Saturday, 23 August 2025

বোধবিজ্ঞান – কগনেটিভ সায়েন্স-এর একটি পর্যালোচনা

 

বোধবিজ্ঞান – কগনেটিভ সায়েন্স-এর একটি পর্যালোচনা

লেখক: শুভাশিস মুখোপাধ্যায়

প্রকাশক: সাহিত্য সংসদ

প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০২৫

মূল্য: ৩০০ টাকা


বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলে, নানা ধারায় সে ভাগ হয়ে নতুন নতুন বিষয়ের জন্ম দেয়। মধ্যযুগে যার নাম ছিল ন্যাচারাল ফিলোসফি বা প্রাকৃতিক দর্শন, তা পরবর্তীকালে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা জীববিদ্যা ইত্যাদি শাখাতে বিভক্ত হয়েছে। প্রতিটি শাখা আবার নানা উপশাখার জন্ম দিয়েছে। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের আর এক নতুন চরিত্রের বিকাশ আমরা প্রত্যক্ষ করছি  দেখছি নানা শাখা এসে এক জায়গায় মিলে সম্পূর্ণ নতুন এক ক্ষেত্রের জন্ম দিচ্ছে। তেমনই এক নতুন বিষয় হল বোধবিজ্ঞান বা কগনেটিভ সায়েন্স, যেখানে এসে মিলেছে কম্পিউটার বিজ্ঞান, তথ্যবিজ্ঞান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মনোবিদ্যা, নৃবিজ্ঞান সহ আরো নানা আপাত-সম্পর্কহীন বিষয়। আমার সীমিত জ্ঞানে এই বিষয়ে সাধারণের জন্য লেখা কোনো বইয়ের কথা আমার জানা নেই। জ্ঞানচর্চার এই অপেক্ষাকৃত নবীন ক্ষেত্রটি নিয়ে বাংলা ভাষাতে বই প্রকাশ করার জন্য লেখক ও প্রকাশককে ধন্যবাদ জানাই।

আমাদের মস্তিষ্ক সম্পর্কে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে, তা সত্ত্বেও অনেক কিছুই এখনো আমাদের অজানা থেকে গেছে। যন্ত্র বা 'মনুষ্যেতর' প্রাণীর ক্ষেত্রে যেভাবে ব্যবচ্ছেদ করে অনুসন্ধান করা যায়, মানব মস্তিষ্কের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। অবশ্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও ব্যবচ্ছেদ নিয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন উঠেছে, এবং তা মোটেই তুচ্ছ নয়। মস্তিষ্ক সম্পর্কে গবেষণা, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্যবিজ্ঞান, এই তিনের মিলনে আধুনিক বোধবিজ্ঞানের জন্ম। ক্ষেত্রটি নতুন বলেই সূচনাতে লেখক তিনটি অধ্যায় বোধবিজ্ঞান কী, এবং তার উৎস কোথা থেকে তা নিয়ে ব্যয় করেছেন। শুরুর কাজ চালানোর জন্য তিনি বোধবিজ্ঞান সম্পর্কে একটা ধারণাকে প্রথমেই সংজ্ঞায়িত করেছেন। প্রাথমিকভাবে তা মানবদেহের সঙ্গে সংযুক্ত, কিন্তু বিষয় থেকে যত বিষয়ান্তরে গেছেন, ততই সেই ধারণাটা আরো বিমূর্ত রূপ নিয়েছে। এই প্রসঙ্গে আসে চোমস্কির সার্বজনীন ব্যাকরণের কথা, যা হয়তো মানুষের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে না। চোমস্কি দেখিয়েছেন, Poverty of stimulus বা উদ্দীপনের অভাব সত্ত্বেও শিশুরা ভাষা শিখতে সক্ষম; অর্থাৎ ব্যাকরণের হয়তো ভাষানিরপেক্ষ অস্তিত্ব আছে। সেই ধারণা থেকেই মনে হয় যে বোধবিজ্ঞানকে আর শুধুমাত্র মানবিকীবিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সমীচীন নয়, প্রকৃতিবিজ্ঞানের বৃহত্তর কাঠামোর মধ্যেই তার চর্চা করতে হবে।

কম্পিউটার বলতে আমরা সাধারণত প্রযুক্তির কথাই ভাবি। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় তার অভাবনীয় উন্নতির কথা, যার ফলে এখন বিশাল বিশাল তথ্যভাণ্ডারকে মুহূর্তের মধ্যে বিশ্লেষণ ও ব্যবহার করা যাচ্ছে। লেখক চার্লস ব্যাবেজ, অ্যালান টুরিং বা জন ফন নয়ম্যানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন; ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে এই বিশেষ বিষয়টিতে অন্তত প্রযুক্তির আগে প্রয়োজন হয়েছে বিজ্ঞানের, যা প্রযুক্তি বিকাশের পথ দেখিয়েছে। ব্যাবেজের যুগে তাঁর পরিকল্পিত অ্যানালিটিক ইঞ্জিন বানানো সম্ভব হয়নি, কিন্তু কম্পিউটার প্রযুক্তি সেই মৌলিক কাঠামোকে স্বীকার করেই অগ্রসর হয়েছে। আধুনিক কম্পিউটারের কর্মপদ্ধতি ইউনিভার্সাল টুরিং মেশিনের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছিল, এক অর্থে সমস্ত আধুনিক কম্পিউটারই হল ইউনিভার্সাল টুরিং মেশিনের রূপভেদ।

মানুষের মন কে কি যন্ত্র হিসাবে দেখা যায়? এই আলোচনা প্রসঙ্গে দেখলাম মন যে ঠিক কী, তা নিয়ে এখনো কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। নানা যুগ তাদের কালের সর্বোচ্চ যন্ত্রকে মডেল হিসাবে রেখে মানুষের মনকে বুঝতে চেয়েছে। সেই কারণে চার্লস ব্যাবেজ ভিক্টোরিয়ার যুগে তাঁর প্রস্তাবিত কম্পিউটারকে ইঞ্জিন নাম দিয়েছিলেন; আধুনিক যুগে আমরা কম্পিউটারকে দিয়ে মানব মনের বিচার করার চেষ্টা করি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে মানুষের মন কি 'কম্পিউটেবল' বা 'গণনাক্ষম’ এই প্রশ্ন নিয়ে অনেক বিজ্ঞানীই চিন্তা করেছেন; অ্যালান টুরিং, রজার পেনরোজ বা কুর্ট গোডেল তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। যন্ত্র হোক বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা,তার পক্ষে কি সত্যিই মানব মনের প্রতিরূপ হওয়া সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের অজানা। তার একটা কারণ হল মানব মনেরও অনেক কিছুই এখনো আমাদের জ্ঞানের বাইরে। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে তা বিজ্ঞানের অতীত। তবে এ বিষয়ে আধুনিক চিন্তাভাবনা সম্প্রতিই শুরু হয়েছে, এখনো অনেকটা পথ আমাদের যেতে হবে।

এই সংক্ষিপ্ত আলোচনাতে বইটির অনেক দিকই তুলে ধরা সম্ভব হল না। বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্র বোধবিজ্ঞানে অবদান রেখেছে, বা বর্তমানেও রাখছে। তাদের অনেকগুলি সম্পর্কেই বর্তমান আলোচকের জ্ঞান নিতান্তই সীমিত। আধুনিক যুগ হলে ইন্টারডিসিপ্লিনারি বা আন্তঃবিভাগীয় গবেষণার যুগ। আমরা ক্রমশই বুঝতে পারছি যে বিজ্ঞানকে নানা ভাগ করে আমরা যে আলাদা আলাদা প্রকোষ্ঠে রাখতাম, সেগুলি নিতান্তই কৃত্রিম; বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব নেই। সেই কারণেই রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় জীববিজ্ঞানীকে, কম্পিউটার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পদার্থবিদ্যাতে পুরস্কার পান। যদি আপনি বিজ্ঞানের আধুনিকতম বিষয় নিয়ে উৎসাহী হন, তাহলে এই বইটি আপনার অবশ্যপাঠ্য। তবে মনে রাখবেন, ‘বোধবিজ্ঞান' এমন বই নয় যে খবরের কাগজের প্রবন্ধের মতো করে তাকে পড়া যাবে। যে সমস্ত বিষয়ের বই আমাদের মাতৃভাষাতে প্রথম প্রকাশিত হচ্ছে, তাদের ভাষা আপাতভাবে একটু কঠিন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রই আছে, যেখানে শব্দচয়ন মোটেই সরল নয়; কিন্তু বহু বছর ধরে সেই শব্দগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে বলে এখন আর আমাদের সেগুলি পড়তে সমস্যা হয় না। যে কোনো ভাষাতে যখন প্রথম কোনো বিষয় আলোচিত হয়, তখন অনেক শব্দই অচেনা ঠেকে। এমন বইকে আত্তীকরণের জন্য সময় দিতে হবে, তবে সেই সময় দিলে পাঠক যে লাভবান হবেন তাতে সন্দেহ নেই।

লেখক এই জটিল এবং নতুন বিষয়টিকে অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে দুই মলাটের মধ্যে উপস্থাপন করেছেন। বইটির মুদ্রণ খুবই সুন্দর, চোখে পড়ার মতো কোনো প্রমাদ নেই। অসাধারণ প্রচ্ছদ নির্মাণ করেছেন সৌম্যেন পাল। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলা জনপ্রিয় বিজ্ঞান বইয়ের তালিকার প্রথমদিকেই থাকবে 'বোধবিজ্ঞান'

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


প্রকাশঃ জ্ঞান ও বিজ্ঞান আগস্ট ২০২৫

Saturday, 19 July 2025

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা - কেন করব?

 

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা - কেন করব?

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

স্বাধীনতার পরের বছরেই আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর উদ্যোগে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা ও প্রসারের জন্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ। প্রতিষ্ঠা দিবসেই প্রকাশিত হয়েছিল পরিষদের মুখপত্র জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকার প্রথম সংখ্যা। সেখানে 'রামেন্দ্র'র পথ না জগদীশ-প্রফুল্ল'র পথ', এই নামের একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন সুপরিচিত সমাজবিজ্ঞানী বিনয়কুমার সরকার। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান প্রসারের জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন। তাঁর প্রায় সমসাময়িক জগদীশচন্দ্র ও প্রফুল্লচন্দ্র আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণাতে আমাদের দেশে পথিকৃৎ। বিশেষ করে জগদীশচন্দ্র তাঁর গবেষণা বাংলা ভাষায় লিখে প্রকাশ করেছিলেন। বিনয়কুমার প্রশ্ন করেছিলেন বিজ্ঞান পরিষদ কোন পথে এগোবে? সে কি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান গবেষণা করার দিকে নজর দেবে? নাকি শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান প্রসারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে?

বিনয়কুমার নিজের মতো করে প্রশ্নের একটা উত্তর দিয়েছিলেন, কিন্তু আট দশক পরে সেই উত্তর নিয়ে আলোচনার সম্ভবত বিশেষ প্রয়োজন নেই। এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীর বিজ্ঞান জগতের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবশ্যই শেষ হয়েছিল, কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে তার অভিঘাত তখনো পুরোপুরি বোঝা যায় নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত ইউরোপই ছিল বিজ্ঞান গবেষণাতে অগ্রগণ্য। কিন্তু হিটলারের ফ্যাসিস্ট শাসন থেকে প্রাণ বাঁচাতে ইউরোপের বিজ্ঞান জগতের রথীমহারথীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইউরোপে নানা দেশের বিজ্ঞানীরা নিজেদের ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করতেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পরে তাঁরা বাধ্য হয়েই ইংরাজিতে তাঁদের গবেষণা প্রকাশ করতে থাকেন। বিজ্ঞানের ভারকেন্দ্র চলে যায় নতুন দুনিয়াতে।

গত তিন দশকে তার সঙ্গে দুটি বিষয় যুক্ত হয়েছে। প্রথমত, অতি দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসার যা আগে কল্পনাতীত ছিল; গোটা পৃথিবীটাই একটা গ্রামের সমতুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাকে আমরা বলি ভুবন-গ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজ। দূরের দেশের কোনো ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষকেও একটা ইমেল লিখলে পরের মিনিটেই আমরা তার উত্তর আশা করি। আরও জরুরি প্রয়োজন হলে সরাসরি ফোন বা মেসেজ করি। এর সুযোগে ইংরাজি বাস্তবিকপক্ষে একমাত্র আন্তর্জাতিক ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত, একাকী বা অল্প কয়েকজন মিলে বিজ্ঞান গবেষণার যুগ এখন অতীত। বহু প্রকল্প এতই ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোনো একটি দেশের পক্ষে তার ভার বহন সম্ভব হচ্ছে না। গবেষণা এখন প্রকৃত অর্থেই আন্তর্জাতিক, নানা প্রকল্পে একই সঙ্গে হাজার হাজার বিভিন্ন ভাষাভাষী বিজ্ঞানী কাজ করেন; তাঁদের মত বিনিময়ের স্বাভাবিক মাধ্যম হল ইংরাজি। বিজ্ঞান বিষয়ক প্রায় সমস্ত প্রধান গবেষণাপত্রিকাগুলি এখন ইংরাজি ভাষাতেই প্রকাশিত হয়। ইউরোপের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ইংরাজি ভাষাতে শিক্ষাদান ক্রমশই বেড়ে চলেছে।

এখানে দু' একটা ব্যতিক্রমের কথা উল্লেখ করতে হয়, তার মধ্যে অন্যতম হল চিন। বিজ্ঞানপ্রযুক্তি গবেষণাতে মোট বিনিয়োগের হিসাবে চিন এখন দ্বিতীয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই। চিনের নীতিপ্রণেতারা বিশ্বাস করেন বিজ্ঞান প্রযুক্তিই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এবং জনগণের মধ্যে বিজ্ঞান প্রসার করতে হলে তাদের মাতৃভাষাই সব থেকে উপযুক্ত। তাই চিনা ভাষাতে বিজ্ঞান প্রসারে তাঁরা অর্থ বিনিয়োগ করছেন। তা সত্ত্বেও সেখানেও গবেষণাতে ইংরাজির ব্যবহার ক্রমশই বেড়ে চলেছে, কারণগুলো আগেই বলেছি। বিজ্ঞানচর্চার চরিত্রটাই হল আন্তর্জাতিক, এবং সেখানে ইংরাজি বর্তমানে একমাত্র মাধ্যম। জাপানের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যেতে পারে।

আগেই দেখেছি আন্তর্জাতিকভাবে ইংরাজি এখন বিজ্ঞানে যোগাযোগের ভাষা। কাজেই আমরা চাইলেও সম্ভবত তার থেকে মুখ ফিরিয়ে বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞানচর্চা করা খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্তু যদি সেটা করতেও চাই, আমাদের সামনে অনেকগুলি প্রতিবন্ধকতা কাজ করবে। ইংরাজির সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে যে কোনো ভাষার প্রয়োজন বিজ্ঞানচর্চার পরম্পরা, সদিচ্ছা এবং বিনিয়োগ। বিজ্ঞানচর্চার পরম্পরা আমাদের সমাজে নেই, দু' একজন বড় বিজ্ঞানী থাকলেও তা দিয়ে পরম্পরা গড়ে ওঠে না। আবার শুধুমাত্র পরম্পরা দিয়ে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি তার উদাহরণ। সেখানে জার্মানি, ইতালি বা ফ্রান্সের মতো বিজ্ঞানে অগ্রসর দেশেও মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা কমে এসেছে। ঐতিহাসিকভাবেই ঔপনিবেশিক শাসনের জন্য আমাদের দেশে ইংরাজি ভাষার চল আছে, এবং বিশেষ করে সমাজের উঁচুতলার মধ্যে তা আরও বাড়ছে। বহুভাষাভাষী ভারতবর্ষে বাংলা একটা প্রাদেশিক ভাষা মাত্র, এবং অবিরত তাকে হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমাদের দেশে বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ হাস্যকর রকম কম; এই মুহূর্তে তা চিনের ন' ভাগের এক ভাগ, এবং ক্রমেই আরও কমছে। সেই অতি সামান্য বিনিয়োগের একাংশকে মাতৃভাষাতে বিজ্ঞান গবেষণার মতো কাজে খরচ করার চিন্তা বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়।

কেন বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগ ক্রমশই কমছে? তার কারণ বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকরা প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ও পুরাণের মধ্যে বিজ্ঞান খুঁজতেই বাসত। তাঁদের কাছে আধুনিক বিজ্ঞান শুধু অপ্রয়োজনীয় নয়, রীতিমত বিপজ্জনক; কারণ বিজ্ঞান শুধু একটা বিষয় নয়। বিজ্ঞান একটা দর্শন, চোখ বুজে কোনো কিছুকে বিশ্বাস করতে বারণ করে, প্রশ্ন করতে ও যুক্তির সাহায্যে বিচার করতে শেখায়। বিশেষ করে আমাদের সমাজে যা কিছু পুরানো তাদের প্রতি একটা অহৈতুকী ভক্তি লক্ষ্য করা যায়, শাসকরা তার সুযোগ নিচ্ছেন। বিজ্ঞান ঠিক সেই পুরানোকেই প্রশ্ন করে। তাই সমাজপতিরা চিরকালই বিজ্ঞানকে অপছন্দ করেন।

বিজ্ঞান গবেষণা ও সাধারণের মধ্যে বিজ্ঞান প্রসারের বাইরে আরও একটা বিষয় আছে, তা হল বিজ্ঞান শিক্ষা। আমি একে দুই ভাগে ভাগ করতে চাই, উচ্চ শিক্ষা ও বিদ্যালয়ে শিক্ষা। প্রথমেই আসি উচ্চ শিক্ষার কথায়। প্রশ্ন আসে, বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে উচ্চশিক্ষার পরে ছাত্র বা ছাত্রীটি কী করবে? পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ এতই কম যে রাজ্য ত্যাগ করা ছাড়া তাদের সামনে বিশেষ পথ খোলা নেই। সেক্ষেত্রে ইংরাজি ভাষাতে অন্তত চলনসই জ্ঞান প্রয়োজন। সারা দেশেও বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে শিক্ষিতদের জন্য যে ক'টি নতুন চাকরি হচ্ছে তাদের অধিকাংশই তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে। সেখানে ইংরাজি ছাড়া গত্যন্তর নেই।

এর পাশাপাশি রয়েছে উচ্চশিক্ষার বাস্তব চিত্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত শতাব্দীতে অনার্স ও পাস পরীক্ষাতে বিজ্ঞানের প্রশ্নপত্র ইংরাজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও হত। কিন্তু আমার জ্ঞানত পদার্থবিদ্যার অনার্সে একজন পরীক্ষার্থীও বাংলা ভাষাতে উত্তর লিখেছে বলে শুনিনি; সে জন্য এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলা প্রশ্নপত্র বন্ধ হয়ে যায়। এর পিছনে একটা কারণ হয়তো ভালো পাঠ্যপুস্তকের অভাব, কিন্তু ব্যক্তিগত জ্ঞান থেকে বলতে পারি যে অন্তত পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে সেই যুক্তি খাটে না। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের উদ্যোগে গত শতাব্দীর শেষ দুই দশকে অনেকগুলি পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক ছাপা হয়েছিল, যেগুলি যে কোনো আন্তর্জাতিক পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত। সেগুলি লিখেছিলেন অমলকুমার রায়চৌধুরি বা সমরেন্দ্রনাথ ঘোষালের মতো দিকপাল বিজ্ঞানী ও অধ্যাপকেরা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ছাত্রছাত্রীরাও শ্রেণিকক্ষে বাংলা ভাষাতে পড়ানোকেই পছন্দ করে। তা সত্ত্বেও পরীক্ষাতে বাংলাতে উত্তর লেখার চেষ্টা ছাত্রছাত্রীরা করেনি। তার কারণ আগের আলোচনা থেকেই পাওয়া যাবে। বর্তমানে অবশ্য বাংলা পুস্তকগুলি বিশেষ পাওয়া যায় না। পেলেও লাভ হত না, কারণ এর মধ্যে পাঠক্রম অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে; কিন্তু আমাদের রাজ্য সরকার নতুন বই ছাপা বা পুরানোর পুনর্মুদ্রণ কোনোটাতেই আগ্রহী নন।

বিদ্যালয় স্তরের সমস্যাটা অন্য রকম। সেখানে বাংলা পাঠ্যপুস্তক পাওয়া যায়, এবং এখনো পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী বাংলা ভাষার মাধ্যমেই পড়াশোনা করে। কিন্তু সমাজের এলিট বা উচ্চশ্রেণি বাংলা মাধ্যম থেকে মুখ ফিরিয়েছেন, সম্ভব হলে তাঁরা বাংলা ভাষাটাকেই ত্যাগ করতে চান। তার পিছনে অনেক আর্থসামাজিক কারণ আছে, বিশেষ করে কাজের সুযোগের কথা আগেই বলেছি। তার সঙ্গে আছে সমাজের তথাকথিত নিম্নস্তরকে দূরে রেখে নিজেদের জন্য একটা আলাদা জগৎ সৃষ্টির প্রয়াস। তাই এখন যখন 'অন্য' শ্রেণির মানুষরাও কষ্ট করে হলেও ছেলেমেয়েদের ইংরাজি মাধ্যমে পড়াচ্ছেন, তখন উচ্চ শ্রেণি তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য বেছে নিচ্ছেন তথাকথিত আন্তর্জাতিক স্কুল। সেখানে বাংলা না পড়ালেও ইংরাজির পাশাপাশি ফরাসি জার্মান বা স্প্যানিশের মতো ভাষা পড়ানো হয়, যদিও ইংরাজির এই আধিপত্যের যুগে সেই জ্ঞান বাস্তবে কোন কাজে লাগবে জানি না।

এ ঘটনা নতুন নয়; আমাদের ইতিহাসেই এর উদাহরণ আছে। সংস্কৃত সাধারণ মানুষের ভাষা ছিল না, তা ছিল সমাজের উচ্চবর্ণের উচ্চ শ্রেণির ভাষা। সাধারণ মানুষ কথা বলতেন প্রাকৃতে। এভাবেই সমাজের উচ্চশ্রেণি নিম্নবর্গের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলেছিল। ইউরোপেও মধ্যযুগে পণ্ডিতরা লাতিন ভাষায় বিদ্যাচর্চা করতেন, নিজেদের মধ্যে মত বিনিময় করতেন। সাধারণ মানুষ সেই ভাষা ব্যবহার করতেন না।

বাংলা একটা দেশের মাতৃভাষা, কিন্তু সেই বাংলাদেশে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির চর্চা সম্পর্কে আমার খুব বেশি জানা নেই। তবে যেটুকু জানি, তার থেকে মনে হয় এই সমস্যাগুলো সে দেশেও কমবেশি আছে। বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান গবেষণা বা উচ্চ শিক্ষার সমস্যাগুলির সমাধান সুদূরপরাহত। সমাজের এলিট শ্রেণি বিদ্যালয়ে স্তরেই বাংলা ভাষাকে ত্যাগ করছেন। আমরা যতই ভাষাদিবস পালন করি, বা রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বলি শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ, সমাজের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। বরঞ্চ আমাদের সামনে এখন প্রশ্ন হল, সত্যিই কি বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান চর্চা বা বিজ্ঞান শিক্ষার কোনো প্রয়োজন আছে? নাকি এ শুধুমাত্র নস্টালজিয়া? শৈশবে কৈশোরে বাংলা ভাষাতে পড়াশোনা করেছিলাম, সেই অতীতে ফিরে যাওয়ার বন্ধ্যা প্রয়াস?

এই প্রশ্নের উত্তর আমি আমার মতো করে দেওয়ার চেষ্টা করব, তবে তার আগে আমাদের দেশে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। আমাদের সমাজে আধুনিক বিজ্ঞানকে বাইরে থেকে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, এখনো পর্যন্ত আমাদের জীবনের সঙ্গে তার যোগাযোগ বিশেষ নেই। ঐতিহাসিক কারণেই আমাদের জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চা প্রাচীন রীতিনীতির সঙ্গে সমঝোতা করে চলেছে। ঔপনিবেশিক শাসকরা যখন বিদেশি শাসনের যৌক্তিকতা হিসাবে আমাদের সমাজের পশ্চাতপদতার কথা বলতেন, তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে আমাদের নবজাগরণ প্রাচীন ভারতীয় সমাজকে মহিমান্বিত করেছিল। কিন্তু এর ফলে প্রাচীন সমাজের অযৌক্তিক দিকগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ব্যাহত হয়েছে, এবং বাস্তবে বিজ্ঞানবিপ্লব করা সম্ভব হয়নি। যেখানে বিজ্ঞানবিপ্লব সফল হয়েছে, সেই পশ্চিমি দুনিয়াতে বিজ্ঞানীদের মধ্যে অলৌকিক বা আধিদৈবিকে বিশ্বাস তলানিতে ঠেকেছে। যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে ধর্মে বিশ্বাস করেন তাঁরাও তাঁদের বিজ্ঞানচর্চাকে তার থেকে পৃথক রাখেন। সেখানে যে কোনো মানুষই বাইবেল বা অন্য ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত অলৌকিক ঘটনাকে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির মোড়কে উপস্থিত করার চেষ্টা করেন না তা নয়, কিন্তু তা নিতান্তই ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাই সমাজের উচ্চশ্রেণি সেই প্রচেষ্টাকে সমর্থনের চেষ্টা করে না বা কোনো প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী তাতে যোগ দেন না।

আমাদের মতো অনেক সমাজে পরিস্থিতিটা অন্যরকম। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেই কেউ বিজ্ঞানমনস্ক হবে এমন কথা বলা যায় না। বিজ্ঞানের বিপ্লব না হওয়ার ফলেই আমাদের বিজ্ঞানীদের মধ্যেও নানা অবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা বাসা বেঁধে আছে। আগে সেগুলি তেমন প্রকাশ পেত না বা প্রচার হত না। এই সর্বব্যাপী সমাজমাধ্যমের যুগে তা সহজেই সামনে আসছে, ফলে যে সাধারণ মানুষটি আগে তাঁর অবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনাকে লুকিয়ে রাখতেন, তিনি এখন তা প্রকাশ্যে আনতে দ্বিধা বোধ করছেন না, এবং তাঁর মতো অনেকেই তাঁকে সমর্থন করছেন। তার ফল হল ভোটের মুখাপেক্ষী আমাদের শাসকরা সমাজের পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিবর্তে তাদেরই জয়গান গাইছেন। যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান সব কিছু শিকেয় তুলে সমাজকে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে।

বর্তমানে বিজ্ঞান নিজেই আক্রান্ত হচ্ছে। বিজ্ঞানপ্রযুক্তির চোখ ধাঁধানো বিকাশ সত্ত্বেও গরিব মানুষের অবস্থার উন্নতি হয়নি; অন্যদিকে ধনী আরও ধনী হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি বেশ ব্যয়সাপেক্ষ, ফলে সমাজের উঁচুতলা তার দখল নিচ্ছে। মানুষের মনে যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে, তা শাসকদের আসন টলিয়ে দিতে পারে। শাসকরা তাই তাকে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী ধারণার বিরুদ্ধে চালনা করার চেষ্টা করছেন এবং অনেক সময়েই সফল হচ্ছেন। পুরানো ধ্যানধারণার বাড়বাড়ন্ত ঘটছে, ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে যুক্তিবাদের জায়গা নিচ্ছে কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস ও রহস্যবাদ।

এই পরিস্থিতিতে অবিজ্ঞান, অপবিজ্ঞান ও অযুক্তির বিরুদ্ধে লড়াইটা কঠিনতর হয়ে পড়েছে। তাহলে উপায় কী? আমরা ইতিহাসের পাতা খুলি। গ্যালিলিওর বিচারের কথা আমরা সবাই জানি। গ্যালিলিও সূর্যকে স্থির পৃথিবীকে চলমান বলে বাইবেল বিরোধী কথা বলছেন, ক্যাথলিক চার্চের সামনে এটাই একমাত্র সমস্যা ছিল না। সমস্যাটা এটাও ছিল যে তিনি তাঁর বই লাতিনে না লিখে ইতালিয় ভাষাতে লিখছেন, যাতে করে শুধু পণ্ডিতরা নয়, সাধারণ মানুষেও তাঁর কথা বুঝতে পারেন। এর ফলে ধর্মের উপর থেকে মানুষের বিশ্বাস টলে যেতে পারে, এবং বাস্তবেও তাই হয়েছিল। নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকার গণিত নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের অবোধ্য ছিল, সেই বই লাতিনেই লেখা। কিন্তু আলোকবিদ্যা সংক্রান্ত তাঁর অধিকাংশ পরীক্ষানিরীক্ষা যে কোনো উৎসাহী মানুষই করে দেখতে পারেন, তাই সচেতনভাবেই তাঁর অপটিক্স বইটি তিনি ইংরাজি ভাষাতেই লেখেন। আধুনিক বিজ্ঞান মূলগতভাবে প্রাচীন বিজ্ঞান থেকে পৃথক; সেখানে প্রাচীন পুস্তক বা পণ্ডিতদের কথায় বিশ্বাস না করে পরীক্ষানিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের উপর জোর দেওয়া হয়, আপ্তবাক্যের জায়গা নিয়েছে যুক্তি। স্বাভাবিকভাবেই সে যুগে সমাজের উপরের শ্রেণির তা পছন্দ ছিল না, কিন্তু সাধারণের বোধগম্য ভাষাতে বিজ্ঞানের প্রকাশের ফলে যে বিপ্লব শুরু হয়েছিল, তাকে আটকানোর ক্ষমতা তাঁদের ছিল না।

আরও প্রাচীন এক উদাহরণের কথা বলতে পারি। মধ্যযুগে ইউরোপ, ভারত বা চিনে যখন বিজ্ঞানচর্চা কানাগলিতে ঢুকে পড়েছিল, তখন তাকে উদ্ধার করেছিল আরব সভ্যতা। আরব সভ্যতার সেই যুগে বিজ্ঞানের চালনাশক্তি হয়েছিল বিদেশি ভাষা থেকে আরবিতে অনুবাদ। বহু গ্রিক, সংস্কৃত, চিনা বইয়ের অনুবাদ হয়েছিলে, খলিফারা ছিলেন সেই কাজের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। গ্রিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী অ্যারিস্টটলের অনেক বইয়ের গ্রিক মূলটি আর পাওয়া যায় না, আরবিতে অনুবাদ হয়েছিল বলে সেগুলি রক্ষা পেয়েছে। এভাবেই নিজের ভাষাতে চর্চার মাধ্যমেই আরব সভ্যতা বিজ্ঞানে প্রাচীন যুগকে ছাড়িয়ে অনেক মৌলিক অবদান রেখেছিল। আরব সাম্রাজ্য স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। আবার যখন তা পিছু হটতে শুরু করে, ইউরোপের পণ্ডিতরা আরবি ভাষায় লেখা বইপত্র হাতে পান। জ্ঞানবিজ্ঞানের বই আরবি থেকে অনুবাদের মাধ্যমে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। অবশ্য প্রথমে সেই অনুবাদ হয়েছিল পণ্ডিতদের ভাষা লাতিনে, কিন্তু তার পরে তা স্থানীয় ভাষাতেও অনুবাদ হয়েছিল।

উপরের দুটি উদাহরণ থেকে দেখতে পাই সমাজে বিজ্ঞানকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করতে গেলে মাতৃভাষার মাধ্যমেই সেটা সম্ভব। আমাদের প্রয়োজন সংস্কৃতির পরিবর্তন; তা মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে সম্ভব, অন্য কোনো ভাষার মাধ্যমে তত সহজে নয়। শুধু বিজ্ঞান পরিষদ নয়, আমরা যারা সমাজের সুস্থ বিকাশ চাই, সমাজকে বৈজ্ঞানিক ধারণার ভিত্তিতে সংগঠিত করতে চাই, আমাদের সকলের সামনে যে পথ খোলা তা হল রামেন্দ্র'র পথ, অর্থাৎ মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান প্রসার। তা যে স্কুল কলেজের শ্রেণিকক্ষে করতে হবে এমন নয়, জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বইও সেই কাজ সাফল্যের সঙ্গে করতে পারে। অবিজ্ঞান ও অযুক্তির বিরুদ্ধে যে পথকে রামেন্দ্র'র পথ বলে এই লেখাতে চিহ্নিত করতে চাওয়া হয়েছে, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী নিজেও সেই পথে স্থির থাকতে পারেননি; তবে সে অন্য প্রসঙ্গ। আরব সভ্যতার ইতিহাস এই শিক্ষাও দেয় যে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের জন্য সংগ্রামকে কখনোই বন্ধ করা যাবে না, তা হলে আবার আমরা পশ্চাৎপদতার কানাগলিতে ঢুকে পড়ব। 

 

প্রকাশ - সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনা, নববর্ষ সংখা- ১৪৩২ 

Friday, 30 May 2025

উল্কার আলো

 

উল্কার আলো

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

রাতের আকাশে উল্কা আমরা অনেকেই হয়তো দেখেছি, এই লেখাতে আমরা সেই উল্কার সম্পর্কে কিছু কথা শুনব। প্রবন্ধের শিরোনামটি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গল্প থেকে ধার করা; গল্পে এক উল্কার আলো প্রেমিকাকে চিনতে সাহায্য করেছিল। আমাদের কাহিনির উল্কারা অবশ্য অত রোমান্টিক নয়, তবে তারা আমাদের সৌরজগতের উপর তারা আলো ফেলেছে।

মহাকাশ থেকে ছোট বড় পাথরের টুকরো প্রায় সময়েই আমাদের পৃথিবীকে ধাক্কা মারে। সে যখন তীব্র বেগে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকে, ঘর্ষণের ফলে তা উত্তপ্ত হয়ে আলো দেয়। আমরা চলতি কথায় বলি তারা খসা। এই সব পাথরের অনেকেই মাটিতে এসে পৌঁছায় না, তা আগেই ভস্মীভূত হয়ে যায়। আমাদের লেখাতে আমরা সেই উল্কাদের গল্পই বলব যাদের সন্ধান আমরা পৃথিবীতে পেয়েছি, এদেরকে বলে উল্কাপিণ্ড। তাদের বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞান অনেকটা এগিয়েছে।

প্রাচীনকালে সমস্ত সভ্যতাই উল্কাকে শুভ বা অশুভ বিবেচনা করত। যেমন, ভারতীয় পুরাণে উল্কাপাতকে অশুভ লক্ষণ মনে করা হত। আমরা রাহু ও কেতুর পৌরাণিক গল্পের কথা জানি। সাধারণভাবে কেতু অর্থে প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানে ধূমকেতু বোঝালেও অথর্ববেদে সম্ভবত কেতু অর্থে উল্কাকেও বোঝাত। উল্কাপাতের ঘটনা অনেক সময়ে পুরানো বইপত্র বা দলিলদস্তাবেজে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। তার মধ্যে সব থেকে প্রাচীন ঘটনাটি প্রায় চারহাজার বছরের পুরানো। প্রাচীন ফ্রিজিয়া, অর্থাৎ বর্তমান তুর্কিতে একটি উল্কাপিণ্ড পড়েছিল, সেটিকে দেবতা বলে পূজা করা হত। খ্রিস্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সেটি রোমে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং অন্তত পাঁচশো বছর সেখানেও তার পূজা চলেছিল। এই ফ্রিজিয়াতেই আজ থেকে ৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যুদ্ধোদ্যত দুই সৈন্যদলের মধ্যে একটি উল্কা এসে পড়ে। তাকে স্বর্গ থেকে পাঠানো ইঙ্গিত মনে করে দুই সৈন্যদলই পিছিয়ে যায়, ফলে সেবারের মতো যুদ্ধ হয়নি।

তবে উল্কাপিণ্ডের খবর নিঃসন্দেহে আরও প্রাচীন। মিশরের সমাধিতে এক গলার হার পাওয়া গেছে যার পুঁথির লোহাটা এসেছিল উল্কা থেকে। পৃথিবী ও উল্কার লোহার মধ্যে খনিজের গঠন আলাদা, তাই তাদের সহজেই পৃথকভাবে চেনা যায়। মনে করা হয় উল্কা থেকে যে লোহা পাওয়া গিয়েছিল, তাই সম্ভবত বিভিন্ন সভ্যতাতে প্রথম লোহার ব্যবহারে লেগেছিল, কারণ পৃথিবীর লৌহ আকরিক থেকে লোহা নিষ্কাশন করা অপেক্ষাকৃত শক্ত।

ফ্রিজিয়ার প্রাচীন উল্কাপিণ্ডটির সন্ধান এখন আর পাওয়া যায় না। উল্কাপাতের ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে, এবং সেই উল্কাটাকে আজও আমরা দেখতে পাই, এমন সব থেকে প্রাচীন উদাহরণ আছে জাপানে। সে দেশের নোগাতা শহরের কাছে ৮৬১ সালের ১৯ মে একটি উল্কা এসে পড়ে, যেটি স্থানীয় এক মন্দিরে আজও রাখা আছে। মেপে দেখা গেছে তার ওজন হল ৪৭২ গ্রাম। ইউরোপে এই রেকর্ড ধরে ফ্রান্সের এক উল্কা, যেটা ১৪৮২ সালের ৭ নভেম্বর মাটিতে পড়েছিল। সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ানের আদেশে সেটি একটি গির্জাতে সংরক্ষিত হয়। সেটির ওজন ১২৭ কিলোগ্রাম। আমাদের দেশ থেকেও দেড়শোর বেশি উল্কা সংগৃহীত হয়েছে, অবশ্য সেগুলি কোনটিই এয় প্রাচীন নয়। বিশেষ করে বেনারস ও রাজস্থানের টঙ্কে পড়া উল্কার কথা আমাদের কাহিনিতে আসবে। সাধারণভাবে যেখানে পাওয়া যায়, উল্কাপিণ্ডের নাম সেই অনুসারেই হয়।

উল্কা কোথা থেকে আসে তা নিয়ে প্রথম থেকেই পণ্ডিতদের মধ্যে তর্ক চলেছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনেস মনে করতেন নক্ষত্রদের থেকে উল্কার জন্ম। একই সময়ে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন যে উল্কার উৎস বায়ুমণ্ডল। অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন মহাকাশ বা স্বর্গ হল অপরিবর্তনীয়, তাই সেখানে উল্কার জন্ম হতে পারে না। এই তর্ক মধ্যযুগ পর্যন্ত চলে, তার পরে এক অদ্ভুত পথ নেয়। ইউরোপের পণ্ডিতরা প্রায় সবাই মিলে সিদ্ধান্ত করেন উল্কাপাত বলে কিছু হয় না; যাঁরা দাবি করেন যে উল্কা দেখেছেন তাঁরা আসলে দৃষ্টিবিভ্রমের শিকার। এমনকি আধুনিক রসায়নশাস্ত্রে স্রষ্টা আন্তন ল্যাভশিয়েরও এই মতের শরিক ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি টমাস জেফারসনকে যখন বলা হয় যে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক একটি উল্কাপাতের ঘটনা দেখেছেন ও উল্কাটিকে খুঁজে পেয়েছেন, তিনি নাকি মন্তব্য করেছিলেন যে আকাশ থেকে পাথর পড়া অসম্ভব, কাজেই ওই দুই অধ্যাপক আসলে মিথ্যাবাদী। ফরাসি বিজ্ঞান আকাদেমি ঘোষণা করে উল্কাপাতের ঘটনা ঘটতেই পারে না; তখন ইউরোপের অনেক মিউজিয়াম তাদের সংগৃহীত উল্কাপিণ্ডগুলি ফেলে দেয়।

শিল্পীর চোখে ১৮০৩ সালের উল্কাবৃষ্টি

প্রথম যে আধুনিক বিজ্ঞানী বলেন উল্কাদের উৎস মহাকাশ, তাঁর নাম আরন্সট ক্লাডনি। এই জার্মান পণ্ডিতটি ছিলেন একাধারে সঙ্গীতজ্ঞও পদার্থবিজ্ঞানী; তাঁকে অনেকেই একই সঙ্গে আধুনিক শব্দসংক্রান্ত বিদ্যা বা স্বনবিদ্যা এবং উল্কাবিষয়ক বিজ্ঞানের জনক বলে মনে করেন। তিনি প্রথম যে উল্কাপিণ্ডের টুকরোটি হাতে পান তা এসেছিল রাশিয়া থেকে। জার্মান বিজ্ঞানী পিটার পালাস সেন্ট পিটার্সবুর্গের আকাদেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি সাইবেরিয়াতে ছ'শো কিলোগ্রাম ওজনের একটি উল্কা খুঁজে পান ও সেটি সেন্ট পিটার্সবুর্গে নিয়ে আসেন। তার অনেকগুলো টুকরো তিনি ইউরোপের বিভিন্ন বিজ্ঞানীর কাছে পাঠান, ক্লাডনিও একটি পেয়েছিলেন। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন যে সেই উল্কাপিণ্ডে লোহার খনিজের রূপের সঙ্গে পৃথিবীর খনি থেকে পাওয়া লোহার আকরিকের কোনো মিল নেই। তিনি বুঝলেন যে সেই লোহার উৎস হল মহাকাশ। ১৭৯৪ সালে তিনি সে কথা প্রকাশ করেন। কিন্তু অধিকাংশ বিজ্ঞানী বললেন ক্লাডনির ধারণা বিচারবিবেচনা করতেই রাজি হলেন না, তা নাকি এতই এতই হাস্যকর যে তার আলোচনা করাটাই অর্থহীন।

কিন্তু দশ বছরের মধ্যেই তাঁদের ক্লাডনির কথা মানতে হল। ১৮০৩ সালের ২৬ এপ্রিল ফ্রান্সের এক শহরে অনেকক্ষণ ধরে টানা উল্কাপাত হয়েছিল। এই ধরনের ঘটনাকে বলে উল্কাবৃষ্টি। একটা শহরের সবাই দৃষ্টিবিভ্রমের শিকার হয়েছে, এমন হতে পারে নাকি? তাই ফরাসি আকাদেমি জাঁ-ব্যাপটিস্ট বায়োটকে বিষয়টি দেখার জন্য পাঠান। বায়োট প্রায় তিন হাজার উল্কাপিণ্ড খুঁজে পান। এরপর আর আকাশ থেকে পাথর পড়তে পারে না, তা বলার সুযোগ রইল না।

অবশ্য সেই পাথরের উৎপত্তি কোথায় তা নিয়ে এখনো সকলে একমত হলেন না। রসায়নবিদ ও আবহবিজ্ঞানীরা বললেন এর উৎস বায়ুমণ্ডল, অন্যদিকে জ্যোতির্বিদ ও ভূতত্ত্ববিদরা মনে করলেন মহাকাশ থেকেই তারা এসেছে। ক্লাডনিও কিছু ভুল করেছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল কিছু উল্কা নিচ থেকে উপর দিকে যাচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা হল যে অন্তর কিছু উল্কার উৎস পৃথিবী। শেষে ১৮৩৯ সালে ফ্রিয়েডরিশ বেসেল দেখান যে সেই মাপে ভুল ছিল।

তার আগেই অবশ্য অন্য এক পর্যবেক্ষণ থেকে অনুমান করা হয়েছিল যে উল্কার উৎস মহাকাশ। ১৮৩৩ সালে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে এক উল্কাবৃষ্টি চলেছিল। দেখা গিয়েছিল সেই উল্কাগুলো যেন আকাশে যেখানে সিংহ রাশি অবস্থান করে সেই দিক থেকে আসছে। সময় যত যায়, পৃথিবীর ঘূর্ণনের জন্য আকাশের রাশিও জায়গা পরিবর্তন করে। দেখা গেল উল্কাবৃষ্টির উৎসও সিংহ রাশির সঙ্গে সঙ্গে সরে যাচ্ছে। এ তখনই হতে পারে যখন উল্কারা মহাকাশের কোন নির্দিষ্ট স্থান থেকে আসে। সেই উল্কাবৃষ্টির বর্ণনা শুনে এক চিত্রকর এক ছবি এঁকেছিলেন, সেটি এখানে দেখানো হল। এরপর জিওভান্নি শিপারেল্লি দেখান যে আকাশের ওই অবস্থান এক ধূমকেতুর পথের সঙ্গে মিলে যায়। অর্থাৎ ওই ধূমকেতু যাওয়ার সময় নানা কারণে তার কিছু টুকরো রাস্তায় ছেড়ে যায়। তারা যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সংস্পর্শে আসে, তখন উল্কাবৃষ্টির সৃষ্টি হয়।

বেনারসের একটা টুকরো

১৮০২ সালে উল্কাপিণ্ডের প্রথম রাসায়নিক বিশ্লেষণ করেন ইংরাজ বিজ্ঞানী চার্লস হাওয়ার্ড। তিনি মোট পাঁচটি উল্কার থেকে টুকরো সংগ্রহ করেছিলেন, তার মধ্যে ছিল বেনারস। তিনি দেখেন যে লোহার এক যৌগের এক রূপ এই সমস্ত উল্কার মধ্যে আছে যাকে পৃথিবীতে পাওয়া যায় না। এই বেনারস উল্কাপিণ্ডটি ১৭৯৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর বেনারসের থকে কিছু দূরে এক গ্রামে পড়েছিল। জন লয়েড উইলিয়ামস নামের এক রয়্যাল সোসাইটির সদস্য কয়েকটি টুকরো সংগ্রহ করে রয়্যাল সোসাইটিতে পাঠান। যে কটি টুকরো এখন অবশিষ্ট আছে তাদের ওজন ৩ কিলোগ্রাম ৭০০ গ্রাম।

এখন আমরা জানি অধিকাংশ উল্কার জন্ম হল গ্রহাণুপুঞ্জে, সেখানে গ্রহাণুদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ফলে ছোট ছোট টুকরো ভেঙে যায়, সেগুলি কখনো কখনো পৃথিবীর দিকে আসে। উল্কাবৃষ্টির জন্য অবশ্য দায়ী ধূমকেতু, সারা বছরের নানা সময়ে উল্কাবৃষ্টি হয়। ধূমকেতু থেকে যে উল্কাদের জন্ম তারা সাধারণত খুব ছোট।

উল্কাপিণ্ড নিয়ে আধুনিক নিউক্লিয় জ্যোতির্বিজ্ঞান খুব আগ্রহী, তার কারণ কি? এক বিশেষ ধরনের উল্কা আছে, যাদের নাম কার্বনেসিয়াস ইভুনা (সি আই) কন্ড্রাইট (অর্থাৎ কার্বন আছে, আফ্রিকার তানজানিয়ার ইভুনা নামের এক জায়গায় একটা পাওয়া গিয়েছিল, এবং কনড্রাইট অর্থ তার ভিতরে গোলাকার দানা আছে, গ্রিক কন্ড্রুল মানে গোলক; তবে এই বিশেষ উল্কাগুলিতে গোলক পাওয়া যায় না।), যারা আমাদের সৌরজগতে কোন মৌল কত রকম আছে তা বলে দেয়। আমাদের পৃথিবীতে বসে এটা বিচার করা কঠিন, কারণ পৃথিবীর মোট ভরের অধিকাংশটাই আছে অভ্যন্তরে, যা আমাদের আয়ত্তের বাইরে। আমরা শুধু ভূত্বকের নাগাল পাই যার মোট ভর পৃথিবীর ভরের আড়াইশো ভাগের এক ভাগ।

এখনো পর্যন্ত মোট ছ'টা সি আই কন্ড্রাইটের সন্ধান পাওয়া গেছে, যার একটির উৎস রাজস্থানের টঙ্ক শহর। ১৯১১ সালের ২২ জানুয়ারি টঙ্কের আকাশে এক বিস্ফোরণ ঘটে ও অনেক উল্কার টুকরো ছড়িয়ে পড়ে, তার একটাই উদ্ধার হয় যার ভর মাত্র ৭ গ্রাম ৭০০ মিলিগ্রাম। সব থেকে ভারি সি আই কন্ড্রাইটের ভর হল ১৪ কিলোগ্রাম, আর সব থেকে হালকার হল ১ গ্রাম। গত বছর পর্যন্ত আমরা পাঁচটা এমন উল্কার খবর রাখতাম, ২০২৪ সালে মরক্কোতে ছ' নম্বরটি পড়ে। এগুলির গুরুত্ব এত বেশি যে সারা পৃথিবীতে বহু বিজ্ঞানী বারবার এদের বিশ্লেষণ করে মৌলিক পদার্থের পরিমাণ নির্ণয় করেন।

কোন খবর এই উল্কারা আমাদের দেয়? আমাদের চারদিকে তাকিয়ে দেখলে বুঝব যে সব থেকে বেশি আছে অক্সিজেন, সিলিকন, লোহা ইত্যাদি মৌল। কিন্তু তাদের অনুপাতটা কি? ভূত্বকে সব থেকে বেশি যে মৌলগুলি আছে সেগুলি হল অক্সিজেন (৪৬.%), সিলিকন (২৭.%), অ্যালুমিনিয়াম (.%), লোহা (.%), ক্যালসিয়াম (.%), সোডিয়াম (.%), পটাশিয়াম (.%), ও ম্যাগনেসিয়াম (.%)। অথচ উল্কা থেকে খবর পাওয়া যায় যে পৃথিবীর মোট মৌলের পরিমাণ হল এইরকম, লোহা (৩২.%), অক্সিজেন (৩০.%), সিলিকন (১৫.%), ম্যাগনেশিয়াম (১৩.%), গন্ধক (.%), নিকেল (,%), ক্যালসিয়াম (,%) এবং অ্যালুমিনিয়াম (,%)। অপেক্ষাকৃত ভারি বলে অধিকাংশ লোহাই পৃথিবীর কেন্দ্রে চলে গেছে, সেই লোহাই পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের উৎস।

প্রশ্ন আসে উল্কার খবরটাই যে ঠিক তা কেমন করে জানা গেল? তার কারণ উল্কার হিসাবটা আবার সূর্যের হিসাবের সঙ্গে মিলে যায়। সূর্যের আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে সূর্যে কোন কোন মৌল আছে বলা যায়। কেমন করে সেই পরিমাণটা বার করা যায় তার অঙ্কটা আবিষ্কার করেছিলেন আমাদের দেশের বিখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, যদিও পরিমাণগুলো বার করেছিলেন সিসিলিয়া পেইন নামের এক ইঙ্গ-আমেরিকান বিজ্ঞানী। দেখা গেল কয়েকটা মৌল বাদ দিলে বাকিদের মধ্যে দুই হিসাবেই আশ্চর্য মিল আছে। মিল নেই কোনগুলোতে? হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, নাইট্রোজেন, আর্গন -- এ ধরনের উদ্বায়ী পদার্থ উল্কা থেকেও প্রায় উবে গেছে, পৃথিবী থেকেও তাই। সূর্যের মোট ভরের কিন্তু ৯৮ শতাংশই হল হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম। নিউক্লিয় জ্যোতির্বিদ্যা এই সমস্ত মৌল কেমন করে এই পরিমাণেই তৈরি হল, তা নিয়ে গবেষণা করে।

গল্প শেষ করার আগে আরো কিছু কথা বলি। উল্কাপিণ্ড বিশ্লেষণ করে অনেক যৌগ পাওয়া গেছে যেগুলি সম্ভবত প্রাণ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। ২০১৫ সালে নাসা জানায় যে এই সমস্ত যৌগ দিয়ে মহাকাশের মতো পরিবেশে পরীক্ষাতে ডিএনএ ও আরএনএ-র নিউক্লিওবেস তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ প্রাণ সৃষ্টির পক্ষে মহাবিশ্ব খুবই অনুকূল। পৃথিবীর বাইরে প্রাণ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা এর ফলে বেড়ে গেল। কেউ কেউ তো এমন কথাও বলেন যে মহাবিশ্বে প্রাণ সৃষ্টি হয় মহাকাশে, তারপর উল্কার মাধ্যমে পৃথিবীতে তার আগমন ঘটেছিল। এ কথা ঠিক না ভুল তা বলার উপায় নেই। এছাড়া কিছু উল্কার মধ্যে এমন সমস্ত ছোট ছোট দানা পাওয়া গেছে, যারা কোনোভাবেই আমাদের সৌরজগতে সৃষ্টি হতে পারে না, অথচ দূরের নক্ষত্রে তাদের সন্ধান মিলেছে। সেই সব দানাকে বলে নক্ষত্রধূলি (stardust)। আমাদের সূর্য পৃথিবী সহ সৌরজগৎ সৃষ্টি হয়েছিল এক বিশাল মহাজাগতিক মেঘ থেকে। সেই মেঘেই এই সমস্ত নক্ষত্রধূলি ছিল, অর্থাৎ নক্ষত্রের মৃত্যুর পরে তাদের দেহাবশেষ মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে, সেই আদি মহাজাগতিক মেঘে তাদের দেহের কিছু অংশ ধরা পড়েছিল। আমাদের দেহের প্রতিটি পরমাণুরই এইভাবে সৃষ্টি, আমাদের দেহ মৃত নক্ষত্রদের ছাই দিয়ে তৈরি।  

 

প্রকাশঃ সন্ধিৎসা, এপ্রিল, ২০২৫