কারখানার কাছে নামানো হয়। দ্বিতীয় ধাপে দুটি প্লেন পনেরজন ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে টেলেমার্কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। কিন্তু দুটিই দুর্ঘটনাতে পড়ে এবং অনেকেই মারা যান। যাঁরা বেঁচেছিলেন তাঁদের জার্মান সৈন্যরা গ্রেপ্তার করে এবং যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করে। চারমাস পরে আবার ছ'জন নরওয়ের কম্যান্ডো ও এক ব্রিটিশ অফিসারকে প্লেন থেকে প্যারাসুটে করে নামানো হয়। আগের চারজনের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হয়। তাঁরা এই চারমাস মস ও লাইকেন খেয়ে বেঁচেছিলেন; শুধু একবার একটা বলগা হরিণ মারতে পেরেছিলেন। এগারোজনের দল কারখানার মধ্যে ঢুকে বিস্ফোরকের সাহায্যে সেটির আংশিক ক্ষতি করেন। তিন হাজার জার্মান সৈন্য তাঁদের সন্ধানে তল্লাসি চালালেও দলের সকলেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পাঁচজন ৩২২ কিলোমিটার স্কি করে নিরপেক্ষ সুইডেনে আশ্রয় নেন, দু'জন যান নরওয়ের রাজধানী অসলোতে। চারজন ওই অঞ্চলেই থেকে যান। কারখানাটি আবার চালু করা হয়েছিল, কিন্তু বারবার ব্রিটিশ বোমারু বিমান তাকে আক্রমণ করে এতটাই ক্ষতি করতে সফল হয় যে শেষ পর্যন্ত তা বন্ধ করে দিতে হয়। যতটা ভারি জল ছিল, পুরোটাই জার্মানিতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। নরওয়ের প্রতিরোধ বাহিনী তার খবর পেয়েছিল; যে ফেরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তারা সেটিকে টাইমবোমার সাহায্যে ডুবিয়ে দেয়।


এখন পৃথিবীতে মোট ৪৩৭টি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী তাপীয় রিঅ্যাক্টর আছে, তার মধ্যে ৩৭০টিতে সাধারণ জল ও আটচল্লিশটিতে ভারি জল ব্যবহার করা হয়। এই জলকেই আবার রিঅ্যাক্টরের ভিতর থেকে তাপ বাইরে আনার কাজে ব্যবহার করা হয়। ভারতে চব্বিশটি রিঅ্যাক্টরের মধ্যে কুড়িটিতে ভারি জল ব্যবহার করা হয়। যে সব দেশ সব থেকে বেশি ভারি জল উৎপাদন করে, ভারত তাদের মধ্যে অন্যতম; নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে রপ্তানিও করে। ভারি জলের উৎপাদন এনরিচমেন্টের থেকে কম খরচসাপেক্ষ।

এনরিকো ফের্মির তৈরি প্রথম রিঅ্যাক্টরে গ্রাফাইট মডারেটর ব্যবহার হয়েছিল। বর্তমানে গ্রাফাইট মডারেটর ব্যবহার করা হয় উনিশটি রিঅ্যাক্টরে। গ্রাফাইটে নিউট্রনের সংখ্যা দশ শতাংশ হ্রাস পায়। তবে এই রিঅ্যাক্টরে একটা বড় সমস্যা হল নিউট্রনের সঙ্গে বিক্রিয়ার ফলে গ্রাফাইট তেজস্ক্রিয় হয়ে যায়, যা পরে সমস্যা সৃষ্টি করে। ভারি জলও তেজস্ক্রিয় হয়, তবে তার পরিমাণ অনেক গুণ কম। তাকেও কাজে লাগানো যায়, শেষে সেই সম্পর্কে দু'চার কথা থাকবে।

তবে ফের্মির অনেক আগেই নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টর তৈরি হয়েছিল। পৃথিবীর সব থেকে পুরানো তাপীয় রিঅ্যাক্টরের বয়স দুশো কোটি বছর। প্রকৃতি নিজেই তাকে তৈরি করেছিল। তার নিদর্শন আছে আফ্রিকার গ্যাবন দেশের ওকলোতে। সেখানে ইউরেনিয়ামের সঙ্গে মিশেছিল জল যা মডারেটরের কাজ করে ইউরেনিয়াম-235-এর বিভাজন ঘটায়। সৃষ্ট তাপ জলকে বাষ্পীভূত করে, তখন বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। আবার কিছুদিন পরে জল জমা হলে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। সেই কারণে ওকলোর খনি থেকে পাওয়া ইউরেনিয়ামের মধ্যে পরিমাণ স্বাভাবিকের থেকে সামান্য কম, তার বদলে বিভাজন প্রক্রিয়াতে পাওয়া যায় এমন সমস্ত মৌল রয়েছে। প্রশ্ন আসে, এই জল তো সাধারণ জল, ভারি জল নয়। তাহলে সেখানে প্রাকৃতিক রিঅ্যাক্টর কাজ করেছিল কেমন করে? আমরা দেখেছি যে সাধারণ জল ব্যবহার করলে ইউরেনিয়ামকে এনরিচ করতে হবে। ইউরেনিয়াম-235 238-এর অর্ধায়ু কাল যথাক্রমে সত্তর কোটি বছর ও সাড়ে চারশো কোটি বছর। এই বিক্রিয়া ঘটেছিল আজ থেকে দুশো কোটি বছর আগে। তখন ইউরেনিয়ামের মধ্যে 235 আইসোটোপের পরিমাণ ছিল বেশি, তিন শতাংশের কাছাকাছি। ফলে তখন প্রকৃতিতেই ইউরেনিয়াম আজকের এনরিচের পরের মাত্রাতে পাওয়া যেত। তাই ওকলোর রিঅ্যাক্টর কাজ করেছিল।

নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টরে বিক্রিয়াকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যেন নিউট্রনের সংখ্যা একটা নির্দিষ্ট মাত্রাতেই আটকে থাকে। এই অবস্থাকে বলে ক্রান্তিক অবস্থা। যদি ক্রান্তিক অবস্থা ছাড়িয়ে যায়, নিউট্রনের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে একসময় একসঙ্গে অনেকগুলি বিক্রিয়া করে প্রচুর পরিমাণ শক্তি তৈরি করবে, এই হল নিউক্লিয় বোমা। বোমার বিষয়টা আরো স্পষ্ট হলে রিঅ্যাক্টরের কার্যপ্রণালী বুঝতে সুবিধা হবে। এখানে আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, তা হল ক্রান্তিক ভর (critical mass)। যদি ইউরেনিয়ামের পরিমাণ খুব কম হয়, তাহলে অনেকগুলি নিউট্রন বিক্রিয়া না করেই বেরিয়ে যাবে। (দ্বিতীয় ছবির ডানদিকে দেখানো হয়েছে।) সেক্ষেত্রেও শৃঙ্খল বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। সেজন্য একটা ন্যূনতম ভরের প্রয়োজন, একেই বলে ক্রান্তিক ভর। বোমার ক্ষেত্রে হঠাৎ করে ইউরেনিয়ামের পরিমাণ ক্রান্তিক ভর পেরিয়ে যায়, তখনই বিস্ফোরণ ঘটে। রিঅ্যাক্টরে নিউট্রন যাতে না বেরিয়ে যায় তার জন্য রিঅ্যাক্টরের একটা আবরণ থাকে যা নিউট্রনকে আবার রিঅ্যাক্টরের মধ্যে ফিরিয়ে দেয়।

নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টরে শৃঙ্খল বিক্রিয়াকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় যাতে করে নিউক্লিয়াসের ভেঙে পড়ার হার পরিবর্তন হয় না। ফলে একই হারে শক্তি তৈরি হতেই থাকে এবং তাকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হয়। পুরানো দিনের রিঅ্যাক্টরে যদি কোনোভাবে বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে এক সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ শক্তি তৈরি হয়ে রিঅ্যাক্টরকে ধংস করে তেজস্ক্রিয় পদার্থ বাইরে ছড়িয়ে দিতে পারত। অবশ্য তা কখনোই ক্রান্তিক ভর অতিক্রম করত না, ফলে নিউক্লিয় বিস্ফোরণের সমতুল্য হত না। কিন্তু প্রচুর পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থ পরিবেশে মেশাও খুবই বিপজ্জনক; চের্নোবিলে এই ঘটনাই অনেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। আধুনিক ডিজাইনের রিঅ্যাক্টরে অবশ্য সে সম্ভাবনাকে অনেক কমানো হয়েছে।

 

চিত্র ৩: লিটল বয়


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে দুটি বোমা জাপানের উপর প্রয়োগ করা হয়েছিল, সেখানে দুটি পদ্ধতি নেওয়া হয়েছিল। হিরোশিমার উপরে যে বোমা ফেলা হয়েছিল, তার নাম ছিল লিটল বয়। এখান বেলনাকার নিরেট ইউরেনিয়াম-235-এর উপর ইউরেনিয়ামের ফাঁপা বুলেট রাসয়ানিক বিস্ফোরক ব্যবহার করে ছোঁড়া হয়েছিল। বুলেট যখন লক্ষ্যবস্তুর উপর আঘাত করে, তখন দুই মিলিয়ে ইউরেনিয়ামের মোট ভর ক্রান্তিক ভর অতিক্রম করে ও বিস্ফোরণ ঘটে। তৃতীয় ছবিতে লিটল বয়-এর ডিজাইন দেখানো হয়েছে। বোমার মধ্যে মডারেটর ব্যবহারের প্রশ্নই ওঠে না, তাই ইউরেনিয়ামকে অনেক বেশি পরিমাণে এনরিচ করতে হয়। লিটল ম্যানে মোট ৬৪ কিলোগ্রাম ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়েছিল যার আশি শতাংশ ছিল ইউরেনিয়াম-235। অবশ্য মাত্র এক কিলোগ্রাম ইউরেনিয়াম-235 বিভাজন বিক্রিয়াতে অংশ নিয়েছিল, এবং শক্তি হিসাবে মুক্ত হয়েছিল মাত্র 0.7 গ্রাম, একটা পেপার ক্লিপের থেকেও কম পরিমাণ! ওই সামান্য ভর থেকেই যে শক্তি পাওয়া গিয়েছিল, তাতে বিস্ফোরণের 1.3 কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে শহরের সমস্ত কিছু ধংস হয়ে গিয়েছিল। নাগাসাকির উপরে ফেলা বোমাতে ব্যবহার হয়েছিল প্লুটোনিয়াম-239। প্লুটোনিয়ামের একটি ফাঁপা গোলকের বাইরে এমনভাবে বিস্ফোরক সাজিয়ে রাখা হয়েছিল যে বিস্ফোরণের ফলে সমস্ত প্লুটোনিয়াম একসঙ্গে এসে কেন্দ্রে জমা হয়। এভাবে প্লুটোনিয়ামের পরিমাণ ক্রান্তিক ভর পেরিয়ে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটে। ভারতে ১৯৭৪ সালে পারমাণবিক বিস্ফোরণ এই পদ্ধতিতেই হয়েছিল, প্লুটোনিয়ামের উৎস ছিল কানাডা থেকে পাওয়া সাইরাস রিঅ্যাক্টর।

রিঅ্যাক্টরের ভিতরে যে তাপ উৎপাদন হয়, তাকে ব্যবহার করে স্টিম তৈরি করে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। রিঅ্যাক্টরের ভিতরের তাপমাত্রা T1 এবং স্টিমের তাপমাত্রা T2 হলে তাপগতিবিদ্যার সূত্র অনুসারে রিঅ্যাক্টরের চরম দক্ষতা হল (T1-T2)/T1। বোঝা যায় যে T1-কে যত বাড়ানো যাবে, দক্ষতা তত বাড়বে। রিঅ্যাক্টরের মধ্যে জ্বালানিকে কঠিন অবস্থায় রাখতে হয়। ইউরেনিয়ামের গলনাঙ্ক 1132 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। অন্যদিকে ইউরেনিয়াম ডাইঅক্সাইডের গলনাঙ্ক হল 2900 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি। সেই কারণে ধাতব ইউরেনিয়ামের পরিবর্তে তার অক্সাইডকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সেরামিকের গুলি বা পেলেটের মহ্যে জ্বালানি ভরা হয়, সেগুলি জির্কোনিয়াম ধাতুর ফাঁপা রডের মধ্যে ঢোকানো থাকে। আধুনিক রিঅ্যাক্টরের ডিজাইনে T1 -কে বাড়িয়ে দশ হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। সেটা সম্ভব হলে রিঅ্যাক্টরের দক্ষতা তিরিশ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে পঞ্চাশ শতাংশ।

আমরা দেখেছি যে রিঅ্যাক্টরকে একটা নির্দিষ্ট মাত্রাতে চালাতে হয়। নিউক্লিয় বিক্রিয়াকে কমানো বাড়ানোর জন্য নিয়ন্ত্রক বা কন্ট্রোলার ব্যবহার করা হয়। এখানে এমন পদার্থ দিয়ে তৈরি রড ব্যবহার করা হয় যাদের সঙ্গে নিউট্রনের বিক্রিয়ার হার খুব বেশি। উদাহরণ স্বরূপ বোরন বা ক্যাডমিয়ামের কথা বলা যেতে পারে। রিঅ্যাক্টরের মধ্যে কয়েকটি নিয়ন্ত্রক রড থাকে যাদের অংশত বা পুরোপুরি বার করে নেওয়া যায়। যখন রিঅ্যাক্টরের মধ্যে পুরোপুরি প্রবেশ করানো থাকে, তারা এত নিউট্রন শোষণ করে যে শৃঙ্খল বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এই রডগুলিকে আগে পিছে করে রিঅ্যাক্টরকে ক্রান্তিক অবস্থাতে রাখা হয়। যদি কোনো কারণে ক্রান্তিক অবস্থা ছাড়িয়ে যায়, রডগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিঅ্যাক্টরের ভিতরে ঢুকে পড়ে। আধুনিক রিঅ্যাক্টরে একই সঙ্গে এমন রাসায়নিক ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যার নিউট্রন শোষণ ক্ষমতা খুব বেশি। ফলে নিউট্রনের অভাবে বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।

প্লুটোনিয়াম239-কেও রিঅ্যাক্টরে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যায়। প্লুটোনিয়াম প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, শক্তি উৎপাদনের সময় তাপীয় রিঅ্যাক্টরে তৈরি হয়। প্লুটোনিয়াম-239 যেমন শক্তি উৎপাদনে লাগে, তেমনি নিউক্লিয় বোমা তৈরিতেও ব্যবহার হয়। বর্তমানে অবশ্য সেই অস্ত্রের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে, ফলে অনেক নিউক্লিয় অস্ত্রধারী দেশ সেই প্লুটোনিয়ামকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজে লাগাচ্ছে। কিছু কিছু রিঅ্যাক্টর প্লুটোনিয়াম তৈরির জন্যই বিশেষভাবে নির্মিত, তাদের বলে ফাস্ট ব্রিডার রিঅ্যাক্টর। এদের কথা আগে এসেছে। এখানে নিউট্রনের শক্তি কমানো হয় না। ফলে ইউরেনিয়ামের দুটি আইসোটোপই প্রায় সমান পরিমাণ বিক্রিয়া করে। ইউরেনিয়াম-235 থেকে শক্তি পাওয়া যায়, অন্যদিকে ইউরেনিয়াম-238 শেষ পর্যন্ত প্লুটোনিয়ামে রূপান্তরিত হয়। তাছাড়া তাপীয় রিঅ্যাক্টরেও যে প্লুটোনিয়াম তৈরি হয়, তাকে সরিয়ে না নিলে তা একসময় বিভাজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে তাপের জোগান দিতে শুরু করে। পৃথিবীতে বিদ্যুতের জন্য নতুন চারটি ফাস্ট ব্রিডার তৈরি হচ্ছে, তার মধ্যে ভারতে একটি।

পরমাণু বিদ্যুৎ একসময়ে খুবই আশা জাগিয়েছিল। বিশেষ করে এই পদ্ধতিতে কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি হয় না, তাই শক্তি উৎপাদনে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ গ্যাস কমায়। কিন্তু কয়েকটি কারণে পরমাণু বিদ্যুৎ থেকে অনেক দেশই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। বিশেষ করে বলতে হয় ২০১১ সালের ফুকুশিমা দুর্ঘটনার কথা। ভূমিকম্প ও তার থেকে তৈরি সুনামির জন্য জাপানের ফুকুশিমার নিউক্লিয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটি রিঅ্যাক্টরে দুর্ঘটনা ঘটে। তেজস্ক্রিয় পদার্থ রিঅ্যাক্টর থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রায় এক লক্ষ লোককে সাবধানতার কারণে সরাতে হয়েছিল। তেজস্ক্রিয়তার কারণে কোনো মৃত্যু ঘটেনি, কিন্তু এইরকম দুর্ঘটনা এড়াতে সারা পৃথিবীর বেশ কিছু নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছে ২০১৯ সালে।

এখন পৃথিবীতে তাপীয় ও ব্রিডার মিলে মোট ৪৩৯টি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী রিঅ্যাক্টর চালু আছে যাদের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় চার লক্ষ মেগাওয়াট। পৃথিবীর মোট বিদ্যুৎ চাহিদার দশ শতাংশ মেটায় নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর। আরো ৬২টি নতুন রিঅ্যাক্টর নির্মীয়মান অবস্থায় আছে। সারা পৃথিবীর নিউক্লিয় বিদ্যুতের দুই শতাংশের কিছু কম ভারতে উৎপাদন হয়, তা দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের তিন শতাংশ। তবে ভারতে নিউক্লিয় বিদ্যুতের উৎপাদন দ্রুত বেড়ে চলেছে। গত দুই দশকে ন'টি নতুন রিঅ্যাক্টর বসান হয়েছে যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় চারহাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে নতুন আটটি রিঅ্যাক্টর বসানোর কাজ চলছে, তারা আরো সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট শক্তি যোগান দেবে।5

ভারতের ইউরেনিয়ামের মজুতের পরিমাণ খুবই কম, তার মানও খুব ভালো নয়। অন্য এক ভারি মৌলকে রিঅ্যাক্টরে ব্যবহার করা সম্ভব বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, তা হল থোরিয়াম। পৃথিবীর মোট থোরিয়ামের পরিণাম ইউরেনিয়ামের দ্বিগুণ, তার পঁচিশ শতাংশই ভারতে আছে। হোমি ভাভা উনিশশো পঞ্চাশের দশকেই থোরিয়াম দিয়ে শক্তি উৎপাদনের কথা ভেবেছিলেন। থোরিয়ামের যে আইসোটোপটি সরাসরি বিভাজন বিক্রিয়াতে ব্যবহার করা যায়, প্রকৃতিতে তার পরিমাণ এতই কম যে তা দিয়ে শক্তি উৎপাদনের খরচ চালানো সম্ভব নয়। থোরিয়ামের প্রধান আইসোটোপ হল Th-232, ব্রিডার রিঅ্যাক্টরে নিউট্রনের সঙ্গে বিক্রিয়া ও তারপরে দুটি বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে তা তৈরি করবে ইউরেনিয়ামের নতুন আইসোটোপ U-2336। এই আইসোটোপটিকে সরাসরি রিঅ্যাক্টরে শক্তি উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। তবে এখনো পর্যন্ত প্রযুক্তি থোরিয়াম জ্বালানি থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার মতো স্তরে পৌঁছায়নি। অবশ্য থোরিয়াম নিয়ে গবেষণা মাঝে বিশেষ এগোয়নি, কারণ মারণাস্ত্র থেকে ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম জ্বালানি হিসাবে বাজারে আসার পরে তাদের দাম কমে গিয়েছিল। এখন আবার থোরিয়াম নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে, তবে তা এখনো গবেষণার স্তরে।

পরমাণু বিদ্যুতের একটা বড় সমস্যা হল বর্জ্য। বিভাজন প্রক্রিয়াতে বর্জ্য পদার্থ হিসাবে তৈরি হয় বেশ কিছু তেজস্ক্রিয় মৌল। আমরা আগেই দেখেছি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্লুটোনিয়াম। ভারত সহ বেশ কিছু দেশ প্লুটোনিয়াম ও অবশিষ্ট ইউরেনিয়াম-238-কে পুনর্ব্যবহার করে অর্থাৎ তাকে আবার বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজে লাগায়। বর্তমানে পরমাণু জ্বালানির চল্লিশ শতাংশ এইভাবে পাওয়া যায়। প্লুটোনিয়াম অস্ত্র তোরিতেও কাজে লাগে, তবে সেই ব্যবহার এখন কমে এসেছে। তাছাড়া যে নতুন মৌলগুলি পাওয়া যায়, তাদের অর্ধায়ুকাল এমন যে বহু বছর পর্যন্ত তাদের থেকে বিকিরণ বেরোতে থাকে, সেই কারণে দীর্ঘকাল পর্যন্ত সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করতে হয়। সমস্ত নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টরের বর্জ্যই বিভিন্নভাবে সঞ্চয় করা হয়। এর পরিমাণ যে খুব বেশি তা নয়; একজন মানুষের সারা বছরের ইলেকট্রিসিটির প্রয়োজন মেটাতে মোটামুটি পাঁচ গ্রাম উচ্চ তেজস্ক্রিয়তার বর্জ্য তৈরি হয়। এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর থেকে পুনর্ব্যবহারের পরে মোটামুটি তিন ঘনমিটার বিপজ্জনক তেজস্ক্রিয়তার বর্জ্য তৈরি হয়। পক্ষান্তরে একটা এক হাজার মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বছরে তিন লক্ষ টন ছাই তৈরি করে, এবং তার থেকেও বড় কথা হল বাতাসে ষাট লক্ষ টন কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাসে মেশে। আমরা জানি যে কার্বন ডাই অক্সাইড হল গ্রিন হাউস গ্যাস; পৃথিবীর উষ্ণায়নের জন্য সেই মূল দায়ী। নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টরে কোনো কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি হয় না।

তেজস্ক্রিয় বর্জ্য রক্ষণে সমস্ত সাবধানতা সত্ত্বেও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা এড়ানো যায় না। এছাড়া পৃথিবীতে ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডারও সীমাবদ্ধ। থোরিয়াম এখনো পর্যন্ত কার্যকরীভাবে ব্যবহার সম্ভব হয়নি। আধুনিক প্রযুক্তিতে কণা ত্বরক ব্যবহার করে তেজস্ক্রিয় বর্জ্যকে এমন মৌলে রূপান্নতর করা সম্ভব যার ক্ষতি কররা ক্ষমতা অল্প দিনেই চলে যায়। থোরিয়ামকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহারেও কণাত্বরক ব্যবহারের কথা চলছে। তবে এখনো তা গবেষণার পর্যায়ে।

অপর এক ধরনের নিউক্লিয় বিক্রিয়াতে কিন্তু তেজষ্ক্রিয়তার সমস্যা নেই, তা হল সংযোজন বিক্রিয়া। শেষ করার আগে সেই বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু জেনে নেওয়া যাক। এই ধরনের তাপপারমাণবিক বা থার্মোনিউক্লিয়ার সংযোজন প্রক্রিয়াই সূর্যের বা হাইড্রোজেন বোমার শক্তির উৎস। সূর্যে কয়েক ধাপ বিক্রিয়াতে চারটি প্রোটন মিলে হিলিয়াম-4 তৈরি করে; এর মধ্যে প্রথমটিতে দুটি প্রোটন মিলে তৈরি করে ডয়টেরন। কিন্তু এই বিক্রিয়া এত ধীরে চলে যে পৃথিবীতে করা অসম্ভব। কিন্তু পৃথিবীতে ডয়টেরন ও ট্রিটিয়ামের বিক্রিয়া ঘটিয়ে হিলিয়াম-4 তৈরি করা সম্ভব; অতিরিক্ত হিসাবে পাওয়া যায় একটা নিউট্রন। ট্রিটিয়াম হল হাইড্রোজেনের আর একটি আইসোটোপ, এর কেন্দ্রে আছে একটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন। ট্রিটিয়ামও তেজষ্ক্রিয়, তার অর্ধায়ু বারো বছরের সামান্য বেশি। প্রাকৃতিকভাবে এই আইসোটোপটিকে পাওয়া যায় না, তৈরি করতে হয়। যেমন ভারি জলের রিঅ্যাক্টরে ডয়টেরনের সঙ্গে নিউট্রনের বিক্রিয়াতে অল্প পরিমাণ ট্রিটিয়াম তৈরি হয়। ১৯৯৮ সালে ভারতের হাইড্রোজেন বোমার জন্য ট্রিটিয়াম এইভাবেই পাওয়া গিয়েছিল। অপেক্ষাকৃত সহজ পদ্ধতিও আছে।

সংযোজন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনো সম্ভব হয়নি, তবে তার জন্য প্রয়াস চলছে। ফ্রান্সে তৈরি হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল থার্মোনিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর, সংক্ষেপে আইটিইআর। ভারত সহ পঁয়ত্রিশটি দেশ এই প্রকল্পের অংশীদার। কোনও তাপপারমাণবিক রিঅ্যাক্টর এখনো পর্যন্ত শক্তি সরবরাহ করতে শুরু করেনি; আইটিইআরই হল প্রথম যন্ত্র যা যে পরিমাণ শক্তি নেবে, তার থেকে বেশি শক্তি তৈরি করবে। ২০২৫ সালে আইটিইআর-এর কাজ শুরু করার কথা, পুরোপুরি কর্মক্ষমতাতে পৌঁছোতে লাগবে আরো দশ বছর। এটা অবশ্যই পরীক্ষামূলক, তবে একবার প্রযুক্তিটা আয়ত্ত করা গেলে তা দিয়ে তখন আরো নতুন নতুন রিঅ্যাক্টর তৈরি করা হবে। সমুদ্রজল ডয়টেরনের অগাধ ভাণ্ডার আছে, ট্রিটিয়ামও সহজেই তৈরি করা সম্ভব। তাই সংযোজন বিক্রিয়া বহু লক্ষ বছর মানব সভ্যতার শক্তি যোগাতে পারে।


তথ্যসূত্র

ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইট https://world-nuclear.org/

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির ওয়েবসাইট https://www.iaea.org/

নিউক্লিয়ার পাওয়ার কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেডের ওয়েবসাইট https://www.npcil.nic.in/index.aspx

Nuclear Power: A Very Short Introduction, Maxwell Irvine (2011)

Nuclear Weapons: A Very Short Introduction, Joseph M. Siracusa (3rd Edition, 2020)

Nuclear Power in India: A Critical History, B. Banerjee and N. Sharma (2008)


চিত্রঋণ উইকিপেডিয়া


1  যে কোনো মৌলের সমস্ত নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা সমান। সেটিই তার রাসায়নিক ধর্ম নির্ধারণ করে। কিন্তু মৌলের নিউক্লিয়াসে নিউট্রনের সংখ্যা আলাদা আলাদা হতে পারে। যে সব নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা সমান, কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা আলাদা, তাদের বলে আইসোটোপ। যেমন সাধারণ হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস হল একটি প্রোটন, কিন্তু ভারি হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে থাকে একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন।

2MeV (Million/Mega electron volt) হল শক্তির একক। 1 MeV = 106 eV; 1 eV=1.6´10-12 joule

3  যে সময়ে কোনো তেজস্ক্রিয় মৌলের নিউক্লিয়াসের সংখ্যা ক্ষয়ে অর্ধেক হয়ে যায়, তাকে বলে অর্ধায়ু কাল। ইউরেনিয়ামের প্রধান আইসোটোপ হল ইউরেনিয়াম-238, তার অর্ধায়ু কাল সাড়ে চারশো কোটি বছর। অর্থাৎ এক লক্ষ নিউক্লিয়াস নিয়ে শুরু করলে সাড়ে চারশো কোটি বছর পরে থাকবে পঞ্চাশ হাজার, আরো সাড়ে চারশো কোটি বছর পরে পঁচিশ হাজার, এই ভাবে নিউক্লিয়াসের সংখ্যা কমতে থাকবে।

বিটা ক্ষয়ের শৃঙ্খল হল ইউরেনিয়ায়াম-239 (অর্ধায়ু 23 মিনিট) -- নেপচুনিয়াম-239 (অর্ধায়ু 2.4 দিন) -- প্লুটোনিয়াম-239 (অর্ধায়ু 24,110 বছর)। ফের্মি এই বিক্রিয়ার কথাই ভেবেছিলেন। এটি হয়, কিন্তু এত ধীর গতিতে যে ফের্মির পরীক্ষাতে দেখা সম্ভব ছিল না।


5  ২০০৫ সালের ভারত মার্কিন নিউক্লিয় চুক্তি ও ২০০৮ সালে ভারতের লোকসভাতে ভোটের কথা পাঠকদের নিশ্চয় মনে আছে। তার পর ষোল বছর কেটে গেলেও এখনো পর্যন্ত ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো রিঅ্যাক্টর কেনেনি। ভারতের বর্তমান বা নির্মীয়মান রিঅ্যাক্টরগুলিও যে সমস্ত ডিজাইনের, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো রিঅ্যাক্টরে তাদের ব্যবহার হয় না।

6 এই বিটা ক্ষয়ের শৃঙ্খল হল থোরিয়াম-233 (অর্ধায়ু 24 মিনিট) -- প্রোট্যাক্টিনিয়াম-233 (অর্ধায়ু 27 দিন) -- ইউরেনিয়াম-233 (অর্ধায়ু 160,000 বছর)

প্রকাশঃ সাম্পান পত্রিকা, জানুয়ারি ২০২৫