নিউক্লিয়
বিদ্যুৎ
গৌতম
গঙ্গোপাধ্যায়
নিউক্লিয়
প্রযুক্তি বর্তমানে চিকিৎসা
খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি
অনেক জায়গায় ব্যবহৃত হলেও
তার সবচেয়ে পরিচিত দিক হল
বিদ্যুৎ ও মারণাস্ত্র।
মারণাস্ত্র নিয়ে বিশেষ আলোচনা
এই প্রবন্ধে থাকবে না,
সেই
বিষয়ে লেখার ক্ষমতাও আমার
নেই। আমরা প্রথম,
অর্থাৎ
বিদ্যুতের দিকেই নজর দেব।
কিন্তু প্রযুক্তি হল ইংরাজিতে
যাকে বলে Two-edged
sword; তার
শুধু ভালো দিকটাকে নেব কিন্তু
খারাপ দিকটার কথা ভাবব না,
তা
সম্ভব নয়। নিউক্লিয় বিদ্যুতের
সঙ্গে নিউক্লিয় অস্ত্র জড়িত,
তাই
সেই বিষয়ে কিছু কথাও লেখার
মধ্যে আসবে।
যাঁরা
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা
পড়েননি,
তাঁদের
জন্য নিউক্লিয়াসের বন্ধন
শক্তি (Binding
energy) সম্পর্কে
কিছু কথা বলে নেয়া যাক। একটা
উদাহরণ দিয়ে শুরু করি,
তা
হল ডয়টেরন অর্থাৎ ভারি
হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস।
এটি হল হাইড্রোজেনের আইসোটোপ।
এর বন্ধন শক্তি হল 2.2
MeV।
এর অর্থ এই নিউক্লিয়াসকে ভেঙে
প্রোটন ও নিউট্রনকে আলাদা
করতে গেলে 2.2
MeV শক্তি
দিতে হয়। তেমনি প্রোটন ও নিউট্রন
মিলে যখন ডয়টেরন তৈরি করে,
তখন
2.2
MeV শক্তি
বেরিয়ে আসে। আবার অক্সিজেন-16
এর
নিউক্লিয়াসে থাকে আটটি প্রোটন
ও আটটি নিউট্রন। এই নিউক্লিয়াসের
বন্ধন শক্তি হল 127.6
MeV।
এর অর্থ আটটা প্রোটন ও আটটা
নিউট্রন মিলে যদি অক্সিজেনের
নিউক্লিয়াস তৈরি করে,
তখন
ওই পরিমাণ শক্তি বেরিয়ে আসে,
অথবা
অক্সিজেনের নিউক্লিয়াস থেকে
সবকটা প্রোটন ও নিউট্রনকে
আলাদা করতে হলে ওই পরিমাণ
শক্তি প্রয়োজন।
 |
চিত্র ১:
বিভিন্ন
নিউক্লিয়াসের গড় বন্ধনীশক্তি
|
অনেক
সময় বন্ধনশক্তিকে নিউক্লিয়নের
অর্থাৎ প্রোটন-নিউট্রনের
মোট সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে গড়
হিসাবে প্রকাশ করা হয়। উপরে
ছবিটাতে গড় বন্ধনশক্তি কেমনভাবে
নিউক্লিয়নের সংখ্যার সঙ্গে
পাল্টায় তা দেখানো হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে গড় বন্ধনশক্তি
প্রথমে বাড়তে বাড়তে নিউক্লিয়নের
সংখ্যা ষাট-এর
কাছাকাছি শিখরে পৌঁছায়,
তারপর
আবার কমতে থাকে। এই আচরণ
নিউক্লিয় বলের চরিত্র থেকে
ব্যাখ্যা করা যায়,
কিন্তু
এই লেখাতে আমরা সেই আলোচনাতে
যাব না।
নিউক্লিয়
শক্তির ব্যবহার কীভাবে করা
হয় তা প্রথম এই ছবি থেকে বোঝা
যায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথায়
পরে আসব,
এখন
একটা নিউক্লিয় বিক্রিয়ার কথা
বলি যা সূর্যের জীবনের শেষ
দিকে ঘটবে। তিনটি হিলিয়াম-4
মিলে
তৈরি করবে কার্বন-12
এর
নিউক্লিয়াস। ছবি থেকে দেখা
যাচ্ছে দ্বিতীয়টির গড় বন্ধনশক্তি
প্রথমটির থেকে বেশি। হিলিয়াম-4-এর
মোট বন্ধন শক্তি 28.3
MeV, এদিকে
কার্বন-12-এর
বন্ধন শক্তি হল 92.2
MeV।
সুতরাং এই বিক্রিয়াতে মোট
92.2-3´28.3=
7.3 MeV পরিমাণ
শক্তি মুক্ত হয়। দূর ভবিষ্যতে
এই বিক্রিয়া হবে সূর্যের
শক্তির প্রধান উৎস। এই ধরনের
বিক্রিয়া যেখানে অপেক্ষাকৃত
হালকা নিউক্লিয়াসরা মিলে
ভারি নিউক্লিয়াস তৈরি করে,
তাকে
বলে সংযোজন (Fusion)
বিক্রিয়া।
উপরে ছবিতে শিখরের বাঁদিকে
যে সমস্ত নিউক্লিয়াস আছে,
তাদের
সংযোজন ঘটিয়ে যদি শিখরের কাছে
পৌঁছানো যায়,
তাহলে
এইভাবে শক্তি পাওয়া যাবে।
একবার
শিখরে পৌঁছানোর পরে আর সংযোজন
বিক্রিয়াতে শক্তি পাওয়া যাবে
না। তবে শিখরের ডানদিকে যে
সমস্ত নিউক্লিয়াস আছে,
তারা
যদি অপেক্ষাকৃত হালকা নিউক্লিয়াসে
ভেঙে পড়ে,
তাহলে
শক্তি পাওয়া যাবে। এই ধরনের
বিক্রিয়াকে বলে বিভাজন
(Fission)।
এবারেও একটা সহজ উদাহরণ নেওয়া
যাক। ইউরেনিয়াম-235
(বন্ধন
শক্তি 1783.9
MeV) বেরিয়াম-138
(বন্ধন
শক্তি 1158.3
MeV), ক্রিপ্টন-97
(বন্ধন
শক্তি 802.2
MeV)-এ
ভেঙে পড়লে মোট শক্তি মুক্ত
হবে 1158.3+
802.2- 1783.9=176.6 MeV।
নতুন নিউক্লিয়াসগুলিরও বিটা
ক্ষয় হবে,
ফলে
আরো কিছু শক্তি পাওয়া যাবে।
ঠিক এই বিক্রিয়াটা ঘটার সম্ভাবনা
খুব কম,
কারণ
বিভাজনে সাধারণত কয়েকটি
নিউট্রনও বেরোয়। তবে শক্তি
পাওয়ার মূল নীতি এই উদাহরণ
থেকে বোঝা যায়। একটি ইউরেনিয়াম
নিউক্লিয়াসের বিভাজন থেকে
প্রায় 200
MeV শক্তি
পাওয়া যায়। সহজ কথায় বললে যে
বিক্রিয়াতে চূড়ান্ত নিউক্লিয়াস
বা নিউক্লিয়াসগুলি শিখরের
অপেক্ষাকৃত বেশি কাছে অবস্থান
করে,
সেইগুলিতে
শক্তি মুক্ত হবে।
এই
লেখার মূল আলোচ্য হল বিভাজন
বিক্রিয়ার সাহায্যে শক্তি
উৎপাদন,
যদিও
শেষে সংযোজন বিক্রিয়া নিয়েও
কিছু কথা থাকবে। তাই বিভাজন
বিক্রিয়ার আবিষ্কার সম্পর্কে
কিছু কথা শুনে নেওয়া যাক।
ইউরেনিয়াম হল প্রকৃতিতে পাওয়া
সব থেকে ভারি মৌল। এটি তেজস্ক্রিয়
বটে কিন্তু তার অর্ধায়ু কাল
এত দীর্ঘ যে আমরা তাকে সুস্থিত
বলেই ধরে নিতে পারি। ইতালির
বিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি
ধীরগতির নিউট্রনের সাহায্যে
ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসকে
আঘাত করেছিলেন। তার ফলে এমন
কিছু মৌল পাওয়া গিয়েছিল যাদের
ধর্ম ইউরেনিয়ামের থেকে সামান্য
হালকা মৌলের ধর্মের সঙ্গে
মিলছিল না। ফের্মি সিদ্ধান্ত
করেন যে নিউট্রন ইউরেনিয়ামের
নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করেছে,
তারপর
বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে নিউট্রন
প্রোটনে রূপান্তরিত হয়েছে।
অর্থাৎ সম্পূর্ণ নতুন এক মৌল
তৈরি হয়েছে যাকে প্রকৃতিতে
পাওয়া যায় না। ফ্রান্সে মাদাম
কুরির মেয়ে ও জামাই আইরন ও
ফ্রেডরিক জোলিও কুরি পরীক্ষাটা
করে দেখলেন কিন্তু ফের্মির
সঙ্গে তাঁরা একমত হলেন না।
জার্মানিতে অটো হান ও লিজে
মাইটনার বারবার পরীক্ষাটা
করছিলেন। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে
পোঁছানোর আগেই ইহুদি মাইটনার
নাৎসিদের ভয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য
হন। হান ও তাঁর সঙ্গী ফ্রিজ
স্ট্রাসমান শেষে অনুমান করেন
যে আসলে নিউট্রনের ধাক্কায়
ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস দু'
টুকরো
হয়ে যাচ্ছে। তার তাত্ত্বিক
ব্যাখ্যা দেন মাইটনার ও অটো
ফ্রিশ। এভাবেই বিভাজন বিক্রিয়া
১৯৩৮ সালে আবিষ্কার হয়েছিল।
কয়েক বছর পরে ফের্মি প্রথম
নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টর তৈরি
করেন।
-
১৯৩৮
সালেই ফের্মির নোবেল পুরস্কার
ঘোষণা হয়েছিল,
সেখানে
অন্য কাজের সঙ্গে নতুন মৌল
আবিষ্কারের কথাও ছিল। ফের্মি
জানতেন যে সেটা ভুল,
কিন্তু
তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে
নোবেল পুরস্কারের তিনি
যোগ্য। কথাটা ভুল নয়। ধীরগতির
নিউট্রনের বিক্রিয়া,
বিটা
ক্ষয়ের প্রথম তত্ত্ব,
ফের্মি
সংখ্যায়ন,
পরমাণুর
টমাস-ফের্মি
মডেল --
ফের্মির
নানা আবিষ্কার এখনো
পদার্থবিজ্ঞানীদের অন্যতম
অস্ত্র। পুরস্কার নিতে যাওয়া
তাঁর প্রয়োজন ছিল। তাঁর
স্ত্রী লরা ছিলেন ইহুদি।
জার্মানির চাপে ইতালিতেও
তখন ইহুদিদের উপর অত্যাচার
শুরু হয়েছে। ফের্মি সস্ত্রীক
সুইডেনে পুরস্কার নিতে যান
ও সেখান থেকে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেন।
সেখানেই তিনি প্রথম নিউক্লিয়
রিঅ্যাক্টর তৈরি করেছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়
মার্কিন নিউক্লিয় বোমা তৈরির
মানহাটান প্রকল্পের তিনি
একজন প্রধান স্থপতি।
|
নিউক্লিয়
বিদ্যুতে ইউরেনিয়াম বা
প্লুটোনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয়
কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী ভারি
নিউক্লিয়াসের বিভাজন বিক্রিয়াকে
কাজে লাগানো হয়। ধরা যাক
ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসের কথা।
কোনো নিউট্রন যখন তাকে আঘাত
করে তখন সে উপরের উদাহরণের
মতো দুটো বড় টুকরোতে ভেঙে পড়ে।
এই প্রক্রিয়াতে অনেকটা শক্তি
পাওয়া যায়,
একই
সঙ্গে দু-তিনটে
নিউট্রন বেরোয়। সেই নিউট্রনগুলো
আবার অন্য ইউরেনিয়ামের
নিউক্লিয়াসকে আঘাত করে তাকে
ভেঙে দেয়। প্রত্যেকটা সংঘর্ষ
থেকে দু-তিনটে
নিউট্রন বেরোয় যারা আবার অন্য
ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে
ধাক্কা মারে। এভাবে নিউট্রনের
সংখ্যা বাড়তেই থাকে। এই পদ্ধতি
চলতেই থাকে,
একে
বলে শৃঙ্খল বিক্রিয়া। দ্বিতীয়
ছবিতে এই বিক্রিয়ার তিনটি
ধাপ দেখানো হয়েছে।
 |
চিত্র
২:
শৃঙ্খল
বিক্রিয়ার তিনটি ধাপ
|
লিখতে
যতটা সহজ লাগছে,
আসলে
বিক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার কাজটা
তার থেকে অনেক শক্ত। প্রকৃতিতে
পাওয়া ইউরেনিয়ামে দুটি আইসোটোপ
আছে,
ইউরেনিয়াম-235
ও
238।
এর মধ্যে দ্বিতীয়টির বিভাজনের
জন্য নিউট্রনের শক্তি বেশি
হওয়া প্রয়োজন। নিউট্রনের
সঙ্গে ইউরেনিয়াম-238
বিক্রিয়া
করে তৈরি করে ইউরেনিয়াম-239।
নিউট্রনের শক্তি বেশি হলে এই
নিউক্লিয়াসের এক অংশ সরাসরি
বিভাজন বিক্রিয়াতে অংশ নেয়।
অন্য অংশ থেকে পরপর দুটি
বিটাক্ষয়ের মাধ্যমে পাওয়া
যায় প্লুটোনিয়াম-239।
নিউট্রনের শক্তি কম হলে শুধু
প্লুটোনিয়ামই পাওয়া যায়।
প্লুটোনিয়ামকেও কাজে লাগানো
হয়; সে
কথায় পরে আসছি। তবে এই আইসোটোপের
সঙ্গে নিউট্রন বিক্রিয়ার হার
অত্যন্ত ধীর,
ফলে
তার সাহায্যে শক্তি উৎপাদনে
অনেক সমস্যা আছে। পৃথিবীতে
বর্তমানে মাত্র দুটি এইরকম
রিঅ্যাক্টর বিদ্যুৎ উৎপাদনে
ব্যবহার করা হয়। এদের বলে
ফাস্ট ব্রিডার,
পরে
আমরা এদের কথায় আসব।
প্রায়
সব নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টরেই
মূল জ্বালানি হল ইউরেনিয়াম-235
আইসোটোপ।
কিন্তু প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামে
তার পরিমাণ মাত্র 0.7
শতাংশ।
আইসোটোপদের রাসায়নিক ধর্ম
একই বলে তাদের আলাদা করা ভীষণ
কষ্টকর ও খরচসাপেক্ষ। নিউক্লিয়
বিভাজন বিক্রিয়াতে যে সমস্ত
নিউট্রন পাওয়া যায় তাদের শক্তি
অনেক বেশি,
গড়ে
2
MeV।
এই শক্তির নিউট্রন ইউরেনিয়ামের
দুটি আইসোটোপের সঙ্গেই প্রায়
সমান মাত্রায় ক্রিয়া করে,
ফলে
বিভাজনে সৃষ্ট অধিকাংশ নিউট্রনই
ইউরেনিয়াম-238-এ
আটকা পড়ে;
শৃঙ্খল
বিক্রিয়াতে তারা কাজে লাগে
না। (দ্বিতীয়
ছবি
দ্রষ্টব্য।)
নিউট্রনের
শক্তি খুব কম,
অর্থাৎ
25
meV (মিলি
ইলেকট্রনভোল্ট)-এর
কাছাকাছি হলে কিন্তু
ইউরেনিয়াম-235-এর
সঙ্গে বিক্রিয়ার সম্ভাবনা
238
আইসোটোপের
থেকে কয়েকশো গুণ বেশি,
তখন
এই সমস্যা থাকে না। এই শক্তির
নিউট্রনকে বলে তাপীয় নিউট্রন,
তাই
যে সমস্ত রিঅ্যাক্টরে এই ধরনের
নিউট্রন ব্যবহার করা হয়,
তাদের
বলে থার্মাল বা তাপীয় রিঅ্যাক্টর।
নিউট্রনের শক্তি কমানোর জন্য
মডারেটর ব্যবহার করা হয়। একটা
দ্রুতগতি স্ট্রাইকার ক্যারমবোর্ডের
দেওয়ালে ধাক্কা খেলে প্রায়
সমান বেগ নিয়ে ফিরে যায়;
কিন্তু
তার সমান ভারি স্ট্রাইকারকে
ধাকা মারলে তার বেগ অনেক কমে
যায়। একই কারণে মডারেটর সাধারণত
হয় হাল্কা পরমাণুর নিউক্লিয়াস।
সব থেকে সরল মডারেটর হল জল।
তার মধ্যে যে হাইড্রোজেনের
নিউক্লিয়াস অর্থাৎ প্রোটন
থাকে,
তার
ভর নিউট্রনের প্রায় সমান।
সেই প্রোটনদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে
নিউট্রনের শক্তি কমে তাপীয়
মাত্রায় চলে আসে।
কিন্তু
জল ব্যবহারে অন্য এক সমস্যা
দেখা দেয়। ডয়টেরনের কথা আগেই
বলেছি;
প্রতি
চারটি নিউট্রন প্রোটন সংঘর্ষে
একটি ডয়টেরন তৈরি হয়। ফলে
নিউট্রনের সংখ্যা কমে যায়।
সেই কারণে জ্বালানির মধ্যে
ইউরেনিয়াম-235-এর
পরিমাণ বাড়াতে হয় যাতে নির্গত
নিউট্রনের একটা বড় অংশ আবার
ইউরেনিয়াম-235-এর
নিউক্লিয়াসের সঙ্গেই বিক্রিয়া
করে শৃঙ্খল বিক্রিয়া চালু
রাখে। ইউরেনিয়াম-235-এর
পরিমাণকে নানা ভাবে বাড়িয়ে
সাধারণত তিন থেকে পাঁচ শতাংশে
নিয়ে যাওয়া হয়,
এই
প্রক্রিয়াকে বলে এনরিচমেন্ট।
অন্য
একটা উপায় হল সাধারণ জলের
পরিবর্তে ভারি জল ব্যবহার
করা। ভারি জলে প্রোটনের জায়গা
নেয় ডয়টেরন। ডয়টেরনের সঙ্গে
নিউট্রনের নিউক্লিয় বিক্রিয়া
হয় না বললেই চলে,
সেই
কারণে নিউট্রনের পরিমাণ কমে
না। সাধারণ জলের প্রতি তিনহাজার
দুশো অণুর মধ্যে একটা ভারি
জলের অণু থাকে। উচ্চ গতি সম্পন্ন
সেন্ট্রিফিউজে ভারি জলকে
সাধারণ জলের থেকে আলাদা করা
যায়। ভারি জল ব্যবহার করলে
প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামই জ্বালানি
হিসাবে ব্যবহার করা যায়,
এনরিচ
করার দরকার পড়ে না।
-
ভারি
জলের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য
ইতিহাসের একটা কাহিনি শোনা
যাক। রিঅ্যাক্টরে ভারি জলের
সাহায্যে যে প্লুটোনিয়াম
তৈরি হয়,
তাকে
বোমাতে ব্যবহার করা যায়।
যদিও নিউক্লিয় বোমা তখনো
ভবিষ্যতে,
কিন্তু
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ
নেওয়া সব পক্ষই এই ব্যাপারে
সচেতন ছিলেন। বিশ্বযুদ্ধের
সময় জার্মানির হাতে যাতে
ভারি জল না পড়ে,
তার
জন্য এক বিশেষ অভিযান চালানো
হয়েছিল। সেই সময় ইউরোপে সব
থেকে বড় ভারি জল তৈরির কারখানা
ছিল নরওয়ের টেলেমার্কে।
সেখান থেকে প্রতি বছর বারো
টন ভারি জল পাওয়া যেত। যুদ্ধের
ঠিক আগে ফরাসি গোয়েন্দাবিভাগ
সেই কারখানার সমস্ত ভারি
জল 'ধার'
হিসাবে
নেয়। জার্মান গোয়েন্দা
বাহিনীর চোখ এড়াতে সেই জল
নরওয়ে থেকে স্কটল্যান্ড
হয়ে ফ্রান্সে পৌঁছায়। যুদ্ধ
বাঁধার পরে ফ্রেডরিক জোলিও
কুরি তার দায়িত্ব নেন,
এবং
ব্যাঙ্ক অফ ফ্রান্সের ভল্টে
রাখার ব্যবস্থা করেন। তারপরে
তা রাখেন এক জেলখানাতে।
ফ্রান্সের পতনের সময় সেই
জলকে ইংল্যান্ডে পাঠানো
হয়।
যুদ্ধে
জার্মানি নরওয়ে দখল করে নিলে
টেলেমার্কের কারখানা পুরোদমে
চালু হয়। ব্রিটিশ গোয়েন্দা
বিভাগ ও নরওয়ের প্রতিরোধ
বাহিনী তখন কারখানাটি ধ্বংসের
সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে
প্রতিরোধ বাহিনীর চারজন
প্যারাট্রুপারকে প্লেন
থেকে কারখানার কাছে নামানো
হয়। দ্বিতীয় ধাপে দুটি প্লেন
পনেরজন ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারকে
নিয়ে টেলেমার্কের উদ্দেশ্যে
রওনা হয়েছিল। কিন্তু দুটিই
দুর্ঘটনাতে পড়ে এবং অনেকেই
মারা যান। যাঁরা বেঁচেছিলেন
তাঁদের জার্মান সৈন্যরা
গ্রেপ্তার করে এবং যন্ত্রণা
দিয়ে হত্যা করে। চারমাস পরে
আবার ছ'জন
নরওয়ের কম্যান্ডো ও এক ব্রিটিশ
অফিসারকে প্লেন থেকে প্যারাসুটে
করে নামানো হয়। আগের চারজনের
সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হয়।
তাঁরা এই চারমাস মস ও লাইকেন
খেয়ে বেঁচেছিলেন;
শুধু
একবার একটা বলগা হরিণ মারতে
পেরেছিলেন। এগারোজনের দল
কারখানার মধ্যে ঢুকে বিস্ফোরকের
সাহায্যে সেটির আংশিক ক্ষতি
করেন। তিন হাজার জার্মান
সৈন্য তাঁদের সন্ধানে তল্লাসি
চালালেও দলের সকলেই পালিয়ে
যেতে সক্ষম হন। পাঁচজন ৩২২
কিলোমিটার স্কি করে নিরপেক্ষ
সুইডেনে আশ্রয় নেন,
দু'জন
যান নরওয়ের রাজধানী অসলোতে।
চারজন ওই অঞ্চলেই থেকে যান।
কারখানাটি আবার চালু করা
হয়েছিল,
কিন্তু
বারবার ব্রিটিশ বোমারু বিমান
তাকে আক্রমণ করে এতটাই ক্ষতি
করতে সফল হয় যে শেষ পর্যন্ত
তা বন্ধ করে দিতে হয়। যতটা
ভারি জল ছিল,
পুরোটাই
জার্মানিতে নিয়ে যাওয়ার
সিদ্ধান্ত হয়। নরওয়ের প্রতিরোধ
বাহিনী তার খবর পেয়েছিল;
যে
ফেরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল
তারা সেটিকে টাইমবোমার
সাহায্যে ডুবিয়ে দেয়।
|
এখন
পৃথিবীতে মোট ৪৩৭টি বিদ্যুৎ
উৎপাদনকারী তাপীয় রিঅ্যাক্টর
আছে,
তার
মধ্যে ৩৭০টিতে সাধারণ জল ও
আটচল্লিশটিতে ভারি জল ব্যবহার
করা হয়। এই জলকেই আবার রিঅ্যাক্টরের
ভিতর থেকে তাপ বাইরে আনার কাজে
ব্যবহার করা হয়। ভারতে চব্বিশটি
রিঅ্যাক্টরের মধ্যে কুড়িটিতে
ভারি জল ব্যবহার করা হয়। যে
সব দেশ সব থেকে বেশি ভারি জল
উৎপাদন করে,
ভারত
তাদের মধ্যে অন্যতম;
নিজের
প্রয়োজন মিটিয়ে রপ্তানিও
করে। ভারি জলের উৎপাদন
এনরিচমেন্টের থেকে কম খরচসাপেক্ষ।
এনরিকো
ফের্মির তৈরি প্রথম রিঅ্যাক্টরে
গ্রাফাইট মডারেটর ব্যবহার
হয়েছিল। বর্তমানে গ্রাফাইট
মডারেটর ব্যবহার করা হয় উনিশটি
রিঅ্যাক্টরে। গ্রাফাইটে
নিউট্রনের সংখ্যা দশ শতাংশ
হ্রাস পায়। তবে এই রিঅ্যাক্টরে
একটা বড় সমস্যা হল নিউট্রনের
সঙ্গে বিক্রিয়ার ফলে গ্রাফাইট
তেজস্ক্রিয় হয়ে যায়,
যা
পরে সমস্যা সৃষ্টি করে। ভারি
জলও তেজস্ক্রিয় হয়,
তবে
তার পরিমাণ অনেক গুণ কম। তাকেও
কাজে লাগানো যায়,
শেষে
সেই সম্পর্কে দু'চার
কথা থাকবে।
তবে
ফের্মির অনেক আগেই নিউক্লিয়
রিঅ্যাক্টর তৈরি হয়েছিল।
পৃথিবীর সব থেকে পুরানো তাপীয়
রিঅ্যাক্টরের বয়স দুশো কোটি
বছর। প্রকৃতি নিজেই তাকে তৈরি
করেছিল। তার নিদর্শন আছে
আফ্রিকার গ্যাবন দেশের ওকলোতে।
সেখানে ইউরেনিয়ামের সঙ্গে
মিশেছিল জল যা মডারেটরের কাজ
করে ইউরেনিয়াম-235-এর
বিভাজন ঘটায়। সৃষ্ট তাপ জলকে
বাষ্পীভূত করে,
তখন
বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। আবার
কিছুদিন পরে জল জমা হলে এই
ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। সেই
কারণে ওকলোর খনি থেকে পাওয়া
ইউরেনিয়ামের মধ্যে পরিমাণ
স্বাভাবিকের থেকে সামান্য
কম,
তার
বদলে বিভাজন প্রক্রিয়াতে
পাওয়া যায় এমন সমস্ত মৌল রয়েছে।
প্রশ্ন আসে,
এই
জল তো সাধারণ জল,
ভারি
জল নয়। তাহলে সেখানে প্রাকৃতিক
রিঅ্যাক্টর কাজ করেছিল কেমন
করে?
আমরা
দেখেছি যে সাধারণ জল ব্যবহার
করলে ইউরেনিয়ামকে এনরিচ করতে
হবে। ইউরেনিয়াম-235
ও
238-এর
অর্ধায়ু কাল যথাক্রমে সত্তর
কোটি বছর ও সাড়ে চারশো কোটি
বছর। এই বিক্রিয়া ঘটেছিল আজ
থেকে দুশো কোটি বছর আগে। তখন
ইউরেনিয়ামের মধ্যে 235
আইসোটোপের
পরিমাণ ছিল বেশি,
তিন
শতাংশের কাছাকাছি। ফলে তখন
প্রকৃতিতেই ইউরেনিয়াম আজকের
এনরিচের পরের মাত্রাতে পাওয়া
যেত। তাই ওকলোর রিঅ্যাক্টর
কাজ করেছিল।
নিউক্লিয়
রিঅ্যাক্টরে বিক্রিয়াকে
এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে
যেন নিউট্রনের সংখ্যা একটা
নির্দিষ্ট মাত্রাতেই আটকে
থাকে। এই অবস্থাকে বলে ক্রান্তিক
অবস্থা। যদি ক্রান্তিক অবস্থা
ছাড়িয়ে যায়,
নিউট্রনের
সংখ্যা বাড়তে বাড়তে একসময়
একসঙ্গে অনেকগুলি বিক্রিয়া
করে প্রচুর পরিমাণ শক্তি তৈরি
করবে,
এই
হল নিউক্লিয় বোমা। বোমার
বিষয়টা আরো স্পষ্ট হলে
রিঅ্যাক্টরের কার্যপ্রণালী
বুঝতে সুবিধা হবে। এখানে আরো
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে,
তা
হল ক্রান্তিক ভর (critical
mass)।
যদি ইউরেনিয়ামের পরিমাণ খুব
কম হয়,
তাহলে
অনেকগুলি নিউট্রন বিক্রিয়া
না করেই বেরিয়ে যাবে। (দ্বিতীয়
ছবির ডানদিকে দেখানো হয়েছে।)
সেক্ষেত্রেও
শৃঙ্খল বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে
যাবে। সেজন্য একটা ন্যূনতম
ভরের প্রয়োজন,
একেই
বলে ক্রান্তিক ভর। বোমার
ক্ষেত্রে হঠাৎ করে ইউরেনিয়ামের
পরিমাণ ক্রান্তিক ভর পেরিয়ে
যায়,
তখনই
বিস্ফোরণ ঘটে। রিঅ্যাক্টরে
নিউট্রন যাতে না বেরিয়ে যায়
তার জন্য রিঅ্যাক্টরের একটা
আবরণ থাকে যা নিউট্রনকে আবার
রিঅ্যাক্টরের মধ্যে ফিরিয়ে
দেয়।
নিউক্লিয়
রিঅ্যাক্টরে শৃঙ্খল বিক্রিয়াকে
এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়
যাতে করে নিউক্লিয়াসের ভেঙে
পড়ার হার পরিবর্তন হয় না। ফলে
একই হারে শক্তি তৈরি হতেই থাকে
এবং তাকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের
কাজে ব্যবহার করা হয়। পুরানো
দিনের রিঅ্যাক্টরে যদি কোনোভাবে
বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে
চলে যায়,
তাহলে
এক সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ শক্তি
তৈরি হয়ে রিঅ্যাক্টরকে ধংস
করে তেজস্ক্রিয় পদার্থ বাইরে
ছড়িয়ে দিতে পারত। অবশ্য তা
কখনোই ক্রান্তিক ভর অতিক্রম
করত না,
ফলে
নিউক্লিয় বিস্ফোরণের সমতুল্য
হত না। কিন্তু প্রচুর পরিমাণ
তেজস্ক্রিয় পদার্থ পরিবেশে
মেশাও খুবই বিপজ্জনক;
চের্নোবিলে
এই ঘটনাই অনেক মানুষের প্রাণ
কেড়ে নিয়েছিল। আধুনিক ডিজাইনের
রিঅ্যাক্টরে অবশ্য সে সম্ভাবনাকে
অনেক কমানো হয়েছে।
 |
চিত্র
৩:
লিটল
বয়
|
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময় যে দুটি
বোমা জাপানের উপর প্রয়োগ করা
হয়েছিল,
সেখানে
দুটি পদ্ধতি নেওয়া হয়েছিল।
হিরোশিমার উপরে যে বোমা ফেলা
হয়েছিল,
তার
নাম ছিল লিটল বয়। এখান বেলনাকার
নিরেট ইউরেনিয়াম-235-এর
উপর ইউরেনিয়ামের ফাঁপা বুলেট
রাসয়ানিক বিস্ফোরক ব্যবহার
করে ছোঁড়া হয়েছিল। বুলেট যখন
লক্ষ্যবস্তুর উপর আঘাত করে,
তখন
দুই মিলিয়ে ইউরেনিয়ামের মোট
ভর ক্রান্তিক ভর অতিক্রম করে
ও বিস্ফোরণ ঘটে। তৃতীয় ছবিতে
লিটল বয়-এর
ডিজাইন দেখানো হয়েছে। বোমার
মধ্যে মডারেটর ব্যবহারের
প্রশ্নই ওঠে না,
তাই
ইউরেনিয়ামকে অনেক বেশি পরিমাণে
এনরিচ করতে হয়। লিটল ম্যানে
মোট ৬৪ কিলোগ্রাম ইউরেনিয়াম
ব্যবহার করা হয়েছিল যার আশি
শতাংশ ছিল ইউরেনিয়াম-235।
অবশ্য মাত্র এক কিলোগ্রাম
ইউরেনিয়াম-235
বিভাজন
বিক্রিয়াতে অংশ
নিয়েছিল,
এবং
শক্তি হিসাবে মুক্ত হয়েছিল
মাত্র 0.7
গ্রাম,
একটা
পেপার ক্লিপের থেকেও কম পরিমাণ!
ওই
সামান্য ভর থেকেই যে শক্তি
পাওয়া গিয়েছিল,
তাতে
বিস্ফোরণের 1.3
কিলোমিটার
ব্যাসার্ধের মধ্যে শহরের
সমস্ত কিছু ধংস হয়ে গিয়েছিল।
নাগাসাকির উপরে ফেলা বোমাতে
ব্যবহার হয়েছিল প্লুটোনিয়াম-239।
প্লুটোনিয়ামের একটি ফাঁপা
গোলকের বাইরে এমনভাবে বিস্ফোরক
সাজিয়ে রাখা হয়েছিল যে বিস্ফোরণের
ফলে সমস্ত প্লুটোনিয়াম একসঙ্গে
এসে কেন্দ্রে জমা হয়। এভাবে
প্লুটোনিয়ামের পরিমাণ ক্রান্তিক
ভর পেরিয়ে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটে।
ভারতে ১৯৭৪ সালে পারমাণবিক
বিস্ফোরণ এই পদ্ধতিতেই হয়েছিল,
প্লুটোনিয়ামের
উৎস ছিল কানাডা থেকে পাওয়া
সাইরাস রিঅ্যাক্টর।
রিঅ্যাক্টরের
ভিতরে যে তাপ উৎপাদন হয়,
তাকে
ব্যবহার করে স্টিম তৈরি করে
টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন
করা হয়। রিঅ্যাক্টরের ভিতরের
তাপমাত্রা T1
এবং
স্টিমের তাপমাত্রা T2
হলে
তাপগতিবিদ্যার সূত্র অনুসারে
রিঅ্যাক্টরের চরম দক্ষতা হল
(T1-T2)/T1।
বোঝা যায় যে T1-কে
যত বাড়ানো যাবে,
দক্ষতা
তত বাড়বে। রিঅ্যাক্টরের মধ্যে
জ্বালানিকে কঠিন অবস্থায়
রাখতে হয়। ইউরেনিয়ামের গলনাঙ্ক
1132
ডিগ্রি
সেন্টিগ্রেড। অন্যদিকে
ইউরেনিয়াম ডাইঅক্সাইডের
গলনাঙ্ক হল 2900
ডিগ্রি
সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি।
সেই কারণে ধাতব ইউরেনিয়ামের
পরিবর্তে তার অক্সাইডকে
জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা
হয়। সেরামিকের গুলি বা পেলেটের
মহ্যে জ্বালানি ভরা হয়,
সেগুলি
জির্কোনিয়াম ধাতুর ফাঁপা
রডের মধ্যে ঢোকানো থাকে।
আধুনিক রিঅ্যাক্টরের ডিজাইনে
T1
-কে
বাড়িয়ে দশ হাজার ডিগ্রি
সেন্টিগ্রেডে নিয়ে যাওয়ার
চেষ্টা চলছে। সেটা সম্ভব হলে
রিঅ্যাক্টরের দক্ষতা তিরিশ
শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে
পঞ্চাশ শতাংশ।
আমরা
দেখেছি যে রিঅ্যাক্টরকে একটা
নির্দিষ্ট মাত্রাতে চালাতে
হয়। নিউক্লিয় বিক্রিয়াকে
কমানো বাড়ানোর জন্য নিয়ন্ত্রক
বা কন্ট্রোলার ব্যবহার করা
হয়। এখানে এমন পদার্থ দিয়ে
তৈরি রড ব্যবহার করা হয় যাদের
সঙ্গে নিউট্রনের বিক্রিয়ার
হার খুব বেশি। উদাহরণ স্বরূপ
বোরন বা ক্যাডমিয়ামের কথা
বলা যেতে পারে। রিঅ্যাক্টরের
মধ্যে কয়েকটি নিয়ন্ত্রক রড
থাকে যাদের অংশত বা পুরোপুরি
বার করে নেওয়া যায়। যখন
রিঅ্যাক্টরের মধ্যে পুরোপুরি
প্রবেশ করানো থাকে,
তারা
এত নিউট্রন শোষণ করে যে শৃঙ্খল
বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এই
রডগুলিকে আগে পিছে করে
রিঅ্যাক্টরকে ক্রান্তিক
অবস্থাতে রাখা হয়। যদি কোনো
কারণে ক্রান্তিক অবস্থা ছাড়িয়ে
যায়,
রডগুলি
স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিঅ্যাক্টরের
ভিতরে ঢুকে পড়ে। আধুনিক
রিঅ্যাক্টরে একই সঙ্গে এমন
রাসায়নিক ছড়িয়ে দেওয়া হয়,
যার
নিউট্রন শোষণ ক্ষমতা খুব বেশি।
ফলে নিউট্রনের অভাবে বিক্রিয়া
বন্ধ হয়ে যায়।
প্লুটোনিয়াম239-কেও
রিঅ্যাক্টরে জ্বালানি হিসাবে
ব্যবহার করা যায়। প্লুটোনিয়াম
প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না,
শক্তি
উৎপাদনের সময় তাপীয় রিঅ্যাক্টরে
তৈরি হয়। প্লুটোনিয়াম-239
যেমন
শক্তি উৎপাদনে লাগে,
তেমনি
নিউক্লিয় বোমা তৈরিতেও ব্যবহার
হয়। বর্তমানে অবশ্য সেই অস্ত্রের
সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে,
ফলে
অনেক নিউক্লিয় অস্ত্রধারী
দেশ সেই প্লুটোনিয়ামকে বিদ্যুৎ
উৎপাদনে কাজে লাগাচ্ছে। কিছু
কিছু রিঅ্যাক্টর প্লুটোনিয়াম
তৈরির জন্যই বিশেষভাবে নির্মিত,
তাদের
বলে ফাস্ট ব্রিডার রিঅ্যাক্টর।
এদের কথা আগে এসেছে। এখানে
নিউট্রনের শক্তি কমানো হয়
না। ফলে ইউরেনিয়ামের দুটি
আইসোটোপই প্রায় সমান পরিমাণ
বিক্রিয়া করে। ইউরেনিয়াম-235
থেকে
শক্তি পাওয়া যায়,
অন্যদিকে
ইউরেনিয়াম-238
শেষ
পর্যন্ত প্লুটোনিয়ামে রূপান্তরিত
হয়। তাছাড়া তাপীয় রিঅ্যাক্টরেও
যে প্লুটোনিয়াম তৈরি হয়,
তাকে
সরিয়ে না নিলে তা একসময় বিভাজন
বিক্রিয়ার মাধ্যমে তাপের
জোগান দিতে শুরু করে। পৃথিবীতে
বিদ্যুতের জন্য নতুন চারটি
ফাস্ট ব্রিডার তৈরি হচ্ছে,
তার
মধ্যে ভারতে একটি।
পরমাণু
বিদ্যুৎ একসময়ে খুবই আশা
জাগিয়েছিল। বিশেষ করে এই
পদ্ধতিতে কার্বন ডাইঅক্সাইড
তৈরি হয় না,
তাই
শক্তি উৎপাদনে গ্রিনহাউস
গ্যাস নিঃসরণ গ্যাস কমায়।
কিন্তু কয়েকটি কারণে পরমাণু
বিদ্যুৎ থেকে অনেক দেশই মুখ
ফিরিয়ে নিচ্ছিল। বিশেষ করে
বলতে হয় ২০১১ সালের ফুকুশিমা
দুর্ঘটনার কথা। ভূমিকম্প ও
তার থেকে তৈরি সুনামির জন্য
জাপানের ফুকুশিমার নিউক্লিয়
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটি
রিঅ্যাক্টরে দুর্ঘটনা ঘটে।
তেজস্ক্রিয় পদার্থ রিঅ্যাক্টর
থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল।
প্রায় এক লক্ষ লোককে সাবধানতার
কারণে সরাতে হয়েছিল। তেজস্ক্রিয়তার
কারণে কোনো মৃত্যু ঘটেনি,
কিন্তু
এইরকম দুর্ঘটনা এড়াতে সারা
পৃথিবীর বেশ কিছু নিউক্লিয়
রিঅ্যাক্টর বন্ধ করে দেওয়া
হয়েছিল। পারমাণবিক বিদ্যুৎ
উৎপাদন আবার আগের জায়গায় ফিরে
এসেছে ২০১৯ সালে।
এখন
পৃথিবীতে তাপীয় ও ব্রিডার
মিলে মোট ৪৩৯টি বিদ্যুৎ
উৎপাদনকারী রিঅ্যাক্টর চালু
আছে যাদের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায়
চার লক্ষ মেগাওয়াট। পৃথিবীর
মোট বিদ্যুৎ চাহিদার দশ শতাংশ
মেটায় নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর।
আরো ৬২টি নতুন রিঅ্যাক্টর
নির্মীয়মান অবস্থায় আছে।
সারা পৃথিবীর নিউক্লিয় বিদ্যুতের
দুই শতাংশের কিছু কম ভারতে
উৎপাদন হয়,
তা
দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের
তিন শতাংশ। তবে ভারতে নিউক্লিয়
বিদ্যুতের উৎপাদন দ্রুত বেড়ে
চলেছে। গত দুই দশকে ন'টি
নতুন রিঅ্যাক্টর বসান হয়েছে
যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা প্রায়
চারহাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে
নতুন আটটি রিঅ্যাক্টর বসানোর
কাজ চলছে,
তারা
আরো সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট
শক্তি যোগান দেবে।
ভারতের
ইউরেনিয়ামের মজুতের পরিমাণ
খুবই কম,
তার
মানও খুব ভালো নয়। অন্য এক
ভারি মৌলকে রিঅ্যাক্টরে
ব্যবহার করা সম্ভব বলে বিজ্ঞানীরা
মনে করেন,
তা
হল থোরিয়াম। পৃথিবীর মোট
থোরিয়ামের পরিণাম ইউরেনিয়ামের
দ্বিগুণ,
তার
পঁচিশ শতাংশই ভারতে আছে। হোমি
ভাভা উনিশশো পঞ্চাশের দশকেই
থোরিয়াম দিয়ে শক্তি উৎপাদনের
কথা ভেবেছিলেন। থোরিয়ামের
যে আইসোটোপটি সরাসরি বিভাজন
বিক্রিয়াতে ব্যবহার করা যায়,
প্রকৃতিতে
তার পরিমাণ এতই কম যে তা দিয়ে
শক্তি উৎপাদনের খরচ চালানো
সম্ভব নয়। থোরিয়ামের প্রধান
আইসোটোপ হল Th-232,
ব্রিডার
রিঅ্যাক্টরে নিউট্রনের সঙ্গে
বিক্রিয়া ও তারপরে দুটি বিটা
ক্ষয়ের মাধ্যমে তা তৈরি করবে
ইউরেনিয়ামের নতুন আইসোটোপ
U-233।
এই আইসোটোপটিকে সরাসরি
রিঅ্যাক্টরে শক্তি উৎপাদনে
ব্যবহার করা যায়। তবে এখনো
পর্যন্ত প্রযুক্তি থোরিয়াম
জ্বালানি থেকে বাণিজ্যিকভাবে
বিদ্যুৎ উৎপাদন করার মতো স্তরে
পৌঁছায়নি। অবশ্য থোরিয়াম
নিয়ে গবেষণা মাঝে বিশেষ এগোয়নি,
কারণ
মারণাস্ত্র থেকে ইউরেনিয়াম
ও প্লুটোনিয়াম জ্বালানি হিসাবে
বাজারে আসার পরে তাদের দাম
কমে গিয়েছিল। এখন আবার থোরিয়াম
নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে,
তবে
তা এখনো গবেষণার স্তরে।
পরমাণু
বিদ্যুতের একটা বড় সমস্যা হল
বর্জ্য। বিভাজন প্রক্রিয়াতে
বর্জ্য পদার্থ হিসাবে তৈরি
হয় বেশ কিছু তেজস্ক্রিয় মৌল।
আমরা আগেই দেখেছি এর মধ্যে
উল্লেখযোগ্য হল প্লুটোনিয়াম।
ভারত সহ বেশ কিছু দেশ প্লুটোনিয়াম
ও অবশিষ্ট ইউরেনিয়াম-238-কে
পুনর্ব্যবহার করে অর্থাৎ
তাকে আবার বিদ্যুৎ উৎপাদনে
কাজে লাগায়। বর্তমানে পরমাণু
জ্বালানির চল্লিশ শতাংশ এইভাবে
পাওয়া যায়। প্লুটোনিয়াম অস্ত্র
তোরিতেও কাজে লাগে,
তবে
সেই ব্যবহার এখন কমে এসেছে।
তাছাড়া যে নতুন মৌলগুলি পাওয়া
যায়,
তাদের
অর্ধায়ুকাল এমন যে বহু বছর
পর্যন্ত তাদের থেকে বিকিরণ
বেরোতে থাকে,
সেই
কারণে দীর্ঘকাল পর্যন্ত
সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করতে হয়।
সমস্ত নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টরের
বর্জ্যই বিভিন্নভাবে সঞ্চয়
করা হয়। এর পরিমাণ যে খুব বেশি
তা নয়;
একজন
মানুষের সারা বছরের ইলেকট্রিসিটির
প্রয়োজন মেটাতে মোটামুটি
পাঁচ গ্রাম উচ্চ তেজস্ক্রিয়তার
বর্জ্য তৈরি হয়। এক হাজার
মেগাওয়াট ক্ষমতার নিউক্লিয়ার
রিঅ্যাক্টর থেকে পুনর্ব্যবহারের
পরে মোটামুটি তিন ঘনমিটার
বিপজ্জনক তেজস্ক্রিয়তার
বর্জ্য তৈরি হয়। পক্ষান্তরে
একটা এক হাজার মেগাওয়াটের
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বছরে তিন
লক্ষ টন ছাই তৈরি করে,
এবং
তার থেকেও বড় কথা হল বাতাসে
ষাট লক্ষ টন কার্বন ডাই অক্সাইড
বাতাসে মেশে। আমরা জানি যে
কার্বন ডাই অক্সাইড হল গ্রিন
হাউস গ্যাস;
পৃথিবীর
উষ্ণায়নের জন্য সেই মূল দায়ী।
নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টরে কোনো
কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি হয়
না।
তেজস্ক্রিয়
বর্জ্য রক্ষণে সমস্ত সাবধানতা
সত্ত্বেও ভূমিকম্পের মতো
প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা
এড়ানো যায় না। এছাড়া পৃথিবীতে
ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডারও সীমাবদ্ধ।
থোরিয়াম এখনো পর্যন্ত কার্যকরীভাবে
ব্যবহার সম্ভব হয়নি। আধুনিক
প্রযুক্তিতে কণা ত্বরক ব্যবহার
করে তেজস্ক্রিয় বর্জ্যকে এমন
মৌলে রূপান্নতর করা সম্ভব
যার ক্ষতি কররা ক্ষমতা অল্প
দিনেই চলে যায়। থোরিয়ামকে
জ্বালানি হিসাবে ব্যবহারেও
কণাত্বরক ব্যবহারের কথা চলছে।
তবে এখনো তা গবেষণার পর্যায়ে।
অপর
এক ধরনের নিউক্লিয় বিক্রিয়াতে
কিন্তু তেজষ্ক্রিয়তার সমস্যা
নেই,
তা
হল সংযোজন বিক্রিয়া। শেষ করার
আগে সেই বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু
জেনে নেওয়া যাক। এই ধরনের
তাপপারমাণবিক বা থার্মোনিউক্লিয়ার
সংযোজন প্রক্রিয়াই সূর্যের
বা হাইড্রোজেন বোমার শক্তির
উৎস। সূর্যে কয়েক ধাপ বিক্রিয়াতে
চারটি প্রোটন মিলে হিলিয়াম-4
তৈরি
করে;
এর
মধ্যে প্রথমটিতে দুটি প্রোটন
মিলে তৈরি করে ডয়টেরন। কিন্তু
এই বিক্রিয়া এত ধীরে চলে যে
পৃথিবীতে করা অসম্ভব। কিন্তু
পৃথিবীতে ডয়টেরন ও ট্রিটিয়ামের
বিক্রিয়া ঘটিয়ে হিলিয়াম-4
তৈরি
করা সম্ভব;
অতিরিক্ত
হিসাবে পাওয়া যায় একটা নিউট্রন।
ট্রিটিয়াম হল হাইড্রোজেনের
আর একটি আইসোটোপ,
এর
কেন্দ্রে আছে একটি প্রোটন ও
দুটি নিউট্রন। ট্রিটিয়ামও
তেজষ্ক্রিয়,
তার
অর্ধায়ু বারো বছরের সামান্য
বেশি। প্রাকৃতিকভাবে এই
আইসোটোপটিকে পাওয়া যায় না,
তৈরি
করতে হয়। যেমন ভারি জলের
রিঅ্যাক্টরে ডয়টেরনের সঙ্গে
নিউট্রনের বিক্রিয়াতে অল্প
পরিমাণ ট্রিটিয়াম তৈরি হয়।
১৯৯৮ সালে ভারতের হাইড্রোজেন
বোমার জন্য ট্রিটিয়াম এইভাবেই
পাওয়া গিয়েছিল। অপেক্ষাকৃত
সহজ পদ্ধতিও আছে।
সংযোজন
পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন
এখনো সম্ভব হয়নি,
তবে
তার জন্য প্রয়াস চলছে। ফ্রান্সে
তৈরি হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল
থার্মোনিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর,
সংক্ষেপে
আইটিইআর। ভারত সহ পঁয়ত্রিশটি
দেশ এই প্রকল্পের অংশীদার।
কোনও তাপপারমাণবিক রিঅ্যাক্টর
এখনো পর্যন্ত শক্তি সরবরাহ
করতে শুরু করেনি;
আইটিইআরই
হল প্রথম যন্ত্র যা যে পরিমাণ
শক্তি নেবে,
তার
থেকে বেশি শক্তি তৈরি করবে।
২০২৫ সালে আইটিইআর-এর
কাজ শুরু করার কথা,
পুরোপুরি
কর্মক্ষমতাতে পৌঁছোতে লাগবে
আরো দশ বছর। এটা অবশ্যই
পরীক্ষামূলক,
তবে
একবার প্রযুক্তিটা আয়ত্ত করা
গেলে তা দিয়ে তখন আরো নতুন
নতুন রিঅ্যাক্টর তৈরি করা
হবে। সমুদ্রজল ডয়টেরনের অগাধ
ভাণ্ডার আছে,
ট্রিটিয়ামও
সহজেই তৈরি করা সম্ভব। তাই
সংযোজন বিক্রিয়া বহু লক্ষ
বছর মানব সভ্যতার শক্তি যোগাতে
পারে।
তথ্যসূত্র
ওয়ার্ল্ড
নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের
ওয়েবসাইট https://world-nuclear.org/
ইন্টারন্যাশনাল
অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির
ওয়েবসাইট https://www.iaea.org/
নিউক্লিয়ার
পাওয়ার কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া
লিমিটেডের ওয়েবসাইট
https://www.npcil.nic.in/index.aspx
Nuclear
Power: A Very Short Introduction, Maxwell Irvine (2011)
Nuclear
Weapons: A Very Short Introduction, Joseph
M. Siracusa (3rd
Edition, 2020)
Nuclear
Power in India: A Critical History, B. Banerjee and N. Sharma (2008)
চিত্রঋণ
উইকিপেডিয়া