Tuesday, 26 December 2023

প্রয়াত হলেন এম এস স্বামীনাথন

প্রয়াত হলেন এম এস স্বামীনাথন


    ভারতের সবুজ বিপ্লবের রূপকার বিজ্ঞানী এম এস স্বামীনাথন গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। তাঁর জন্ম হয়েছিল বর্তমান তামিলনাড়ুর কুম্ভকোনমে ১৯২৫ সালের ৭ অগস্ট।  ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হওয়ার, কিন্তু ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে এয়। এই দুর্ভিক্ষে তিরিশ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল। ভারতের খাদ্য সমস্যা মেটানোর দিশা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।  মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি করার পরে দিল্লির ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট (আইএআরআই) থেকে জেনেটিক্স ও উদ্ভিদপ্রজনবিদ্যা নিয়ে এমএসসি করেন। স্বল্পকাল ইউনেস্কো বৃত্তি নিয়ে হল্যান্ডে গবেষণার পরে তিনি কেমব্রিজ থেকে ডক্টরেট করেন। আমেরিকার উইন্সকন্সিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পনেরো মাস গবেষণার পরে সেখানে অধ্যাপনার সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে ১৯৫৪ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কয়েক মাস পরে তিনি  আইএআরআইতে চাকরি পান।  
    স্বাধীনতার আগেই ভারতে ফলন ছিল জনসংখ্যার অনুপাতে কম। ব্রহ্মদেশ, পুর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাঞ্জাবের মতো উর্বর অঞ্চল ভারত থেকে আলাদা হওয়ার পরে সমস্যা আরো বাড়ে। অন্যদিকে স্বাধীনতার পরে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটতে থাকে; কৃষি কোনোভাবেই তার সঙ্গে তাল রেখে উঠতে পারছিল না। ফলে ভারতকে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করতে হত। বয়স্কদের হয়তো আমেরিকার পিএল ৪৮০ গমের কথা মনে আছে, সেই গমের গুণমান ছিল অত্যন্ত খারাপ, এবুং সেই সাহায্যের পরিবর্তে আমেরিকার শর্ত মেনে নিতে হত। স্বামীনাথনের মতো তরুণ বিজ্ঞানীরা এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটান। মার্কিন কৃষিবিজ্ঞানী নর্মান বোরলাগের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গবেষণা করে স্বামীনাথন  মেক্সিকোর বামন প্রজাতির গম ও জাপানি গমের মিলন ঘটিয়ে ভারতে চাষের উপযোগী নতুন এক ধরনের গমের জন্ম দেন। পরে এক সাক্ষাৎকারে স্বামীনাথন বলেছিলেন মহেঞ্জোদড়োর যুগ থেকে চারহাজার বছরের ইতিহাসে যে ফলন হত, ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ এই চার বছরেই তাকে দ্বিগুণ করা সম্ভব হয়েছিল। চাষীদেরও সেই উচ্চ ফলনশীল শস্য ব্যবহারে সম্মত করার পরে ১৯৬৮ সালে গমের ফলন আগের বছরের তুলনায় তিরিশ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পায়। বোরল্যাগ শুধু ভারত নয়, এশিয়ার অনেক দেশকেই উচ্চফলনশীল শস্য গবেষণাতে সাহায্য করেছিলেন;  সেই অবদানের স্বীকৃতিতে ১৯৭০ সালে তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। বোরল্যাগ তার ঠিক আগে স্বামীনাথনকে লিখেছিলেন যে সবুজ বিপ্লবের কৃতিত্ব ভারত সরকারের অফিসারদের, বিজ্ঞানীদের, নানা সংস্থার ও চাষীদের; কিন্তু মেক্সিকোর বামন প্রজাতির গমের গুরুত্ব স্বামীনাথনই বুঝতে পেরেছিলেন। তা না হলে হয়তো এশিয়াতে সবুজ বিপ্লব সম্ভব হতো না। যে কোনো রকম বিপ্লবের মতো সবুজ বিপ্লবেরও নিঃসন্দেহে ভালো ও খারাপ  দুই দিকই আছে, তা নিয়ে আলোচনার পরিসর ভিন্ন। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে ভারতকে খাদ্যে স্বনির্ভর করার পিছনে আছে সবুজ বিপ্লব।
    স্বামীনাথনের সভাপতিত্বে ন্যাশনাল কমিশন অন ফার্মারস শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে উৎপাদন খরচের দেড়গুণ রাখার  সুপারিশ করেছিল। সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনের এই প্রধান দাবি কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নিলেও এখনো রূপায়িত করেনি। তিনি পরিবেশ রক্ষা করে কৃষির জন্য সচেষ্ট ছিলেন। স্বামীনাথন ১৯৭২ থেকে ১৯৮০ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চের অধিকর্তা ছিলেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ তিনি ছিলেন ফিলিপাইন্সের ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অধিকর্তা। চিন, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, কেনিয়া সহ বহু দেশের কৃষি গবেষণাতে তিনি সাহায্য করেছিলেন।
    ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজের প্রথম প্রাপক স্বামীনাথন, সেই অর্থে গড়ে তুলেছিলেন স্বামীনাথন রিসার্চ ফাউন্ডেশন। আলবার্ট আইনস্টাইন পুরস্কার, ম্যাগসেসে পুরস্কার, পদ্ম বিভূষণ সহ বহু সম্মান তিনি পেয়েছেন। ২০০৭ সাল থেকে তিনি ছ' বছর রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য ছিলেন। টাইমস পত্রিকার বিচারে বিংশ শতাব্দীর সব থেকে প্রভাবশালী কুড়ি জন এশীয়ের তালিকাতে তিন ভারতীয়ের একজন ছিলেন স্বামীনাথন, অন্য দুজন  গান্ধী  ও রবীন্দ্রনাথ।

                                        গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় 

সৃষ্টির একুশ শতক পত্রিকার নভেম্বর ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত

Saturday, 2 December 2023

জ্যোতির্বিজ্ঞান ও আঠারো উনিশ শতকের কয়েকজন মহিলা জ্যোতির্বিজ্ঞানী


জ্যোতির্বিজ্ঞান ও আঠারো উনিশ শতকের কয়েকজন মহিলা জ্যোতির্বিজ্ঞানী

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


আধুনিক বিজ্ঞানের প্রথম যুগ নারীদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল। সমাজের বাধা অতিক্রম করে বিজ্ঞানের অঙ্গনে প্রবেশ করতে তাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম জ্যোতির্বিদ্যার থেকে, নানা বাধা পেরিয়ে সেই বিজ্ঞানেও কয়েকজন মহিলা অবদান রেখে গেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সব থেকে পুরানো সংগঠন হল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি অফ লন্ডন। ১৮২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সোসাইটি ১৮৩১ সালে নাম পরিবর্তন করে হয় রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি। কিন্তু ১৯১৫ সালের আগে মহিলারা এই সোসাইটির সদস্য হতে পারতেন না। তবে সাম্মানিক সদস্য হওয়ার সুযোগ ছিল, কয়েকজন নারী সেই সম্মান পেয়েছিলেন। এই লেখাতে আমরা তাঁদের মধ্যে চারজনের কথা সংক্ষেপে শুনব।

১৮৩৫ সালে প্রথম দুই মহিলাকে সোসাইটির সাম্মানিক সদস্য করা হয়, তাঁরা হলেন ক্যারোলাইন লুক্রেশিয়া হার্শেল ও মেরি সমারভিল। ক্যারোলাইন হার্শেলের তাঁর জন্ম ১৭৫০ সালে জার্মানির হ্যানোভারে। তাঁর দাদা বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেল। ইউরেনাস গ্রহের আবিষ্কার, তারাদের সাপেক্ষে সূর্যের প্রকৃত গতি, আমাদের ছায়াপথের প্রথম মডেল, শ্বেত বামন নক্ষত্র, যুগ্ম নক্ষত্র উইলিয়ামের আবিষ্কারের তালিকা শেষ হবে না। সেই সময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেলের অনেক আবিষ্কারের সময় তাঁকে সাহায্য করেছিলেন ক্যারোলাইন। 

ক্যারোলাইন হার্শেল

 

উইলিয়ামের প্রথম জীবন বেশ কষ্টে কেটেছিল। তিনি জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডে চলে আসেন। জ্যোতির্বিদ্যা ছিল তাঁর শখ। তাঁকে বাড়ির কাজে সাহায্যের জন্য ক্যারোলাইন ইংল্যান্ডে আসেন। ক্যারোলাইন বাড়িতে পড়াশোনার বিশেষ সুযোগ পাননি। দশ বছর বয়সে টাইফাস রোগের জন্য তাঁর বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাঁর উচ্চতা ছিল মাত্র চার ফুট তিন ইঞ্চি। হার্শেল তাঁকে নিজের কাজের সহকারী করে নিয়েছিলেন; সে যুগের সেরা দূরবিনগুলি তাঁর হাতেই তৈরি। ক্যারোলাইন তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। ইউরেনাস আবিষ্কারের পর উইলিয়ামের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, রাজার অনুগ্রহে একজন সহকারী রাখার অর্থও মঞ্জুর হয়।

তখনো ফটোগ্রাফি আবিষ্কার হয়নি, ক্যারোলাইন উইলিয়ামের পর্যবেক্ষণ লিখে রাখতেন। সেই সমস্ত পর্যবেক্ষণ সুশৃঙ্খলভাবে প্রকাশের উপযোগী করতেন। নিজে পর্যবেক্ষণ করতেন, এবং অঙ্ক কষে জ্যোতিষ্কের অবস্থান ও কক্ষপথও নির্ণয় করতেন। তাই দাদা বোনকেই সহকারী বেছে নেন। ক্যারোলাইন হলেন প্রথম পেশাদার মহিলা জ্যোতির্বিদ, এবং ইংল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথম বেতনভুক মহিলা সরকারী কর্মচারী। উইলিয়ামের জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষণের রেকর্ড প্রকাশের উপযোগী করেন ক্যারোলাইন। ১৭৯৮ সালে রয়্যাল সোসাইটির গবেষণাপত্রিকা ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে সেই তালিকাতে তাঁর নামও লেখক হিসাবে আছে। তিনিই প্রথম মহিলা যাঁর গবেষণা ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল। তিনি রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির প্রথম মহিলা স্বর্ণপদক বিজয়ী এবং তার প্রথম দুজন সাম্মানিক মহিলা সদস্যের একজন। উইলিয়ামের ছেলে জন তাঁর সময়ের অন্যতম সেরা জ্যোতির্বিদ ছিলেন, ক্যারোলাইন ও জন চিঠিপত্রে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে আলোচনা করতেন।

উইলিয়ামকে যখন সাহায্য করতে হত না, ক্যারোলাইন নিজে তখন একটি ছোট দূরবিন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন। ধূমকেতু খোঁজার জন্য সেটি উইলিয়াম ক্যারোলাইনের জন্যই বানিয়েছিলেন। ১৭৮৩ সালে তিনি তিনটি নীহারিকা খুঁজে পেয়েছিলেন। ১৭৮৬ থেকে ১৭৯৭ সালের মধ্যে আটটি ধূমকেতু ক্যারোলাইন আবিষ্কার করেছিলেন। প্রথম আবিষ্কারের দিনটা ছিল ১ আগস্ট, ১৭৮৬। সেটি নিঃসন্দেহে পুরোপুরি ক্যারোলাইনের একার কৃতিত্ব, দাদা সেই সময় সেখানে ছিলেন না।

হার্শেলদের আকাশ পর্যবেক্ষণ নিরুপদ্রব ছিল না। উত্তর ইউরোপের শীতে সারা রাত বাইরে কাটানোর মূল্য হিসবে নিউমোনিয়া ছিল খুব স্বাভাবিক ঘটনা। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে নিউমোনিয়া ছিল প্রাণঘাতী রোগ। একবার অন্ধকারে বরফে ঢাকা মাঠের উপর দিয়ে দৌড়োতে গিয়ে এক লোহার গজাল ক্যারোলাইনের পায়ে ঢুকে গিয়েছিল। অনেক দিন তাঁকে বিছানাতে কাটাতে হয়েছিল। কিন্তু নিজের আঘাত নয়, ক্যারোলাইন চিন্তিত ছিলেন তাঁর দুর্ঘটনার ফলে উইলিয়ামের আকাশ পর্যবেক্ষণে কতটা অসুবিধা হবে তাই নিয়ে। তিনি সবসময়েই বিশ্বাস করতেন যে উইলিয়ামই আসল, তাঁর নিজের কাজটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়।

উইলিয়ামের মৃত্যুর পরে ক্যারোলাইন জার্মানি ফিরে যান। সেখানে তিনি উইলিয়ামের রেকর্ড থেকে আড়াই হাজার নীহারিকার এক তালিকা বানিয়েছিলেন। তাঁর তৈরি করা জ্যোতিষ্কের তালিকাগুলি এখনো আকাশ পর্যবেক্ষণে ব্যবহার হয়। বিশেষ করে জার্মানিতে প্রকাশিত তালিকাটির উপর ভিত্তি করে পরের নিউ গ্যালাকটিক ক্যাটালগ (NGC) তৈরি হয়েছিল। এখনো আকাশে অনেক আলোকউৎসকে NGC সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। তাঁর ছিয়ানব্বই বছর বয়সে প্রুশিয়ার সম্রাট তাঁকে এক স্বর্ণপদকে ভূষিত করেন। তাঁর আবিষ্কৃত ধূমকেতুগুলি ছাড়াও একটি গ্রহাণু, চাঁদের বুকে একটি গহ্বর, দুটি নক্ষত্রমণ্ডল ও একটি কৃত্রিম উপগ্রহের নাম তাঁর নামে দেওয়া হয়েছে।

মেরি সমারভিল ছিলেন রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির প্রথম দুই সাম্মানিক নারী সদস্যের অপরজন। তাঁর জন্ম ১৭৮০ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্কটল্যান্ডে। তাঁর বাবা উইলিয়াম ফেয়ারফ্যাক্স ছিলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ভাইস অ্যাডমিরাল। ক্যারোলিনের সঙ্গে মেরির একটা পার্থক্য ছিল, তিনি একাই গবেষণা করেছিলেন। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত, বই পড়ে তিনি বীজগণিত, জ্যামিতি, ক্যালকুলাস, গতিবিদ্যা ইত্যাদি শিখেছিলেন। নিউটনের বিখ্যাত বই 'প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা' তিনি পড়েছিলেন। ক্যালকুলাসের কিছু সমস্যার সমাধান করে তিনি ছদ্মনামে প্রকাশ করেছিলেন। পিয়ের-সিমোঁ লাপ্লাসের লেখা গ্রহনক্ষত্রদের গতিবিধি ও মাধ্যাকর্ষণ সংক্রান্ত বিখ্যাত বইটি তিনি ফরাসি থেকে ইংরাজিতে অনুবাদ করেছিলেন, বহুদিন সেটি ইংল্যান্ডে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে ব্যবহার হত। 

মেরি সমারভিল

 

মেরির প্রথমবার বিয়ে হয় ১৮০৪ সালে তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয় স্যামসন গ্রেগের সঙ্গে। তাঁরা লন্ডনে থাকতেন। কিন্তু তাঁর স্বামী মেয়েদের বিদ্যাচর্চার প্রয়োজন আছে মনে করতেন না। ১৮০৭ সালে স্যামসনের মৃত্যু হলে মেরি স্কটল্যান্ডে ফিরে যান। ১৮১২ সালে তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ হয় অপর এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় ডাক্তার উইলিয়াম সমারভিলের সঙ্গে। ইউলিয়াম মেরিকে পড়াশোনা ও গবেষণা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। সূর্যালোকের বেগুলি রশ্মির চৌম্বক ধর্ম বিষয়ে তাঁর গবেষণা প্রবন্ধ ১৮২৬ সালে ফিলোজফিকাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল, সেটিই এই পত্রিকাতে প্রকাশিত কোনো মহিলার একক লেখা প্রথম প্রবন্ধ। ইউরেনাসের তার গতিবিধি ব্যাখ্যা করার জন্য আরো দূরের একটি গ্রহের কথা যাঁরা প্রথম বলেছিলেন, মেরি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

জ্যোতির্বিদ্যা ছাড়াও অনেক বিষয়ে তাঁর উৎসাহ ছিল। বেশ কয়েকটি বই লিখেছিলেন মেরি সমারভিল। ১৮৩১ সালে তাঁর লেখা প্রথম বই দি মেকানিজম অফ দি হেভেন্‌স' প্রকাশিত হয়। তিন বছর পরে প্রকাশিত হয় অন দি কানেকশন অফ দি ফিজিক্যাল সায়েন্সেস। বইটির পনের হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল; জার্মান ও ইতালিয়ান ভাষাতে অনূদিত হয়েছিল। ডারউইনের অরিজিন অফ স্পিসিস প্রকাশের আগে বিজ্ঞান বিষয়ক কোনো ইংরাজি বই এত সংখ্যায় বিক্রির নজির নেই। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত হয় 'ফিজিক্যাল জিওগ্রাফি’, ইংরাজি ভাষায় এই বিষয়ের প্রথম বই। ১৮৬৯ সালে ঊননব্বই বছর বয়সে প্রকাশিত হয় 'মলিকিউলার এন্ড মাইক্রোস্কোপিক সায়েন্স’, বইটি লিখতে তিনি সময় নিয়েছিলেন দশ বছর। ১৮৭২ সালের ২৯ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। তার পরের বছর প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনী 'পার্সোনাল রিকালেকশনস'। সে যুগের অনেক বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল ও নিয়মিত চিঠি বিনিময় হত। তাঁর নামে একটি গ্রহাণু, চাঁদের বুকে একটি গহ্বর ও একটি কৃত্রিম উপগ্রহের নাম রাখা হয়েছে। ২০১৭ সালে জনগণের ভোটে ব্যাঙ্ক অফ স্কটল্যান্ডের নতুন দশ পাউন্ডের নোটে তাঁর ছবি ছাপার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১৯০৩ সালে সোসাইটি মার্গারেট লিন্ডসে হাগিন্স ও অ্যাগনেস মেরি ক্লার্ককে সাম্মানিক সদস্যপদ দেয়। মার্গারেট লিন্ডসে হাগিন্সের জন্ম ১৮৪৮ সালে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে। তাঁর বাবা জন মারে ছিলেন উকিল। মার্গারেটের মা হেলেন লিন্ডসে মারা যাওয়ার জন আবার বিয়ে করেন। সেই সময় থেকে জনের বাবা রবার্ট ছিলেন মার্গারেটের সঙ্গী। রবার্ট ছিলেন শৌখিন জ্যোতির্বিদ, তিনি মার্গারেটের মনে এই বিষয়ে আগ্রহ জাগিয়েছিলেন। মার্গারেট জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে নানা বইপত্র পড়ে নিজে নিজে শিখতেন। ১৮৭৩ সালে একটি প্রবন্ধে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম হাগিন্সের তৈরি একটি বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্রের কথা পড়ে নিজেই একটি বর্ণালীবীক্ষণ তৈরি করেন। এক যন্ত্রনির্মাতার মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে উইলিয়াম হাগিন্সের আলাপ হয়, ১৮৭৫ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। দুজনে একসঙ্গে কাজ শুরু করেন। 

মার্গারেট লিন্ডসে হাগিন্স

 

উইলিয়াম সবসময়েই তাঁদের গবেষণাকে দুজনের যৌথ কাজ বলতেন। মার্গারেটের দায়িত্ব ছিল দূরবিনের মাধ্যমে নক্ষত্রটিকে দেখা, তারপর দুজনে মিলে তার বর্ণালীর ফটোগ্রাফ তুলতেন। সেই সময় ফটোগ্রাফির অনেক উন্নতি হয়েছিলেন,। মার্গারেট ও উইলিয়াম প্রথম জ্যোতির্বিদ্যাতে সেই নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ করেন। তাঁরা অভিজিৎ নক্ষত্রের হাইড্রোজেনের বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ১৮৮৯ সালে মার্গারেটের নাম প্রথম কোনো গবেষণাপত্রিকাতে লেখক হিসাবে প্রকাশিত হয়; সেটির বিষয় ছিল গ্রহের বর্ণালী পর্যবেক্ষণ। অন্য অনেক নক্ষত্র ও নীহারিকার বর্ণালী তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। নীহারিকের বর্ণালীতে তাঁরা অনেক অচেনা চিহ্ন খুঁজে পান। প্রথমে ভাবা হয়েছিল এ কোনো অজানা মৌলের চিহ্ন, মার্গারেটের বন্ধু অ্যাগনেস মেরি ক্লার্ক সেই প্রস্তাবিত মৌলের নাম দেন নেবুলিয়াম। অনেক বছর পরে বোঝা যায় সেটি ছিল আয়নিত অক্সিজেনের বর্ণালী। ১৮৯২ সালে দেখতে পাওয়া নোভা পর্যবেক্ষকদের একদম প্রথম সারিতে ছিলেন হাগিন্স দম্পতি। তাদের পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায় যে নোভার থেকে হাইড্রোজেন গ্যাস প্রচণ্ড গতিতে বাইরের দিকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁদের যৌথ বই, 'ফটোগ্রাফিক আটলাস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ স্টেলার স্পেকট্রা'। এরপর থেকে তাঁরা পরীক্ষাগারে বর্ণালী পর্যবেক্ষণে মন দেন। তাঁরা সূর্যের বর্ণালীতে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের পরিমাণ নির্ণয়ের কাজ করেছিলেন। পরবর্তীকালে মেঘনাদ সাহার সমীকরণ তাঁদের পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা দেবে। মার্গারেট প্রাচীনযুগে জ্যোতির্বিদ্যাতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন ও এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাতে সেই বিষয়ে লিখেছিলেন। তিনি ও উইলিয়াম ১৯০৩ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়েও গবেষণা করেছিলেন। উইলিয়ামের মৃত্যু হয় ১৯১০ সালে। পাঁচ বছর পরে ১৯১৫ সালের ১৪ মার্চ মার্গারেট প্রয়াত হন।

অ্যাগনেস মেরি ক্লার্ক মুলত জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক বেশ কয়েকটি বই লেখার জন্য পরিচিত হয়েছিলেন। তাঁর বইগুলি সমকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল, পেশাদার বিজ্ঞানীদের তা সাহায্য করেছিল। অ্যাগনেসের জন্ম ১৮৪২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আয়ারল্যান্ডের কর্কে। তাঁর বাবা জন উইলিয়াম ক্লার্ক ছিলেন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। জন ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে পড়েছিলেন; অ্যাগনেসের মা ক্যাথরিনও ছিলেন উচ্চ শিক্ষিতা। তিন ছেলেমেয়েকে তাঁরা বাড়িতেই শিক্ষা দিয়েছিলেন। জনের একটি টেলিস্কোপ ছিল, অ্যাগনেস ছোটবেলা থেকেই সেটি ব্যবহার করতেন। মাত্র পনের বছর বয়সেই তিনি জ্যোতির্বিদ্যার এই ইতিহাস লেখা শুরু করেন।

অ্যাগনেসের স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। দিদি এলেন ও তিনি সেই জন্য ১৮৬৭ থেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত ইতালির ফ্লোরেন্সেই বেশি সময় কাটান। ১৮৭৭ সাল থেকে তাঁদের পরিবার লন্ডনে বাস শুরু করেন। সেই বছরেই সুপরিচিত এডিনবার রিভিউ পত্রিকাতে অ্যাগনেসের দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে একটি ছিল কোপার্নিকাসের সময়ে ইতালির জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাস। প্রবন্ধগুলি উচ্চপ্রশংসিত হয়েছিল, এরপর থেকে তিনি প্রতিবছর দুটি করে প্রবন্ধ লেখার আমন্ত্রণ পান। শেষ পর্যন্ত মোট পঁয়ত্রিশটি প্রবন্ধ তিনি এডিনবার রিভিউতে লিখেছিলেন। 

অ্যাগনেস মেরি ক্লার্ক

 

সমকালীন জ্যোতির্বিদ্যার গবেষণার সম্পর্কে লেখার জন্য বিজ্ঞানী মহলে অ্যাগনেসের পরিচিতি হয়। ১৮৮০ সালে তিনি প্রকাশ করেন 'দি কেমিস্ট্রি অফ স্টারস'। সেই প্রবন্ধকে কেন্দ্র করেই জন্ম হয় তাঁর প্রথম বইয়ের, 'এ পপুলার হিস্ট্রি অফ অ্যাস্ট্রোনমি অফ দি নাইনটিন্‌থ সেঞ্চুরি'। ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত এই বইটি পেশাদার জ্যোতির্বিদদের কাছেও অবশ্যপাঠ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর আগে এই ধরনের সমস্ত বইতে কোপার্নিকাস থেকে নিউটনের কাল পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথা লেখা হত। অ্যাগনেসের বইতে প্রথম আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার বিবরণ পাওয়া গেল। সমস্ত প্রধান ইউরোপিয় ভাষা জানতেন অ্যাগনেস, তিনি সব সময় মূল প্রবন্ধ পড়ে তবেই তার সম্পর্কে লিখতেন। বইটির চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। এমন কি প্রকাশের তিরিশ বছর পরে সুদূর ভারতবর্ষে মেঘনাদ সাহার গবেষণার প্রেরণা ছিল এই বই।

বই প্রকাশের আগে অ্যাগনেসের সংগে কোনো পেশাদার জ্যোতির্বিদের সরাসরি পরিচয় ছিল না। এর পরেই তাঁর সঙ্গে মার্গারেট হাগিন্সের পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার মানমন্দির থেকে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি তিন মাস সেখানে কাটান। সেখানে করা তাঁর পর্যবেক্ষণ মানমন্দিরে প্রকাশিত হয়। ১৮৯০ সালে তিনি তাঁর দ্বিতীয় বই দি সিস্টেম অফ দি স্টারস প্রকাশ করেন। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় বই 'প্রবলেমস ইন অ্যাস্ট্রোফিজিক্স'। ১৯০৫ সালে প্রকশিত হয় 'মডার্ন কসমোজেনিস'। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার একাদশ সংস্করণে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস এবং তিরিশ জন জ্যোতির্বিদের জীবনী লেখেন। ব্রিটেনে ১৮৮২ সালে থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে ডিকশনারি অফ ন্যাশনাল বায়োগ্রাফি সংকলন। সেখানে অন্তত ১৬৫টি প্রবন্ধ লিখেছিলেন অ্যাগনেস। ১৯০৭ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যু পর্যন্ত লিখে গেছেন অ্যাগনেস। তাঁর মৃত্যুর পরে এডিনবার রিভিউতে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা শেষ প্রবন্ধ, সেটি ছিল আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণার বিবরণ। চাঁদের বুকে একটি গহ্বরের নাম তাঁর নামে দেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি তাঁর নামে একটি পদক চালু করেছে; জ্যোতির্বিদ্যা বা ভূপদার্থবিদ্যার ইতিহাস বিষয়ে গবেষণার জন্য এই পদক দেওয়া হয়।

১৯১৫ সালের আগে আরো তিনজন মহিলাকে সোসাইটির সাম্মানিক সদস্যপদ দেওয়া হয়েছিল। জ্যোতির্বিদ্যার জন্য অর্থ সাহায্য করার জন্য অ্যানে শিপশ্যাঙ্কসকে ১৮৬২ সালে সাম্মানিক সদস্যপদ দেওয়া হয়েছছিল। তিনি কেমব্রিজ মানমন্দিরকে দশ হাজার পাউন্ড দিয়েছিলেন। সেই অর্থে কেনা দূরবিনের নাম তাঁর নামে রাখা হয়েছিল। চাঁদের বুকে একটি গহ্বরও তাঁর নাম বহন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্টের হার্ভার্ড মানমন্দিরের দুই কর্মী উইলেমিনা ফ্লেমিং ও অ্যানি জাম্প ক্যাননকেও যথাক্রমে ১৯০৭ ও ১৯১৪ সালে সাম্মানিক সদস্য পদ দেওয়া হয়েছিল। জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে দুজনেরই বিপুল অবদান আছে, এই প্রবন্ধে স্বল্পপরিসরে তার পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়। সামান্য সুযোগ পেয়েই এই নারীরা প্রতিবন্ধকতার পাহাড় জয় করতে পেরেছিলেন। সেই সমস্ত বাধা কিছুটা হলেও দূর হয়েছে সন্দেহ নেই, তার পিছনে আছে এঁদের মতো নারী বিজ্ঞানীদের অবদান। 

 

প্রকাশ জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার, শারদীয় ২০২৩  






Monday, 20 November 2023

ভারতের চন্দ্র অভিযান

 

ভারতের চন্দ্র অভিযান

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

আকাশে সূর্যের পরেই সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হল চাঁদ, তাকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল চিরদিনের। চাঁদকে নিয়ে দেশবিদেশের পু্রাণে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। মহাভারতের গল্পে কুরুপাণ্ডবদের সবার চন্দ্রবংশে জন্ম, অর্থাৎ তারা চাঁদের বংশধর। অন্য এক গল্পে আবার চাঁদের জন্ম হয়েছিল সমুদ্রমন্থনে, শিব তাকে নিজের জটায় বসিয়ে নিয়েছিলেন। 1969 সালের 20 জুলাই মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল এরোনটিক্স এন্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা নাসার মহাকাশযান অ্যাপোলো-11-এর মহাকাশচারীরা চাঁদে পা দিয়েছিলেন। গ্রহ-উপগ্রহ মিলিয়ে পৃথিবীর বাইরে একমাত্র যেখানে মানুষের পা পড়েছে তা হল চাঁদ।

ভারত সহ অনেক দেশই বিভিন্ন কারণে চাঁদে অভিযানে আগ্রহী। চার বছর আগে বাহুবলী অর্থাৎ জিএসএলভি মার্ক-৩ রকেট শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়েছিল, সে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় চন্দ্রযানকে। চন্দ্রলোকে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন সংক্ষেপে ইসরোর এটি ছিল দ্বিতীয় অভিযান। এর আগে ২০০৮ সালে প্রথম চন্দ্রযানকে চাঁদের চারদিকে কক্ষপথে স্থাপন করেছিল ইসরো। পরের অভিযানের লক্ষ্য ছিল আরো সুদূরপ্রসারী। এই দ্বিতীয় চন্দ্রযানের অরবিটার এখনো মাত্র একশো কিলোমিটার উপর থেকে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করছে। চাঁদের বুকে নামার কথা ছিল অবতরণ যান বা ল্যান্ডারের। সেই বছর অর্থাৎ ২০১৯ সাল ছিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার জনক বিক্রম সরাভাইয়ের জন্মশতবর্ষ, সেই কথা মনে রেখে ল্যান্ডারটির নাম দেওয়া হয়েছিল বিক্রম। চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের পরে চারপাশে ঘুরে তথ্য সংগ্রহের জন্য ছিল সৌরশক্তিচালিত রোভার প্রজ্ঞান। এর আগে কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন চাঁদের বুকে মহাকাশযান নামাতে সক্ষম হয়েছিল।

শুরুতে উৎক্ষেপণের দিন ঠিক করা হয়েছিল ১৪ জুলাই, কিন্তু কিছু ত্রুটি ধরা পরার জন্য তা শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে করা হয় ২২ জুলাই। কিন্তু বিক্রমকে সফ্‌ট ল্যান্ডিং (পুরানো এক লেখায় পড়েছিলাম পালকের মতো অবতরণ) শেষ পর্যন্ত করানো সম্ভব হয়নি। সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখে পূর্বনির্ধারিত সূচী অনুযায়ী বিক্রমকে চন্দ্রযান থেকে বিচ্ছিন্ন করাতে বিজ্ঞানীরা সফল হয়েছিলেন, কিন্তু সে যখন চন্দ্রপৃষ্ঠের দু’কিলোমিটার উপরে তখন রকেটের নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দেয়। তিনশো তিরিশ মিটার উচ্চতায় বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই সময় তার নামার বেগ ছিল সেকেন্ডে ৫৮ মিটার, যা নিরাপদ মাত্রার উপরে। বিক্রম সম্ভবত চন্দ্রপৃষ্ঠে ৫০ মিটার প্রতি সেকেন্ড বেগ নিয়ে নেমেছিল, যা অনেকটাই বেশি। এই হার্ড ল্যান্ডিঙের পর বিক্রমের চিহ্ন অবলোহিত ক্যামেরাতে খুঁজে পাওয়া গেলেও তার সঙ্গে আর যোগাযোগ স্থাপন করা যায় নি। মূল চন্দ্রযান অবশ্য এখনো চাঁদের চারপাশে আবর্তন করছে এবং তথ্য পাঠাচ্ছে।

সফ্‌ট ল্যান্ডিং বিষয়টা মোটেই সহজ নয়। এই ঘটনার মাত্র কয়েকমাস আগে ইজরায়েলের অবতরণ যান চাঁদে নামার সময় দুর্ঘটনাতে পড়েছিল। এই বছরও রাশিয়ার লুনা-২৫ মিশনের ল্যান্ডার চাঁদের বুকে আছড়ে পড়ে। অনেক রকম সমস্যা আসতে পারে। যেমন চাঁদের খুব কাছে যখন ব্রেক করার জন্য ল্যান্ডিং রকেট চালানো হবে, তখন চাঁদের থেকে ক্ষুদ্র ধূলিকণা ছিটকে এসে রকেটের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে, সেই কথা মাথায় রেখে রকেট ডিজাইন করতে হয়। এ ধরনের নানা সমস্যার জন্য চন্দ্রযান-২ অভিযানে অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই কাজে আসে নি।

তবে বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়েন নি। সেই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েই ভারতের তৃতীয় চন্দ্র অভিযান এ বছর সফল হল। তৃতীয় চন্দ্রযানের ল্যান্ডার ও রোভারের নাম একই রাখা হয়েছিল। গত ১৪ জুলাই শ্রীহরিকোটা থেকে এলভিএম থ্রি এম ফোর রকেটে করে চন্দ্রযান--কে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। অবতরণের জন্য ২৩ আগস্ট দিনটাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল কারণ দক্ষিণ মেরুতে তখন সকালবেলা। চাঁদের বুকে দিন রাত্রি দুইই প্রায় পৃথিবীর পনের দিনের মতো দীর্ঘ। চাঁদের ঘূর্ণন অক্ষ তার সূর্যের চারপাশে আবর্তন তলের সঙ্গে প্রায় লম্বভাবে আছে, ফলে দিন রাতের দৈর্ঘ্য দক্ষিণ মেরুতেও প্রায় এক। এবার আর সমস্যা হয় নি, চাঁদের বুকে ভালো ভাবেই নেমেছিল ল্যান্ডার বিক্রম। রোভার প্রজ্ঞান তার কাজ করেছে। প্রজ্ঞান ও বিক্রম দুইই সৌরশক্তির সাহায্যে কাজ করে, ধরা হয়েছে তারা চোদ্দ দিন মতো কাজ করবে। আলো থাকার ফলে এই দুইয়েরই ক্যামেরাতে ছবি দেখা গেছে ও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে রাতের তাপমাত্রাতে কোনো যন্ত্রের পক্ষে কাজ করাও অসম্ভব। এই লেখা তৈরির সময় বিক্রম ও প্রজ্ঞান শীত ঘুমে, তা থেকে জেগে উঠে তারা আবার কাজ শুরু করল কিনা তা আপনারা এই লেখা পড়ার সময় জেনে যাবেন। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার মুকুটে এক নতুন পালক যোগ হল। এ বর্তমানে বেশ কিছু দেশের বা সংস্থার উপগ্রহ আকাশে পাঠানোর দায়িত্ব নেয় ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। তার এই সাফল্যের ফলে আর অনেকেই তার সঙ্গে যৌথভাবে কাজে আগ্রহী হবে সন্দেহ নেই।

চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে এই প্রথম কোনো যান অবতরণ করল। চাঁদে যদি জল থাকে তা দক্ষিণ মেরুতে পাওয়ার সম্ভাবনাই সব থেকে বেশি। চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই, কাজেই তরল অবস্থায় জল থাকা সম্ভব নয়, তা বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে। জল একমাত্র থাকতে পারে বরফ রূপে। আগেই বলেছি চাঁদের ঘূর্ণন অক্ষ তার আবর্তন তলের সঙ্গে লম্বভাবে আছে, ফলে দক্ষিণ মেরুতে সুর্য সবসময়েই দিগন্তের কাছে থাকে। তাই সেখানকার অনেক গভীর গহ্বরের তলাতে সূর্যের আলো কোনোদিন পৌঁছায় না। বরফ থাকার সম্ভাবনা সেই সব জায়গাতেই বেশি। জল পাওয়া গেলে তার তাৎপর্য হবে বিশাল। চাঁদে যদি কোনোদিন স্থায়ীভাবে থাকার স্টেশন তৈরি হয়, তার জন্য জল পৃথিবী থেকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে না। পান করার পাশাপাশি জলের তড়িৎবিশ্লেষণ করে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পাওয়া যাবে। অক্সিজেন নিঃশ্বাস নিতে লাগবে, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্য উদ্বায়ী খনিজও সেই গভীর গহ্বরে থাকতে পারে। দক্ষিণ মেরুই হবে সম্ভবত স্টেশন তৈরির আদর্শ জায়গা, জল পাওয়ার পাসাপাশি আরো একটা বড় সুবিধা সেখানে আছে। সেখানে কিছু কিছু পর্বতের চূড়া প্রায় সব সময়েই সূর্যালোকে আলোকিত হয়, ফলে শক্তির জন্য সৌর প্যানেল বসানোর এ এক আদর্শ অবস্থান।

প্রজ্ঞান ও বিক্রমের মধ্যে যে সমস্ত যন্ত্রপাতি আছে তা দিয়ে চাঁদের মাটিতে কী কী মৌল আছে তা বিশেষণ করা যাবে। ফলে চাঁদের উৎপত্তি সম্পর্কে আমাদের বর্তমান যে তত্ত্ব আছে তা কতটা ঠিক বা ভুল তা বিচার করা যাবে। কী ধরনের খনিজ আছে তাও জানা যাবে। এছাড়া চাঁদের বুকে ভূমিকম্প (চন্দ্রকম্প!) হয় কিনা তা দেখবে প্রজ্ঞান। আমাদের জ্ঞান অনুযায়ী চাঁদের কেন্দ্র অনেক আগে শীতল হয়ে জমাট বেঁধে গেছে, তাই সেখানে ভূমিকম্প হওয়ার কথা নয়। তবে বিজ্ঞানে তত্ত্ব নয়, প্রমাণই শেষ কথা বলে। তাই এই ধরনের জ্ঞান জরুরি। বিজ্ঞানীরা তাই প্রজ্ঞান বা বিক্রম থেকে আসা তথ্যের জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে আছেন।

এখানে একটা বিশেষ তথ্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করি। ভেবে দেখেছেন কেন চাঁদে পৌঁছাতে চন্দ্রযানের এক মাসের বেশি সময় লাগল অথচ নিল আর্মস্ট্রংরা তিন দিনে পৌঁছে গিয়েছিলেন? কারণ সেখানে ব্যবহার হয়েছিল স্যাটার্ন ভি রকেট যাতে জ্বালানি ছিল ২৬৩০ টন। এলভিএম থ্রি-র জ্বালানির পরিমাণ ৩৫০ টন, তা দিয়ে সরাসরি চাঁদে যাওয়া সম্ভব নয়। এই রকেটের আগে নাম ছিল জিএসএলভি থ্রি, চন্দ্রযান-২ তেও এরই ব্যবহার হয়েছিল। জিওসিনক্রোনাস বা ভূসমলয় কক্ষপথ পর্যন্ত ভার বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একে তৈরি করা হয়েছিল, তার উচ্চতা হল পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৩৬,০০০ কিলোমিটার। এর সাহায্যে চন্দ্রযানকে চাঁদের উদ্দেশ্যে পাঠানোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল। এলভিএম থ্রি বেশ কয়েকবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেছে, প্রত্যেকবার যখন পৃথিবীর কাছে এসেছে, পৃথিবীর আকর্ষণকে ব্যবহার করে তার বেগ বাড়ানো হয়েছে। একে বলা হয় গ্র্যভিটি অ্যাসিস্ট, চলতি কথায় স্লিং শট। এভাবে বেগ কমানোও সম্ভব, চাঁদের চারদিকে কক্ষপথে যানকে স্থাপনের জন্য সেটাই করা হয়েছে। সাধারণত দূরে মহাকাশ যান পাঠানোর জন্য এই পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়, কারণ এতে করে অনেকটা জ্বালানি বাঁচানো যায়।নিচের অ্যানিমেশনে বিষয়টা দেখামো হয়েছে। এগুলি Phoenix0777 নির্মিত।





এই সাফল্যের আনন্দের মধ্যেও কয়েকটা কথা বলা প্রয়োজন। কিছুটা সাহায্য পেলেই ভারতীয় বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা নিজেদের চেষ্টাতে কতদূর যেতে পারেন তার উদাহরণ হল চন্দ্র অভিযান। দেশে গবেষণাখাতে বরাদ্দ যখন গত বেশ কয়েক বছর ধরে ক্রমশই কমে আসছে, তখন এই সাফল্য কিছুটা আশা জাগায়। দেশের শিল্প সংস্থা এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এও একটা আশার দিক। কিন্তু আমাদের সরকার চন্দ্রযানের সাফল্য নিতে যতটা আগ্রহী, গবেষণার পিছনে অর্থ বরাদ্দে বোধহয় ততটা নয়। প্রচার মাধ্যমে চন্দ্রযান-এর খরচ কোন সিনেমার থেকে কম তা নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস দেখা গেলেও কীভাবে এই খরচ কমানো গেল তা নিয়ে কারো আগ্রহ দেখা গেল না। ঠিকই যে স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে খরচ কিছুটা কমানো সম্ভব হয়েছে, কিন্তু সেটা একটা অংশ মাত্র। সম্ভবত সমস্ত কারণ আলোচনা করতে গেলে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছুটা সমালোচনা করতে হয়, তাই এই নীরবতা। খরচ কমাতে হয়েছে কারণ বরাদ্দ ছিল না। বিক্রম বা প্রজ্ঞান যদি শীতঘুম থেকে উঠে কাজ করে তা ভালো, কিন্তু তার ব্যবস্থা করা যায় নি। যাঁরা লুনা-২৫-এর খরচের সঙ্গে তুলনা করছেন তাঁরা ভুলে গেছেন যে রাশিয়ার অভিযান যাতে দক্ষিণ মেরুতে অন্তত এক বছর কাজ করতে পারে সেই ব্যবস্থা ছিল। চিনের চ্যাঙ্গি-ফোরের রোভার ও ল্যান্ডার চন্দ্রপৃষ্ঠে চার বছর আটমাস কাজ করে চলেছে, চ্যাঙ্গি-ফাইভ চাঁদ থেকে নমুনা পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে কতটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে আপনি চাইবেন, এবং তার জন্য কত খরচ করতে রাজি আছেন। সংবাদপত্র লিখেছে যে চন্দ্রযান অভিযানের খরচ হয়েছে সাতশো একুশ কোটি টাকা, তার মধ্যে উৎক্ষেপণ রকেটেরই খরচ সাড়ে পাঁচশো কোটি টাকা। সেই প্রযুক্তি ইসরো আগেই আয়ত্ত করেছিল। ইসরোর বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদরা অসাধারণ কাজ করেছেন সন্দেহ নেই, কিন্তু বিনিয়োগ না করলে একটা সীমার পরে এগোনো সম্ভব নয়।

যদি কেউ বলেন আমাদের মতো দেশে এর বেশি অর্থ গবেষণাতে দেওয়া সম্ভব নয়, তাঁদের মনে করিয়ে দিই ইসরো গত ন' বছরে বিভিন্ন দেশ ও বেসরকারি সংস্থার উপগ্রহ তুলে তিন হাজার তিনশো কোটি টাকা আয় করেছে। চন্দ্রযানের সাফল্যের পরে তা বাড়বে সন্দেহ নেই। সেই ইসরোর বাজেট বরাদ্দ ২০২২ সালের ১৩,৭০০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ১০,৫০০ কোটি টাকা। মনে রাখতে হবে এর একটা বড় অংশ গবেষণার খরচ যা ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ। কোনো বিজ্ঞান গবেষণাই সঙ্গে সঙ্গে লাভ দেয় না। উন্নত দেশ দূরে থাক, এমনকি অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশই জিডিপির যে অংশ বিজ্ঞান গবেষণাতে খরচ করে, আমাদের দেশ করে তার থেকে অনেক কম। ফলে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের সংখ্যাও অন্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে আনুপাতিক হারে অনেক কম। সাফল্যের জন্য মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানী প্রযুক্তিবিদদের অভিনন্দন জানাতেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে যে বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে উন্নতি করতে হলে শুধুমাত্র একদিকে মন দিলে চলবে না; প্রয়োজন সার্বিক উন্নয়ন।

চাঁদে অভিযানের জন্য এত খরচ করে আমাদের লাভ কী? বিজ্ঞানের দিক থেকে অনেক লাভই সম্ভব। চাঁদের উল্টোদিকের পিঠে যদি দূরবিন বা রেডিও টেলিস্কোপ বসাতে পারি, তাহলে তা পৃথিবীর যে কোনো টেলিস্কোপের থেকে শক্তিশালী হবে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল অনেক তরঙ্গকে শোষণ করে নেয়, বায়ুতে প্রতিসরণের জন্য অসুবিধা হয়। তাছাড়া শহরের আলো, মোবাইল টিভি রেডিওর সিগন্যাল এগুলো না আটকাতে পারলে টেলিস্কোপের পক্ষে কাজ করা শক্ত। চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই, উল্টো দিকে পৃথিবী থেকে কোনো সিগন্যাল পৌঁছবে না। অভিকর্ষ কম বলে অনেক বড় টেলিস্কোপ বানানো যাবে। চাঁদের বায়ুচাপ প্রায় শূন্য, পৃথিবীতে আমরা অনেক খরচ করে ঐরকম অত্যুচ্চ ভ্যাকুয়াম বানাতে পারি। সার্নের লার্জ হ্যাড্রনিক কোলাইডারের মতো বড় কণাত্বরক বা অ্যাকসিলারেটর চাঁদে বানানো খুব সহজ, বায়ুশূন্য স্থান আলাদা করে বানাতে হবে না, সুপারকন্ডাক্টর তারকে ঠাণ্ডা করার ঝামেলা অনেক কম।

তবে যে সমস্ত কারণে ভবিষ্যতে চাঁদে অভিযানের বা এমনকি স্থায়ী বেস তৈরির খরচা উঠে যেতে পারে তার একটা হল শিল্পোতপাদন। ইলেকট্রনিক্স শিল্পের মতো অনেক শিল্পে বায়ুশূন্য বা ধূলিকণা শূন্য স্থান লাগে, তার জন্য অনেক খরচ করতে হয়। সেগুলো সহজে চাঁদে স্থাপন করা সম্ভব। অপর একটা লাভ হতে পারে শক্তি উৎপাদনে। হিলিয়ামের এক আইসোটোপ আছে হিলিয়াম-৩ যা পৃথিবীতে নেই বললেই চলে। সূর্যে নিউক্লিয় সংযোজন বা ফিউশন প্রক্রিয়াতে শক্তি তৈরি হয়। আমরা হাইড্রোজেন বোমাতে সেই প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়েছি, কিন্তু এখনো তাকে নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে উঠতে পারিনি। তা করতে পারলে অনেক সুবিধা হবে, গ্রিন হাউস গ্যাসের সমস্যা নেই, তেজস্ক্রিয়তার ভয় নেই। ফ্রান্সে এক আন্তর্জাতিক প্রয়াসে ফিউশন রিঅ্যাক্টর বানানো হচ্ছে, আমাদের দেশও তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। পৃথিবীতে হিলিয়াম-৩ পাওয়া গেলে রিঅ্যাক্টর বানানো অনেক সহজ হতোসূর্য থেকে হিলিয়াম-৩ সৌর বায়ুর সঙ্গে বেরিয়ে আসে, কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল তাকে আটকে দেয়। চাঁদের মাটিতে কোটি কোটি বছর ধরে হিলিয়াম-৩ জমা পড়েছে, তাকে তুলে পৃথিবীতে পাঠাতে পারলে খরচ উঠে আসতে পারে।

চাঁদে মানুষ নেমেছে পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল, আমরা কবে চাঁদে থাকতে পারব? কেমন করে চাঁদে বাস করা সম্ভব অল্প কথায় দেখা যাক। প্রথমত, চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই, তাই মহাজাগতিক রশ্মি আর সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিকে আটকানোর কেউ নেই। চাঁদের দিন আর রাত দুটোই পৃথিবীর চোদ্দ দিনের সমান। বায়ুমণ্ডল না থাকার ফলে দিনের তাপমাত্রা উঠে যায় 110 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে আর রাতের তাপমাত্রা নেমে যায় -170 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। দক্ষিণ মেরুতে তা আরো নেমে -230 ডিগ্রি ছোঁয়। ছায়াতে আর রোদে তাপমাত্রার পার্থক্যও হয় বিরাট। এ সবের থেকে বাঁচতে হলে বাস করতে হবে মাটির তলায়। চাঁদে অনেক বিরাট বিরাট লাভা নল আছে, তাদের সিল করে বায়ু ধরে রেখে তার ভিতরেই থাকা যায়। শক্তির অভাব হবে না। অভিকর্ষ পৃথিবীর ছয় ভাগের এক ভাগ, তাই সহজেই বিশাল বিশাল সোলার প্যানেল বসানো সম্ভব। তার জন্য দরকারি সিলিকন চাঁদেই পাওয়া যাবে। জল থেকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাওয়া যাবে। এমনকি কৃত্রিম আলো ব্যবহার করে গাছদের সালোক সংশ্লেষ করানো সম্ভব। আর অনেকরকম পরিকল্পনা করা যায়। মানুষ শেষ চাঁদে নেমেছিল ১৯৭২ সালে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা আবার ২০২৪ সালে চাঁদে মানুষ পাঠাতে এবং ২০২৮ সাল থেকে চাঁদে স্থায়ী বেস বানাতে চাইছে। চিন চাঁদের হিলিয়াম-৩ উত্তোলনের পরিকল্পনা করছে। জাপান ২০৩০ সাল থেকে স্থায়ী ভাবে চাঁদে অভিযাত্রীদল রাখার ব্যাপারে চিন্তা করছে। চন্দ্রযান- আমাদের সেই ক্লাবের সদস্য করার দিকে একধাপ এগিয়ে দিল। 

 

প্রকাশ নিশিত, উৎসব ২০২৩ 

Monday, 13 November 2023

ওপেনহাইমারের তিন ছাত্র

 

ওপেনহাইমারের তিন ছাত্র

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


ক্রিস্টোফার নোলান নির্মিত সিনেমাটির জন্য অনেকেই এখন জে রবার্ট ওপেনহাইমার ও মার্কিন প্রশাসনের সংঘাতের কাহিনি জেনে গেছেন। মার্কিন পরমাণু বোমা প্রকল্প মানহাটান প্রজেক্টের বৈজ্ঞানিক দিকের প্রধান ছিলেন ওপেনহাইমার। জাপানের উপর বোমা ফেলাতেও তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল। যুদ্ধের পরে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা করে পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদ কমানোর কথা বলেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল পরস্পরের সহযোগী, কিন্তু তার পরে শীতল যুদ্ধে তারা হয়ে দাঁড়াল একে অপরের প্রতিপক্ষ। মার্কিন সরকারের কমিউনিজম বিরোধিতার ইতিহাস আমরা জানি, শীতল যুদ্ধের গোড়ার দিকে তা চরমে পৌঁছেছিল। কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা না করেও সেনেটর জোসেফ ম্যাকার্থির উদ্যোগে তৈরি এক কমিটি (House Un-American Activities Committee সংক্ষেপে HUAC) কমিউনিস্টদের খুঁজে বার করে তাদের শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর হয়। হলিউডের প্রায় তিনশো শিল্পী ও কলাকুশলীকে ব্ল্যাকলিস্ট করা হয়, তাঁদের হলিউডে কাজ পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এঁদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন, তিনি দেশ ছাড়েন।

সেই তীব্র সোভিয়েত বিরোধিতার পরিবেশে পারমাণবিক অস্ত্র বিষয়ে ওপেনহাইমারের মতো নেতৃত্বস্থানীয় বিজ্ঞানীর মত প্রশাসনের কাছে প্রায় বিশ্বাসঘাতকতার সমতুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাছাড়া ওপেনহাইমার হাইড্রোজেন বোমা তৈরিরও বিরোধী ছিলেন, তাই অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে তাঁর প্রভাব খর্ব করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সেই কারণে বামপন্থার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নিরাপত্তার বিপদ, এই অভিযোগ আনা হয় এবং শেষ পর্যন্ত অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সঙ্গে তাঁর সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করা হয়।

কখনো কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হলেও উনিশশো তিরিশের দশকে ওপেনহাইমারের সঙ্গে বামপন্থী আন্দোলনের গভীর যোগাযোগ ছিল। তাঁর ঘনিষ্ঠদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য। এই লেখাতে আমরা সেই আলোচনাতে যাব না। তবে মনে রাখতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বামপন্থাকে চিরকালই সন্দেহের চোখে দেখা হয়, সেখানে ওপেনহাইমার ছিলেন বিরল ব্যতিক্রম। তাই তিনি ছিলেন বামপন্থী ছাত্রদের স্বাভাবিক আকর্ষণের কেন্দ্র। তাঁর ছাত্র জিওভান্নি রসি লোমানিজের কথায়, বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় সমস্ত ছাত্রই ছিলেন উদারপন্থী, এবং অনেকেরই বামপন্থী ঝোঁক ছিল।

ওপেনহাইমার যখন পরমাণু বোমা প্রকল্পের দায়িত্ব পান, তিনি তাঁর ছাত্রদের সেই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু সন্দিহান স্বভাবের মার্কিন সামরিকবাহিনির কাছে তাঁদের অনেকেই প্রথম থেকেই ছিলেন না-পছন্দ। ফলে মানাহাটন প্রকল্পের মূল কেন্দ্র লস আলামসে কাজের সুযোগ তাঁদের সামনে আসেনি। ওপেনহাইমার নিজেও পরবর্তীকালে সুরক্ষা বিষয়ক শুনানির সময় তাঁদের কয়েকজনকে বামপন্থী বলে চিহ্নিত করেন, ফলে তাঁদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তবে তাতে করে ওপেনহাইমারও রেহাই পাননি, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে যে জিওভান্নি রসি লোমানিজ, জোসেফ ওয়াইনবার্গ, ডেভিড বোম, ম্যাক্স ফ্রিয়েডমান ও ডেভিড হকিন্স, এঁদের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির যোগাযোগের কথা জেনেও তিনি তাঁদের পরমাণু বোমা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। আরো অভিযোগ আসে যে তাঁর ভাই ফ্রাঙ্ক ও তিনি নিজেও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।

ওপেনহাইমারের বিচার এই প্রবন্ধের আলোচ্য নয়। ওপেনহাইমার শুনানির সময় যাঁদের নাম করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বেশ কয়েকজন তাঁর ছাত্র। এঁদের মধ্যে তিনজনের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য, ঘটনাচক্রে তিনজনই ছিলেন ইহুদি। ওপেনহাইমারের সেই তিন ছাত্রকে নিয়েই এই লেখা।

জিওভান্নি রসি লোমানিজের নাম এই লেখাতে আগে এসেছে, তিনি ছিলেন পোলিশ আমেরিকান। তাঁর বাবা রাশিয়া অধিকৃত পোল্যান্ডের বাসিন্দা, জারের সৈন্যবাহিনিতে বাধ্যতামূলকভাবে যোগ দেওয়ার পরিবর্তে তিনি দেশ ছাড়েন। কিছুদিন ব্রাজিলে কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি আমেরিকাতে কৃষিবিষয়ক রসায়ন বিষয়ে পড়াশোনা করে সেই বিষয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করেছিলেন। জিওভান্নির জন্ম আমেরিকাতে ১৯২১ সালের ১০ অক্টোবর, মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে তিনি স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি ওকলাহামা কলেজে ভর্তি হন। কলেজের পরে তিনি আরো উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বিভিন্ন সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেন। বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বৃত্তি দিয়েছিল, তাই সেখানেই তিনি পড়াশোনা শুরু করেন। এই সময়েই তিনি বার্কলের রেডিয়েশন ল্যাবে ওপেনহাইমারের সংস্পর্শে আসেন। একই সঙ্গে তিনি আর্নেস্ট লরেন্সের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। দুজনেই তাঁকে পরমাণু বোমা সংক্রান্ত কাজে যুক্ত করেছিলেন।

লোমানিজের স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল বামপন্থার দিকে। বার্কলের রেডিয়েশন ল্যাবে তিনি ফেডারেশন অফ আর্কিটেক্টস ইঞ্জিনিয়ার্স, কেমিস্টস এন্ড টেকনিশিয়ান্‌স (FAECT)-এর এক শাখা গঠন করেছিলেন। কার্যক্ষেত্রে ইউনিয়ন করার অধিকার দিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এক আইন করেছিলেন, অথচ সেই রাষ্ট্রপতির অফিস থেকেই নির্দেশ যায় যে কোনোভাবে এই ইউনিয়নকে বন্ধ করতে হবে। ইউনিয়ন ভাঙার লক্ষ্য নিয়ে লোমানিজকে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য হিসাবে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। লরেন্স ও ওপেনহাইমার দুজনেই আলাদা আলাদা চিঠিতে পরমাণু বোমা প্রকল্পে লোমানিজের গুরুত্বের কথা বলে তাঁকে ছাড় দেওয়ার অনুরোধ করেন, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বহু বছর পরে যখন মার্কিন আইন অনুসারে গোপন কাগজপত্র প্রকাশ্যে আসে, তখন লোমানিজ দেখেন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়ো অভিযোগ আনা হয়েছিল। ওপেনহাইমার ও লরেন্স সুপারিশ করেছিলেন সৈন্যবাহিনি যেন তাঁর বিশেষ জ্ঞানের সাহায্য নেয়, কিন্তু সেই চেষ্টা হয়নি। তাঁর উপর আলাদা করে নজর রাখা হয়েছিল; দু'বার তাঁর ডিভিশনকে ইউরোপে যুদ্ধে পাঠানো হলেও তাঁকে বদলি করে আমেরিকাতেই রেখে দেওয়া হয়।

১৯৪৩ সালেই ওপেনহাইমার মার্কিন সৈন্যবাহিনির গোয়েন্দাদের জানিয়েছিলেন যে লোমানিজ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, তবে তিনি তাঁর সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করবেন। ১৯৫৪ সালে শুনানির সময় তিনি সম্পূর্ণ ঘুরে গিয়ে বলেন যে তিনি যদি জানতেন লোমানিজ পার্টিসদস্য, তাহলে তিনি এই চিঠি লিখতেন না। যুদ্ধের পরে লোমানিজ কিছুদিন বার্কলেতে কাজ করার পরে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট করার সুযোগ পান, ওপেনহাইমার তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। সেখানে তিনি কিংবদন্তী পদার্থবিদ রিচার্ড ফেইনম্যানের কাছে গবেষণা করেছিলেন। ১৯৪৯ সাল নাগাদ তিনি ফিস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর চাকরি পান। কিন্তু তারপরেই তাঁকে HUAC-এর সামনে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়। পরে ওপেনহাইমারের আর এক ছাত্র ডেভিড বোমের কথা আসবে, প্রায় একই সময় তাঁকেও ডেকে পাঠানো হয়েছিল। তাঁরা দুজনে ওপেনহাইমারের সঙ্গে দেখা করেন। লোমানিজ বলেছেন যে ওপেনহাইমার ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন।

লোমানিজের নিজের কথায়, সেই সময় যাঁরা সরকারী নীতির বিরোধিতা করতেন, কিংবা শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বিভেদ দূর করার বা কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নতির বলতেন, প্রশাসন তাঁদের কমিউনিস্ট বলে চিহ্নিত করত। কমিউনিজম হয়ে দাঁড়িয়েছিল মূল শত্রু। মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। হলিউডের কয়েকজন চিত্রনাট্যকারকে যখন HUAC-এর সামনে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়, তাঁরা সংবিধানের সেই ধারার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে তাঁরা নিজেদের বক্তব্য প্রকাশ করেছেন, মার্কিন কংগ্রেসের সেই নিয়ে প্রশ্ন করার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি, কংগ্রেসকে অবজ্ঞা করার অভিযোগে তাঁদের কারাদণ্ড হয়েছিল। লোমানিজকে কমিটি প্রশ্ন করেছিল তিনি নিজে কি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বা তিনি কি কোনো সদস্যকে চেনেন? লোমানিজের ইচ্ছা ছিল নিজের সমর্থনে প্রথম সংশোধনীকে ব্যবহার করার, কিন্তু চিত্রনাট্যকারদের কথা মনে রেখে তিনি পঞ্চম সংশোধনী ব্যবহার করেন। সেই সংশোধনীতে বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। তাঁর বিরুদ্ধে গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগ বা বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনা হয়েছিল, তিনি তীব্রভাবে তা অস্বীকার করেন।

প্রথমবার শুনানির পরেই ফিস্ক বিশ্ববিদ্যালয় লোমানিজকে বরখাস্ত করে। লোমানিজের স্ত্রী একটা সামান্য কাজ শুর করেন, লোমানিজ নিজে ইউনিয়নে নাম লিখিয়ে ট্রাক চালানোর কাজ নেন। সেই কাজও একসময় চলে যায়। লোমানিজ আবার কর্নেলে ফিরে থিসিসের কাজ শেষ করেন। তাঁর থিসিসের শেষ বাক্যটি ছিল, “The author is also very glad that no money channeled through the Army or Navy was required to finance this work.” ফেইনম্যান আপত্তি করেননি।

এরপরে কংগ্রেসকে অবজ্ঞা করার অভিযোগে লোমানিজের বিচার হয়। ওয়াশিংটনে বিচার, টাকা ধার করে তাঁকে সেখানে যেতে হয়। উকিলের পয়সা তাঁর ছিল না, বিনা পয়সায় কেউ তাঁর কেস নিতে রাজি হচ্ছিল না। একই সঙ্গে ডেভিড বোমেরও বিচার হচ্ছিল, তাঁর নিযুক্ত উকিল শেষ পর্যন্ত লোমানিজের পক্ষে দাঁড়ান। বিচারে দুজনেই মুক্তি পান।

এরপরে কয়েক বছর লোমানিজকে জীবনের জন্য সংগ্রাম করতে হয়। কখনো ট্রাক চালিয়েছেন, কখনো রঙের কারখানা, ব্যাগ সেলাইয়ের কারখানা বা রেললাইন মেরামতির শ্রমিকের কাজ করেছেন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছিল বলে রঙের কারখানার মালিক তাঁকে ছাঁটাই করেন। চার বছর তাঁর থাকার কোনো জায়গা ছিল না, তিনি ও তাঁর স্ত্রী প্যাকিংবাক্সের কাঠ দিয়ে একটা ঘর বানিয়ে সেখানে থাকতে বাধ্য হন, সেখানে জল বা বিদ্যুতের প্রশ্নই ওঠে না। অবশেষে ১৯৬০ সালে তিনি এক কলেজে পড়ানোর চাকরি পান। দু' বছর পরে নিউ মেক্সিকো টেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি চাকরি নেন। ১৯৯১ সালে অবসর নেওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। ৩১ ডিসেম্বর ২০০২ তাঁর মৃত্যু হয়।

লোমানিজ বা তাঁর মতো কয়েকজন এই বিরূপ পরিস্থিতিতেও দেশ ছাড়েননি। অনেক পরে চাকরি তাঁরা পেয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবে তাদের গবেষক জীবনের ইতি ঘটেছিল। এর পরে যে দুজনের কথা বলব তাঁরা দেওয়ালের লিখন পড়তে পেরেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই বুঝে তাঁরা দেশ ছাড়েন। তাঁদের একজন ভারতে প্রায় আট বছর কাটিয়েছিলেন, তাঁর নাম বার্নার্ড পিটার্স।

দেশত্যাগ অবশ্য পিটার্সের কাছে নতুন নয়। তাঁর আসল নাম বার্নার্ড পিয়েত্রোভস্কি। তাঁর জন্ম ১৯১০ সালে জার্মানি অধিকৃত পোল্যান্ডে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে খাদ্যাভাবের সময় তাঁর বাবা তাঁকে ব্ল্যাক ফরেস্টে এই চাষীর কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখানে বালক বার্নার্ড ভেড়া চরাতেন এবং ক্ষেতের ছোটখাটো কাজ করতেন, বিনিময়ে খেতে পেতেন। বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরে তিনি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে তিনি মিউনিখ টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করেন, সে বছরই হিটলার ক্ষমতায় আসেন। বার্নার্ড ছাত্রদের মধ্যে নাৎসিবিরোধী প্রচার করতেন, সেজন্য নাৎসিদের ক্ষমতা দখলের কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁকে গ্রেপ্তার করে দাচাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। তিন মাস পরে বার্নার্ড সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন। পুলিশকে এড়িয়ে এক সাইকেল সম্বল করে আল্পস পর্বতমালা পার হয়ে তিনি ইতালিতে যান। সেখানে পদুয়াতে তাঁর বান্ধবী হান্না লিলিয়ান সেই সময় ডাক্তারি পড়ছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করার পরে বার্নার্ড ইংল্যান্ডে যান। ১৯৩৪ সালে তিনি যান আমেরিকা, সেখানে হান্না তাঁর সঙ্গে যোগ দেন ও তাঁরা বিয়ে করেন।

ইতিমধ্যে পিয়েত্রোভস্কি হয়েছেন পিটার্স। তিনি আমেরিকাতে এক আমদানি কোম্পানিতে কাজ করছিলেন। ১৯৩৭ সালে হান্না ডাক্তারি পড়াশোনা শেষ করার পরেই তিনি চাকরি ছাড়েন। দুজন মিলে সানফ্রান্সিস্কোতে যান, হান্না সেখানে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারে কাজ নেন। বার্নার্ড বন্দরে শ্রমিক হিসাবে কাজ শুরু করেন। পরের বছর হান্নার সূত্রে বার্নার্ডের সঙ্গে ওপেনহাইমারের আলাপ হয়, ওপেনহাইমার তাঁকে পদার্থবিজ্ঞান পড়তে উৎসাহিত করেন। তিনি বার্কলেতে ভর্তি হন এবং ওপেনহাইমারের সঙ্গেই কাজ করে ডক্টরেট করেন। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট করলেও এর পর তিনি লরেন্সের সঙ্গে পরীক্ষামূলক বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। পরের তিন বছর তিনি মূলত পরমাণু বোমা প্রকল্পের কাজেই যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করেন। এই সময় তিনি কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং সেই বিষয়ে প্রথম সারির বিশেষজ্ঞ হিসাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃত হন।

বার্নার্ড পিটার্স বার্কলেতে FAECT-এর সদস্য হয়েছিলেন। লোমানিজ বা বোমের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। সেটাই তাঁর বিপক্ষে অনুসন্ধানের জন্য যথেষ্ট কারণ বিবেচিত হয়েছিল। ওপেনহাইমার একবার মার্কিন গোয়েন্দাকে বলেছিলেন পিটার্স ‘very red’, ১৯৪৯ সালে গোপন শুনানির সময় তিনি আবার বলেন যে বার্নার্ড কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, 'a dangerous man and quite red’ । তার যুক্তি হিসাবে তিনি বলেন যে পিটার্স জার্মানিতে নাৎসিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন ও দাচাউ থেকে পালিয়েছিলেন! গোপন শুনানি হলেও সেই খবর কাগজে বেরিয়ে যায়। পিটার্স কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেন। তাতে কোনো কাজ হয়নি, রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বরখাস্ত করে। আমেরিকাতে কাজ পাওয়ার সুযোগ তাঁর সামনে বন্ধ হয়ে যায়।

হোমি ভাভার সঙ্গে পিটার্স গবেষণা করেছিলেন, ভাভা তাঁকে ভারতে নবনির্মিত টাটা ইন্সটিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে আমন্ত্রণ জানান। পিটার্স আট বছর বম্বেতে ছিলেন, টাটা ইন্সটিটিউটের মহাজাগতিক রশ্মি সংক্রান্ত গবেষণা তাঁর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছায়। তাঁর কাজের স্বীকৃতিতে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে। এর পরে তিনি কোপেনহাগেনে নিল্‌স বোর ইন্সটিটিউট অফ থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সে যোগ দেন। কয়েক বছর পরে তিনি ডেনমার্কের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের অধিকর্তা হয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।

সব শেষে আসি ডেভিড বোমের কথায়। বোমের জন্ম আমেরিকার পেনসিলভেনিয়াতে ১৯১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর। তাঁরা বাবা স্যামুয়েল ছিলেন হাঙ্গারিয়ান ইহুদি, আমেরিকাতে এসে তিনি আসবাবপত্রের ব্যাবসা শুরু করেছিলেন। মা ছিলেন লিথুনিয়ান ইহুদি। তাঁর বাড়িতে ইহুদি রীতিনীতি মেনে চলা হত, কিন্তু বোম তরুণ বয়সেই অজ্ঞেয়বাদী হয়ে যান। পেনসিলভেনিয়া কলেজে পড়াশোনার পরে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে এক বছর কাটান। তার পরে বার্কলেতে রবার্ট ওপেনহাইমারের সঙ্গে কাজ শুরু করেছিলেন। মহামন্দার সময় তাঁর শহরে খনিশ্রমিকদের দুর্দশা দেখে তিনি আগেই প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়েছিলেন। তিনি অল্পদিনের জন্য আমেরিকান কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হয়েছিলেন। তাঁর নিজের কথায়, ইহুদিদের উপর নাৎসিদের অত্যাচারের কথা জানতে পেরে তিনি বুঝেছিলেন যে কমিউনিস্টরা নাৎসিদের প্রকৃত বিরোধী। তবে তিনি স্ট্যালিনের কার্যকলাপকে সমর্থন করতেন না।

ওপেনহাইমার বোমকে লস আলামসে মানহাটান প্রকল্পে যোগ দেওয়ার জন্য বলেছিলেন, কিন্তু কমিউনিস্ট যোগাযোগের জন্য তাঁকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। এদিকে যে গবেষণা তিনি ডক্টরেটের জন্য করছিলেন, পরমাণু বোমাতে তার গুরুত্ব থাকায় তাকে গোপনীয় বলে ঘোষণা করা হয়। ফলে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যেখানে বোমের পক্ষে থিসিস লেখা বা তার জন্য পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে না। শেষকালে থিসিস ছাড়াই ওপেনহাইমারের সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়। বোমের অন্য এক কাজও পরমাণু বোমা তৈরিতে লেগেছিল। যুদ্ধের পরে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন, সেই সময়ে আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়েছিল।

বোমকে ওপেনহাইমারের সুরক্ষা শুনানিতে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়েছিল, কিন্তু মার্কিন সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর উল্লেখ করে তিনিও সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন, তাঁর সহকর্মীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতেও তিনি রাজি হননি। সেই জন্য ১৯৫০ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, অবশ্য তিনি জামিনে ছাড়া পান। আগেই বলেছি যে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ার জন্য পরের বছর তিনি অভিযোগ থেকে মুক্ত পান। ইতিমধ্যে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বরখাস্ত করে, মুক্তি পাওয়ার পরেও তাঁকে আর নিয়োগ করা হয়নি। আইনস্টাইন তাঁকে সহকারী নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ওপেনহাইমার তাঁকে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেন। তার কারণ ওপেনহাইমার জানতেন যে সুরক্ষা শুনানিতে তিনি বোমের নামে অভিযোগ এনেছেন, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর কাজ পাওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া ওপেনহাইমার অনুমান করেছিলেন যে অনতিবিলম্বেই তিনিও অভিযুক্ত হবেন, বোমের প্রিন্সটনে থাকা তাঁর বিরুদ্ধে যাবে। আইনস্টাইন ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তাঁর জন্য সুপারিশ করেছিলেন, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি ব্রাজিলে সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পান।

১৯৫১ সালে ব্রাজিলে যাওয়ার পরে সে দেশের মার্কিন কনসাল তাঁর পাসপোর্ট বাজোয়াপ্ত করেন যাতে তিনি ব্রাজিল থেকে আমেরিকা ছাড়া অন্য কোথাও না যেতে পারেন। এটা ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। বাধ্য হয়ে বোম ব্রাজিলের নাগরিকত্ব নেন। মাঝে দু’ বছর ইজরায়েলে কাটিয়ে ১৯৫৭ সালে তিনি ব্রিটেনের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসাবে যোগ দেন। ইতিমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে হাঙ্গারিতে আন্দোলন দমন করেছিল তার সঙ্গে একমত হতে না পেরে তিনি মার্ক্সবাদে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৮৭ তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন। ১৯৯২ সালের ২৭ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়।

তিন ছাত্রের মধ্যে বোমই পরবর্তীকালে বিজ্ঞানে সব থেকে বেশি অবদান রেখেছেন। বিজ্ঞান আলোচনার সুযোগ এই নিবন্ধে নেই, খুব সংক্ষেপে কয়েকটা কথা বলি। আইনস্টাইনের সঙ্গে প্রিন্সটনে আলোচনার সময়েই বোম কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তাৎপর্য নিয়ে আগ্রহী হয়েছিলেন। তিনি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। খুব কম বিজ্ঞানীই প্রথম প্রথম সেই ব্যাখ্যাতে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, এমনকি আইনস্টাইনও একমত হতে পারেননি। কিন্তু পরবর্তীকালে জন স্টুয়ার্ট বেল তাঁর লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন এবং এক অসমীকরণের প্রস্তাব করেন। সেই বিষয়ে পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণের জন্য তিন বিজ্ঞানীকে ২০২২ সালে পদার্থবিদ্যার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। বর্তমান বোমের তত্ত্ব সাধারণভাবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম ব্যাখ্যা হিসাবে স্বীকৃত।

এই তিনজন ছাড়াও ডেভিড হকিন্স, মাক্স ফ্রিয়েডমান, জোসেফ ওয়াইনবার্গ, ফিলিপ মরিসন বা ডেভিড ফক্সের মতো পরমাণু বোমা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীদের নাম করা যেতে পারে যাঁরা আমেরিকান প্রশাসনের বিরাগভাজন হয়েছেন, জেল খেটেছেন বা চাকরি হারিয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন ওপেনহাইমারের ছাত্র। সকলের কথা আলাদা করে বলার হয়তো প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে পিটার্সের বিষয়ে ওপেনহাইমারের আচরণ সহকর্মীদের কাছে অপ্রত্যাশিত লেগেছিল। ওপেনহাইমারকে লেখা এক চিঠিতে তাঁর সহযোগী ভিক্টর ভাইসকফ লিখেছিলেন যে পিটার্সই রাজনৈতিক মতের জন্য চাকরি হারানো প্রথম বিজ্ঞানী নন, কিন্তু কোনো বিজ্ঞানীর অভিযোগের জন্য চাকরি হারানো বিজ্ঞানী হিসাবে তিনিই প্রথম। শুধু ভাইসকফ নয়, হান্স বেথে, ফ্রাঙ্ক কন্ডনের মতো বিজ্ঞানীরাও এই ঘটনার পরে ওপেনহাইমারকে চিঠি লিখে তাঁর কাজের নিন্দা করেছিলেন ও যে কোনো মূল্যে সমস্যার সমাধানের কথা বলেন। ওপেনহাইমার পিটার্সের কাছে তাঁর ভুল স্বীকার করেন ও প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। সব থেকে বড় কথা হল যে যারা মার্কিন সৈন্যবাহিনির হাতে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র তুলে দিয়েছিল, তাদের কয়েকজনের উপরেই শাস্তি নেমে এসেছিল; ওপেনহাইমার নিজেও রেহাই পাননি।


তথ্যসূত্র

  • Interview of G. Rossi Lomanitz by Shawn Mullet, Niels Bohr Library & Archives, American Institute of Physics, College Park, MD USA

  • Interview of David Bohm by Maurice Wilkins, Niels Bohr Library & Archives, American Institute of Physics, College Park, MD USA

  • Brighter than a Thousand Suns, Robert Junk, Mariner Books, 1970

  • Robert Oppenhreimer: A Life from Begining to End, Hourly History, 2002

  • In the Shadow of the Bomb: Oppenheimer, Bethe and Moral Responsibility of the Scientist, S.S. Schweber, Princeton University Press, 2020

     

    সৃষ্টির একুশ শতক পত্রিকার ২০২৩ উৎসব সংখ্যায় প্রকাশিত